Monday, December 31

প্রবন্ধ : মহম্মদ লতিফ হোসেন





 ‘ছোটোগল্প: নূতন রীতি’ এবং বিমল করের ‘গগনের অসুখ’
-
‘ছোটোগল্প: নূতন রীতি’ বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে যে প্রশ্নটি আমাদের সর্বাগ্রে ভাবিয়ে তোলে সেটা হল- এই নূতন রীতি কি বাংলা সাহিত্য আন্দোলনের কোনও আভাগার্দধর্মী প্রয়াস ? প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতিষ্ঠান বিরোধীদের দ্বন্দ্বটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানে থেকে প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করবার সাহসটিই নতুন। আর এই সাহসটিই দেখাতে পেরেছিলেন বিমল কর। আলোচনার শুরুতেই তাঁকে তথাকথিত প্রতিষ্ঠানের ভেতরে রেখে দেখতে চাইলাম তার কারণ ১৯৪২ থেকে ১৯৯৭- এর সময়কালে তাঁর রচিত প্রায় ২০০টি গল্পের মাত্র ৩৩টি লিটল ম্যাগে প্রকাশিত হয়েছিল, বাকি সব গল্পই বড় পত্রিকা তথা বাণিজ্যিক কাগজে জায়গা নিয়েছে। কাজেই সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে তাঁকে তথাকথিত প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় কর্মী বলতেই হয়। কিন্তু একজন সক্রিয় কর্মীর এহেন বিপ্লব কি প্রতিষ্ঠানের নিয়মতান্ত্রিকতাকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করায় না ? বিমল কর এই প্রশ্নটিকেই তুলতে পেরেছিলেন। আর পেরেছিলেন বলেই  ‘ছোটোগল্প: নূতন রীতি’(১৯৫৮-১৯৫৯) হয়ে উঠেছে ছোটোগল্পের তথাকথিত নিয়মতান্ত্রিক নীতিবাদী শুদ্ধতার বিরুদ্ধে এক তীব্র জেহাদ।

   প্রতিটি শিল্পীই জীবনের একটি পর্যায়ে এসে নিজেকে, নিজের সৃষ্টিকে ভেঙ্গে-চুরে দেখতে চান। নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে যাচাই করে নিতে চান। ‘ছোটোগল্প:নূতনরীতি’–এরমাধ্যমে বিমল করও হয়ত সেই experiment-ই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বুঝতে হবে তাঁর এই প্রয়াস শুধু নিজেকে যাচাই করবার জন্য নয়, বরং শতবর্ষ অতিক্রান্ত সমগ্র বাংলা ছোটোগল্পের জগতকেই তিনি পরীক্ষাগারে ঊল্টে-পাল্টে দেখতে চেয়েছিলেন। সেই হিসেবে একে বলতেইহয়-এ যেন বাংলা ছোটোগল্পের এক অনন্য অবিনির্মাণ (deconstruction)। ফার্দিনান্দ দ্য স্যসুর বলেছিলেন- ‘deconstruction is also a construction’। সে দিক থেকে ছোটোগল্পের নতুন রীতিও বাংলা ছোটো গল্পের জগতে একটি নতুনconstruction নয় কি ?

 ছোটোগল্প একজন মননপ্রধান লেখকের আত্মপ্রকাশের তীব্রতম বাহন –এ সত্য বিমল করের গল্পে প্রতিষ্ঠিত। গল্পপত্র পত্রিকা পরিচালনায় বা তরুণ গল্পকারদের গল্প সংকলনে বিমল করের যে সচেতন শিল্পবোধ ও অতৃপ্ত জীবন জিজ্ঞাসার পরিচয় পাওয়া যায়, আমরা বলতে পারি তাঁর গল্পগুলি তারই জীবন্ত চালচিত্র হয়ে উঠেছে।১ ‘আত্মজা’, ‘উদ্ভিদ’, ‘সোপান’, ‘পিঙ্গলার প্রেম’, ‘জননী’, ‘সুধাময়’, ‘ইঁদুর’ এমনকিআমাদের আলোচ্য ‘গগনের অসুখ’ গল্পটিও এ ধারার উজ্জ্বল সংযোজন। গল্পগুলি যেমন প্রেম, সমাজসত্য, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের এবং মনোজগতের তীব্র বিশ্লেষণে তৎপর তেমনি ভাষা ও আঙ্গিকের নিত্যনতুন ব্যবহারেও অনন্য।

‘গগনের অসুখ’ আখ্যানটি ধারণ করেছিল শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকাঅক্টোবর, ১৯৬২। সময়কালটির দিকে লক্ষ রাখলে বোঝা যাবে তার মাত্র তিন বছর আগেই ১৯৫৮-৫৯ সালে ছোটোগল্পের নতুন রীতির propaganda প্রকাশিত হয়েছিল, যার প্রধান manifesto-ই ছিল-
আমরা আমাদের মনোমত করে গল্প লিখতে চাই, যে লেখা সাধারণত চলতি পত্রিকা গুলির পক্ষে ছাপা সর্বদা সম্ভব নয়।



লক্ষ করবার বিষয় এটাই যে প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকায় ছাপানো অসম্ভবের দোহাই দিয়ে যে গল্প আন্দোলনের সূচনা, ‘গগনের অসুখ’ গল্পটি কিন্তু সেই প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল। কাজেই প্রশ্ন উঠতে পারে নতুন রীতির আন্দোলনের প্রভাব কি তবে ‘গগনের অসুখ’ গল্পে পড়েনি ? আমরা বলতে পারি পড়েছে, কিন্তু তা খানিকটা তির্যকভাবে। আসলে নিজেদের মনোমত করে গল্প লেখবার যে উদ্যম ও সক্রিয়তা নতুন রীতি আন্দোলনের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছিল, ‘গগনের অসুখ’ সেই তল থেকেই উঠে এসেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলতে হয়, এই নতুন রীতির আলোকেআমরা যেভাবে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘দুঃস্বপ্ন’ কিংবা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিজনের রক্তমাংস’ –কে পাঠ করি, ‘গগনের অসুখ’-কে কিন্তু সেই একই সমতলে রেখে পড়তে পারি না। ‘গগনের অসুখ’ গল্পে ‘অসুখ’ কথাটিতে যদি আমরা জোর দেই তাহলে বলতেই পারি এই অসুখ আসলে সমাজে বসবাসকারী অথচ সমাজ বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ মানুষের একান্তই ব্যক্তিগত মানসিক অসুখ। গগনের যে অসুখ তা হয়ত শারীরিক সেই সাথে মানসিকও। লেখক কোনও স্পষ্ট চিহ্নিত অসুখের নাম উচ্চারণ করেন নি। কিন্তু প্রশ্ন উঠতেই পারে কি এমন অসুখ যা গগনকে তার পরিবার থেকে, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় ? লেখক কেনই বা তার নাম উচ্চারণ করেন না ? এখানেই হয়ত external reality–কে ছোটো করেinternal reality–এর ক্ষেত্রটিই বড় হয়ে ওঠে, যেখানে লুকিয়ে আছে ‘ছোটোগল্প: নূতন রীতি’ আন্দোলনের অন্যতম বীজটি।

   গগনের অসুখ গগনকে ভারাক্রান্ত করেছে। তার মধ্যে অভিমান আছে, রাগ আছে। এ রাগ, এ অভিমান তার অভ্যস্থ কুলিশ কঠোর জীবনযাত্রার প্রতি। যে জীবনযাত্রায় শীত, বাতাস, অন্ধকার কিংবা বিষন্নতা আত্মীয়ের মতো তার সাথে সহাবস্থান করে। কিন্তু এর বাইরেও তার মধ্যে আশাবাদী মনোভাবও সুপ্ত আছে। এ আশা নিঃসঙ্গ জীবনকে অতিক্রম করে সমাজ জীবনে প্রবেশ করবার আশা। কিন্তু বাস্তবে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা অতিক্রান্ত হলেও গগনের আর পারিবারিক জীবনে ফিরে আসা হয়না। সে কেবলই ভেবে চলে –
নয়নরা থাকলে...তার গগন এত শূন্য হত না।


আসলে বাহ্যিক ঘটনার ঘনঘটা নয়, লেখকের অন্তর্লীন ভাবের বহিঃপ্রকাশের মধ্য দিয়েও এখানে ছোটোগল্পের চিরাচরিত কাহিনি সর্বস্বতাকে অস্বীকার করবার ক্ষেত্রটি তৈরি হয়েছে। হয়তো কথকের মুখ থেকেই তাই শুনতে পাই –
বাইরে হাত বাড়ান গেলনা বলেই গগন ভেতরে হাত রাখল।


মনের ভেতরের এই রহস্যকেই আলো ফেলে নতুন ভাবে দেখতে সক্ষম হয়েছিল নতুন রীতির লেখকেরা।

 ১৯৯০ সালে দেশ পত্রিকার একটি সাক্ষাৎকারে বিমল কর বলেছিলেন –
শুধু গল্পের জন্য গল্প তো আমি লিখতে চাইনা। যদি তেমন কোনও কথা আমার নতুনভাবে না জোটে, অকারণ মামুলী গল্প লিখে কী লাভ ?


‘গগনের অসুখ’ কিন্তু মামুলী কোনও গল্প নয়। শুধু গল্পের জন্য গল্প লিখবার প্রয়াসেও এটি লেখা হয়নি। এখানেও অনেক নাবলা কথাকে বলতে চাওয়ার সদিচ্ছা আছে, implied author -এর সাথে implied reader–এর যোগসূত্র স্থাপনের কৌশল আছে। লক্ষ করবার বিষয় এখানে আদি-মধ্য-অন্ত্য সমন্বিত কোনও কাহিনি নেই, ‘মধুরেণ সমাপায়েৎ’-এর মধ্য দিয়ে যার পরিণতি ঘটছে। বরং গল্পের শেষে এক রাশ প্রশ্ন আর অনিশ্চয়তা পাঠককে গ্রাস করেছে। এই গল্পটি শেষ অবধি  প্রতিবেদনধর্মী কোনও রচনা হয়ে থাকেনি। বরং থিসিস-অ্যান্টিথিসিসকে অতিক্রম করে এর প্লট সিন্থেসিসের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।

গল্পটিতে যেহেতু সরাসরি কোনও কাহিনি নেই, কাজেই এর মধ্যে কাহিনি এবং না-কাহিনির একটাbinary opposition আছে। গগন এবং তার মামার কথপোকথনের মধ্য দিয়েই পাঠককে বাহ্যিক গল্পের বুনটটি তৈরি করে নিতে হয়। এখানেই তৈরি হয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রকৃত ক্ষেত্রটি। গগনের মধ্যে এক প্রকার stream of consciousness আছে, পাশাপাশি উক্তি-প্রতুক্তির মধ্য দিয়ে একটি সমান্তরাল গতিমুখও এখানে তৈরি হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে ধূর্জটি প্রসাদ, সতীনাথ ভাদুড়ী কিংবা গোপাল হালদার প্রমুখেরা আমাদের চৈতন্যপ্রবাহ রীতি উপহার দিয়েছেন ঠিকই, বিমল কর ছোটোগল্পের জগতে সেই রীতিকেই কিছুটা তির্যক উপস্থাপন করবার চেষ্টা করলেন। ‘গগনের অসুখ’ তাই কেবল গগনের চৈতন্যপ্রবাহতেই নয়, পাশাপাশি পার্শ্বচরিত্রের সক্রিয়তাতেও অগ্রগতি লাভ করেছে। এখানেই চরিত্র নির্মাণের pattern-টিও নতুনত্ব লাভ করেছে। গল্পে কোনও ফরওয়ার্ডব্যাক নেই কিন্তু ফ্ল্যাশব্যাক আছে। একাধিক চিঠির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে লেখক বর্তমান থেকে অতীতে, আবার অতীত থেকে বর্তমানেযাত্রা করেছেন। পাশাপাশি রয়েছে আলো-অন্ধকারের বিচিত্র চিত্রকল্প, নিশ্চিত মৃত্যুর হাতছানি। একদিকে অমোঘ মৃত্যু অন্যদিকে গভীর জীবনবোধের এই দ্বন্দ্বকে কোনও নির্দিষ্ট তত্ত্ব ও দর্শন দ্বারা ব্যাখ্যাকরা সম্ভব নয়। অন্যদিকে ‘অথরসপোরশন’- এর ভাষা কোথাও অমসৃণ, কোথাও তীক্ষ্ণ বলে মনে হলেও বাক্য গঠনে কিংবা শব্দচয়নে যে কোনও মোলায়েম ভাব নেই -একথা বলা চলেনা।প্রত্যক্ষতা- স্পষ্টতার পাশে জীবনের অনিশ্চয়তা ও অনির্দেশ্যতা বোধক দিকটিকেও লেখক বিভিন্ন শব্দে হাজির করেছেন–
অন্ধকারে গগন চোখের পাতা খুলল। বাইরে অন্ধকার নেমেছে। কাঁঠাল গাছের মতন বেশ ঘন বুনন্ত অন্ধকার। বাতাস আসছিল, অগ্রহায়নের ঠাণ্ডা বাতাস। মিহি কুয়াশার মতন ধোঁয়ার রেখা দেখা যাচ্ছে অদূরে। গগনের শীত করছিল। কাছাকাছি একটা দেবালয় আছে, ঘণ্টা বাজছিল। গগন আকাশে কয়েকটি তারা দেখতে দেখতে দেবালয়ের ঘণ্টা শুনল। প্রতিটি ঘণ্টা এমন করে বাজে যেন পায়ে পায়ে শব্দটা ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে। গগন ভাবল, তার মনে হল, সে বোধহয় প্রত্যহ দূর থেকে দূরান্তে সরে যাচ্ছে।


ছোটোগল্পের ‘ছোটো’ হওয়া নিয়ে যে বিতর্ক আছে, অর্থাৎছোটোগল্পকে ছোটো এবং গল্প হতে হবে, যার প্রধান শর্তই হল- যাকে এক দফায় পড়ে ফেলতে হবে, ইংরেজিতে যাকে বলে  ‘ইন ওয়ান সীটিং’..

৭,’গগনের অসুখ’-কে কেন্দ্র করে এ জাতীয় কোনও প্রশ্ন ওঠা সম্ভব নয়। কারণ readership–এর দায়িত্ব যদি অটুট থাকে তবে গল্পটিকে নিঃসন্দেহে এক দফায় পড়ে ফেলা সম্ভব। এজন্যলেখককে suspense, surprise কিংবা stunt তৈরির কোনও কৃত্রিম ছলনার বশবর্তীও হতে হয়নি। গীতি কবিতার মতই গল্পটি স্বতঃস্ফুর্ত অন্তর্লীন ভাবনার দ্যোতক হয়ে উঠেছে।

কনজিউমারিজমের যুগে ‘cultural industry’ নামক প্রতিষ্ঠানটি সাহিত্যকেও পণ্যে রূপান্তরিত করেছে। আর পাঁচটি বিজ্ঞাপিত পণ্যের মত সাহিত্যও আজ ‘মাল’ হয়ে উঠেছে। প্রতিষ্ঠানের ‘পা চাটা’ ফরমায়েশি লেখকদের সৃষ্টি তেমন শিল্প-উৎকর্ষহয়ে উঠতে পারছেনা। বিমল কর তাঁর ‘ছোটোগল্প নূতন রীতি’-র মাধ্যমে যেন এর বিরুদ্ধেই গর্জে উঠেছিলেন। এ প্রতিবাদ আসলে  কনজিউমারিজমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, তথাকথিত ‘মাল আমদানি’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ‘সমাজ’কে যদি একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ধরা যায়, ‘পরিবার’-কে যদি বলা হয় সেই সমাজের ক্ষুদ্রতম একক তবে আমরা লক্ষ করব গগনের অবস্থান সেই পরিবার তথা সমাজের বাইরে। অর্থাৎ ‘পরিবার’ নামক প্রতিষ্ঠানের বাইরে গিয়ে সে ক্রমশindividuality–এর দিকে যাত্রা করেছে। কথকের মুখেই তাই শুনতে পাই –
গগন ভাবল, তার মনে হল, সে বোধ হয় প্রত্যহ দূর থেকে দূরান্তে সরে যাচ্ছে।


পাশ্চাত্য শিল্প-সাহিত্যের ধ্যান-ধারণাগুলির যে দ্রুত পরিবর্তনঘটছিল কাফকা তাকে এভাবে ধরতে চেয়েছিলেন –
বালজাক একটা ছড়ি নিয়ে ঘুরতেন। সেই ছড়ির গায়ে খোদাই করা ছিল একটি বাক্য। সেটি হল- আমি প্রতিটি বাধাই চূর্ণ-বিচূর্ণ করি। আমারও একটি প্রবাদবাক্য আছে। তা হল- প্রতিটি বাধাই আমাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে।


  রাবীন্দ্রিক গল্প কাঠামোয় লেখকের অবস্থান ছিল সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের(omnipotent) মতই। অন্যান্য লেখকেরা সেই ধারাটিকে অগ্রগতি দান করেন। বালজাকের মতই তাঁরা চরিত্রদের আভ্যন্তরীণ সকল বাধাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করতেন। চরিত্রদের জন্ম-মৃত্যু, এমনকি চরিত্রদের চাল-চলনের একটি সামগ্রিক sketch লেখকেরা নিজেদের মত করেই তৈরি করতেন। পরবর্তীকালে ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ব, মার্কসীয় দর্শন, পাশ্চাত্য নানা ইজম-এর ব্যবহার বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রটিকে তথ্যে ও তত্ত্বে, দার্শনিক মতাদর্শে পূর্ণ করে তুলেছিল। ধীরে ধীরে গল্প হয়ে উঠল অন্তর্মুখী। বিমল কর, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়েরা হয়ে উঠলেন কাফকার মতই, বাহ্যিক বাধা-বিপত্তি যাদের চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে লাগল। বাইরে থেকে মুখ ফিরিয়ে তাঁরা তখন ভেতরের কথা বলতে চাইলেন নতুনভাবে, নতুন দৃষ্টিতে, নতুন রীতিতে। আর তাতে পাঠকও হয়ে উঠল তাঁদের সহযাত্রী। বিমল করকে তাই বলতে শুনি –
গল্প যতকাল নিছক গল্প ছিল ততকাল পাঠক ছিল শ্রোতা। গল্প যখন থেকে কাব্যের ঐশ্চর্য গ্রহণ করল, তখন থেকে পাঠক আর শ্রোতা থাকল না, লেখকের অভিজ্ঞতার সে সাথী হল, অর্থাৎ কৌতূহল মিটিয়ে সে তৃপ্তি পেল না, অন্যের অনুভূতি সবিস্তারে অনুভব করতে পারল। নিজের অভিজ্ঞতার অনুভূতির মতন....
১০
‘গগনের অসুখ’ পাঠ করে আমরা পাঠকেরাও লেখকের অনুভূতির সাথে নিজেদের অনুভূতিগুলির সংযোগ সাধন করতে পারি। আমরাও হয়ে উঠতে পারি লেখকের অভিজ্ঞতার সাথী।  গগনের মত আমরাও ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে থাকি। to be-not to be-এর দ্বন্দ্ব আমাদের মধ্যেও তখন প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। গগনের মত আমরা পাঠকেরাও তখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাসকারী কোনও নিঃসঙ্গ প্রাণী হয়ে যাই।


‘ছোটোগল্প: নূতনরীতি’ মোটেও স্বাস্থ্যবান ছিল না, এ কথা ঠিক। কিন্তুযত্নবান হাতের স্পর্শ তাতে ছিল তা আমরা লক্ষ করেছি। গগন কোনও স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ নয়। সে রোগভারে জীর্ণ, ব্যাধিগ্রস্ত, সমাজ বিচ্ছিন্ন যুবক। কিন্তু গগন চরিত্র সৃষ্টিতে লেখক যে যত্নবান ছিলেন তা আমরা বলতেই পারি। গল্পে নিজের কথা নিজের মনোমত করে বলবার যে অবকাশ ‘ছোটোগল্প: নূতনরীতি’ দিয়েছিল ‘গগনের অসুখ’ গল্পেও সেই রীতি অনুসৃত হয়েছে। স্টোরি-অ্যান্টিস্টোরির দ্বন্দ্বের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে ‘গগনের অসুখ’ গল্পটিও হয়ে উঠেছে গল্প ভাঙার গল্প, internal reality-এর গল্প। সেই সাথে ‘ছোটোগল্প: নূতনরীতি’  আন্দোলনের অন্যতম ধারক ও বাহক।
               


তথ্যসূত্র ও উৎস নির্দেশ :


১. অরুন মুখোপাধ্যায়, কালের পুত্তলিকা, বাংলা ছোটগল্পের এক শ বছর: ১৮৯১-১৯৯০, দেজ পাবলিশিং, পৃ. ৩৯৫-৩৯৬
২.সন্দীপ দত্ত, বাংলা কবিতা আন্দোলনের তিন দশক, পৃ. ৩৯৬
৩.বিমল কর, বিমল করের শ্রেষ্ঠ গল্প, পৃ. ২৭৫
৪. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭৪
৫. ‘...আমার পরিশ্রমটা অনেকটা মজুরের মতন’, বিমল করের সাক্ষাৎকার, প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায়, দেশ, ৩ নভেম্বর ১৯৯০, পৃ. ৩৩
৬.বিমল কর, বিমল করের শ্রেষ্ঠ গল্প, পৃ. ২৭৩
৭.সন্দীপ দত্ত, বাংলা কবিতা আন্দোলনের তিন দশক, পৃ. ৩০
৮.বিমল কর, বিমল করের শ্রেষ্ঠ গল্প, পৃ. ২৭৩
৯.শেখর বসু, শাস্ত্র বিরোধী গল্প সম্পর্কে কয়েকটি কথা, পৃ. ২১
১০.সন্দীপ দত্ত, বাংলা কবিতা আন্দোলনের তিন দশক, পৃ. ৩১

                                                           






7 comments:

  1. খুব ভালো হয়েছে। নতুন কিছু জানলাম। লতিফকে অভিনন্দন।

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো আলোচনাটি। এখন গল্পটি পড়তে হবে।

    ReplyDelete
  3. অসাধারণ লাগলো লেখাটি।
    নতুন কিছু জানলাম।
    গল্পকার দেবেশ রায়ও এই আন্দোলনের শরীক ছিলেন। দেবেশ রায় সম্পর্কিত কোনো লেখা থাকলে আমাদের সাথে ভাগ করে নেবেন। খুবই উপকৃত হব।
    ধন্যবাদ 🙏

    ReplyDelete