Monday, December 31

অণুগল্প : ত্রয়ী সেন




হঠাৎ


রোজকারের সকালের মতনই এক আলোমাখা সকাল শুধু কুয়াশার প্রকোপ টা বেশি ছিল আজ, বাস্তবের কুয়াশা যে মনের দ্বার ঠেলে ভিতরের দিকে ঢুকে গেছে তা নিয়ে মৃণাল বাবুর কোনও সংশয় ছিল না। সকালের চোখ খুলেই যে লোকটি আগের দিন রাতে ভিজিয়ে রাখা ত্রিফলার জল খুঁজতেন, সে আজ ভুলে গেছেন খেতে। হাতের কাছে ঠেকনা দিয়ে রাখা লাঠির দিকে তাকিয়ে মুখটা বাঁকিয়ে বললেন " হুঁ! আমায় এমন দেখলে হবে? আমার বৃদ্ধাবস্থার ঢের বাকি।" তারপর উঠে বসলেন খাটে । তার চৌকির ডানদিকের টেবিলের ওপর রাখা পদ্ম মুখি ঘড়ি, তাতে চোখ যেতেই দেখলেন, বাড়ির ঢং ঢং করে বেজে ওঠা বস্তুটির সাথে সেই পদ্ম ঘড়ির সময়ের অদল-বদল হয়েছে প্রায়, বুঝলেন পদ্ম ঘড়ি মাঝ রাতেই বন্ধ হয়ে গেছিল।
কারন উনি ঘুম থেকে উঠতেই দেওয়াল ঘড়ির মুখে তাকিয়ে আসল সময়ের পরখ করে নিয়েছিলেন ।
পদ্ম ঘড়িটা হাতে নিয়ে, মনে মনে বললেন " ঘড়িটার আর দোষ কই! তাকে সামাল দেওয়ার লোক টাই আজ নিজেকে সামাল দিতে ব্যস্ত।
মৃণাল বাবুর স্ত্রী রেবা। উনি নিজের হাতে দরদাম করে কিনেছিলেন এই ঘড়ি টি, তাদের বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে। শুধু তাই না রেবা দেবী নিজের জন্মদিন ভুলে যাতেন কিন্তু তাদের বিবাহ বার্ষিকী পালন করতে কখনই ভুলতেন না, মৃণাল বাবুর এখনও মনে করে খুশি হন সেই দিনের মাধুর্য, কতই না সুন্দর ছিল সব। সকাল থেকে হরেক রকম রান্না তার সাথে নিজের হাতে মিষ্টি বানাতেন স্বামীর জন্য। তার আগের দিন গড়িয়াহাটে গিয়ে নিজে পছন্দ করে ধুতি পাঞ্জাবী আনতেন রেবা দেবী, কখনও স্বামীকে নিয়ে যেতেন না। কারন উনি মানা করতেন কেনার জন্য। মৃণাল বাবুর উৎসাহ কম ছিল এ সবে । কারন রেবা দেবী কে নিয়ে তার মাথা ব্যথা কম ছিল বললেই হয়, কারন তাদের বিয়ে টা মৃণাল বাবুর মত মেনে হয় নি। ব্যবসা করতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু বাবার ভয়ে তা কাজে করতে পারেন নি। তার মাথা থেকে ব্যবসা আর বাইরে যাওয়ার হুজুক নামানোর জন্য তারা মৃণাল বাবুর বিয়ে দিয়ে দেন, তারপর সেই ক্ষোভে তার সংসারে মন ও বসেনি তেমন। যদিও তিনি ছিটকে বেড়িয়ে যান নি দায়িত্ব নিয়েছিলেন কিন্তু ভালোবাসতে পারেন নি। আজ সে ৪৩টা বছর পার করে এসেছেন তার পত্নীর সাথে। কোনও সন্তান নেই তাদের। বিবাহ বার্ষিকীর সময় সীমা এই বছরে আর বেশি দূরে নেই আর পনেরো দিন পরেই। কিন্তু উৎসাহ দেওয়ার মানুষ টা অনেক দিন হলো তার সাধেন ঘরের বাহিরে। রেবা দেবী খুব অসুস্থ। ক্যান্সারের কবলে বিরাজমান। হাসপাতালে ভর্তি সে।
মৃণাল বাবু দুপুর করে রোজই প্রায় দেখতে যান রেবা দেবী কে। ওনি কথা বলতে পারেননা আর, নড়াচড়া তে বোঝান উনি খুশি মৃণাল বাবু যায় বলে। যখন ওনাকে কাচের জানলার বাইরের দূর থেকে দেখেন মৃণাল বাবু তখন বুঝতে পারেন তার মনের আর্তনাদ। বুক ফাটানো এক চিৎকার এসে বলে "রেবা বাড়ি চল ফিরে।"  তিনি এখন বুঝতে পারেন দায়িত্ব টা কবেই ভালোবাসায় পরিনত হয়ে গেছে কিন্তু আগে তা তিনি কখনোই বুঝতে পারেননি।  কেমোতে রেবা দেবীর মাথায় তেমন চুল আর অবশিষ্ট নেই তা দেখে মৃণাল বাবু মাঝে মধ্যে আড়ালে চোখ মুছে ছেন কতবার।
এ কথা ভাবতে ভাবতেই পূর্ব দিকের জানালা টা খুলে দিলেন তিনি। বাইরে দেখতেই খেয়াল এলো আজ রবিবার, কারন পাশের পার্কে আজ বেশিই হুল্লোড়, সব বাচ্চাদের।
তিনি এক পা করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে রাখা খবরকাগজ টা তুলে নিলেন। ঘরে এসে দেখলেন বেলা বেড়েছে অনেক, তাই খবরকাগজ টা রাতে এসে পড়বেন। স্নান সেরে তিনি খাওয়ার টেবিলে বসলেন। রান্না টা উনি ভালোই পারেন সেটা ভাবাটাও বড্ড ভুল। তাই কাজের মাসি এসে রেঁধে গেছেন। উনি চা টা খান না তাই মাসি বেলার দিকে রান্না করে যান। আজ ও তাই করেছেন। দুপুর দেড়টা, বড্ড দেরি হয়ে গেছে কারন তাড়াতাড়ি খেয়ে ওনাকে ওষুধ খেতে হয় নার্ভের। রেবা দেবী থাকাকালীন তিনি এমন দেরি করার সাহস ও পেতেন না।
ভাবতে ভাবতেই টেলিফোনের শব্দ। খাওয়ার টেবিলের পাশেই টেলিফোন টির স্ট্যান্ড, তাই উঠতে হয় নি তাকে।
শব্দ টা আজ বড্ড কানে লাগার মতোন ছিল। ফোন তুলেতেই উনি হাতের দলা করা ভাত টা থালার মধ্যে রেখে দিলেন। তার চোখের সামনেটা জলে ঝাপসা হয়ে গেল।
রেবা দেবী গত হয়েছেন।
একটু আগেই তিনি তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন হাসপাতাল থেকে জানালো। মৃণাল বাবু উঠলেন হাত ধুলেন, যেতে হবে হাসপাতালে । তিনি নিশ্চুপ, তবে কি তিনি আন্দাজ করেছিলেন সকালের বন্ধ ঘড়ি দেখে!!!
আলমারির পাশের দেওয়ালে রেবা দেবীর রাখা ছবিটা দেখে মনে মনে ফাটা গলায় বললেন," অনেক কষ্ট পেয়েছ, আন্দাজ করে বলতে পারি শরীরের টা মনের চাইতে কম। অনেকটা পথ অতিক্রম সাবধানে তুমি যেও।
দূরে আসমান পরিস্কার করে মৃনাল বাবুর জীবনে হয় তো কালো মেঘের বাস্তবতা নিয়ে এলো।

No comments:

Post a Comment