Monday, December 31

গল্প: সুস্মিতা চক্রবর্তী





বৃষ্টির দিনে


কাল সারারাত জ্যোতির বাচ্চাটা ট্যাঁ ট্যাঁ করে চেঁচিয়েছে।সাথে নচ্ছার প্যাটপাটানি বৃষ্টি।ভোরের দিকে বাচ্চাটা ঘুমোতে গৌরির চোখ লেগে এসেছিল, গত একসপ্তাহ জ্যোতিকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানির ধকল সামলে গা গতর এক্কেবারে হাল ছেড়ে এলানি দিতে চাইছে।হাঁটুর ব্যথাটাও চাগাড় দিয়েছে পুরোন শত্তুরের মত আবার।বাচ্চাটা জুড়োতে এমন বানের মত ঘুম উথলে এসেছিল শরীর ময় যে মাথার উপর থেকে চুঁইয়ে পড়া জলে, কাদাটে, স্যাঁতসেঁতে মেঝেতেই মরা মানুষের মত পড়েছিল গৌরি।পাঁচটার ট্রেনটার বাঁশি তেরপলের ঘরটার নড়া ধরে কাঁপিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও উঠতে ইচ্ছে করছিল না মোটে।থকথকে ঘুমে লেগে থাকা চোখ টেনে খুলে গৌরি দেখল উদোম বুকে জ্যোতি শুয়ে আছে, আর গায়ের গরমটুকু আঁকড়ে বাচ্চাটা।দুটোকেই ইচ্ছে করছে তার বের করে দিতে শালা লাথি কষিয়ে এক।যত হারামি এসে জুটেছে এই গৌরির ঘাড়ে।কেন রে পিরীত করার সময় মনে ছিল না।পোয়াতি হতে না হতে সেই যে এসে দিয়ে গেল, আর খোঁজটা নিল তোর পেয়ারের লোক।যত্ত বেজন্মার দল।মেঘভাঙা সকালে একগলা ঘুম থেকে শরীরটাকে টেনে তুলে ঝুপড়ির বাইরে এসে দাঁড়ায় গৌরি; আঙুল ছোঁয়া দূরত্বে পাতা রেললাইন সদ্য চলে যাওয়া ট্রেনের দাপটে এখনো কাঁপছে, ভারী বুকের মত ওঠানামা করছে,প্রতিদিন পিষে যেতে যেতে মুখ বুজে শুধু গুমরোচ্ছে ভোর থেকে মাঝরাত, ছড়িয়ে দিতে দিতে তার বোবা কাঁপনটুকু দুলন্ত মাটির গা ঘেঁষে থাকা এই ঘর নামক খুপরিগুলোয়।ছোট থেকেই মাটির এই দুলনি পায়ের দশ আঙুলে আঁকড়ে শুষে নিতে বড্ড ভাল লাগত গৌরির।অনেককাল হল মাটি ছুঁলে আঙুল তার আর কাঁপুনি টের পায় না।শালা পেটের যন্তরটাকেও যদি এরম অসাড় করে দেওয়া যেত!


মেঘ ছুঁতে গিয়ে থমকে গেছে যেসব মানুষের আদুরে ঘরদুয়ার, বাদলা আকাশের নীচে ঝিরঝিরে বৃষ্টি মেখে এমন দিনে সেখানে সকাল ঘুমায় অকাতর।সেতারের সুরতরঙ্গের মত সময় এসে দাঁড়ায় নিশ্চিন্ত ঘুমে জুড়ানো মানুষ মানুষীর মেঘবারান্দায়।ঘাড়ের উপর চেপে বসে থাকা খাইখাই পেটগুলোকে নিয়ে সেই মেঘজুড়ানো পাড়ার দিকেই যাচ্ছিল গৌরি।রেললাইনের ওপারের সাবেকি অভিজাত পাড়া ভেঙে গজিয়ে উঠতে থাকা ফ্ল্যাট মহল্লাতে তার একচ্ছত্র আধিপত্য।

দূর থেকে প্রতিদিনের মত, গটমটিয়ে আসা গৌরিকে দেখছিল লালন।বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে সাইকেল স্ট্যান্ডের একটু কোনাচ ঘেঁষে রোজই এসময় এখানে থাকে সে।ডাউন রাণাঘাট ধরে উল্টোডাঙা যাবার জন্য ঠিক এইখানটাতেই দাঁড়াতে হবে এমন মাথার দিব্যি অবশ্য কেউ দেয়নি তাকে।তবু লালন এইখানটাতেই যে দাঁড়ায় তার কারণ একটাই, সে জানে চোখ দিয়ে না দেখলেও জায়গাটা পেরোবার সময় গৌরি একবার তাকে দেখে ঠিকই যায়।লালচে রুক্ষ চুল খোঁপায় দলা পাকানো, দেহাতি ঢং এর শাড়িটা গোড়ালির খানিকটা উঁচুতে উঠিয়েই পড়া, সাতসকালেই ঘাম লেপ্টানো কপালে উড়ন্ত চুলের মাঝে আটকে থাকা বিন্দি, ভেবে দেখলে দেখার মত তেমন কিছুই নয়।কাঁচা বয়সের ছুকরি হলেও নাহয় মনের ডগায় যুক্তি একটা খাড়া করা যেত।লালন ঠিক নিজেও বোঝে না, চল্লিশ পেরোন এই মেয়েছেলেটাকে দেখার জন্য কেন সে হাপিত্যেশ করে রোজ সকালে এইখানে ঠেকা দেয়।গৌরি যদি তাকে খেয়াল না করে চলে যেত, তাহলে অবশ্য আর দাঁড়াত কিনা লালন জানে না।কিন্তু চেয়ে না দেখলেও  গৌরি,লালনের দাঁড়িয়ে থাকাটুকু টের পাওয়া জানান দিয়ে যায়।কারণ প্রতিদিন এইখানটা দিয়ে যাবার সময় সে উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে থুতু ফেলে যায় এক দলা!


কংক্রিটের আনাচ কানাচ জুড়ে তেড়েফুঁড়ে ঝাঁটা মারে গৌরি।সুখ বিলাস ভোগের যোগান দিয়ে উড়ে আসা পরিত্যক্ত, রংচঙে হরেক কিসিমের প্যাকেট, বিড়ি, সিগ্রেটের পোড়া শরীর, ছোট একচিলতে ফেলানি কাগজ কিংবা একটা নিরীহ, দুর্বল মৃত পাতাও রেহাই পায় না তার ঝাঁটানি থেকে।এক ফোঁটা আবর্জনাও যেন সে পণ করছে রাখবে না, প্রবল পরাক্রমে চারতলা, পাঁচতলা আবাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, উঠোন, সিঁড়ির কোনা, ঘুঁপচিতে নীচু হয়ে, গুঁড়ি মেরে ঝাঁটা মারে গৌরি।সপ্তাহে দুদিন প্রতিটি বিল্ডিং এ এই ঝাঁট আর একদিন ধোয়ানো, জলের তোড়ে ভাসিয়ে দেওয়া, চৌপাটে উড়িয়ে দেওয়া রাজ্যের ধুলো ময়লা আবর্জনার অস্তিত্ব।দুই মেয়ে,  এক ছেলে আর লতায়পাতায় কিছু রিস্তেদার নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থের মেঘমহল্লায় এই তার কাজ সপ্তাহভর।গৌরি ছাড়া এ পাড়ায় অস্তিত্ব নেই আর কোন সাফাইওয়ালার।দু একজন বাইরের লোক কাজ হাতাবার চেষ্টা করে সরে পড়েছে ল্যাজ গুটিয়ে গৌরির ঝাঁটা আর মুখের তোড়ে।কাউকে টিঁকতে দেবে না গৌরি তার নিজস্ব বাহিনী ছাড়া এ মোটামুটি মেনে নিয়েছে নির্ঝঞ্ঝাট এই ভদ্দরলোকের পাড়া।তার একটা কারণ অবশ্য গৌরির তোড়ফোড় এই সাফাই।ঝাঁটার দাপটের কারণেই তার মুখের দাপট ও সয়ে নেয় বাবুরা সেটা গৌরিও জানে।সকাল থেকে সেই বেলা তিন চার গড়িয়ে এই সাফাই ই তো করে যায় সে।এত ঝাঁটায়, এত, এত, মাঝেমাঝে জলের পাইপে দৈত্যের মত বাড়িগুলোকে চান করাতে করাতে নিজের দিকেও ঘুরিয়ে দেয় সে জলের ধারা।এত ঝাঁটার বাড়ি, এত জলের স্রোত তবু কোত্থেকে এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে থুতু উঠে আসে এমন বোঝে না গৌরি।একবার যদি মুখপোড়া মনটাকে ঝাঁটাতে পারত এমন হাতের সুখ করে!!


চাইলে কি আর সাফ করে ফেলতে পারত না, তবু মনের কোণে জমে থাকা শ্যাওলার মত মখমলি মায়াটুকু চেঁছে ফেলতে পারেনি লালন।তবে ব্যাপারটাকে ঠিক মায়া বলা যায় কিনা তাও সন্দেহ হয় তার।বস্তুত ভেবে দেখলে গৌরিকে মায়া করবার এলেমই বা তার কোথায়।ইন্দ্রপ্রস্থ দাপিয়ে বেড়ানো মেয়েছেলেটাকে মায়া সে করতে যাবেই বা কোন আক্কেলে।দিব্যি খাচ্ছে, দাচ্ছে, পিছু পিছু গন্ডাখানেক আন্ডা বাচ্চা, রিস্তেদারের গুষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে তার হুকুমের গোলাম হয়ে।এমনকি ইন্দ্রপ্রস্থের  ভদ্দরলোকেরা পর্যন্ত গৌরির চোপাকে ভয় খায়।এখন তার আর নিজেরই বিশ্বাস হয় না এই ধুকধুকে সাহস আর চালচুলোহীন বাউন্ডুলেপনা নিয়েই একদিন সে ফুঁসলে এনেছিল ওই জাঁহাবাজ মেয়েমানুষটাকে। জাঁহাবাজ? কি জানি, ঠিক এইরকম, এইরকম ই থাকলে কি সাহস হত আর।তবে মুখের ঝামড় তো গৌরির তখনো ছিল,টিটাগড়ের বস্তির পিছন লাগা ছেলেপুলেদের সাহস হত না ঘাঁটাবার।চেষ্টা তো আর কম কেউ করে নি।একদিন চড় ও খেয়েছিল মুকেশ, হাত ধরে গৌরির টানতে গেছিল ছট পুজোর দিন সকালে গঙ্গার ঘাটে।লালনের অবশ্য অত সাহস টাহস কোনকালেই ছিল না।প্যাংলাটে চেহারার মতোই কলজের জোরও তার চিরকাল টিংটিং এ।তবু মোহাব্বতটা শেষপর্যন্ত  হয়েই ছিল।ফুঁসলানোর মত লোকের তো অভাব ছিল না গৌরির, তবু এই লালনের দিকেই ঢলেছিল কেন কে জানে।মেয়েমানুষ ওই নদীর মতোই।কোন লগনে কোন দিকে বাঁক নেবে, কখন উজান, কখন ভাঁটি কোন স্রোতের টানে কোথায় বয়ে যায় জানতে পেরেছে কে আর কবে ।অন্তত লালন তো জানতে পারে নি।হ্যাঁ দোষ তারও ছিল বটে, সে পুরুষ মানুষের ওরম দু একটা দোষ তাদের পাড়ায় কোন লোকটারই বা নেই।সেইজন্য, সেইজন্য একেবারে ফেলেই যাবে, অত উজান, ভরা গাঙের মত ডুবিয়ে দিয়ে তাকে চলেই যাবে স্রোতটুকু মুছে নিয়ে! জলের দাগ লাগা পাঁকের বুকে ফেলে রেখে যাবে এত বড় একটা  জীবন।


থিকথিকে পাঁকে লেপ্টে গেছে শহরটা একটু বৃষ্টি হতে না হতেই।মেঘমল্লারি আকাশ, খানা খন্দে জমা জলে কদর্য ঘোলাটে মুখ ভেংচে ভাসছে শহরময়।রাণাঘাট লোক্যাল থেকে উল্টোডাঙা নেমে ঊদ্ধর্শ্বাসে দৌড়চ্ছিল লালন।রাজ্যের রংবেরঙের ছাতা আর হেলে দুলে যাওয়া এলানে লোকজন ঠেলে গুঁতিয়ে।মুখ থুবড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে আজ রাস্তাঘাট।উচিত ছিল আজ আগের ট্রেনটাই ধরা, কিন্তু সকাল হলেই বিড়ির সুখটানের মতোই কি এক আঁকপাঁকানি নাচনকোঁদন শুরু হয় রক্তে।ওইটুকু, ওইটুকু সময়েই লালনের ভিতরের গোঁয়ারগোবিন্দ  কেউ একটা  বিদ্রোহ করে।ভিজে ন্যাতার মত, এই ছিঁচকাদুনে আকাশটার মত সেঁতিয়ে থাকা সারাটা দিনে ওইতো একটু সময় যখন লালন টের পায় তার রক্তের টানাপোড়েন।এত বছর পরেও ঘেন্নাটুকু আজো টাটকা জিইয়ে রেখেছে গৌরি।কে জানে ঘেন্নার মধ্যেও একটু অপেক্ষা থাকে কিনা।


সাড়ে তিনটের  আপ কল্যাণী লোকালের জন্য রোজ রোজ তার এই কানখাড়া অপেক্ষার কোন মানে খুঁজে পায় না গৌরি।এই ভোঁ টা শুনলেই ফেরার পথ ধরে সে।কিন্তু সেই জন্যই কি আর মন নড়েচড়ে ওঠে বচ্ছরের পর বচ্ছর।এটাও ঠিক যে আজকাল দুপুর গড়ালে আর আগের মত টান রাখতে পারে না কাজে, গড়ানি দিতে ইচ্ছে হয় খানিক।তা সেটুকু তো যে কোন ফ্ল্যাটবাড়ির চাতালেই সে দিব্যি দিতে পারে, তার জন্য রোদ, বৃষ্টি পেরিয়ে বারো মাস ঘরের পথ ধরার দরকারটা কি ট্রেনের ভোঁ গুণেগেঁথে! কেই বা সেখানে বসে আছে ভাতের থালা মেলে তার জন্য।তবু সকাল থেকে হাঁইমাই করে কাজ সেরে এই সময়ে ফিরতি রাস্তা ধরবেই গৌরি।চেনা রাস্তাটুকু চোখ বন্ধ করেই যাওয়া যায়।ডান, বাঁ, রেললাইনের স্লিপার কটা তাও প্রায় গোণাগাঁথা।চোখ অবশ্য খুলেই যায় সে, গাড়িঘোড়া চাপা পড়বে নইলে।কিন্তু মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে খুব চোখ বন্ধ করেই যায়, যেমন করে বিশ বছর আগে লালনের হাত ধরেছিল।গঙ্গার ধারে এক বিকেলে চোখ বন্ধ তাকে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল লালন, “ এ গোওরি এইবার দ্যাখ, আমাদের ঘর দ্যাখ কেমন।” চোখ মেলে চেয়ে কালবোশেখি ফুঁড়ে যাওয়া নদীর মত হাসিতে ফেটে পড়েছিল গৌরি, “  পাগলা, লালন পাগলা আছিস রে তুই, বিলকুল একটা পাগলা”, হাসির দমকে বৃষ্টি তে তছনছ গাছপালার মত দুলছিল সে, “ এই ঘর, এখানেই রাখবি তুই আমায়”। “ কেন তোর পছন্দ না, দ্যাখ কেমন জলের ধারে ঘর আমাদের, চারপাশে আর কেউ নেই, কতবড় ঘরে শুধু আমরা দুজন,” লালনের কথা শুনে শাঁইশাঁই বাতাসও হাসছিল দরজা, জানলা কপাট হীন জরাজীর্ণ প্রকান্ড বাড়িটাকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিতে দিতে।একটু দূরের খেয়াঘাট আর মানুষের নজর থেকে ভাঙাচোরা বাড়িটাকে আগলে রাখা গাছপালারা হাত বোলাচ্ছিল তার ঝুরঝুরে পলেস্তারায়, ছাদের আলসেতে, বটের চারা গজানো শ্যাওলা জড়ান মখমলি দেওয়ালে।হাসির দমকে বেসামাল হতে হতে গৌরি দেখেছিল, ঠিক তেমন একটা গাছের মত তাকে ছুঁয়ে আছে লালন, সরিয়ে দিচ্ছে তার কপালে লুটিয়ে থাকা ঘামে ভেজা এলোমেলো চুল।বাড়িটার মত সেই আদরটুকুর কাছে নিজেকে মেলে ধরতে ধরতে গৌরি সেই ভাললাগাকেই ডেকেছিল লালন বলে।মানুষ নয়, কক্ষনো জীবনে না পাওয়া এক গহীন গাঙের সুখকেই সে ডেকে বলেছিল, “ ঘর করবি আমার সাথে?”


মাটি ফুঁড়েই যেন প্রতিদিন শহরটায় গজাচ্ছে  কিলবিলে কীটের মত মানুষের ঘর।লোহার খাঁচার কোটরে কোটরে বাতাসে গজিয়ে ওঠা ঘর,সার্কাসের খেলুড়ের মত ঝুলন্ত লালন রং লাগায় খসখসে নিষ্প্রাণ চেয়ে থাকা হা হা শূন্য সেই ঘরে।হাতের কাজের কদর আছে তার।আর সেটা আছে বলেই টিটাগড় ছেড়ে এই এদ্দূর এসেছে সে।মজুরি এখানে দ্বিগুণ। উল্টোডাঙা থেকে আধঘন্টা খানেকের রাস্তা।আজ স্যাঁতস্যাঁতে শহরে সেটুকু পেরোতেই মিনিট চল্লিশেক লেগে গেল লালনের।দৃকপাতহীন চকচকে রাস্তার ধারে ভয়ে মুখ লুকিয়ে থাকা কিছু জলাজমি।সেগুলোকে কোতল করেই উঠছে কুড়িতলার আকাশখেঁকো একটা বিল্ডিং। না সেটা নয়, এডিজি গ্রুপের সেই জলাজমি ভরাট করে ওঠা সবুজ স্বপ্ন নামের প্রোজেক্টে নয়, লালনের ঠিকেদারের কাজ একেবারে তার পাঁচিল লাগোয়াই একটা তেতলা বাড়িতে।এ তল্লাটের অধিকাংশ বাড়ির মতোই, বিশাল হাত পা মেলা বাড়িটার বাসিন্দা বলতে এক ষাট পেরোন দম্পতি।ছেলে নিয়ম মেনে বিদেশে।প্রাণভোমরার মত ভিটে আগলে পড়ে এদুটি মানুষ।আজ ঢুকতে ঢুকতেই লালন দেখল অনুকূল, শম্ভু আর নিতাই সিঁড়ির উপর বসে।এতক্ষণে জামা,প্যান্ট ছেড়ে কাজে লেগে যাওয়ার কথা।আজ তো লালন দেরি করে ফেলেছে।নিতাইরা আসে ফুলবাগানের দিক থেকে।লালনের ভুরুর জিজ্ঞাসা দেখে নিতাই নিজেই বলল, “ কাজ বন্ধ, ভিতরে যাও,শোন গিয়ে।”খুব কম বাড়িতে লালন, রঙ করতে গিয়ে এমন মানুষের মত ব্যবহার পেয়েছে।বেশিরভাগ জায়গায় তো বাড়ির লোকেদের তুই তোকারি শুনেই কান অভ্যস্ত আর ব্যবহারে সব সময় একটা সতর্ক চোখ বসান থাকে, সেটা মাপতে থাকে চুরি হচ্ছে নাকি কিছু।সময় কিংবা হাতের এধার ওধার ছড়িয়ে থাকা জিনিস।এই বাড়ির মাসিমা লালনদের নিজের হাতে চা করে খাওয়ান দুবেলা।দুপুরেও ওরা নিজেদের টিফিন কৌটো খুললে এটা সেটা রান্না দিয়ে যান।বাইরের বসার ঘরটাই রং চলছে এখন।সেখানে ঢুকতেই লালন দেখল মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা মেশোমশায় রং এর জন্য প্লাস্টিক ঢাকা সোফাটার উপরেই বসে।পাশে দাঁড়িয়ে মাসিমা কথা বলছেন নিহারুল মিস্তিরি,  লালনের ঠিকেদারের সাথে।লালন ঢুকতেই মেশোমশাই, মাসিমা দুজনেই তাকিয়েছিলেন।ভ্যাবাচাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকা লালনের দিকে চেয়ে মেশোমশাই ই বললেন আস্তে আস্তে, “ হল না লালন, হল না, বাড়িটা আর রাখা গেল না।” মেঝের উপর উবু হয়ে বসে পড়ে লালন।কাজ চলতে চলতেও সে দেখেছে ঝামেলাটা হচ্ছে।কিন্তু তাই বলে এদ্দূর! এডিজি গ্রুপের লোকেরা তো সেই কবে থেকেই চাপ দিচ্ছে বাড়িটা বিক্রি করে দেবার জন্য।এই দিক দিয়েই হবে শপিং মল একটা, তার আন্ডার গ্রাউন্ড গ্যারেজের জন্য এই জমিটুকু পেলে সুবিধে ওদের।সেই হাঙরের হাঁ থেকে তো এই দুটি মানুষ আগলে রেখেই তো রং করানোর কথা ভেবেছেন বাড়িটা।জরাজীর্ণ, বৃদ্ধের মত নয়, যতদিন বাঁচবেন তাঁরা এ বাড়ি থাকবে সমস্ত মর্যাদাটুকু নিয়ে, যৌবনের সৌন্দর্যে।কতবার মাসিমা ওদের বলেছেন, “ ছেলে মোটেই চাইছেনা এসব রং টং হোক বুঝলে, সে চায় ঝামেলা মুক্ত হয়ে আমরা তার কাছে চলে যাই, দেখ বাবা শিকড়ের টান আর বুকের পাঁজর এ দুটো কেউ বোঝে নিজের হাতে তিলে তিলে একটা বাড়ি বানালে।আমরা দুজনে মিলেই একটু একটু করে গড়েছি এ বাড়ি, এর প্রতিটি ইঁটে আমাদের সেইসব দিন আছে, মরে না গেলে বাপু যেতে পারব না একে ফেলে কোথাও চিরতরে।” “ পড়ে গেলেন কি করে?” লালন জিজ্ঞেস করে। “নিজে পড়িনি,  ধাক্কা খেলাম, আজ সকালে মর্ণিং ওয়াক সেরে ফিরছি, পিছন থেকে আসা একটা বাইকে…”, চোয়াল শক্ত হল লালনের। “ ছেলেগুলোকে চেনেন?” “ সবাই চেনে তাদের লালন, তারা ক্ষমতার, ক্ষমতাবানের ছেলে, সেটাই যথেষ্ট পরিচয়, আর খবরটা পেলেই জানি, আমেরিকা থেকে ফোন আসবে সেখানে চলে যাওয়ার জন্য। কেউ তো নেই লালন লড়বার মত, কাল প্রাণেও মেরে ফেলতে পারে, আজ শুধু ধাক্কা দিয়েছে।তোমাদের মাসিমার কি হবে।” ঘরের মধ্যে এখন কথা বলছে একটা পুরোন সিলিং ফ্যান।মেরামত দরকার ছিল তার,এ বাড়ির আরো অনেককিছুর মতোই। মন উঠে গেলে কি আর মেরামত হয় তার।


মেরামতির চেষ্টা যে করেনি গৌরি তা নয় কিন্তু লালন যেদিন গায়ে হাত তুলল তার ইয়ার দোস্তদের সামনে, সেইদিনই গৌরি বুঝেছিল কিছু ভাঙচুরের কোন মেরামতি হয় না।তিনটের আপ ট্রেনের বাঁশি বাজলেই মন আনচান শুরু হয়ে যেত।লালনের ফেরার ট্রেন ছিল সেটা।এমনই ধারা শ্রাবণের দিন ছিল।চৌকির উপর আর নীচ মিলিয়েই ঘর।ইঁদুরের গর্তের মত সারসার।রেললাইনই উঠোন।অন্যদিন দুপুরের এই সময়টায় খাওয়াদাওয়া সেরে উকুন বাছতে বসে লালনের মা আর তার বান্ধবীরা।ন্যাংটা বাচ্চা কাচ্চা দৌড়োয় এদিক ওদিক কিছু।টিভির  আর সংসারের জগাখিচুড়ী আওয়াজ ভেসে বেড়ায়।সেইদিনটা ছিল শুধু বৃষ্টির।পলিথিন, টিন, আসবেসটাস, ইলেকট্রিক পোল ভিজছিল গাছপালার মত আহ্লাদে; লালন দেখিয়েছিল তাকে নদী আর তার ঘর, এই গর্তের থেকে কতদূর তার কূল, তবু মনে হচ্ছিল গৌরির সেদিন নদীই এসেছে উঠে বুঝি ঘর দোরের পাশটিতে তাদের।লালনের মা, বাপ ছিল না।কোন এক রিস্তেদারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল।চৌকিতে উপুড় হয়ে শুয়ে হাঁ করে দোর খুলে বৃষ্টি আর হাওয়ার একাদোক্কা খেলা দেখছিল গৌরি, খেলতে খেলতে জল মাঝেমাঝে ভাসাচ্ছিল ঘর, এভাবে কখনো বৃষ্টি তাদের চৌকাঠ ডিঙোন নি আগে,চৌকির পাশেই একখাবলা জানলা একটা, সেখান দিয়ে ছাঁট এসে মাটির মতোই  ভিজিয়ে দিচ্ছিল তাকেও।সোঁদা গন্ধ ছাড়া সেই দুপুরে পৃথিবীতে যেন ঘ্রাণ ছিল না কোন আর।অবেলার রান্নার কটু গন্ধেরা এধার ওধার থেকে ভেসে আসা রোজ মুছে গিয়েছিল, একদৃষ্টে বাইরের জল মাখা আলোর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে থাকতে গৌরি প্রথম জেনেছিল বুকের ভিতর লুকিয়ে থাকে কিছু কথা যা শুধু এমন ঝাপসা বৃষ্টির দিনেই স্পষ্ট দেখা যায়, সেই কথাকটি নিয়ে সে অপেক্ষা করছিল লালনের।


বৃষ্টিটাকে শাপান্তবাপান্ত করতে করতেই বাড়ি ফিরছিল লালন।সঙ্গে রঙের মিস্তিরি আরো দুজন।ঘর ফাঁকাই থাকার কথা, কাজেই নির্ঝঞ্ঝাটে বসা যাবে ভেবেই ডেকে আনা ইয়ারদের। হাঁ করা দরজা, বেতালের মত ভিজে যাওয়া ঘরদোর আর চৌকির উপর নির্বিকার গৌরিকে দেখেই মাথায় আগুন জ্বলে গেল তার।খানিক আগে ঢেলে আসা তরলটুকু শুধু উস্কেছে মাত্র তখন নেশার ঘোর।বিকৃত মুখে তার নাম ধরে লালনের ডাক শুনেই চমকে তাকিয়ে ছিল গৌরি। “ রেঁধেছিস?” লালনের উস্কোখুস্কো চোখ মুখ, অসংলগ্ন চেহারার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল গৌরি। তারপর এতক্ষণের যত্নে জমান সব শব্দদের বৃষ্টি ছাঁটে উড়িয়ে দিয়ে, বৃষ্টির ঘরদুয়ার ভেঙেচুরে তীক্ষ হাওয়ার শিসের মত  চেঁচিয়ে উঠেছিল, “ কাল রাতে কোথায় ছিলি? ঘরে আসিস নি কেন বল।” পিছনে দাঁড়ান দুই স্যাঙাতের সামনেই মেয়েছেলেটার এই আস্পদ্দায় লালন যেন কখনো না দেখা একটা আগুন পাহাড় হয়ে গেল, সব লাভাটুকু ঢেলে দিতে দিতে গৌরির শরীরময় লালন এক অদ্ভুত সুখে ভাসছিল।জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই মেয়েমানুষ পিটাতে দেখেছে সে অনেক।রোজ রাত্তিরে রিকশা চালিয়ে পাওয়া টাকা উড়িয়ে তার বাপটা যখন এসে পিটাত তার মা কে, লালন শুধু গুটিয়ে রাখত ছেঁড়া লেপকাঁথার স্তূপের মত তার প্যাংলা শরীরটাকে, চৌকির এককোণে।আরেকটু বড় হতে সে চেষ্টা করত ঘরেই না থাকার সে সময়টুকু।রক্তের বিদ্রোহের উসখুসানিটুকু ছোটবেলা থেকে বালিশ চাপা দিতে শিখেছে সে।চিরকালের রোগাসোগা, ভীতু, মাথা গুঁজে রাখা লালন সেদিন গৌরিকে পেটাতে পেটাতে প্রথম টের পাচ্ছিল এমন এক আশ্চর্য সুখ যা মেয়েমানুষ আগে দেয়নি কখনো তাকে। গৌরি তো নয়, শালা নচ্ছার জীবনটাকেই হাতের সুখ করে পেটাচ্ছিল সে উন্মাদের মতন।


তিনটের বেলা ঝিম ঘোলাটে চোখে চেয়ে আছে আকাশময়।বৃষ্টি শুধু চাপা পড়া আবর্জনা উপড়ে আনে এ শহরে।আকাশটার মতোই শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল গৌরির, দৃকপাতহীন।এইরকম একটা হাত পা মেলে থাকার নিজের ময়দান যদি থাকত তার!বাদলা হাওয়ায় উড়ে আসা এলোমেলো চুলেদের রুক্ষ হাতে ঠেলে সরাতে সরাতে হাঁটছিল গৌরি।নাঃ, বৃষ্টি এসে টেনে ভাসাক সেইসব চাপা আবর্জনা চায় না সে আর।সে শুধু চায়, কি চায়? ঠিক কি চায় সে?সক্কাল হতে না হতে এই গুষ্টির জোয়াল টানা, এও কি চায় সে!সে না থাকলে কতটুকু কি এসে যাবে এদের।লালন! এতগুলো বছর, সেও তো পার করে দিল, দরকার হল না তাকে।কাউকেই কি দরকার কারুর।গৌরি টের পায় বৃষ্টিটা আসছেই, ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে, আর ঢাকা পড়ে থাকা আবর্জনা তারাও ভেসে উঠতে চাইছে আবার।ইচ্ছে করে না তবু, ইচ্ছে করে না ঝাঁটিয়ে ফেলতে।নিজস্ব বলতে তো তার ওটুকুই।তিনটের বেলায় লালন ফিরবে না আর, তবু সে রোজ আঁচরানিটুকু টের পায় আপ ট্রেনটা ঢুকলেই, থাক আবর্জনাটুকু থাক।সেটুকুই তার আকাশী ময়দান।


রেলপারের বস্তির পিছনেই চমৎকার একটা ময়দান।না, এঁদো ডোবা, মানুষের উচ্ছিষ্ট, আগাছার একচেটিয়া রাজত্ব আর উদ্বাস্তু কিছু ভাম বেড়ালের আস্তানা সেই জমিকে দেখে ময়দান বলবে না কেউ।কিন্তু জমি চিনেই জহুরি হয়েছেন মিঃ ছাবারিয়া।এতদিন এইসব শহরতলি তে এত বড় হাউজিং প্রোজেক্ট করার রিস্ক নেওয়ার কথা ভাবাও যেত না।কিন্তু ইদানীং ছাবারিয়া গোষ্ঠী এই জমিটা নিয়ে ভাবছে।জমিটার লোকেশান চমৎকার, রেল স্টেশন আর বিটি রোড দুটোই খুব কাছে।ইদানীং এডুকেশন একটা দুর্দান্ত বিজনেস, তাতে হাত পাকানো এক বড় খেলুড়ে গ্রুপ প্রস্তাব দিয়েছে ছাবারিয়াদের টাউনশিপের মধ্যেই তারা ফ্র‍্যাঞ্চাইজি নিতে ইচ্ছুক নামী ব্র‍্যান্ডের বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের।সেটা হলে এর ভিতরেই যে শপিং মল করার কথা ভাবছেন মিঃ ছাবারিয়া সেটাও চলবে হু হু করে।সল্টলেকের বহুতলের ঠান্ডা ঘরে বসে দূরের সবুজের দিকে তাকিয়ে প্ল্যানটা নিয়ে মাথায় নাড়াচাড়া করেন মিঃ ছাবারিয়া।সবুজের মধ্যে জলছবির মত ফুটে উঠছে সেই স্বপ্নের রঙ।সমস্যা একটাই, বহুদিনের গেঁড়ে বসা একটা বস্তি! শিকড়বাকড় সমেত উপড়াতে প্রচুর খসাতে হবে, যেভাবে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ বাড়ি গুলোকে গিলে ফেলা যায়, ধমকে চমকে নরমে গরমে, এটা ঠিক ততটা সহজ হবে না।অবশ্য ভারতবর্ষের তেত্রিশ কোটি দেব দেবী।কেউ না কেউ তো ঠিক আছেন, ছাবারিয়াদের কাজটা উৎরে দেবার জন্য।প্রথম কাজ সঠিক দেবতা চিহ্নিত করে পুজো চড়ানোর ব্যবস্থা করা।দেবতা আর অসুর দুইই সঙ্গে থাকলে এই দেশে অসম্ভব কথাটা আর বোকাদের অভিধানেও থাকে না।


আপাতত ডাউন রাণাঘাট লোক্যালের প্রয়োজন নেই লালনের।সল্টলেকের মাসিমার বাড়ির কাজ বন্ধ।সাইকেল স্ট্যান্ডে নিয়ম মাফিক এসে অবশ্য দাঁড়িয়েছিল কিন্তু ছটার কাঁটা সাড়ে ছয়ের দিকে চলতে শুরু করতে লালন বুঝল গৌরি আজ আসবে না।মাঝেমাঝে যে হয় না এমন তা নয়, তবে কিনা সেরকম দিনের সংখ্যাটা খুবই কম আর লালনের ও দাঁড়িয়ে থাকার সময় থাকে না।ট্রেন ধরতে হয়।আজ তার হাতে ফেলে ছড়িয়ে খরচ করার মত অনেকখানি সময়। এখুনি কাজের খোঁজে বেরোবার ইচ্ছেও আর নেই।গৌরি তার মেয়েছেলে নিয়ে ঘর করার সব সাধ মিটিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।কাজেই বাপ, মা মরে সে এখন বলতে গেলে ঝাড়া হাত পা ই।লালন টের পেল এই হাত পা খেলানো সকালটায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার বেশ একটা উদাস উদাস ভাব আসছে।অন্যসময় গৌরির সাথে দেখাটুকু না হয়ে চলে গেলে কাজের মাঝেও খচখচানি একটা থেকেই যেত, আজ সেটা আর হচ্ছে না।কেমন যেন একটা পাথর সরে হালকা হয়ে যাওয়ার আরাম।এই যে গৌরির না আসাটুকু এ হয়ত ইচ্ছে করেই।কেন জানি লালনের মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করেই এলোনা গৌরি।এই যে বছরের পর বছর লালন দাঁড়িয়ে থাকে, একদিন ও তাকাল ফিরে আর, অথচ টের পাওয়াটুকু জানান তো দিয়ে গেল।এতটাই অচ্ছেদ্দা, শাস্তি পাওয়ার মত কিই বা করেছিল সে।সেই বৃষ্টি দুপুরের নেশা ছুটে যেতে হাত, এমনকি লজ্জা ঘেন্নার মাথা খেয়ে গৌরির পা পর্যন্ত জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চায়নি সে? লাথি মেরে চলে এল গৌরি, অথচ আগের দিন দুপুরের মারটা খেয়েছিল সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, বিনা প্রতিবাদে।চাইলে কি পারত না ঠেকাতে? চেঁচায় নি, কাঁদে নি, ঠেকায় নি একটা বোবা গাছের মত তার মারগুলো খেয়েছিল গৌরি।আজো লালন বোঝে না তার মত একটা প্যাংলা মানুষের নেশার ঝোঁকের মারগুলো ওভাবে কেনই বা সহ্য করল গৌরির মত তরতাজা একটা মেয়ে আর যদি বা করলিই পরদিন সকাল না হতে অমন সারা মহল্লার লোকের সামনে মুখের উপর লাথি মেরে চলেই বা এলি কেন।নাঃ, গৌরিকে সে কোনকালেই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারে নি।যেমন এই মুহূর্তে এটাও সে বুঝতে পারছে না একটু আগের সেই হালকা ভাবটা কেটে গিয়ে আবার মনটা জেবড়ে যাচ্ছে কেন, পাথরের মত ঝুম হয়ে যাচ্ছে কেন।একটা সাইকেলের উপর এলানি দিয়ে মনটাকে নিয়ে আরো খানিক আলসে নাড়াচাড়া হয়ত করত লালন, যদি ঠিক সেইসময়েই রেলপারের বস্তির দিক থেকে প্রবল একটা হুজ্জুতির আওয়াজ ভেসে না আসত।


চুপচাপ ভালমানুষের মত দাঁড়িয়ে পড়েছে সোয়া ছটার রাণাঘাট।জোঁকের মত সেঁটে থাকা নিত্যযাত্রীরা খসে পড়েছে রেললাইনে আগেই।পঞ্চাশ, ষাট জন তেএঁটে চেহারার লোক ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে।তাদের চোখ মুখ দেখেই মনে হচ্ছে হাতে প্রচুর সময় নিয়েই তৈরি হয়ে এসেছে। যথেষ্ট হুজ্জুতি,ঝামেলা না জুটিয়ে সরার কোন লক্ষণ দেখাবে না।বেপরোয়া, মরিয়া প্যাসেঞ্জাররা বিকল্পের সন্ধানে কেটে পড়তে লাগল টুকটাক।ভিড়টার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে গোটা ঘটনাটা মাপছিল রিন্টু বোস।খুবই স্থিতধী দৃষ্টিতে।এসব ঘটনাতে বিচলিত হতে নেই।ছাবারিয়াদের এডিজি গ্রুপের প্রোজেক্টটা নির্বিঘ্নে উৎরে দেওয়াটা তার কাছে একটা চমৎকার চ্যালেঞ্জ। প্রায় তিরিশ বছরের পুরোনো একটা বস্তির শিকড় বাকড় সমেত উপড়ে আনা সহজ কাজ নয় মোটেই।সূক্ষ হিসেব নিকেশের খেলাটা শুরু হয়েছে সবে।অনেককাল পরে সেই ওয়াগন ব্রেকিং সময়ের চনচনে উত্তেজনাটা টের পাচ্ছিল রিন্টু। আঃ,  একটা সিগারেটের জন্য বড্ড আঁকড়াচ্ছে মনটা।হিসেব আর নিকেশ, নিকেশ আর হিসেব,মগজে টোকা খাচ্ছে তার এখন  ক্যারামের ঘুঁটির মত, আঃ একটা সিগারেট এই সময়।নাঃ, ওয়াগান ব্রেকার অতীতের মত আরো কিছু কিছু পুরোন দাগ, অভ্যাস ছাড়তে হয়েছে তাকে।মস্তিষ্কে অক্সিজেন সাপ্লাই নাকি কম হয়, প্রেশার টাও হাই যাচ্ছে।তবু যে পার্টি এতটা ভরসা রেখেছে তার উপর, কারণ এই হিসেব আর নিকেশ এই ঘুঁটি দুটোকে চমৎকার মসৃণ ভাবে ম্যানেজ করতে পারে সে।ট্রেনটার সামনে জড়ো বস্তির ভীড়টাকে আবার ফোকাস করল রিন্টু।এতগুলো না এতগুলোই ফোকাসে রাখার প্রয়োজন নেই কোন।ব্যাকগ্রাউন্ড ঝাপসা করে মূল অবজেক্ট কে ফোকাসের জন্য খুঁজছে এখন রিন্টু ঘোষের চোখ।আর সেটা ধীরেধীরে স্থির হচ্ছে সামনের সারিতে থাকা দপদপে একটা মুখের উপর।লালচে চুল উড়ছে সেখানে।রিন্টু ঘোষের চোখ সরু হচ্ছে।একটা পাত্তা না দেওয়া, দুনিয়া নস্যাৎ করে দেওয়া মুখ, আস্ত একটা পাড়া হাতের মুঠোয় করে রেখেছে।রিন্টুর লোকেরা অবধি দুচার বার সেখানে ঢোকার চেষ্টা করে সুবিধে করতে পারে নি।বাকি মুখগুলো এখন ঝাপসা।জ্বলজ্বলে একটা মুখে রিন্টু মিলিয়ে নিচ্ছে তার হিসেব।পার্টির জমায়েত গুলোতেও যায় না এই শালী।কম্বল বিতরণেও না।অনেক বছরের চেনা মুখ, অনেক বছর ধরে দেখে আসা অসহ্য গুমোরের একটা মুখ।বস্তির লোকেদের লাইনের ওপারে ধাঙড় পাড়ায় পুনর্বাসনের প্রস্তাবেও বাধা দিচ্ছে এই মেয়েছেলেটাই।গা ঝাড়া দিয়ে খুবই শান্ত পায়ে এবার ভীড়টার দিকে হাঁটতে শুরু করল রিন্টু।হিসেব হয়ে গেছে তার।বাকিটুকু বাকি শুধু।


গোটা ঘটনাটাই, জটাই রিন্টুর গতিবিধি সমেত লক্ষ্য করছিল আরো একজোড়া চোখ।রিন্টু অবশ্য এখন আর জটাই রিন্টু নেই, গত ইলেকশনে দাঁড়িয়ে এম এল এ হয়েছে, সেই বিখ্যাত মাটি ছোঁয়া মানতের জটাও নেই।কোন গহীন মনস্কামনা পূর্ণ করে সেটি বিদায় নিয়েছে।রেললাইনের ধারের চেপ্টে থাকা জড়োসড়ো বাড়িটা এখন তেতলা।একতলায় রিন্টুর অফিস ঘরে দিনভর মাছির মত ভীড়।একসময় রিন্টুকে মেশিন চালাতে দেখেছে লালন, আজ দেখল টগবগে একদল জনতাকে কেমন সাপুড়ের মত খেলিয়ে বশের ঝাঁপিতে পুরে ফেলছে রিন্টু।উপযুক্ত  পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি,প্রত্যেক বাসিন্দার নামে একটি তৈরি ফ্ল্যাট এই সব কিছু আদায় করার জন্যই যে পার্টি প্রস্তুত, ছাবারিয়ারা কেন একটা মাছিও যে নইলে গলতে পারবে না খুব প্রত্যয়ের সঙ্গেই বোঝাচ্ছিল রিন্টু।ভীড়ের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা কটা হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সঙ ভুঁইফোড় হয়ে গজাচ্ছিল।দুচার জন তেড়িয়ার মত কিছু বলার চেষ্টা করেছিল কিন্তু জাদুকরের সম্মোহনের মত তাদের শান্ত করে খুবই আন্তরিক ভাবে রিন্টু বোঝাচ্ছিল, এই প্রোজেক্ট আসলে একটা বিরাট সুযোগ, জবরদখল করে এতকাল বাস করে আসা মানুষের কাছে এটাই সুযোগ নিজস্ব একটুকরো বাসা আদায় করে নেবার।মেট্রোর প্রোজেক্টে তাই হচ্ছে, ছাবারিয়ারা ও তাই করতে বাধ্য।সর্বশক্তি দিয়ে পার্টি, তার মহামহিম নেতৃত্ব মানুষের সঙ্গে আছে।লোকগুলোকে কথা দিয়ে খেলিয়ে চমৎকার ভাবে রেললাইনের একপাশে সরিয়ে আনছিল রিন্টু,আচমকাই নাকের ডগায় নেচে উঠল একটা তর্জনী। “ এই শালা কোন হরিদাস পাল রে তুই, ফোঁপর দালালি করতে এসেছিস।তিন বছর আগে বলেছিলি না এই জমিগুলো আমাদের পাইয়ে দেওয়ার জন্য লড়বে তোর পার্টি।কোথায় রে কারুর বাপের টিকি দেখলাম না তো।এখন কে জানে আবার কাদের টাকা খেয়েই দালালি করতে এসেছিস।যা ফোট।একদম ফোট।আমাদের বাপের জমি আমরা বুঝে নেব।তোর পার্টিকে মাথা গলাতে হবে না।এ এ এ,” মুখ ঘুরিয়ে ঠিক রোজ সকালের মত এক খাবলা থুতু ফেলে গৌরি, “ দরদ! আমাদের জন্য দরদ দেখাতে এসেছে।” রিন্টুর হকচকানো মুখটা চেটেপুটে নিচ্ছিল লালন, হঠাৎ ভীড়ের মধ্যে তার দিকে গৌরিকে তাকাতে দেখেই মাথা নীচু করে ফেলে, এখন আর গৌরিকে দেখা যাচ্ছে না, আসতে আসতে গুটিয়ে ফিরে যেতে যেতে লালন শুনতে পায় একটা তীক্ষ্ণ গলা, “ যা যা, আমরা কেঁচো নই, ভয়ে গর্তে সেঁধিয়ে যাব, তোর পার্টিকে বলে দে গে আমাদের ঠেকা নিতে হবে না।কোত্থাও যাব না আমরা, কোন ফেলাট টেলাট চাই না, এইখানে ছিলাম, এইখানেই থাকব।” কথাগুলো শুধু রিন্টুকেই বলল? গলাটা আরো চড়ে গেল না, সেটা তাকে,তাকেই দেখে।কেঁচো? লালনকে তাই শোনালো না গৌরি।লালন টের পেল ঠিক সেই দুপুরের মত একটা পাগলা রাগের ঘূর্ণি উঠে আসছে তার শরীর বেয়ে।যা খুশি,  যা খুশি তাই বলে যাবে, এই মেয়েছেলেটা তাকে সারাজীবন! কি করবে, এইতো এই আছড়ে পড়া রাগ পোড়াচ্ছে তার শরীর এখন, কি করবে, কি করতে পারে সে এখন, খুব বেশি কিছু তাদের করার নেই, কোনকালেই কি ছিল! কবে আর বুঝবে গৌরি নামের সেই হাহাকারটা তার।


সাওধান, খুউব সাওধান গৌরি।ফিসফিস করে বলে গেল নাকি কেউ? রিন্টু ঘোষের চোখে ভয় দেখেছে গৌরি সকালবেলা।কিন্তু ভয় পুষে রিন্টুর মত লোকের দিন চলে না।গৌরি জানে কাজটা সে ঠিক করেনি।বস্তুত কিছুই করার নেই তার।বস্তির লোকেরাই অনেকে নির্ঝঞ্ঝাট পুনর্বাসন চায়।নিজের ঘর কথাটুকু আজো মানুষ কে বড় আচ্ছন্ন করে।এই অবরোধ ইত্যাদি সবই যতটুকু পারা যায় আদায় করার জন্যই তো।ভিতরে ভিতরে গৌরি তো জানেই পার্টি সব গুছিয়েই করছে, বস্তির লোকেই অনেকে আছে তার ভিতর।তবু যে সব জেনেবুঝেও তেড়েফুঁড়ে গেল সে কারণ ভীড়ের মধ্যে একটা মুখ।তামাশা দেখতে আসা।গৌরির হেরে যাওয়া, ভয়ে গুটিয়ে যাওয়া, মাথা ঝুঁকিয়ে থাকা দেখতে আসা একটা মুখ।শুনশান বন্ধ চটকলের পাশের রাস্তাটা দিয়ে হাঁটুর দাওয়াই নিয়ে ডাক্তারের কাছ থেকে ফেরার পথে সেই মুখটাই ভাবছিল গৌরি।তার দ্রুত চলনের খুব কাছ ঘেঁষে নিঃশব্দে পিছন থেকে এগিয়ে আসা একজোড়া পা সে খেয়াল করেনি মোটে।


এমন বাদলেই ভেঙে ছিল তার ঘর।এমন এক বারিষেই ডেকেছিল তাকে ঘর।সেই আওরাপন বর্ষা না নামলে, একটা লঝঝড়ে পুরোনো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, তার পাগলের মত কথা শুনে কি আর কেউ হতে চাইত তার ঘর!লালনের খুব মনে হয় বৃষ্টির একটা বড় ষড়যন্ত্র আছে তার জীবনে।আজকের বৃষ্টিটাও কি যেন একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে তাকে।সকালের অবরোধের ঘটনাটার পর সারাটা দিন বড় আলুনি কেটেছে।ভিড়ের মধ্যে তার উদ্দেশ্যেই কেঁচো কথাটা ছোঁড়া হয়েছে নিশ্চিত লালন।সেই থেকে নিশপিশে মনটাকে সামলাতে বেগ পেতে হয়েছে তাকে বেশ।মেয়েছেলেটার বড্ড বাড় বেড়েছে।তখনো মাথায় চড়েই ছিল,এখনো তাই।বস্তির ঘরে ঘরে বৌ পেটানোর রেওয়াজ।একটা দিন, মাত্র একটা দিন গায়ে হাত তুলেছিল বলে মটমটিয়ে চলে যাবে।আর মাঝেসাঝে মেয়েমানুষের ঘরে রাত কাটানো সেও খুব বড় কথা নয়।মোটে দু বার গেছে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে।নাঃ, ভেবে দেখলে অপরাধের তুলনায় অত্যাচার সেইই সয়েছে বেশি।এই যে এতটা কাল একা বয়ে গেল, গৌরির মত সাদি তো করেনি আরেকটা।তাকে ছেড়ে খুব তো বিয়ে করলি, সেও কি লালন বোঝে না, তাকে জব্দ করার জন্যই।টিঁকতে পারলি, সেখানেও!পারলি টিঁকতে।ছেলে মেয়ে নিয়ে চলে আসতে হল না!তবে? বোতলটা ঘরের এককোণে রেখে ঠোঁট মুছল লালন।হ্যাঁ আজ খানিক গিলেছে সে।বেশ করেছে।শালা, কেঁচো, লালন কেঁচো! বড্ড বাড় বেড়েছে মাগীর।হাতের নাগালে, একবার, একবার দরকার, শুধু। একা, একা পাই দাঁড়া, একা রাস্তায়, একা আ ..আজ শুক্রবার না? হ্যাঁ, শুক্রবার ওই চটকলের হোমিওপ্যাথটার কাছে যায় গৌরি।আজ, আজ কি যাবে? বাইরে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে।লালন শুনতে পেল অন্ধকারে জলের একটানা ঝমঝমে স্বর, যাবে,যাবে, আজ যাবে, আজ লালন, মেয়েছেলেটার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াবে।ছিঁড়েখুঁড়ে এই বৃষ্টির মত দেখবে কোথায়,কোথায় এত ঘেন্না জমা থাকে এই লালন নামটার জন্য তার ভিতর।


দুপাশে উঁচু ভুতুড়ে পাঁচিল, মাঝখান দিয়ে চলে গেছে খেয়াঘাটের দিকে রাস্তাটা।রাত নটার পরে এ তল্লাট বিলকুল শুনশান।চটকল লক আউট বছর পাঁচেক।আম জাম কাঁঠালের ঝুপসি ছায়া তার চৌহদ্দি ডিঙিয়ে পিচ রাস্তাটাকেও ঠেসে ধরেছে দুপাশ থেকে।কিছু নেশাড়ুর আস্তানা সন্ধ্যের পর থেকে।তবু খেয়াঘাটের স্বল্প সংখ্যক যাত্রী চলাচল করে আটটা অবধি।তারপর এ রাস্তা নিজের সাথে নিজে কথা কয়।এটাই গৌরির শর্টকাট, সুতরাং সে এ পথেই শুক্কুরবার করে ডাক্তার দেখাতে গেলে ফেরে।নেশাখোর, জুয়ারে কেউ তাকে ঘাঁটাবে এমন কষ্ট কল্পনা তার চৌহদ্দিতে নেই।ছুকরি বয়েস হলেও কথা ছিল।আর সে বয়েসেই যখন কেউ সাহস পায় নি, তখন এই নাতিপুতির মুখ দেখা কালে আর ভয়টা কি।তবে আজ এই মারকাটারি বৃষ্টি টা এসে পড়ায় রাস্তার ছমছমে ভাবটা বড্ড গিলে খাচ্ছিল।এরম বৃষ্টি এলে এভাবে, কি যেন সব কেড়েকুড়ে নেয়, খিমচে ধরে বুকের ভিতর।বেখবরের বান ডাকে অবেলার, খুব কাছেই অথচ নাগালের বাইরে যেন কোথায় একটা।জোরে জোরেই পা চালাচ্ছিল গৌরি, বৃষ্টির পথটুকু এত নির্জন ভালো নয়, কে যেন বলছিল তার ভিতর।আজো এমন ভাসানের বৃষ্টি নামলে, একটাই মুখ দপদপায়।ভাল নয়, সেসব খুঁচিয়ে ওঠা ভাল নয়।ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি বলছিল ভাল নয়।ভাল নয়।কাছেই, খুব কাছেই বিদ্যুৎ চমকটা দেখতে পেয়েছিল গৌরি।আকাশটাকে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হিলহিলে চাবুকটার মতোই মাথার পিছনে আচমকা একটা আছড়ে পড়া তীব্র আঘাত টের পেল সে।চোখের সামনে নিঃশব্দ বজ্রপাতে এখন ঝলসে যাচ্ছে অন্ধকার।তবু তার মধ্যেই মুখটা চিনতে অসুবিধা হয়নি গৌরির।


চোখ বন্ধ আর খোলার মাঝের সময়টুকুর হিসেব নেই কোন।মাথার পিছন চেপে ধরা দশ আঙুল চ্যাটচ্যাটে এখন।তবু গৌরি টের পেল মরেনি,বেঁচেই আছে কারণ চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে পিচ রাস্তার উপর আছড়ে পড়ল মদের বোতলটা।বৃষ্টির মত ছিটকে পড়া কাঁচের টুকরো থেকেই একটা তুলে নিচ্ছে লালন।ব্যথা, ভয়,আতঙ্ক, বিস্ময় সব ছাপিয়ে এই মুহূর্তে গৌরি টের পেল সে তলিয়ে যাচ্ছে যার মধ্যে সেটা অবিশ্বাস।বাধা দিতে চাইছে সে প্রাণপণ, ঠেকাতে চাইছে লালনকে কিন্তু উঠে দাঁড়াবার আগেই আরেকটা বিদ্যুৎ চমকে গৌরি দেখল ভাঙা কাঁচের তেকোণা খন্ডটা  হাতে ধরে থাকা লালনের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে লোকটা,লোহার রডটা হাতেই।কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র।তারপর ঠোঁট ফাঁক হতে দেখল গৌরি লোকটার,মুহূর্মুহূ বিদ্যুৎ ঝলকে।একটা শব্দ ও কানে এল না।সব শব্দ এমনকি সব দৃশ্য ও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে এখন চোখের সামনে থেকে তার, মরে যাক, সে মরে যাক, এই তো সেই দুটো চোখ দেখতে পাচ্ছে সামনে সে এখন তার, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার জন্য, তারই জন্য, হারিয়ে যায় যদি আবার, মরে যাক, এই বৃষ্টি তেই আজ সে মরে যাক।


কেউ উঠিয়ে নিচ্ছে তাকে।নাম ধরে ডাকছে তার।এক আকাশ বৃষ্টি এখন তাদের ঘর।নদীর মত ভেসে যাচ্ছে সে।কপাট খোলা, দুয়ার ভাঙা প্রকান্ড ঘরের হা হা বাতাসের মত বয়ে যাচ্ছে সে।মুখের উপর ঝুঁকে পড়া সেই মুখ,কতকাল ধরে খুঁজছে সে।কি বলছে লালন, পালিয়ে যেতে, ভীষণ জরুরি এখন পালিয়ে যাওয়া? গুন্ডাগুলো ফিরে আসতে পারে আবার।কি কি বলছে লালন। “ঘরের কথা বল লালন, সেই যে বলেছিলি, তেমন করে ঘরের কথা কেউ বলেনি কখনো গৌরিকে।” দশটা চটচটে আঙুলে টুপটুপে জল ঝরা গাছের মত একটা মুখে ঘর খোঁজে গৌরি, এই বৃষ্টির ঝাপসা দেওয়ালটুকু হারিয়ে যাওয়ার আগেই, এই কখনো না দেখা প্রত্যয়ী চোখ দুটো হারিয়ে যাওয়ার আগেই আবার খুঁজে নিতে হবে তাকে।কিছু কি বলল সে।কি বলল?গৌরি নিজের কথা শুনতে পায় না।অনেক দূর থেকে ভেসে আসে কপাট খোলা বাড়ির ঘর দুয়ারে ডেকে ফেরা হা হা বাতাসের স্বর, “ যাব না, কোথায় যাব বল!এখানেই তো আমাদের ঘর”, ওঠার চেষ্টা করে গৌরি, কে বলছে তাকে, কে বলল, “ হারিস না, গৌরি, হারিস না, আমি তোর হার দেখতে পারি না...এই তো এসেছি, একবার দেখিয়ে দে শুধু কত ঘেন্না।” এত এত বছরের কত কষ্টের জমানো ঘেন্না সব ধুয়ে যায়,এইটুকু একটা বৃষ্টিতে!শহরের পাপ ধুতে ধুতে ক্লান্ত বৃষ্টি তখন বহুকাল পরে আবার জুড়ায় একজোড়া ঠোঁটের আশ্রয়ে।




1 comment:

  1. বাহ্, মেদুর,মোহময়, দীর্ঘশ্বাস আছে বটে, তবে এক অদ্ভুত অনুভূতিও আছে। সব মিলিয়ে বেশ তৃপ্তি পেলাম...

    ReplyDelete