Monday, December 31

অণুগল্প : অরবিন্দ তন্ত্রী






একটি প্রণাম এবং অনামিকা

শুরুটা এরকম-- আঙ্কল এটা কি তোমার বার্থ-- সরকারি কাজে বাইরের শহরে যাচ্ছি , রাতের ট্রেন--সংরক্ষিত বার্থে বসে ছোট্ট উত্তর দিলাম--হ্যাঁ ; সঙ্গের লাগেজ গুছিয়ে জরুরি ফোনে ব্যাস্ত, ট্রেন নির্দিষ্ট সময়েই ছেড়েছে-- দূরপাল্লার ট্রেন ছাড়ে সময় মেনে পৌঁছানোর হিসাব থাকেনা ... আবার সেই রিনরিনে গলা -- আঙ্কল তুমি কি ডিনার করেই এসেছো  ? .....এবার মুখ তুলে তাকালাম-- ঠিক অপোজিট বার্থে সময়োপযোগী পোষাকে উজ্জ্বল তরুণী,শান্তচাহনি -একঅদ্ভুত লাবণ্যে মাখামাখি, ঘিরে আছে চেনা চেনা গন্ধ ,
দেখি ব্যাগ থেকে টিফিনবক্স বার করছে , একটু অবাকিই হলাম, জানা নেই শোনা নেই একেবারে তুমি দিয়েই শুরু ,ডিনারের খোঁজ ! এবার ও ছোট্ট উত্তর দিলাম--হ্যাঁ রাতের খাবার খেয়েই এসেছি  ....তরুণী ডিনারে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল , আমি রাতের শয্যার প্রস্তুতি শুরু করলাম । তরুণীর নাম শোনা  হল না  ; ডিনারশেষে শয্যা প্রস্তুতির মুহুর্তে অসাবধানে পায়ে পা লেগে যায়
দেখলাম অপ্রস্তুত তরুণী আমার দু পা স্পর্শ করে প্রণাম করল এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শির স্পর্শ করে আমার মুখে উচ্চারিত হল-- শুভমস্তু , কল্যাণ হোক , দীর্ঘজীবী হও......
                  অভ্যাস মতো ভোরের আলো আমাকে জাগিয়েছে , বিপরীত বার্থে চাদর        মুড়ি দিয়ে তরুণী গভীর নিদ্রায় ; ওয়াশরুম
ঘুরে ফিরে এলাম নিজের বার্থে, দেখি উঠে
বসেছে তরুণী , জানালা গলা সকালের প্রথম আলোয় উদ্ভাসিত , নিশ্চিন্ত নিদ্রার কোমলতা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে  ; এবার আর চুপ করে থাকতে পারলাম না , আমিই শুরু করলাম-- কি রে কি হল এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লি ... ? মন ভালো করা এক মুখ ঐশ্বর্যের হাসি ছড়িয়ে জবাব এলো-আঙ্কল আমি ও তোমার মতো আর্লিরাইজার,উঠিসকালেই , আমারহোস্টেল রাত্রি এগারোটা বাজতে না বাজতেই ঘুমিয়ে

পড়ে, আলো বন্ধ হয়ে যায়  ...... তরুণীর নাম জিজ্ঞাসা করা হল না  ; আলাপচারিতায় ঘনত্ব বাড়ে, ক্রমশঃ এগোয় ...... বি টেক মাল্টিমিডিয়া সেকেণ্ড ইয়ার, ছাত্র জীবনের বেশিটাই নিজভূমে পরবাস ,হোস্টেলে দিনগুজরান বাড়িতে বাবা মা মাধ্যমিকের ছোট ভাই  , মোটামুটি ত্রৈমাসিক বাড়ি ফেরা ; কথার পিঠে কথকতার শিলমোহর, বাধাহীন দিক পরিবর্তন ও কম নেই-- আচমকা ফিরে আসে গতরাতের প্রণাম এপিসোড--আচ্ছা চলার পথে পায়ে পা লেগে যাওয়া-এতো হামেশাই হয় -- বড়জোর কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রতিনমস্কার করে কিন্তু পদস্পর্শ--উঁহু মনে করতে পারছি না ..এত বছরের যাত্রা পথে প্রথম অভিজ্ঞতা--আবার সেই মুক্ত    ঝলকানো  শীতের নরম রোদের হাসি ....না আঙ্কল বিশেষ তেমন কিছুই নয় ,আসলে এই সব ছোট ছোট মূল্যবোধ আমাদের জীবন এগিয়ে নিয়ে যায়--চলার পথে   পাথেয়   বলতে   পারো ,  বড়দের আশীর্বাদ  শুভকামনা  সেই  পাথেয়কে সমৃদ্ধ করে .. আমাদের গল্প বেশ জমে উঠেছে , ছুটছে মোটামুটি বল্গাহীন--প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে ! অল্প আগে ও যে আমরা পুরোটাই অপরিচিত ছিলাম এখন তা আর একেবারেই মনে হচ্ছে না ; ..আচ্ছা আঙ্কল তুমি ও তো আমার মাথা ছুঁয়ে আশীর্বাদ করলে, যতটুকু বুঝেছি তা পুরোটাই লোক দেখানো নয় ... তুমি ও তো আমায় চিনতে না .... ওর নাম তখনো জানা হয়ে ওঠে নি ,কিন্তু বুকেরভেতর দলা পাকানো ভালোলাগা...সমাজ এখনো মানবিক ঐশ্বর্যের ঘ্রাণে ম ম করছে এখনি গেল গেল র সত্যিই কিছু হয় নি, নেবার মতো এ সংসার এখন ও যথেষ্ট ধনী ! ইতি মধ্যে নিকট আত্মীয়ের সতর্কবার্তা-- আর মাত্র দুটো , তার পরেই তোমার স্টেশন , হুড়পাড় কোরো না , যথেষ্ট  সময় বাকি ...  নামার সময় সঙ্গী হয়ে
দরোজা পর্যন্ত এলো, সগতোক্তির মতো যেন শুনলাম-- আমার পাক্কা তিন ঘণ্টা ...সামান্য বিষণ্ণতা কি কোথা ও ছিলো  ?....বহু যাত্রী তখনো চাদরে মোড়া  , নাসারন্ধ্রে মৃদু ফরর-- ফরর আওয়াজ  ;  ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রেন ছুটছে  , ক্রমশঃ মিলিয়ে যাচ্ছে চাকার ধাতব শব্দ ..... গন্তব্য স্টেশন ছাড়া তরুণীর আর কিচ্ছু জানা হল না ...........



No comments:

Post a Comment