Monday, December 31

গল্প : সুমন্ত কুন্ডু






ছাতা হারাবেন না


ভর্তি বাজারের থলি হাতে নিশ্চিন্ত মনেই বাড়ি ফিরছিলেন মনোহর বাবু, হঠাৎ মাঝরাস্তায় তার খেয়াল পড়লো তিনি ছাতাটি হারিয়েছেন ! এবং মনে পড়া মাত্রই মনের ফুরফুরে মেজাজটি মুহূর্তের মধ্যে চটকে গেল । যাবারই কথা, ঘরে ফিরে ছাতা হারানোর সংবাদটি দিলে, স্ত্রী মালিনী দেবী যে রণচণ্ডী মুর্তি ধারণ করবেন তা মনোহর বাবুর পক্ষে সামলানো কঠিন ।

বাজারে বেরোনার সময় পইপই করে মালিনী চেতবানি শুনিয়েছিল ‘ছাতাটা হারাবে না, মনে করে নিয়ে যাবে, মনে করে নিয়ে আসবে । যা বেয়াক্কেলে মানুষ তুমি এই করে এমাসে তিনটে হল’ ।

‘স্ত্রীবাক্য শিরোধার্য’ জ্ঞান করে কথাটা মনোহর বাবুর মনে নিয়েছিলেন । কিন্তু তামাম বাজার ঘুরে সংসারের যাবতীয় প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামস্রী লিস্ট মিলিয়ে আরোহণ করে ফিরে আসার পথে মনটি যে কোন দুর্ভাবনার অন্তরালে তাকে ফাঁকি দিয়ে স্ত্রীর অমন অমোঘ চেতবানীটিও ভুলিয়ে দিলো তা তিনি কিছুতেই মনে করতে পারলেন না । দোষটা তারই । ছাতা হারানোর ছেলেমানুষিটা একপ্রকার মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে। যেখানে সেখানে ছাতা ভুলে ফেলে আসেন, সহৃদয় কেউ দেখলে খোঁজ দেন নয়ত ছাতাটির বেঘোরে বিয়োগ ঘটে ।মালিনী দেবী ততই রেগে যান । তার  জিহ্বা করলা-নিম-কালমেঘ প্রভৃতি তিক্ত ও কড়া স্বাদের বস্তুর একত্র সমন্বয় হয়ে ওঠে । ধাঁধাঁ করে তার মুখনিঃসৃত বাক্যবাণগুলি মনোহর বাবুর একদম ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া’ অন্তঃস্থলকে চূর্ণ-বিচুর্ণ করিয়া দেয় । ওনার জীবনে ওইটি সবচেয়ে অসহায় মুহূর্ত ।



না ! মনোহর বাবু আর ভাবলেন না । ছাতাটার খোঁজ করতে হবে । বাজারে তিনি যে যে দোকানে গিয়েছেন, যার যার সাথে আলাপ করেছেন সবাইকে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন । ছাতা না নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরবেন না । অগত্যা, অর্ধেক রাস্তা অতিক্রম করে আবার তিনি বাজারে ফিরে এলেন । দেউলহাটের এই বাজারটা বেশ বড় । আজকে হাটবার, ক্রেতা বিক্রেতার ভিড়ে জমজমাট ।

মনোহর বাবু বাজারে পুনরাগমন করে প্রথমেই  ঢুকলেন ‘মা লক্ষ্মী ভাণ্ডারে’ । চিন্তিত মুখে তাকে  ফিরে আসতে দেখে মা লক্ষ্মী ভাণ্ডারের তারপদ মুদি জিজ্ঞাসা করলেন ‘দাদা! কিছু ভুলে গেছেন নাকি?”

মনোহর বাবু চিন্তিত মুখে উত্তর দিলেন ‘ছাতা’

‘ছাতা!’ – তারপদ মুদি অবাক ! তিনি তো ছাতা বেচেন না ।

‘আসলে ছাতাটা কোথায় হারালাম খুঁজে পাচ্ছি না । এখানে ফেলে যায়নি তো” মনোহর বাবু সমস্যাটা খোলসা করলেন ।

‘কই দেখিনি তো, আপনি তো সামনের বেঞ্চিটায় বসেছিলেন, দেখুন ফেলে গেলে থাকবে । কত লোক আসছে যাচ্ছে, কে আর অতো নজর দিচ্ছে’ তারাপদ চটজলদি জবাব দিয়ে অন্য খদ্দেরের ফর্দ বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল । মনোহর বাবু বেঞ্চির আশেপাশে দেখলেন, কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি নেই । মুদিকে পুনরায় জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা হল না । খদ্দের সামলাতে সে ব্যস্ত । ব্যর্থ মনোরথ মনোহর সরখেল মুদির দোকান থেকে আশাহত হয়েই বেরিয়ে পাশের স্টেশানারি দোকানটিতে ঢুকলেন । এখানেও ব্যপারটি একইরকম ঘটল । ছাতা পেলেন না তিনি । এবার হেঁটে এলেন ওষুধের দোকানে । বউয়ের হাঁটুতে ব্যথার জন্য মলম কিনতে এই দোকানেও ঢুকেছিলেন একবার । ওষুধের দোকানেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল । পরপর কয়েকটি যায়গায় ব্যর্থ হয়ে তিনি ভেতরে ভেতরে দমে গেলেন অনেকটা । তবুও হাল ছাড়লেন না । আজ যদি তিনি ছত্রহীন হয়ে বাড়ি ফেরেন তাহলে দাম্পত্য কলহের যে তিক্ততম পাঁচনটি গিলতে হবে তার জন্য সংসার ত্যাগ করে মুনিঋষি হয়ে যেতে হয় । অতএব ছাতা ছাড়া তিনি ফিরছেন না ।  নতুন উদ্যমে আবার শুরু করলেন । একে একে জেরক্সের দোকান, দশকর্মার দোকান, ফলের দোকান সর্বত্রই ঢুঁ মারলেন ।  হৃত ছাতা পুনরুদ্ধার হল না কোথায় । তার মনের আশার কাঁটাটি ক্রমশ ধীরে অথচ নিশ্চিত ভাবে নিরাশার দিকে ঢলতে শুরু করল ।



এবার তিনি হাটে ঢুকলেন । কাঁচা আনাজের ছাউনিগুলোয় একে একে খোঁজ করলেন । সব দোকানেই ভ্রুকুঞ্চিত শ্রীমুখখানি উপস্থাপন করে  ‘দাদা আমার ছাতাটা ফেলি গেছি? দেখছেন?’ বেদবাক্যের মতো কথা কয়টি উচ্চারণ করে গেলেন । প্রত্যুত্তরে সর্বত্রই ‘না’ শুনে শুনে ভেতর থেকে দমে গেলেন । তবু হাল ছাড়লেন না । বউয়ের মুখনিঃসৃত নিম-করলার পাঁচনটির দিব্যি রেখে তিনি তন্ন তন্ন করে গোটা বাজারটা চশে ফেললেন । সবজি বাজার ছেড়ে মাছের বাজার, সেখান থেকে মশলা মরিচের দোকান, চারাগাছ বিক্রির ছাউনি, পাইকারি বাজার, ধূপ দশকর্মা, অলি গলি, বাদ দিলেন না কোথাও কিন্তু নিট ফল সেই শুন্যই রয়ে গেল । অনেকখানি কায়িক, মানসিক ও আত্মিক পরিশ্রমের পরও তিনি ছাতাটি খুঁজে পেলেন না । নিদারুণ আশাভঙ্গের ব্যর্থতায় মুহ্যমান হয়ে ক্রমশ ছিমিয়ে পড়লেন ।  হাটবারের এই প্রবল ভিড়ের সাপেক্ষে তার কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি নিতান্তই ক্ষুদ্র এবং সহজে বহনযোগ্য । কাজেই বস্তুটি কেউ যে ঝেপে দিয়েছে এসম্ভবনা প্রবল । মনোহর বাবু নিজেকে প্রবোধ দিতে শুরু করলেন । রোদের উত্তাপ বাড়তে শুরু করেছে । সরবাঙ্গে ঘাম ঝরছে তার । পরিশ্রম এবং দুশ্ছিন্তার যুগপৎ আক্রমনে তিনি বিধ্বস্ত । আর পারছেন না । স্ত্রী আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য এবার অন্যরকম তোষণমূলক নীতি নেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করছেন ।

এমনই মানসিক ভাঙনকালে তিনি মৃদু পায়ে হাটের পাশের চায়ের দোকানটায় ঢুকলেন । বাজার করার সময়ও এ’দোকানে ঢুকেছিলেন একবার ।  দোকানের ছেলেটা মুখচেনা, নাম বিশু। যদিও জানেন যে এখানেও ছাতার খোঁজ না পাওয়ার সম্ভবনাই প্রবল তবুও  ছাতা হারানোর সর্বনাশের  কথাটি আবারও একবার ব্যক্ত করে তিনি বিশুর নয়ন দুটির দিকে জিজ্ঞাসু আঁখিপাত রেখে  চাতকপাখির ন্যায় ব্যকুলতা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন  -‘বিশু, ভাই দেখেছো নাকি ছাতাটা?”

বিশু একটু ভাবল । খানিক মাথা চুলকে বলল ‘আপনার ছাতা, একটু আকাশি রঙের কি ?’

এই প্রথম মনোহর বাবু কারোর কাছ থেকে আশাজনক উত্তর পেলেন, মনটা নেচে উঠল । কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ছাতার রঙটা তার মনে ছিল না । বস্তুজগতের প্রতি এতো পঙ্খানুপুঙ্খ দৃষ্টিপাত মনোহর বাবুর কোনোদিনই ছিল না । কাজেই রং মেলানো গেল না, তবে তাতেও আশ্বানিত হয়েই বললেন ‘হ্যাঁ ওইরকমই । পেয়েছ নাকি ভাই !”

‘না পাইনি তবে আপনার যাওয়ার পর যেন ওইরকম একটা ছাতা গণেশ দার হাতে দেখছিলাম । অবশ্য ওটা গণেশ দার ছাতাও হতে পারে’

হুম তা পারে তবুও মনোহর বাবুর বুকে একদলা আশার আলো ছলাত করে উঠলো । একবার গনেশের কাছে খোঁজ নিয়ে দেখবে নাকি । ওনারই ভুল করে ফেলে যাওয়া ছাতাটিই হয়ত গণেশ নিয়ে গেছে । খোঁজ পেলে নিশ্চয়ই গণেশ ফিরিয়ে দেবে । গণেশ ঘোষকে কে তিনি চেনেন, মৌখিক একটা সম্ভাষণের সম্পর্ক আছে কাজেই গণেশ যদি ভুল করে বা জ্ঞানতই বেওয়ারিশ ছাতাটি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে থাকে একবার খোঁজ করা নিতান্ত দৃষ্টিকটু হবে না । মনে মনে সংকল্প দানা বাঁধল, তাছাড়া শেষ চেষ্টা বলতে এই একটিই হাতে রয়েছে, আর কোথাও কোন সম্ভবনা নেই । অতএব তিনি বেরুলেন ।

গণেশ ঘোষের বাড়িটা হেঁটে যাওয়া যায় কিন্তু রিস্ক না নিয়ে তিনি রিস্কা নিলেন । হেঁটে যাওয়ার মতো জোর আর অবশিষ্ট নাই ।

গনেশের ঘরে পৌঁছে কড়া নাড়তেই ব্যাজার মুখে গণেশ বেরুলো । ‘কি মনোহর দা, এমন অসময়ে?’ কিঞ্চিৎ আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞেস করল ।

‘আসলে বিশুর চায়ের দোকানে আমার ছাতাটা ভুল করে ফেলে এসেছিলাম । বিশু বলল তুমি নাকি ওটা নিয়ে এসেছ?’ নিষ্পাপ মনেই মনোহর বাবু কথাটা বললেন । কিন্তু কথাটার অর্থ এবং ইঙ্গিত গনেশের পক্ষে সুখদায়ক হল না ।

‘কে ? বিশু, বিশু বলেছে এরকম কথা ! আমি আপানার ছাতা নিয়ে চলে এসেছি । আমি চোর, এতবড় অপবাদ’ – গণেশ তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলো । ব্যাপারটা এদিকে গড়াবে মনোহর বাবু ভাবনেনি । গনেশকে শান্ত করতে করতে বলল ‘ও এভাবে বলেনি । মানে ভুল করে তুমি যদি নিজের ছাতা মনে করে আমারটা নিয়ে চলে আসো । আমি উঠে যাওয়ার পরই তুমি এসেছিলে কিনা তাই’ ।

গনেশের চোখদুটো লাল হয়ে রইলো । সটান নিজের রুমে গিয়ে একটা আকাশি রঙের ছাতা নিয়ে এলো । ‘এই দেখুন, এটা আমার ছাতা, বাঁটে আমার নাম খোদাই আছে’ বলে মনোহরের মুখের উপর ছাতাটা ধরল  । মনোহর বাবু হুমড়ি খেয়ে ছাতার ওপর পড়লেন একবারে । গনেশের কথাটা ঠিক, ছাতাটা ওর নিজেরই । বাঁটে সোনালি রঙে জি জি অর্থাৎ গণেশ ঘোষ খোদাই আছে বটে । এ ছাতা মনোহর বাবুর নয় ।



এর পরের ঘটনার আর অনুপুঙ্খ বিবরণ নিষ্প্রয়োজন ।মাঝসমুদ্রে হাল ভাঙা নাবিকের মতো মনোহর বাবু ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীর টাকে টেনে টেনে ফিরে এলেন । ‘যা আছে কপালে’ এই আপ্তবাক্য টাকেই অবলম্বন করে ধীর বিষণ্ণ পায়ে স্ত্রীর এক্তিয়ারে প্রবেশ করলেন । তিনি জানেন নিদারুণ এক ঝড়ের মুখোমুখি পড়তে চলেছেন ।

চোরের মতো নিঃশব্দ পদচারনায় সদর দরজা পেরিয়ে রান্নাঘরের দাওয়ার সামনে পৌঁছালেন । স্ত্রীকে কাছে পিঠে দেখতে পেলেন না ।

ধীরে ধীরে বাজারের ব্যগটা নামালেন । বুকের ভিতরের ঢিপ ঢিপ আওয়াজটা বাড়ছে । কোনোক্রমে স্ত্রীর মুখোমুখি হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন । চুপি চুপি নিজের ঘরের দিকে পা টিপে টিপে পা বাড়ালেন ।

‘কোথায় ছিলে, এতো বেলা হল’- পিছন থেকে স্ত্রীর কণ্ঠস্বরটা ঝম করে বাজলো হটাৎ। দাঁড়ালেন মনোহর বাবু । ঘুরে তাকালেন । তার চোখেমুখে পরিশ্রমের ছাপ সুপস্ট  । স্ত্রীর চোখেও নানারকমের আলো ঝিলিক দিচ্ছে । কোনটা রাগের, কোনটা বিরক্তির , কোনটা তিরস্কারের । মনোহর বাবু চুপ করে রইলেন । তিনি অপেক্ষা করছেন মালিনীর মুখ থেকে ‘ছাতা কোথায়?’ এই নিশ্চিত জিজ্ঞাসাটুকুই বেরিয়ে আসার ।কিন্তু সেরকম হল না, এমত অবস্থায় মালিনী দেবীর জিহ্বা চিরপরিচিত করলা-নিম-কালমেঘ মিশ্রিত তিক্ততম পাঁচন না হয়ে অপেক্ষাকৃত তরল আন্তরিকতার সুধা মিশ্রিত শ্রুতিমধুর হয়ে বলে উঠল ‘ইশ ! ঘামে তো একদম ভিজে গেছো । কতবার বলেছি বাইরে বেরুলে ছাতা নিয়ে বেরুতে । তোমার টেবিলেই ছাতাটা গুছিয়ে রেখে দিলাম, তাও নিয়ে যেতে ভুলে গেলে । কি যে বে আক্কেলে মন তোমার’

মনোহর বাবু এমন মধুর কণ্ঠস্বর শোনার পড়েও তারিতাহতের মতো হয়ে পড়লেন । ছাতা, আমার ছাতা, টেবিলের ওপর ! নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি । পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় মিথ্যে আর কিছু হয়না ।



রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে ঘরে ঢুকলেন তিনি ।  পাট করে মোড়া সুসজ্জিত ছাতাটি বাচ্ছা শিশুর মতো টেবিলের প্রশস্ত বুকে পরম সুখে শুয়ে আছে । আকাশি রঙের একটি মানব শিশুই যেন বা । নিষ্পাপ, নিরুপদ্রপ । সকালে বাজার বেরোনার আগেই ছাতাটিকে টেবিলের ওপর রেখে মালিনী তার ‘ছাতা হারাবে না শীর্ষক’ কঠিন চেতবানিটি শোনাচ্ছিলেন । মনোহর বাবু বানীটি কানে নিলেন, চেতনা মননে নিলেন কিন্তু উল্লেক্ষিত বস্তুটি যে  ভুল করে টেবিলেই ফেলে রেখে গেলেন তা আর স্মরণে নিতে পারলেন না ।  বস্তুজগতের জাড্য ধর্ম মেনে বস্তুটি ধীর স্থির ওইখানেই পড়ে রইল পুরো সময়টা । যে নিদারুণ সময়টার পুরোটা জুড়ে  মনোহর বাবু গোটা দেউলহাটের বাজারকে তন্নতন্ন করে তোলপাড় করছিলেন ।

পার্থিব পৃথিবীর এই নিষ্ঠুরতম রসিকতায় তিনি একেবারে নীরব, নিথর হয়ে রইলেন ।

                                                         






















No comments:

Post a Comment