রণজিৎ শীল
ইলিয়াসের দুধে ভাতে উৎপাত : মানবতার প্রতীকী সংকট
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) বাংলাদেশ তথা বাংলা সাহিত্যের এক ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক ।দেশভাগের কিছু পূর্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি করা মন্বন্তর , কালোবাজারি , খাদ্য সংকটের মতো কালো মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে জন্ম নেওয়া সাহিত্যিকের রচনার শিরা উপশিরায় ঘুরে ফিরে বাংলাদেশের নানা সময়ের ঘটনা ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছে একটু লক্ষ করলে বোঝা যায় ।আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর ৫৪ বছরের জীবনে মাত্র দুটি উপন্যাস ও ২২-২৩ টি গল্প রচনা করেছেন সত্য ।সংখ্যার বিচারে নয় ভাবনার গভীরতায় , ভাষার দৃঢ়তায়, শৈলীগত নবনির্মাণে ইলিয়াস এক বলিষ্ঠ লেখক এবিষয়ে সংশয় নেই। বাবা স্কুল হেডমাস্টার অর্থাৎ নিজে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হলেও মধ্যবিত্ত জীবনচর্চার স্বাভাবিক পরিণতিতে তাঁর অবস্থান দৃঢ় ছিলনা ।তাই পরবর্তী জীবনে মধ্যবিত্তের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে ফিরে যান চাষি মজুরের জীবনে ।তাঁর এই সময়ের গল্প গুলিতে এই বীক্ষা ও চিন্তনের পরিবর্তন অন্যমাত্রা দান করেছে ।তাঁর গল্পে দেখা যায় আপসহীন আক্রমণের ভঙ্গী যেমন স্বতন্ত্র ,তেমনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাষা তীরের ফলার মতো শানিত ,সজারু কাঁটার মতো তীক্ষ্ণ ।তার গল্পের মুল কাহিনী বাস্তবের কপি পেস্ট নয় বরং গল্পের চরিত্ররা অনেক বেশি স্বপ্রতিভ।একজন সাহিত্যিকের সাথে কথোপকথনে ইলিয়াস নিজেই বলেছিলেন যে- তার গল্পের চরিত্ররা আগের থেকে ভাবনার ফলশ্রুতি নয় বরং তার গল্পের চরিত্ররাই গল্পকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ।আখতারুজ্জামান নিজে ওতপ্রোত ভাবে রাজনীতি করেননি সত্য কিন্তু রাজনৈতিক উত্থানপতন ,আন্দোলনের গতিপথ ,বিপ্লবের ভয়াল রুপ প্রত্যক্ষ করেছেন।ঢেউ লেগেছে তার অতল হৃদয়ে , তার হৃদয়কে আরথিন ছাড়া বিদ্যুৎ এর মতো ঝলসে দিয়েছে পূর্ব পাকিস্থানের মুক্তি যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি কৃষক ,মজদুর ,সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই । অনুভব কয়েছেন এপার বাংলার নকশাল আন্দোলনের তীব্রতা ।সাহিত্য ক্ষেত্রে ইলিয়াস মানিক বন্দোপাধ্যায়ের উত্তরসূরী হলেও অনেক জায়গায় তিনি মানিকের পথ থেকে অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখেছেন অটুট রেখেছেন আপন ঘরানা ।মানিক সাম্যবাদে বিশ্বাসী । তাঁর বিশ্বাস জায়গা করে নিয়েছে তাঁর সাহিত্যে ।শ্রমিক শ্রেণি, মজদুর সমাজ হয়ে উঠেছে তাঁর রচনার নিয়ন্ত্রক ।কিন্তু সুকৌশলে ইলিয়াস সেই মোহ কাটিয়ে বাংলা সাহিত্যে এক নব নির্মাণ করলেন মজদুর নয় অভিজাত নয় তাঁর গল্পের নায়ক সময় ।গল্পের চরিত্ররা শ্রেণি ভিত্তিক নিয়ন্ত্রক না হয়ে, হয়ে উঠল সময় কেন্দ্রিক নায়ক ।কিন্তু সাম্যবাদের কথা সরাসরি না বললেও অধিকারের কথা ,জীবনের প্রয়োজনীয় প্রাপ্য আদায়ের অঙ্গীকার ।তাঁর গল্পের পাঠক মাত্রই বুঝতে পারবেন দেশভাগের যন্ত্রণা ,পাকিস্থান সরকারের পূর্ব পাকিস্থানের বাংলা ভাষী মানুষের প্রতি বৈষম্য মূলক আচরণ,খাদ্য সংকট ,গ্রামের নিঃস্ব মানুষের হাহাকার ,তার গল্পের ধমনীতে নিত্য প্রবাহিত ।এর আগেই বলা হয়েছে ইলিয়াস নিজেই বলেছেন যে তার গল্পের চরিত্ররা আপন গৌরবেই মহীয়ান । যেখানে লেখকের আর কর্তৃত্ব চলেনা, চলেনা রিমোড কন্ট্রোল।তার-ই এক প্রতিভাস আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের “দুধে ভাতে উতপাত” নামক গল্পটি ।গল্পটি রচিত হয়েছে ১৯৬৫-৭৮ সালের মধ্যে কোন এক সময়ে ।অর্থাৎ দেশভাগ , পাকিস্থান ,স্বাধীন বাংলাদেশ হাতে পেয়েছে ততদিনে পূর্ব বঙ্গের সাধারণ মানুষ ।এই গল্পের মূল প্লট অতি সাধারণ হলেও এর প্রতীকী আবদার অনেক গভীর ।হাশমত মহুরি পেশায় ব্যবসায়ী ।জয়নাবকে সন্তানের বা সংসারের খাবার জোগারের জন্য ধারে চাল নিতে হয়।আধ্মন চালের দাম শোধ না করতে পারায় জরদস্তি জয়নাবের কালো দুধেল গরু হাশমতের বোন জামাই হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায় ।প্রতিবাদ করার প্রয়াস পর্যন্ত তখন সে পায় না ।মানসিক দ্বন্দ্ব যন্ত্রণা তার পাজরের হাড় ভেঙ্গে দিয়েছে । তাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে ,সন্তান সন্ততির অতিসাধারণ প্রত্যাশা একটু খানি দুধ ও ভাত না দিতে পারার আক্ষেপ ।শেষে জয়নাব রোগ যন্ত্রণার বিষময় দেহ নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বিছানায় ।জয়নাবের ও তার সন্তানের দুধভাত খাওয়ার স্বপ্ন ভঙ্গ শুধু তার ব্যক্তিগত যন্ত্রণা বললে ভুল হবে ।সেদিনের তামাম পূর্ব পাকিস্থানের সাধারণ মানুষের অন্তরের আর্তি –ই নয় রীতি মতো ক্ষোভ ভাবলে অত্যুক্তি হবেনা বলেই আমার মনে হয় ।যে আশা নিয়ে বাঙালি নতুন সূর্যের আলোতে অবগাহন করবে বলে আনন্দে আতখানা হয়ে পড়েছিল সে স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে ।জয়নাবের দুধ ভাত খাবার ও সন্তানদের খাওয়ানোর আশার অন্তরালক্ষে কোথায় যেন ঘুরে দাঁড়াবার প্রয়াস ,অধিকার লাভের তীব্র বাসনা ,ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার রক্তিম মুখ ভেসে উঠেছে পাঠকের কল্পনালোকে ।তাই তো জয়নাব বারবার ছেলেকে বলে ওঠে “ওইদুল্লা বাবা আমার কালা গাইটা আনতে পারলি না? হাশমত মউরির পোলায় দড়ি ধইরা টাইনা লইয়া গেলো ।একটা বছর পার হইয়া গেলো একটা দিন দুগা ভাত মাখাইতে পারলাম না ।“ মাতৃ হৃদয়ের এই যে হাহাকার এটা শুধু ব্যক্তি জয়নাবের নয় ।দেশভাগ পরবর্তীপূর্ব বাংলার বাঙালি জাতির মাতার আর্তনাদ ছাড়া আরকী?।
ইলিয়াস অতি সন্তর্পণে পাঠকের ভাবালুতাকে এড়িয়ে নিয়ে আবেগে মাতিয়ে দিতে সক্ষম এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ।মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্য,বস্ত্র বাসস্থানের মতো ন্যূনতম বিষয় যখন প্রশ্নের মুখে পড়ে তখন আর মানুষের ধর্ম ,জাতি লিঙ্গ , আপন -পর মাথায় থাকে না ।পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ কল্পনায় আপন সন্তান সন্ততি নিয়ে স্বপ্নের নীড় রচনা করে। , যখন সে তার সামান্য অংশটুকু হাতের কাছ থেকে দূরে চলে যায় তখন সে অসহায় বাইসনের মতো হিংস্র হয়ে ওঠে । যখন কালো গরুটিকে হারুন মৃথা নিয়ে যেতে নেয় তখন জয়নাব হুঙ্কার দিয়ে বলে ওঠে ছেলেকে “বুইড়া মরদটা কী দ্যাহস ? গরু লইয়া যায় খাড়াইয়া খাড়াইয়া কী দ্যাহস “ অর্থাৎ জয়নাব প্রতিবাদের বিষ শল্য নিক্ষেপ করেছেন সুকৌশলে এটা সচেতন পাঠকের বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়না । এ যেন নিজের প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার ,নিজের অধিকার আদায়ের এক সূক্ষ্ম ইঙ্গিত ,পৃথিবীতে বাঁচার সংগ্রামের এক প্রতীকী ডাক । অবহেলিত ,বঞ্চিত , প্রলেতারিয়াৎ মানুষের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সংকল্পটি সুচালো সূচের মতো ফুটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন ইলিয়াস ।এইখানেই ইলিয়াস স্বতন্ত্র ,এইখানেই ইলিয়াসের লেখক সত্তার অনন্য ব্যক্তিত্ব ।
এখানেই গল্প শেষ করেননি লেখক ।জয়নাব ছেলে ওইদুল্লাকে শেষ বারের মতো আদেশ দিলে ছেলে বেরিয়ে পড়েছে মাতার আদেশ কায়েম করার সঙ্কল্প নিয়ে।গল্পে কোথাও সরাসরি বিদ্রোহের কথা নেই তবে ঝাঁঝ চোরাস্রোতের মতো প্রবহমান । তাইতো এই গল্পের গতি বুঝতে তিন সেকেন্ড সময় লাগেনা পাঠকের ।এইখানেই ইলিয়াসের কলম স্বাতন্ত্র্য ।
এই গল্পে যখন দেখা যায় দরিদ্র ঘরের ওইদুল্লা মহুরির বাড়িতে যায় তখন দেখে সেখানে অ্যালুমিনিয়াম থালা থেকে গম ছিটিয়ে মুরগিকে খাওয়াতে তা দেখে তার মনে হয় সব কটা মুরগির ঠোঁট কামড়িয়ে গম গুলি দাঁতে চিবিয়ে ফেলে ।এই বক্তব্যের অন্তরালে ওইদুল্লার শুধু নয় সেই সময়ের অস্থির দোলাচল সময়ের বাঙালি জাতির অন্তরের এক হিম -শীতল কষ্টের আগুনকে আবিষ্কার করা যায় । এখানেই যা মানুষের প্রয়োজন তা যেন হয়ে উঠেছে বিলাসিতা ।দুধ ভাত বাঙালি জাতির অতি প্রাচীন কাল থেকেই প্রত্যাশিত বিষয় ।আমরা কবি রায়গুণাকর ভরত চন্দ্রের মুখেও অষ্টাদশ শতকে শুনেছি ঈশ্বরী পাটনির বর প্রার্থনা “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে” অর্থাৎ ন্যূনতম প্রয়োজন টুকু মিটলেই তারা সুখী-খুশি ।এই গল্পে দেখেছি আমরা যখন ওহিদুল্লা মহুরির বাড়িতে গিয়ে নিজেদের বিক্রি করা গরুর দুধ আবদার করে মাতা জয়নাবের শেষ ইচ্ছে দুধ ভাত খাওয়ার ইচ্ছে পূরণের জন্য। সে বলে তার মায়ের হাউস অর্থাৎ শখ হয়েছে দুধ ভাত খাওয়ার । দু দুটো আন্দোলন হয়েছে ।নতুন স্বাধীন সূর্যও উঠেছে কিন্তু বাঙালি সাধারণ মানুষ সূর্য গ্রহণের গাঢ় অন্ধকার কাটিয়ে উঠতে পারেনি ।বাংলাদেশের কৃষকদের এই খাদ্য সংকট , অভাব অনটন এক নির্মম সত্য এইভাবেই ইলিয়াস সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই গল্পের শাখা প্রশাখায়।
এই গল্পে আমরা অবাক হই না যখন দেখি মহুরির অনুপস্থিতিতে হারুন মৃথার কটূক্তি শুনি ” তর মায়ের প্যাট খারাপ , তগো হইছে মাথা খারাপ ।“ এ তো ৭০ দশকের বাংলাদেশের কঠিন নিরেট সত্য ।ইলিয়াস ধরতে চেয়েছেন এই সময়কে ,বোঝাতে চেয়েছেন দেশভাগ ,স্বাধীনতার পর মেকি ভেগ ধারীদের আসল রুপ ।আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এই গল্পে এই সময়ের মানুষের প্রতিদিনের জীবন যাপনের একটি স্পষ্ট ছবি এঁকে আঘাত করেছেন মানবতার সোনালী অট্টালিকায় ।ইলিয়াস বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের নাড়ীর যন্ত্রণা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তো তিনি ইলিয়াস ।
No comments:
Post a Comment