শ্রাবস্তী ও শ্রবন
আমরা ছিলাম ছোটবেলার সাথী। ওর বাবা আর আমার বাবা দুই বন্ধু। এক মফস্বল শহরে আমাদের বাস। ছোট থেকেই সবাই বলত আমাদের নাকি বিয়ে হবে। মা বাবাদের হাসিতেও কোনদিন তার অন্যথা দেখিনি। তাই কি...কিম্বা তা নয়। আমার মনে হয় কেউ কিছু বলুক আর নাই বলুক কৈশোর থেকেই আমরা দুজন দুজনকে ভালবেসেছিলাম। মানে ওকে না দেখতে পেলে আমার বুকের মধ্যে সবসময় ফাকা ফাকা লাগত। সে বন্ধুদের সঙ্গে সরস্বতীর পুজোর রাতজাগাই হোক কিম্বা অঙ্ক পরীক্ষার আগের রাত... সর্বক্ষণ। কিছুই ভাল লাগত না। ও আমাকে কোনদিন কিছু বলেনি। কিন্তু আমার মনে হয় ওরও ঠিক তাই হত। ও শুধু একদিন একটা কথাই বলেছিল আমায়। মা ওকে বাটি করে কুলের মিস্টি আচার দিয়েছিল খেতে। দুনিয়ার সব থেকে কিপ্টের মত একটা কুল-বীজ চুষতে চুষতে ও বলেছিল, ‘ তোমার কাছে আসার কথা ভাবলেই আমার বুকের ভেতরটা এমন ধকধক করে কেন গো? কখনো কখনো তোমার নাম শুনলেও অমন হয় !কেন গো...বল তো কেন?’
সে প্রশ্নের উত্তর তোড়জোড় করে কীভাবে দেয় তখনও জানতাম না। আমি চোখ নামিয়ে ওর আচারের বাটিটা দেখছিলাম। ও যেই মুখ ঘোরাচ্ছিল লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে দেখছিলাম। যেভাবেই হোক না কেন আমি শুধু হাঁ করে ওকে দেখতাম। কখনও কখনও ড্যাবড্যাব করে সবার সামনেও। ওর দুই বেনি বা মাথা ওপর বাধা ঝুটি, ওর ববি প্রিন্টের ফ্রক বা পুজোর সময়ে লাল ছাপা শাড়ি, দুস্টুমিতে ভরা ওর দুই চোখের তারা অথবা মন খারাপে টলটলে জলে ভরা পুকুর পুকুর ওর দুই চোখ। আমি দেখতাম। আর ভাবতাম কবে বিয়ে হবে আমাদের? ও একদিন আমায় বুড়ো আঙুলের কাঁচকলা দেখিয়ে বলেছিল, ‘ তোমার মত একটা ভ্যাবলাকে বিয়ে করতে বয়ে গেছে আমার!’
ঠিক তাই। ওর বয়েই গেল। বিয়েটা ও করল না । এক বিকেলে আমি ঘুমিয়েছিলাম। পা টিপে টিপে ও নাকি আমার ঘুমন্ত মুখের ওপর ঝুঁকল। তারপর একটা নাম শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী।বিড়বিড় করে বলছিলাম আমি বারবার। সেই একটা নাম। মা পিছন থেকে ওকে অনেক ডেকেছিল। ও আর পিছন ফেরে নি। ঘরের ভেতরে নাকি আমি বলেই চলেছিলাম...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী!
(২)
ওকে ছেড়ে এসেছিলাম। তার জন্য আমার কি আজকাল আপশোষ হয়! বুঝতে পারি না। ওকে কি আমি এখনও ভালবাসি...চাই! জানি না। এত সুন্দর আমার সংসার। তাকে সরিয়ে এইসব কথা এতটুকুও ভাবতে ইচ্ছা হয় না। কিন্তু এই এখন এত বছর পরে যখন ও একজন মাঝবয়েসী সংসারী মানুষ। স্ত্রীপুত্রদের নিয়ে সুখী জীবনের এক পুরুষ। তখন ও আমাকে নিয়মিত মেসেজ করে, ফোন করে। উত্তর না দিয়ে ফেরাতে পারি না। বশর চারেক হল ওর সাথে আবার দেখা সোশ্যাল মিডিয়ায়। বাবা-মা মারা গেছে, আর ভাই বোন নেই। তাই সেই ছেলেবেলার গঞ্জ শহরে আর যাওয়া হয় না। যেটুকু যোগাযোগ ঐ সোশ্যাল মিডিয়াতেই। সেখান থেকেই একদিন ওর অনুরোধ এল।
সেই সেদিন, যেদিন ওর বাড়ি থেকে অলক্ষুণে সন্ধেবেলায় ফিরে এসেছিলাম। তারপর থেকে শ্রাবস্তী আমায় ছেড়ে যায়নি। জোর করে ওকে মনে করতে চাইতাম না। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ শ্রাবস্তী নামের একটা সরু চাবুক নেমে আসত আমার বুকের মধ্যে। আমি যেন একটা বাসি মড়ার গা ছুঁয়ে ফেলতাম। স্বামীর আদর-বিছানা, ছেলেদের মানুষ করা , একজনের মিসেস বলে পরিচিত হওয়া...এইসব চলতে চলতে সেই চাবুকের বাড়ি আবছা...আরো আবছা হয়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু আজকাল যখনই ওর সাথে কথা হয়। তখনই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সেই চাবুকের বাড়ি নেমে আসে । আমার স্বামী একদিন জিজ্ঞাসা করে বসল, ‘ তোমার চোখমুখ এত বসে যাচ্ছে কেন। এত কালো কালো দাগ কীসের। কী হয়েছে? কীসের টেনশান...’ হালকা চালে ঋতুবন্ধের প্রসঙ্গটা এনে তাকে এড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু চিন্তা তো এসেই যায়! কেন টেনশান আমার! কী জন্য পড়ছে চাবুকের বাড়ি আজ এতদিন পরেও। ও তো বারবার এখনও বলে যাচ্ছে...শ্রাবস্তী নামে কেউ ছিল না। কেউ নেই। সত্যি সত্যি নানাভাবে জানতে পেরেছি। আমাদের সেই শহরে , সেই সময়ে কিশোরী থেকে যুবতী শ্রাবস্তী নামের কেউ ছিল না! তাহলে এসবই কি ওর কল্পনা...কিন্তু ও তো তেমন কল্পনাপ্রবন ছেলে না। কবিতা-টবিতা লেখা তো দূরের কথা। জীবনে ড্রয়িং খাতায় আঁচড়টুকুও কাটেনি। তাহলে কি আমি ভুল শুনেছিলাম? তা তো না ...আমি নিজেকে চিমটি কেটে, খিমচি কেটে, কামড়ে বুঝে নিয়েছিলাম। বিড়বিড় করে ও বারবার বলছিল শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী। ইস্…নামটা যেই এল ... চাবুকের বাড়ি আবার পড়ল। নাহ্ এভাবে আর পারা যাচ্ছে না। ভুলে যেতে হবে ওকে।
(৩)
‘ফোন করলি কেন আবার? বলেছিলি নিজে ভুলে যাবি...আমাকেও ভুলে যেতে হবে। তাহলে?’
‘তুমি কি ভুলে যেতে পেরেছিলে!’
‘ সে তো আমার কথা...ভোলা যায় না! আমি ভুলতে পারিনি তোকে...ভালো যে বাসি তোকে কী করে ভুলি?’
‘ তোমার বৌ আছে...এসব কথা তোমার মোটেও বলা উচিত না।’
‘শোনাও তো তোর উচিত না! তাহলে?’
‘জানিনা...কিন্তু তুমি বলবে না!’
‘বাহ্...বল, কেন ফোন করেছিস?’
‘ জানিনা...কিচ্ছু জানি না। এমনি...’
‘ তাহলে তো কিচ্ছু বলার নেই। রেখে দি?’
‘দাও তোমার ইচ্ছে হলে...’
ফোনটা কেটে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আবার বেজে উঠল। এবার বিপরীত দিক থেকে।
‘কেন ফোন করলে?’
‘তুই তো বারণ করিস নি?’
‘ওসব ছাড়... বলো...কী?’
‘ যে কথাটা বারবার বলতে চাই...তোকে ভালবাসি...শুধু ভালবাসি!’
‘মিথ্যে...তুমি ভালবাস শ্রাবস্তীকে? এই দেখ , তুমি ভালবাসার কথা বললে... শ্রাবস্তীর নাম এল আর আমার গায়ে চাবুকের ছ্যাকা ফুটে উঠছে...লাল লাল দাগ!’
‘উহ্! তোর এই কমপ্লেক্সটা ছাড়...শ্রাবস্তী ফ্রাবস্তি কেউ নেই। আমি তোকে ভালবাসি...আমাদের দুজনের আবার নতুন করে ভালবাসার দুনিয়ায় মিলে যেতে হবে...’
‘ তুমি কি পাগল! আমাদের দুজনেরই এত সুন্দর ভালবাসায় ভরা সুখের জীবন। আবার নতুন করে ভালবাসা...ইস ছাড়। রেখে দাও।’
‘রেখে দেব...হ্যাঁ, হয়ত আমি পাগল!কিন্তু তুইও তো আমায় প্রশ্রয় দিচ্ছিস। তাহলে তুইও কি পাগল না? আসলে আমরা দুজনেই দুজনের ভালবাসা পাওয়ার জন্য পাগল রে! আমরা দুজন দুজন দুজনকে পাইনি। তাই আমাদের মিলতেই হবে। সেটাই আমাদের ভবিতব্য...’
‘ বড় বেশি দিবাস্বপ্ন দেখ তুমি। আসলে আমরা খুব সুখী। তাই দিনরাত ভালবাসা ভালবাসা করি। ভাব তো যদি রাতদিন খেটে দুটো পেটের ভাত জোগাড় করতে হত। সেটা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারতে না তাহলে কী তুমি এইভাবে দিনরাত ভালবাসা ভালবাসা করতে পারতে?’
‘আর তুইও তাহলে দিনরাত ভূত শ্রাবস্তীর কিল খেতিস না!’
‘শ্রাবস্তী ভূত না মোটেই। সে আছে ...কোথাও নিশ্চই আছে। সেখান থেকে বারবার এসে আমায় চাবুক মেরে যায়! একমাত্র তুমি জান তার ঠিকানা। কিন্তু তুমি কিছুতেই বলবে না!’
‘ আর আমিও বলব ... ভাল বা খারাপ, হালৎ যেমনই হোক না কেন। আমি তোকেই ভালবাসি রে...যত দিন যাচ্ছে। বুকের চিনচিনে ব্যাথা দিয়ে সেকথা বুঝতে পারছি!শ্রাবস্তী বলে কেউ, কখনও নেই...ছিল না!’
‘ তাহলে আমরা যার যার কথা নিয়ে, নিজের নিজের মত থাকি। তুমি আর ফোন কোরো না!’
আর ফোন এল না...গেল না। প্যাচপেচে ঘাম আর খিস্তি গালাগালির মাছের বাজারে, মাঝরাত্তিরের নিঃসঙ্গ রেললাইনের স্লিপারের ওপরে... অ্যালকোহলের গন্ধে...গেস্টদের এন্টারটেন করার ফাকে ফাকে ওয়াইনের গ্লাস হাতে নিয়ে কিম্বা এসির ঠান্ডায় পর্দা সরিয়ে কাচের ওপার থেকে রাত আড়াইটের মেট্রোপলিটন সিটির স্কাইলাইনে খুটে খুটে ...কথাগুলো বেজেই চলল...বেজেই চলল! তোকে ভালবাসি শুধু তোকে ... তুইও আমায়...যাই হোক না কেন... নাহ্! তোমার মনের ভেতরে শ্রাবস্তী আছে শুধু শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী!
(৪)
চ্যালেঞ্জটা আমি নিয়েই নিলাম। এভাবে বএললে বাচাদের মত হিরোগিরি দেখানো হয়ে যায়! অবশ্য চ্যালেঞ্জ বললে চ্যালেঞ্জ...না বললে...আসলে কিছু করার ছিল না। আর পারছিলাম না ওকে ছেড়ে থাকতে। ওকে বললাম,
‘তুই যখন বলেছিস। তখন নতুন করে শুরু করব আবার। একেবারে অচেনা কোন জায়গায় চলে যাব। যেখানে কেউ চেনে না আমায়। হাড়ভাঙা খাটুনি খাটব বেঁচে থাকার জন্য। তারপর দেখব তোকে মনে পড়ে কিনা...তোকে ভালবাসতে ভালবাসতে ছটফট করি কিনা!’ ও উত্তর দিয়েছিল,
‘ তোমার পরিবারের কী হবে?’
‘সে আমি সব গুছিয়ে দিয়ে যাচ্ছি ওদের জন্য। লুকিয়ে ভলেন্টারি রিটায়ারমেন্ট নিয়েও নিয়েছি। টাকাপয়সা সব ওদের নামে ফিক্সড করে দিয়েছি।’
‘ বাহ্...আর ওরা যে তোমায় পাগলের মত খুজবে?’
‘ পাবে না ...তারপর একদিন মেনে নেবে।সবাই এভাবেই একদিন মেনে নেয়!’
‘তা বলে...’
‘না রে আমার আর কিচ্ছু করার নেই। আমি অতি সাধারণ একটা লোক...আমার প্রচন্ড লোভ...তোকে ভালবেসে এসেছি সেই শিশুকাল থেকে। তারপর তুই চলে গেলি। বুকের ভেতরে কবর দিলাম আমার ভালবাসাকে। আবার হঠাৎ দেখা হল...আর তোকে হারাতে চাই না। তোর বলা কস্টিপাথরে আমার সেই ভালবাসাকে যাচাই করব এবার। যদি উতরে যেতে পারি তাহলে ফিরে এসে দাঁড়াব তোর সামনে। বলব তুই চল!’
‘ আমি যাব কেন? আমার এত সুন্দর সংসার ফেলে?’
‘যাবি...কারণ তুই আমায় ভালবাসিস আর আমিও তোকে ভালবাসি!’
‘ না ...তুমি আমায় ভালবাস না ...ভালবাস শ্রাবস্তীকে!’
ফোনটা কেটে দিয়ে সেই রাতেই বেরিয়ে পড়লাম।
(৫)
হিমাচলের এক অজ গাঁ। অদ্ভূত সুন্দর একটা নাম...পাঞ্ছিলা। নাক খ্যাদা, গোল মুখের মানুষগুলোর সারা শরীর জুড়ে হাসি। আছে, ওদের ঝগড়া আছে...মাতাল হয়ে মারামারি আছে। শাপশাপান্ত আছে...অনেক কিছুই আছে। তবু আমার মনে হয় ওরা সব সময় যেন আসছে। ওদের সেই হাসি যখনই চোখে পড়ে। আমি ওর ছোট্টবেলার দুষ্টুমিস্টি হাসি মুখটা দেখি।
ছোট্ট একটা দোকান করেছি এখানে। দেশলাই থেকে স্যারিডন সবই রাখি। আট কিলোমিটার চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাস ধরি। দু ঘন্টার ঝাকুনি খেতে খেতে ছোট্ট শহর। সেখান থেকে মাল কেনা। সারাদিন দোকানদারি। নিজের রান্না-বান্না-ঘরের কাজকম্ম...রান্নার জন্য কাঠকাটা। সব চলতে থাকে। আর ফাকে ফাকে আলোছায়ার লুকোচুরির মত ওকে দেখে ফেলি ।
এখানে মেঘ-বৃষ্টি-রোদ সত্যি সত্যি লুকোচুরি খেলে।শীতকালটায় বরফ আর বরফ। ঘরের মধ্যে কাঠের ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকা। আমার কিন্তু একলা লাগে না। মনে হয় ও যেন আমার পাশটিতে শুয়ে আছে। আমি কাপড়ের পট্টি সেকে ওর ঠান্ডা পাগুলো গরম করছি। ভোরবেলা চোখ বন্ধ করে হরেকরককমের পাখির ডাক শুনি। মনে হয়...ফোনে ওর মৃদু গলা শুনছি। আমি বুঝতে পারছি...নাহ্...সত্যি সত্যি ওকে ভালবাসি। আর হ্যাঁ...এই শান্ত শীতল দিনরাত্তিরগুলোতেও কিন্তু শ্রাবস্তী নামের কাউকে খুঁজে পেলাম না। ।নিজের মনকে ঘুলিয়ে ঘুলিয়ে ক্লান্ত করেও জানতে পারলাম না… কে সেই শ্রাবস্তী... কে?
(৬)
পাঞ্ছিলা গ্রাম থেকে দেওধারিয়া আশ্রম, গাড়িতে প্রায় আধ ঘন্টার রাস্তা। আশ্রমটা বৃক্ষানি সাধুদের আশ্রম। অদ্ভূত সাধু এরা। এই পাহাড়, জঙ্গল , নদী, পশুপাখি ...এরাই সাধুবাবাদের উপাস্য। এরা ধ্যান করে ঘন্টার পর ঘন্টা। আর নীরবে সেবা করে চলে ঐ প্রকৃতির। গেরুয়া পরা মানুষগুলোর সবাই নাকি বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী প্রফেসার, গবেষক। জীবনের এক পর্বে এসে এনারা উপলব্ধি করেছেন প্রকৃতিকে ভাল না বেসে মানুষের মুক্তি নেই!
এখানে আশ্রমের ফুল বাগানের দেখাশোনা করি আমি। এক মেঘ-বর্ষার বিকেলে আমায় দেখলেন আশ্রমের প্রধান স্বামী অরণ্যেশ। বলিরেখার কাটাকুটি মুখে, সারা শরীরে। একটু ঝুঁকে বসে রয়েছেন কম্বল পাতা বিছানায়। কী শান্ত... তার দুটো নীলাভ চোখ। সেই দুই চোখের সামনে বড় দ্বিধায় ভুগছিলাম। কী বলব ?...কে আমি? কেন এসেছি? অদ্ভূত দাবী এক মাঝবয়েসী ভিনভাষী মহিলার...সে এখানে থাকতে চায়! কিন্তু কেন...তা সে জানাতে চায় না...অদ্ভূত, সত্যি অদ্ভূত! ...আমার ঠোট কাপছিল। হাড় কাপানো জোলো ঠান্ডাতেও ঘামছিলাম আমি। কিন্তু অরণ্যেশ হাসলেন...তার দুই চোখে নাম না জানা কত রঙবেরঙের ফুল ফুটে উঠল। তিনি বললেন...আপ ফুলোঁকো দেখরেখ কিজিয়ে।
ঢালু উঠোনে গোল করে সাজানো ফুল বাগানে দাঁড়িয়ে আছি আমি। দূরে সবুজ থেকে নীলচে হয়ে যাওয়া পাহাড়ের গায়ে গায়ে পাকদন্ডী। সেই পথে কাছের মানুষগুলো একটু একটু করে বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যায়। আবার দূরের বিন্দুগুলো একসময় স্পষ্ট হয়ে একটা পরিপূর্ণ অবয়ব হয়ে ওঠে। আজ বারবার চোখ চলে যাচ্ছে ঐ দূরের সীমানায়। একটা বিন্দু একটু একটু করে এগিয়ে আসছে না! তাই তো... ঠিক...সত্যি সত্যি এগিয়ে আসছে।
যোগাযোগের সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ওকে ভুলেই গিয়েছিলাম বহুদিন। তারপর একদিন একটা ফোন। ধরলাম...একটা অচেনা ল্যান্ড ফোনের নম্বর। এস টি ডি কোডটা বলে দিল অনেক দূরের কোনো জায়গা থেকে ফোনটা এসেছে। অনেকবার জানতে চাইলাম কে ফোন করেছে...কে? কোন উত্তর নেই। বুঝলাম এটা ওর ফোন। সাথে সাথে আমার চারদিকে ভিড় করে এল অনেকগুলো ছবি। ওর বাড়ির লোকেদের দুশ্চিন্তা...তন্নতন্ন করে ওকে খোঁজা...ওর স্ত্রীর সাময়িক অসুস্থতা...ইত্যাদি ইত্যাদি। হ্যাঁ...শ্রাবস্তীও এল সেই ধারালো চাবুক নিয়ে। কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেলাম। নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিলাম না। আমি কাদছিলাম...ওর জন্য আমি কাদছিলাম। কত...কতদিন পরে! কেন! জানি না। তারপরেও একবার এসেছিল ফোন। সেই একইভাবে কোন কথা নেই। মনে হচ্ছিল ভয়ঙ্কর তোলপাড় চলছে ওর মধ্যেও। না চাইলেও আমাকে ফোন না করে থাকতে পারছে না। তারপর ভয়ঙ্কর একঘূর্ণি উঠল আমার মধ্যে… প্রবল দুই জলস্রোতের ধাক্কা । সংসার নাকি ঐ পাগল প্রেমিক...কাকে ছাড়ব আমি? কিন্তু আবার যদি ও শ্রাবস্তীর নাম নেয়...তাহলে?
(৭)
‘ কেমন আছিস?’
‘তুমি কেমন আছ?’
‘দেখছিস না...কত রোগা হয়েছি। সারাদিন খাটছি। পেটের ভাত জোগাড় করা মুখের কথা না। বুঝছি রে…তবুও বলছি,বেশ আছি...তুই?’
‘ আমি? ...এই ফুলবাগানের মধ্যে কেমন আছি...বুঝতে পারছ না?’
‘হুঁ...তুই সব ছেড়ে চলে এলি? কী করে জানতে পারলি আমি এই কাছেই আছি?’
‘ এলাম...আসতে হল! আর ...চেষ্টা করলে পঙ্গু যদি পাহাড়ে চড়তে পারে...তো এই বয়সে কি প্রযুক্তি শিখে...তোমার ঐ পাঞ্ছিলা আর এই দেওধারিয়াকে চিনে নেওয়া যায় না!’
‘তাই তো!’
বাগানের একটা দিক ফাকা হয়ে শূণ্যে ঝাপ দিয়েছে। সেইখানে এসে বিকেলের গাঢ় হলুদ রোদ পড়ল। সামনে নাম না জানা একের পর এক পাহাড়ের চূড়াগুলোয় কারা যেন সোনালি আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। একটু পরে ফুলের গন্ধ মেখে নেমে আসবে সন্ধ্যা। অনেকদিন বৃষ্টির পরে আজ আকাশে এক টুকরোও মেঘ নেই।
‘ এখনও এক বছর হয়নি না!’
‘কেন?’
‘এমনি...’
‘বাহ্...এক বছর পরে আমার যাওয়ার কথা ছিল। আমি তো কিছুই জানাইনি...তুই চলে এলি। শোন তোর বাঁহাতটা ধরতে পারি?’
চামড়ার ভেতর থেকে উকি দেওয়া শিরার এক হাত, আর এক হাতকে ছুঁয়ে ফেলল।
‘বলো! কী দেখছ অমন করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।’
‘ দেখছি...রে! আমার সারাদিনের সব কাজের ফাকে ফাকে তো তোকেই দেখি! ছুঁতে যাই কিন্তু তুই পালিয়ে যাস! আজ ...ধরেছি শক্ত করে তোর হাত...আজ তোকে পালাতে দেব না!’
‘এ তোমার পাগলামি...আমাদের দুজনের সংসার আছে। সব ছেড়ে এই বয়সে আমরা এমনভাবে ... ইস!কী করছি আমরা!’
আকাশে এখন হালকা একটা কমলা আভা। দু-একটা তারা উকি মারছে এখানে ওখানে। পাহাড়্গুলো একের পর এক মাথায় ঘোমটা দিয়েছে।
‘জানো... সেদিন নিজের মুখ পুড়িয়ে, সব লজ্জার মাথা খেয়ে... স্বামী অরণ্যেশজীকে তোমার কথা বলতে যাব...তিনি কী বললেন জান?’
‘কী?’
‘ পুরুষ আর প্রকৃতির মিলনেই এই জগত আর এই সংসার। তাকে অস্বীকার করা যায় না। তাই তো… তিনি আর তার গুরুভাইরা প্রকৃতিকে রক্ষা করছেন। নাহলে পুরুষ রুষ্ট হবেন…এ সভ্যতা তখন থাকবে না। আমি চুপ করে তার পায়ের কাছে বসে শুনছিলাম। তিনি বন্ধ দুইচোখ খুলে তাকালেন… আমি দেখলাম। ভালবাসার ঝরণা নেমে আসছে তার দুইচোখ থেকে। দুই পরিণত বাঙলাভাষী মানুষ কত দূর থেকে এখানে এসে থাকছে! এ নিশ্চই প্রকৃতি দেবীর নির্দেশ। তিনি জানেন... জানো তারপর তিনি বললেন… একদিন তোমরা মিলতে হবেই মা… আবার চোখ বন্ধ করে ফেললেন তিনি।’
‘হুঁ… তিনিই খবর দিলেন আমায়। আমি জানতাম তুই এসেছিস…আমার জন্যেই এসেছিস । তবু আসিনি। বুকের ভেতরটা ছিড়ে গেছে তবুও আসিনি…’
‘কেন?’
‘মনে হচ্ছিল…পরীক্ষা যেন শেষ হয়নি। আর…’
‘আর…কী?’
‘শ্রাবস্তীর ভুল ধারণাটা যদি আবার তোর মনে পড়ে যায়! দূর থেকে দেখেছি তোকে। আশ্রমের কাজে ব্যস্ত তুই। তোর চোখেমুখে কত খুশি!’
‘এখানে এসেছি…তারপর থেকে বিশ্বাস করো…শ্রাবস্তীকে আর দেখিনি। কোন চাবুক আমায় আর স্পর্শ করেনি!’
‘তাই?’
‘হুঁ…ঠিক তাই!’
তখন চারিদিকে ঘন নীলচে অন্ধকার। দূরের প্রার্থনাকক্ষ থেকে উপনিষদের মন্ত্রোচ্চারণ ভেসে আসছে। আকাশে লক্ষ কোটি তারার ঝলকানি।
‘তোর মনে আছে? বিকেলে খেলার শেষে আমরা দুজনে নদীর পারে শুয়ে আকাশে তারা গুণতাম!’
‘মনে আছে…খুব মনে আছে!’
‘এ কি তুই কাঁদছিস কেন? আজ চরম পরিশ্রম আর দারিদ্রেও তোকে অনুভব করছি… বারবার করছি…আর শ্রাবস্তীর ভূতটাও তো কোথায় পালিয়েছে…আজ তো চিৎকার করে বলার দিন…দুজন দুজনকে ভালবাসি। চল না আজ আবার আমরা ঐ ঘাসের বিছানায় শুই। তারপর আকাশের ওড়না থেকে একটা একটা করে হীরের কুচি কুড়িয়ে নি!’
‘ না…না…তুমি চলে যাও!’
‘না…তুই চল!’
‘না...’
‘কেন রে...এখনও রাত আছে, তারারা আছে...ঐ আকাশ আছে...আমরাও আছি!’
‘ সে বয়স নেই যে!’
‘ তোর শ্বাস প্রশ্বাসে এখনও যে সেই মধুগন্ধ...আয় না...যাই!’
সেইরাতে শিশির, জোছনা, মাতাল হাওয়া, পাহাড়দের কবোষ্ণ বুক পাহারা দিয়েছিল। তারাদের গুনতে গুণতে কখন যেন মিশে গিয়েছিল সব শ্বাস প্রশ্বাস…
(৮)
তবুও ফিরে আসতে হল। ও যখন ওর সব ভার আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে অচেতন। ওর সব অস্তিত্ব যখন আমার পাজরের নীচে আশ্রয় নিয়েছে। ঠিক তখন শুনতে পেলাম আমার মাথার মধ্যে এক ভয়ঙ্কর বাঁধ ভাঙার কম্পন। তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য শুধু আমার মস্তিষ্ককেই আঘাত করছিল, গুড়িয়ে দিচ্ছিল। প্রতিধ্বনির পর প্রতিধ্বনি ...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী। নিশ্চিত ঘুমে মগ্ন ওকে জাগাতে পারলাম না। সারারাত সেই সবুজ উপত্যকায় নিজের কঙ্কালটাকে চিনে নিচ্ছিলাম একটাই শব্দে...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী। কে আমি...কী আমার ভালবাসা...কী আমার অস্তিত্ব...উত্তর খুঁজে পাইনি...শুধু একটাই শব্দ...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী।
আমার স্বামী সব শুনতে শুনতে নির্বিকার ভাবে চা শেষ করল। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ এটা কমন ম্যাটার...আরে এমন শ্রাবস্তী সবার ছিল, আছে...থাকবে...তা বলে ডিউটি ভুললে হবে নাকি! চলুন আমি যাচ্ছি আপনার সঙ্গে!’ ওরা চলে গেল। আমার সেই ছোট্টবেলার শহরে আমার স্বামী যাচ্ছে…ওকে ফিরিয়ে দিতে। চূর্ণ-বিচূর্ণ আমি নিজের ঘরে ফিরে দরজাটা বন্ধ করলাম। একা থাকতে হবে আমায়। অনেক… অনেকটা সময়...কতক্ষণ...জানি না! বুকের ভেতর থেকে উঠে আসছে নামটা...শ্রবণ...শ্রবণ...শ্রবণ। কে এই শ্রবণ... জানি না…কিচ্ছু জানি না। সেই রাতে ফুলের গন্ধে, হাওয়ার মাতলামিতে, তারাদের প্রশ্রয়ে হারিয়ে যেতে যেতে যখন সব চেতনা আমার শূণ্য হবে। ঠিক তখন বুকের দরজা ভেঙে বেরিয়ে এল শ্রবণ? চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম লজ্জায়। কিছুই বলতে পারিনি ওকে। কিন্তু আমায় খুঁজতে হবে, জানতে হবে...কে এই নাম...শ্রবণ...শ্রবণ...শ্রবণ।