Wednesday, December 25

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্পে নারী : জয় দাস





আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্পে নারী
জয় দাস

‘মাটি জল বায়ু অগ্নি এবং মানুষ
ভারতবর্ষ তোমাকে প্রণাম করেই
সেই ইতিহাসে কোণঠাসা নারী আমরা
শুরু করলাম কথামানবীর ভাষ্য’
মল্লিকা সেনগুপ্ত১

ভারতবর্ষ কেন পৃথিবীর যে কোনো দেশের ইতিহাসেই নারীরা দীর্ঘ সময় ধরে হয়েছে উপেক্ষিত, নির্বাসিত। অসভ্যযুগে যৌথবিবাহ(Group Marriage), বর্বর যুগে জোড় পরিবার(Pairing Marriage) এবং সভ্যযুগে একনিষ্ঠ বিবাহ(Monogamy) পদ্ধতির মাধ্যমে যেভাবে সমাজ রূপ পায় মাতৃতান্ত্রিকতা থেকে পিতৃতান্ত্রিকতায় ও সামাজিক শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানসিক চিন্তাধারা থেকে নারীরা বঞ্চিত হয়ে স্থান পায় রান্নাঘর ও আঁতুড় ঘরের একঘেয়ে দাসত্বজীবনে। সেই দাসত্বজীবন প্রথম প্রশ্নের সম্মুক্ষীণ হয় শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে। কারণ এই প্রথম নারীরা অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থায় সরাসরি অংশগ্রহণ করে।২ সেইসময় যে বইগুলি লেখা হয় ‘Declaration of the Rights of Women’(Olympede Goleges : 1791) ও ‘Vindication of the Rights of Women’(Mary Wollstone Craft : 1792) – বইগুলিতে প্রতিবাদের কারণ ছিল অধিক কায়িক শ্রম করে পুরুষদের তুলনায় কম বেতন পাওয়ার ক্ষোভ আর সরকারের চোখে, আইনের চোখে ও শিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েদের সমান অধিকারের দাবী।৩ আমাদের ভারতবর্ষে কিন্তু নারীমুক্তি কথাটি নিয়ে আসেন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু জ্ঞানাণ্বেষী ব্যক্তিরা। আমাদের দেশে নারীরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিয়ে লড়াই করেছেন আরও কিছুদিন পরে। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি, বেগম রোকেয়া প্রভৃতি মণীষী নারীদের কথা উল্লেখ করেও বলা যেতে পারে ভারতবর্ষে দুই বিশ্বযুদ্ধের টানাপোড়েন, দ্বন্দ্ব, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের দিনগুলিতে ভারতবর্ষের নারীরা নিজেরা নিজেদের বাঁচাতে শেখে, ঘরের অন্তঃপুর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। কিছু বুভুক্ষু পুরুষের চোখে নারী কিন্তু শরীর ছাড়া আর কিছু নয়, তাই দুর্ভিক্ষ(১৯৪৩) দাঙ্গা(১৯৪৬) দেশভাগ(১৯৪৭) ঘটনা যাইহোক না কেন সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত, ধর্ষিত, আহত হতে হয় নারীদের। তবু হার না মানা নারীরা ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে চলে, ’৬৯-এর গণ আন্দোলন কি নারীদের ছাড়া এমন বড় ‘গণ’ হতে পারত ? আবার ’৭১-এ চরম নির্যাতিত হতে হতে এই নারীরাই শেখে মড়া থেকে মারা। এ বিদ্রোহ অন্তহীন কেননা আধুনিকতার আভরণে সমাজ আবার সেই নারীদের পড়ায় শৃঙ্খল। যেমন নারীরা শিক্ষিত হয়েছে কত সংগ্রামের মধ্যদিয়ে সেই শিক্ষিত নারীদের ‘শিক্ষা’ আজ বিয়ের একটি উল্লেখযোগ্য বিশেষণে কি দাঁড়ায়নি ?
বিভিন্ন পত্র পত্রিকার বিজ্ঞাপন গুলি সেই কথাই কিন্তু বলে। তবে কিছু কিছু পুরুষেরা যেমন নারী মুক্তির পথে বাঁধা তেমনি কিছু কিছু নারীরাও - সংস্কারের দ্বন্দ্ব, বিজ্ঞাপনের চমক প্রলোভনে কিছু নারীরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য থেকে পৌঁছে যায় ব্যক্তিসর্বস্বতায়। সেখানে পোশাকে হয়ত আধুনিকতা আসে কিন্তু মননে নয়।
‘আসলে সেই পুরোনো তত্ত্বেই ফিরে যেতে হয় – সমাজ বদল। এর কোনও বিকল্প নেই। কী বর্জন করবে, কে বর্জন করবে, কেন বর্জন করবে এ বিষয়ে পরিস্কার ধারণা না জন্মালে কেবল পোশাকই বর্জিত হবে, ঘুণে ধরা পুরোনো সংস্কার গুলো লেপটে থাকবে সারা গায়ে। ওগুলো বর্জন করতে জ্ঞান, চিন্তাশক্তি দরকার হয়, ওটা হেয়ার রিমুভারে হয় না।’৪
আর তাই-
‘জিনসের প্যান্ট, স্কিন টাইট টপ অথবা মিনিজ এবং টিশার্ট পরিহিতারা আধুনিক সাজে সজ্জিত হয়ে, আটশ টাকার জুতো, বারোশ টাকার অত্যাধুনিক বিদেশি সানগ্লাস পরে ঘটিতে দুধ নিয়ে গনেশকে খাওয়াতে ছোটে।’৫
ছোটগল্পকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস(১২-ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ – ৪ জানুয়ারি ১৯৯৩) শুধু বাংলাদেশেরই একজন শ্রেষ্ঠ অন্যতম গল্পকার নন, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তিনি সমাদৃত। তাঁর নির্মম কৌতুকবহ বাচনভঙ্গী, সরস নির্মোহ ভাব লেখনীর ক্ষেত্রে তাঁকে অনন্য করে তোলে। তিনি তাঁর গল্পের বয়ানে ব্যবহার করেন পর্যাপ্ত ডিটেলস, তাই দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন স্বপ্নের জগৎ, কুসংস্কার, যৌন জীবনযাপন এবং প্রায় সবকিছুই, তিনি সাহিত্যে জুড়েন। সেখানে বাদ যায়না প্রতিদিনের ব্যবহৃত তথাকথিত অশ্লীল ভাষাও। যার ফলে বাংলাদেশের অন্যান্য শ্রেষ্ঠ গল্পকার থেকে তাঁকে আলাদা করে চিনে নিতে আমাদের কোন অসুবিধে হয় না।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পাঁচটি ছোটগল্প গ্রন্থে প্রকাশিত হয় মোট ২৩টি ছোটগল্প৬ । কিন্তু ঢাকার মাওলা ব্রাদার্স থেকে খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের সম্পাদনায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের যে রচনাসমগ্র বার হয় চারটি খন্ডে তার এক ও চার নম্বর খণ্ড মিলিয়ে আমরা মোট ৩২টি (রচনাসমগ্র১ – ২৩টি গ্রন্থিত গল্প + রচনাসমগ্র৪ ৯টি অগ্রন্থিত ছোটগল্প) ছোটগল্প হাতে পাই। ইলিয়াসের নারী নিয়ে ছোটগল্পের সংখ্যা হাতে গোনা। তিনি বাস্তবধর্মী লেখক তিনি বাস্তবকে যেমনটি দেখেছেন তেমনটি(বাইরে ভিতরে) তাঁর কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। সাহিত্য বাস্তব ছাড়া নয়, বাস্তব মানবসম্পদ ছাড়া নয় আর মানবসম্পদে নারী-পুরুষ দু’জনেই অংশী। ইলিয়াসের ছোটগল্প গুলি থেকে নারীর মাতৃত্বের দিক, ফ্রয়েডিয়ান যৌনতার দিক, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বাসের দিক, গ্রামে প্রতারিত নারী, লোভাতুর নারী – ভালো খারাপ নির্বিশেষে সবকিছুই ফুটে ওঠে। এক নির্বিকারত্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
‘আমি(আখতারুজ্জামান ইলিয়াস) নির্দিষ্ট কোনো Philosophy মাথায় রেখে reality দেখি না। Reality –কে আমি ভেতর থেকে দেখতে চাই। কিন্তু আমি তো  Journalist না,  reality মানে যা আমি দেখতে পাচ্ছি কেবল তাই নয় -  এর ভেতরকার স্বপ্ন সাধ সংকল্প সংস্কার কুসংস্কার সবই reality-র ভেতরকার reality’৭
ইলিয়াসের ‘যোগাযোগ’(গল্পগ্রন্থ- ‘অন্যঘরে অন্যস্বর’, মে,১৯৭৬) গল্পটি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে রচিত হলেও এটি একটি বিশ্বজনীন সমস্যায় রূপান্তরিত হয়। মাতা ও সন্তান-এর মধ্যে সন্তান বড় হবার সাথে সাথে সম্পর্কের যে ব্যবধান বাড়তে থাকে ‘যোগাযোগ’ সেই সমস্যার গল্প হয়ে ওঠে। রোকেয়া তার খোকন কে রেখে যায় বাপের বাড়ি অনেকদিন পর সেখানে গিয়ে সে হারিয়ে যায় শৈশব স্মৃতি মধুরতায়, কিন্তু খোকনের ঘটে বিপত্তি, সে দোতলার কার্নিশ থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলেছে। রোকেয়া ভাবছে তার সন্তানের এই বিপত্তি তার বাড়িতে না থাকার দরুন। আবার এও ভাবছে যে তার খোকন যদি তাকে দেখে তাহলে তার সব ব্যথার উপশম হবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না । হাসপাতালে রোকেয়া গেলেও ‘রোকেয়ার হাতের তালুর নিচে খোকনের জ্বরের তাপ বাড়ে শুধু’৮। লেখক নিজের গল্প সম্পর্কে জানান আমাদের-
‘আমি বলতে চাইছিলাম একজন মা- with her all affection, motherhood, বাৎসল্য- একটা পর্যায়ে ছেলের সব কষ্ট লাঘব করতে পারে না। রোকেয়া ছেলের অসুস্থতার কথা শুনে ফিরেছে। ...সে যখন ছেলের কাছে পৌঁছাচ্ছে তখন তার গাঁয়ে ১০৩০ জ্বর কম্বলের মত জড়িয়ে। রোকেয়া হাত দিচ্ছে কিন্তু সে-হাত ঐ কম্বল ভেদ করে ছেলের কষ্টের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। ...ছেলে যখন বড় হতে থাকে মায়ের সাথে এক পর্যায়ে আর যোগাযোগ ঘটে না। যে মায়ের উপর তুমি দারুণ dependent ছিলে একসময় , এক পর্যায়ে তার সাথে তোমার সব কষ্টের আর যোগাযোগ ঘটছে না। তুমি তোমার সব problem আর share করতে পারছ না। হয়তো তোমার প্রেমের সমস্যা বা কোনো philosophical crisis দুজনের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তা হয় না, এটা দুজনের জন্য খুব বেদনাদায়ক। তবু এটাই সত্য।’৯
এটা গল্পে যে রোকেয়া ও তার খোকনের মধ্যে হয়েছে তা নয়, এটা হয়েছে স্ত্রী হারানো সোলায়মান আলী(রোকেয়ার বাবা) আর রোকেয়ার মধ্যেও। খোকনের খবর শোনার পর ট্রেনে বিরতিহীন রোকেয়ার কান্না দেখে সোলায়মান আলীর মনে হয়-‘এতো আদর এতো ভালোবাসা ওর কষ্ট কি একটুও কমেনা ?’(‘যোগাযোগ’, পৃষ্ঠা- ৫৪)। এ গল্পের যে সমস্যা তা অনেক পুরোনো। যে কারণে কার্তিক ঠাকুরের সাথে উমার বিয়ে হয়নি, ও কার্তিক চিরকুমার। কারণটি মা দুর্গার অভিমান, পাছে বৌ আসলে মায়ের আদর কমে। কিন্তু দেখবার বিষয় বিবাহ নামক ব্যবস্থায় মধ্যবিত্ত বাঙালি নারীকে, যে চাকুরীরতা নয়, তাকে সর্বদা সময়ের ব্যবহার করতে হয় সংসারে। এই সংসারে তাদের  সর্বাধিক অধিকার ফুটে ওঠে দুটি সম্পর্কের মাধ্যমে-

এই নারীর প্রণয়ী ও মাতৃত্বের দ্বন্দ্বের চরম অভিঘাত লক্ষ্য করি আমরা বনফুলের ‘বুধনী’ গল্পের মাধ্যমে। তাহলে যে নারীর এতটা সময় পার হয় ‘মাতৃত্ব’ সম্পর্কের মাধ্যমে তার অধিকার হঠাৎ করে অন্য কেউ যখন নেয় তখন দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী। সুতরাং শাশুড়ি ও বৌ –এর সম্পর্কের এই গুপ্ত টানাপোড়েন শুধুমাত্র নারী সম্পর্কের মিথ বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। তার ভুল-ভ্রান্তি খুঁজতে হবে আমাদের গভীর সামাজিক সম্পর্কের মানসিক টানাপড়েন গুলিতেই। না হলে ‘চোখের বালি’(১৯০৪) উপন্যাসের মত সংসারের সমস্ত সম্পর্কের টানাপোড়েনের দোষ ‘মাতৃ-ঈর্ষা’র উপর পড়তে বাধ্য, আজও। এও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর চরিত্রের চরম অবমাননা ছাড়া আর কি?
ইলিয়াসের সেপ্টেম্বর, ১৯৮২ সালে প্রকাশিত ‘খোঁয়ারি’ গল্পগ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য গল্প হল ‘তারাবিবির মরদ পোলা’। এটি একটি ফ্রয়েডিয়ান যৌন মনস্তত্ত্বের গল্প। রমজানের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী তারাবিবি। বয়সের ব্যবধানের দরুন তারাবিবির দাম্পত্য স্বাদ কিছুটা তিক্ত- ‘তুমি (রমজান) তো একখান মরা মানুষ! তামামটা জিন্দেগী ভইরা খালি বিছানার মইদ্যেই পইড়া রইছ, একটা দিন বুঝবার পারলা না আমি ক্যামনে কি পেরেশানির মইদ্যে ঘরবাড়ি চালাই।’(‘তারাবিবির মরদ পোলা’,পৃষ্ঠা-১৩৪) আর সেই কারণে তারাবিবি তার ছেলে গোলজার কে অহেতুক সন্দেহ করে। এবং গোলজার ও তার স্ত্রী সখিনার মধ্যে সর্বদা লড়াই বাধানোর চেষ্টা করে। কিন্তু যেদিন সত্যি গোলজার পরকীয়ায় যায় সেদিন এই তারাবিবি-ই বলে তার স্বামীকে- ‘পোলায় আমার জুয়ান মরদ না একখান? তুমি বুইড়া মড়াটা, হান্দাইয়া গেছো কব্বরের মইদ্যে, জুয়ান মরদের কাম তুমি বুঝবা ক্যামনে?’ (‘তারাবিবির মরদ পোলা’,পৃষ্ঠা-১৪৭) তারাবিবির মধ্যে দ্বন্দ্ব এভাবেই কাজ করে। তারাবিবির এই দ্বন্দ্ব   দুটি সম্ভাব্য কারণ দিয়ে দেখা যেতে পারে-
এক। তারাবিবি নিজের অদম্য ইচ্ছে(id) সরাসরি পূরণ করতে পারছে না, সামাজিক বিধিনিষেধের(Ego, Superego) জন্য তাই সেটি সে পূরণ করতে চাইছে অন্য পথে, পুত্র গোলজারের হাত ধরে।
দুই। যেহেতু তারাবিবি নিজের দাম্পত্য জীবনে সুখী নয়, তাই তার পাশাপাশি নিজের ছেলের সুখী গৃহকোণ তার চোখে জ্বালা ধরাবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
তারাবিবির এই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব কে ফ্রয়েডিয়ান ভাষায় বলা হয় ‘ডিফেন্স মেকানিজম’। এর অনেকগুলি ভাগ। তারাবিবি’র যেটি তাকে বলা হয় ‘Projection’ অর্থাৎ নিজের অদম্য ইচ্ছে গুলিকে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে দোষারোপ করা –
‘This involves individuals attributing their own unacceptable thoughts, feeling and motives to another person’১০
তারাবিবির এই দ্বন্দ্বের কারণ লুকিয়ে আছে মূলত পুরুষ তান্ত্রিক সমাজেই কারণ আমাদের সমাজে আজও পুরুষের পরকীয়া বা দুটি বিয়ে দোষের হয় না, দোষটা হয় মেয়েদের বেলাই। তাই রমজান বৃদ্ধ বয়সে (নিজের সাধ্যের বাইরে বেরিয়েও!) তারাবিবিকে বিয়ে করতে পারে। কিন্তু তারাবিবিকে তার অদম্য ইচ্ছে পূরণের জন্য ব্যবহার করতে হয় ‘Projection’-এর চোরাপথ। ইলিয়াস কিন্তু নর-নারীর প্রেম কে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানে না বেঁধে স্বাধীনভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা রাখতেন।
‘একজন সভ্য নারী আর পুরুষের পরস্পরের প্রতি যদি অনুমোদন থাকে সেখানে তাদের মিলনে কোনো সংস্কার, অপরাধবোধ, পাপবোধ যেন বাধা হিসেবে না-আসে, সে-রকম সোসাইটি কোনোদিন আসবে কি না জানি না, কিন্তু যা আসবে না তাকে প্রত্যাশা করব না কেন?’১১
গল্পগ্রন্থ ‘দুধেভাতে উৎপাত’-এর (ফেব্রুয়ারি,১৯৮৫) একটি খুব সুন্দর গল্প হল ‘মিলির হাতে স্টেনগান’। গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের পরের স্বপ্নভঙ্গের গল্প। বাংলাদেশের সাথে জড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের(১৯৭১) রক্তদাগ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরের ইতিহাস আলাদা। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ইলিয়াস মনে করতেন  যে-
‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের দারুণ স্বপ্ন ছিল। ...এত স্বপ্ন দেখার তো কোনো মানে ছিলনা। মুক্তিযুদ্ধ তো তেমন organized কিছু ছিল না, তা ছাড়া এর definite কোনো goal-ও ছিল না। সাধারণ মানুষ কৃষকেরা যে যুদ্ধ করেছিল তা তো কোনো আদর্শ থেকে করেনি। করেছে, কারণ না-করলে তারা মারা পড়ত। আর মুক্তিযুদ্ধের পরের সময়টা তো চরম স্বপ্নভঙ্গের কাল। ...Positive হলো মানুষের প্রতিরোধ করার সংকল্প, মানুষের সাহস।’১২
মিলি তবু আশা রাখে আব্বাস পাগলার উপর। তার পাগলামি শুরু মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। আব্বাস পাগলা মনে করে দুশমনেরা এখন আকাশ, চাঁদ সব দখল করে নিচ্ছে, আব্বাস পাগলা তাদের আটকাতে পারে কিন্তু তার জন্য চাই স্টেন গান। তাই মিলি আব্বাস পাগলা কে অন্য সকল থেকে আলাদা করে চিনতে পারে। মিলির দাদা রানা একসময়ের মুক্তিযোদ্ধা এখন অপরাধ মূলক কাজ করে, রাজনৈতিক নেতাদের সাহায্যে উঠতি বড়লোক। মিলির দাদার বন্ধুরাও তাই। মিলির মা তাদের মধ্যে কোনো পয়সাওয়ালা দাদার বন্ধুর সাথে মিলির বিয়ে দিতে চায়। কিন্তু মিলি তাদের আলাদা করতে পারে না। সে তাদের মধ্যে আলাদা করতে পারে একমাত্র আব্বাস পাগলা কে। এই আব্বাস পাগলাই শেষে ভালো হয়ে যুদ্ধ ভুলে যায়। রানার কাছে আসে কাজের সাহায্য চাইতে। মিলির কাছে তখন আব্বাস পাগলাও সকলের সাথে ভিড়ে মিশে যায়। মুক্তিযুদ্ধে অনেক মেয়েরাও শহীদ হয়। মিলি আব্বাস পাগলার মাধ্যমে সেই লড়াইয়ের মধ্যে মিশে যেতে চায়, তাই তো সে  শেষে দাদার স্টেনগান চুরি করে আব্বাস পাগলা কে দিতে চায়, কিন্তু আব্বাস পাগলা তখন সুস্থ আর বাংলাদেশের মত মিলিরও হয় স্বপ্নভঙ্গ কেননা আব্বাস পাগলাও সকলের সাথে ভিড়ে হারিয়ে যায়।
এখন সময়ে বিত্তই করে মান বিচার। বিশেষণে হারিয়ে যায় বিশেষ্য। ‘মিলির হাতে স্টেনগান’ গল্পে আমরা দেখি মিলির মা’কে, তিনি গাড়িওয়ালা ছেলেটিকেই মিলির সাথে বেশি পছন্দ করেন বিয়ে দিতে, তিনি জানেন রানা সৎ পথে উপার্জন করছেন না, তবু তার উপরই ভালোবাসা উগরে দিচ্ছেন। এমন আরো একটি চরিত্র দেখি ইলিয়াসের ‘কীটনাশকের কীর্তি’ গল্পে (গল্পগ্রন্থ-‘দোজখের ওম’, ১৯৮৯)। আমরা পাই রামিজ আলির বোন আসিমুন্নেসা কে। যে নিজেকে সঁপে দেয় গ্রামের বিত্তশালী হাফিজুদ্দির ছেলে ‘ম্যাট্রিক পাসের’ কাছে। গল্পে কোথাও নেই বিশেষ্যের নাম।  এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে রমাপদ চৌধুরীর ‘রত্নকূট’ গল্পের কাঞ্চনের কথা, যে শেষ পর্যন্ত জয় করে লক্ষপতি মোহনলালকে। এই বিত্তশালীদের কাছে সঁপে দেওয়া ছাড়া কি উপায় আছে কাঞ্চনদের, ও রমিজের বোনদের? রমিজের বোনের সেই সম্পর্কের উপরেই তো নির্ভর করত একদা পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। বলতে গেলে আয় ভোগস্পৃহা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য চায় সবাই আর সেই আর্থিক দুর্বলতায় অনেক কাঞ্চনরাই বাধ্য হয় নিজেদের সঁপে দিতে বিত্তশালী মোহনলালদের কাছে।
ইলিয়াস এভাবে নারীর দোষ গুন সব মিলিয়ে তুলে ধরেন, সেখানে বাদ যায় না কিছুই। যেমন- আমাদের মায়েরা অসুখ কে একটু বাড়িয়ে বলতে ভালোবাসে। সেই রকম-ই একটি গল্প হল ‘অসুখ-বিসুখ’ গল্পটি। আতমন্নেসা সর্বদা অসুখ বিলাসি। নিজের মেয়ের অসুখকে সে হিংসা করে। সে চায় তার ঘরেও মেয়ের মত নানা রঙের বোতলে সাজানো ঔষুধ থাকুক। তার জন্য  সে সবাইকে তার শরীর খারাপের কথা বলে। গল্পের পরিনামটি কিন্তু কষ্টের গল্পের শেষে সত্যি আতমন্নেসা’র বড়ো রোগ হয়, ক্যান্সার, সে বোঝে কিন্তু সে সুখী তার টেবিলে দামী ঔষুধ সাজানো দেখে আর তাকে নিয়ে তার পরিবারের ব্যস্ততা দেখে।
‘দুধেভাতে উৎপাত’-গল্পে আমরা দেখি ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’ বাঙালি নারীর চিরন্তন মাতৃত্বের বাণীটিকে। জয়নাব হত দরিদ্র গ্রামের বৌ, সে এখন মৃত্যু পথযাত্রী তার একমাত্র ইচ্ছে তার সন্তানেরা যেন তার সামনে একটু দুধভাত খেতে পারে। কিন্তু তার আশা পূর্ণ হয়না। গরিবের দুধের আশা পূর্ণ হয় চালের গুড়ো দিয়ে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে অভাগী পারেনি তার মায়ের আশা পূর্ণ করতে তেমনি ’৪৭,’৫২,’৭১ পেরিয়ে যাওয়া বাংলাদেশে ওইদুল্লা’ও পারেনা তার মায়ের আশা পূর্ণ করতে। অগ্রন্থিত গল্পে ইলিয়াসের এমনি একটি গল্প হল ‘ঈদ’ যেখানে রজব কে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য নিজের মায়ের কাছে মার খেতে হয় কেননা রজব যাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে তারা মালিক পক্ষ, তার মা সে বাড়িতে কাজ করে। রজবের মা ফতিমার অসহায়ত্বের সঙ্গে মমতার দিকটি খুব নিখুঁত লেখনীতে তুলে ধরেন ইলিয়াস এই গল্পে।
ইলিয়াসে গ্রন্থিত একটি গল্প হল ‘প্রেমের গপ্পো’(গল্পগ্রন্থ-‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’, জানুয়ারী ১৯৯৭) সেখানে নিজের স্ত্রী বুলা’র কাছে নিজের দর বাড়াতে জাহাঙ্গীরকে সাজাতে হয় তার মিথ্যে প্রেমের কিছু গল্প। সেই গল্পগুলিতে জাহাঙ্গীর সব নারীকে প্রত্যাখিত করেছে। বুলা বোঝে, কেননা একই গল্প অন্যদিন বলবার সময় প্লটের পরিবর্তন করে। বিবাহিত জীবনের স্বামী-স্ত্রী’র মানসিক টানাপোড়েন, সেইসঙ্গে জাহাঙ্গীরের মানসিক একাকীত্বের মিথ্যে গল্প ফানুস সুন্দরভাবে তুলে ধরা আছে। চিরন্তন পুরুষত্ব নিজের স্ত্রীর কাছেও নিঃসঙ্গতার ঝাঁপি খুলবেনা তার বদলে তৈরি করবে মিথ্যে প্রেমের আষাঢ়ে গপ্পো।
এভাবে ইলিয়াস ভালোমন্দ সবমিলিয়ে তাঁর গল্প ভুবনে নারীদের তুলে ধরেন, তারা হয়ে ওঠে আমাদের চেনা জগতের রক্ত-মাংসে গড়া মানবী। যারা এই আবহমান কালে নিস্তব্ধে তদের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
‘টুম্পারানীর একটুও নেই ভয়
একবার যা সত্য ভাবে তাইতে নিঃসংশয়।
টুম্পা যখন বড়ো হবে, রইবে না আর খুকী
নিজের সত্য অটল রাখতে নেবে অনেক ঝুঁকি।
সেনাপতির হাতে বাজুক অস্ত্রের ঝঙ্কার
টুম্পারানীর চোখে মুখে ছাপ নেই শঙ্কার

রাজা রানী উজির নাজির দ্যাখাক প্রলোভন
টুম্পা নেবে মুখ ফিরিয়ে, টলবে না তার মন
টুম্পা রইবে অটল নিজের শক্তি ও বিশ্বাসে
জনপ্রাণী থাকুক কিংবা নাইবা থাকুক পাশে।’
- আখতারুজ্জামান ইলিয়াস১৩


তথ্যপঞ্জি—
১। মল্লিকা সেনগুপ্ত, ‘নান্দীমুখ’(কথামনবী), মূলগ্রন্থ – “মল্লিকা সেনগুপ্ত কবিতা সমগ্র”, সম্পাদনা- সুবোধ সরকার, আনন্দ, কোলকাতা, জুন২০১৩, পৃষ্ঠা-২০৫।
২। কনক মুখোপাধ্যায়, ‘মার্কসবাদ ও নারিমুক্তি’, মূলগ্রন্থ – “নারী নির্যাতন নারী আন্দোলন”, ড. চিত্ত মণ্ডল সম্পাদিত, নবজাতক প্রকাশক, কোলকাতা, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৬, পৃষ্ঠা-১৭৬-১৭৮।
৩। শেফালী মৈত্র, ‘নৈতিকতা ও নারীবাদ’, নিউ এজ, কোলকাতা, জুন ২০০৭, পৃষ্ঠা-২১-২২।
৪। সেরিনা জাহান, ‘মেয়েলি শরীর : শরীরী মেয়ে’, মূলগ্রন্থ – ‘লৌকিক উদ্যান মানবী সংখ্যা’, দশমবর্ষ পূর্তি সংখ্যা ১৯৮৯-১৯৯৯, সম্পাদক- প্রেমেন্দ্র মজুমদার, ইউ বি আই স্টাফ ওয়েলফেয়ার এণ্ড কালচারাল সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত, কোলকাতা, শ্রাবণ ১৪০৬, আগস্ট ১৯৯৯, পৃষ্ঠা-৩৩।
৫। ঐ, পৃষ্ঠা-২৩।
৬। খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, ভূমিকা, রচনাসমগ্র।১, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাওলা ব্রাদার্স।।ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯, পৃষ্ঠা-তিন।
৭। শাহাদুজ্জামান, ‘জীবনের জঙ্গমতা ও লেখকের উপনিবেশ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস’(সাক্ষাৎকার), পৃষ্ঠা-৩৭।(বইটি প্রতিলিপি রূপে আমার কাছে সংরক্ষিত তাই পুরো তথ্য দেওয়া গেল না)।
৮। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ‘যোগাযোগ’, মূলগ্রন্থ- “রচনাসমগ্র।১ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস”, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৫৮।
৯। শাহাদুজ্জামান, ‘জীবনের জঙ্গমতা ও লেখকের উপনিবেশ’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা- ৬৬-৬৭।
১০। Internet Search ‘www.simplypsychology.org’ ।
১১। শাহাদুজ্জামান, ‘জীবনের জঙ্গমতা ও লেখকের উপনিবেশ’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা- ৫৬।
১২। ঐ, পৃষ্ঠা – ৭৪।
১৩। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ‘টুম্পারানী’, মূলগ্রন্থ – “রচনাসমগ্র।৪ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস”, মাওলা ব্রাদার্স।।ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা- ২০৪।

No comments:

Post a Comment