Wednesday, December 25

মানসী রায়ের অণুগল্প : চৌকাঠ








মানসী রায়
চৌকাঠ

মন্দিরা তৈরি হচ্ছিল। পিতৃশ্রাদ্ধ মিটিয়ে ছেলে আবার দিল্লি ফিরে যাবে। এয়ারপোর্টে তাকে বিদায় জানাতে সে-ও উপস্থিত থাকবে। যদিও ছেলে বারবার বারণ করেছিল এইরকম শোকের সময়, মানসিক বিপর্যয় নিয়ে তাকে বাইরে না বেরোতে। মন্দিরা শোনেনি। সত্যিই, এত আকস্মিক ভাবে সবকিছু ঘটে গেল! স্বাস্থ্য নিয়ে সুকল্যাণের কখনওই তেমন কোনও অভিযোগ ছিল না। তারপরও... ডাক্তার বলছিলেন ম্যাসিভ এটাক নাকি কোনওরকম পূর্বলক্ষণ ছাড়াই হতে পারে! তবে শেষ ক'দিনে বাড়ি ভর্তি লোকজনের মধ্যে থেকে মন্দিরার প্রাথমিক দিশেহারা ভাবটা অনেকটাই কেটেছে। সে জানে তার আসল সমস্যা শুরু হবে এর পর থেকে। একমাত্র সন্তান বাইরে পড়াশোনা করে। স্বামীহীন একার জীবন খুব স্বস্তির হয়তো হবেনা।

       বিশাল আয়নাতে নিজেকে অপাঙ্গে দেখছিল মন্দিরা। বিছানার পাশের টেবিলে সুকল্যাণ আর ছেলের সর্বশেষ ছবিটা ফ্রেমবন্দি করে রেখে দিয়েছে ছেলে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে সামান্য থমকাল মন্দিরা। বাইশটা বছর প্রেমে-অপ্রেমে কীভাবে যেন কেটে গেল! অথচ সুকল্যাণ কোনওদিনই তার সেই কল্পনার পুরুষ ছিলনা। বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই তার মনশ্চক্ষে যার আনাগোনা, সে বাস্তবে সত্যি সত্যি তার সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিল কই? ভিড়ের মধ্যে, নির্জনে, সমুদ্রে, পাহাড়ে...সব জায়গায় মন্দিরা কেবলই খুঁজে বেড়াত একটা নির্দিষ্ট কল্পিত মুখ আর তার কাল্পনিক চরিত্র! তার প্রাক্তন প্রেমিক বা সুকল্যাণ- কারুর সঙ্গেই বহু চেষ্টা করেও মন্দিরা যাকে মেলাতে পারেনি!  অন্যদিকে ছেলে যত বড় হতে থাকল, সে অপার বিস্ময়ে, অবিশ্বাসে ধীরে ধীরে বুঝতে পারল তার সেই প্রবল অস্তিত্বহীন, আকাঙ্ক্ষিত পুরুষকে সে শেষপর্যন্ত নিজের গর্ভে ধারণ করে ফেলেছে!  সেই মুখ, সেই চেহারা, সেইরকমই কাঙ্ক্ষিত স্বভাব...। ছবিতে পাশাপাশি দুজন। বাবা-ছেলে? কল্পনা-বাস্তব? না প্রতিদ্বন্দ্বী?
     
        সাদা নয়, মাঝবয়সী মন্দিরা নিজেকে তার প্রিয় রঙে সাজাচ্ছিল। প্রার্থিত পুরুষের কাছে এটাই হবে তার প্রথম এবং শেষ নিজেকে প্রকাশ করার অছিলা। অব্যক্ত, অনুচ্চারিত। তারপর হয়তো কোনও বৃদ্ধাশ্রম - মন্দিরা ছকে রেখেছে।

ছেলে ডাকছিল ঘরের বাইরে থেকে। মন্দিরা অভ্যেসবশে সাড়াও দিল। কিন্তু সে চৌকাঠটা কিছুতেই ডিঙোতে পারছিল না!

No comments:

Post a Comment