Monday, December 31

প্রবন্ধ : দেবায়ন চৌধুরী







 স্বপ্নময়ের অণুগল্প

             
আমরা যারা অণুগল্প পড়তে ভালোবাসি, অল্পস্বল্প ভাববার চেষ্টা করি সাহিত্যের সংরূপ নিয়ে; তাঁদের কাছে অবশ্যই প্রিয় হয়ে ওঠেন গল্পকথক স্বপ্নময় চক্রবর্তী। সাম্প্রতিক সময়ে অণুগল্প নিয়ে যে নতুনভাবে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে, এর মূলে তাঁর অবদান কম নয়। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘অণুগল্প সংগ্রহ’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল অভিযান পাবলিশার্স থেকে, ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। শতাধিক গল্পের এই সংকলনের সূত্র ধরেই আমরা পাঠক হিসেবে চিনে নিতে চাইব অনন্য অণুগল্পকারকে। ‘সোনাকথা রুপোকথা’, ‘এই আমি, এই তুমি’, ‘সম্পর্কের এমব্রোডারি’, ‘সময়ের ছেটানো ছবি’—এই চারটি ভাগে  অণুগল্পগুলিকে ভাগ করা হয়েছে। সময় ও সম্পর্ক যেকোনো সাহিত্যিকেরই লেখার প্রধান অবলম্বন। আর, মিথের পুনর্নিমাণের প্রচেষ্টা স্বপ্নময়ের গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। চলুন এবার একটি অণুগল্প পড়ি—

“ রাজারহাটে সাড়ে তিন কাটার প্লট পেয়েছিলাম। বাড়ি করব বলে ভিত খোঁড়া হচ্ছিল, একটি কৌটো বের হল মাটির তলা থেকে। সিঁদুর কৌটো। একটা আয়না। হাড়ের চিরুনি। পুঁতির মালাও পেয়েছিলাম।

        বাড়ি হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে সন্ধের সময় একটা বউ-এর কান্না শুনি। যার একটা সংসার ছিল। যে ঘরছাড়া হয়েছিল।” (পৃঃ ২২) গল্পটির নাম ‘ঘর সংসার’। যার বিবেকবোধ সক্রিয়, সেই বুঝি হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! মাটি খুঁড়ে যে বস্তুগুলো পেয়ে যান লেখক, সেগুলি আমাদের অন্য এক জীবনের গল্প বলতে চায়। উপনগরীর জন্য গ্রামের মানুষের উচ্ছেদ হবার বিষয়টি আমরা তো মেনেই নিয়েছি একভাবে। উন্নয়নের হিড়িকে উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে আমাদের বেশিরভাগ মানুষেরই মাথাব্যথা নেই। কিন্তু এই গল্পে যখন দেখি সন্ধের সময় এক বউ-এর কান্নার স্বর শুনছেন কথক, মনের কোণে কি উঁকি দেয় না দুঃখবোধ? ‘যার একটা সংসার ছিল। যে ঘরছাড়া হয়েছিল।’ দীর্ঘশ্বাসের ডালপালা বেঁধে ফেলে দুটি সময়, দুটি ঘর, দুটি মানুষকে। চোখের জল আড়ালে চলে যায়। বহুতলের ভিতের নিচে এমনই কত ঘরহারাদের আয়না। ‘সোনাকথা রুপোকথা’ অংশের ‘ভুল কোকিল’ গল্পে দেখি লেখক থিম ট্যুরিজম নিয়ে কথা বলছেন। একটি রিসোর্ট যেখানে কৃত্রিমভাবে থিম তৈরি করা হয়। একদিন দুপুরবেলায় সেখানে কোকিল ডাকছে খুব। কম্পিউটার ইনচার্জ বুঝতে পারছেন না গণ্ডগোলটা ঠিক কোথায়। কম্পিউটার বন্ধ করে দেবার পরেও ডেকে উঠল কোকিল। ‘কী সর্বনাশ!’ গল্পের শেষ লাইনটি এরকম— “বাগানে একটা সত্যিকারের কোকিল ঢুকে গেছে।” (পৃঃ ১৬) যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়ে ওঠে যেন প্রকৃতি। কোকিলের ঢুকে পড়া যে কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ বুঝতে পারেনি, তার নাম মধুবন্তী। নকল দেখে দেখে আমরা আসল চিনতেই যে ভুলে গেছি আমরা। প্রযুক্তির উন্নতি, মানুষের কৃত্রিম জীবন নিয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘ভেলা’ গল্পটির কথা এই কাহিনির সূত্রে মনে পড়ে যায়। ‘আমাদের রবীন্দ্রনাথ’ আখ্যানে দেখি রবীন্দ্রনাথের শেষযাত্রার পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। তাঁর শবযাত্রায় রয়েছে মন্ত্রীবর্গ। সব রাজনৈতিক দল। “সি.পি.এম., কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেপি, এমনকি মাওবাদীরাও। সবাই বলছে রবীন্দ্রনাথ আমাদের।” শবদেহ নামানোর পর দেখা গেল একজন অতিমান্য রবীন্দ্রভক্ত রাজনৈতিক নেতা ‘রবীন্দ্রনাথকে প্রণাম করে তাঁর মুখমণ্ডলের একটি মাত্র শ্বেতশুভ্র শ্মশ্রু ছিন্ন করে পকেটে ঢোকালেন।’ ক্রমে ক্রমে বিধায়ক থেকে আবৃত্তিকার, অধ্যাপক থেকে গায়ক সকলেই ‘রবীন্দ্রনাথকে খুবলে নিতে লাগলেন।’ শেষে দেখা গেল শবাধারে কিছু ফুল কেবল পড়ে রয়েছে। মারাত্মক! এখানেই শেষ নয়। সৃষ্টিকর্তা নেমে এলেন। হাতে মাইক নিয়ে বললেন, রবীন্দ্রনাথকে ফিরে পেতে চাইলে টুকরোগুলি ফিরিয়ে দিতে হবে তাঁর কাছে—তিনি জোড়া দিয়ে প্রাণসঞ্চার করবেন। অনধিক দুশো শব্দের এই গল্পটির শেষ হচ্ছে এইভাবে—“ মাইকের ব্যাটারি শেষ হয়ে গেল। কেউ কিছুই ফিরিয়ে দিল না।” (পৃঃ ২১) গল্পটির বাস্তবতা নিয়ে আদৌ কোন সন্দেহ প্রকাশ করা চলে কি? রবীন্দ্রনাথ আমাদের বলে তাঁকে টুকরো টুকরো করে খুবলে নেবার চেষ্টা আমরা তো করে চলেছি প্রতিনিয়তই। পূজা নিবেদনের ফুল সেখানে কোনো অর্থ রাখে আমাদের কাছে? বিশ্বকবির শেষযাত্রার মর্মান্তিক পরিণতিকে ভিত্তি করে গল্পকার আসলে আমাদের রবীন্দ্রভাবনাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইলেন। সৃষ্টিকর্তার অসহায়তার সূত্রে সভ্যতার সংকটের অন্য ভাষ্য তৈরি হয় যেন। রবীন্দ্রনাথের প্রাণ ফিরে না পাবার কথা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে এই গল্পটি ফুটিয়ে তোলে আমাদের অন্তঃসারশূন্যতাকেই।



‘এই আমি, এই তুমি’ শিরোনামের অন্তর্গত গল্পগুলি ছুঁয়ে থাকে বিভিন্ন বিষয়কে। ব্যক্তিগত পরিসরের সূত্রে উঠে আসে সমাজ সময়ের জরুরি কিছু প্রসঙ্গ। ‘কথা’ গল্পে দেখি রেলের কামরায় জানলার পাশে মুখোমুখি বসে এক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা বই পড়েন। কোনোদিন তাদের কথা বলতে দেখেনি কথক। ভদ্রমহিলা হৃদয়পুর স্টেশনে নেমে যাবার আগে রোজ বলেন- “ ... আসি। আবার কাল কথা হবে কেমন?

             ভদ্রলোক বই থেকে চোখ তুলে বলেন হ্যাঁ, আবার কাল কথা হবে।” (পৃঃ ২৯)

কথার ধারণাকেই পাল্টে দেন লেখক। আবিষ্কার করতে থাকেন আমাদের এই প্রতিদিনের জীবনে ছড়িয়ে থাকা সংযোগের ভাষাকে। খালি চোখে যা ধরা পড়ে না। গভীর, গোপন, রহস্যময়। কবিতার মতো। কবিতার সঙ্গে অণুগল্পের মানসিক নৈকট্য খুব বেশি করা পড়ে স্বপ্নময়ের লেখায়। ‘দেখা’ গল্পে দেখি ক্যানসার আক্রান্ত অতুলবাবু তাঁর রিডারের কাছে শুনতে চাইছেন জীবনানন্দের কবিতা—যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে...। শ্যামলী পড়ল কবিতাটি। অতুলবাবু চোখে দেখতে পারেননা জেনেছি আমরা গল্পের প্রথমেই। গল্পের শেষে যখন অতুলবাবু বলেন- “ তোমার চোখে জল শ্যামলী, আমি যে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি” (পৃঃ ৩০); দেখার অন্য অর্থ তৈরি হয়ে ওঠে। চোখের দেখাকে ছাপিয়ে যায় মনের দৃষ্টি। স্বপ্নময়ের গল্পে অন্যান্য সাহিত্যিকদের লেখার উল্লেখ আখ্যানের আত্মার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকে। ‘আবার দেখা’, ‘অন্তর্গর্ভ’, ‘রেখে আসা’ গল্পগুলি অণুর মধ্যেই ফুটিয়ে তোলে বৃহতের ব্যঞ্জনা। গল্প শেষ হয়। কিন্তু ফুরোয় না...



যেকোনো লেখাই আদতে রাজনৈতিক। তবু কোনো কোনো লেখায় রাজনৈতিক অভিঘাত বেশি তীব্র হয়ে ওঠে। যেমন ‘পতাকা’ গল্পটি—

“ কারখানা বহুদিন বন্ধ। রসময় তেলেভাজা ভাজে। পার্টি অফিসে মাঝেমাঝে ওর তেলেভাজা যেত, এখন যায় না। ভি আর এস নিয়ে একজন বাবু কমরেড বড়ো তেলেভাজার দোকান করেছে। শো-কেস, কাগজের বাক্স, ভালো কারিগর। ওই দোকান থেকেই এখন তেলেভাজা যায়।

        রসময়ের মেয়ে বাড়ি থেকে আলুর চপের লেচি নিয়ে আসে। আজ লাল পতাকাটা দিয়ে ঢেকে আলুর চপের থালা নিয়ে এল।

        রসময় ভীষণ জোরে থাপ্পড় মারল মেয়েকে। ছিঃ, এ কী? লাল পতাকায় ঢেকে আলুর চপের লেচি আনলি?

        মেয়েটি কাঁদে। বলে কী করব? ঘরের কোনায় ন্যাকড়া হয়ে পড়ে ছিল এতদিন...

        চোখ মোছে। ওই পতাকা দিয়েই। ” (পৃঃ ৩৬)

গল্পটি পড়বার পর স্তব্ধতা গ্রাস করে পাঠককে। লাল পতাকার গল্পে কীভাবে জড়িয়ে যায় দিনবদলের ছবি। বন্ধ কারখানার শ্রমিকের পেশা পাল্টে গেছে। এদিকে পার্টির পছন্দ বদলেছে, মনোযোগও নয়কি? রসময়ের মেয়ে লাল পতাকা দিয়ে ঢেকে আনে আলুর চপের থালা। পতাকার ব্যবহারিক প্রয়োগ ও কাণ্ডজ্ঞানের দর্শন নিয়ে ভাবনার মধ্যেই চমক লাগে। বাবা তার মেয়েকে মারছে লাল পতাকার অবমাননার জন্যে। মেয়েটি কী করবে সে দেখেছে পতাকাটি ‘ঘরের কোণে ন্যাকড়া হয়ে পড়ে ছিল এতদিন...’ । পতাকা দিয়ে মেয়েটির চোখের জল মোছার ছবিতে গল্পটি ছুঁয়ে ফেলে শিল্পের সর্বোচ্চ স্তরকে। পরতের পর পরত খুলতে খুলতে যায় গল্পটি। পতাকা মানে যে চোখের জলের সম্বল, নানা দুঃখের মধ্যেও জাপ্টে থাকা জীবনবোধ—কতজন অনুভব করি আমরা? যে শ্রমিক কারখানার কাজ হারালো, তার ঘরের কোণে পতাকাকে ন্যাকড়ার মর্যাদা থেকে মুক্ত করবার দায় কি পার্টির ছিল না? নাকি কমরেডের পার্টি বাবুতে ভরে গেছে? তেলেভাজার সূত্রে পরিবর্তিত পরিস্থিতির নিখুঁত চিত্রায়ন কতটা অব্যর্থ, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘ইতিহাস’ গল্পে দেখি একদা বাম রাজনীতি করা এক কাঠকলের মালিককে, যিনি মেয়ের বিয়ের জন্য আসবাব বানাবেন। তাঁর অফিস ঘরে লেনিনের ছবি। শাসক দলের নেতাদের সঙ্গেও তিনি ঘনিষ্ঠ। যাহোক, ভিয়েতনামের সেগুন চেরাই হচ্ছে—“ হঠাৎ তীব্র শব্দ। অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। বিদ্যুৎ চালিত করাত বেঁকে গেল।



আসলে কাঠের গভীরে ছিল কয়েকটা বুলেট। গোপনে। যুদ্ধের।” (পৃঃ ৩৭) লেখকের অন্তর্ঘাতী প্রতিবেদন স্পষ্ট। এক নিমেষে মনে পড়ে যায় ভিয়েতনামের যুদ্ধের কথা। ‘উন্নয়ন’ গল্পে দেখি উন্নয়নের স্বার্থে শহিদ বেদী ভাঙা হচ্ছে। সায় দিচ্ছে কথক চরিত্র। যার কাকা ছিলেন উদ্‌বাস্তু আন্দোলনের কিশোর শহিদ। ‘পাথরের লেখা এখন ঝাপসা’- আমাদের স্মৃতিও। পূর্বপুরুষের জবরদখল করা প্লটে দলিল পাবার পর উঠছে নতুন ফ্ল্যাট। উদ্বাস্তু কলোনীতে আবার ভিটেহারা ইতিহাস। স্বপ্নময়ের কথাভুবনে বারবার পাই দেশভাগ পরবর্তী সময়ে উদ্বাস্তু মানুষের জীবনের কাহিনি। লেখকের অণুগল্পগুলির ‘আমি’-কে তাঁর জীবনের সূত্রে মিলিয়ে পড়া যেতে পারে হয়তো। কিংবা এই আমি আসলে এই সময়ের প্রতিনিধি বিশেষ।  লেখক- পাঠকের সংযোগে আত্মকথনরীতি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য বলেই ধারণা আমাদের। ‘উন্নয়ন’ গল্পের প্রোমোটার হারান জ্যাঠার ছোটোছেলের বাঁ হাতে চণ্ডীর সুতো, আর ডান হাতে সিগারেটকে কীভাবে পড়ব আমরা? সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কোন সূত্রে? শহিদের রক্ত ব্যর্থ হবে না বলে আমাদের চিৎকারের তবে কোনো মূল্যই কি নেই? বাঙালি সত্যি আত্মঘাতী জাতি। ‘শিশুশিক্ষা’ গল্পে দেখি মা ছেলেকে ইংরেজি শেখাতে চেষ্টা করছেন। স্কুলের আন্টির ইংরেজি উচ্চারণ অবশ্য আলাদা। সাংস্কৃতিক পার্থক্যের বিষয়টি সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেন লেখক। গল্পের শেষে দেখা যায়, মন্দিরের সামনে মা ছেলেকে নমো করতে বলছে—“ছেলে বলে, এলিফ্যান্ট গড।

মা বলে—ছিঃ, ইনি গণেশ ঠাকুর।” (৯৬) উপনিবেশের প্রভাব থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি আজও। নয়া- উপনিবেশবাদ জাঁকিয়ে বসেছে আমাদের মনে। তিন বছরেরও কম বয়সি শিশুর ইংরেজি শিক্ষা কতটা সিদ্ধিলাভ কতটা করবে, তা সময় বলতে পারবে। এটুকুই বলার, স্বপ্নময়ের গল্প বাঙালি সংস্কৃতির পরিবর্তনকে প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন করে। ‘সাক্ষরতা’ গল্পে দেখি তিনমাস সাক্ষরতার ক্লাস করার পর নয়নতারা স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ মুখস্থ করেছে—“ কিন্তু কোন্‌টা ক কোন্‌টা খ বুঝতে পারে না।” সনাক্তকরণের সমস্যাকে কীভাবে দেখব আমরা? সাক্ষরতা মিশন আদৌ কতটা সার্থক? মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কথা উঠে আসে একাধিক গল্পে। একটি হোমে মূক ও বধির কিশোরীর ধর্ষণ নিয়ে লেখা হয়েছে ‘প্রতিবাদ’ গল্পটি। ‘বহুরূপী’ গল্পে পাই চরিত্রের মুখে অমোঘ উচ্চারণ—“ ... মানুষ সাজাটাই সবচেয়ে কঠিন।” (পৃঃ ৭০)



‘সম্পর্কের এমব্রোডারি’ কাব্যিক শব্দবন্ধটি থেকেই আঁচ করা যেতে পারে বিষয়ভাবনা সম্বন্ধে। ‘প্রথম অক্ষর’, ‘শেষ অক্ষর’, ‘সবুজ সোয়েটার’, ‘হলুদ শাড়ি’ গল্পগুলি জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়। বস্তুগুলির অনুষঙ্গে জড়ো হয় সম্পর্কের গন্ধ।  ‘মা’ গল্পটি গড়ে উঠেছে সারোগেট মাদার যূথিকার বেদনার অভিব্যক্তিতে। ‘ঘুঁটে’ গল্পে পাই টিফিন বাক্সে একজন লোক ঘুঁটে নিয়ে যাচ্ছে। শেয়ালদা স্টেশনে পুলিশের প্রশ্নে সে জানায়-- “এখন বসিরহাট থেকে এলাম কিনা। আমি তো কাজ করি মেটেবুরুজ। দেশে গেলাম অনেকদিন পর। মা মরেছিল ছোটোবেলায়। নানির কাছে বড়ো হলাম। দেখতে গিয়েছিলাম। এখনও ঘুঁটে দিতে পারে। একটা নিয়ে যাচ্ছি। হাতের ছাপটা লেগে রয়েছে... ” (পৃঃ ১১৪)। সঞ্চরণের তত্ত্ব, জীবন- জীবিকা সব ছাপিয়ে হাতের ছাপের সংরক্ষণ আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়। কেউ ভালোবাসে না বলে যে লোকটা মরবে ভেবেছিল স্বপ্নময়ের গল্পে সেই মানুষই নতুনভাবে বেঁচে ওঠে। রসগোল্লার ভাঁড় দেখে জিজ্ঞেস করে ওতে কিছু আছে কিনা! সামান্য অসামান্য হয়ে ওঠে লেখকের প্রসাদগুণে। অণুগল্প খুব কম সময়ে পাঠকের সঙ্গে যেভাবে সংযোগস্থাপন করতে চায়, তার সার্থক দৃষ্টান্ত হতে পারে আলোচ্য লেখকের আখ্যানমালা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের সংরূপের প্রচলিত আদর্শ যে বদলে বদলে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের ব্যস্ত জীবন অল্প কথায় গল্প শুনতে চায়। চটজলদি পাঠযোগ্য হলেও যার প্রভাব থেকে যাবে অনেকক্ষণ। স্বপ্নময়ের সার্থকতা এখানেই তিনি অণুগল্পের সংরূপে যোগ করেছেন নিজের ব্যক্তিত্ব। বাংলা সাহিত্যে অণুগল্পের ইতিহাসে তিনি বুড়ো আঙুলের ছাপ মুদ্রিত করেছেন বলাই বাহুল্য।



এবারে ‘সময়ের ছেটানো ছবি’ অংশের ‘ভিটে’ গল্পটি সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করছি-

“ হাইওয়েটা দারুণ। ছয় লেন-এর। কিন্তু গাড়িটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। ড্রাইভার গিয়েছে মেকানিক ডাকতে। একা বসে আছি। হাওয়া নেই।

          হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়াল একটা লোক। দু-দিগন্তে দু-হাত।

          বলল, এইখানে ছিল আমার গ্রাম।” (পৃঃ ১৫২) স্থানাঙ্ক নির্ণয়! আমাদের আলোচনার প্রথমেই আমরা তথাকথিত উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। বিজ্ঞাপন শোভিত হাইওয়ে কেবল স্বপ্নের নয়, বরং স্বপ্নভঙ্গের—চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন লেখক। গল্পের আয়তনটুকু মনে রাখার মতো। ‘লক্ষ্মী’ গল্পে দেখি পৌষলক্ষ্মীর পুজোর প্রসাদ খাবার পর বড়ো কর্তা কাঁদছেন।  সামনের বছর এ জমিতে কারখানা হবে। ‘চাষি’ গল্পে দেখি  এক চাষি সর্বাঙ্গে পঙ্ক- চন্দন  মাখছে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে। বলছে—“ শেষ বারের মতো চাষ করে নিলাম গো।” (পৃঃ ১৪৫) কৃষি ও শিল্প নিয়ে বিতর্কের কথা মনে পড়বে পাঠকের। রাজনৈতিক হত্যা, দলবদল উঠে আসে গল্পে। সাম্প্রতিক বিষয়কে আখ্যানে আত্মস্থ করে তাকে চিরন্তন মর্যাদায় উন্নীত করেন লেখক। ‘জঙ্গলমহলের বাপগুলান’ গল্পে পাই এক পুরোহিত ঘরে বৃদ্ধ পিতার মৃতদেহ রেখে অন্যের অপঘাতে মৃত্যুর শ্রাদ্ধ করে আসে—“ ঘরের ভিতরে পচা গন্ধের মধ্যে পিতা জনার্দন তাঁর বি.এ. পাশ করে বসে থাকা সন্তানকে বলে—কম্পিউটার শিখবি বলেছিলি মেয়ে, এই নে টাকা।

     এবার কেঁদে ওঠে বাপ ও মেয়ে।” (পৃঃ ১৬৯) জঙ্গলমহলে মাওবাদী ও যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে সাধারণ মানুষের করুণ অবস্থা ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পকার। ‘চলো পালটাই’,  ‘হাওয়া’ গল্পগুলি পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদল সার্থকভাবে ফুটিয়ে তোলে।  আমাদের চারপাশের বাস্তবতা যখন উঠে আসে আখ্যানের বাস্তবতায়, আমরা চমকিত হই। এমনই একটি গল্প— ‘ঝন্টুদা ভালো আছ?’

“হাসপাতাল তছনছ হচ্ছে।... ভেঙে দে কাচ।... খুলে দে অক্সিজেন। ইশ মাইরি ঝন্টুদা, কী হল! ঝন্টুদার গলায় কাচ ফুটে গেছে। ঝন্টুদাই তো নেতা। ঝন্টুদা ওই হাসপাতালের বিছানায়। তিনটে সেলাই। ঝন্টুদার চিকিৎসার কোনো গাফিলতি চলছে না চলবে না। ভালো আছ তো ঝন্টুদা?”



শিল্প হল জীবনের সমালোচনা। সত্য কথা বলা ছাড়া আর কোনো দায় নেই শিল্পীর। আমাদের সুখ-অসুখের বৃত্তান্তকে মানবিক দৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন যিনি আন্তরিক সততায়, তাঁর আখ্যানের পাঠ যে পাঠককেও নতুনভাবে গড়ে তুলতে চায়। এখানেই স্বপ্নময় চক্রবর্তী অনন্য। স্বতন্ত্র তাঁর আখ্যানভুবন। ভাঙা কাচের শিল্পে যেখানে প্রতিফলিত হয় এক আকাশ জীবনবোধ!   



....................................

























2 comments: