Monday, December 31

গল্প : প্রিয়াঞ্জলি দেবনাথ





আগন্তুক

রাত্রি অনেক্ষন ধরেই বাগানে পাইচারি করছিল। হঠাৎ করেই পশ্চিমের পাঁচিলের গা-ঘেষে একটা খসখস শব্দ ! কেমন যেন দেওয়ালে ঘষটানির আওয়াজ। রাত্রি দু'মিনিট স্থির হয়ে দাঁড়াল, কিন্তু কই আর তো আসছে না শব্দটা...! নিজের মনেই মৃদু হেসে বিরবির করে বলে উঠল, 'আবার মনের ভুল !'

সূর্য অনেক্ষনই অস্ত গেছে। পশ্চিমের লালচে রাক্ষুসে আকাশটা ধোঁয়াটে হয়ে উঠেছে। কিন্তু আকাশে তারা তো নেই একটাও, বোধ হয় মেঘ করেছে... এমনই আরো অনেক কিছুই এলোমেলো ভাবে রাত্রির মনে দানা বাঁধছিল। হঠাৎ আবার একটা খচখচ শব্দ। এবার মনে হচ্ছে শব্দটা খুব কাছে, যেন শুকনো পাতার ওপর দিয়ে দুটো পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে ! ...হঠাৎ একটা পুরুষ কণ্ঠস্বর ---
--- 'রাত্রি...'
আবার চারিদিক নিশ্চুপ, সন্ধ্যার আলো-আঁধারে রাত্রির মুখটা ঠিক মতো বোঝা যাচ্ছে না, তবে মনে হচ্ছে যেন একটা নিথর পাথর প্রতিমা, যেন নিস্পলক চোখে কোনো শান নেই। আবার একই কথার পুনরাবৃত্তি ---
--- 'রাত্রি...'
'কেমন আছো ? কথা বলবে না ?'
কিছুক্ষন নিস্তব্ধ। এর পর রাত্রির শুষ্ক ঠোঁটটা যেন একটু ফাঁক হয়ে শুকনো মৃদু স্বরে বেরিয়ে এল --- 'কে !!?'
--- 'চিনতে পারলে না...! আমি অনির্বাণ। আজ ভোরের ট্রেনে নামলাম।'

তিন বছর আগের কথা। চূচুড়ার একটা প্রাইভেট স্কুলে ইনটারভিউ দিতে গিয়ে অনির্বাণের সাথে রাত্রির পরিচয়। বেশ খোশমেজাজের অনির্বাণ মালদার ইংলিশ বাজারের ছেলে, পড়াশুনার সূত্রেই এদিকে আসা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় পি.এইচ.ডি. করছে। পড়াশুনার পাশাপাশি কিছু রোজগারের তাগিদেই তার ইনটারভিউ দেওয়া। চূচুড়ার মেয়ে রাত্রিরও পড়াশুনার অবসরে কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ইচ্ছে। রাত্রি সবেমাত্র বি.এ. পাশ করে ডিসট্যান্স-এ ইতিহাসে এম.এ. করছে।

মর্নিং স্কুল। বর্ধমানের ইউনিভারসিটি হোস্টেল থেকে সকালে চূচুড়া আসতে বেশ অসুবিধাই হয় অনির্বাণের। চূচুড়াতেই কাছাকাছি কোথাও থাকার ব্যবস্থা করতে পারলে সুবিধাই হত তার।

রাত্রির থেকে অনির্বাণ অনেকটাই সিনিয়ার। সিনিয়ার দাদা হিসাবে রাত্রি তাকে যথেষ্ট সম্মান করে। তাই অনির্বাণকে কাছাকাছি একটা ঘর খুঁজে দিতে তার অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, করলোও তাই ; নিজের বাড়ির কছেই রাত্রি অনির্বাণের জন্য একটা ভাড়াঘরের ব্যবস্থা করে দিল।

কয়েক মাস কেটে গেল। রাত্রি--অনির্বাণের বন্ধুত্ব বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে। রাত্রির বাড়িতেও ছুটির দিনে মাঝে মাঝেই সন্ধ্যের চাউমিনের নিমন্ত্রণ থাকে অনির্বাণের। এই ভাবেই চলতে থাকল। তবে বিষয়টা নিয়ে অনেকের মধ্যেই একটু কানাফুসো দেখা দেয়। অনির্বাণ এত কিছু ভাবে না, ভাবতে চায়ও না সে, কেউ কিছু বললেই হেসে উড়িয়ে দেওয়াই তার স্বভাব। কিন্তু রাত্রির মনে কোথাও যেন একটু সংশয় বাসা বাঁধছে।

সেদিন বুধবার। স্কুলের সেকেন্ড পিরিয়ডের পর স্টাফ রুমের চেয়ারে বসে রাত্রি কোনো একজন আধুনিক গল্পকারের গল্প উল্টেপাল্টে দেখছিল। হঠাৎ ইংলিশের অনিতা দি পাশে এসে বসে রাত্রিকে বলল ---
--- 'কী ব্যাপার রাত্রি, কতদূর ? কিছুই তো জানতে পাচ্ছি না। তোমাদের মধ্যে কি সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে ? অনির্বাণ কিন্তু দারুণ ছেলে...।'
রাত্রি সঙ্কুচিত মুখে বলে উঠল ---
--- 'আরে না না, কী বলছ দিদি !
অনির্বাণ দা-কে আমি যথেষ্ট রেসপেক্ট করি। এমন কোনো ব্যাপার নেই।'
এমন সময় কোথা থেকে যেন ঝড়ের মতো অনির্বাণ উড়ে এল,
--- 'কোন ব্যাপার টা ? ...ও আচ্ছা আচ্ছা, বুঝেছি ! হ্যাঁ, কিছুদিনের মধ্যেই তো আমরা বিয়ে করছি।,
এই বলে হো হো করে হাসতে হাসতে অনির্বাণ চলে গেল। কিন্তু রাত্রির মুখে একফালি কালো মেঘের ছায়া, তার চোখে মুখে একটা ভয়।

স্কুল ছুটির পর অনির্বাণ খুব ব্যস্ত ; ট্রেন ধরবে, ইউনিভারসিটি যাবে। কিন্তু রাত্রির শুকনো মুখটা তার চোখ এড়ায়নি। তাই যাবার আগে রাত্রিকে বলে গেল,
--- 'রাত্রি, কে কী বললো, তাতে কী যায় আসে ! আমরা নয় আমাদের মতোই থাকলাম।'
রাত্রির মুখে একটা নিস্তব্ধতা, একটা অসারতা অবিচল হয়ে রইল...

এর পর দু'দিন কেটে গেল। রাত্রির চিরকালের মাইগ্রেনের সমস্যাটা মাঝে মাঝেই দেখা দেয়, তাই দু'দিন স্কুল কামাই। কিন্তু অনির্বাণ, তার কী খবর, একবার কি ফোন করেও খবর নেওয়া যায় না ! শনি--রবি স্কুল ছুটি, সোমবার একেবারে তার সাথে দেখা হবে, এর মধ্যে কিছুতেই তাকে ফোন করবে না রাত্রি। কিন্তু মনটা যেন কেমন একটা খচখচ করছে, সেলফোনের ফেভারিট লিস্টটা বারে বারে অন করেও অফ করে দিচ্ছে সে।

সোমবার সকাল। আজ একটু আগে আগেই বেড়িয়েছে রাত্রি। স্কুলে গিয়ে কিছুতেই সে আগে কথা বলবে না, ...এসব ভাবতে ভাবতেই অটোতে উঠল। পাঁচ মিনিটের অটো পথ। স্কুলে পৌঁচেছে, না অনির্বাণ এখনো আসেনি, এত তাড়াতাড়ি আসার কথাও নয়। অফিস ঘরে ঢুকতেই বড়দি বললেন,
--- 'শরীর কেমন রাত্রি ?'
--- 'এখন ঠিক আছি বড়দি ।'
ঘর থেকে বেরিয়ে আসার মুখেই বড়দি আবার বললেন,
--- 'আচ্ছা অনির্বাণ চাকরিটা কেন ছেড়ে দিল বলতো ?'
...কী...?
রাত্রি কি ভুল শুনলো !
সে নির্বাক, স্তম্ভিও...। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থেকে বেহুঁশের মতো দ্রুত পায়ে
অফিস ঘর থেকে বেরিয়েই সোজা স্কুল গেটের দিকে ছুটে চলল। তারপর অনির্বাণের ভাড়াবাড়িতে। বাড়িওয়ালার কাছ থেকে জানতে পারল, দু'দিন আগেই অনির্বাণ অ্যাডভান্সের টাকাটাও না নিয়ে বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।
এরপর ক্রমাগত ফোনে ট্রাই করে গেছে রাত্রি। কিন্তু বার বারই নট রিচেবেল। এমনকি ইউনিভারসিটি হোস্টেলেও খবর নিয়েছে সে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। হঠাৎ করেই কোথায় যেন উবে গেল ছেলেটা।

এর পর তিন বছর কেটে গেছে। আবার সেই কণ্ঠস্বর, সেই অনির্বাণ...!
--- 'সরি তোমায় বলে যেতে পারিনি। আসলে মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।'
খুব ক্যাজুয়াল ভাবেই অনির্বাণ বলে চলল, যেন কিছুই হয়নি। তিন বছর নয়, যেন তিন দিনের গল্প।

অনেক্ষন পর খুব মৃদু স্বরে রাত্রি বলল,
--- 'কোথায় উঠেছো ?'
--- 'ঘড়ির মোড়ে, ব্লু ডায়মণ্ড হোটেলে।'
--- 'ও, যাও এখন ফিরে যাও, রাত হয়ে গেছে।'
আর কিছুই বলতে পারল না রাত্রি। অনির্বাণ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল,
--- 'ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি। কিন্তু প্লিজ, কাল সকাল দশটায় চূচুড়া স্টেশনে একবার দেখা করো, প্লিজ...। অনেক কিছু বলার আছে।'
রাত্রি আর কোনো কথা না শুনে রাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। সোজা নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ করে বিছানার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে অনেক কিছু ভাবছে। চোখে কি জল আসছে ? কই না তো, কেমন যেন একটা আনন্দ অনুভব হচ্ছে।
কাল কি যাওয়া ঠিক হবে ? নাকি আবারো..!! না না, আর কিছু ভাববে না সে।

সকাল দশটার মধ্যে স্টেশনে পৌঁছে গেছে রাত্রি। কেমন যেন যন্ত্রের মতোই এসেছে সে। অনির্বাণ আগেই পৌঁছে গেছে, সেই গাল ভরা হাসি মুখ। রাত্রির মধ্যে কেমন যেন একটা আরষ্ঠভাব। হঠাৎ করেই অনির্বাণ রাত্রির হাতটা ধরে বললো,
--- 'রাত্রি আমার ভুল হয়েছে, আসলে আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। তুমি কী ভাববে বুঝে উঠতে পারিনি।'
কিছুক্ষ দু'জনেই নিশ্চুপ...। অনির্বাণ আবার বলতে শুরু করে --
--- 'শিলিগুড়ির একটা গভমেন্ট স্কুলে চার মাস হল আমি জয়েন্ট করেছি। আমাদের আর কোনো অসুবিধা হবে না। মা-কে তোমার কথা বলেছি, মাও রাজি।
আচ্ছা আজ আমি আর বসতে পারব না। আমায় এখনি ট্রেন ধরতে হবে, পরশু ফিরব, মা কে নিয়ে আসব। সেদিনই বিকেল চার'টেতে চন্দননগর স্ট্যাণ্ডে দেখা করব। তখনই তোমার মুখ থেকে উত্তরটা জানব। প্লিজ... সেদিন এস। আজ আসলাম। '
রাত্রি যেন কিছুই বলতে পারল না। শুধু অবাক দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে নির্বাকের মতো চেয়ে রইল।

মাঝে একটা দিন কেটে গেল। আজই অনির্বাণ আসবে। রাত্রি তো কিছুই স্থির করেনি। তবে...! অনির্বাণ দা-কে কী উত্তর দেবে সে ? না না, 'অনির্বান দা' নয়, আজ প্রথমবার 'অনির্বাণ'-এর সাথে দেখা করতে যাচ্ছে রাত্রি।
দুপুর দুপুর নাগাতি বেরিয়ে গেল। আজ একটু বেশিই সেজেছে রাত্রি। চারটের আগেই পৌঁছে গেল। মনের ভেতর কেমন যেন একটু ভয় ভয়, তবে একটা অন্যরকম অনুভূতি। আজ সে অনেক কথা বলবে, মনে মনে অনেক কিছু ঠিক করে রাখতে শুরু করল। আজ শুধুই বোবার মতো শুনবে না, বলবেও। এমনই আরো অনেক অভিমানী কথা দানা বাঁধতে থাকলো মনের কোণে...

চারটে দশ বেজে গেল। অনির্বাণ তো এখনও এলনা। মোবাইল নম্বরটাও দিয়ে যায়নি। রাত্রি উশখুশ করতে লাগলো, তার যেন আর তর সয় না। সে উদ্বিঘ্ন হয়ে ভাবতে লাগল...। ক্রমে ঘড়ির কাঁটা চারটে তিরিশ-এর ঘর ছোঁয় ছোঁয়।
--- 'তবে কি আজও...!! না না, এমন কেন ভাবছি !!'
আসলে এক একটা মিনিট মনে হচ্ছে এক একটা দিন। এখনি আসবে হয়ত...

এক ঘন্টা কেটে গেল। ঘড়ির কাঁটা পাঁচটার ঘরে। বাসস্ট্যাণ্ডের এককোণে একটা বেঞ্চের ওপর রাত্রি একা বসে। ক্রমে সময় এগোয়। বিকেল গড়িয়ে পশ্চিমের আকাশটা লাল হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে আকাশের লালচে ভাব কেটে গিয়ে ধূসর হয়ে সন্ধ্যা নেমে এল। এর পর ক্রমে রাত্রির অন্ধকার যেন সন্ধ্যার ধূসর আলোকে গ্রাস করে নিল।




2 comments:

  1. অনির্বান নামটা সার্থক হয়েছে।
    শেষ হইয়াও হইলো না শেষ

    ReplyDelete