Monday, December 31

অণুগল্প : সুবর্ণা রায়










বিশ্বজোড়া ফাঁদ


"মাত্র তিন ঘন্টার জন্য, দিন না দাদা!"

"ফোট্‌ বললাম না! নিলে পুরো নিতে হবে। কিনে। পাঁচ হাজার পিস।"

"অত হবে না দাদা। হাজার দিচ্ছি, তিন ঘন্টা। দিন না! খুব দরকার!"

"ফোট্‌ স্লা!"

সরকারী মর্গের দারোয়ানটা দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়ায় অসীমের শেষ আশাটা দিনের আলোর মতো টুপ করে নিভে গেল।

সারাদিন চেষ্টা করে একটা মড়া জোগাড় করতে পারল না। নিজের ওপর রাগে বিড়িটা পুরো না খেয়েই গায়ের জোরে ছুঁড়ে ফেলল।

দুটো ছোট পাথরের মাঝখানে আগুণটা মিটমিট করে জ্বলতে লাগল। আর সেই দেখেই অসীমের মাথায় ঝিলিক মারল একজন। পাথরতপু।

"তপুদা, প্লীজ ম্যানেজ করে দাও! জাস্ট তিন ঘন্টার জন্য একটা মড়া লাগবে।"

ক্রাশারে পাথর ভাঙা হয় তপুর কারখানায়। কিন্তু পিছনে হেন কাজ নেই সে করে না। কারো বৌ তুলে আনা থেকে শুরু করে পার্টির তোলা, সব!

"সেকিরে! মড়া দিয়ে কি করবি?"

"বলা বারণ আছে। শুধু এটুকু বলতে পারি, শবসাধনা করব। কাউকে বলবে না কিন্তু।"

সাড়ে পাঁচ ফুটের বছর সাতাশের গোলগাল চকচকে অসীমের দিকে ছ'ফুটের অভিজ্ঞ পাথরতপু হাঁ করে চেয়ে রইল খানিক। তবে সামলে নিল। সে কাজে বিশ্বাস করে, কারণে নয়।

"মরগে যা! কত দিবি বল।"

"হাজার?"

"ধুর! মড়াফরা জোগাড় করা হ্যাপার কাজ। দুই দিস।"


কাজটা সহজ নয়। সব হিসেব করে করতে হচ্ছে। বাড়িতে কেউ নেই। বিয়ের নেমন্তন্নে গেছে। গ্যারেজের পিছনদিকে ছোট্ট বাগানটায় নামিয়ে দিয়ে গেছে মড়াটা পাথরতপুর ড্রাইভার। বছর পনেরোর একটা ছেলে। ফেলটেল করে সুইসাইডের কেস নির্ঘাত! দেহে কোথাও আঘাত নেই।

বুক ধড়ফড় করছিল অসীমের। মঙ্গাতান্ত্রিকের কথামতো শবের পিঠে বসে টানা দু'ঘন্টা মন্ত্র জপ করতে হবে মনে মনে।

সামনের সোমবার চাকরিটা এবার হতে বাধ্য। ইন্টারিভিউতে টপাটপ বলে দেবে কম্বোডিয়ার প্রেসিডেন্ট কে, বা মিশরের শেষ ফ্যারাওয়ের নাম কি! মহাজ্ঞান লাভ করলে বিদিশাও সমীহ করবে। আধোঅন্ধকারে শুধু বিদিশার মুখটা মনে করেই সাহস বেড়ে গেল অসীমের। বাবু হয়ে মড়ার পিঠের ওপরে বসে পড়ল।


"হ্যালো, তপুদা! মড়াটা গরম কেন? একটু নড়লও মনে হল!" ছিটকে উঠে দৌড়ে ঘরে গিয়ে পাথরতপুকে ফোন করল অসীম।

"সদ্য মরেছে রে। সুইসাইড। রিগর মর্টিস বুঝিস? মাসলটাসলে কেমিক্যাল চেঞ্জ হয়। তাতে ওরম মনে হয়, যে নড়ছে। ওসব মনের ভুল। নে, নে! এক ঘন্টা হতে চলল। তাড়তাড়ি কাজ সার।"

ফোন কেটে দিল পাথরতপু। অসীম বারান্দার কম পাওয়ারের লাইট জ্বালিয়ে রাখল। আশেপাশের বাড়িগুলো আজ যেন একটু বেশিই চুপচাপ।


শিন্টু মিঞা শেষমেশ রাস্তার ওপরেই বসে পড়ে কপাল চাপড়াতে লাগল। শুধু অস্পষ্টভাবে "বা'জান" শোনা যাচ্ছিল। বাকিটুকু বোঝা যাচ্ছিল না। চোলাইএর তীব্র কটু গন্ধ আর নোংরা কাপড়, কেউ হাত লাগাল না। বৌ পালিয়েছে অনেক আগে। থাকার মধ্যে ওই ছেলে। বশির। চাল আনবে কথা দিয়েছিল। তিনদিন হয়ে গেছে ভাতের এক দানাও পড়ে নি পেটে। খাদানে সাতদিনের কাজ পেয়েছে একটা। কিন্তু কাঁচা পয়সা দিনশেষে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে ভাট্টিতে।

ভাত ভাত করে মাথা খেয়ে নিচ্ছিল ছেলেটা। গায়েগতরে বাড়ছে লকলকিয়ে, আর বাড়ছে তার খিদে। চ্যালাকাঠ দিয়ে বেশ করে মেরেছিল শান্টু। উঃ আঃ করা ছাড়া কিচ্ছু বলেনি ছেলেটা। বেরিয়ে গেছে ঘর ছেড়ে।

"বা'জান রে!" ডুকরে কেঁদে উঠল শান্টু।


পাঁচশ টাকা! তিন ঘন্টার বদলে। থালাভর্ত্তি ভাত, সবজি! বশির নিঃশ্বাস চেপে পড়ে আছে উপুড় হয়ে। শুধু পিঠের ছেঁড়াজ্বালাগুলোর ওপর যেন নুনের ষাট কেজির বস্তা চাপিয়ে দিয়েছে কেউ।






No comments:

Post a Comment