Monday, December 31

গল্প : দেবাশিস দে





হৃদয় হরন

দিদি, ধ্রুব বসু’র  বাড়িটা কোন দিকে বলেতে পারেন ?  আমরা তিনজন যাচ্ছি। সামনে সামনে চারজন ভদ্রমহিলাও ধ্রুব বসুর আমন্ত্রণে তার বাড়িতে সাহিত্য ও সংগীতের বিজয়া সম্মেলনে যাচ্ছিলেন - এটা ঐ প্রশ্নের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম। আমরাও ধ্রুব বসুর বাড়ি খুঁজতে চাইছিলাম, আমাদের হয়ে ওই চার ভদ্রমহিলা যখন আমাদের মুখের জিজ্ঞাসা কেড়ে নিয়ে আগেই ঐ প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, আমরাও অপেক্ষায় থাকলাম উত্তর শোনার জন্য।

          ওমা, এ যে উত্তরের বদলে প্রশ্ন – যে বাড়িতে এক ভদ্রলোক মারা গিয়েছেন ? ওই গলিটা দিয়ে গিয়ে একেবারে শেষে বাঁদিকের বাড়ি। আমাদের মত ঐ চার ভদ্রমহিলারাও অবাক হয়ে তাকিয়ে দিক নির্দেশক উত্তরদাতার দিকে। অনুমান  হল - কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। তাও ঐ নির্দেশ মত ওই চার ভদ্রমহিলার পিছু পিছু আমরাও গন্তব্যের দিকে গুটি গুটি পায়ে।

তিনতলা বাড়িতে একতালার মেন গেটে নেম-প্লেটে লেখা – ধ্রুব বসু। মাইক টেস্টিং এর আওয়াজ আসছে। নামটাও মিলে গেল।  না ভুল নয় তাহলে, ঠিক বাড়িতেই এসেছি – কিন্তু মৃত্যুর খবরটা কি – মজা করার জন্য !! একতালার ডাইনিং রুমে  বেশ কয়েকটা জোড়া চটি , এবার আরও নিশ্চিত হলাম। একতলার কোনের ঘর থেকে এক ভদ্রমহিলা আমাদের দেখছেন। আমাদের পূর্বসূরিরা ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন  এটা ধ্রুবদার  বাড়ি না ?

-         হ্যাঁ , তিনতলায় উঠে যান।

-         আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি ?

-         হ্যাঁ বলুন

-         এই বাড়িতে কি কেউ মারা গিয়েছেন ?

-         হ্যাঁ আমার ছোটো ভাই। আপনারা  যাঁর কাছে এসেছেন ওনার কেউ নয়। আমার ছোটো ভাই।

-         কি হয়েছিল ?

-         সেরিব্রাল অ্যাটাক।

-         এই বাড়িতেই থাকতেন ?

-         হ্যাঁ, ভাইফোঁটা থেকে এই বাড়িতেই  থাকতো । গত পরশু হঠাৎ করে চলে গেল।

                       ভদ্রমহিলার চোখ জলে ভরে গেল।

-         আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করব, যদি কিছু মনে না করেন – ধ্রুবদার কেউ হন আপনি ?

-         হ্যাঁ ওনার স্ত্রী।

-         তাহলে আজ এই অনুষ্ঠান ?

-         ওনাকে না করেছিলাম, উনি বললেন - সবাইকে বলা হয়ে গেছে, এখন আর কিছু করা যাবে না। আসলে ও  আমার আদরের ভাই, ওনার কেউ নয়।

-         না,না, ধ্রুবদা এটা ঠিক করেননি, আজ অনুষ্ঠান না হলেই ভালো হত।

-         প্লিজ, আপনারা তিনতলায় যান, ওনাকে কিছু বলার দরকার নেই, এখন  নিশ্চয়ই আপনারা বুঝে গেছেন এই বাড়িতে আমার পজিশন কি ? ওর মন বলে কিছু নেই। এই মাইকের আওয়াজ, গান, বাজনা আমার দগদগে ক্ষতে প্রলেপ দেবে ? আমায় এসব সহ্য করতে হবে। প্লিজ আবারও বলছি ওনাকে এ ব্যপারে কিছু  বলার দরকার নেই, আপনারা তিন তলায়  চলে যান।

          মনে মনে ভাবছি ধ্রুবদাকে যে ক’দিন দেখেছি, এত কঠিন মনের মানুষ বলে মনে হয়নি। হয়ত এমন হতে পারে শালাবাবুর সাথে ওনার সম্পর্ক ভালো ছিল না । আমাদের মধ্যে ইতি উতি গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। ওই চার ভদ্রমহিলাদের মধ্যে দেখলাম একই ব্যাপার। কারও মুখে বিরক্তি সূচক, কারো মুখে কৌতূহল সূচক ছবি। আমরাও কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না -  কি যে করা উচিত এই সময় ! সিদ্ধান্ত নিলাম ধ্রুবদাকে বুঝিয়ে আজকের অনুষ্ঠান  যদি বন্ধ করা যায়।

ওপরে উঠে দেখি ধ্রুবদা ব্যস্ত, যেখানে শিল্পীরা  বসবে সেখানে ছোটো চৌকিটায় একটা সুন্দর চাদর পাতছেন, দর্শক আসনে তখন বেশ কয়েকজন ভদ্রলোক , ভদ্রমহিলা। আমাদের দেখতে পেয়ে ধ্রুবদা এগিয়ে এলেন, করমর্দন পর্ব চলল। তারপর সেই কঠিন কথাটা – আচ্ছা ধ্রুবদা আজকের অনুষ্ঠানটা কি বন্ধ  করা যেত না, খুব কি দরকার  ছিল ?

-         দেখুন আপনাদের সবাইকে একমাস  আগে থেকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছি, আজ হঠাৎ  করে এই সাহিত্য সঙ্গীতের আসর বন্ধ করি কি করে বলুন ?

-         না, তাও মেসেজটা যদি পাঠাতেন তাহলেই তো ভালো হত, পরে আবার কোন দিন হত, তার জন্য কি  আছে ।

-         আপনারা আমায় পাষাণ ভাবছেন, জানি। কিন্তু আমি কি করি বলুন-তো ? প্রায় ইচ্ছা করেই আমি কাউকে কিছু জানায়নি। আমি চাইছিলাম আজ অনুষ্ঠান হোক। আসলে আমার ওই শালাকে আমি বড্ড ভালবাসতাম জানেন। এই দু-দিন কোন কাজে মন বসাতে পারছি না, কি করে যে কি হয়ে গেল। সব সময়ে ওর কথা মনে হচ্ছে । তাই ভাবলাম আজকের বিকালটা  যদি সবাইকে নিয়ে ভুলে থাকতে পারি। মনটা ভালো লাগবে। আর এর রেশটাও দু-তিনদিন থেকে যাবে মনে – এই জন্য এই আয়োজন।

এর পর সবার সম্মিলিত সিধান্তে বিজয়া সম্মেলনের বদলে অনুষ্ঠান হল স্মরণ-সভা।





No comments:

Post a Comment