Monday, December 31

অনুবাদ গল্প : রতন শিকদার

যুদ্ধবন্দী


(মুনা ফাধিল একজন মানবাধিকারকর্মী তার প্রধান কাজ উদ্বাস্তু নারীর অধিকার এবং জাতিগত ও ধর্মগত সহিষ্ণুতার বিষয় নিয়ে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, বর্তমান হিংসা নিয়ে তার বহু রচনা আছে।)

 সাহিরা ঝকঝকে সাদা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছিল তার বাবা  সকালের সূর্যের আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সে মার্বেল পাথরের উপর বসে একটা ট্রানজিস্টার রেডিও ঘাটাঘাটি করছিলো। সূর্যের আলো তাকে ধুইয়ে দিচ্ছিল। সাহিরা তার দিকে এগোলো কিন্তু সে সাদা দেয়ালটাতে মরীচিকার মতো উধাও হয়ে গেল।

তার চারপাশের বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি দেখে সালে শুধুই অবাক হয়ে যাচ্ছিল। কুড়ি বছর আগে যখন প্রথম সেই ইরানীদের হাতে ধরা পড়েছিল, তখন সেগুলো মোটেই এরকম ছিল না। এখন সে দিনের বেশিরভাগ সময় এগুলোর রহস্য ভেদ করতেই কাটিয়ে দেয়। বন্দিদশায় সবই একরকম ছিল। বন্দীরা বারবার একই গল্প করতো নিজেদের মধ্যে, আর ভান করত তারা সেগুলো নতুন করে শুনছে। সাহিরা তার দিকে তাকিয়ে হাসলো। তাকে একটা ছোট্ট শিশুর মত লাগলো যে নিজের হাতের কাজেই মত্ত। এইমাত্র সাহিরা তার শাক সবজি গুলো ধুতে সিঙ্কের দিকে এগিয়ে গেল।

 সালে যখন ধরা পড়েছিল তখন সাহিরার বয়স ৫ আর যখন ছাড়া পেল তখন সে ২৩।  দীর্ঘ আট বছরের যুদ্ধের শেষে যখন প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দফায় যুদ্ধবন্দীর বিনিময় হলো, তখন সাহিরা আর তার মা অপেক্ষা করেছিল। ফিরে আসা বন্দীদের তারা জিজ্ঞাসা করেছিল, তারা সালে কে দেখেছে কিনা বা তারা তা কে জানে কিনা। তারা কেউ কিছু বলেনি। ১৯৯৬ সালে সাহিরার মা মারা গেল। সালে মুক্তি পেল ১৯৯৮ সালে।

  সেবার শীতে, বাগদাদ শহরের নুসুর চকে সাহিরা তার গাড়ির মধ্যে তিন রাত কাটিয়েছিল। তখন কথা দেয়া হয়েছিল শেষ যুদ্ধবন্দীদের ঘরে ফিরিয়ে আনা হবে। সাহিরা তার বাবার পুরনো পরিচয় পত্রের একটা ফটো কে বড় করে চকচকে সোনালী ফ্রেমে বাঁধিয়ে নিয়েছিল। সাহিরা আশা সালে যদি তাকে চিনতে নাও পারে তবে সে নিদেনপক্ষে নিজের ছবিকে চিনবে। সাহিরা তার গাড়ির সিটে জুবুথুবু হয়ে বসেছিল। ঠান্ডাতে জামার হাতাটা টেনে আঙুলের ডগা অব্দি নামিয়ে দিয়েছিল আর ঝিমোচ্ছিল। হট্টগোলের মধ্যে লোক গুলো যখন তার গাড়ির পাশ দিয়ে গেল তার, গাড়িটা দুলে উঠল আর সে জেগে গেল। জনতা তার গাড়িটাকে তাদের সাথে নিয়ে চলতে থাকলো।

 জেলখানার দরজা হাট করে খুলে দিয়ে রক্ষীরা যখন চিৎকার করে ফার্সিতে তাদের বেরিয়ে আসতে বলল, প্রথমে সালে বিশ্বাসই করতে পারলো না। সালে তার সহবন্দিদের মতই ভাবল যে তাদের মেরে ফেলা হবে। একজন আশাবাদী মানুষ প্রশ্ন করল, 'তোমার কি মনে হয় ওরা আমাদের ছেড়ে দেবে' সালে তাকে একটা থাপ্পর মারল। চুপ কর। ওরা তাদের এক সারিতে হাঁটিয়ে বাইরে নিয়ে গেল। বাইরের জগৎ চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো উজ্জ্বল। সালের আকাশ দেখার খিদে, কিন্তু আকাশের উজ্জ্বলতা তার চোখের সহ্য সীমার চাইতে বেশি। ওরা যখন তাদের দিকে নতুন পোশাক ছুঁড়ে দিয়ে বলল পোশাক পাল্টাতে, সালে তখন অবাক হতে শুরু করল। তার পুরনো জামা থেকে একফালি কাপড় ছিড়ে ফেলল, এই আশা যদি মিথ্যা হয়, তবে সে নিজের গলায় ফাঁস দিয়ে মরবে। তারপর সালে আর অন্য সবাইকে গদি আঁটা সিটের একটা বাসে তোলা হলো। সালে গত ১৮ বছর কোন গদিতে বসে নি। সে হাতের তালু দুটো গদিতে ঠেসে ধরে কেঁদে উঠলো। এবার সে বুঝলো তারা দেশে ফিরছে।

"বসেরা"
"বাবা, এখানে" তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরল আর তাদের সময় জ্ঞান চলে গেল
"বসেরা" সালে সাহিরার ঠোঁটে প্রায় চুমু খেয়ে ফেলেছিল। সালিহা ইতস্তত করলো, "বাবা আমি সালিহা। মা......"
সালে তার মেয়ের হাতের বেষ্টনী থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল, যেন সে বিদ্যুতের ছোবল খেয়েছে। সাহিরা সেই ছোট্ট মেয়েটা, ঘরের ভিতর হাটবার সময় তার পায়ে পা জড়িয়ে খিক খিক করে হাসতো, আর এদিক ওদিক দুলতো আর তার কোঁকড়া চুলগুলো নাড়াতো। সালে তার কপালে চুমু খেয়ে বলল "সাহিরা,আমিতো তোকে চিনতে পারিনি।"

বাবা সালে মুখ তুলে দেখল সাহিরা তোয়ালে দিয়ে তার ভেজা হাত মুছছে। "তোমার খিদে পেলে খাবার তৈরি আছে। তোমাকে শুধু একটু গরম করে নিতে হবে। ঠিক আছে? আমাকে কাজে যেতে হবে। আর কিছু দরকার তোমার? ঠিক আছে? বুঝলে তো? " সাহিরা তার স্বাভাবিক একমুখী কথাবার্তা চালিয়ে গেল। তার পাশ দিয়ে কোট আর টাকার ব্যাগটা আনতে যাওয়ার সময় তার বাবার মাথায় আলতো করে চাপড় দিল। "বাড়ি থেকে বেরোবে না মনে থাকবে? আর কোন দরকার পড়লে আমাকে ফোন করবে"।

 সালে রেডিওর ভিতরের কলকব্জার নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। সে হুড়কোর শব্দ শুনতে পেলো। একবার, তারপর দুবার আর তার মেয়ের পায়ের শব্দ দূরে সরে গেল। সালে সাবধানে নিচু হয়ে তার চেয়ারের গদি টা আসল কিনা বুঝতে চাইল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে পর্দা গুলো টেনে দিয়ে চোখ ধাঁধানো সূর্যের আলোটাকে আটকে দিল।

No comments:

Post a Comment