Monday, December 31

গল্প : দেবযানী কর সিনহা



 এ কেমন অশরীরী
               

প্রথমে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করলেও আস্তে আস্তে বৃষ্টিটা ভয়াবহ রূপ নিল। সে কী দাপট! এত ঝোড়ো বাতাস সমেত দামাল বৃষ্টি কখনো দেখিনি।  চারিদিকটা ধোঁয়ায় ঢেকে গেলে যেমন অস্পষ্ট হয়ে যায় তেমনই বা তার তুলনায় আরো বেশি ঝাপসা লাগছে।হাঁটু পর্যন্ত জল ভেঙে ভেঙেআমি চলতে শুরু করেছি কষ্ট হলেও যাচ্ছি কিন্তু  তবু যেতে পারছিনা। মাটি যেন পা টেনে ধরছে। থেমে যাওয়ার থেকে এগিয়ে যাওয়া ভাল এই মুহূর্তে  এই কথাটির যদিও কোনো মূল‌্য নেই।কখনো কখনো থামতেও হয়।

বৃষ্টি থামবার কোনো নামগন্ধ নেই। এক্ষুনি থামবে বলে মনে হচ্ছেনা।   বাড়ির রাস্তা তো অনেকটা!  এমনি দিনে দশ মিনিটের মধ‌্যে বাড়ি ফিরি। আজকে মনে হচ্ছে কত দূরের দেশ আমার বাড়ি।আজকে বাড়ি  ফিরতে হয়তো রাত পেরিয়ে যাবে। জায়গায় জায়গায়  বিপদ এখন ওত পেতে বসে আছে।কেন যে বেরলাম আজ। মনে হল একটা বড়সড় সাপ এক মিটার দূরত্বে রাস্তাটা  পার হল।ভয় পেয়ে চমকে উঠি।  যদি পেঁচিয়ে ধরত, বিষধর হলে ছোবল দিয়ে পালাত?  অন্ধকারে কিছুই করতে পারতাম না। কী জাতের চিনতেও পারতাম না। চলে গেল ভাগ‌্যিস!  এখন এসব  ভেবে লাভ নেই
যখন বেরিয়েছিলাম মেঘ জমেনি আকাশে, স্বাভাবিক ওয়েদার ছিল।আর এখন?  জমা জলে পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে কষ্ট করে কোনরকমে হেঁটে যাচ্ছি। দুর্ভাবনায় গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।   ভাবলাম, কিছুক্ষণের জন‌্য আশেপাশের একটা বাড়িতে আশ্রয় নিলে অন্তত ভিজতে হবেনা।এমনিতেই এখন সন্ধেরাত।  তার উপর কোনো বাড়িতে যদি কিছুক্ষণ দাঁড়াই তাহলে অনেক রাত হয়ে যাবে।সারা শরীর ভিজে গেছে। সত‌্যিই আর যেতে পারছিনা। প্রচন্ড হাওয়ায় কিছুতেই সামনের দিকে যাওয়া যাচ্ছেনা। দেখছি  চোখের সামনে রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলো ক্রমশ জলে ডুবে যাচ্ছে।দিশাহীন হয়ে ছুটতে শুরু করলাম।  এখানে আমার কারোর সঙ্গে তেমন চেনাজানা নেই।
  একটা বাড়ির গেট খুলে দৌড়ে খোলা বারান্দার  উপর উঠে যাই। শব্দ পেয়ে তখুনি দরজাটা কে খুলে দেখল, বোধহয়  আমার পায়ের শব্দ পেয়েছে। এক ভদ্রলোক উঁকি দিয়েই আমাকে দেখলেন।  পুরুষদের একটা গুণ তারিফ না করে পারিনা, হুট করে অকারণে আশ্চর্য হয় না তারা। অযথা ভয় পায়না। চেঁচিয়ে লোক জড়ো করেনা। আমি তাঁকে দেখে হাসবার চেষ্টা করি।
-তিনি বললেন ও আপনি? বৃষ্টিতে একেবারে ভিজে গেছেন যে, যেন কত দিনের চেনা!

ভেতরে আসুন, ভেতরে আসুন।  বাইরে কেন দাঁড়িয়ে আছেন।
-যাব? চিনি না জানিনা
প্রথমে অস্বস্তি লাগছিল কিন্তু ভাবলাম যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেটা তো খোলা জায়গা। সেই  ভিজতেই হচ্ছে যখন যাই ভেতরে।ঘরে একটু না বসলে উনি অপমানিত বোধ করতে পারেন।তাঁর কথা মেনে না নিলে এখুনি বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করা উচিত। ভিজলে ভিজব। বড়জোর ঠান্ডা লাগবে। এর বেশি আর কী হবে। বাজ পড়ল বিকট শব্দ করেচমকে উঠলাম।
কী করব কী করব। আমি তো আশ্রয়ই  চাইছিলাম। এখান থেকে চলে যাব? এসব ভাবার আগেই ঘরের ভেতর থেকেএক ভদ্রমহিলার কন্ঠস্বরও শুনতে পেয়েছি ।
খুনখুনে স্বর। বৃদ্ধার স্বর শুনে নিশ্চিন্ত হই।   সাহস করে বারান্দা লাগোয়া ঘরটাতে তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়ি।ভদ্রলোক ঘরের ভেতর থেকেই ডাকছিলেন। দুজনেই আমাকে দেখে খুশি হয়েছেন  মুখ দেখে মনে হল।অনন্তকাল ধরে মানুষের উপকার করবার জন‌্যই তাঁরা অপেক্ষা  করছেন । চেয়ার থেকে উঠে বৃদ্ধার পাশে  গিয়ে বসলেন  সুপুরুষ ভদ্রলোকটি।
দেখে বোঝাই যাচ্ছে অসুস্হ তবু আমাকে দেখেই বৃদ্ধা উঠে বসতে  চেষ্টা করলেন। মধ‌্যবিত্ত পরিবার কিন্তু রুচিবোধ ভীষণ উন্নতমানের। এটাই দেখে আমারও খুব ভাল লাগল । দেখলাম ঘরটা বেশ বড়। দেয়াল জুড়ে কবিগুরুর একটা ছবি।খুব সুন্দর ছবি।  নিমেষে বুঝে নিলাম এঁরা কেমন হতে পারেন।দরদি তো বটেই শিল্পীমনের। হ‌্যাঁ এমন মানুষদের ভালবাসি আমি। ভালই হল কিছুটা সময় ভাল কাটবে, তারপর বৃষ্টি কমলেই চলে যাব।  একটা অদ্ভুতুরে পরিবেশ আচমকা দেবালয়ের মতো লাগছে।এখনো কিছু মানুষ আছেন যাঁরা অন‌্যের   বিপদে সাহায‌্য করতে পারলে খুশি হন। সহজেই আপন করে নেন। আমাকে পেয়ে বৃদ্ধার কথার শেষ নেই। শুরু হল ওই প্রান্ত থেকে একের পর এক প্রশ্ন। হয়তো আমার অস্বস্তি কাটানোর জন‌্যই কথা বলছেন।  মনে হল যাক, সময়টাও কাটছে।  কোথায়  থাকি?  কি পড়ি? এদিকে কেন এসেছি? আগে আমাকে কোথাও দেখে​ছেন কিনা ভাববার চেষ্টা করলেন,মনে করতে পারছেন না। ভদ্রলোক এরমধ‌্যে অন‌্য একটা ঘরে চলে গেলেন। একটু বাদে রান্নাঘর থেকে খুটখাট শব্দ পেলাম।
একটু পরে চা আর স্ন‌্যাকস জাতীয় কিছু এনে সামনে ছোট টি টেবিলে রাখলেন। আমি চা খাইনা, এতসব আনলেন কেন? একজন পুরুষ মানুষ একা সংসার সামলাচ্ছেন  দেখে অবাক হয়েছি।তৃতীয় কাউকে দেখছি না। এদিকে বৃদ্ধার  সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাত হয়ে গেল আমার খেয়াল নেই।
বৃষ্টি ধরারও নাম নেই। কী আওয়াজ! মেঘ ডাকছে একসময় আমাকে অবাক করে দিয়ে বৃদ্ধা বললেন তুমি গান জানো? একটা গান শোনাও দেখি -ভদ্রলোকটিও চাইছেন গান শুনতে। তিনি মুখে অনুরোধ করেননি। পাশে বসতে এসেও বসলেন না, দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন।  গান গাইতে জানিনা বলি কি করে? মাঝে মাঝে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাই।অনেকে বলে বেশ ভাল গানের গলা।  কবি র ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বৃষ্টির রাতে এক অচেনা বাড়িতে  আমি মৃদু স্বরে গান ধরলাম'জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ'।
এতক্ষণ সব ঠিক ছিল,  কেন জানিনা আচমকা ভয় করতে শুরু করেছে।গাইছি কিন্তু অজানা ভয়ে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।প্রথমে মনে হয়েছিল ঘরের ভোল্টেজ কম। ক্রমশ ছায়া ছায়া ভাবটা ঘনীভূত হচ্ছে।ওঁদের অবয়বদুটো  আস্তে আস্তে অস্পষ্ট হচ্ছে। বুঝতে পারছিনা দরজা কোন দিকে।  কতবার বললাম ঘরগুলো এত অন্ধকার কেন? উত্তর পেলাম না। বৃষ্টির শব্দে বোধহয় শুনতে পাননি। এটা ঠিক ওঁরা খুব মনোযোগ দিয়ে গান শুনছেন।  গাইতে গাইতে থেমে যেতে হল মাঝখানে শেষের লাইনগুলো ভুলে গেছি,  কিছুতেই মনে পড়ছে না।তখনই বৃদ্ধা তার সুললিত কন্ঠে বাকিটা গাইলেন' এখন সময় হয়েছে কি,  সভায় গিয়ে তোমায় দেখি,',,,,,,,, ।
কী সুন্দর গাইলেন। মুগ্ধ হয়ে শুনলাম। এঁরা খালি গলায় সঙ্গত ছাড়া এত সুন্দর গাইছেন, অবাক হচ্ছি।ভদ্রলোক গাইলেন 'আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরানসখা বন্ধু হে আমার',,,।রীতিমতো জলসা বসেছে।ঘরগুলো কিন্তু  আগের মতোই অন্ধকার হয়ে আছে। আবছা আলোয় রহস‌্যময়  জাদুঘর। এরকম বাড়ি আগে দেখিনি। এটা বড় কোয়ার্টার। কারোর নিজস্ব বাড়ি না। ঢুকবার সময় তো সেরকমই মনে হল।

আমিও সঙ্গীতপ্রাণা, গান ভালবাসি আর কবিগুরুর গান হলে তো কথাই নেই।  একে অচেনা তার উপর এত অদ্ভুত সুন্দর গান করছেন। এই মানুষ দুটো আরো অদ্ভুত। কেউ বোধহয় মেশেনা  প্রথমে এটাই মনে এল।  মনে হচ্ছিল আরো শোনাতে অনুরোধ করি।
কতগুলো গান  শুনলাম মনে নেই।অদৃশ‌্য মায়াজালে ওঁরা বেঁধে ফেলছে আমাকে। বৃদ্ধা মা ছেলেকে ইশারা করে আমাকে কিছু বলতে বললেন।সেটা টের পেয়ে এতক্ষণে ভয়ে পা কেঁপে উঠল।মাথা ঝিমঝিম করছে।ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ থাকলে অনেক কিছু টের পাওয়া যায়। আমি বুঝলাম এঁরাও আমাকে কোনোভাবে আটকাতে চাইছে।   তাতে কী স্বার্থসিদ্ধি হবে? ঠোঁটের উপরে ঘাম জমে উঠছে বুঝতে পারছি।নাহ এক্ষুনি বেরতে হবে।চা -টা ছুঁয়েও দেখিনি।ওভাবেই পরে থাকল।  এমনিতে চা এর প্রতি আসক্তি নেই। ভেবে দেখলাম বৃষ্টি কমল কি কমল না তার অপেক্ষা করব না। এক্ষুনি পালাই। না হলে আজ আর বেঁচে ফিরব না!
এতটা সময় আগন্তুকের সঙ্গে যথেষ্ট মানবিক আচরণ করলেন।আশ্রয় পেলাম। যথেষ্ট হল।   তারপর চৌকাঠ পেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়াতেই দেখলাম ঘরটা নিমেষে অন্ধকার হয়ে গেল।  মোমবাতি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে বারবার ডাকছিলেন।   আচমকা জ্ঞান ফিরলে যা অনুভূতি হয় তেমন হল আমার।  এক নজরে যা দেখলাম বলতে পারব না। এমন হয় নাকি? ভদ্রলোকটির মুখের একপাশ পোড়া। চোখদুটো অন্ধ।

ভয়ঙ্কর গাঢ় দাগটা । উফ!  কী ভয়ানক।  মনে মনে খুব কষ্ট পেলাম। এঁদের সত‌্যি আগে কখনো দেখিনি। এই রাস্তা ধরে আসা যাওয়া করি এদের চিনতে পারছিনা।অবশ‌্য চলার পথে সবাই যে চেনা হবে তা না, সব চেনারও এক প্রথম সময় ছিল ধরে নিলেও এঁদের হাবভাব ক্রমশ দুর্বোধ‌্য ঠেকছে।  যদিও তখনো মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। ওঁরা এমনভাবে এদিকে তাকিয়ে কিছু বলাবলি করছিলেন  যা  দেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হল।তাছাড়া এতবার বললাম কটা বাজল বলছেন না কিছুতেই।
  সাহস নিয়ে উঠে দাঁড়াই। একটা দমকা হাওয়া কোথা থেকে এসে ঘরের বাতিটা নিভিয়ে দিয়েছে। শ্বাস বন্ধ করে ঘরের বাইরে চলে আসি। আবার গুনগুন ফিসফাস শুনতে পাচ্ছি। খনখনে স্বরে বৃদ্ধ তাঁর ছেলেকে বলছেন ওকে ধর ধর, রাতটার জন‌্য আটকা। তোর ঘরে জোর করে নিয়ে যা।

আর থামি? প্রায় দৌড়ে গেট পেরিয়ে রাস্তায় উঠে যাই, অবশ‌্য ফিরবার সময় দেখলাম ওটা গলি। রাস্তা কই? সব ঝোপঝাড় জঙ্গলময় পুরনো টাউনশিপ। একসময়ে প্রচুর লোক বসবাস করত কিন্তু এখন শ্মশানের মতো খাঁখাঁ করছে। কোনো কোয়ার্টারে লোকজন নেই।সম্পূর্ণ আলাদা একটা জগতে কিভাবে চলে গেলাম? সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিও হয়নি। সব শুকনো। গাছের পাতা বাতাসে উড়ে অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। পুরোটাই মাটির রাস্তা। ধুলো উড়ছে খুব। ওঁরা কারা?গানগুলো কানের ভেতর অনুরণন তুলছে। আর কিছু শুনতে পাচ্ছি না।  আনমনে দৌড়াচ্ছি।  সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই নিয়ম। পেছন ফিরে তাকাবো না। তাই সামনেই যাচ্ছি বাড়ি কোথায় বুঝতে পারছিনা আবার বুঝতেও হয়তো পারছি। তাঁরা  আমাকে আটকাচ্ছিল কেন? আপন কেউ? কন্ঠস্বর ভাল লেগেছে কিন্তু দৃষ্টি ভাল লাগেনি। ব‌্যবহার ভাল লেগেছে কিন্তু মনোভাব ভাল না। ভয়ঙ্কর। রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে আমাকে দুর্বল করে আজ রাতেই শেষ করে দিত। আর ওঁরা এতটাই অসহায় কারোর সর্বনাশ করতে দেরি করেনা। ওঁদের জাগতিক দিকটা আজগুবি। তার থেকেও আজগুবি হল আমার বাস্তব বিস্মৃত হওয়া।
-


No comments:

Post a Comment