Monday, December 31

অণুগল্প : অশোক মজুমদার




বিনোদিনী



বিনোদ বাবু ভীষণ ভালো লোক।হাসিমুখ,যেকোন লাইনে সে পাশবই আপডেট হোক, আধার কার্ড করানোর হোক কিংবা নিতান্ত রেশনের,তিনি হাসিমুখেই বলেন,’নিন না নিন।’ লাজুক গদগদ মুখে বাজার করেন। সাইকেল টাইকেল প্রায় ধাক্কা মেরে দিলে কিংবা পায়ে পারা পড়ে গেলেও তিনি খানিক উফ করে চোখ বুজেই বলে দ্যান–‘না না ঠিক আছ,লাগেনি লাগেনি।’

                 নরম মাটি দেখলে আঁচড় কাটার স্বভাব থাকলেও অত তুলতুলে নরম মাটিতে তেমন কেউই আঘাত করতে পারে না বোধহয়। চেঁচানো তো দূর সামান্য মন কষাকষিও পাশের বাড়ির ঘোড়েল দূর্মুখ বিজনবাবু পর্যন্ত করতে পারেননি। 

                 চায়ের দোকানে দোকানে, ক্লাবে ক্লাবে পুজো মন্ডপে মন্ডপে হাসির রোলে রোলে বিনোদবাবু ওঠেন। ওঠেন মোটামুটি কারো না কারো মুখে মুখে। তবে মজলিশে যদি তাকে কেউ নির্ঘাত তোলেই সে হল পোদ্দারদা।

                 তা সেই পোদ্দারদার থেকেই শোনা, সে এক বৃষ্টির রাতে ছাদের দরজায় ঠকঠক শুনে তিনি নাকি দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছিল ডাকাতের দল। বিনোদবাবুর চেহারা দশাসই হলেও গলার স্বরে সে কি বিড়ম্বনা।। আড়াল থেকে শুনলে পাক্কা চিকন সুরের কোনো মহিলা কন্ঠ লাগে। বিনোদবাবু সেই সুরেই নাকি বলেছিলন,’ দেখে নামুন সামনে ঘরমোছার বালতিটা আছে। ‘

                তারপরও তারা ছাড়েনি বটে যা পেরেছে নিতে ; মালপত্তর বিছানার চাদরে বেঁধে গাট্টি পাকানোর পর ; যখন বৃষ্টি ধরছে না ঠিক তখন,তখন চারটে হবে। হঠাৎ তিনি মেঝের কোন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে তাক থেকে ডায়েরী খানা নিচ্ছেন দেখে সে দলের কে একজন ধমক দিয়ে উঠল — কী হল?  মুখে শব্দ না করে যেন কিচ্ছুটি হয়নি এমন ভাব করে তিনি শতরঞ্জি পেতে হারমোনিয়ামের বেলো করা ক্লিপটা খুলতেই চোখ ড্যাবড্যাব করতে থাকা লোকটা মুখের কাপড় নামিয়ে বলল,’ এ কি রে শালা গান গাইবে নাকি? ‘

               পাশের একজন হামলে পড়ে থামাতে যাচ্ছিল। বিনোদবাবু বললেন,চারটেতে আমি রেওয়াজ করি — দয়া করে বিঘ্ন ঘটাবেন না।

               এমনিতে তার বাড়ি উজাড় করেও সাড়ে তিন হাজার টাকা, দুটো দেওয়াল ঘড়ি,আর একটা ছোট পেটিকায় কিছু পুরোনো চাঁদির টাকার কালেকশন বই কিচ্ছুটি পাওয়া যায় নি। তবু একজন, হারমোনিয়াম খানা তুলতে যাচ্ছিল তা তার ভার দেখে ‘ধুর শালা’ বলে রেখে দিল। একে কিছুই তেমন জুটল না তায় ডাকাতি করতে এসে এমন এক লোকের পাল্লায় পড়া!  বৃষ্টি আর আধঘন্টায় না থামলেও আলো ফুটবে, যে ব্যাটা নচ্ছাড় টিপ দিয়েছিল তার বাপ-বাপান্ত করছিলো তারা। তারই মাঝে বিনোদবাবু শুরু করলেন– ধা-মা-পা-ধা-নি-সা…. ধামা – পানি – ধাসা…. অবস্থা বুঝুন। এমন সব হাজারো কাহিনি তার নামে ঘুরে বেড়াত। তিনি নাকি পিঁপড়েদের চিনি খাওয়াতেন। জানালার সামনে চিনি দিয়ে ডাকতেন — আয় আয় চই চই চই চই।

           তা এহেন একজন পাড়া মাথায় করা মানুষ,ইদানিং কেমন থম মেরে গেছেন।আচ্ছা গান টান গাইছে?  পোদ্দারদা শুনে বললেন, গাইছে তবে কটা দিন কি একখানা সেই যে বলো না,  রবীন্দ্রসংগীত আছে না?  ওফফ ওই যে…

—- কোন টা?

আরে প্রশ্নে প্রশ্নে একেবারে মানে ওই কারে কয়, কেন, কিসের?  কি যেন… যাতনাময়?

—হ্যাঁ হ্যাঁ,  তা এই ভাম বয়সে আবার… বলেই সকলে ফেটে পড়ল হাসিতে।

       বেশ কদিন পর যে খবরটা পাওয়া গেছিলো সে খবরটা আর পোদ্দার দা কে দেওয়ার জো ছিল না।  খবরটার সত্যতা যাচাই করেছি ক’জন। সন্ধে ছটা বাজতেই অবাক কান্ড, বিনোদ বাবু কিছু আলাপ সাধলেন আর তারপরই…. এদিকে বিনোদবাবু গাইছেন দু কলি…..’ সখিইই….কারে কয়’ ওদিকে পোদ্দার দার বাড়ি থেকে একই কলি গাইছেন পোদ্দার দারই বউ!  ইনি থামছেন,উনি গাইছেন, উনি গাইছেন,ইনি থামছেন। আমরা কুটোপাটি হচ্ছি। কথাটা তবে ভুল রটেনি?  কচুর শাক রেঁধে বিনোদবাবুকে পাঠানো?  হুমম।

        অবিশ্যি তার পরেও পোদ্দার দা বিনোদবাবুর কীর্তি তুলে ধরতেন আড্ডায়। আর আমরা তা শুনে গম্ভীর হয়ে কেশে, এ ওর দিকে চাওয়া চাওয়ি করে কূল পেতাম না।

             সেই বিনোদবাবুই?  ঠিক দেখেছিস?

—- হ্যাঁ হ্যাঁ বাসে চেপে দিয়েছে। সাগর দত্ততে নিয়ে গেছে কৌশিকরা । শুনেই যারা আড্ডা মারছিলাম, একটা টোটো ধরে ছুটলাম। পোদ্দার দাও ছিলো।ইমারজেন্সিতে গিয়ে দেখি রক্তারক্তি অবস্থা। মাথায়, হাতে-পায়ে সেলাইয়ের পর সেলাই।ডাক্তার বললেন অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে। ব্লাড দিতে হতে পারে। আর তেমন কিছু হয়নি তবে ডান পা টা ভেঙেছে না চিড় তা এক্সরে করতেও হবে।

               যাক বাবা খুব ভাগ্য, বলল পোদ্দার দা। আমরা তখন আউটডোরের বাইরে চা খাচ্ছি।  তখনই, ওমা!  তুমিইই বলে পোদ্দার দা সামনে থামা রিকশাটার কাছে গিয়ে তার স্ত্রীকেই নামাচ্ছে। তারপর তার স্ত্রীর কাঁদো কাঁদো ভাব দেখে কি বলবে তা ভেবে পাচ্ছে না। আমরা এগিয়ে গিয়ে অভয় দিলাম, কিছু হয়নি তেমন, চিন্তা করবেন না।

               পোদ্দার দা কি বুঝলো বোঝা গেল না, স্ত্রীকে বগল দাবা করে বিনোদবাবুকে দেখতে নিয়ে চলল। আর পইপই করে বোঝাতে লাগল, ‘টুক করে কপালে ছুঁইয়ে ওসব লুকিয়ে ফেলবে, নার্স দেখলে আর রক্ষে থাকবে না বলে দিচ্ছি।’ আর তারপর হাসিমুখে আমাদের দিকে ফিরে বললে —প্রসাদী ফুল, আর বলো কেন, ওর মাথায় ছোঁয়াতে এনেছে। গানের গুরু বুঝলে না!

          আমরাও সমস্বরে বললাম–‘ওওওও।’

            এর বেশ কিছুদিন পর বিনোদবাবু সরস্বতী পুজোয় পোদ্দার বউদিকে নিয়ে যুগলবন্দী গেয়েছিল বললে গল্প মনে হলেও, তবলায় ঠেকা দিয়েছিল পোদ্দার দা স্বয়ং।

              কি কেমিস্ট্রী মাইরি; বিনোদ- বিনোদিনীর।



No comments:

Post a Comment