Monday, December 31

ভ্রমণ : অনুরঞ্জনা ঘোষ নাথ



দেবভূমি হিমাচল

"আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী "-এ শুধু কবির বাণী নয়, আমাদেরও মনের কথা।  --তাই যখনই শহুরে ক্লান্তি মাকড়সার মতো মনে মস্তিষ্কে জাল বুনতে শুরু করে তখনই মনপিউপা কখন যেন নিজের অজান্তেই রঙিন ডানা মেলে উড়বার দিন স্থির করে ফেলে।

এবার প্রজাপতিরা যাবে হিমাচলপ্রদেশ তথা  মনিকরণ -মানালি -রোটাং -ধরমশালা -ডালহৌসি আর পাঞ্জাবের অমৃতসর। ২২ অক্টোবর ত্রয়োদশীর দিন দুগ্গা দুগ্গা বলে বেড়িয়ে পড়লাম  তিনজনে (আমি, পতিদেব ও আমার ছেলে সুরম্য। ) আমরা ঠিক করেছি হাওড়া থেকে রাজধানী এক্সপ্রেস এ চেপে দিল্লী আর ওখান থেকে মারুতি dzire নামক যানে করে  শিমলার নিচে পরওয়ানু (পরমাণু )তে (কালকার কাছে )রাত্রি যাপন করে পরদিন মানালির দিকে যাবার পথে মনিকরণ দেখে নেব। আমি এর আগেও একবার মানালি গেছি দিদি জামাইবাবুর সাথে।  সেবার রোটাং যাত্রা স্থগিত করতে হয়েছিল শৈত্য প্রবাহ আর ধসের কারণে। মনিকরণও অধরা ছিল। তাই এবারকার যাত্রা নিয়ে ভীষণ রোমাঞ্চিত আমি।  রোমাঞ্চিত সঙ্গের সফরসঙ্গীর জন্যও -যার বয়স মাত্র পাঁচ বছর এবং যার অজানাকে জানার অচেনাকে চেনার আগ্রহে প্রতি মুহূর্তে করে চলা প্রশ্নবাণে আমাদের  যুগপৎ আনন্দিত ও অতিষ্ঠ করে তুলছে।

আমার চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী ট্রেনের বিনিদ্র রজনীতে কখনো গয়া কখনো মোগলসরাই, এলাহাবাদ কখনো বা কানপুর স্টেশন  দেখতে দেখতে পরদিন সকালে দিল্লী পৌছালাম। দিল্লীতে যে আমাদের চালিত করবে তার নাম করণ সিং ঠাকুর। পথে যেতে যেতে দেখছি চারদিকে সবুজের সমারোহ -তার বুক চিরে চলে গেছে highway-সেই highway তে হাই স্পিড এ চলছে আমাদের আধুনিক বাতানুকূল তৈলচালিত মারুতি কারখানার 'ইচ্ছে' ( 'dzire') যান হরিয়ানা থেকে হিমাচলের পথে -কখনো ব্রিজ কখনো পথ -খালি ক্ষেতে উড়ে যাচ্ছে সাদা বকের দল -কোথাও সবুজ কচি কচি গাছ  মাথায় সোনার মুকুট পরে সর্ষে নাম নিয়ে হাওয়ায় আন্দোলিত আবার কোথাও ইউক্যালিপটাসের সারি আর একগুচ্ছ ধাবা। সেখানকার একটাতেই মধ্যাহ্নভোজ সারা হল।  এখানকার বেশিরভাগ ধাবাই ভেজ,   যা অত্যন্ত আমিষপ্রিয় নাথ পরিবারের কাছে ভীষণ ট্র্যাজিক ব্যাপার।



পরওয়ানুতে পৌঁছতে বিকেল হল। শীতের শুরুর মতো হাল্কা ঠান্ডা এখানে। হিমাচল প্রদেশ ট্যুরিজম এর হোটেল শিবালিক এ রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা হয়েছে আমাদের। বেশ সুন্দর হোটেলটা যদিও একটু নির্জন প্রকৃতির।  হোটেলের বিস্তৃত ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে ডিনার করে ঘুম লাগালাম দুদিনের নিরবিচ্ছিন্ন যাত্রার ক্লান্তি দূর করার জন্য যা ছিল খুবই প্রয়োজনীয়। পরদিন সকালে রওনা দিলাম মণিকরণের উদ্দেশ্যে. বহুপথ, যানজট ইত্যাদি পেরোতে পেরোতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এলো।  হিমাচল প্রদেশের মান্ডি শহর থেকে একটা রাস্তা মানালির দিকে ও অপর একটি মনিকরণের দিকে গেছে অনেকটা 'v' আকৃতির মতো।  মান্ডি ছুঁয়ে মনিকরণ হয়ে আবার মান্ডি ফিরে মানালির পথ ধরতে হবে। আর একটু সকাল সকাল  বেরোলে ভালো ছিল -অনভিজ্ঞতার মাশুল দিলাম সন্ধ্যেয় পৌঁছে।  মণিকরণের আশপাশের দৃশ্যাবলীর সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করার নয়। মণিকরন হল উষ্ণ প্রস্রবণ।  এছাড়া এখানের মূল আকর্ষণ এখানকার গুরুদ্বার ও শিবমন্দির। কুলু জেলার ৪৫ কিমি উত্তর পশ্চিমে পার্বতী ঘাঁটিতে পার্বতী নদীর মধ্যে অবস্থিত হিন্দু ও শিখদের ধর্মস্থল মনিকরণ। সমুদ্রতট থেকে এর উচ্চতা ১৭৬০ মিটার। শীতে এখানে যখন বরফ পড়ে তখনও গুরুদ্বারের ভিতর উষ্ণ প্রস্রবনে স্নান করার মজা নেওয়া যায়। এর জলে বহুল পরিমানে গন্ধকের উপস্থিতি চর্মরোগ বাতজ রোগের ক্ষেত্রে কার্যকরী। চালের পুঁটলি বেঁধে এই জলে ফেলে সিদ্ধ করে ও এই জলে চা করে গুরুদ্বারের লঙ্গরে পর্যটকদের ক্ষুন্নিবৃত্তির তৃপ্তি সাধন করা হয়। শোনা যায় গুরুনানক ভাই মর্দানা ও পঞ্চ পেয়ারের সঙ্গে এখানে যখন  এসেছিলেন মর্দানাকে লঙ্গরের জন্য কিছু ডাল আটা চেয়ে আনতে বলেছিলেন। আর যেখানে তিনি বসেছিলেন তার সামনের একটা পাথর মর্দানাকে তুলতে বলেছিলেন, যখন মর্দানা পাথর তুলল ওখানথেকে গরমজলের স্রোত বেরোতে লাগলো যা আজও কায়েম আছে। অবশ্য অন্য একটি জনশ্রুতিও আছে গুরুনানককে নিয়ে এ সম্পর্কে। এতো গেল ঐতিহাসিক মত। হিন্দু পৌরাণিক মতে শিবপার্বতী এগারো হাজার বছর ধরে এখানে তপস্যা করেছিলেন। মাতা পার্বতী যখন জল ক্রীড়া করছিলেন তখন তার কানের দুলের মণি খুলে জলে  পড়ে যায় এবং ভগবান শিব নিজের কণাদের পাঠিয়েও তার খোঁজ পায়না। এতে ক্রুদ্ধ শিব তৃতীয় নয়ন খুলে ফেলেন, তাতে সমগ্র দেবতারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়েওঠেন। শেষে জানা যায় মণিটি পাতালে শেষনাগের কাছে আছে, শেষনাগ অনিচ্ছাসত্ত্বেও মণি দিতে বাধ্য হয়ে রেগে হুঙ্কার ছাড়লে এখানে গরম জলের ধারার সৃষ্টি হয় আর মণি ফেরত পেয়ে শিব পার্বতী খুশি হয়ে ওঠেন আর তখন থেকে  এর নাম হয় মনিকরণ। এখানকার পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক কাহিনীর মতোই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও আকর্ষণীয়। ক্রিস্টাল পাথরের টোপাজের ন্যায় আলোর বিচ্ছুরণ, সুন্দর বন্য ফুল লতাপাতা, শুকনো ফল এই স্থানকে স্বর্গীয় মহিমায় মহিমান্বিত করেছে যা থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম সন্ধ্যায় পৌঁছানোর কারণে।



যাহোক  আমরা যখন ওখানে পৌঁছে সিঁড়ি দিয়ে নামলাম দেখি উষ্ণ প্রস্রবনের গরম জল নদীর ঠান্ডা জলের সংস্পর্শে এসে ধোঁয়া নির্গত করছে। গন্ধকযুক্ত সেই বায়ুর ঘ্রাণ ছোটবেলাকার মায়ের ও প্রতিবেশিনীদের দেওয়া উনুনের ধোঁয়ার কথা মনে করিয়ে দিল।  পায়ে হাঁটা লোহার ব্রিজ পেরিয়ে পৌঁছালাম বিশালায়তন গুরুদ্বার  এ। এখানে রয়েছে উষ্ণ প্রস্রবনের জল বয়ে যাওয়া স্নানাগার। পুরুষ মহিলা ভিন্ন ব্যবস্থা। রয়েছে হট কেভ -যার অনেকগুলো ঢোকার মুখ আধুনিক টালি দিয়ে বাঁধানো।  প্রবেশপথগুলো খুব ছোট ও নিচু  হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়। ভিতরটা অবশ্য আলোকিত বাল্বের আলোয়।


এরপর গুরুদ্বার এর মূলমন্দির ও শিবমন্দির দর্শন করে ফিরতে ফিরতে মনস্থির করলাম  যদি কখনো জীবন ফের এখানে আসার সুযোগ দেয় তাহলে আমি শুধু মনিকরণেই আসব এবং ৫-৬ দিন এখানের উষ্ণ প্রস্রবনে বসেই কাটিয়ে দেব -যত রোগ জরা ব্যাধি দূর হয় কিনা দেখবো। বেশ মনোকষ্ট নিয়েই ফিরতি পথ ধরলাম মানালির। বেশ সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছিলো তখন আর অন্ধকারের বুক চিরে আলো ফেলে  দ্রুত ফিরে চলা গাড়িতে একটু যেন ভয়ই করতে লাগলো। ইষ্টনাম জপতেজপতে অভিজ্ঞ চালকের দক্ষতায় রাত নটা নাগাদ পৌঁছলাম মানালির মাল রোডের ওপর হিমাচল ট্যুরিজম এর অপর একটি হোটেল কুনজুম- এ।

পরের দিন ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যেতে একা একা বেড়িয়ে পড়লাম মানালির রাস্তায়। আমার ব্যাপক লাগে একা একা নতুন জায়গায় ঘুরতে। সকালের আড়মোড়া ভাঙা প্রকৃতিকে নিজের হাতের ছোঁয়ায় ডেকে তুলতে। দোকানে দোকানে উনুনের ধোঁয়া আর গরম চা, মানুষের পরিমিত আনাগোনা আর কাঁচা সোনারংয়ের সূর্যের হালকা তাপ এই শীতে আমায় মায়ের আদরের মতো করে জড়িয়ে ধরবে আর আমি তার ওম নিতে নিতে  পথ চলব -এ এক অনন্য সাধারণ অনুভূতি।


ঘুরতে এসে প্রকৃতির সৌন্দর্যের বিরল মুহূর্তের দৃশ্যাবলী বন্দি করি মুঠোফোনে। তাও কি পারি সব? যে আবেগ নিয়ে মনের চোখ দেখে মুঠোফোন কি পারে তা বন্দি করতে? তাই প্রানভরে দুচোখ দিয়ে অবাক অপুর মতো চলার পথের বাঁকে বাঁকে প্রকৃতির অদৃশ্যপূর্ব রূপ দর্শন করি আর যতটা পারি বেশি বেশি করে ভরে নিই স্মৃতির মণি কোঠায় যাতে বাড়ি ফিরে অনেকদিন পর কংক্রিটের কেজো জঙ্গলে দিন কাটাবার পর স্মৃতি রোমন্থনে পাই সেই সুন্দর পৃথিবীর স্পর্শ।  সেই  কারণেইতো বারবার ছুটে যাই উন্মুক্ত প্রকৃতির কোলে -অনেকটা গরমের বা পুজোর ছুটিতে ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে মামাবাড়ি যাবার মতো -কেউ পড়তে বলবেনা, বকবেনা, মারবেনা -অন্যায় প্রশ্রয় দেবে, খেলতে দেবে,মাঠেঘাটে বনবাদাড়ে ছুটতে দেবে,যেখানে সকালে ঘুম থেকে ওঠার তারা নেই, রাতে ঘুমোতে যাবার জলদি নেই... তাইতো আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার নিষ্পেষণে শেষ হয়ে যাওয়া জীবনটা নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃতি মায়ের ভালোবাসায়, মামাবাড়ির মতো উন্মুক্ত আকাশ, উদাত্ত পৃথিবীর মধ্যে।
এরপর আমরা মানালির আশেপাশে দর্শনীয় স্থানে এলাম।  ঘন পাইনের বনে অবস্থিত হিড়িম্বা দেবীর মন্দির। কীরকম ভয় ও ভালোলাগার মিশেল ঘটেছে এখানে। দারুনির্মিত মন্দিরের কারুকাজ সমঝদারের আকর্ষণ উদ্রেক করে। মোটা মোটা বড়ো বড়ো খরগোশ দেখলাম যা কয়েকজন হিমাচলী মহিলা পর্যটকদের হাতে দিয়ে ফটো তুলতে বলছে। সত্যি খরগোশ গুলো খুব মজার। ওখানে হিমাচলী পোশাক পরে ছবি তোলারও ব্যাবস্থা রয়েছে এবং আমরা তা গ্রহণ ও করলাম। চমরিগাইয়ের ও দেখা মিললো। ওমা ! দেখি সেও pose দিয়ে ফটো তোলার জন্য একদম রেডি। এখান থেকে বশিষ্ঠ মন্দিরের শিল্প  স্থাপত্য দেখে আমরা চললাম মানালি ক্লাব হাউস এর দিকে। ওখানে সুরম্য ও সুমন বোটিং করলো আর চারপাশটা একটু ঘুরে আমরা হোটেলে ফিরে লাঞ্চ সেরে একটু মানালির ম্যাল এ ঘুরে বেড়ালাম। আমরা মাল রোডে থাকাতে হোটেল থেকে নেমেই দোকানে চলে যাচ্ছিলাম -নানারকম জিনিসের পসরা নিয়ে বসা দোকানগুলো ঝলমল করছে আলোতে,  জিনিসে, মানুষে. অনেকরকম আকৃতির ছোট ছোট রবার প্যাকেটবন্দি (২০-৩০ টাকা থেকে শুরু )দেখলাম। দেখে বেশ মজাও লাগল যে কতরকম বাহার তাদের।  তার কিছু দোকান ছেড়ে আমাদের ঝুলিতেও এলো।  নানারকম পঞ্চু শাল সোয়েটার তথা শীতপোশাকের মেলা -ইচ্ছে থাকলে তার কিয়দংশ আপনার ঝুলিতেও স্থানান্তরিত হতেও পারে কি বলেন !
পরের দিন রোটাংপাস। সকাল সকাল রেডি হয়ে চললাম করণের সঙ্গে সেই পথে। মনে মনে রোমাঞ্চ হচ্ছে। আবার ভয়ও হচ্ছে। আগেরবার 'মারি ' পর্যন্ত গিয়েছিলাম (মিশণ রোটাংপাস  আনসাকসেসফুলই ছিল)। তবে ওখানে এত শৈত্য প্রবাহ ছিল যে ভালো করে গাড়ি থেকে নামাই যাচ্ছিলোনা। তবে এবার রয়েছে রৌদ্রকরোজ্জ্বল আবহাওয়া। তাকে সফরসঙ্গী করে হিমালয়ের রূপ দেখতে দেখতে চলতে লাগলাম উঁচু থেকে উঁচুতে। পথে বরফাবৃত পর্বতে ওঠার উপযুক্ত পোশাক পরে নিতে হল যা ভাড়ায় পাওয়া যায়।  পোশাক পরিহিত আমাদের দেখে মনে হচ্ছিল এখুনি বোধয় রকেটে চেপে মহাকাশচারীর মতো মহাকাশে পাড়ি দেব। মারি পর্যন্ত যখন এসে পৌঁছলাম ততক্ষনে সবুজের সমারোহ শেষ হয়ে কোথাও ধূসর কালো কোথাও বরফের মুকুট মাথায় নিয়ে পর্বতেরা আমাদের চারদিক আলো করে দাঁড়িয়ে। করণ বললো আরকিছুদিনের মধ্যেই সবটা অ ঞ্চল বরফে ঢেকে যাবে এমনকি মানালীতেও বরফ পরে যেখানে আমরা কাল কতো ঘুরলাম। পথে যেতে যেতে এবার দেখা মিললো তরল ঝর্ণা  ও বরফ হয়ে যাওয়া স্ফটিকাকৃতির সুন্দর ঝর্ণার। আরো যত উপরে উঠতে লাগলাম দেখি পর্বতেরাও শীতে সাদা বরফের চাদর গায়ে জড়িয়ে রাজার মতো সূর্যের ওম নিচ্ছে. গাড়ি থেকে নেমে দেখি চারদিকে বরফ আর বরফ !!অবাক করার মতো বিষয় এইযে সূর্যের এত তাপ ছিল যে ওই বরফের রাজ্যে দাঁড়িয়েও রীতিমতো গরম বোধ করছিলাম -টুপি খুলে আমি বরফের মধ্যে শুয়ে পড়েছিলাম। অসাধারণ সে অনুভূতি। আমার নিচে বিশাল  বরফাবৃত পর্বত ওপরে উন্মুক্ত  আকাশ -তাদের মাঝে প্রকৃতির এই অসাধারণ সৃষ্টির মধ্যে আমি এক নগন্য জীব শুয়ে আছি আর আমার মন সেইমুহূর্তের জন্য ঈশ্বরের কাছে নিজের জীবনের কাছে প্রণত হচ্ছে -এই অপরূপ ঘটনার সাক্ষি হবার সুযোগ পেয়ে সুধন্যা হবার জন্য।  মনে মনে বললাম "হে ঈশ্বর, হে প্রকৃতি তোমরা আমাকে ভালোবেসে আপন করে নিলে তোমাদের এই আতিথেয়তা আমি কোনোদিন ভুলবোনা -ভুলবোনা এ অবর্ননীয় অনুভূতি যা আমার মনের ও শরীরের অন্দরে কন্দরে রোমাঞ্চ জাগিয়ে তুলছে।'


ফেরার পথে পড়লাম যানজটে।  ওপরথেকে পাহাড়ের পাকদন্ডী বেয়ে সারিবদ্ধ গাড়ির লাইন দেখে মনে হচ্ছিল যেন সার সার পিঁপড়ে দাঁড়িয়ে আছে।পর্বতের মাথায় বরফের মুকুটে কাঁচাসোনা রোদের স্বর্ণাভ ঝিকিমিকি খেলা দেখতে দেখতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম স্বপ্নের রাজ্যে। দেবভূমিতে দেবতার বাস -সেইখানে নগন্য মানুষের পদার্পন -একথা ভাবতে ভীষণ ভালো লাগলো আর ভালো লাগতে লাগতে কেমন একটা ভালোলাগার আবেশ সারা মনে শরীরে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
মারি অবধি পৌঁছে দেখলাম তুষারপাত হচ্ছে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মতন -জীবনে প্রথম দেখা তুষারপাত মন ছুঁয়ে গেল -হাত পেতে রাখলাম আর হাতের তালুতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তুষারকণা এসে বসত জমাতে লাগল আর আমি ছোট্টশিশুর মতো অবাক কৌতূহলে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
পরেরদিন মানালি ছেড়ে ধরমশালা যাবার পালা। সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম -মানালি থেকে কুলু হয়ে মান্ডি ও কাংড়া উপত্যকার মধ্যে দিয়ে ধরমশালা যেতে হয়। মানালী ছাড়ার সময় কিছুদূর পার্বতী নদী আমাদের বিদায় জানাতে এসেছিল। কিছুদূর পর্যন্ত উপল খন্ডের উপর তার ফিরোজা রঙের স্বচ্ছ জলের নাচ দেখতে দেখতে আর মানালী রোটাংয়ের স্মৃতি মনে নিয়ে এগোতে লাগলাম। তবে এখানে সেই পথের দুধারে খালিমাঠ বড়ো ঘাস ছিল, bhuttico শাল কারখানার বিজ্ঞাপন ছিল একটু দূর দূর কুলু থেকে মানালি যাবার পথে তা আর দেখলাম না। বোধয় এটা অন্য রুট। ধীরে ধীরে কাংড়া উপত্যকায় যখন পৌঁছালাম তখন তার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনকে আপ্লুত করে দিল। পথের বাঁকে বাঁকে ঈশ্বর যেন সৌন্দর্য মুঠো মুঠো করে ছড়িয়ে দিয়েছে।  কোথাও উঁচু পাহাড়ে ঘন পাইনের অরণ্য কোথাও নিচে পাহাড়ী গাছের ঝাঁকড়া চুলো সার মাথা, কোথাও সারিবদ্ধ পাহাড় যেন লাইন দিয়ে স্কুলের প্রার্থনাতে যোগ দিয়েছে আর তার ওপরে মেঘ ও রৌদ্রের খেলা তাকে আরো আকর্ষনীয় করে তুলেছে। পাহাড়ের আড়ালে সূর্য চলে গেলে ঠান্ডা বোধ করতে লাগলাম আবার পাকদন্ডী পেরিয়ে নতুন পাহাড়ের পথে উঠলে সূর্য উঁকি দিলেই বেশ তাপ অনুভূত হতে লাগলো। সূর্যের টুকিটুকি খেলায় মনটা বেশ মেতে উঠলো।  আবার কোথাও দেখলাম সূর্যের আলোয় উপত্যকা ধুয়ে যাচ্ছে -নেমে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করল সেই ছোট্টবেলাকার বন্ধুদের হাত ধরে। এরকমই আরো আরো সুন্দর প্রকৃতিকে সাক্ষি করে পৌঁছে গেলাম ধরমশালা।

ধরমশালা পৌঁছে দেখলাম চারিদিকে ছোট ছোট দোকান আর বহু বিদেশী পর্যটকদের ভিড়। গাড়ি ধরমশালা ছেড়ে ম্যাক্লয়েডগঞ্জ এর দিকে এগোতে থাকলো -পথের দুপাশে যেমন প্রকৃতির অবারিত দান এখানে দেখলাম তেমনি দেখলাম এখানকার রাস্তাঘাট বেশ বাঁধানো সুন্দর ও ঝকঝকে। মনে হল কোন বিদেশে চলে এসেছি যেখানে পথঘাট এত সুন্দর।  এখানে গাড়ি থেকে পথে চলা এক নীলনয়না বিদেশিনীকে দেখলাম ধূসর কেশা ও ধূসর বেশা -তার চোখদুটি অপার মোহময় ও আকর্ষণীয় -যদিও একঝলক তাকে দেখেছিলাম কিন্তু তার সৌন্দর্য মনকে এমন বিদ্ধ করেছিলো যে আজও তাকে মনে করলেই যেন সামনে দেখতে পাই।

যাইহোক ধরমশালা হয়ে ম্যাকলয়েডগঞ্জ  এ পৌঁছতে সন্ধে হল। হোটেল ভাগসু তে (সৌজন্যে হিমাচল ট্যুরিজম )স্থান নিলাম। খুব সুন্দর হোটেল ঘরগুলো অর্ধচন্দ্রাকৃতি আকারে বসানো।  ঘরের লাগোয়া বারান্দার পাশেই ওপেন টেরেস -মাথায় ছাতাযুক্ত কালোরংয়ের টেবিল চেয়ারে সুসজ্জিত। তাকে ঘিরে ছোট গ্রিল এবং তার পরে অনেক বড় লন।  এখানে বেশ ঠান্ডা লাগছিলো।  ঘরটি খুব বড়  না হলেও সুসজ্জিত ও কাঠবাধাঁনো হওয়াতে বেশ আরামদায়ক। একটু ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম ম্যাকলয়েডগঞ্জ এর মূল বাজার চত্তরে। এখানে বহু তিব্বতি ও বিদেশিদের ভিড়। দোকানে দোকানে নানারকম শীতপোশাক,কেক প্যাস্ট্রি, পাথরের গয়না আর রকমারি রঙিন পাথরের পসরা। এখানে একটি তিব্বতি হোটেলে স্নাক্স হিসেবে মটন ও চিকেন মোমো খেলাম। ভিতর থেকে বেরোনো গলিত মাখনের যে সুস্বাদ ও সুঘ্রাণ তা ক্ষুধার্ত ভোজন রসিক বাঙালি  মানুষদের এমনভাবে সম্মোহিত করল যে রাধুঁনীটি প্রায় অপহৃত হয়ে কলকাতা পাড়ি দিচ্ছিল শুধু দলে ভারী নই বলে এই দুঃসাহসিক অভিযানটি ভবিষ্যতে করব বলে তখনকার মত মনস্থির করলাম !এবার চলল সামান্য কেনাকাটা আর কেক কেনার পর্ব।

এরপরের দিন সকালে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম দলাইলামা মন্দির দর্শনে। বিশাল বড় মন্দির মনকে শান্ত পবিত্রতায় ভরিয়ে দেয়। লামাদের সমোচ্চারিত গুরুগম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণে সমগ্র পরিবেশ স্বর্গীয় অনুভবে ভরে ওঠে। ওখান থেকে ফেরারপথে একটি হোটেলে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে করণের সাথে ভাগসু ঝর্ণা, ধরমশালা স্টেডিয়াম ও ভাগসু মন্দির দেখলাম। ওখানে একটি ঠান্ডা জলের সুইমিং পুলে লোকে নির্দ্বিধায় কিভাবে সাঁতরাচ্ছে দেখে অবাক হলাম।
পরদিন আমরা চললাম ডালহৌসির উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যে বেলায় পৌঁছে হোটেল আর্ক্- এ এলাম।  এই হোটেলের লিফটটি হোটেলের বাইরের দিকে থাকায় ওঠা নামার সময় প্রকৃতির সুন্দর দৃশ্যাবলীর সম্মুখ সাক্ষাৎ হবার বারংবার সুযোগ মিলল।

এখানথেকে পরদিন চললাম চাম্বা জেলার খাজিয়ার এর উপত্যকায়, এটি হিমালয়ের একটি বিরাট পার্বত্য উপত্যকা। ওখানে পৌঁছে সুবিস্তৃত গালিচার মতো  সবুজ ঘাসের বিস্তার দেখে মন আনন্দে ভরে উঠলো আর আমি একটা সুবিধামতো জায়গা দেখে ব্যাগপত্তর ফেলে ধুপ করে শুয়ে পড়লাম। বরবাবাজীবন যদিও "করো কি করো কি গিন্নি" বলে হাঁ হাঁ করে ছুটে এলো তবুও কাউকে পাত্তা না দিয়ে সেই সময় উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে কেমন যেন বিছিয়ে দিতে ইচ্ছে করল ঘাসের ঢালু জমিতে আপন প্রাণ প্রবাহিত করে দিয়ে ওই ঢাল বেয়ে গড়িয়ে চলে গিয়ে পৃথিবীর অন্দর মহলে ঘাসের সাথে মিশে যেতে  ঘাস হয়ে -মনে হল শুধু চোখ দিয়ে নয় পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে একে অনুভব করি -নিয়ে নি যতটা পারি সাপ্টে আপন স্মৃতিকোঠায় -আর সেথায় তারে  বন্দি করে রাখি জীবনভোর -ইটকাঠলোহার জেলখানার অধিবাসীদের এ কী অন্যায্য চাওয়া??

এখানে সুরম্য পড়েছিল হিমাচলী পোশাক আর কোলে ছিল ৩টি  কচি কচি খরগোশ ছানা -ওমা একদম হিমাচলী শিশু লাগছে ওকে। দেখলাম মিষ্টি ভেড়ার পাল তারা উপত্যকায় কচি ঘাসের জলখাবার খেতে এসেছে। সুরম্য ওদের দেখে কী খুশি, ওদের সঙ্গে কিছুক্ষন খেলার পর বায়না ধরল  যে ওদের একটাকে বাড়ি নিয়ে এসে পুষবে। ওকে থামানো মুশকিল হল, শেষে ধর্মতলা থেকে পরিষ্কার দেখে ছোট্ট একটা  ভেড়া ওর জন্য কোলকাতায় ফিরেই কিনে আনা হবে -এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে তবে তিনি ক্ষান্ত  হলেন। সেসব কথা ভুলে গেলেও আজও মাঝে মাঝে হিমাচল প্রদেশের কথা উঠলেই মনে করিয়ে দেয় যে, ওর ভেড়াটা এখনো কেনা হয়নি ! আর দুঃখ পেলে বা পড়তে ইচ্ছে না করলেই বলে যে ও  নাকি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে khajiar এ গিয়ে ভেড়া চড়াবে আর আমি আর ও নাকি ওখানেই থেকে যাব !!!

ডালহৌসি থেকে পরদিন আমরা পাততাড়ি গুটিয়ে চললাম অমৃতসরের পথে। পথে যেতে যেতে দেখলাম  ঘন ঝাউবনের মধ্যে ঝিকিমিকি সোনারোদের ঝিলিক-যেন লুকোচুরি খেলা -সেই ছোট্টবেলাকার মতো। যেন ঘন ঝাউবনের পরেই মিলবে আমার সেই রূপকথার রাজ্য -সেই ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী আর সোনার কাঠি রুপোর কাঠি রাজপুত্তুর কোটালপুত্তুরের দেখা -আর সেইসব না ফুরোনো গল্পগুলো -যার শেষ লাইনে এসেও মনের কোনে উঁকি দিত ওই একটাই প্রশ্ন -তারপরে? তারপরে? তারপরে? আজও সেই ঝাউয়ের বন দেখে ওই একটাই প্রশ্ন জেগে উঠছে -তারপরে? তারপরে? তারপরে? প্রকৃতির এই আলোছায়ার খেলা দেখতে দেখতে হিমাচল থেকে পাঞ্জাবে চলে এলাম। 'হাভেলি ' বলে একটি রেস্তোরাঁতে মধ্যাহ্নভোজ (লস্যি সহ )সেরে ওয়াঘা বর্ডার দেখতে গেলাম, যেখানে দুই দেশের সীমারেখা একই ভূখণ্ড কে খন্ড খন্ড করেছে...... কেন জানিনা মনে ভেসে উঠলো 'রিফিউজি 'নামক হিন্দি চলচ্চিত্রের সেই ঋদয়স্পর্শী  গানটি ---

"পঞ্চি নদিয়া পবনকে ঝোঁকে
কোই সরহদ না ইনহে রোকে,
সরহঁদে তো ইনসানো কে  লিয়ে হে,
সোচো তুমনে ঔর ম্যায়নে ক্যায়া  পায়া ইনসা হোকে "


ওখানে দুদেশের বর্ডারে নাচগান দেখলাম যাতে আমরা সাধারণ দর্শকরাও অংশগ্রহণ করতে পারলাম। অনুষ্ঠানটিতে দেশপ্রেমের চেয়ে চটুল হিন্দিগান ও হৈচৈ টাই বেশি আছে বলে আমার মনে হল।  আর দেশপ্রেমের স্লোগান বড্ডো আরোপিত লাগল।

এরপর চললাম অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির। জালিয়ানওয়ালাবাগ স্বর্ণমন্দির এর পাশেই অবস্থিত। যেখানে ইংরেজ শাসকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সাক্ষি বহনকারী দেওয়ালটি বুলেটের চিহ্ন বুকে নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে, আছে সেই মৃত্যু কূপ টিও যদিও আর তার চারদিক বাঁধানো। বাগটিও  সুন্দর  করে লালপাথর ও নানারকম পাতা বাহারি গাছে সাজানো। এর পাশে শ্বেত পাথর ও সোনায় বাঁধানো

স্বর্ণমন্দির তথা গুরুদ্বার এ প্রবেশ করলাম। চারদিকে পুকুর ও তাতে অজস্র বড় বড় রঙ্গিন মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে আর তার মাঝে উজ্জ্বল হয়ে আছে মন্দিরটি। পরিচ্ছন্ন নিয়মনিষ্ঠ পরিবেশে ঈশ্বরের ভজন মনে অপার্থিব অনুভূতি এনে দেয়। এখানকার শুধু মন্দির এর কারুকাজ  নয় মন্দিরের ভিতরের সিলিং ও টেবিল ফ্যান, ভজন গায়কদের হারমোনিয়াম ও মাইক্রোফোন সবই সোনায় বাঁধানো দেখে মুগ্ধ ও বিস্মিত হলাম। হালুয়া প্রসাদ সহ স্বর্ণ মন্দিরের স্বর্ণাভা মনকে পরিপূর্ণতায় ভরে দিল।

পরেরদিন ভোরে উঠে সূর্যসাক্ষি করে অমৃতসর কে বিদায় জানিয়ে পাঞ্জাব,  হরিয়ানা হয়ে দিল্লী ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে যখন আসলাম তখন ঘড়িতে দুটো। সন্ধ্যে ৬.৩০ এ আমাদের উড়ান। আনন্দ সহকারে এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে ঢুকে পড়লাম। এবার যে আমাদের ঘরে ফেরার পালা.....।










3 comments: