Monday, December 31

গল্প : রবীন বসু








মিতালি ও তার সোঁদরবনের বাড়ি       



—এ্যাই, তোরা যাবি একদিন আমাদের বাড়ি?

ইউনিভর্সিটি থেকে বেরিয়ে এইট বি বাসস্ট্যাণ্ডের দিকে যেতে যেতে মিতালি কথাগুলো বলেছিল l সবাই হো হো করে একপ্রস্থ হেসে উঠেছিল l তারপর যে যার মত সব মন্তব্য l

—ও বাবা, তোদের বাড়ি বলতে তো সেই মাতলার পাড়ে, সোঁদরবন l  যেখানে ডাঙায় বাঘ আর জলে কুমির l না বাবা, বেঘোরে প্রাণটা দিতে চাই না l দীপক একটা লাফ দিয়ে মিতালির পাশ থেকে সরে এলো l

—তা কী খাওয়াবে খুকুমণি? গাঙের লাল কাঁকড়া? চয়ন চোখ বড় বড় করে l

মিতালি কেমন সংকুচিত হয়, লজ্জা পায় l সে সুন্দরবন অঞ্চলের মেয়ে বলে তাকে কম বিদ্রূপ সহ্য করতে হয় নি কলেজ ইউনিভার্সিটিতে l দখনো আবাদের মাল এই সব বিশেষণে ভূষিত করেছে তার শহুরে সহপাঠীরা l তবু খেতমজুর হারান দাসের মেয়ে জেদ ছাড়ে নি, পড়াশোনা সে চালিয়ে যাবে l মাস্টার্স কমপ্লিট করে বি এড টা করলেই সে এস এস সি তে বসবে l তারপর স্কুলে একটা চাকরি l দুঃখী অভাবী বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে l ছোট ভাইবোন দুটিকে মানুষ করবে l


না, মিতালির বাড়িতে আর যাওয়া হয় নি l যাদবপুরের বাংলা বিভাগের তেরোর ব্যাচ ইউনিভার্সিটি ছাড়ার পর আমরা সব ছড়িয়ে পড়লাম যে যার মত l শুনেছিলাম মিতালি অনেক কষ্ট করে বি এড করেছিল l তারপর দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ও এস এস সি উতরে একটা হাইস্কুলে জয়েনও করেছিল l এই পর্যন্ত আমার জানা ছিল l বাকিটা জানলাম কাল ফেসবুকে রাকার ওই পোস্টটা দেখে l রাকা একটা সংবাদপত্র থেকে একটা নিউজের অংশ তুলে দিয়ে লিখেছে, সংবাদে যে মেয়েটি ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার হয়েছে সে তাদের সহপাঠী মিতালি l স্বামী লোহার রড জাতীয় কিছু দিয়ে মাথার পেছনে জোরে আঘাত করায় তার মৃত্যু l তারপর গলায় কাপড়ের ফাঁস লাগিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা বলে চালাতে চেষ্টা করেছে l


স্কুলে চাকরি পাবার পর পরই মিতালির এক দূর সম্পর্কের দিদি সম্বন্ধ আনে l মিতালির আপত্তি ছিল l

বলেছিল,  না দিদি, এত  তাড়াতাড়ি আমি বিয়ে  করব

না l ভাইবোন দুটো ছোট l বাবা আর আগের মত কাজে যেতে পারেনা, বুকে হাঁফ ধরে l কটা বছর যাক, তারপর ভাবব l কিন্তু দিদি শোনে নি l  কিছুদিনের মধ্যে একদিন স্কুল থেকে ফিরে দ্যাখে কারা যেন এসেছে l ওরই ছোট ঘরটাতে তারা বসেছে l মা এগিয়ে এসে ফিস ফিস করে বলল, ওরা তোকে দেখতে এসেছে l ছেলে, ছেলের বাবা-মা আর এক বন্ধু l ওদের কোন দাবী নেই l ছেলে একটা  বড় নার্সিং হোমে টেকনিসিয়ান l ভালো মাইনে পায় l তোর বাবার শরীর ভালো না, তাই বলছিল, আমি থাকতে থাকতে মিতালির বিয়েটা দিয়ে যাই l কখন কী হয়ে যায় l

মিতালি মায়ের মুখ চেপে ধরেছিল l—আচ্ছা চল, আগে দেখি তো ছেলেকে l

প্রথম দেখাতেই কেমন ভালোলেগে গিয়েছিল মিতালির l

নাম জেনেছিল সুদীপ l  মিতালি শুধু একটা শর্ত রেখেছিল, তার মাইনের টাকা সে অর্ধেক বাবা-মাকে দেবে l সুদীপের মা বলেছিল, নিশ্চয়ই দেবে l ওনারা হলেন তোমার জন্মদাতা জনক-জননী, তুমি ওদের দেখবে না তো কে দেখবে l তোমার যা খুশি দিও, আমরা আপত্তি করব না l


কিন্তু সেটা যে ছিল মুখোশ আর একটা বানানো অসত্য কথা তা বিয়ের পরই টের পায় মিতালি l  আরও অনেক কিছু টের পেয়েছিল l সুদীপ ড্রাগ নেয়, ও নার্সিংহোমের টেকনিসিয়ান না, সামান্য মাইনের ওয়ার্ড বয় l আসলে ওরা মিতালির মাইনের টাকাটা নেবে বলে ফাঁদ পেতেছিল l শুরু হল নানারকম অত্যাচার l প্রথম প্রথম ও বাড়িতে কিচ্ছু জানায় নি l মাইনের টাকাটা প্রায় সবই শাশুড়ির হাতে তুলে দিত l আর স্কুল ছুটির পর রাত পর্যন্ত কোচিংয়ে পড়িয়ে যে টাকা পেত সেটা বাবা-মাকে দিয়ে আসত, তাও এদের না জানিয়ে l কিন্তু সুদীপের টাকার চাহিদা দিন দিন বাড়তে লাগল l না পেলে গায়ে হাত তুলত, অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিত l কয়েকবার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়েছিল, পুড়িয়ে মারবে l শেষে মিতালি ভয় পেয়ে বাপের বাড়ি চলে যায় l তখন সে চার মাসের গর্ভবতী l নিজের থেকেও,যে প্রাণ আসছে তাকে রক্ষা করা দরকার l তার নিরাপত্তা আগে l সেখানেও সে ঠকে গেল l  কয়েকমাস চুপচাপ থাকার পর পুজোর সময় সপ্তমীর দিন সুদীপ গিয়ে ক্ষমাটমা চেয়ে তাকে ফিরিয়ে এনেছিল l কিন্ত সেদিন রাত্রেই এই ঘটনা l

সংবাদে প্রকাশ মিতালির বাড়ির লোকেরা সুদীপের নার্সিংহোমে বডি নিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি ডেথ সার্টিফিকেট জোগাড় করে বডি পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল l লোকাল থানাও টাকা খেয়ে প্রথমে বডি ছেড়ে দিয়েছিল বিনা পোস্টমর্টেমে l প্রতিবেশী কিছু ব্যক্তি ও একটা এন জিওর চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত মিতালির শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ওর বডি পোড়াতে পারেনি l থানা বাধ্য হয়েছে পোস্টমর্টেমে পাঠাতে l


রাকা ফেসবুক পোস্টে মিতালির সহপাঠী ও যাদবপুরের প্রাক্তনীদের উদ্দেশ্যে আবেদন রেখেছিল, তারা যেন এই ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করে l  সই সংগ্রহ করে প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করে l মিতালির পরিবার যেন জাস্টিস পায় l সরকার যেন তার দিনমজুর অসুস্থ বাবাকে আর্থিক সাহায্য দেয় l রাকার সেই পোস্ট কাজ দিয়েছিল l অনেক বুদ্ধিজীবী আর সরকারী আমলাদের নজরে এসেছিল l ফল লালবাজার থেকে লোকাল থানায় নির্দেশ গিয়েছিল l তারা তড়িঘড়ি সুদীপ, তার বাবা-মা ও এক অবিবাহিত বোনকে  মিতালিকে হত্যার অপরাধে জামিন অযোগ্য ধারায় অ্যারেস্ট করে l


                 ★ ★         ★


এখন আমরা রাকার নেতৃত্বে  সুন্দরবনে মিতালিদের বাড়ি যাচ্ছি l যাদবপুর স্টেশন থেকে সকাল ৮-২২ এর নামখানা লোকালে উঠেছি l নামতে হবে জয়নগর-মজিলপুর স্টেশনে l সেখান থেকে অটো বা ট্রেকারে জামতলা হাট l ওখানেই মিতালিদের বাড়ি l কিন্তু আমাদের যেতে হবে জামতলা হাট ছাড়িয়ে কুলতলী থানায় l কেননা, সেখানেই মিতালির বডি আছে l থানার  সাব-ইনস্পেক্টর মহঃ বশিরের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাকা বলে দিয়েছে তারা গিয়ে মিতালির বডি নিয়ে ওর বাড়িতে যাবে l কেসটা নিয়ে এত জলঘোলা হচ্ছে দেখে মিঃ বশির আর হেলদোল করে নি l

রাকাও চেয়েছিল  সংবাদপত্রের লোক, চ্যানেলের রিপোর্টার, মিতালির এক সময়ের সহপাঠীদের নিয়ে গিয়ে থানার উপর চাপ সৃষ্টি করতে l যাতে দোষীরা কোন মতে ছাড় না পায় l আর মিতালির মৃতদেহের সম্মানজনক দাহ হয় l

বেঁচে থাকতে যে মেয়েটির সামান্য একটা ইচ্ছাকে তারা মর্যাদা দিতে পারেনি, এখন মৃত্যুর পর যদি একটু শান্তি ও সম্মান দেওয়া যায় l


সাদা কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা থানার শানবাঁধানো মেঝেতে শুয়ে ছিল মিতালি l  কত স্বপ্ন ছিল মেয়েটির l

চাকরি করবে, বাবার চিকিৎসা, ভাইবোনদের মানুষ করা l সে সাধ তার পূর্ণ হল না l পূর্ণ হল না সংসার সাধ, ভালোবাসায় প্রতারিত হল l বাঁচাতে পারল না পেটের শিশুটাকে, নিজেও বাঁচল না l রাকা আস্তে আস্তে মৃত মিতালির মুখের কাপড় সরাল l কশ বেয়ে এখনো শুকনো রক্তের দাগ l চোখ বন্ধ l মনে হল এক্ষুনি যেন ও উঠে বসবে আর বলবে, তোরা এলি তাহলে শেষ পর্যন্ত আমার সোঁদরবনের বাড়িতে l

                                     




No comments:

Post a Comment