Monday, December 31

গল্প : অনুভব ব্যানার্জী








আনন্দধারা

পাড়ার মোড়ে আবছা কুয়াশায় অপার্থিব মনে হচ্ছে পাশের ঘা ঘেঁষে বেরিয়ে যাওয়া গলির মুখটাকেও।অল্প দূরে হাতের চেটোয় মুখ রেখে বসে আছে ত্যাজ্য মাকড়সার জালের মত একলা মফস্বলের রেলস্টেশন।
সব দৃশ্যেরই একটা গল্প থাকেই। জৌলুস বিহীন সেকেলে ছাদ,ভাঙা পুকুর ঘাট, খড়খড়ি দেওয়া জানলা কিংবা মেট্রোপলিটন শহরের স্বপ্নিল এপার্টমেন্ট এর রোদ ঝাঁঝা ফাঁকা টেরেস সবাইই আপন ধর্মে কিছু বলতে চায়।
জনস্রোতের কোলাহল,প্রাণের উষ্ণতা যেমন নাগরিক জীবনকে চেনায় তেমনই নিসর্গতা তার অদ্ভুত ক্ষমতাবলে নিজের কাছে নিজেকে প্রকাশ করিয়ে দেয়।
বটগাছের ছায়া,গভীর জলের মায়া ছাড়াও তো নিসর্গতা আসে!
মফস্বলের ইট-কাঠ,খোলা অঙ্ক খাতার একাগ্র অন্যমনষ্কতায় নিসর্গতা আঙুল বুলিয়ে যায়।
এসব কথায় আবার উদাস হয়ে এল শোভনার মনটা।দূরে কাদের বাড়িতে যেন সিরিয়াল হচ্ছে।আলগা,অপলকা শব্দ ভেসে আসছে একটা-দুটো।
বারবার মনে পড়ছে পৌলস্তর হাতে আঁকা শোভনার সেই ছবিটা,মনে পড়ছে পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া আর পৌলস্তর গাওয়া শেষ গান "এই একলাঘর আমার দেশ,আমার একলা থাকার অভ্যেস...।"
শোভনা তো কখনো তেমন চোখে দ্যাখেনি পৌলস্ত কে।
তাহলে আজ কেন এসব মনে পড়ছে? তবে কি একটা মানুষের নিশব্দ ভালোবাসা,অবেদন এই ভাবে বদলে দিতে পারে আর একটা মানুষ কে!
পাশের বাড়িতে লোকটা আবার সেইরকম সরোদ বাজাচ্ছে।
সেই সুরে ভয়ানক আর্তীর চেয়ে ভয়ানক এক বিষাদ,নাকি সেটা শোভনারই মনের ধারণা!
ভীষণ যন্ত্রনা হচ্ছে মনের গভীরেও,অস্থির লাগছে।ইচ্ছে করছে তছনছ করে দিতে এই ঘর,এই বাড়ি,এমনকি সমগ্র পৃথিবী টাকে।
এরকম ভাবেই সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো রাতের দিকে।
মাঝে একবার তার বাবা এসেছিলেন তাকে খাবার জন্য নিচে ডাকতে কিন্তু মেয়ে ঘুমে বিভোর দেখে আর না ডেকে ফিরে গেলেন নিচে।
একদম ভোর রাতের দিকে শোভনার মনে হল বুকের ওপর একটা অসহ্য ভার,
মুখটা তীব্র ভাবে তেঁতো লাগছে।ঘরে একটা গুমোট ভাব অথচ জানালা তো খোলাই আছে!
হঠাৎ মনে হল খারাপ লাগা,একটা নিঃস্বার্থ মানুষ কে এভাবে ফিরিয়ে দেবার অপরাধ বোধ এবং এই সবের উপরে একটা তীব্র মনোকষ্ট যেন ছায়ার আকৃতি নিয়ে গ্রাস করতে আসছে শোভনা কে।রাত্রি যেন চলে যাবার আগে তার আত্মাকেও সাথে নিয়ে যেতে চায়।
কিন্তু এটা কি হচ্ছে?
কেনই বা হচ্ছে!
হঠাৎ শোভনার মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় হ্যারি পটার সিনেমায় দ্যাখা  Dementors দের কথা।মানসিক দুঃখ,কষ্ট,হতাশা কে আশ্রয় করে যারা বেঁচে থাকে,যাদের চুম্বনে মানুষ মৃত্যুর থেকেও খারাপ দশায় পর্যবসিত হয়।
শরীরটা হয়ত থাকে কিন্তু শুধু মাত্র শরীরটাই থাকে।শোভনার শেষ মূহুর্তে একবার বাবা-মায়ের মুখগুলো মনে পড়ল।
ঠিক এই মুহুর্তে পরপর দুটো ঘটনায় যেন ম্যাজিক শুরু হল ঘরের ভেতর।
গতকাল রাত্রের পাশের বাড়ির সেই ভদ্রলোক বলিষ্ঠ কন্ঠে গেয়ে উঠলেন, "আনন্দধারা বহিছে ভুবনে।
দিন-রজনী কত অমৃতরস উথলি যায়
আনন্দ গগনে।"
মালকোষের সুর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই ঘরের পরিবেশটা একটু হালকা হল।
আর শোভনা তার ফিরে পাওয়া সামান্য মানসিক শক্তির সবটুকু জড়ো করে একছুটে ছাদে বেরিয়ে এসে দম নিলো।
ছোট ফোনটা থেকে পৌলস্ত কে মেসেজ করল"আজ সন্ধ্যেবেলা দেখা কর,কথা আছে।"
আজ এতদিন বাদে আবার পৌলস্ত কে এই কথাগুলো বলতে গিয়ে শোভনার মনে হল Dementors রাও বোধহয় মানুষের মনেই থাকে।তাইই কি বাস্তবে কি রুপকথায় এদের সম্পূর্ণ মৃত্যু হওয়া সম্ভব নয়।
অবসাদ রুপী এই Dementors দের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র সম্ভাব্য উপায় তাই
'গান ভালোবসে গান।'




No comments:

Post a Comment