Tuesday, January 1

গল্প : সুজয় চক্রবর্তী





একটি প্রেমের গল্প

ব্যাচেলার থাকার এই এক সমস্যা।  সহজে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় না । সবাই-ই 'ফ্যামিলি' চায়!

আমার এখনও 'ফ্যামিলি' হয়নি । লাইনে আছি । কিন্তু সেই সময়টুকু দিলে তো ! যেখানেই ঘরের জন্য যাই, সেই এক কথা, 'ফ্যামিলি আছে তো? ', 'ও, আপনি ব্যাচেলর ! না  ভাই, অন্য কোথাও দেখুন।' একজন তো একবার বলেই দিলেন, ' ঘর তো ফাঁকা। বলেন তো, হাতে একটা মেয়ে আছে, দেখাতে পারি।' মানে আমাকে বিয়ে দিয়ে তবেই তিনি তার ঘরে ঢোকাবেন ! বিটকেলে পাবলিক সব । কিছুতেই বোঝাতে পারি না, আমার এখন বউ চাই না, ঘর চাই। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সবে মাত্র চাকরিটা পেয়েছি । বাড়ি থেকে বেশ দূরে। একটু গুছিয়েগাছিয়ে না নিয়ে এসবে নেই আমি ! সেকথা বাড়িতেও বলেছি । দুটো বছর সময় লাগবে আমার। কিন্তু বাড়ির লোকও সে কথা শুনলে তো!  বিশেষ করে মা। সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান। কোনওরকমে থামিয়ে রেখেছি। আর ঠিক করেছি, বছর দুই পরেও যদি বাসা ভাড়াই থাকি, তো ঐ লোকটাকে গিয়ে একদিন বলবো, ' এই দেখুন, ফ্যামিলি আছে । ঘর খালি আছে আপনার? '

যাইহোক, শেষে আমার মেজো মাসির দূর সম্পর্কের এক জামাইকে ধরেটরে অনেক খোঁজ-খবর করার পর জয়িতাদের এই বাড়িটাতে থিতু হয়েছি ।

আমি এ পাড়ায় নতুন । এক মাসও হয়নি। ধীরে ধীরে পরিচিত হচ্ছি আশপাশের লোকজনের সঙ্গে । অনেকের সঙ্গেই আলাপ এখনও বাকি । সামান্য যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাদের মধ্যে আছে সনাতনের বাবা, কীর্তনীয়া বিশু, সুমনের দিদিমা আর বিশালের মা ।
 অফিস যাওয়ার সময় একটা দৃশ্য আমি রোজ দেখি । জয়িতাদের বাড়ির পাশের ফাঁকা মাঠটাতে একটা বাচ্চা মেয়ে খেলছে। একা একাই । বয়স তিন কি চার হবে । কখনও কাদামাটি, কখনও ধুলোবালি নিয়ে ওর খেলা । কোনও ঝামেলা নেই। কান্নাকাটি নেই।

 একদিন অফিস যাওয়ার পথে ওর নামটাও জানতে পেরেছি । পামেলা। খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। খালি গা। সারা হাতপায়ে ধুলো। কিন্তু একগাল হাসি।
আমার নতুন চাকরি। বাড়ি থেকে  হাতে একটু সময় নিয়ে বেরোই । অনেকদিন অফিস থেকে ফেরার সময়েও ঐ একই ছবি দেখেছি । বাচ্চাটা একমনে খেলছে । কখনও পুতুলকে শাড়ি পড়াচ্ছে, কখনও হাড়িতে ভাত চাপিয়েছে ; এইরকম আর কি।

এরমধ্যেই পামেলা আমাকে বেশ চিনে ফেলেছে ৷ রাস্তায় দেখলেই জিজ্ঞাসা করে, ' কাকু, কুথায় যাচ্ছো? কখনও বাজারফেরত আমাকে দেখতে পেলে জানতে চায়, 'কী এনেছো ?' আবার কখনওসখনও আমিও ওর 'রান্না' করা খাবার মুখে দিয়ে বলি, 'বাঃ, হেব্বি হয়েছে !' ও খুব মজা পায়। কিন্তু প্রায়ই ও 'ডিমে'র ঝোল 'রান্না' করে। আর সেই গরম ডিমের ঝোল খেয়ে আমার যখন জিভে 'ছ্যাঁকা' লাগে, তখন যেন ওর হাসি আর ধরে না মুখে! মাঝেসাঝে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি  পামেলার মা'কে । কখনওসখনও চোখাচোখি হয়। ঐ পর্যন্তই।  কথা হয়নি কোনও দিনও। তবে আমি যে জয়িতাদের ভাড়াটে, সেটা জানে।

আজ যাওয়ার সময় দেখলাম পামেলা কাঁদছে! রান্নাবাটি খেলছিল। বোঝা গেল ওকে কেউ বকেছে । খুব খারাপ লাগলো । থেমে গেলাম ।
মুখ নামিয়ে বললাম , ‘ কি হয়েছে তোর, কাঁদছিস কেন ?’
---- মা মেরেছে।
---- নিশ্চয় তুই দুষ্টুমি করেছিস?
---- না, আমি কিছু করিনি...
---- তাহলে মা তোকে এমনি এমনি মারলো !
----- হ্যাঁ ।
---- আচ্ছা, দাঁড়া, তোর মা'কে আমি বকে দিচ্ছি।
কথাটা বলে নিচু হয়ে ওর চোখদুটো হাতের চেটো দিয়ে মুছে দিলাম।

খেয়াল করিনি । চোখ সরাতেই দেখলাম সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে পামেলার মা ! শিউলি।  সেদিন জেনেছি ওর নামটা।  জয়িতা কোন একটা ব্যাপারে 'শিউলি বৌদি' বলে কথা বলছিল।

তা, 'বৌদি' যখন, দাদা নিশ্চয় আছে। এর আগে এত কাছ থেকে ওকে কখনও দেখিনি। যেটুকু নজরে পড়লো, তাতে হাতে চুড়ি, মাথায় সিঁদুর কিছুই দেখলাম না। অবাক হইনি। এখন অনেকেই এসব পরে না। এরজন্য যুক্তিও আছে তাদের। আমার মাসতুতো বোনটা  এরকমই। ও প্রায়ই একটা কথা বলে,' কই, পুরুষরা তো বিয়ের পর কোনও চিহ্নই বয়ে বেরায় না, যার থেকে বোঝা যায় পুরুষটি বিবাহিত! তাহলে মেয়েরা কেন বয়ে বেড়াবে!' তাতো ঠিকই । একেবারেই বাস্তব । আমার ভালো লাগে ওর কথা। আমি সায় দিই।
শিউলির দিকে তাকাতে দেখলাম লজ্জামাখা একটা মুখ ৷ কিন্তু বেশ মোহময়ী। নিশ্চিত, পামেলার সঙ্গে আমার কথাবার্তা ও শুনেছে! ততক্ষণে আমিও কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছি । বকা তো দূর অস্ত। শিউলিকে দেখে মুখ দিয়ে কোনও কথাই আমার বেরোলো না!  আর বেরোবেই বা কি করে? তাকে বকার অধিকারই বা আমাকে কে দিয়েছে ? মাথা নিচু করেই ছিলাম। ঘড়িতে চোখটা পড়তেই পা চালালাম। শুধু আমার চাকরিটাই নতুন নয়, অফিসে বসও নতুন!
এরপর শিউলিকে দূর থেকে দেখলেই আমি মাথা নিচু করে ফেলতাম। লজ্জায়। লজ্জা পাবারই কথা। যার সঙ্গে তেমন কোনও পরিচয় নেই, সেই তাকেই কি না বকাঝকা! বুঝতে পারলাম সেদিন কথাটা বলে ঠিক করিনি। কথাটা যে জাস্ট বলার জন্যই বলা, তা শিউলিও জানে। তবু লজ্জাটা আমার একটু বেশিই। তাই মাথা হেঁট হয়ে যেত ওকে দেখলে। শেষ পর্যন্ত অফিস যাওয়া আসার রাস্তাটাই পালটে ফেললাম! এখন পামেলা বা শিউলি কারও সঙ্গেই আর দেখাটেখা হয় না।

পাড়ায় যাদের সঙ্গে দেখা হলে খুব সহজেই পাশ কাটাতে পারি না, তাদের মধ্যের একজন হল কীর্তনীয়া বিশু। ওর কথা বলার ধরন যে কাউকেই মুগ্ধ করে। রাস্তায় দেখা হলে কুশল সংবাদ ও  জিজ্ঞেস করবেই,  এই সৌজন্যবোধটা ওর আছে । কীর্তনীয়া বিশু এ পাড়ায় অনেক দিন আছে । দূর সম্পর্কের এক মামার বাড়িতে থাকে, খায়। এছাড়া নিজের আর কেউ নেই। রোজগার বলতে অন্য তল্লাটে গিয়ে  কীর্তন শুনিয়ে যা পায়। খুচরো পয়সা, চাল-ডাল। বিয়ে-থা হয়নি। আর জীবনে করবে বলেও মনে হয় না৷  পাড়ার প্রায় সব খবরই রাখে ও। দীপকের বউয়ের কবে বাচ্চা হবে, নন্দিতার বৌদি কেন বাপের বাড়ি চলে গেছে, টুম্পার বাবা কেন ওর দাদাকে মেরেছে, এমন হাজারটা ঘটনার কথা জানে ও ।

আজ শনিবার। অফিস ছুটি। খোকনের পান বিড়ির গুমটির সামনে বিশুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছিল । তাই হয়তো আজ আর বেরোয়নি । কথায় কথায় পামেলাদের কথা উঠলো। মানে, আমিই উঠালাম আর কি। জানতে পারলাম বিয়ের বছর খানেকের মাথায় না কি বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হল তরিতের। তড়িৎ মানে পামেলার বাবার। পামেলা তখন পেটে। ব্রেন ইনজুরি।  সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চললো ছ'মাস। প্রথম দিকে কিছুটা ভালোর দিকে ছিল তড়িৎ। শেষে ভুল চিকিৎসায় মারা গেল ! এরজন্য ডাক্তার ,নার্স দায়ী না । দায়ী নাকি শিউলিই ! 'অলক্ষ্মী' আসার পর থেকেই এক এক করে অনেকগুলো অঘটন ঘটেছে তাদের সংসারে। তাই শাশুড়ি মা যে আর কোনও অঘটন ঘটাতে চান না, সে কথা ঠারেঠোরে বুঝিয়েও দিয়েছেন। তবু মুখ বুঁজে ছিল শিউলি। কিন্তু যেদিন পামেলা হল, সেদিন হাসপাতাল থেকেই সে যাতে বাপের বাড়ি চলে যেতে পারে, তার সব বন্দোবস্ত পাকা করে রেখেছিলেন শাশুড়ি মা। সেই থেকে শিউলি আছে বাপের বাড়ি। আসলে গীতা দে'র মতো শাশুড়ি যার কপালে, তার সংসার জীবনে তো অনেক কষ্টই ভোগ করতে হবে! শিউলি ঝড়ে পড়লো অকালে ; মা-বাবার সংসারে। এখন সে বাধ্য হয়ে বিড়ির কুলো হাতে নিয়ে বসেছে।

শিউলির সম্পর্কে যেটুকু বললো বিশু, তাতে যেকোনও সংবেদনশীল মানুষেরই খারাপ লাগতে বাধ্য। আমারও লেগেছিল। আরও বিশেষ করে খারাপ লাগলো ওর সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বসে ছিলাম। একজন স্বামীহারা মহিলা কত কষ্ট সহ্য করে যে একটা বাচ্চাকে মানুষ করে তুলছে, তার প্রতি সহানুভূতি দেখানোর যে প্রয়োজন, সে বোধ আমার ছিল না। করুনা হয় নিজের ওপর।

আজ আবার বিশুর সঙ্গে দেখা বটতলায়। একথাসেকথায় বিশু যা বললো, আমি তো শুনে থ'। শিউলি নাকি আমাকে আর দেখা যায় না কেন, তা জিজ্ঞেস করেছে তার 'বিশুদা'কে । বিশুকে সে এও  বলেছে, তাকে না কি অনেক দিন কেউ বকেনি ! শুধু সান্ত্বনা দিয়ে গেছে সবাই। সে এখন চায়, তাকেও কেউ বকুক।

আজ বছর দশ পরেও বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, শিউলিকে এতটুকু বকিনি আমি!


              -----------------------

17 comments:

  1. খুব ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ দাদা।

    ReplyDelete
  3. ধন্যবাদ দাদা।

    ReplyDelete
  4. ধন্যবাদ দাদা।

    ReplyDelete
  5. ধন্যবাদ গল্পটা খুব সুন্দর।

    ReplyDelete
  6. আহা রে! বাহ! আপনি বেশ ভালো গল্প লেখেন তো দাদা। আপনি লিখুন। আপনার আর একটি পাঠক হল। শুভেচ্ছা।

    ReplyDelete