Tuesday, January 1

গল্প : অন্বেষা চক্রবর্তী







দাঙ্গা


হিন্দু মুসলমান মিলিয়ে ১০০ লোকের বাস এ গ্রামে। স্বাধীনতার প্রাগমুহুর্তে উত্তাল চারিদিক।

ফজরের নামাজ শেষে বাড়ির দাওয়াই মুড়ি নিয়ে বসে সামসুল। গ্রামের রফিক খাঁর ছেলে সে। সেই যেবার সামসুল ১০ ক্লাসের পরীক্ষা দেবে, সেবারই এক দুর্ঘটনায় এক পা হারায় রফিক। আর পড়াশোনা হয়নি রফিকের, বাপের জমি এখন সেই দেখাশোনা করে।

দাওয়াই খেতে খেতে সামসুল হাঁক ছাড়ে আম্মিকে খাবার বেঁধে দেওয়ার জন্য।

" আইস্যি রে বাপ, ঠাহর দেহি"।
একখান গামছা তে বাটি করে ভাত তরকারি বেঁধে আনে আম্মি," সাবধানে যাস্ বাপ, বাইরের অবস্থা কিছু ভালো বুঝি না"।


"তুই শুধু শুধু চিন্তা করস্ আম্মি"-।
খাবারটা আর ঠোঙায় কিছু ফুল নিয়ে বেড়িয়ে পরে সামসুল। তাড়াতাড়ি পা চালায় সে।

তারজন্য অপেক্ষা করে আছে লক্ষী। ফুলটা নাটমন্দিরে দিয়ে সে যাবে লক্ষীর কাছে।

 রমেন মুদীর মেয়ে লক্ষী। এক কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিন জন্মেছিল বলে বাপে নাম রেখেছিলে লক্ষী।জন্মের সময় মা মারা যাওয়ায় বড়ই বাপসোহাগী সে।

ধানের ফলন ভালো হওয়ায় হাতে কিছু টাকার আশা করা যায়। লক্ষী কে এবার একটা দেশি তাঁতে বোনা শাড়ি কিনে দেওয়ার খুব ইচ্ছে সামসুলের। এই মন্দার বাজারে হাটের দুপয়সার কাঁচের চুড়ি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি সে।

মন্দিরের সামনে এসে ফুলটা রাখতেই দেখতে পায় দূরে কদম  গাছের নিচে লাল ডুরে পাড়ের শাড়ি জড়িয়ে তারি অপেক্ষায় লক্ষী। খুব সুন্দরী না হলেও বড্ড মায়া জড়ানো মুখ  মেয়েটার। অভিমানের সুরে বলল " সেই কহন বাপ থেইক্কা তোমার লগে ঠাঁই দাঁড়াই আইস্যি মানা করস্যে বেড়াইতে, তাও চুপিচুপি আইসি"।

'ভয় কি? আমি খাকইত্যে তোর কোন বিপদ নায়" ----সামসুল সাহস যোগায়। মুচকি হেসে মাথা নামায় লক্ষী, আর এই হাসি টুকুই সারাদিনের কাজের রসদ যোগায় সামসুলকে।

পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে। খবর ছড়িয়ে পরে মুসলমানদের জন্যই শুধু আলাদা দেশ হবে, তাতে কোনও হিন্দুর জায়গা হবে না। যে নাট মন্দিরে পূজার সময় হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ভোগ খেত, তা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। যে চাচাদের বাড়িতে সিমাই হলেই ডাক পড়ত মালতি , চিত্রাদের, সেই চাচাদের রক্তচক্ষু আজ বড় অচেনা লাগে। হিন্দুর জোয়ান ছেলেদের প্রায়ই লাশ পাওয়া যায় বড় রাস্তায়। ঘাত প্রতিঘাতে প্রাণ যায় নিরীহ মানুষের। আর এতকিছুর পরও যারা জোর করে থেকে গেছে, তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, শুরু হয় অকথ্য অত্যাচার।

আগুন লাগে লক্ষীদের বাড়িতেও। বাপ সেই যে শহরে গেল মাল আনতে আর ফেরেনি। রাতের অন্ধকারে সামসুলের হাত ধরে পালায় লক্ষী। অনেক দিন নানা বনে জমির ক্ষেতে লুকিয়ে বেড়িয়েছে ওরা। কাল ভোর ভোর সামসুল ওকে পৌঁছে দেবে রিফিউজি ক্যাম্পে।

এক গাছের তলায় বসে দুজন, জলের ধারা শুকিয়ে দাগ পরে গেছে শুকনো মুখে। খাবার ও তেমন পায়নি। " কথা দিইছিলাম্ পরাণ থাকতে তোর ক্ষতি হবে না"-- সামসুল বলে।

" তবে কি আর আমাগো দেইখ্যা হবে না?"- অসহায় লক্ষ্মী জানতে চায়। "

' হবে রে, এই অশান্তি একটু কইম্যা গ্যালেই আবার সব ঠিক হইয়া যাইবো"- আশ্বাস দেয় সামসুল।


ভোর ভোর লক্ষী কে রিফিউজি ক্যাম্পে রেখে ফেরার পথে রওনা দেয় সামসুল। লক্ষী দূর থেকে শুধু  দেখেছিল ওর চলে যাওয়া।



আজ আরেক লক্ষী পুজো। আকাশের চাঁদ সেরকমই বড়। লক্ষী জায়গা পেয়েছে কলকাতা শহরে এক ঘুপচি রিফিউজি ক্যাম্পে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন থেকে এ নাকি তার দেশ।

তবে সেটা কী ছিল? তার বড় হয়ে ওঠার জায়গা, তার কদম গাছ, কাজলী নদী, তার সামসুল.......


বাপ বলেছিল এই পূর্ণিমায় তার জন্ম, আজো লক্ষী অপেক্ষা করে সামসুলের , সে আসবে তাকে নিয়ে যাবে। তার সামসুল কখনো কথার খেলাপ করে না। সে আসবে।





8 comments: