Wednesday, January 2

গল্প : গৌতম দে




পরী

আমার নাম ধীমান চ্যাটার্জি। লিপি দুলের প্রেমিক।
আমি লিপি দুলে। ধীমান চ্যাটার্জির প্রেমিকা।
অনেকটা বাঁধা আর শক্তি যেন দুটো ডাম্বেল হয়ে প্রতিনিয়ত আঘাত করছে আমাদের। আজ দুহাজার আঠেরোর পনেরো আগস্ট। একটা সিদ্ধান্তে এসেছি। আমরা দুজনে। এই সিদ্ধান্তটা আমাদের একেবারে নিজস্ব। দুজনের সম্মতিক্রমে...।



এসো, কাছে এসো। একদম ঘন হয়ে কাছে বসো। আমার এই কথায় লিপি খুব খুশি হয়। সে অনেকটা আবেগ নিয়ে আমার খুব কাছে সরে আসে। একেবারে কোলের কাছে। আমাকে ভীষণ বিশ্বাস করে লিপি। ভালোবাসে। খুব খুব ভালোবাসে।

লিপির সঙ্গে প্রেম করছি বছর পাঁচেক। এখনও চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের যেন কথার শেষ নেই। কোনও বিরাম নেই। এ পাড়ার প্রতিটা মানুষ, প্রতিটা গাছ, প্রতিটা পাখি জানে আমাদের প্রেমকাহিনী। কিন্তু আমাদের বাড়ির মানুষজন আমাদের প্রেম মেনে নিতে পারেনি। মেনে নিতে পারেনি বলে পাড়ার অনেকেই 'লায়লা-মজনু' নামে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে। তাতে আমাদের কিসসু যায় আসে না। 

আমি যেমন লিপিকে ভাবোবাসি সেও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। 'আমাকে ছাড়া সে একদন্ড কাউকে ভাবতে পারে না।'  সে বুক চিতিয়ে বলেও এই কথা।

আমি মাঝেমধ্যে ওর এই কথায় হেসে উঠি। বলে কি অষ্টাদশী মেয়েটি!

আমি যত  হাসি ও তত রেগে যায়। ভীষণ রেগে যায়। তারপর চিৎকার করে বলে, আমি, কি এমন হাসির কথা বললাম। বলো? 
আমি এর কোনও উত্তর দিই না। কেবল হাসতেই থাকি। হো হো হি হি। হাসতে হাসতে আমার শরীরটা ছড়িয়ে পড়ে চাদ্দিকে। মাথাটা ফুটবলের মতো গড়াতে গড়াতে চলে যায় রেল লাইন বরাবর। দুটো হাত টপাটপ এ গাছের কিংবা ও গাছের ডাল ধরে ঝুলতে থাকে। দুপায়ে ভয়ংকর গতি নিয়ে একছুটে চলে যাই অজানা জায়গায়। অনেকটা স্বপ্নের জগতে। সেখানে লিপিকে পরীর মতো দেখতে পাই। সাদা পোশাকের সুন্দর পরিপাটি সাজ। পরীর পিঠে সুন্দর দুটো ডানা। সেই সুন্দর ডানা নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে এখানে সেখানে। গাছে গাছে রং বেরঙের ফুল ফল। কত নাম না জানা নানা রঙের পাখি। পরীকে চেনে। তার সঙ্গে খেলা করে। আকাশের রং ঘন নীলে ডোবা। গর্বিত মেঘগুলো নিজেদের শরীর ভাঙতে ভাঙতে দিকশূন্যপুরে এগিয়ে যাচ্ছে। লিপিও সেই মেঘেদের সঙ্গে খেলতে খেলতে আমার দৃষ্টির বাইরে হারিয়ে যাচ্ছে। সেই হারিয়ে যাওয়াতে যেন ক্লান্তি নেই। কেবল আনন্দ আর আনন্দ। 
আমি আঁতকে উঠি। আমি 'লিপি লিপি' করে চেঁচিয়ে ডাকি। এটা ঠিক, লিপি দু'হাত বাড়িয়ে সাড়া দেয়। সেও ডাকে। বলে, এসো আমাকে ধরো তো দেখি। লিপি খিলখিল করে হাসতে হাসতে অনায়াসে এই কথাগুলো বলে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। লিপির পিছন পিছন বেপরোয়া ভাবে  ছুটতে থাকি। লিপি নামক পরীর নাগাল পাই না তবুও। 
আবার ফিরেও আসি। এইসব লিপি বুঝতে পারে না। কেবল আমার শরীরটা ওর কোলের কাছে প্রাণহীন একখন্ড পাথরের মতো পড়ে থাকে।

আসলে ওর রাগটা আমার ভীষণ ভালো লাগে। রাগলে পরে ওর ঠোঁটজোড়া থরথর করে কাঁপে। তখন আমার মনে হয়, ওর পাকা করমচার মতো ঠোঁটজোড়া এখুনি বুঝি মুখ থেকে খসে পড়বে মাটিতে! এই ঠোঁট দিয়ে সে অনেকবার আমাকে চুমু খেয়েছে। আদর করেছে। ওর ঠোটজোড়ায় অনেক রস আছে। মিষ্টি রস। ঠিক মিষ্টি রস নয়। অনেকটা ঝাঁঝাল। নেশা ধরিয়ে দেওয়ার মতো। আমিও মাঝে মধ্যে ওর ঠোঁটে  ঠোঁট ডুবিয়ে ওর জিবের অনেকটা নাগাল পেয়ে যেতাম। তাতে ও খুব খুশি হত।

তো সেই পাকা করমচার মতো ঠোটজোড়া যদি  খসে পড়ে তখন এই লিপিকে দেখতে কেমন লাগবে? লিপির ঝকঝকে দাঁতের পাটিজোড়া ভয়ানক ভাবে বেরিয়ে আসবে। এই অনিন্দ সুন্দর মুখটা দেখতে খারাপ লাগবে তখন। তার চেয়ে বরং  দু'হাতের তালু নৌকোর কোল করে ওর ঠোঁটের তলায় মেলে ধরি আমি। যদি পড়ে যায়, আমার হাতেই পড়বে। এখনও কাঁপছে। ভয়ানক ভাবে কাঁপছে লিপির ঠোঁটজোড়া।

আমার হাসিটা আসতে আসতে পেটের ভিতর ঢুকে যায়। ঢুকতে ঢুকতে শরীরের অনেক নীচে নেমে যায়। তারপর  মাথাটা ওর ঘাড়ের কাছে নিয়ে যাই। ও দুহাতে জড়িয়ে ধরে আমায়। আমার ঠোঁটজোড়া ওর ঘাড় স্পর্শ করে। আমার দুই ঠোঁট ওকে খুব আদর করে। আদর করতে করতে ডান কানের লতিতে কামড় বসায়। আমি বুঝতে পারি, ওর ঠোঁটের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীর কাঁপছে। এবার আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। 

লিপি আমার হাতে তুলে দেয় ওর যত্নে রাখা স্তনজোড়া। আমি যেন জাগলারির মাস্টার হয়ে উঠি মুহূর্তে। দু'হাতে ওর দুই স্তন নিয়ে খেলতে থাকি। স্পষ্ট দেখতে পাই প্রতি মুহূর্তে ওর দুই স্তন জায়গা পরিবর্তন করছে আশ্চর্যজনক ভাবে। 

আগেও বলেছি। আবার বলছি, লিপি আমাকে বিশ্বাস করে। ভালোবাসে।

ভালোবাসতে বাসতে আমরা দুজন মাখনের মতো গলতে থাকি। গলতে  গলতে একেবারে গাছের শিকড়ে গিয়ে পৌঁছে যাই।

এই বৃদ্ধ বটগাছটা সব জানে। ওর কোলেই আমাদের বহু বছরের আশ্রয়। সব জানে আমাদের কথা। বড় বড় শিকড়ের ফাঁকে অনায়াসে ঢুকে যায় আমাদের শরীর। আমরা ক্ষণিকের শীতল আশ্রয় পেয়ে আপ্লুত হয়ে উঠি। তখন এই নির্জন জায়গাটা মনে হয়, আরও নির্জন। আশপাশে আমাদের মতো একটিও প্রাণী  নেই। আমাদের কান্ড কারখানা একমাত্র এই প্রবীণ বটগাছ জানে। আমাদের ছেলেমানুষী দেখে পাতায় পাতায় হাততালির শব্দ বেজে ওঠে। আমরা স্পষ্ট শুনতে পাই।
আমাদের গলতে থাকা শরীরের ভিতর থেকে একটা পাখি তীব্র চিৎকারে ডাকে। শেষবারের মতো এই ডাক বোধহয়। সেই ডাক আমাদের দুজনার শরীরে দুলতে থাকে। ঘন ঘন। পরস্পরের নিঃশ্বাসে ধূপের সুগন্ধি ভাসে। ভাসতে থাকে।  আমাদের শরীর গলতে গলতে গড়াতে গড়াতে রেল লাইনের বরাবর চলে যায়। আর কয়েক মিনিটের মধ্যে একটা এক্সপ্রেস ট্রেন যমদূতের মতো ছুটে আসবে। 

শেষবারের মতো আমরা দুজনায় দুজনকে দেখতে থাকি। দেখি লিপি সত্যি সত্যি একটু একটু করে পরী হয়ে যাচ্ছে। অথচ নীলে ডোবা চেনা আকাশটা আজ উধাও। সাদা মেঘের পরতে পরতে কি ভীষণ রক্তের দাগ। হঠাৎ তীব্র গতিতে ভয়ংকর হুইসেল বাজাতে বাজাতে ঝড়ের মতো ট্রেনটা ছুটে আসে আমাদের মধ্যে। দিশাহীন আমি লিপিকে দেখতে পাই না। লিপিও আমাকে দেখতে পায় না।

ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর আমরা দুজন দুজনকে নতুনভাবে দেখি। তারপর বাঁচার আনন্দে পাগলের মতো হেসে উঠি। 

No comments:

Post a Comment