Tuesday, January 1

গল্প : সায়ন্তনী বসু চৌধুরী

                     


এপার-ওপার    
                         
বিকেলের আলো নিবে এলে এ পাড়াটা কেমন যেন মৃত্যুপুরী হয়ে যায়। আস্ত আস্ত বাড়ীগুলো যেন গিলে খেতে আসে। ল্যাম্পপোস্টগুলোর নীচে কী প্রকাণ্ড এক একটা ছায়া পড়ে! মাঝে মাঝে মনে হয় বুঝি কোনো বিশালাকার দৈত্যের দেহাবয়ব। চিরটাকাল বড়ো রাস্তার ধারে উজ্জ্বল নিয়নের আলোর নীচে থেকে এসে  এই নির্জন এলাকায় বৈশালীর কিছুতেই মন বসে না। অথচ সে নিজেই একসময় ভিড় আর আলো থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলো। আগে ওরা যে পাড়ায় থাকতো সেখানে রাত বলে কিছু ছিলোনা। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী দুপুর বিকেল আর গোধূলিবেলা পেরিয়ে অন্ধকার নেমে এলেও গোটা দিন একইরকম কোলাহল। রাত দুটো আড়াইটের সময়েও গাড়ীর হর্নের তীব্র আওয়াজে ঘুম ভেঙে যেতো। কতো রাত যে ও পাখিকে কাঁধে ফেলে জেগে কাটিয়েছে তার কোনো সঠিক হিসেব নেই।

বৈশালীর মেয়ে পাখি এখন ক্লাস টু তে পড়ে। সক্কাল সক্কাল নেচার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের হলদে রঙের বাস এসে তাকে নিয়ে যায়। গাবলু গুবলু বাচ্চাটা দুইদিকে পনিটেইল বেঁধে টা টা করে। তারপর বাসে উঠে মেরুন রঙের ইউনিফর্মের ভিড়ে হারিয়ে যায়। নামকরা স্কুল। ভারী সিলেবাস আর ইঁদুর দৌড়ের চাপে একরত্তি বাচ্চাগুলোর চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবার জোগাড়। তাই বোধহয় ওদের কারও মুখে হাসি থাকে না। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে মেয়ে আর বরের জন্য টিফিন রাঁধে বৈশালী। লুচি, পরোটা, ম্যাকারনি, পাস্তা, ম্যাগি...। এক সময় সে নিজেও কর্পোরেট সেক্টরে ছিলো। অফিস যাবার তাড়া, বাস ধরার তাড়া, সমীরণের সঙ্গে লুকিয়ে প্রেম করার সময় বের করা ... সব মিলিয়ে জীবনটা তখন কী যে দারুণ গতিময় ছিলো, ভাবলেও বৈশালী অবাক হয়। আর এখন? রজত আর পাখি বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলে বৈশালী এক্কেবারে একা। গোটা বাড়ীটায় কী যে ভীষণ নিঃসঙ্গতা! প্রতিটা দেওয়াল, প্রতিটা কার্নিশ জুড়ে একাকীত্ব। দম আটকে আসে ওর।
সমীরণ খুব সাধারণ একটা চাকরী করতো। খুব সাধারণ। মাত্র বারো হাজার টাকা স্যালারি। দুহাজার সাতে সালে সদ্য স্নাতক বৈশালীর মনে হয়েছিলো ওটাই অনেক। মাত্র দুজনের সংসার। বারো হাজারে চলবে না? কতো আর খরচা হবে একটা মাস চালাতে? বিরাট বড়ো বাড়ী দামী গাড়ী এসব তো বৈশালী চায় না।

সমীরণ আর ওর একটা ছোট্ট সংসার হবে। আর ওদের একটি ফুটফুটে সন্তান হবে। এই তো বৈশালীর স্বপ্ন। পাখি নামটা সমীরণেরই দেওয়া। ওরা যখন ভবিষ্যতের দিনগুলো সাজাতো, তখনই ভেবে রেখেছিলো সমীরণ। মেয়ে হলে পাখি আর ছেলে হলে পলাশ। মুম্বইয়ের সবচেয়ে নামকরা হাসপাতালে মেয়েকে যখন প্রথমবার  ছুঁয়েছিলো বৈশালী সেদিন পাখি নামটা ছাড়া ওর মুখ থেকে আর কিচ্ছু বেরোয়নি। রজতেরও খুব পছন্দ হয়েছিলো নামটা। সমীরণকে সেদিন ঠিক কতোখানি মিস করেছে, বৈশালী বলতে পারবেনা।

ছয়তলার ওপরে ঝুলন্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে বৈশালী নিজের ঘরের দিকে ফিরে চায়। গত ছ বছরে রজত ওর কোনো ইচ্ছেতে বাধা দেয়নি। যেমন ফ্ল্যাট চেয়েছিলো বৈশালী, ঠিক তেমনটাই কিনেছে রজত। রজত নিজের ক্ষমতার অতিরিক্ত করেছে শুধুমাত্র বৈশালীকে খুশী করার জন্য। আগে ওরা হাইওয়ের ধারে একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতো। বৈশালী থাকতে চায়নি বলেই রজত শহর ছাড়িয়ে এতোটা ভেতরে ফ্ল্যাট কিনেছে। রজতের ভালো চাকরী। বেশ নামকরা কোম্পানির ইঞ্জিনিয়র ও। রজতরা বৈশালীর পিসতুতো দিদির শ্বশুরবাড়ীর তরফের আত্মীয়। পিসতুতো দিদির কল্যাণেই বৈশালীর সঙ্গে রজতের সম্বন্ধটা হয়েছিলো। তখন বৈশালী নিজে একটা চাকরী জুটিয়ে নিয়ে বাড়ীর সঙ্গে তুমুল লড়ছে। আসলে সমীরণের সঙ্গে বৈশালীর সম্পর্ক বাড়ীতে জানাজানি হতে তীব্র অশান্তি হয়েছিলো। বাবা, মা, দাদা কেউই রাজী হয়নি। সমীরণের রোজগারের অভাব মেটাতে বাড়ীর বিরুদ্ধে গিয়ে বৈশালী চাকরী করছিলো। সেসময় রজতের মতো একটা ভালো ছেলের সত্যিই বড্ড প্রয়োজন ছিলো। ভালো ছেলে মানে ভালো রোজগারের ছেলে। বাড়ীতে অকথ্য বকুনি খেয়ে বোকা বোকা মুখ করে প্রেমিকা বৈশালী সবাইকে বলেছিলো,
-বারো হাজারে দিব্যি সংসার চলে যাবে। আমি হিসেব করে দেখেছি। তাছাড়া আমার চাকরীটাও তো আছে।
দাদা চেঁচিয়ে উঠে প্রশ্ন করেছিলো,
-কতো পাস শুনি?

আসলে তখন প্রেমের ঘোরে বাস্তব বোধবুদ্ধি দিয়ে সবকিছু বিচার করার ক্ষমতা ছিলো না। আজ বৈশালী হাড়ে হাড়ে বোঝে সংসার চালাতে মাস গেলে পঞ্চাশ পঞ্চান্ন হাজারও কম পড়ে। মাঝে মাঝে একলা দুপুরগুলোতে সমীরণের কথা ওর খুব মনে পড়ে। রজতের ব্যস্ততায় বিরক্ত হয় বৈশালী। কিন্তু যখন ভাবে আজ যদি ও সমীরণের সঙ্গে হাওড়ার কোনো মধ্যবিত্ত পাড়ায় পড়ে থাকতো তাহলে হয়তো এমন মাখনের মতো নরম ত্বক এমন জেল্লাদার চেহারা থাকতো না, তখনই ওর ভেতরে একটা সাদা আর কালোর লড়াই শুরু হয়। সমীরণকে মনে রাখার মতো কোনো কারণ আছে কী না বৈশালী তা জানে না। তবুও সারাদিনের একাকীত্ব ওকে পুরনো কথাগুলো ভাবতে বাধ্য করে।

***
রবিবার করে পাখির আঁকার ক্লাস থাকে। মেয়েটা দারুণ ক্রিয়েটিভ। নিজের ঝোঁকেই গান, আঁকা, নাচ সবেতে ভর্তি হয়েছে। স্কুলের সব ফাংশনে তার পার্টিসিপেট করা চাই-ই-চাই। পাখিকে আঁকার স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে বৈশালী একা একা সময় কাটায়। বাড়ী আর রান্নাঘরের জন্য টুকটাক কেনাকাটা সেরে রাখে। অনেক সময় তিন চারদিনের আনাজের বাজারটাও হয়ে যায়। আজ ওর শরীর ভালো নেই। মডার্ন আর্ট অ্যান্ড ড্রয়িং ক্লাসের সোজাসুজি যে ছোট্ট কফিশপটা খুলেছে সেখানেই গুছিয়ে বসেছে বৈশালী। আজকাল রজতের সঙ্গে সময় কাটানো হয়ে ওঠে না আর। মেয়েটা যতো বড়ো হচ্ছে, ওদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে দূরত্বও যেনো বাড়ছে। তাছাড়া প্রায় সময়েই রবিবারও রজতের অফিস খোলা থাকে। বৈশালী আজকাল একাকীত্বে ভোগে। বছর চারেক আগেও সংসার থেকে লম্বা ছুটি নিয়ে ও বর্ধমানের বাড়ী চলে যেতো। তখন বাবা বেঁচে ছিলেন। বাড়ীটা আনন্দে জমজমাট থাকতো সারাদিন। কিন্তু এখন সে বাড়ীও শ্মশান। বাবা নেই, মায়ের একবার মেজর অ্যাটাক হয়ে গেছে। দাদা বৌদি আমেরিকা থেকে আসতে চায়না। বৈশালী একজন আয়া রেখে দিয়েছে মায়ের জন্য। দুঃখের অতলে ডুবে থাকতে আর ভালো লাগে না ওর। তাই এই পালিয়ে বাঁচা।

কফিশপের সামনে একটা ঝাঁ চকচকে চারচাকা এসে দাঁড়ালো। সাদা রঙের ব্লেজার পরা একজন মাঝবয়সী লোক আর সঙ্গে দুজন কমবয়সী ছেলে এসে চারটে চেয়ারওয়ালা একটা টেবিল নিলেন। বিকেল বেলার ব্যস্ত রাস্তা আর মানুষ দেখা ছাড়া বৈশালীর আজ কোনো কাজ নেই। হঠাৎ চেনা গানের দুটো লাইন বেজে উঠলো সামনে বসা ভদ্রলোকের মোবাইল ফোনে। এ গান বৈশালীর বহুবার শোনা। একটা সময় প্রতিটা শীতের দুপুর তার কাঁধে মাথা রেখে বৈশালী বারবার শুনত এই গান। গত দশ বছরে সমীরণকে ভুলতে চেয়েও আরও বেশী করে মনে করেছে বৈশালী। কিন্তু সমীরণ কি তাকে একবারও খুঁজেছে? একবারও কি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে বৈশালীর সঙ্গে?
-হ্যালো, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি মিটিং সেরে এইমাত্র একটু কফি খেতে এলাম। ফ্লাইটের ঢের দেরী আছে, চিন্তা কোরোনা। আমি মিস করবোনা।

বহুদূর থেকে চির পরিচিতের কণ্ঠস্বর শুনলে মানুষ যেমন নানা অনুভূতিতে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়, আজ প্রায় একযুগ পরে সমীরণের গলা শুনে বৈশালীও তেমনি অবাক হয়েছে। কিন্তু এ কী? এতো পরিবর্তন? সেই সদা হাস্যময় ছিপছিপে তরুণ আজ এমন গম্ভীর একটা মানুষ সেজে বৈশালীর এক্কেবারে কাছাকাছি এসে হাজির হলো? বছর দশেক আগে একটা অধ্যায় শেষ হয়ে যাবার সেই অন্ধকার দিনগুলো বৈশালীর মন থেকে একেবারে উবে গেলো যেনো। নিজেকে আটকাতে না পেরে পায়ে পায়ে বৈশালী টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো। সম্পর্ক নেই বলে একবার ডেকে কথা বলতেও কি নেই?
-সমীরণ তুমি?

কথাটা বলেই নিজেকে অতি সন্তর্পণে সামলে নিলো বৈশালী। আপনি কি মিস্টার সমীরণ মুখার্জী?
খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে ভদ্রলোক প্রথমে বৈশালীর মুখের দিকে তাকালেন। তারপর প্রায় মিনিট তিনেক ভেবে নিস্পৃহ গলায় উত্তর দিলেন,
-হ্যাঁ, আমিই সমীরণ মুখার্জী। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।

বৈশালীর নরম দুই গালে কেউ যেন কড়া হাতে দুটো চড় মারলো। চিনচিন করে উঠলো মনের মধ্যেটা। মুহূর্তের জন্য মনে হলো সমীরণ বদলা নিচ্ছে। একদিন আর্থিক অবস্থার দোহাই দিয়ে বৈশালীর বাবা দাদা ওকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো। আজ হয়তো বৈশালীকে অপমান করে সমীরণ সেই আগুনেই জল ঢালতে চাইছে। কিন্তু পরক্ষণেই একবুক অভিমান ওর গলা টিপে ধরলো। জীবনের সাড়ে চার বছর যে ছেলেটার সুখ দুঃখ আপন করে ও দিন কাটিয়েছে আজ তার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যান পেয়ে বৈশালীর নিজেকে বড়ো তুচ্ছ মনে হচ্ছে।

***
ড্রয়িং খাতা খুলে নানারকম আঁকিবুঁকি দেখিয়ে আপন মনে বকে চলেছে পাখি। মেয়ের কথার দিকে বৈশালীর মন নেই। সে শুধু রজতের কথা ভাবছে। সমীরণ নামক অতীতকে মনের কোণে লালন করে নিজের জীবন সঙ্গীর প্রতি ও তো সুবিচার করেনি। আজ বৈশালী সব গ্লানি মুক্ত হয়ে বাড়ীর পথে এগোচ্ছে। কারণ আজ সে জানে আমৃত্যু পাখি আর রজতকে আঁকড়ে তাকে এপারেই বাস করতে হবে। জীবন নদীর ওপারে আজ আর তার কেউ নেই। 

1 comment:

  1. তরতর করে এগিয়ে গেল। প্রেম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়ে যায়। তবুও প্রেম থাকলে সেখানে অপমান করার ভাবনা সচরাচর আসে না। কিন্তু বাস্তব বলে, আসে। আর এখানেই এ গল্পের জিত। চমৎকার লাগলো ।

    ReplyDelete