Monday, December 31

মুক্তগদ্য : তনুশ্রী পাল


রাত কথা                                                     

              রাত,রাত্তির,রাত্রিবেলা!জীবনের সুনির্দিষ্ট আয়ুষ্কালের অনেকটাই তার দখলে বটে। রাত্রির সঙ্গে ঘুমের আর ঘুমের সঙ্গে স্বপ্নের ঘনিষ্ট সম্পর্ক এ আর নতুন কথা কি।তবে নির্ঘুম রাত, আর সে রাতের গায়ে হেলান দিয়ে স্বপ্নদর্শনও কিছু কম হল না!তবে প্রাণীমধ্যে মনুষ্যকুলের ইহা জন্মসিদ্ধ অধিকার নয় মোটে, অন্যতর প্রানীর আধবোজা চোখে নিশ্চিন্তির জাবরকাটার নয়নাভিরাম দৃশ্য দর্শনে মনে হয়,এ জগতে মনুষ্য ছাড়া অপর প্রানীও দিবাস্বপ্ন দেখে থাকে!
                       স্বপ্ন কথায়... রাতকথা... তায় মনে আসে হাজার কথা ।এই যেমন একদম গুঁড়ি বাচ্চা মানে মাতৃগর্ভের নিশ্চিন্তির ওম থেকে সদ্য বহিষ্কৃত হয়েছে যেটি;দিবারাত্র খালি ঘুমায় সেটিও ওই ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই হাসে কাঁদে ।লোকে বলে শিশুর দেয়ালা। গত জন্মের সুখদুঃখের স্মৃতি নাকি তাকে হাসায় কাঁদায়!চমকে ওঠে ,ভয় পায়!তার স্বপ্নে আসা-যাওয়া করে আগের জন্মের, তারও আগের আগের জন্মের নানা জন, নানা শোক-আনন্দের ঘটনার প্রবাহ?তা সে গেল নাহয় কাঁথা-কানি বালিশ-মশারি আর বাড়িসুদ্ধ লোকের  সচকিত প্রহরার ঘেরাটোপে অতি নিশ্চিন্তির শৈশবে দেয়ালা পর্ব।একইসঙ্গে অপর কঠিন সত্যটিও অস্বীকার করি কি উপায়ে-পৃথিবীর লক্ষ-কোটি শিশুর জীবনে নিরাপত্তার বলয়টুকু থাকেনা।আবার মাতৃগর্ভের আঁধার পেরিয়ে পৃথিবীর আলো দেখতে পায়না বা দেখতে দেওয়া হয়না কতশত ভ্রূণকে,তার সঠিক পরিসংখ্যান দেওয়া প্রায় অসম্ভব।সে গেল অন্য প্রসঙ্গ ।রাতজীবন নিয়ে বলতে গিয়ে কেন ভ্রুন, শিশুকথা মনে এসে গেল?
 কেন নয় - গজল ,গুলাব,সাকি,সরাব,আতর... ! কেন নয় - বর্ষার রিমঝিম, স্মৃতির পাতা উল্টে পড়ে নেয়া- "জন্মের সুতুলি থেকে / পাথুরে পথ বেয়ে / দুধারে স্বপ্ন ছিঁড়ে/ খৈ-ফুল নিম কাঠ /টুকরো আগুন খেয়ে/জ্বলে যাওয়া ভাঙা স্বরে/ নাভির পাঁচালী  ছুঁয়ে /ফিরে দেখা জীবনের গূঢ়তম পাঠ ...''   
                        তো শিশুর দেয়ালা শেষে রাত ,অন্ধকার ,ভয় ,মেজঠাকুমার প্রতিদিনের লালকমল আর নীলকমলের গল্প শেষে কেন জিন পরি আর ভূত আর রাক্ষস-খোক্কস ?তবু শোনার নেশা!অনেক পরে ভেবেছি কমেডি দিয়ে গল্প শেষ হয়নি কোনওদিন  মেজঠাকুমার, কেন?ওই ঠাকুমাকে আমরা মেজদি ডাকতাম।তার স্মৃতিতে কি তাড়া করে দেশভাগ আর শরনার্থী শিবিরের রাক্ষস-খোক্ষসদের কোনও তিক্ত স্মৃতি?
                                                    আমার শৈশব আর বাল্যকাল কেটেছে উত্তরবাংলার গ্রামে।বিদ্যুৎ আসেনি তখন।লন্ঠনের মৃদু আলোটুকুই ভরসা।উৎসব অনুষ্ঠানে,যাত্রা আর কীর্তনের আসরে হ্যাজাকের ফসফোস শব্দ আর আলো।দুর্গা পূজায়ও সেই হ্যাজাক ,সংখ্যায় কিছু বেশি;এইমাত্র।ঠাকুরঘরে আর তুলসীতলায় প্রদীপ ।ধুনো আর প্রদীপের পলতে পোড়া একটা মিষ্টি গন্ধ এখনও টের পাই মনেমনে।তো সে দিনগুলি -রাতগুলি আজ বড় অলৌকিক মনে হয়।কৃষ্ণপক্ষ রাতের গভীর নিকষ অন্ধকারের অদ্ভুত দ্যুতি;ঝোপে-জঙ্গলে,মাঠ-ঘাট,মেটেপথের দুধারে অজস্র জোনাকির বিচরণ আর মাথার ওপর ঘনকৃষ্ণ আকাশে লক্ষকোটি মিটমিটে গ্রহ-নক্ষত্র ,ছায়াপথ,সে এক বিপুল বিস্ময়!চোখ ফেরানো যেত না।বর্ষা ঋতুতে সে রাত আরও অনিশ্চিত ভয়ের জগতে ঠেলা মেরে ফেলে দিত।চারধারে প্রবল বিক্রমে বেড়ে ওঠা গাছপালা আর বিস্তারিত পাটখেতের কালচে সবুজ  বনের আড়ালে প্রায় ঢাকা পরে যেত গোটা গ্রাম।সাপ আর ডাকাতের আতংক ছিল আমাদের রাতজীবনের অঙ্গ ।
               এমন একরাতে চাপাস্বরে ডাকাডাকি,"ডাক্তার বাবু ,ডাক্তার বাবু' -দাদু হোমিওপ্যাথি ডাক্তার ছিলেন।অনেক লোকের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছিল।ডাকাত নাকি ?লণ্ঠন হাতে দরজা খুললেন দাদু পেছনে বাড়িশুদ্ধ সবাই।গামছায় চোখমুখ জড়ানো কয়েকটি লোক।একটি যুবককে কোলপাজা কোরে নামিয়ে এনে সিঁড়ির নিচে রাখল ক'জনে মিলে।হাঁটুর ঠিক ওপরে একটা বল্লম গেঁথে আছে ,গামছা দিয়ে বেঁধেছে হাঁটু ।ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে, ভেসে যাচ্ছে ছেলেটির পা!একটুও মুখবিকৃতি নেই কান্না নেই; দাঁতেদাঁত চেপে রয়েছে।ওরা হাসপাতালে যায়নি কেন?ভয়ংকর সে দৃশ্য মনে আছে।আমাদের ঘরের ভেতরে চলে যেতে বলা হল।কি চিকিৎসা হল বা তাদের কি হল শুনিনি।পরের দিন জেনেছিলাম মাইল দুয়েক দূরে এক বর্ধিষ্ণু কৃষকের বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল।একটা ডাকাতকে বল্লম হেনে জখম করেছে সে বাড়ির ছেলে!
      গ্রামসুদ্ধ সব্বার প্রিয় ফুটফুটে চেহারার পরোপকারী আর এক মাড়োয়ারি তরুণের কথা খুব মনে আছে।টিপু সুলতান নাটকের রিহার্সাল চলছিল তখন আমাদের বাড়িতে প্রতিদিন।সে করবে টিপুর রোল।বিশ্বকর্মা পূজায় আর দুর্গা পূজায় নাটক হবে,সবাই অপেক্ষায় দেশসুদ্ধ মানে গ্রামসুদ্ধ লোক। বীনাপাণি অপেরা নামে যাত্রাদল ছিল আমাদের গাঁয়ে, তারা পালা-পার্বনে যাত্রা করতেন কিন্তু নাটক তেমন হত না। সেবার সবাই মিলে নাটক করবেন স্থির হয়েছিল।আমার মাকেও একটা রোল দেওয়া হয়েছিল ,সাদা পৃষ্ঠায় লেখা সে রোল মা মুখস্থ করতেন ,মনে আছে বেশ। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় সেই মারয়ারি বাড়িতে ডাকাত পড়ল , লুঠপাট তো হলই ছেলেটিকেও খুন করে রেখে চলে গেল  ডাকাতদল । সারাগ্রাম শোকে মুহ্যমান হয়ে রইল। নাটকটাও আর হয়নি ।   
 আজ সুদূর সে রাতগুলি সে গ্রাম কেমন নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য লাগে। -সেই প্রকান্ড চাঁদ ,হলুদ জ্যোৎস্নার ঢেউ ছড়িয়ে শাসন করত সে গ্রামের আকাশ, মাঠ-ঘাট ,ঘন গাছ-পালা,বাড়ি-ঘর,উঠোন,তুলসীতলা,ফসলের ক্ষেত,সীমানা প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা নিবিড় বাঁশবন ! সে চাঁদের দিকে চেয়ে কি কারণে অদ্ভুত সুরে ডাকত আমাদের পোষ্য ভুলু ।ঝাপড়া লিচুগাছটার ডাল থেকে উড়ে যেত বাদুরের দল।কুয়োপাড়ের কদমগাছ থেকে ভেসে আসত প্যাঁচার বিশ্রী ডাক! ঠাকুমা বারবার উচ্চারণ করতেন,"" হরি হরি কৃষ্ণ কৃষ্ণ ।''


                                                   
   

No comments:

Post a Comment