Monday, December 31

গল্প : জয়িতা ভট্টাচার্য







বিনির্মাণ 

টানের সময় নদী সরে যায়।মনসুর, শ্যামাপদ, শচীনের খুব কষ্ট।মাঝ নদীতে চরা।অনেকে কোমর জল বুক উঠলেও হেঁটে পেরোয়।শহরের বাবুরা পিকনিকে এলে লাভ। সে আর কত। ধান জমি কী আর সকলের হয়। গ্রামটা বেঁচে ওঠে দূরের প্রথম ট্রেনের ভোঁ এ। গ্রামটা মাঝরাতে জেগে ওঠে স্বপ্নের মতো যখন তীব্রগতি তে  দূরপাল্লার ট্রেন টা চলে যায়।পাশ ফিরে শোয় আবার গ্রামটা।
কার্তিক পুজোর পর রাতে এমনই মাঝরাতের ট্রেনে গলা দিয়েছিলো জনাই রোড স্টেশন থেকে আরো দু কিমি দক্ষিনের বদনপাড়ার শামু। মরতে গেছিলো পায়ে হেঁটে নিঃসাড়ে কতটা পথ। শামুর বউএর বাচ্চা হয়নি। কার্তিক ফেলে গেছিলো কারা যেন।কানাঘুষো শোনা যায় শামুর শিশ্ন কেঁচোর মতো নির্বীজ ছিলো।
শামুর বউ শহরে পালিয়ে গেল পরের জগদ্ধাত্রী পুজোর ভোরের প্রথম ট্রেনটায়। আনোয়ারের সাথে।সে ঠিকে মিস্ত্রীর কাজ করে এখন।বস্তিতে থাকে
মেয়ের কোলে ছেলে,ফের পোয়াতি।

কার্তিক পেরিয়ে অগ্রহায়ণ মাসে এমন সময় আমরাও পাঁচ মিনিটের হল্টে হাঁচোর পাঁচর ইকিরমিকির সব নিয়ে গ্রাম ছেড়েছিলাম।
ছাতিম গাছে ম ম সুবাস এখন।
সন্ধ্যে হলে যা কুয়াশা সকালে তাইত শিশির। ওভার ব্রীজের ওপর দিয়ে ঝম ঝম করে ট্রেন যায় শহর প্রান্তে।
এখন ভুলে যাবার দিন।সুর্য একপেশে।ম্লান মুখের আকাশ ,ছায়া আসল মানুষটাকে ছাড়িয়ে অনেকটা দূর বিস্তার করে।
স্মৃতি কোনটা আর কোনটা কল্পনা মিলেমিশে যায় একসময়।
বড়ো দিঘীর গা ঘেঁষে বাড়িটা।একতলায় নতুন সংসার।
ছোট্টো মেয়ে কোলে ছেলে কর্তা গিন্নী একটা পোষা কুকুর আর একটা মস্ত হনুমান।সারা পাড়ায় নতুন পরিবারটি নিয়ে ঢি ঢি। হনুমান কেউ পোষে!
জলের ধারে বাঁধানো চাতালে কুকুর আর হনু বসে থাকে দীর্ঘ ল্যাজ ঝুলিয়ে।শব্দহীন। একটা ঝুলপড়া নোংরা সিঁড়ির মাথায় সাজানো ফিটফাট ঘরে আলাপ করতে আসে ওরা স্বামী স্ত্রী।সামনে বসে আছে মেদবহূল চেহারা নিয়ে দত্ত ডাক্তার।
ঘুমের মধ্যে উসখুশ করি। বাতাসে এখন আর্দ্রতা সামান্য ।ঠিক তখনই ঘুম ভেঙে যায়।দত্ত ডাক্তার...... গত দুর্গা পুজোর সময় মারা গেছেন। হঠাত তিনি কেন অসেছেন।আর হনুমান.....ওরা ত কত অস্পষ্ট দূরের সেই বদনপাড়ার গাছে গাছে ঝুলত।
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে লাফালাফি। একদিন বাচ্চা টা ট্রেন চাপা পড়ল।শিশু সে।বোঝেনি কি পারে আর না পারে।বসেই রইলো চকমকে রোদ ছিটকোনো রেলের পাতে। কেউ ভাবতে পারেনি।
সাতদিন ওরা বসে বসে হাহূতাশ করলো নিঃশব্দে।প্রতিটা ট্রেন নতুন বিষাদ বয়ে আনে।
সেই পরিবারো তামাদি হয়ে গেলো।
দরজা খুলে লোহার গ্রীল।রাস্তাটা নিঝুম।
আমি নিশির ডাকে এগিয়ে যাই।
যেন ঘড়ি নেই। প্রতিটা ট্রেনের সঙ্গে জুড়ে আছে নিত্যদিনের লিপি।
রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে তুমি।আবছা অন্ধকার বন্ধ দোকানের শেডে।
এপারে শেষ রুটিটা সেঁকে খরিদ্দারের হাতে তুলে দিচ্ছে মাসী।বুড়োটা গুছিয়ে নিচ্ছে তল্পি।
আমাকে যেতে হবে।মাঝ রাস্তায় এসে আটকে রয়েছে চোখ ধিকি ধিকি আগুনে।নেভেনি এখনো।
গরম রুটি অথবা প্রণয়.......
ঝমঝম করে এগিয়ে আসছে ট্রেন।তোমার মুখ ফ্যাকাশে রক্তহীন।
একটা সার্কাসের লরি। কোথা থেকে ছুটে আসছে।
আমি এখন ওভারব্রীজে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছি।
আমার রক্তে ভেসে যাচ্ছে পথ।আমার শুকনো শরীর কুঁচকে পুটুলি হয়ে আছে।আমি কাঁদছি ঘুমের ভেতর।ঘামছি।
ভোরের ট্রেন পার হয়ে গেল।ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে বসি অন্ধকার ঘরে।শীত।বুকের ভেতর জোরে ঘন্টা বাজছে।
জানলা খুলে দিই।সামনে ছাতিম গাছ।এখন প্রতিটা স্বপ্ন লিখে লিখে রাখি।যদি সত্যি হয়ে যায়

No comments:

Post a Comment