Monday, December 31

গল্প: বিজয়া দেব

             


                                                                                   
  মালারানি ঋষি
             
বারান্দায় পুইঁগাছ লাগিয়েছে মালারানি। মালারানি ঋষি। একসময়ে এরা অচ্ছুৎ ছিল। আজকাল জলচল হয়েছে। এই রামরাজাপুর গ্রামে উঁচুবর্ণের লোকেরা প্রায় নেই। গাঁ ছেড়ে দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যারা আছে তারা মালারানির সমগোত্রের না হলেও তথাকথিত উঁচুগোত্রের নয়। কর্মকার, লোহার, মালি। তাই মালারানি ঋষিকে আজ আর গাঁয়ের বড়দীঘি থেকে জল আনতে গেলে ঝামেলা পোহাতে হয় না। তবে গাঁয়ের পঞ্চায়েত আছে, রীতি নিয়মের বাড়বাড়ন্ত আছে। এমন নয় যে মালারানি সব সব বিধিনিষেধ থেকে রেহাই পেয়ে গেছে। সুধারানি আছে না? মালারানির একমাত্র মেয়ে? স্বামীছাড়া। শরীর স্বাস্থ্য ভাল। ভালোবাসার কাঙাল। ওকে নিয়ে খুব ভাবনা। এই যে পুঁইগাছটা বারান্দার পাশ ঘেঁষে তরতরিয়ে বাড়ছে একে নিয়েও কি মালারানির কিছু কম মাথাব্যথা? গাঁয়ের পঞ্চায়েত প্রধানের লোকের চোখ পড়লে খচাখচ কেটে নিয়ে যাবে, তাকে জিজ্ঞেস অব্দি করবে না। সেবার খুব পুরুষ্টু লাউ হয়েছিল, মাত্র দুটো লাউ খেতে পেরেছে নিজেরা, বাকিগুলো পেড়ে নিয়ে গেল পাঞ্চাতের লোকজন।
বলে- আমাদের প্রধান কত ভালো লোক, গাঁয়ে তোর জলচল হয়েছে। বড়দীঘি থেকে খেয়ালখুশি জল নিতে পারছিস, এটা কি কিছু কম কথা? কেউ ত তোকে কিছু বলছে না। এই জাতধর্ম নিয়ে এই যে তুই আমাদের সাথে চলতে পারছিস, সেটা কি কম বড় কথা? কলাটা মূলোটা ফলাবি আর সব একা একা খাবি তাই কি হয়? সবাইকে দিয়ে থুয়ে যা থাকে সেটা হচ্ছে গিয়ে তোর। বুঝলি কি না!
 বোঝে মালারানি। না বুঝে উপায় কি! বুঝতে হয়। কথাগুলো ফেলে দেয়ার মত নয়। সে ত নিজেই দেখেছে শাশুড়ি সন্ধ্যারানি ঋষি জলের জন্যে কতদূর যেত কলসি ঘড়া মাথায় নিয়ে, যেত পাঁচ মাইল দূরের হাওরে। সে-ও যেত শাশুড়ির সাথে। ফেরার পথে ভরা কলসি মাথায় নিয়ে পায়ের জোর যেত হারিয়ে। সে সব দিন ত ভোলার কথা নয়। এমনও হয়েছে সুধারানিকে কোলে নিয়ে কলসি মাথায় জল আনতে হয়েছে। ধীরে ধীরে সময় গেছে, গাঁ ছেড়ে চলে গেছে বামুন কায়েতরা। মালারানির অনুমতি মিলেছে গাঁয়ের বড়দীঘি থেকে জল আনার। তাতেই অনেক কৃতজ্ঞ মালারানি। কলসি নিয়ে অতদূর যেতে হয় না। তবে সুধারানিকে নিয়ে মাঝে মাঝে হুমকির মুখে পড়তে হয়। মালারানির কাছে সুধারানি ফিসফাস করে রাত হলে। বলে সে সুজনকে ভালবাসে। সুজনও তাকে ভালবাসে। সুজন মালি। সুজনের বাবা নিজন মালি।  আগে নিজন মালি বামুন কায়েতদের পুজোর ফুল জোগান দিত। আর মালারানির ত মুদ্দোফরাসের পরিবার। মালারানির নিজের লোকটা ত ঐ কাজই করত।
 নিজন মালি আঁচ করেছে। একদিন তাকে পথে পেয়ে শাসানি দিয়েছে। একে ত জলঅচল জাত, তায় স্বামীছাড়া। বেশি বাড়াবাড়ি হলে পঞ্চায়েতের কাছে তুলবে সে ব্যাপারটা। মালারানি যেন মেয়েকে সামলে রাখে। মালারানি মেয়েকে বোঝায়। সুজনকে ভুলে যেতে বলে। কিন্তু মেয়ে তার কথা কি শোনে?
 বলে- কেন মা , আমার কি কাউকে ভালবাসতে নেই? কী দোষ আমার বলতে পারো? সুজন আমায় খুব ভালবাসে।
 আরও কথা বলে সুধারানি, বলে- বাবা ত ভাল কাজ করত মা,  শ্মশানে কত লোকের সাহায্য হত। বিস্টিবাদলের রাতে মানুষের কত অসুবিধে। বাবা যদি ঐ কাজ না করত তা হলে?
 হায় রে সুধা, তোর মত যদি ভাবত সবাই! এমনটা মনে কেউ ভাবে না। কেউ না। মন জানে মনের কথা। বাইরের লোকজন তা শুনবে কোন সুখে! ওরে সুধারানি, এসব কথায় কে কবে কান দিয়েছে বল? দুমুঠো খা’, মার সাথে কাজকর্মে মেতে থাক। ওতেই সোয়াস্তি। সুখ খুঁজতে গিয়ে হুজ্জোতি ডেকে আনিস না।
 কথা শোনে মেয়েটা? তাহলে যা কোন চুলোয় মরবি মর। রেগে গালাগালি করে মালারানি।  খিলখিল হাসে সুধা।
বলে- ওসব নিয়ে আমি ভাবব কেন? আমি বেশ আছি। আসুক পঞ্চায়েতের ফরমান, আমি সুজনকে ঠিক ভালবেসে যাব।
       ভোরের আলোর রেশ ছুঁয়েছে মালারানির বারান্দা। পুঁইগাছটি বাড়ছে তরতরিয়ে। গাছের গোড়ায় জল দিল সে। হেমন্তের হাল্কা মিঠে রোদ্দুর শিশিরভেজা চকচকে পাতাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। পেছনে ঠিক ঘাড়ের ওপর কেউ কি শ্বাস ফেলল? কে? জীবনলাল। ঠিক তার পেছনে। গা ঘেঁষে।
এত গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছ কেন গো, আমি অচ্ছুৎ মানুষ। এখন বুঝি ছোঁয়াছুঁয়ির বাধা নেই? কেন? জীবনলাল আরেকদিন তার আঁচল ধরে টানাটানি করছিল। একেবারে ভরদুপুরে। পঞ্চায়েতের লোক। অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়ান দিয়ে এনেছিল সে। আজও সেই জীবনলাল।
- কী রে, খাসা গাছ হচ্ছে। লকলকিয়ে বাড়ছে তোর পুঁই। আগার দিকটা কাল কেটে নিয়ে যাব। তোর হাতে লক্ষ্মী আছে। সেইবার লাউ নিয়ে গেলাম। কচি নধর লাউ ...আহা আর কী করি বল...
বলে কানের কাছে মুখ নামিয়ে এনে বলে- তোর মেয়েটাকে কাল দেখলাম বিকেলের হাটে, অমনি। মানে, যেন এই লকলকিয়ে ওঠা তাজা পুঁইলতা। তুই-ও তেমনি। যেন নধর লাউ। যেমন মা তেমন মেয়ে।
মালারানির ইচ্ছে হয় লোকটার গালে একটা সপাটে চড় মারে। কিন্তু কিছুই করতে পারে না। ভেতরের আগুনে শুধু জল ঢালে। ঢেলে ঢেলে ঠান্ডা করে। প্রধানের লোক জীবনলাল। যা তা বলে জীবনলাল। পান খাওয়া দাঁত দেখিয়ে হাসে। মালারানি চুপ। সহ্য কর সহ্য কর। সইতে না পারলেই বিপদ। বিপদ কোন দিক দিয়ে আসে কিচ্ছু বলা যায় না। যদি পঞ্চায়েত মিটিং বসে তাকে নিয়ে?  যদি বলে-  বড়দীঘি থেকে আর জল নিতে পারবি না মালারানি। অচ্ছুৎ অচ্ছুতের মত থাক। অনেক দয়া দেখিয়েছি তোদের। তোরা দয়ার যুগ্যি নোস।
 বলতেই পারে। শিউলির পরিবার ত পঞ্চায়েতের নির্দেশে গাঁ ছাড়ল। বিধবা শিউলির ছেলে প্রধানের মেয়েকে ভালবেসে ছিল। গাঁ ছাড়া হতে হল ওদের। শিউলি ওরা ডোম চাঁড়াল নয়। কামার। প্রধানের অনেক জমিজিরেত আছে। শিউলি খুব গরিব ছিল। কোথায় যে গেছে শিউলি জানে না মালারানি।
   পরদিন জীবনলাল আরও কয়জন লোক এনে পুরুষ্টু পুঁইগাছের  পাতা ডাঁটা সব কেটে নিয়ে গেল। শুধু গোড়ার দিকটা রেখে দিয়ে বলল- গোড়ায় জল দিস গো মালারানি, তোর হাতে সোনা আছে। এবারের ডাঁটা পাতা সব তোর। আমি আর হাত দেব না। আরে আমাদের দেহে দয়ামায়া আছে। অত কষ্ট করে লাগিয়েছিস, খাবি না?
 মালারানি ভাবছে , অচ্ছুতের হাতে লাগানো গাছ অচ্ছুত হয় না কেন? ভাবেই শুধু, বলতে পারে না কিছুই।
 যাবার সময় জীবনলাল ফিসফিস করে-যা রসালো গাছ করেছিস, ডাঁটা চিবিয়ে খাবো আর তোকেই মনে করব। খুব সুন্দর, খুব সুন্দর, আহা। মেয়ের নাম রেখেছিস সুধারানি, আহা রে!  মালারানির হাতটা নিসপিস করে। সপাটে একখানা চড়! ঈস! নিজেকে সামলে রাখতে এত কষ্ট?
 যা...ই জীবনলাল হাসতে হাসতে যায়। যাবার সময় মাঠঘাট কাঁপিয়ে গলা ছেড়ে গান গায়। .........
   -বেসুরো বদমাশ!
  চমকে পেছন ফিরে দেখে মালারানি, সুধারানি দাঁড়িয়ে। সুধারানি বলছে কথাগুলো। মেয়েটা কি জীবনলালের কথা শুনেছে?
 -এত কষ্টের ফসল, বেমালুম কেটে নিয়ে গেল, কিছু বলো না কেন?
 মালারানি কথা বলে না । দেয়ালেরও কান আছে। কী দরকার!  সুধার রাগ আছে। চেঁচিয়ে কথা বলার অভ্যেস আছে। মেয়েটাকে নিয়ে খুব ভয়।
- এত ভয়ে কেউ বাঁচে?
 কথাটা বলে গটগট করে চলে যাচ্ছে মেয়ে।
মালারানি ডাকে-এই কোথা যাস?
 মেয়ে ফিরেও তাকায় না।
     পরদিন বিকেলে বড়দীঘি থেকে জল নিয়ে আসার পথে ছায়ামাখা পথে কাঁখের কলসি ও হাতের বালতিটা নামিয়ে একটু দম নিচ্ছিল মালারানি। হেমন্তের বিকেল। চট করে ছায়া গাঢ় হয়ে আসে। গ্রামীণ সুঁড়িপথ। একটা হুটোপাটির মত আওয়াজ হল। তারপরই মেয়েলি কণ্ঠের তীক্ষ্ণ চিৎকার। একটা যন্ত্রণাকাতর ছটফটানি। ভয় পেয়ে মালারানি তাড়াতাড়ি কলসিটা মাথায় তুলতে যাবে, দেখে জীবনলাল টলতে টলতে ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। তাকে দেখে থমকে দাঁড়ায়।
 একটা বিষাক্ত শ্বাস ফেলে বলে- একটা সাপিনীকে জন্ম দিয়েছিস।  দ্যাখ, কী করেছে তোর সুধারানি।
 জীবনলালের কনুই চুঁইয়ে টপটপ করে রক্ত ঝরছে।
 - দাঁড়া , আগামী পঞ্চায়েত মিটিনে তোদের হবে। এ গাঁ তোদের ছাড়তেই হবে। বিচার হোক তোর বদ চরিত্তিরের মেয়ের। আগের সোয়ামি ত ছেড়েছে, তবু  খুব দাপট, হ্যাঁ? নিজন মালির ছেলেকে চাই? কেমন? তা হলে দ্যাখ, কী হচ্ছে আর কী হতে যাচ্ছে। শুধু দেখে যা।
 চলে যায় জীবনলাল। আর এদিকে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে সুধা।
 ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা রক্ত মুছে নিয়ে বলে- এখানে কি করছিস মা? লোকটার মাথায় দু’ঘা বসাতে পারলি না?
 বলে জলের বালতিটা হাতে তুলে নিয়ে বলে- ঘরে চল মা । অতো কি দেখছিস, আরও দুদিন অমনটা হয়েছে। কাবু করতে পারে নি আমাকে। পারবেও না।
 যেতে যেতে মালারানি বলে- চল এ গাঁ ছেড়ে চলে যাই। শিউলি ওরা কোথায় যে গেল! ওরা কোথায় আছে জানতে পারলে ওদের কাছাকাছি কোথাও ঠাঁই করা যেত। 
 সুধারানি কথা বলে না। ওর দুপদাপ পায়ের শব্দে নিবিড় হয়ে আসা হেমন্তের সুঘ্রাণ সন্ধ্যা নিবিড়তর হয়। কাল কী হবে জানে না মালারানি। মাথার কলসিটাকে ঠিকঠাক ধরে সে এগোয়। একটুখানি বিন্যস্ত স্বাচ্ছন্দ্য চায় সে। মানুষ বলেই ভাবে নিজেকে। হেমন্তের সন্ধ্যায় রূপবতী প্রকৃতির মূক ভাষ্যে সে-ও এক মূক রমণী, এ কথা তার চাইতে ভাল কেউ জানে না।
           


     
     
      

2 comments: