Monday, December 31

গল্প : রাজেশ ধর





আর কতদিন

কতদিন হল! কতবছর! মনে করতে পারে না সিদ্ধেশ্বরী। এইভাবে, একঠাঁয়ে, একটানা। দুচোখের পাতা বুজে আসতে চায়। আর যে কিচ্ছুটি দেখতে ইচ্ছা করে না!  কিন্তু উপায় আছে? আলো চোখের ওপর পড়লে... চোখ বোজা যায়! ভেতরের সাদা আলোটা কিছুতেই নেভায় না। অথচ! রাতের জন্য হালকা তাঁতের শাড়ি পড়িয়ে দেয়। গরমকালে পাখা চলে। আগে ওপর থেকে ঝোলা পাখা ছিল একটা। এখন তার সাথে দু-দুটো দাঁড়ানো লম্বা পাখা। ঘুরতেই থাকে। পেছনের জানালাটা ওরা বন্ধ করে দেয়। ভালই করে। পচা পাঁক, নোংরা জঞ্জাল, ভেসে আসা গরুমরা,কুকুরমরার গন্ধ। দিনের বেলাতেই পেটের নাড়িভুড়ি উঠে আসতে চায়। শীতকালে গায়ের ওপর দিয়ে জড়িয়ে দেয় বেশ দামী শাল। নরমে গরমে বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু ঐ যে দুটো চোখ বোজা যায় না! কাউকে যে আর দেখতে ইচ্ছা করে না! সব মনে হয় পটুয়ার তৈরি মুখোশপরা পুতুল।

মোটের ওপর মাঝারি এই ঘরটা। সেই সেকাল থেকেই। নতুন ঘর আর হল না। তাতে অবশ্য দুঃখ নেই সিদ্ধেশ্বরীর। তিন বোনের বাড়ি কাছাকাছি। ও বড়, মেজ করুণাময়ী আর ছোট ভগবতী। চিরকাল বড়দেরই তো দায়িত্ব ছোটদের দেখেশুনে দাঁড় করাতে হয়। মেজগুলোর বুদ্ধি একটু বেশি হয়। প্রথম থেকেই মেজটার ঠাঁটবাট একটু বেশি। ওর বরের জন্য একেবারে বারোখানা ঘর। আর ওর নিজের জন্য বিরাট ঐ বাড়ি । এখনও কত বড় চৌহদ্দি! লোক-লস্করের ভিড় লেগেই থাকে। কিছু না কিছু তারা এমনিতেই পায়। কিন্তু নাম হয় মেজর! একেবারে পাশেই মেজটা থাকে। ওর ঘরের উচু মাথাটা এখান থেকে দেখা যায়। কিন্তু তার জন্যই ভিড় এদিকে  কম। আগে তো শুধু ভিখারি, কিছু গেঁজেল, পাগল আর দু-একটা খ্যাপা। এরাই আসত। ইদানিং এই কিছু বছর, কেউকেউ আসছে। বোঝে সিদ্ধেশ্বরী। এত চাপ, আয়-রোজগার নেই! কীসব আরো যে হচ্ছে! মেয়েরা সব ছেলেদের মত! সংসার ভাঙছে, ছেলেপুলে উচ্ছন্নে যাচ্ছে! আরো নাকি এদের টাকা দরকার! কত কী যে দরকার! তাই আজকাল তারা আসছে। আর সাথে করে আনছে দুটোপয়সা, গয়নাগাটি। টাকাকড়ি অবশ্য ওর কাছে থাকে না! কিন্তু ছোটখাট গয়নাগুলো ঐ  সিন্দুকটায় থাকে! যারা দিয়েছে তারা মাঝে মাঝে দেখতে চায়। দেখাতে হয়।

আগে; বছরে দুই অমাবস্যা কাত্তিকে আর ভাদ্দরে, কিছু লোক হত। সামনের চত্বরটায় ছোট মেলামত বসত। ধার দিয়ে গোটা কয়েক অশ্বত্থ, শিশু, বুনো কাঠাল, চালতার জঙ্গল সমেত একটা বড়সড় মাঠ ছিল এই চত্বরটা। এখন আর সেটা অদ্ধেকও নেই। বাসরাস্তা আর দখলকরা দোকানপাট গিলে খেয়েছে। ঐটুকু জায়গাতে আজকাল ঐদুদিন মারকাটারি ভিড়। মুখোশে মুখোশে ছয়লাপ। সিদ্ধেশ্বরী আঁতকে ওঠে। ভয় হয় ওর। এত কচি বাচ্চা, বুড়োবুড়ি জুটেছে! যদি হুড়োহুড়ি লাগে! পায়ের তলায় চাপা পরে মরবে না তো!  তার মধ্যেই চেয়ার টেবিল পাতা হয়। কালো প্যান্ট, সাদা জমা পরা ছেলেরা খাওয়ায়। ঘি-ভাত, আলুর রসা, চাটনি। সেইসময়ে কেমন কেমন মনে হয় ওর। ভেতরটা যেন ফুলে ওঠে সিদ্ধেশ্বরীর। মেজটাকে বলতে ইচ্ছে করে –দেখে যা, সবুরে মেওয়া ফলে।  মেজ কিন্তু দেখে না। একবার তাকিয়েও দেখে না। ভগবতীটা ছোটবেলা থেকেই ওর ন্যাওটা। সেই তো সব খবর দেয়।

মেজটা আর ছোটটা পিঠোপিঠি। সেই সময় থেকেই খুনসুটি আর ঝগড়া। মেজটার বাড়ি বাঁদিকে। ছোটটা আছে ডানদিকে ।ঐ দেখা যাচ্ছে শ্মশান। ওর গোড়ায়। এখন কি আর সেই শ্মশান আছে! একটা পদ্মপুকুর ছিল শ্মশানের আগে। তার  মাটির তলায় এখন খাবার জলের সিন্দুক। আর ওপরে কলকারাখানার মত ঘরবাড়ি। কত লোক কাজ করছে। ভেতরে সুন্দর কেয়ারি করা বাগান, বাচ্চাদের খেলার মাঠ। বুড়োরা বিকেলে হাওয়া খায়। বিজলির চিতায় মরা পুড়ছে।ভগবতীর ঘর একটাই। তবে বেশ উঁচু আর লম্বাটে। খুব রঙচঙে। ওর গয়নাগাটি, সিদ্ধেশ্বরীর থেকে অনেক অনেক বেশি। আর যত্নটাও খুব বেশিই পায় ও। দুবেলাতেই মাছ, মাংস। ডাল, তরকারি, মিস্টি, পায়েস আরও নানারকম। মোটা কাঠের দরজাটা বন্ধ করে দিনে তিনবার বিশ্রাম নেয় মেয়েটা। তার আবার খুব রাগ! কেউ বিরক্ত করে না।

আর ওর বেলায়! ও কিছুই করেনি। তাও সবাই বলে--ও খুব শান্ত, দয়াময়ী। কারুর দুঃখ নাকি সহ্য করতে পারে না! তাই এই শাস্তি!  প্রতিদিনের খাবার বলতে শুধুই ফল-মিস্টি । ঝুলকালি লাগা ঘরটায় ছুঁচো, ইদুর, টিকটিকিদের সাথে থাকা। এইসব সবকিছুই মেনে নেয় সে।  এমনকি সারা দিন-সন্ধেটাও অভ্যেস হয়ে গেছে। কিন্তু  সারাটা রাত ঐভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে দঁড়িয়ে জাগা! আর এই মুখোশগুলোকে দেখা! কতদিন পারে কেউ? মেজটার নাকি রুপো আর হাতির দাঁতের মিনে করা পালঙ্ক। ছোটরও শোয়ার জন্য সুন্দর একটা বড়সড় খাট আছে। ওদের স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আরাম করে শুতে পারে। ওর আর মেজর বরদুটো শুয়ে শুয়েই দিন কাটায়। এমন স্ত্রৈণ পুরুষ আবার ওর পছন্দ না। তেমন ছেলেও বা ও এল কই! তাই বিয়েই আর করা হল না। আজকাল মুখোশগুলো, ওর দুধ-হলুদ রঙ,সুন্দর মুখ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। আর বলে ও নাকি এদেশের না। মেজ আর ছোট কী করে ওর বোন হয়! ওদের মত ঘরজামাই বর কীভাবে এমন মেয়ে বিয়ে করার সুযোগ পাবে?  তখনও বেশ ভাল লাগে! কিন্তু কোমরটা টনটন করে ওঠে মাঝেমাঝেই। আর সত্যি সত্যি তখন  খুব রাগ হয়...হিংসা হয়। কেড়ে নিতে ইচ্ছে করে দুই বোনের ভাগ্য! খাট-পালঙ্ক কিচ্ছুটি দরকার নেই। ঐ  ফাকা ফাকা করে লোহার শিক বসানো দরাজাটা! কিছু দিয়ে ওটা আড়াল করুক ওর ঘরের আব্রু। দিনরাত জ্বলা ঐ সাদা বিজলির আলোটা নিভিয়ে দিক। তারপর ও মাটিতেই শুয়ে পড়বে সেই আগের মত। ঘুমোবে সারা রাত... নিশ্ছিদ্র ঘুম। সারাটাদিন মুখোশ দেখার থেকে শান্তি!

                                                                                    ২

তখন ভাগীরথী বইত এই ঘরটার ঠিক পেছন দিয়ে। অবশ্য এই ঘরটাই ছিল না তখন। ঘোলা জলের ছোট ছোট ঢেউ উঠত ভাগীরথীতে। জোয়ার-ভাটার খেলা চলত। পানসি-বজরা-গহনা-পালতোলা ময়ূরপঙ্খী, হংসমুখীর চলাচল ছিল দিনরাত জুড়ে। আর শ্রাবণের বৃষ্টি শুরু হলেই বন্যা।এপারে তখন সুন্দরী, গরান, ক্যাওড়ার জঙ্গলে চড়ে বেড়ায় হরিণ, বাঘ, বুনো শুয়োরের ঝাঁক। এই এখানে ছিল ছোট্ট একটা ঘাট। বৃষ্টি শেষ হওয়া এক বিকেলে সেই ঘাটে নামল বলদেব পাল। বলদেবই মনে হয় একমাত্র, যার মুখে কখনই মুখোশ দেখেনি সিদ্ধেশ্বরী। ওরা তিনবোন নেমেছিল।  সেই দূর পাহাড়ের দেশে বলদেব গিয়েছিল কাজের খোঁজে। ওখানেই পাহাড়ে পাথরে দিনরাত মাথা খুড়ে মরত সে। সেই ভাবেই তাদের তিনবোনকে সে পেয়েছিল । ইচ্ছে ছিল আরও চার মেয়েকে খুঁজে নিয়ে সে আসবে। তখন সাত কন্যা যার সাথে থাকত সে মহা ভাগ্যবান। কিন্তু ছেনি, হাতুড়ির সাথী বলদেবের নাকে মুখে সবসময় পাথরের গুড়ো ঢুকত। তাই অসুখে ধরল তাকে। চলে আসতে হল এখানে। এই জঙ্গল পেরিয়ে ছিল তার গাঁ, পুঁটিমারি। সে গাঁয়ের পুঁটি মাছের খুব স্বাদ। কিন্তু বলদেব গাঁয়ে গেল না। মাঝিরা নামিয়ে দিয়েছিল ওদের তিনবোনকে। বিকেলের রোদ তখন পাকা কামরাঙা। ওদের তিনজনের দিকে তাকাল বলদেব। তারপর চোখ বুজে বসে পড়ল। পরদিন কুঁড়ে বানাল এখানেই।

চোখে জল আসে সিদ্ধেশ্বরীর। কী মজাই না ছিল তখন! ঘাটের চারপাশে পাখিদের কিচিরমিচির, কতরকমের ফুলের গন্ধ! তখনও মুখোশ ছাড়া অনেকেই ছিল। তারা নৌকাতে উঠতে, নামতে দিয়ে যেত মন্ডা, বাতাসা, ক্ষীরপুলি...কত কী! তার সাথে বলদেবের স্নেহ-শাসন।  বড় গঞ্জ বলতে বেশ দূরে বঁড়শে। তাদেরই কর্তা চৌধুরী মহারাজ যাচ্ছিলেন বজরায় চড়ে। তার মুখে একটা মস্ত বড় মুখোশ দেখেছিল সিদ্ধেশ্বরী। ঐ নদীর বুক থেকেই মেজর জাঁকজমক দেখে তার ভাল লেগে গেল। নামলেন তিনি। পছন্দ করলেন মেজকে। মেজও খুব খুশি। তার বাড়িতে ছিল বিশাল লম্বা চওড়া ছেলে, প্রমথেশ। তাকে  এনে বিয়ে দিলেন মেজর সাথে। তারপরে এখানেই একটু দূরে রাতারাতি জঙ্গল কেটে বিশাল পোড়ামাটির ঘর বানিয়ে দিলেন। খাওয়ার জন্য জঙ্গল কেটে চাষজমিও হাসিল করে দিলেন। কিন্তু এই জমি তার ছিল না। ছিল তহশীলদার আলিসাহেবদের। তহশীলদার খোঁজ নিতেন না জঙ্গলের। চৌধুরী মেজর বাড়িতে রোজ শয়ে শয়ে লোক পাঠাতে শুরু করলেন। এইভাবে এই মহাল ভোগ করতে শুরু করলেন তিনি। আলিসাহেব তখন মারা গেছেন। তার ছেলেরা ছোট ছোট কিছু বলতে পারল না। কিন্তু রেগে রইল।

একটু দূরে সিরিডিহির মহাশ্মশান। সেখান থেকে এক পাগল-ক্ষ্যাপা এল। তার মুখেও একটা মুখোশ ছিল। ঘরে বৌ নেই বলে খাওয়া হয় না তার। ছেলে ভৈরবের সাথে সে ছোটর বিয়ে দিল। ছোটর নজরদারিতে শ্মশানে দাহব্যবসা বেশ জমে গেল। সেই খ্যাপা…মস্ত গুরুদেব হয়ে গেল। বৌমার জন্যেও পাকা ঘর বানাল সে।

দুইবোনই যাবার সময় বলদেবের হাতেপায়ে ধরেছিল। সঙ্গে করে নিয়ে যাবে, না সে যায় নি। পরে বলছিল বলদেব...তোকে ছেড়ে কোথায় যাব? সিদ্ধেশ্বরী চুপ করে ছিল। আরও বলেছিল সে...স্বপ্নে যে তোকে দেখেছিলাম মা! ওরা দুই বোন গর্জন তেলে মাখামাখি কালো। আর বলদেব সিদ্ধেশরীকে হলুদ মাখাত। বাটা শ্বেত চন্দন আর টগরের পাপড়ির ক্কাথ মাখিয়ে রাখত তার মুখে। মনেই হত না তারা দুজনে ওর বোন।

কী যত্নই না করত বলদেব! নিজের হাতে করে নাওয়াত,খাওয়াত। না খেলে জোর বকা দিত। খেয়ে নিত সিদ্ধেশ্বরী। রাতের বেলায় ফাকা নদীর ঘাটে গান শোনাত বলদেব।  আকাশে, চারপাশে হয় চাঁদের আলো নয়ত তারার ঝিকিমিকি। সেই গানে দুচোখে ঘুম নেমে আসত সিদ্ধেশ্বরীর। সকালবেলাতেও বাজত বলদেবের ভোরেলা গান। সাজিভর্তি হয়ে থাকত সদ্যফোটা লালজবার রাশি । জবার লুকোচুরি গন্ধ ঘুম ভাঙাত ওর।

ছোট-মেজর নামযশ, আরাম-বিলাস বাড়ছিল। কিন্তু সিদ্ধেশ্বরী চাইত দিনগুলো যেন এমনই যায়। অথচ গেল না। একবার ভরা বর্ষায় ভাগীরথীতে মহাপ্লাবন হল। ভেসে গেল বলদেব আর তার কুঁড়েঘর। আশেপাশের গাঁ-গঞ্জ সব ধুয়ে মুছে সাফ। মানুষের আর কোন চিহ্নই থাকল না।

কী করত তখন সিদ্ধেশ্বরী? বলদেবের জন্য কাঁদবে? না সে উপায় নেই। সে এক বিভীষিকা! অনেক অনেক পরে একসময় সেই প্লাবনের জল নামল। তারপরেই শুকোতে শুরু করল অত বড় নদী। মাত্র কয়েকটা বছর… থাকল এক সরু  সোঁতা । দুপাশে আবার ঘন হল জঙ্গল। আবার বুনো জীবজন্তু। ওরা তিনবোন শুধু ভূতের মত তিন বাড়িতে।

ঐ সরু সোঁতায় নৌকা চলল অনেক অনেক বছর পর। দুপাশে বসল দু-একটা গ্রাম। ছোট্ট এক খেয়ার পারাপার শুরু হল।  তার মাঝি বলত, সাতগাঁ থেকে ঘুরে আবার নিজের খাতে ফিরে গেছে ভাগীরথী। নতুন সোঁতা নাম নিল গড়িনী। তার সরু সরু স্রোতের সাথে আরও কত মুখোশ এল। দুচার ঘর মানুষও এল।  কত মানুষ-মুখোশ সিদ্ধেশরীর সাথে থাকল, চলে গেল। সবার কথা আজ আর মনে পড়ে না। কিন্তু সেইসব দিনগুলোতেও সব শান্তই ছিল। সারাটা দিন দাঁড়িয়েই সে সবাইকে দেখত। রাত্রিবেলা এইঘরটায় পড়ত মোটা কাঠের আগল। তারপরে ঘুমোত সে। খোলা জানালা দিয়ে ঘরে আসত গড়িনীর মিঠে বাতাস।

                                                                                   ৩


মনে হয় এই সেদিন। তাও অনেকদিন আগে। এক টুকটুকে লাল মুখোশ এল। তখন তাদের খুব জোর। তারা অচেনা ভাষায় কথা বলত। অনেক কুলি কামিন লাগাল সে। তার নাম নাকি টালি! বাপ রে...টালি, খোলার নাম কেউ দেয়! খুব হাসি পেয়েছিল সিদ্ধেশ্বরীর। কিন্ত এলেমদার লোক সে। সরু গড়িনীকে কেটে চওড়া খাল বানাল। আবার নৌকা, মানুষজন, বাণিজ্য। একসময় আর জঙ্গলের কুটোটুকুও থাকল না। মেলা জায়গার লোকজন এসে বসছিল তখন। ঐ সময়েই এল লক্ষ্মী হালদার। বড় একটা মুখোশে ঢাকা ছিল তার মুখ। বেঁটে, হেটো ধুতি পরা লোকটা নৌকা থেকে নামল। কিছুক্ষণ তাকাল ওর দিকে। তারপরেই ভেউভেউ কান্না। স্বপ্নে নাকি সিদ্ধেশ্বরী ওকে ডেকেছে। সে থাকতে শুরু করল তার ঘরেই। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হত লোকটা। সবাই বলত ভর পরেছে। বাঁজা মেয়ের বাচ্চা, অম্লশূলের ওষুধ...অনেক ফিকির জানত সে। কিন্তু তার আসল ফিকির ছিল অন্য।

 মাঝরাতে, গায়ে কালি মাখা দশ-বারোজন ষন্ডা নৌকা থেকে নামত। তাদের নিয়ে সিদ্ধেশ্বরীর কাছে আশীর্বাদ চেয়ে লক্ষ্মী বেরিয়ে পড়ত। সিদ্ধেশ্বরী বুঝতে পারত মুখোশের দলের কীর্তি। জমিদারদের কানেও উঠছিল কথাটা। তখনই একদিন সে বলতে শুরু করল। আবার নাকি তাকে সিদ্ধেশ্বরী বলেছে স্বপ্নে। গাঁয়ের সবাই রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোক।কোনো ভয় নেই। সিদ্ধেশ্বরী এই ঘাটে নিজেই পাহারা দেবে। সেই শুরু হল। মাঝরাত পর্যন্ত সিদ্ধেশ্বরীকে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। লক্ষ্মী আগল টেনে বেরোলে তবে সে  শুতে পারত। তখন থেকেই ওর দুর্ভাগ্যের শুরু। একরাতে লক্ষ্মী বেরোল। আর এল না। তারপর  লক্ষ্মীর ছেলে নিল ওর থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব। তারপর নাতি।

এখনও লক্ষ্মীর বংশই ওর থাকা খাওয়ার দায়িত্বে। এখন আর তাদের গলা উচিয়ে বলতে হয় না যে এই গাঁ রক্ষার সব দায় সিদ্ধেশ্বরীর। সবাই সেকথা জানে। কালে কালে, কীভাবে জায়গাতার নামই হয়ে গেল...সিধপুর। আজ,  কালো ধোঁয়া, ধুলো, সামনে পেছনে লোহার ছোটবড় গাড়ির একটানা দৌড়, খিস্তি, গালাগাল, নেশা, হিংসা, ঝুটো দেখনদারিতে...গমগম করছে সিধপুর।মাথা গুলিয়ে যায় মাঝে মাঝে ওর। এত মুখোশ আসে তার কাছে! সবাইকে লক্ষ্মী হালদার মনে হয়। তারপর ভুল ভাঙে। নাহ্‌...লক্ষ্মী তো এতটা...এমন ছিল না! সে তো একটু হলেও ওকে রাতে ঘুমোতে দিত। পাটা-কোমরটা জিরোতে পারত। এক এক দিন ভোররাতে সে খুলে ফেলত মুখোশটা। তারপর সেই ভেউভেউ কান্না...ক্ষমা করে দে...ক্ষমা করে দে।

অনেককাল এইভাবে কাটল! যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারে না সিদ্ধেশ্বরী! আর তারপরেই আসল সেই দিনটা। কুচকুচে কালো একটা দিন। ও বুঝল অসহ্য যন্ত্রণা কাকে বলে।  সেই দিনটা চলে গেলে মনে হয়েছিল আর তাকাবে না সামনে! যতদিন থাকবে দুচোখ বন্ধ করে জেগে থাকবে। তারপর থেকেই ওর ঘরের পুরো আগলটা উঠে গেল।  ফাক ফাক লোহার শিকের দরজা বসল। সারাটা রাত প্রদীপ আর সাদা বিজলির বাতি। প্রত্যেকটা পল তাকিয়ে থাকতে হয় ওকে। সবাই ভাবে খালের দিকে পিঠ করে এলাকার দিকে যতক্ষণ ও তাকিয়ে থাকবে ততক্ষণ কোনো বিপদ হবে না। অথচ সেদিন তো প্রথমে ও পারেনি! আসলে ও নিজে কিছুই করতে পারেনি। ভোরের কাক ডাকার আগে খাল পেরিয়ে বড় বড় রামদা, সড়কি, মশাল ঢুকছিল এপারে। সেই আলিসাহেবের দখল হওয়া জমির কষ্ট ভুলতে না-পারা কিছু মানুষ আগে আগে। পেছনে গোঁফছাড়া দাড়িওলা ষন্ডার মুখোশ অগুনতি । তখন, মেজর বাড়ি পেরিয়ে আরও কিছু দূরে বসতি।

ওরা প্রথমে মেজর বাড়িতে ঢুকল।  একেএকে গয়নাগাটি,টাকাকড়ি কেড়ে নিল। মেজকে খুঁজছিল ওরা। কিন্তু আগেই বুঝে মেজ গিয়ে লুকিয়েছিল। তার বরের একটা ভাঙা ঘরের কোনে। তারপর সারা বাড়িতে ওরা আগুন লাগিয়ে দিল। আওয়াজ উঠছিল…লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। আগুনের হলকা দেখে তারপর ছুটে এল চার-পাঁচটা গাঁয়ের মানুষ। সে কি রক্তক্ষয়, মানুষের কাটা মুন্ডু, হাত, পা!না , একটাও মুখোশের ছিল না…একসময় ওপারের ওরা পালাতে শুরু করল। এই ঘাটের কাছে এসে ওদের বড় সর্দার কাদায় পিছলে পড়ে গেল। কয়েকটা মুখোশ তাকে ধরে নিয়ে গেল ঐ সামনের হাড়িকাঠে…ওহ্‌! পরদিন থেকে ওর ঘরে ভিড় আরও বেড়ে গেল। ও খুব জাগ্রত! মহাবিপদ থেকে ও রক্ষা করেছে পুরো অঞ্চলকে। মহাশত্রুর বিনাশ হয়েছে ওর হাতে!



                                                                                   ৪

সিদ্ধেশরী এখন আশাই ছেড়ে দিয়েছে। আর মনে হয় ও ঘুমোতে পারবে না। দুপায়ের, কোমরের আর দুচোখের কষ্ট তাকে সহ্য করেই যেতে হবে। ওর চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে। কিন্তু তারপরেই বিচ্ছিরি তাপ আসে। পেছনের টালিনালার  ওপরে বসেছে নোংরা জল পরিস্কার করার বিদ্ঘুটে কল। সেটা চলতে শুরু করলে ঐ বিচ্ছিরি তাপ বেরোয়। সেই তাপে দুচোখের জল শুকিয়ে যায়।

হঠাৎ করেই একদিন ওর মনে হল। দিন যেন এবার পাল্টাবে! হালদারদের বুড়ো ঠাকুরদা সেদিন  ওর পায়ের কাছে বসে গলা ছেড়ে কেঁদেছিল। আর তারপরেই ওর মনে হল। এবার পাল্টাবে সব… পাল্টাবেই। খালপারের  এই ঘরটা নাকি আর থাকবে না।ঘরটাই শুধু না পুরো এলাকাটাই তো আসলে সেই তহশীলদারদের।  এতদিনে  তার বংশের ছেলেরা সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে। এখানে এই বড় পাকা সড়কের ওপর তারা অনেক বড় প্রাসাদ বানাবে! সিদ্ধেশ্বরীকে তারা তাড়িয়ে দেবে? অন্য কোথাও যেতে হবে? বাহ্‌… সেখানে গেলে ও যদি একটু জিরোতে পারে!আর যদি মুখোশ না দেখতে হয়!  একটুও মন খারাপ হল না ওর।

কয়েকদিনের মধ্যেই  তারা এল। তারপর সামনের চত্বরটাতেই দাঁড়িয়ে হালদারদের পুরো গুষ্ঠিকে কথা দিল। সিদ্ধেশ্বরী সবাইকে বাঁচায়। তাই একটা সুন্দর ঘর বানিয়ে দেবে তার জন্য। আর বাকি জায়গাতে, তাদের অট্টালিকা হবে। হালদাররাও ঘর পাবে সেখানে।  আড়ালে গিয়ে আরও কিছু বলল তারা।  হালদাররা খুব খুশী।

 কিন্তু অদ্ভূত হালদারদের মুখে হসি আসল না। কালিতে কে যেন লেপে দিল ওদের মুখোগুলো। একটা চৌকি পেতে কিছু মুখোশ বসে পড়ল চত্বরটায়। এটা সিদ্ধেশরীর জমি। এখানে শুধু সিদ্ধেশ্বরী থাকবে। আর কেউ না! হিন্দুর দেশে এ অন্যায় তারা মানবে না। তারা দিনের বেলার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে বসে রইল। কয়েকদিনের মধ্যে ওদের সামনে ভিড় হতে শুরু করল । এমন হল! সড়ক দিয়ে গাড়ি যাওয়াই বন্ধ! সারাদিন শুধু কালো কালো মাথা। আস্তে  আস্তে মন্ত্রী, সান্ত্রী সবাই আসতে শুরু করল। কয়েক হপ্তা যাওয়ার পর বড় মন্ত্রী এসে বলল-সিদ্ধেশ্বরীর এই ঘরই থাকবে। তাকে কোথাও যেতে হবে না। অনেক মালা পেল সেই মন্ত্রী। তার মুখের চওড়া হাসি মেলাচ্ছিল না। মুখ কালি হওয়া মুখগুলো দুধ খেল। মন্ত্রী, সান্ত্রী, পুলিশ,মুলিশ সব চলে গেল।  ফের মন ভাঙল সিদ্ধেশ্বরীর। চলে যাওয়া হল না। মুক্তি নেই।  বুকের ভেতরটা ফাকা লাগছিল।  তার সাথে কেমন গুরগুর করছিল।  বাইরে থেকেও ভেসে আসছিল একইরকম একটা অদ্ভূত আওয়াজ। চত্বর পেরিয়ে লম্বাটে উচু বাড়িগুলোর মাথা ছাড়িয়ে টুকরো টুকরো আকাশের দিকে তাকাল।  সন্ধে পেরিয়েছে।  গরম এক হলকার সাথে থমথমে মেঘে ছেয়ে আছে গোটা আকাশ। হরেক রকমের বিজলির আলো মশে সেই আকাশ ফ্যাকাশে ধোঁয়া…ধোঁয়া।


মাঝরাতের পর ঝড় উঠল। এমন ঝড় বহু যুগ দেখেনি ও! চত্বরে থেকে যাওয়া একমাত্র বুড়ো আমগাছটা উপড়ে পড়ল…এক লহমায়। হাওয়াতে ওর গায়ের কাপড় থাকছিল না। ওকে মেজ, ছোটর মত দেখতে না মোটেও। তাই কেউ না থাকলেও ওর লজ্জা করছিল। ঘরের সব কিছু, বাসনপত্র, ঘন্টা-কাঁসর এমনকি ঐ গয়নার সিন্দুকটাও নেচে বেড়াতে লাগল। একটু বাদেই বিজলির বাতিগুলো ঝুপ করে হারিয়ে গেল। শেষ কবে এমন হয়েছিল! মনে করতে যাবে সিদ্ধেশ্বরী। তখনই দেখল। বেশকটা সরু সরু বিজলির হাতবাতি ঢুকে পড়েছে ওর ঘরে। ওরা কি গয়না রাখা  সিন্দুকটা ভাঙতে এল? না তো…ওরা যে ওর দিকে এগোচ্ছে। ওরা কি শেষ পর্যন্ত ওকেও…হায়, হায় বলদেব কেন ওকে এইভাবে বানিয়েছিল।  মুখোশগুলো লোহার চেন দিয়ে ওকে বেঁধে ফেলল।

     
  ৫

               
ঝড় থেমেছে অনেক্ষণ! এখনও ভোর হয়নি। মলমূত্র, আবর্জনা আর জঞ্জালের বোঝার নীচে, খালের পচা কাদায় উপুড় হয়ে পড়ে ছিল সিদ্ধেশ্বরী। বহু বহু কাল পর ওর দুচোখ বোজা। দুটো পা-কোমর টানটান।  ও চাইছে কেউ যেন ওকে আর খুঁজে না পায়। এভাবেই যেন ও থাকতে পারে।যুগের পর যুগ। আর ঠাঁয় ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। এই দুর্গন্ধ…গা গুলোনিকেও আজ কী যে ভালো লাগছে! আর দেখতে হবে না মুখোশদের। কী অদ্ভূত! সকালের সেই মুখোশগুলোর কয়েকটাও ছিল হাতবাতি নিয়ে। ওর বলছিল…শালি কী ভারি রে! তোলা যাচ্ছে না। গাড়ি ফাড়ি নেই…কোথায় গিয়ে ফেলব…শেকল ধরে টানছিল আর বলছিল? ওরে সিদ্ধেশ্বরী তোকে…


কীসব গুঁজে দিয়ে আগুন জ্বালাচ্ছিল ওরা। ভয়ঙ্কর আওয়াজ…ঝড়ের আওয়াজও তাকে চেপে রাখতে পারছিল না। কোনযুগের দেয়ালগুলো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছিল। ভেঙে পড়ার সময়, কোন আওয়াজটার জোর বেশি! এই শব্দ… নাকি যা কানে আসছিল। সিদ্ধেশ্বরীর দিব্যি…এমন সাইকোলোন তিনশো বছরেও আসে নি…পনেরো দিনের কী প্ল্যানিং মাইরি…দোষ খেলে খা, আলির বাচ্চা, তোদের জমি,কুড়ি পার্সেন্ট খাবি। তোরা নাকি শোধ তুলবি…খাবি না! খা শালা খা...হ্যা, হ্যা, হ্যা…ওহ্‌ কী পেলান মোনতিরির! ওরে সিদ্ধেশ্বরী তোকে… এই প্রথমবার বলদেবকে অভিশাপ দিয়েছিল সিদ্ধেশ্বরী। কেন ওর  দুটো কান থাকল…কেন, কেন! খালের কাদা আশ্রয় দিলে শান্তি পেল ও। সব শোনার থেকে…সব দেখার থেকে। এবার ওর মুক্তি…মুক্তি…শান্তি।



  ৬

 না কাদা মেখেও মরার মত ঘুম এল না সিদ্ধেশরীর। ওর ঘরটা এখন  রঙচঙে পাথরের। শুধু চুড়োটাই পঞ্চাশ হাত। মাথার ওপর সোনার জলে লেপা কলসি বসানো। এখন আর একটা ঘর নেই। পুরো চত্বর জুড়ে বিশাল বাড়ি। সারা বাড়িজুড়ে গেরুয়া পতাকা...ওঁ লেখা...পতপত করে উড়ছে হাওয়ায়। হালদাররা পালিয়েছে। হিন্দি বলা, টিকি মাথার এক মোটা বুড়ো রোজ ওকে খাওয়ায় পরায়। চেনাজানা কেউ আর সাথে থাকে না। না ভুল বলা হল। মুখফোলানো লেজওয়ালা এক বিশাল পুরুষ অবিশ্যি ওর পাশে এসেছে। তাকেও দিনরাত ওর মতই পুরু কাঁচের দরজার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে থাকতে হয় সামনে। সিদ্ধেশ্বরী বুড়ি হচ্ছে। তার ক্ষমতা কমছে। এলাকাটাকে আর একা রক্ষা করতে পারছে না ও। কোনোমতে সে নিজেকে বাঁচাচ্ছে। তাই উনি...

টনটন করতেই থাকে সিদ্ধেশ্বরীর কোমর, হাঁটু, গোড়ালি, পায়ের পাতা...চোখ ঢুলে আসে। মাঝরাতে পাশের উনি বলে ওঠেন...ঔর কিতনে দিন এই নাকাবো কে বিচ রেহেনা পড়েগা রামজি!  এখন  আর একটামাত্র সাদা বিজলির আলো না। অনেক...  অনেক...অগুনতি, হলুদ, সাদা...ছোট বড়, বিজলির আলো জ্বলে সারা রা...রাতভোর।


5 comments:

  1. জনপদগাথা!মানুষী-ঈশ্বরের অসহায়গাথা!

    ReplyDelete
  2. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  3. খুব সুন্দর লেখা। ভালো লাগলো। ❤️❤️

    ReplyDelete