Monday, December 31

গল্প : হরেন্দ্রকুমার ঘোষ





ইচ্ছে পূরণ


সায়ন্তন ওরফে সান্টু উইকএন্ডেও কোন না কোন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। ব্যস্ত থাকাটা একটা বাতিকের মতন। বর্তমান এই বাতিকের নাম 'অ্যাকসেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট'। ক্লাসে যাবার উদ্দেশ্যে সান্টু শেয়ার ক্যাবে চড়ে বসলো। খানিকটা এগোনোর পর উঠলো এক ললনা। পরস্পর হ্যালো বলতেই সান্টুর দুনিয়া উথালপাথাল হয়ে গেল। প্রবল এক ঢেউ সান্টুকে প্রায় এক যুগ আগেকার স্মৃতির তটে আছড়ে ফেললো।
সান্টু তখন সদ্য ক্লাস টেনএ উঠেছে, সেসময় ক্লাস নাইনে ভর্তি হ'ল দ্যুতি। অসহ্য রকমের সুন্দর দ্যুতির ছটায় উঁচু ক্লাসের তাবড় তাবড় ছেলেদের ঝলসে যাবার মতন অবস্থা। ওর দৃষ্টিতে পড়ার জন্য সকলের পোশাক আশাকের চাকচিক্য বেড়ে গেল, বদলে গেল চুলের স্টাইল। দ্যুতির সামনে সকলেই নিজের নিজের প্রতিভা জাহির করাতে ব্যস্ত। সান্টু এর ব্যতিক্রম হবে তাতো হয়না ! তবে স্বভাব ভীরু সান্টু বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারলোনা। শেষমেষ সান্টু যে উপায়টি করলো সেটা হ'ল আত্মঘাতী।  দ্যুতির স্কুলে যাবার রাস্তাটি সান্টুদের বাড়ির সামনে দিয়ে গিয়েছে। গর্বিনী দ্যুতি যখন রাস্তা আলো করে হেঁটে যেত সান্টু তখন খানিকটা দূর থেকে চাতকের দৃষ্টিতে দ্যুতিকে দেখতে দেখতে অনুসরণ করতো। মাঝেমধ্যে দ্যুতি পেছন ফিরে দেখেছে। তাতে সান্টুর সাহসটা যখন একটু বাড়ার মুখে তখন সান্টু আর এক রুস্তমকে দেখতে পেল যে প্রায় দ্যুতির গায়ে গায়ে হেঁটে দ্যুতিকে অনুসরণ করছে। একদিন দেখলো দ্যুতি হাত উঁচিয়ে ছেলেটি কিছু বলছে। সান্টুর মনে হ'ল ছেলেটি জোরাজুরি করছে, নিশ্চই মতলব খারাপ। ভীরু সান্টুর ভেতর শিভালরি জেগে উঠলো। দ্যুতির নজর কাড়ার চমৎকার সুযোগ। সান্টু দৌড়ে গিয়ে সান্টুর চেয়ে দ্বিগুণ বলবান ছেলেটির কলার চেপে ধরে বললো, " কী দাদা, বেপাড়ায় এসে হীরোগিরি, ইভ্ টিজিং ? " তারপরই একটা পটকা ফাটার জোর শব্দ। সান্টুর চোখে অন্ধকার, সান্টু বোধবুদ্ধিহীন ভাবে হাতপা চালিয়েছিল বটে কিন্তু সেগুলো কেবল হাওয়া কেটে বেড়িয়ে গিয়েছিল। এরপর অন্যান্যরা যখন দুজনকে ছাড়িয়ে দিয়েছিল তখন দেখা গেল সান্টুর কষে রক্ত, নাকে রক্ত আর কপালে একটা আব।  ব্যাপারটা এখানেই শেষ হ'লনা। প্রিন্সিপালের ঘরে সান্টুর তলব, কিছু বাক্যবাণ এবং বাবার নামে একটা চিঠি। চিঠিটা বাবাকে দেখানোর পর আর একপ্রস্থ বর্ষণ (প্রহার এবং বাকবাণ দুইয়েরই)।
এতক্ষণ সিনেমার দৃশ্যের মতন পুরণো ঘটনাটা সান্টু দেখতে পাচ্ছিলো। অনেক দিন ধরে পুষে রাখা জখমটা থেকে একটু রক্তপাতও হ'ল যেন। ইতিমধ্যে সান্টুর গন্তব্য এসে গেল। ওয়েভ করে সান্টু ক্যাব থেকে নেমে পড়লো।  সেদিন রাতে সান্টু এবং ক্যাবে দেখা মেয়েটি(আদতে দ্যুতি),দুজনেই ফেসবুক সার্চে লেগে গেলো, ফলে উভয়ের মধ্যে পরিচয়ের সংশয় টুকুও দূর হ'ল। তারপর দুজনের মধ্যে শুরু হ'ল ঝর্ণা ধারার মতন চ্যাটিং ধারা। এদের অফুরান গালগল্পের কথা এই অণুকথনে লেখার উপায় নেই। অতএব গুটিকয়েক সার বার্তালাপ উল্লেখ করা হ'ল °° °° °° °° °° °° °° °° °° °° °° °° --- বীরবিক্রমে মার খেয়ে উধাও, তারপর এক দশক বাদে ভোজবাজির মতন দেখা হ'ল। তা এই 'আই টি' শহরে কী করা হয় ? --- সকলে এখানে যা করে আমিও তাই করি , আই টি কোম্পানির চাকরি।  --- কতদিন আগে এখানে আসা হয়েছে, আর থাকা হয় কোথায় ?  --- বছর চারেক হ'ল এখানে এসেছি। যেখান থেকে তুমি ক্যাবে উঠলে, প্রায় সে জায়গার কাছাকাছি থাকি। --- আশ্চর্য ! আমিও তো প্রায় ওরকম সময় থেকেই ওখানে রয়েছি, চাকরিও তোমার মতনই। একই জায়গায় রয়েছি অথচ এতদিনের মধ্যে একবারও দেখা হয়নি !  --- দেখা না হয়ে ভালই হয়েছে। আর এক দফা মার খাওয়া থেকে রেহাই পেয়েছি, তাইনা ? --- সেই দিনের মারটা কিন্তু তুমি নিজের দোষেই খেয়েছিলে। একে তো পিছু নিতে তার উপর আগুপিছু না ভেবে ওরকম বীরত্ব ফলাতে গেলে ফলতো ভুগতেই হবে। --- তখন কী আর জানতাম যে মারমুখো পালোয়ান লোকটা তোমার দাদা !  তবে প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ করাটা আমার পক্ষে শাপে বর হয়েছিল। ক্ষিপ্ত বাবা আমাকে একেবারে দেশান্তরী করে ছেড়েছিল। সেই জন্যই হয়তো পড়াশোনটা চালিয়ে এই চাকরি অবধি পৌঁছতে পেরেছিলাম। --- বাঃ ! ভালইতো, তোমার জীবনে আমারও কিছু অবদান রয়েছে ! সেসব ঠিক আছে কিন্তু নব কার্তিকের মতন চেহারা নিয়ে এখনও সিঙ্গল্ স্ট্যাটাসে রয়েছ কেন ? --- সেই ঘটনা থেকে আমি বড্ড ভীতু হয়ে গিয়েছিলাম যে। আর সিঙ্গল্ স্ট্যাটাস আমার একারই বুঝি ? --- অভয় দেবার মতন কাউকে এতদিনেও পাওনি ? --- না পাইনি, তবে মনে হচ্ছে এবারে পেয়ে যাব। তোমার কী মনে হয়, পাব ? --- হুঁ আমারও সেরকমই মনে হচ্ছে। অভয়টা দিয়ে দেওয়াই উচিৎ। আহত মুখের স্মৃতিটা বড্ড জালাতন করে যে ।


1 comment: