Monday, December 31

গল্প : সুবল দত্ত






সম্পর্ক     

                                       
হাসপাতালের বিশাল প্রাঙ্গণে গায়ে গায়ে ভীড়। এই এক হাসপাতাল ভারত ও প্রতিবেশী দেশ থেকে ঠকে হেরে অল্পে আরোগ্য হওয়া রুগী ভুল বা অবহেলিত চিকিৎসায় জটিল আশাহত হয়ে এখানে আসে আরোগ্যের কামনায়। বাংলাদেশীয় ভাষা উর্দু মেশানো হিন্দী উত্তর বিহার মানভূম ওড়িয়া তামিল তেলেগু ভাষায় মিশ্রিত কোলাহল। ধর্মের কট্টরতা ভুলে এক বেডে রোগ নির্ণয়। কালো সাদা সুন্দর অসুন্দর বিচারের অহংকার এখানে অবাঞ্ছিত। লোভ চোরা কাম ঘৃণা নেই পরবাসে অস্বস্তি নেই শুধু যন্ত্রণার ভিড়ে নিজেকে সমর্পিত করে প্রতিক্ষা আর প্রতিক্ষা।
       ওপিডিতে ঢোকার জন্য মলিনা বিশাল লম্বা কিউ এ । পিছনে জামাইবাবু । মলিনার হুইলচেয়ার ধরে। কাঁধে হাত। মলিনার কোলে রাখা ক্যাথিটার বেয়ে লাল রস। বুকে ব্যান্ডেজের বর্ম। হাসপাতালে আয়োডোফর্মের তীব্র গন্ধের সাথে এক ঝলক পদ্মের সুরভি পেল সে।   আকাশে ফিট সাদা পেঁজা মেঘ সিংহ হয়ে ছুটছে। অনেক বছর স্বামী বিতাড়িত হয়ে পূজো ভুলেই ছিল ।বাপের বাড়ির কেউ বেঁচে নেই। মায়ের কি ইচ্ছা । সব অচেনা কষ্টের আনন্দ ও আনন্দের কষ্টগুলো কি শুধু মলিনার? সুখের মুখ কি দেখতে পাবো না?
এই ভিন পরিবেশে অসুখী দেহে মনে জোর জবরদস্তি দেবী মা আসতে চায়। অভিমানী মলিনা মন শক্ত করে পূজোর চিন্তা দূর দূর করে তাড়ায় কিন্ত তক্ষুনি মাথার ভিতরে জয়ঢাক বেজে ওঠে ।
      হঠাৎ করে পিছন থেকে একটা জোর ধাক্কায় মলিনার হুইলচেয়ার সামনের কালো বোরখা পরা একজনের পিছনে ধাক্কা মারতে সে টাল সামলাতে না পেরে মলিনার কোলে বসে পড়ল । সে তখন তার হাতে সিকিউরিটি গার্ডের কাছে থেকে হাসপাতালের ব্যান্ড পরছিল। গার্ড সংগে সংগে তার হাত ধরে টেনে ওঠালো। বোরখা পরা মেয়েটা মোটেও রাগলো না। মলিনার দিকে তাকিয়ে হাসলো । মলিনা ওর মুখ দেখে চমকে উঠল। মেয়েটা হুবহু তার মতন দেখতে। সেই নাক চোখ মুখ গায়ের রঙ। মলিনা যেন আয়নায় নিজের মুখ দেখছে। সে দেখল মেয়েটা একটা হুইলচেয়ার ধরে আছে। তাতে বসে সাদা টুপি পরা মেহেদী দাড়িওলা এক রুগী। কোলে তিন রঙের তিনটি ক্যাথিটারের পাইপ । সাদা হলুদ ও লাল। গার্ড ওদের হাতে ব্যান্ড পরায়। মলিনার হুইলচেয়ার ঠেলে জামাইবাবু লিফ্টে করে দোতলায় স্ক্যান রুমের ওয়েটিং হলে আসে। মলিনা দেখে এখানে পঞ্চাশ জনের উপর মানুষ বসে। প্রত্যেকের মুখ যন্ত্রণাক্লিষ্ট। কেউ ভাবী যন্ত্রনার কথা ভেবে আর কেউ দেহ যন্ত্রণায় । প্রত্যেকের সাথে এক দুজন আপনজন। কষ্ট উপশম করতে কষ্ট সহভাগী হয়ে আরোগ্যের জন্যে। জামাইবাবু রুমাল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিল চুল ঠিক করে দিল। এই স্নেহ স্পর্শে চোখ বুজে এল মলিনার ।
-আপনেরা কি বাংলাদ্যাশ থাইক্যা আইসেন?
চমক ভাঙ্গলো মলিনার। দেখল সামনের একটা চেয়ারে বসে সেই বোরখা পরা মেয়েটি। হুইলচেয়ার বসে মলিনা মাথা নাড়ল। - নাঃ আমি বর্ধমান থেকে এসেছি । - সাথে আপনের স্বামী বূঝি? মলিনা মুখ নিচু করে ঘাড় নাড়ল। - তবে উনি কেডা হন? - জামাইবাবু । ইতস্তত করে মলিনা বলেই ফেলল। একটু বিরক্ত । অন্যের ব্যাপারে এত আগ্রহ কিসের? মলিনা অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য চাকা ঘোরালো। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে মলিনার হাঁটু ধরে থামালো আর কাছে টানল। - জামাইবাবু মানে? আপনের দুলাভাই? আপনের দিদিভাই কই? মলিনা মাথা নাড়ে। দেখে মেয়েটি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে । অস্বস্তিতে চোখ নামিয়ে নিল মলিনা ।ও যেন ওর সব কিছু পড়ে নিয়েছে। মেয়েটি মলিনার হাত চেপে ধরল। -তুমাকে তুমি করেই বলি। কিজানি মনে লাগে তুমার সবই আমার মতো। জানোতো এমনই হয় । ওই তো। দ্যাখো আমি একাই আমার চাচাজানকে লইয়া আইলাম। ওনার কেউ দ্যাখার নাই আমারও নাই।
    মেয়েটি মলিনার মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে। - জানোতো ও আমার দুশমন। কিন্ত আমার দ্যাখভাল ও একাই কইরাসে। আমার দুইটা কিডনিই নষ্ট হইয়া ছিল । ইন্সাল্লাহ। আল্লার মেহেরবানিতে ওই চাচা জানের কিডনিতে আমি বাঁইচা আসি।
- ও ওনার একটাও কিডনি নেই বুঝি। তাই উনি অসুস্থ? মলিনার সরল বোকা প্রশ্ন। - না না। উনার গুপ্ত অঙ্গে অসুখ। হঠাৎ যেন পরিবেশ পরিস্থিতিতে সজাগ হয়ে উঠল মেয়েটি। - আরে, আমি তো তোমার নাম জিগাই নাই। কি নাম গো তুমার? তুমি খুব সুন্দর।এক্কেবারে আমার মত। আমার নামটা বলি? আমি আমিনা। আমিনা বিবি। কি হইয়াসে গো তুমার? মলিনা নাম বলে কিন্তু তার অসুখের কথা বলতে গিয়ে চুপ করে যায়।আমিনা নিজেই উত্তরটা দেয়। - কি আর অসুখের কথা কইবা। এখানের যত মানুষ আছে সব নুংরা রুগী । এখানে তো এতো ভীড় আমারে যে কয় ঘন্টা পর ডাকবা কে জানে । মেয়েটি একবার টোকেন ডিসপ্লে বোর্ডের দিকে তাকায় আর ক্লান্ত গলায় তার চাচাজানের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে। মলিনার সারা শরীর হিম হয়ে এল। মনে হল তার চারপাশে যত অসুস্থ মানুষ অপেক্ষারত সবারই তার মতন যন্ত্রণাক্লিষ্ট দেহ ও জীবন ইতিহাস । এই আমিনারও কি সেই পোড় খাওয়া অতীত? আর ওই মানুষটির সাথে কি তার ভক্ষক রক্ষকের সম্পর্ক? কে জানে।
          মলিনা চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখে একজন প্রৌঢ় লম্বা হিমাচলি মানুষ আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছে টয়লেটের দিকে। সাথে সাথে এক মহিলা লোকটির পেচ্ছাপের ক্যাথিটার বয়ে নিয়ে চলেছে । লোকটার হাতে মোবাইল। মোবাইলে আনন্দ সঙ্গীতে তার মাথা নড়ছে। একটা হাত মহিলার কাঁধে। আঙুল গুলো তার কাঁধে তাল দিয়ে চলছে । মলিনা মুখ নিচু করে ম্লান হাসলো। ঈশ্বর কত রকমের যে সম্পর্ক গড়েছে তার কূল নেই। মনের সাথে মনের। দেহমনের একরকম অনুভূতির সাথে অন্য অনুভূতির। মনের সাথে দেহের। আবার এক মানুষের সাথে অন্যের।
      আমিনা মলিনার হুইলচেয়ার নিজের কাছে টেনে নেয়। ফিসফিস করে বলতে থাকে। - তুমার জেবনে কি সমস্যা জানিনা। ইন্সাল্লাহ তুমাকে আমার ভীষণ ভীষণ ভালো লাগসে। তুমার মুখখান যেন আমারটা বসানো । আমি যেন আরশিতে আপন মুখ দেখতাসি। তুমাকে আমার ভালমন্দ সকল কথা বলতে ইচ্ছা করসে। আমিনা তার অতীত ফিসফিস করে বলতে লাগল। মলিনা মুখ নিচু করে আমিনার অতীত জীবন যেমন যেমন শুনতে লাগল তেমনি তেমনি নিজের যন্ত্রণাময় স্মৃতি পরত পরত তার চোখের সামনে ফুটে উঠতে লাগল।




No comments:

Post a Comment