Monday, December 31

অণুগল্প : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়













অপেক্ষার রঙ


          শ্যামল বসুর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করার মাস দুয়েক পর থেকে রোজ সকালে একটা করে মেসেজ আসতে থাকে। প্রথম প্রথম দু একদিন অন্তর অন্তর। তারপর থেকে রোজ।

          সকালে উঠে চোখ খুলেই বিদিতা অনলাইন হয়ে দেখত ------ " তোমার সকাল, আমার সকাল / তোমার চোখেই দেখি সকাল / তোমার খুশিই আমার সকাল।" আবার কখনও লিখত ------ " তুমি সকালবেলার ফুটে ওঠা ফুল / সুবাস ছড়াও সবখানে।" এর উত্তরে কত কিছু লিখতে ইচ্ছা করত বিদিতার। কিন্তু সব কথা শেষ পর্যন্ত সাজিয়ে উঠতে পারত না বিদিতা।

          বিদিতাকে নিয়ে কেউ কোনদিন কবিতা লেখে নি। তাই এটা তার কাছে একটা অন্য প্রাপ্তি। কিছু লিখতে গেলেই মাথায় হাজার কথা ভিড় করে আসে। একটা কথার গায়ে আর একটা কথা চেপে বসে। শেষপর্যন্ত আর কিছু লেখা হয়ে ওঠে না। পাঠিয়ে দেয় শুধু এক শব্দের মন্তব্য ------ " দারুণ ", কখনও " অসাধারণ ", আবার কখনও " অপূর্ব " ।

          বেশি কথা বলে নি, একদিক থেকে ভালই হয়েছে। কে না কে ! শ্যামল তার প্রোফাইল পিকচারে কখনও পাখি, কখনও ফুল, কখনও প্রজাপতি, আবার কখনও নিসর্গ। তাই শ্যামল বসু কে, কোন বয়সের কিছুই বিদিতা জানে না।

          অবশ্য বিদিতা নিজেও তার প্রোফাইলে নিজের ছবি দেয় নি। অ্যাকাউন্ট খোলার দিন থেকে আজ পর্যন্ত সেই একটিই ছবি ---- বৃষ্টিভেজা কলকাতার একটি রাস্তা।

          প্রোফাইলে নিজের ছবি দেওয়া না দেওয়া নিয়ে শ্যামল একটা অসাধারণ কথা বলেছিল ----- " আমি চাই কথা দিয়েই পরিচয়ের বন্ধন দৃঢ় হোক। এতে মনের ধৈর্য্যও অনেক বাড়ে, বাড়ে কল্পনাশক্তি। আমার ভালো লাগছে তুমিও আমার মতো একই পথের পথিক। "

          না, বিদিতা মোটেই শ্যামলের ভাবনার সঙ্গে একমত নয়। সে ভয়ে তার ছবি দেয় নি। কারণ কম্পিউটারের জোরে একটা ছবিকে কত কিছু করে দেওয়া যায়। কিন্তু তবুও বিদিতা তার আসল বক্তব্যকে শ্যামলের কাছে প্রকাশ করে নি।

          বিদিতার মনে হয়, শ্যামল আসলে কবি। তার দেখার চোখ কত আলাদা। একটা সাধারণ বিষয়কেও কত সুন্দর করে পরিবেশন করতে পারে। মানুষ মানে তার কাছে একটা মানবিক সত্তা। বিদিতা বরং তার ছবি দেখতে চেয়েছে কিন্তু শ্যামল একবারের জন্যও সেই কৌতুহল প্রকাশ করে নি।



                                      দুই


          আজ সকালে বিদিতা অনলাইন হয়েই কিছুটা চমকে উঠল। শ্যামল লিখেছে, " আজ একবার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে আসতে পারবে ? "

          " কেন ? কি হয়েছে ? "

          " তোমাকে একবার দেখব বিদিতা। "

          " কেন ? এটাই তো ভালো। "

          " না, ভালো নয়। যদিও তুমি যেটা ভাবছ সেটা নয়।"

          " মানে ? "

          " ওই যেরকম সবাই দেখতে চায়। অনেকদিন হল, আর তোমাকে না দেখে থাকতে পারছি না। আমার মনের মানসী এবার তার অবগুণ্ঠন খুলে ফেলুক ইত্যাদি ইত্যাদি। আমারটা কিন্তু সেরকম কিছু নয়। "

          " কিরকম ? "

          " আমি আমার সৃষ্টির উৎসবিন্দু দেখতে চাই। সে কোথা থেকে উৎপন্ন হয়েছে, উৎসবিন্দুটি কিরকম, কিভাবে কোথা দিয়ে যাচ্ছে তা আমার আলোচনার বিষয় নয়। "

          এরপর আর না করতে পারে নি বিদিতা। শ্যামলের কথা মতোই অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সামনে এসে দাঁড়াল। দুজনের কেউই কাউকে চেনার চিহ্ন বলে দেয় নি। শ্যামলই প্রথম বলেছিল, " আমরা খুঁজে নেব। " বিদিতা সমর্থন করেছিল।

          চল্লিশ বছরের জীবনে বিদিতা এই প্রথম কারও জন্য অপেক্ষা করছে। মায়ের মৃত্যুর পর সংসারে একমাত্র মেয়ে বলতে সে। তাই সংসার সামলে নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় সে আর পায় নি।

          অ্যাকাডেমির চারপাশে অনেক ঘোরাঘুরি করেও শ্যামল নামের কাউকে চিনে উঠতে পারল না বিদিতা। বাড়ি ফিরে এসে শ্যামলকে লিখল ----- " এই প্রথম নিজেকে আজকের মতো করে বাইরে আনলাম। চারপাশ কী ভীষণ মুখর ছিল। একবারের জন্যও নিজেকে একা মনে হয় নি। অপেক্ষার রঙ যে এত বৈচিত্র্যপূর্ণ হতে পারে তা আমার আগে জানা ছিল না। সত্যিই তুমি খুব সুন্দর। তোমার মাধ্যমে নিজেকে এইভাবে যে একদিন আবিষ্কার করব তা কখনও ভাবি নি। রবীন্দ্রনাথের সেই লাইনটার কথা খুব মনে পড়ছে, " আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া / বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া। "




                           ******************





No comments:

Post a Comment