Monday, December 31

অণুগল্প : অমর কুমার পাল


মূল্য 

  উত্তরবঙ্গগামী সরকারি বাসে উঠলাম শিলিগুড়ির উদ্দেশে । গাদাগাদি প্যাসেঞ্জারে দম বন্ধের উপক্রম । দাঁড়িয়ে থাকা প্যাসেঞ্জারের হাঁটুর গুঁতো বাড়ি ফিরে এক্স রে করানোর কথা ভাবায় ।
    বাস কন্ডাক্টর টিকিট চাইছেন প্রত্যেকের বিশেষত মেয়েদের ঘাড়ে, পিঠে হাত ঠেকিয়ে আলতো ছোঁয়া দিয়ে দিয়ে । শরীর স্পর্শ করা তাদের চাকুরীগত অধিকার । উত্তরবঙ্গে এটাই চল্ ।
    আমার কাছে একশত আশি টাকা নেবার পর সামনের থ্রি-সিটে উনি গেলেন । সেখানে একটি বছর সাতেকের মেয়ে জানালার পাশে বসে । এইদিকে বছর পঞ্চাশের একজন ও বছর পঁচিশের একজন মহিলা বসে । বেশ-ভূষায় দারিদ্র্যতার ছাপ তাদের তিনজনেরই ।
    ‘দুইজনে শিলিগুড়ির ভাড়া কত দাদা ?’
    ‘ওই বাচ্চাটারও লাগবে । আপনি তিনজনের মোট পাঁচ শ’ চল্লিশ টাকা দিন।’
‘পাআআচ শ’ চল্লিশশশ !’
‘ভাড়া বেড়ে গেছে দিদি । তেলের যা দাম ! জানেনই তো ।’
‘কিন্তু বাচ্চাটারও কি ফুল ভাড়া !’
‘ঠিক আছে আপনি পাঁচ শ’ দিন ।’
‘তাড়াতাড়ি করুন । অনেক টিকিট করা বাকি ।’
‘চাইর শ’ দিলে হবা নায় ?’
‘না ওর কমে হবে না । তাড়াতাড়ি করুন না ।’
ব্লাউজের ভেতর থেকে বের করে খুব কষ্টে বছর তিরিশের মহিলাটি ৫০০ টাকার নোটটি দিলেন । নিরাভরণ শরীরের মূল আভরণ ছিল যেন সেই নোটটি । বাস চলতে লাগল । তুলতুলে শরতের নরম রোদের পরশ মেখে আমি ঝিমোতে লাগলাম । কতক্ষণ সময় বয়ে গেছে জানি না । হঠাৎ এক বাদামওয়ালার চিৎকারে চোখ খুলে দেখি ডালখোলার ঐতিহাসিক জ্যামে আটকে ।
‘এই টাইমপাস, মম্ফলি, বাদাম, বাদাম ।’
‘মা বাদাম খাবো ।’
সামনের বছর সাতেকের মেয়েটি ওর মাকে বলল ।
‘ভাড়া দিতেই তো সব টাকা শেষ । হাজারবার কইনু তোক আসফা হবে না । তাহাও শুনবে না । টোটো ভাড়ার টাকাও নাহি এখুন ।’
‘অল্প কিনো না মা ।’
এই কথা শুনেই ক্ষিপ্রগতিতে মেয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় কসিয়ে দিল তার মা । চুলের মুঠি ধরে পিঠেও দিল ঘা কতক । অসহায় মানুষের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যেন । চোখ বুজলাম আমি । ভাবলাম, তেল না সন্তান—কার মূল্য অভাবের দিনে বেশি ? তেলেরই বোধহয় !     
            

3 comments: