Monday, December 31

গল্প : অমিতাভ দাস





সুবিমলের একদিন 


গত বছর এমনি এক জুন মাসের বৃষ্টিভেজা ভোর রাতে বাবাকে নিয়ে ছুটতে হয়েছিল । প্রথমে সরকারী হসপিটাল , তারপর বেসরকারী নার্সিংহোম । আজকেও জুন মাসের বৃষ্টিভেজা শেষ রাত । এম্বুলেন্সে মাকে নিয়ে চলেছে সুবিমল নার্সিংহোমের দিকে । পথে অবিরাম বৃষ্টি । কখনো কম কখনো বেশী ।

মায়ের কষ্ট হচ্ছে । বুকে চাপ চাপ ব্যথা । এম্বুলেন্সে শুয়ে যেতে পারছে না ।শ্বাসকষ্ট হচ্ছে । একটু শুয়ে আবার বসছে  উঠে । বৃষ্টি জোরে নামল । সুবিমলের বাবা কাচ টেনে দিলেন । অথচ কেন যেন বৃষ্টিটা সুবিমলের ভালো লাগছে । অথচ তার ভেতরে একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে । এই মুহূর্তে সে প্রায় কপর্দক শূন্য ।  গত এক বছর ধরে তার টিউশান নেই । হাতে টাকা নেই । ধার করে চলছে । বাড়ির লোক জানেনা কীভাবে সে সংসার খরচ দিচ্ছে । জেনেও বা কী করবে ! সে লিখে , প্রুফ দেখে অন্য নানা ছোট- বড় কাজ করে সামান্য কিছু উপার্জন করছিল ।

এই রকম একটা ঘটনা তাকে যেন সমুদ্রে নিক্ষেপ করেছে । ভেতরে ভেতরে ভাঙন টের পাচ্ছে সে । তবু নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে । কান্না পাচ্ছে না , তবু মনটা ভারী হয়ে আছে সুবিমলের ।

রাস্তা দিয়ে শব্দ করতে করতে পৌচ্ছে যাচ্ছে এম্বুলেন্স । ভোর কেটে একটু একটু আকাশ পরিষ্কার হতে চাইছে যেন । বৃষ্টিটা একটু ধরেছে ।




ডাক্তার ডেকে বললেন , অবস্থা খুব খারাপ । ওখানেই ই সি জি , ইকো ইত্যাদি নানা পরীক্ষা করা হল । এমনকি দুদিন আগে করা ই সি জি রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বললেন , আরো দুদিন আগেই নাকি হার্টে একটা মাইনর এটার্ক হয়ে গেছে । অথচ ওদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বুঝতে পারেননি । অন্য অসুধ দিয়েছেন । যদিও কয়েক দিন যাবৎ জ্বরে ভুগছিল সুবিমলের মা । ডাক্তার জ্বরের চিকিৎসা করেছেন । এখানে ডাক্তার বললেন , আই সি ইউতে এখনি ভর্তি করতে হবে । চান্স ফিফটি ফিফটি । 72 ঘন্টা না গেলে কিছু বলা যাবে না । নন বেঙ্গলি ডাক্তার সুবিমলের বাবাকে ধমকের সুরে বললেন , আপ লোগ শোয়ে রাহে থ্যা ক্যায়া-- অব কিউ লায়ে-- বাঁচেগা কী মরেগা বোল নেহি সাকতা...


এসব বলে ডাক্তার চলে গেল । এবার প্রথম কান্না পেল সুবিমলের । গলার ভেতর কান্না জড়িয়ে আসছে । অনেক দূর থেকে বোন , বোনের বর চলে এসেছে । বোনকে দেখে যেন আরো বেশীই কান্না পেল তার ।

সুবিমল কাউকেই খবর দিতে পারেনি । বা দিতে ইচ্ছেও করেনি । কী দরকার মানুষকে বিব্রত করবার ! এই স্বভাব সংকোচ তার চিরদিনের । তবু মনে হল দু- চারজনকে বলা দরকার । তারপর মনে হল , আমার তো কোনো বন্ধু নেই । কারণ আমার ভ্রাম্যমান জীবন । ভাড়া থাকার সুবাদে আজ এখানে পাঁচ বছর , আবার অন্যত্র সব গুটিয়ে সাত বছর-- এভাবেই চলেছে ওদের জীবন । কোথাও থিতু হতে পারেনি । ফলত সেভাবে বন্ধুও গড়ে ওঠেনি । কম কথা বলা , লাজুক সুবিমল নিজের মতোই থাকে , ছাত্র পড়ায় । ক্লাব কালচার নেই , চাঁদা তোলা নেই , রকবাজি নেই । অবসরে বই পড়ে । ওইটেই তার নেশা ।

করব না করব না করেও সে দুচার জন অতি পরিচিত মানুষকে জানালো । তাঁরা যখন খবর পেয়ে ওর কাছে ফোন করছে , মায়ের কথা জানতে চাইছে , সুবিমলের তখন কেবল গলা আটকে আসছে । কথা বলতে পারছে না । যেন এখনি কান্না করে দেবে । সে কোনো কথা বলার মতো অবস্থায় নেই , তবু কথা বলতে হচ্ছে ।

অন্যদের নানা উপদেশ এখন শুনতে হচ্ছে । কেউ বললে , পাশে আছি । কেউ বললে , এখন তো তোমাকেই সব করতে হবে । চাপমুক্ত থাকো । কেউ বললে , একটু ব্যস্ত আছি  ভাই। পরে ফোন করব তোমায় । আবার কেউ বললে , অফিস থেকে একদম ছুটি নেওয়া যাবে না রে । কাকিমা কেমন আছেন ফোন করে একবার জানাস । কেউ বা বললে , প্রয়োজন হলে আমাকে ফোন করবেন ।

কেবল একটি অনুজ প্রতিম প্রাক্তন ছাত্র বললে , স্যার আমি এখনি আসছি । তবে সুবিমল তাকে কাজ ফেলে আসতে বারন করলে ।

এইজন্যেই সে অন্যকে ফোন করে বিব্রত করতে চায়নি ।  মনে হল , অকারণেই খুব বিব্রত করে ফেলেছি । নিজের কাছেই খুব গিল্টি ফিল করল ।




সুবিমলের কাকা , এলাকার বেশ নাম করা নেতা । উকিল মানুষ । সে দুপুরে চলে এলো , সঙ্গে বেশ কয়েকজন ছেলে । সুবিমল দেখে এসেছে বরাবর, নেতারা একা একা কোথাও যায় না । একটা দল থাকা চাই । নেতার সঙ্গে অনেকেই থাকে । সেইটেই হয়ত অলিখিত নিয়ম । না হলে লোকে নেতা বলে মানবে কেন ?তাঁরা যে সমাজসেবক । মানুষের পাশে পাশে থাকে । মানুষের কাছাকাছি তাঁদের বাস । মানুষের বন্ধু বলে কথা ।

সুবিমল মাথা নিচু করে বসে ছিল আই সি ইউ- এর বাইরে একটা চেয়ারে । গিয়েই তিনি হম্বি- তম্বি শুরু করে দিলেন । এখানে কেন আনা হল ? ঐ নার্সিংহোম ভালো ছিল । ওখানে আমাদের পার্টির ভোম্বলদা ছিল । ঐখানকার এম এল এ- কে একটা ফোন করলেই সমস্যা মিটে যেত । তোদের মেডিক্লেম নেই-- এত টাকা কে দেবে ? কীভাবে জোগার হবে ? ইত্যাদি ইত্যাদি ।

সুবিমল বললে , মেডিক্লেম করা আছে তবে এক বছর মাত্র করেছি । শুনেছি হার্টের সমস্যায় তিন বছর পলিসির বয়স না হলে ক্লেম পাওয়া যায় না , তাই চিন্তায় আছি ।

বিকেলে ভিজিটিং আওয়ারে সুবিমল মা- কে দেখতে গেল । মায়ের কথা বলা বন্ধ । মা- কে যে ঘরে রেখেছে সেটা খুব ঠান্ডা । মাথার ওপর এসি মেসিনটা । মায়ের গায়ে কম্বল । তিনি তাকিয়ে আছেন । কথা বলতে চাইলেন , পারলেন না । নার্স একজন এসে মানা করলে ।মা-কে দেখে খুব কষ্ট হল সুবিমলেন । সারা শরীরে নানা রকম নল । চারপাশে কত অত্যাধুনিক মেশিন- পত্তর । গলায় আর হাতে চ্যানেল করা হয়েছে । তিনি নীরবে তাকিয়ে আছেন সুবিমলেন দিকে । সুবিমল বললে , তোমার কিচ্ছু হয়নি , সব ঠিক হয়ে যাবে -- সামান্য সমস্যা ।

মাকে দেখে বাইরে বেরিয়ে বুকটা যেন মোচড় দিয়ে উঠল । কেমন যেন কান্না পেল । সে তো নিজেকে খুব শক্ত মনের মানুষ বলেই জানত । তাহলে ? এতটা আবেগ থাকাটা কী ভালো !  সে মনে জোর আনতে চাইল --- বাইরে বেরিয়ে এলো । ভিতরেই একটা চা- এর দোকান । একটা চা নিয়ে একটু আড়ালে গিয়ে বসলে । মনে পড়ল এই তো কয়েকদিন আগেই সে একটা স্বপ্ন দেখেছিল ভোর রাতের দিকে । ভয়ে জেগে উঠে ঢক ঢক জল খেয়েছিল । সারা শরীর ভিজে উঠেছিল ঘামে । দেখেছিল , সুবিমলের মা কাঁদছে । বললে , আমি মনে হয় আর বেশী দিন বাঁচব না । অথচ আরো কটা দিন বাঁচতে হবে । আমি মরে গেলে কে দেখবে তোকে । তোর যে খুব কষ্ট হবে রে...এই কথাগুলো শুনে স্বপ্নের ভিতর আধো অন্ধকারে কাঁদছিল সুবিমল । ওই স্বপ্ন সে আজো ভুলতে পারেনি ।

চা শেষ হয়ে গেছে । কাগজের কাপটা নিয়ে সে বসে আছে । মনটা আবার খারাপ হয়ে যাচ্ছে । সে কিছুতেই শক্ত হতে পারছে না ।বিস্ময়ে  ভাবতে থাকে স্বপ্ন তাহলে সত্যি হয় !!




বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয় । খুব ক্লান্ত সুবিমল । ভেতরে ভেতরে হিসেব কষে যাচ্ছে কীভাবে টাকা জোগার হবে । বোধহয় ওর মনের কথা বুঝতে পেরে ওর বোন এক কোনে ডেকে বললে , চিন্তা করিস না দাদা , টাকা ঠিক জোগার হয়ে যাবে । আমি হাজার পঞ্চাশ দিতে পারব । বোনের কথায় কিছুটা আশ্বস্থ হয় সুবিমল ।

এত সবের মধ্যেও সুবিমলের বাবার চিন্তা বাড়ির দুটো পোষ্য বিড়াল নিয়ে । তারা যে সারাদিন অনাহারে আছে । সুবিমলকে বললে , তুই চলে যা । তোর যা যা কাজ আছে কর । একটু রেস্ট নে । বাড়ি গিয়েই বিড়াল দুটোকে খাওয়াবি । পাড়ার কুকুর দুটোকেও কিছু দিস খেতে -- গেটের কাছে বসে থাকে । আর দেখ , টাকা পয়সা কীভাবে জোগার করা যায় -- মেডিক্লেমে যদি কিছু না পাই...

সুবিমল ইচ্ছে না থাকলেও চলে এলো সন্ধে সাতটা নাগাদ । রাতে বোন ফোনে বললে , মা এখন কিছুটা ভালো । ওষুধে রেসপন্স করছে । তবে ডাক্তার এখনো আশার কথা বলেনি । রাতে থাকতে বলেছে--- কখন প্রয়োজন হয় ।

তারপর কিছুটা থেমে বললে , কাকা খুব অসন্তুষ্ট তোর ওপর ।

-- কেন ?

-- কারণ তুই কেন চলে এসেছিস আগে ?

-- বাবা বললে যে...

--সে তো আমি জানি । ওঁর কিছু জুনিয়র উকিল ও আরো কয়েকজনের সামনে খুব বাজে ভাবে বললেন , কী রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলে ! মা হসপিটালে ভর্তি ছেলে চলে গেল রেস্ট নিতে । এদের বোধ- বিবেক আর কবে হবে !! এই যে পঞ্চু , তপা , লালু আছে--- আমাদের পার্টির ছেলে এদের কী দরকার থাকার -- তবু এরা আছে...আশ্চর্য ছেলে তো , চলে গেল বাড়িতে ঘুমুতে । কোথায় আট- দশ জন বন্ধুবান্ধব নিয়ে থাকবে , রাত জাগবে--- কখন কী দরকার হয়...এসব শুনে আমার  খুব খারাপ লাগল রে দাদা। কাকা সুযোগ পেলেই অন্যকে অপমান করেন । অসম্মান করেন ।

-- আমারো তো শুনে খুব খারাপ লাগছে রে...এসব তো সহ্য করতেই হবে । এও এক ভবিতব্য । জানিস তো ,ও এই রকম । বিপদে পড়েছি । নেতা মানুষ । এঁদের ছাড়াও তো চলে না । আজকাল জানিস তো পার্টিই শেষ কথা । রুলিং পার্টি । কিছু বললে চটে যাবে । তবে কাকিমাকে একদিন বলতে হবে যে কেন এই রকম ব্যবহার  করেন  আমাদের কাকা ।

ফোন রেখে দেওয়ার পর মন খারাপ হয়ে গেল সুবিমলের । সে সংবেদনশীল মানুষ । আহত হল কাকার এইসব কথা শুনে ।কী আর করবে-- কারণে- অকারণে কাকার সাহায্য ওদের নিতেই হয় ।

চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে সুবিমল । সে বুঝতে পারে ধীরে ধীরে তার কোনো বন্ধু নেই । কেউ নেই কিছু নেই । একটু একটু করে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে । সে ক্রমাগত একা থেকে আরো একা হয়ে যাচ্ছে । আবার এও ভাবছে , আজকাল কেই বা কার বন্ধু--- কোথায় বন্ধু --- নিকষ আঁধার--- কেবল গহিন অন্ধকার -- বাইরে ভেতরে , আজ সর্বত্র ই যেন ঘন নিঃসীম অন্ধকার ।


ভাবতে ভাবতে নীরব একাকী বিছানায় এই প্রথম বার বেশ জোরে শব্দ করে কেঁদে উঠল সে ।


6 comments:

  1. Valo, bastob.. Kintu Mon kharaper bastob.... Amr maa Sotti khub osustho ekhn......

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্রিয় পাঠক , অনেক অনেক ধন্যবাদ । আপনার মা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন , এই প্রার্থনাই করি ।

      Delete
    2. প্রিয় পাঠক , অনেক অনেক ধন্যবাদ । আপনার মা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন , এই প্রার্থনাই করি ।

      Delete
  2. কি লিখেছ গো অমিতাভ !অসাধারণ!

    ReplyDelete