Monday, December 31

গল্প : দীপান্বিতা সামন্ত







 পরাজয়

 আজ স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেলো ...প্রতি বছর পুজোর  ছুটি পড়ার দিন তাই-ই  হয় ।ঈপ্সিতা অতসী ঋতুপর্ণা আর আমি .. চারজন কলিগ মিলে ঠিক করেছি একটু খাওয়া দাওয়া আর দু চারটে প্যান্ডেল ঘুরে তবে বাড়ি ফিরব । সাজগোজ  করে এসছি  সবাই ... তবু বেরোনোর আগে  আর একবার মেক আপটা ঠিক করে নিলাম ।  ঋতুপর্ণা বেরোনোর মুখে বলে - ' ঈপ্সিতাদি একটু ওয়েট করো না গো ...একটা মফ চেইন কিনবো ..বাড়িতে একটা আছে কিন্তু আমি পরতে ভুলে গেছি ...আর একটা সাজঘর থেকে কিনে নিই ...আমার শাড়িটার সাথে ভালো যাবে তাই না বলো ?'

অতসী একটু কপট রাগ করে বলে- ' ঋতু তোমার এই এক রোগ ..সাজ আর শেষ হয় না । নাও নাও চলো ..খুব দেরি করা চলবে  না...শাশুড়ি আছেন বাড়িতে ।' আমার বাড়িতেও  গেস্ট আসবে আমি জানিয়ে দিই সেই সুযোগে । সাজঘরে ঢুকে সবাই প্রায় কিছু কিছু কস্টিউম জুয়েলারি কিনে ফেলি  খুব একটা প্রয়োজন  না থাকলেও ।

বিনোদিনী গার্লস স্কুল স্টেশন থেকে একটু ভেতরের দিকে  স্কুলের সামনেই রিক্সা স্ট্যান্ড ..অটোও চলে ।স্টেশনের আগে পড়ে বাজার । রিকশা বা অটো স্ট্যান্ড বাজার অবধি , স্টেশন অবধি যেতে গেলে ভাড়া একটু বেশি দিতে হয় । ঝটপট দুটো রিক্সাকে জিগ্গেস করে আমি আর অতসীদি  উঠে পড়লাম একটা  রিক্সাতে । কি খেয়াল চাপলো হঠাৎ জিগ্গেস করলাম ভাড়া কতো দাদা ?

- পঁচিশ টাকা

প্রায় আঁতকে ওঠা স্বরে বললাম ..' পাগল হয়ে গেলেন নাকি এই সোয়া এক কিলোমিটার রাস্তা পঁচিশ টাকা! ' কুড়িটাকার বেশি কোনভাবে হতে পারে না মনে মনে হিসেব করে নিলাম ...যাবোই না রিকশাতে ।ঈপ্সিতা আর ঋতুপর্ণা অন্য রিক্সাতে সবে উঠতে যাচ্ছিলো ... আমিই নেতৃত্ব দিয়ে ডাক দিই - 'এই নাম নাম সব ..চলো অটোতে যাবো ।'

 কথায় আছে হুজুগে বাঙালি । বাকি সবাই হই হই করে নেমে পড়লো । আমাদের রিক্সাওয়ালা বোঝানোর চেষ্টা  করলেন যে ভাড়া এমনিতে সাতাশ পুজোর সময় বলে ..তিনি  পঁচিশ চেয়েছেন ...

সে যুক্তির তোয়াক্কা না করে উল্টো দিক থেকে আসা একটা ফাঁকা  অটোকে  দাঁড় করিয়ে উঠে পড়লাম চারজন । অর্থাৎ পঞ্চাশ টাকার জায়গায় আঠাশ টাকা অটো ভাড়া  দিয়ে আর একটু পথ হেঁটে এসে স্টেশনে গেলাম ... কার মনে কি হচ্ছিলো জানিনা ..আমার মনের মধ্যে যেন আত্মপ্রাসাদের হাসি ফুটে উঠছিলো ।

সারাদিন আগমনীর আনন্দে মেতে ছিলাম । খাওয়া দাওয়া আর দু একটা প্যান্ডেল ঘুরে বাড়ি ফিরলাম । বাড়ি ফিরেই আত্মীয় স্বজনের আতিথেয়তার দায়িত্ব ও ব্যস্ততার মাঝে ভুলে গেছিলাম সব ।

ভালো কলিগ ..ভালো স্ত্রী ..ভালো মায়ের দায়িত্ব পালন করে সব কাজের শেষে আর একবার আত্মতৃপ্ত হই । খুশি মনে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি । অনেকের মতো আমার হিসেবী মনও  রাতে চোখ বুজে সেরে নেয়  সারাদিনের জমা খরচের হিসেব ।

ভাবতে ভাবতে মনে হয়-  এহ্ সারাদিন বড্ড বাজে খরচ করেছি । সাজঘরে গিয়ে দেড়শো টাকা দিয়ে ওই দুলটা এখন না কিনলে চলতো ।রেস্টুরেন্টে গিয়ে একগাদা খাবার নিয়ে অনেকখানি নষ্টও করা হলো ... ফেরার পথেও ট্রেনের ভিড় এড়াতে বার তিনেক অটো পাল্টে এলাম ।

আমাদের নেমে যাওয়ার পর রিকশাওয়ালার পাংশু মুখটা হঠাৎ মনে পড়লো । ভেতরে কেমন একটা অস্বস্তি হলো । পাঁচটাকা বাঁচিয়ে আজ খুব কি লাভ করলাম ! বিবেকের মুখোমুখী হলাম । নিজেকে বড়ো ছোট মনে হলো । গায়ে গতরে খেটে পুজোর সময় যদি পাঁচটা টাকা বেশিই চায় সত্যিই খুব অন্যায় ? পুজোর সময় তো বাড়ির রান্নার দিদি থেকে পেপারওয়ালা গ্যাস ডেলিভারি ম্যান কেউ বাদ যান না আমার বোনাসের আওতা থেকে ...পুজোর  চাঁদার জুলুমও  কম নয় ; নিজের সাজগোজে কোথাও খামতি রাখিনি ..দুটোর জায়গায় চারটে ড্রেস ছটা ম্যাচিং দুল হার কিনতে পিছপা হই নি ..তবে ওই গায়ে গতরে খাটা মানুষটাকে কেন এমনভাবে বঞ্চিত করলাম মনে করে আত্মগ্লানির আগুনে পুড়তে থাকলাম । নিজেকে বড্ড নিষ্ঠুর মনে হলো ।


.......................................


সারা পুজোতে যতবার বাজে খরচ করেছি ..ততবার ওই পাংশু মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে । নিজের কাছে পরাজিত হাওয়ার গ্লানি কোথাও যেন দংশন করতে থাকে বার বার । সমস্ত দুঃখ কষ্টের ভার বয়ে বেড়ানো মনে হয়  এর থেকে অনেক সহজ । কি করা যায় , কি করা যায় ভাবনা আমাকে অস্থির করে তোলে । দিন রাত্তির সব কাজের মধ্যে বার বার আমাকে ব্যাঙ্গ করছে যেন কেউ ... স্থির থাকতে দিচ্ছ না । বিজয়া দশমী তারপর লক্ষী পুজোর কাজ মিটতেই দু দিন পর কি মনে করে  রওনা দিলাম স্কুলের দিকে । কি মনে করে ট্রেন  থেকে নেমে অটো কিংবা রিক্সা কোন কিছু না নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম স্কুলের দিকে । ছুটির মাঝে ম্যাডামকে এ পথে দেখে খুব চেনা মুখ বা ছাত্র ছাত্রী দু একজন প্রশ্ন করলো ...কোনরকম দায়সারা একটু উত্তর দিয়ে একগুঁয়ের মতো এগিয়ে চললাম । পথে একজায়গায় দেখতে পেলাম প্যাসেঞ্জার নিয়ে গন্তব্যের দিকে মোড় নিচ্ছে সেই রিকশাওয়ালা । হাতে যেন চাঁদ পেলাম আমি ...এতো সহজে দেখা পাবো এটা একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিলো । 'রিকশা ....রিকশা' বলে চিৎকার করলাম ..এসব ক্ষেত্রে ভরা রিকশার রিকশাওয়ালারা সাধারণত ফিরেও তাকান না । তাঁরা জানেন ডাকটা তার উদ্দেশ্যে নয় । অগত্যা সামনের এক ভদ্রলোককে বলে রিকশাকে  দাঁড়াতে বললাম । বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তিনি দাঁড়ালেন ..রিকশায় বসা ভদ্রলোক ভদ্রমহিলাও ঘুরে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন । আমি বেশ উদগ্রীব ভাবে দাঁড়াতে ইঙ্গিত করে প্রায়  দৌড়ে কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলাম - "কতদূর যাচ্ছেন ? "

তিনি বেশ নিরীহভাবে বললেন - "নেতাজী কলোনী "

- বেশ বেশ চট করে ওনাদের ছেড়ে ফিরে আসুন ..খুব দরকার আপনার সঙ্গে ..এক জায়গায় যাওয়ার আছে ।

মাথা নেড়ে চলে গেলেন ...আমি অপেক্ষায় ।

পাঁচ মিনিট দশ মিনিট পনের মিনিট কেটে যায় । তাঁর আর দেখা নেই ..নিজেকে অসম্মানিত মনে হচ্ছিলো..কারন নেতাজী কলোনী গিয়ে ফিরে আসতে পাঁচ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয় । ভাবলাম ফিরে যাই , আবার একটু ইতস্ততঃ করে দাঁড়িয়ে গেলাম পাঁচ মিনিট ।

এমন সমায় প্যাক প্যাক করে হর্ন বাজাতে বাজাতে তিনি আসছেন । দু কথা শোনাবো ভাবতে গিয়েও চুপ করে গেলাম ... তিনিই বললেন দিদি কিছু মনে করবেন না একটা বাচ্চা অসুস্থ ..তাকে ওইদিকের ক্লিনিকে পৌঁছে দিয়ে আসতে দেরি হয়ে গেলো । আবার একবার লজ্জিত হলাম মনে মনে ।

বুঝতে না দিয়ে উঠে বসে বললাম  '' আচ্ছা ঠিক আছে ...চলো  স্টেশনের ওপারে জুবিলী পার্কের পাশের পুলিশ ফাঁড়ির কাছে যাবো । "

বললো অনেক ভাড়া পড়ে যাবে ..আপনি অটোতে যেতে পারতেন ..ওপাশেও অটো পেয়ে যেতেন ।

-হুম তা পেতাম ..ঠিক আছে যা লাগে লাগবে । চলো দরকার খুব । নামিয়ে একটু দাঁড়াতে পারবে তো ।

- ঠিক আছে ..যাবেন কোনদিকটা ?

- ওইদিকে বোনের বাড়ি আমার ..ওখান থেকে আর একটু ।

- আচ্ছা

নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দাঁড়ালো ..ফাঁড়ির পাশেই মিষ্টির দোকান ...এই অঞ্চলে বেশ নামকরা । দশটা রসগোল্লা  আর পাঁচশো গ্রাম রাবড়ি নিয়ে এগিয়ে এসে বললাম ধরো দেখি ।

- হ্যাঁ দিদি ধরছি ..উঠুন ..

- না না আমি আর উঠবো না ...এটা তোমার জন্যে । আর সেদিনের আচরণের জন্যে এই দিদিকে যে মাফ করতে হবে ভাই ।

ব্যাপারটার জন্যে একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না সে । না দিদি একি করছেন দিদি... না না সেসব চুকে গেছে , খেটে খাই আমাদের ওসব ব্যাথা মনে রাখলে চলে না । মুখ কোথায় লুকাবে জায়গা খুঁজছিলো হয়তো ।

আমি শুধু বললাম - দিদিরাও মাঝে মাঝে ভুল করে ..সেটা শুধরে নিতে হয় ..ক্ষমা করিস ভাই ...যা তুই,  আজ তোকে ভাড়া দেবো না ..তাহলে খুশি তো ।

আহ্লাদে তার চোখে জল দেখলাম  ।আবেগে  তার সরল গ্রাম্য ভাষায় বলে ওঠে - ' ছি ছি দিদি !আর এখন ভাড়ার কতা কইবেন না । আসচি দিদি । '

' আয়' বলে আমি রাসমণি স্কুলের  ইতিহাসের শিক্ষিকা  জনপ্রিয় কৃষ্ণা দিদি একবুক  পরাজয়ের আনন্দ নিয়ে বোনের বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম ।



3 comments:

  1. খুব সুন্দর একটা মেসেজ পেলাম গল্প টাতে 💖💖💖

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লেখা। প্রথমটা পড়ে মনে হচ্ছিল গল্পটা চিরাচরিত কিন্তু শেষের উত্তরণ খুব মানবিক আর মর্মস্পর্শী। শেয়ার করতে পারি কী?

    ReplyDelete