বাস্তু
অধিরথ একটা পুরনো বেতের চেয়ার সামনের লনটাতে রেখে বললো, “ কত্তা, আর কেন? এবার মেনে নিন। আর যে সামলানো যাচ্ছেনা। “ রামতনুবাবু চেয়ারটাতে গা এলিয়ে বসলেন। সিগারেটটা ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বেশ অ্যাক্টো করে বললেন, “ কতবার বলেছি ওসব কথা মুখে আনবিনা, এতো শুধু বাড়ি নয়, বাপ- ঠাকুরদার স্মৃতি, যার তার কথায় বেচে দেবো? এর মর্ম কেউ বুঝবেনা রে, কেউ বুঝবেনা।“ বলেই আবার উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকলেন জীর্ণ পুরনো বাড়িটার দিকে।বিশাল দোতলা বাড়ি। ভেঙে পড়েছে এখানে ওখানে।কোথাও কোথাও গজিয়ে উঠেছে বটগাছ, আগাছা।সারা শরীর জুড়ে যেন অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। অধিরথ পুরনো কাজের লোক। কত্তার মুখের ওপর কিছু বলতে পারেনা। গোঁজ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।
“কী রে! কিছু বলবি? “
“ বলছিলাম কী কত্তা, কাল নৃপেন প্রোমোটার আবার এসেছিল।আপনাকে আর একবার বলতে বলেছে “
“ তোর খুব লোভ না! ফ্ল্যাট বানাবে, তোকেও একটা দেবে বলেছে। সব জানি। খুব লোভ তোর।“ বেশ রেগে গেলেন রামতনুবাবু। “ নৃপেন হারামজাদাকে বলে দিস এই বাড়ি আমি বেচবোনা। যা পারে করে নিক। এর প্রতিটা বিন্দুতে আমার পূর্বপুরুষদের পায়ের ছাপ লেগে আছে। এত সহজে আমি তা মিলিয়ে দিতে দেবনা, শালা প্রোমোটার! “ এরপর আরও কয়েকটা বেশ চোখা চোখা গালমন্দ করলেন।
বিকেলের দিকে কোলকাতায় নিজের তিনকামরার ফ্ল্যাটে ফিরে এলেন রামতনুবাবু। মনের মধ্যে রাগটা যেন কিছুতেই মিটছেনা। সারাদিনে নানা ঝামেলায় খবরের কাগজটা পর্যন্ত পড়া হয়নি। রেডিওটা চালিয়ে হালকা করে গান শুনতে শুনতে চোখ বোলাচ্ছিলেন খবরে। তারপর অন্যদিনের মতো একতাড়া লটারি নিয়ে এসে মেলাতে বসলেন।
বাকিটা যেন স্বপ্নের মতো।সারারাত ঘুমোননি।সাতসকালে লটারি দোকানের ছেলেটার সঙ্গে দেখা করেই ট্যাক্সি করে মধ্যমগ্রামের দেশবাড়ি।
দৌড়ে এল অধিরথ।
তাড়াতাড়ি বেতের চেয়ারটা এনে দিল।
“বুঝলেন কত্তা, আমিও ভেবে দেখলাম আপনিই ঠিক। স্মৃতি বলে কথা। একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? তাই কখনো হয়?”
রামতনুবাবু একথার কোন উত্তর দিলেন না। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকলেন। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন “ জানিস! লেগে গেছে, লটারিটা লেগে গেছে।ফার্স্ট প্রাইজ।পাঁচ কোটি।“
থম মেরে গেল অধিরথ।চোখটা ঠিকরে বেরোচ্ছে।
রামতনুবাবু একবার নিজের বাড়ির চারপাশটা ঘুরে এলেন। তারপর বেশ অ্যাক্টো করে বললেন,” বুঝলি অধিরথ,পুরনো ব্যাবসাটা ছেড়ে প্রোমোটারি শুরু করবো। ভাবছি এই বাড়িটা ভেঙে নিজেই একটা ফ্ল্যাট বানাবো। নতুন ব্যাবসা নিজের বাড়ি থেকেই শুরু হোক। কী বলিস।“
অধিরথ নিজের মাথা চুলকে বললো, “ তা যা বলেছেন কত্তা! “
No comments:
Post a Comment