Wednesday, December 25

শ্যামল সরকারের গল্প : সময় ফুরিয়ে যায়





শ্যামল সরকার
সময় ফুরিয়ে যায়



নিধু বিয়ে করতে যাচ্ছে । বরযাত্রী সাথে  দু’জন ------ নিধুর দিদি মনোরমা আর জামাইবাবু বিমল । বিমলের বাই-সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে পা দুলিয়ে বসেছে মনোরমা । নিধু বিমলের ধুতি আর পাঞ্জাবী পড়ে  বর সেজেছে । দীর্ঘদিন বাক্সে ভরা ছিল ওগুলো । তাড়াহুড়োতে আর ধুয়ে নেবার সময় হয় নি । গলায় একটি গাঁদা ফুলের মালা । বাড়ীতেই ফুটেছে রাশি রাশি পেচি গাঁদা ।  নিধু নিজের বাইসাইকেলে একা । ঢ্যাঙ্গা জামাইবাবু বিমলের পাঞ্জাবির ঝুল বেটে খাটো নিধুর প্রায় পা পর্যন্ত নেমে এসেছে । মনোরমা বলল ---- এটাই ভাল হয়েছে, ময়লা কোঁচকানো ধুতিটা আর দেখা যাচ্ছে না । প্রায় তিন মাইল পথ পেরিয়ে পাশের গাঁ কেস্টপুরে গুলতিদের বাড়ী ।  সাইকেল চলছে ।  ভাঙাচোরা পথ । বিমল তাড়া দিচ্ছে ---- তাড়াতাড়ি সাইকেল চালা নিধু, সন্ধ্যার আগেই পৌঁছতে হবে বিয়েবাড়ি । শুক্লপক্ষের পঞ্চমীর প্রথম রাতের গভীর অন্ধকারে ঐ দুর্গম এই পথে যাওয়া সম্ভব নয় । সান্তনা দেয় সে ---- বিয়ে শেষ হতে হতে জ্যোৎস্না ফুটবে । তখন আর রাধাপুর ফিরতে অসুবিধা হবে না । বিয়ের পর শেষ রাতের জ্যোৎস্নালোকে নিধুর সাইকেলের ক্যারিয়ারে চেপে প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাবে  বালিকা বধূ গুলতি । নিধুর মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে । গুলতিটাকে কী সুন্দর লাগছিল গতকাল যখন ও বাড়ীতে মেয়ে দেখতে গিয়েছিল । হাসি হাসি মুখ । নাদুস নুসুস চেহারা । কী সুন্দর তেলতেলে শরীর । ঘটক বলছিল ---- এখন এই যে কালো দেখছ, বিয়ের জল পড়লেই দেখো, টকটকে ফর্সা হয়ে যাবে । নিধু মনে মনে গুলতির ফর্সা চেহারাটাও যেন দেখতে পাচ্ছিল । কী সুন্দর !

    সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে আছে নতুন বৌ । ঘোমটায় মুখ ঢাকা ।  নিধুর বড়ো ইচ্ছে করছিল বউয়ের মুখটা দেখতে । কিন্তু লাজুক মেয়েটি শুভদৃষ্টির সময়ও মুখ তোলে নি ।  নিধু বলেছে কোমরটায় জড়িয়ে ধরে রাখো । উঁচুনিচু রাস্তা, পড়ে যাবে । আকাশে কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে । চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রাস্তা । বিমল মনোরমার সাইকেল সামনে ।    পিছু পিছু নতুন বর-বৌ । নিধু ভাবছে --- অমনই চাঁদমুখ গুলতি তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে আছে । কী সুন্দর নরম স্পর্শ । ভেবে ফেলেছে --- আজ রাতে আর ঘুমোবে না । কালরাত্রির বিধিনিষেধও মানবে না কিছুতেই ।

    ওরা বাড়ী পৌঁছল এক সময় । মেয়েলি আচারের পর অন্য ঘরে বউয়ের শোবার আয়োজন থাকলেও তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেল নিধু  । এতক্ষণে  ঘোমটা সরল বউয়ের । বয়সের ভারে চামড়া কুচকে যাওয়া, দাঁত ফোকলা স্ত্রীর মুখ দেখে অবাক নিধু । জিজ্ঞেস করল ---- কে তুমি ? তুমি তো গুলতি নও ! বৌ বলল ---- আমি রিতু । গুলতি আমার নাতনী, ভাইপোর মেয়ে । সবাই ওকে রসিকতা করছিল তোমার হবু বৌ বলে । আর দেরি করল না নিধু, একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুয়ে পড়ল তক্ষুনি । হাই তুলে বলল --- আজ কালরাত্রি, তুমি ওঘরে শুতে যাও । বাঁশের ঘরের ফাঁকফোকর দিকে উঁকি দেওয়া চাঁদ ততক্ষণে হারিয়ে গেছে মনখারাপের মতো একখণ্ড মেঘের তলায় ।

    আসামের চা বাগানে কাজ করে নিধু ----- তেজপুর । সরদারের কাজ । কুলিকামিনরা কত মান্যি করে । বিছানায় শুয়ে মনে মনে ভাবছিল নিধু ওদের কথা । ঘুম আসছিল না কিছুতেই । একটা চরম কষ্ট মনের ভেতর ভিড় করে আসছে । নিজের গালেই চাপড় মারতে ইচ্ছে করছে চরম বোকামোর জন্য । একটা অন্য কথা মনে এল । তেজবাহাদুরের মেয়ে টগরীটার সাথে ওর ভাব হয়ে গিয়েছিল ।  একদিন চলে এসেছিল টগরী ওঁর ঘরে কিসের যেন এক ছুতোয়, আজ আর মনে নেই । ওর ভরাট শরীর, মিষ্টি হাসি দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারে নি । সেইই প্রথম মনের ভেতর উথাল পাথাল অবস্থা । ঘরের ভেতরে ডেকে এনেছিল ।  জামা খুলেছিল টগরী, ভেতরের ছোট জামাও । ঘোর লেগে গিয়েছিল তখন নিধুর । সারা শরীরে একটা প্রবল উত্তেজনা । বেড়ে গিয়েছিল বুকের লাবডোব । মাথা ঘুরছিল । হঠাৎ কী যেন হয়ে গিয়েছিল তার ---- আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে নি । কাত হয়ে পড়ে গিয়েছিল বিছানায় । অচেতন । একটু বাদে জ্ঞান ফিরলে দ্যাখে ----- কী সব বিশ্রী গাল পাড়তে পাড়তে টগরী মিশে যাচ্ছে সবুজ বাগিচার গহীনে । টগরী আর ফিরে আসে নি কোনদিন । শুনেছে কোন এক বাগিচা শ্রমিকের সাথে ঘর বেঁধেছে সে ।  এরই মাঝে রিতুর মুখটা ফিরে এল মনের মধ্যে । একটু বেচারি বেচারি চেহারা । বেশ বয়স হয়েছে । অনটনের চাপ বয়সটাকে একেবারে ঘেঁটে দিয়েছে । কিছুতেই ওটা আন্দাজ করা যাচ্ছে না । ত্রিশও হতে পারে, ষাটও হতে পারে ।  রাত শেষ হয়ে আসছে ।  নিধুর মনের চঞ্চলতাও ধীরে ধীরে থিতু হয়ে আসছে । কোথায় যেন শুনেছিল জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ --- এই তিনের উপর মানুষের কোন হাত নেই । এসব ঈশ্বরের ঠিক করাই থাকে । মন বলছে নিধুর --- রিতুকে অস্বীকার করা তো ঈশ্বরের ইচ্ছেকে অস্বীকার করা । এভাবে ভেবে একটু শান্তি পেল নিধু । স্থির করে ফেলল ---- না, কিছুতেই নয়, রিতুকে অস্বীকার করবে না । তখন চোখে ঘুম নেমে এল । স্বস্তির ঘুম । অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমালো সে ।

     দুপুরবেলা নিয়মরক্ষার  ভাতকাপড় আর বৌভাত হল । বিকেলে ট্রেন ধরল দু’জন । আসামের ট্রেন । জেনারেল কম্পার্টমেন্টের একটু খানি সীটে গাদাগাদি করে বসল নিধু-রিতু । ট্রেন চলছে । রিতু বলল ---- আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ গো ? নিধু বলল ---- বহুদূর ।  নিজের বাড়ী যেতে হবে না ?

রিতু কিছু না বলে বরের ঘাড়ে মাথা রাখল । চোখ বোজা । যেন সে সঁপে দিয়েছে নিজেকে পুরোপুরি পরম বিশ্বাসে ।  বড়ো ভাল লাগছে নিধুর । সে জীবনে কোনদিন কারো মনের এত কাছে যেতে পারে নি ।  কারো কাছে এত বিশ্বাসের পাত্র হয় নি জীবনে । নিধু মুখের খুব কাছে মুখ এনে বলল ---- ভয় পাচ্ছ ?

রিতু চোখ বুজেই বলল --- তুমি তো আছ । ভয় কিসের । নিধুর মনে বড় বিস্ময় জাগল ---- সামান্য কটি মন্ত্রতন্ত্রের এত জোর ! যদিদং হ্রদয়ং তব, তদিদং হ্রদয়ং মম ...... ।  এতেই দুটো অপরিচিত মানুষের মনে জন্ম নিল অপরিসীম নির্ভরতা ! এত ভাললাগা ! প্রশ্ন জাগল মনে ---- কী করে হয় এসব ?  তক্ষুনি আসামগামী ট্রেনটি প্রবল ঘট ঘট শব্দ করে একটি রেলসেতু পেরোল ঝড়ের বেগে  । রিতু প্রায় চেপে ধরেছে নিধুকে । নিধু বলল । একটু ঘুমিয়ে নাও । রিতু মাথা রাখল নিধুর ঘাড়ে । মুদ্রিত চক্ষু, স্থির ।



       আসামের চা-বাগানে পৌঁছে গেছে তারা । তখন সকাল । চারপাশ ভেসে যাচ্ছে প্রভাতের নরম রোদ্দুরে । সেখানে জনবসতি খুব হালকা ।  চার দিকে বিস্তৃত সবুজের সুবিন্যস্ত সমারোহ দেখে রিতু অবাক । সে বলল ---- এত সুন্দর জায়গায় কাজ করো তুমি ! আমরা এখানে থাকব ? নিধু বলল ---- হুম । আমরা এই সবুজের সন্তান । বাগিচা বাগান আমাদের মা ।  আমাদের অন্নদাত্রী । আমরা দু’জন এই মায়ের কোলে কাটিয়ে দেব বাকী জীবন ।  নিধুর কথায় যেন আলো ফুটেছে রিতুর মুখে । নিধু স্থির  চোখে তাকাল রিতুর চোখে চোখ রেখে ।  হঠাৎ সে দ্যাখে ---- প্রবীণা রিতু ঐ নির্মল অরুণালোকে বদলে গেছে আচমকা । নিধুর সামনে  দাঁড়িয়ে কিশোরী গুলতি তখন মিটিমিটি হাসছে  সকালের সূর্যের মতো । বিস্ময়ে বিমূঢ় ।  নিধুকে তখন তাড়া দিল কচি নববধূ  --- কই, নিয়ে চলো তোমার ঘরে, চটপট । প্রবল উচ্ছাসে তখন তারা প্রায় দৌড়াতে শুরু করেছে বাঁধন হীন স্রোতের মতো ---- উচ্ছল, ছলছল । পাশ থেকে কে যেন চিৎকার করে উঠল ----  কত গই আছা নিধু, কিয়  দৌড়ি আছা ?

উত্তর দিল নিধু ছুটতে ছুটতেই ----- সংসার করতে যাই কাকা,  ছোট্ট জীবন, সময় ফুরিয়ে যায় যে  চোখের নিমেষে ।



No comments:

Post a Comment