Friday, May 3

অসমীয়া গল্পের অনুবাদ : বাসুদেব দাস

২৬ মার্চ,১৯৭১
দিলীপ বরা

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ - বাসুদেব দাস

রাজধানী শহর থেকে বহু দূরের একটি ছোট রেলস্টেশন।বিনয়বাবু চাকরি সূত্রে এই স্টেশনে বদলি হয়ে আসার বেশিদিন হয়নি।তা হলেও বাবু স্টেশনটার কাহিনি অনেক শুনেছেন।ভূতে পাওয়া স্টেশন।‘গোটা দেশটাই ভূতে পাওয়া।‘ বাবুর প্রায়ই মনে হয়। প্রথম যখন রেলে চাকরি পাওয়ার খবর পেয়েছিল তখনই বাবুর মা-বাবা ছেলেকে যাতে এদিকে চাকরি করতে না হয় তারজন্য নানারকম চেষ্টা চরিত্র করেছিল। তবে সেগুলি কাজে এল না। রেলের উপর মহলে বাবুর বাবার পরিচিত কেউ ছিল না।ফলে বিনয় বাবুকে ‘সোনার বাংলা’ছেড়ে একেবারে যাদুর দেশ কামরূপের এক কোণে এসে বসবাস করতে হল।বাবুকে মা-বাবা সাবধান করে দিয়েছিল,মানুষকে ভেড়া বানানোর দেশ কামরূপ।তারমধ্যে মা-কামাখ্যার পীঠস্থান।বুঝেসুজে চলবি।
এই স্টেশনেই গার্ডবাবু সুমিত সাহা এবং তাঁর পরিবার থাকে।দুই বঙ্গভাষী বাবুর মধ্যে খুব কম সময়ের মধ্যেই অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠল।সাহা বাবুর বয়স বিনয় বাবুর বয়সের প্রায় দ্বিগুণ।সুমিতবাবুর আদি বাড়ি বাংলাদেশের বরিশালে।মুজিবর রহমান বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধের সময় সুমিত সাহার পরিবারকে বরিশাল ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল।
‘সেইসব দিনগুলি ছিল বড় ভয়ঙ্কর।বিনয় বাবুকে সাহা বাবু অতীতের কাহিনি শোনায়।বিনয় বাবুরও ভালো লাগে,একই জাতি,একই ভাষা।সাহাবাবুর ছোট পরিবার।স্ত্রী এবং দুটি ছেলেমেয়ে।মেয়েটি বড়,স্থানীয় কলেজে বি এ পড়ছে,নাম তার বাসবী।ছেলেটি স্কুলের শেষ ক্লাসে।সাহাবাবু বিনয় বাবুকে অনুরোধ করলেন ছেলেটিকে পড়াশোনায় সাহায্য করতে।বিনয় বাবু পড়াশোনার পাট চুকিয়েছেন খুব বেশিদিন হয়নি।দশম শ্রেণির একটি ছেলেকে পড়া দেখিয়ে দেওয়ায় তার কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।অঙ্ক এবং ইংরেজি দুটো বিষয়েই বিনয় বাবুর দখল আছে।
‘আপনাকে কিছু একটা দেব।‘সাহাবাবু টিউশুনির জন্য টাকা দিতে চাইলে বিনয় বাবু বাধা দিলেন।এখন ও সে বিয়ে করেনি।মা-বাবার প্রয়োজন টুকু বাবার পেন্সন থেকেই হয়ে যায়। যুবক ছেলেটির কথা শুনে সাহাবাবু খুশি হলেন।ছেলে পড়ানো শুরু করার পর থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা বিনয়বাবু সাহাবাবুর বাড়ি যাওয়া আসা শুরু করলেন।সাহা বাবু বাড়ি থাকলে টিউশুনির পরে দুজনেই দীর্ঘকালীন আড্ডা মারেন।এরকমই একটি সন্ধ্যেবেলা তাঁর জীবন সংগ্রামের কাহিনি সাহাবাবু বলতে শুরু করলেন।
‘সবকিছু খুলে বলুনতো।’বিনয় বাবুর ও খুব আগ্রহ ছিল।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে তিনি পড়েছেন।শেখ মুজিবর,বাঘা সিদ্দিকি,ঢাকা বিশ্ববিদালয়ে রাজাকারদের,বিনয় বাবু অনেক কাহিনি শুনেছেন। হলেও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকা কারও সঙ্গে এতদিন কথা হয়নি।সাহা বাবুর কথা শোনার জন্য স্বাভাবিক ভাবেই আগ্রহী হয়ে উঠল নতুন করে চাকরিতে প্রবেশ করা যুবক অ্যাসিস্টেন্ট স্টেশন মাস্টার।
ধর্মের নামে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়েছিল।১৯৪৭ সনের চৌদ্দ এবং পনেরো আগস্ট দুটো নতুন দেশের জন্ম হয়েছিল,ভারত এবং পাকিস্তান।পাকিস্তান ও ছিল দুটি,পূর্ব এবংপশ্চিম,মাঝখানে দুই হাজার মাইলের ব্যবধান।দুই পাকিস্তানের মানুষগুলির মধ্যে বেশিরভাগ বাসিন্দা ইসলামধর্মী হওয়া ছাড়া অন্য কোনো কথাতেই মিল ছিল না।পশ্চিমের মানুষগুলি দীর্ঘদেহী,হৃষ্টপুষ্ট,পূর্বের মানুষগুলি ক্ষীণকায়,দুর্বল।পশ্চিমের মানুষগুলির ভাষা উর্দু-সিন্ধি-পাখতুন,পূর্বের মানুষগুলির ভাষা বাংলা।পশ্চিমের মানুষেরা রুটি খায়,পূর্বের মানুষেরা ভাত খায়।পশ্চিমের মানুষেরা গায় গজল,পূবে গায় ভাটিয়ালি।‘
‘পোশাক পরিচ্ছদেও মিল ছিল না,পশ্চিমের কুর্তা শেরওয়ানির বিপরীতে পূবে লুঙ্গি-জামা,ধুতি-পাঞ্জাবি,শাড়ি-ব্লাউজ।জনসংখ্যার দিক থেকে পূর্ব পাকিস্থান বৃহৎ,কিন্তু অফিস-কাছারি,পুলিশ-মিলিটারির বেশিরভাগ চাকুরিজীবীরা পশ্চিমের।পূর্বের মানুষেরা বারো মাস জলের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে,পশ্চিমের মানুষের গঠিত সরকার কেবল ধন আকর্ষণ করে। পাকিস্তানের জন্মদাতা জিন্না সাহেব গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের কথা বলেছিলেন,কিন্তু মাত্র কয়েকবছর পরে পশ্চিমে সামরিক অভ্যুত্থান হয়।সমগ্র দেশকে সামরিক শাসনের অধীনে নিয়ে আসা হয়।‘
জনতা প্রতিবাদ করল না?’
পশ্চিমে প্রতিবাদ না হলেও পূর্বে হয়েছিল।কঠোর হাতে পশ্চিমের মিলিটারি পূর্বের প্রতিবাদী কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিল।পূর্বের জনসাধারণ শারীরিকভাবে দুর্বল হলেও মেধার দিক দিয়ে পশ্চিমের থেকে অনেকটা এগিয়েছিল।পশ্চিম থেকে এসে সামরিক অফিসাররা বেছে বেছে পূর্বের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা,অপহরণ,এবং নিখোঁজ করলেন।সংখ্যালঘুদের উপরে বেশি করে অত্যাচার চলল।দেশ বিভাজনের সময় পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যাওয়া মোট জনসংখ্যার শতকরা চব্বিশ শতাংশ হিন্দু এই সময়ে কমে গিয়ে আঠারো শতাংশে পরিণত হয়।পুর্বপাকিস্তান থেকে অনেকেই শরনার্থী হয়ে ভারতে চলে আসে,তার বেশিরভাগই হিন্দু।কিছু পূব এবং পশ্চিমের দেশগুলিতে চলে যায়।‘সাহাবাবুর দৃষ্টি দরজার পর্দা ভেদ করে রাতের পৃ্থিবীর দিকে চোখ রাখে।চূণা পাথরে জল ঢাললে যেভাবে বুরবুরি ঊঠে সেভাবে সাহার মনের ভেতরেও স্মৃতির বুরবুরনি দেখা দিল।সেই দিনগুলি কী ভয়ানক ছিল।্রক্ত পিপাসু রাজাকাররা অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।প্রতি রাতে দরজায় টোকর পড়ত।রাজাকারদের লিষ্টে থাকা বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবী ,নেতা,ছাত্রদের ধরে নিয়ে জেলে ভরা হচ্ছিল।হিন্দু প্রতিবাদকারীদের রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাবার পরে আর কোনো খবর পাওয়া যেত না। নিখোঁজ হওয়া পরিবারের যুবতি মেয়ে এবং কম বয়সী মেয়েদের গায়ে ওরা হাত দিত।ওরা লুণ্ঠন এবং ধর্ষণ কার্যেও লিপ্ত ছিল।কোথাও প্রতিবাদ করার কোনো উপায় ছিল না।পুলিশ,ম্যাজিষ্ট্রেট সবাই ওদের ভয়ে তটস্থ।মুজিবর রহমানের আওয়ামী লীগ রাজাকারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার হুমকি দেওয়ায় তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।রাজাকারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তুষের আগুনের মতো ভেতরে ভেতরে জ্বলছিল।বেশিদিন লাগল না।বাঘা সিদ্দিকির অধীনে আত্মগোপনকারী একটা দল গড়ে উঠল।বোমা দেওয়া,রেল লাইন উপড়ে ফেলা,সেনা এবং পুলিশ ছাউনিতে গেরিলা পদ্ধতিতে গোলা বর্ষণ ইত্যাদি অনেক ঘটনা বাঘা সিদ্দিকির নে্তৃত্বে ঘটে চলল।পশ্চিম পাকিস্থানের সামরিক বাহিনি মিলিটারির সাহায্যে প্রতিবাদকারীদের কণ্ঠ যতই চাপা দিতে চেষ্টা করল ততই আর ও অনেক প্রতিবাদী কণ্ঠের জন্মদান করল।অবশেষে সামরিক সরকার মুজিবরের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হল।এক ব্যক্তি,এক ভোট নীতির আধারে সার্বজনীন ভোটে জাতীয় অ্যাসেম্বলিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা করা হল।‘এতটুকু বলে সাহা বাবু চুপ করলেন।
‘কী ভাবছেন?’তাকে বেশ কিছু সময় চুপচাপ বাইরের গহীন অন্ধকারের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিনয় বাবু জিজ্ঞেস করলেন।
‘কি বলছ?’বিনয় বাবুর কথা শুনে গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠা মানুষের মতো সাহা বাবু ধড়মড় করে উঠে বসলেন।
জিজ্ঞেস করছিলাম,আপনি কি ভাবছেন?’সাহাবাবুর ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখ দেখে বিনয় বাবুর চিন্তা হল।
ফেলে আসা ভয়ার্ত দিনগুলির স্মৃতি আজ ও আমার বুকের ভেতরে কম্পন তুলে।কত মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেল,কত জনের মুন্ডহীন দেহ পথের পাশে,মাঠে ঘাটে পড়ে রইল,কত বৌ-ঝিকে রাজাকারদের হাতে ধর্ষিতা হয়ে ধর্মান্তরিত হতে হল,আজ ও তার সঠিক হিসেব হয়নি।উনিশ শো সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে মুজিবরের দল আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিটারি শাসক মুজিবরকে সরকার গঠন করতে দিল না।প্রধান মন্ত্রী হওয়ার পরিবর্তে মুজিব হলেন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি।হাজার হাজার রাজাকারে পূব পাকিস্তানের শহর-নগর ভর্তি হয়ে পড়ল।অনেক হিন্দু এবং কিছু সংখ্যক মুসলমান ও বাড়ি-ঘর,জমি-মাটি,বন্ধু-বান্ধব,আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে বেঁচে থাকার তাড়নায় সাত পুরুষের ভিটা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে এল,শরণার্থী হল।অনেকে তা ও করতে পারল না।যারা রাজাকারদের হাতে পড়ল তাদের বেশিরভাগকেই হত্যা করা হল।মেয়ে-বৌ্দের ধর্ষণ-বলাৎকারের পরে ধর্মান্তরিত করে রক্ষিতা এবং চাকরানী হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেল।‘সাহা বাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।কথা বলার সময় তাঁর দুচোখ দিয়ে জলের ধারা বয়ে গেল।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে,আপনারা প্রত্যেকেই ভালোভাবে পালিয়ে আসতে পেরেছেন।সান্ত্বনা দেবার সুরে বিনয় বাবু বললেন।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত সাহা বাবু বিনয়ের কথার কোনো উত্তর দিল না।রাত গভীর হয়ে আসছিল।রাজধানীর উদ্দেশে যাওয়া ডাউন পেসেঞ্জার একটু পরেই এসে যাবে।বিনয় বাবু ঘড়ির দিকে তাকালেন।
‘ডাউন পেসেঞ্জার আসার সময় হয়ে গেছে।আমি উঠছি।’বিনয় বাবু চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন।রেলের কোয়ার্টারের হলদে বাল্বের আলোতে সাহা বাবুর দুই চোখ দিয়ে বয়ে যাওয়া চোখের জলটুকু একটা ক্ষণিকের সাপের মতো জ্বলজ্বল করে উঠছিল।বিনয় বাবু চমকে উঠলেন।
‘আপনি কাঁদছেন?’
সাহা বাবুর সম্বিৎ ফিরে এল।শার্টের আস্তিন দিয়ে তিনি চোখের জল মুছে ফেললেন।
‘ট্রেন যাবার পরে চলে এসো’।
‘অনেক রাত হবে।’বিনয় বাবু নিম্নস্বরে আপত্তি জানাল।
‘কিছু হবে না।আজ ইলিশ এনেছিলাম।’সাহা বাবু জোর করলেন।কোনো বাঙালি ইলিশ মাছের লোভ সামলাতে পারে?মৃতদেহে মাছি পড়ার মতোই ইলিশের উপরে বাঙালিরা ঝাঁপিয়ে পড়ে।
‘কোথায় পেলেন?এখানে তো ইলিশ পাওয়াই যায় না।‘বিনয় বাবুর জিভে জল এসে গিয়েছিল।কত দিন ইলিশ মাছের স্বাদ পাইনি।
‘কাল ফেরার সময় নিয়ে এলাম।রাজধানীর বাজারে পদ্মার ইলিশ এসেছে শুনে আর লোভ সামলাতে পারলাম না।’সাহা বাবুর মুখে কিছুক্ষণ আগে দেখা যাওয়া মন খারাপের চিহ্নমাত্র আর নেই।বিনয় বাবুর ও মন ভরে গেল,ইলিশ মাছের স্বাদ পাওয়ার আশায়।
সাহাবাবু ড্রইং রুমেই বসে রইলেন।ভুলতে চাইলেও বিভীষিকায় ভরা দিনগুলির স্মৃতি ভোলা সম্ভব নয়।সাহা বাবুর পরিবারে দশজন মানুষ ছিলেন।মা-বাবা,দাদু-দিদিমা,সাহা বাবু,তিন ভাই আর দুই বোন।দাদু-দিদিমা ষাঠ বছর অতিক্রম করেছিল।চাষের জমি ছিল একশ বিঘার উপরে।দাদু মুসলমান শ্রমিকদের দিয়ে চাষ করাতেন।স্বাধীনতার সময়েও সংঘর্ষ হয়েছিল।কিন্তু সাহা বাবুর বাবার জমিতে চাষ করা চাষার মাথায় তখনও মৌলবাদী সংগঠনের প্রভাব বিস্তারিত হয়নি।হিন্দু জমিদার এবং জমিতে চাষ-বাস করা মুসলমান চাষিরাও এক সময়ে হিন্দুই ছিল।জাতিতে নিচ এবং অর্থনৈ্তিকভাবে বিশেষভাবে পেছেনে পরে থাকা এই মানুষগুলিকে হিন্দু জমিদার তথা উচ্চ বংশজাত মানুষগুলি কোনোদিনই তুলে ধরার চেষ্টা করল না।উলটো কীভাবে ওদের সামাজিক,অর্থনৈতিক তথা শৈক্ষিকভাবে পেছনে ফেলে রেখে নিজের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে তোলা যায় সেই কথাতেই তারা প্রাধান্য দিয়েছিল।স্বাধীনতা এবং দেশ বিভাজনের পরে গরিষ্ঠসংখ্যক মুসলমানের দেশ পূর্ব পাকিস্থানে হিন্দু জমিদার তথা উচ্চ বংশজাত হিন্দু পরিবারগুলির প্রতি দুঃখী মুসলমান মানুষগুলির মধ্যে এতদিন ধরে সুপ্ত থাকা রোষের বহির্প্রকাশ ঘটতে লাগল।অনেকদিন ধরে ভেতরে ভেতরে তুষের আগুনের মতো জ্বলতে থাকা আগুনকে দেশবিভাজনের বাতাস আরও উদ্দীপিত করে তুলল।অনেক ধনী জমিদার এবং উচ্চ বংশজাত হিন্দু পরিবার বাড়ি-ঘর বিক্রি করে ভারত,ইংল্যাণ্ড ইত্যাদি দেশে চলে গেল।তখন ও তাতে থেকে যাওয়া দুঃখী হিন্দু মানুষগুলিকে গরিষ্ঠ মুসলমানরা নানাভাবে অসুবিধা দিতে লাগল।সরকারি কাগজপত্রেও হিন্দু পূর্ব পাকিস্তানীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদা দেওয়া হল।চাকরি-বাকরি,সমস্ত রকম সুযোগ-সুবিধা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হল।হাতে না মেরে ভাতে মারার এই ব্যবস্থা বহু গরিব হিন্দুকে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য করল।সাহা বাবুও বাবাকে বরিশালের মাটি-বাড়ি,ঘর-দুয়ার বিক্রি করে কলকাতায় চলে আসার কথা বলেছিলেন।কিন্তু ছেলের কথায় সোমেন্দ্র সাহা রাজি হলেন না। সাত পুরুষের বাড়ি ঘর ছেড়ে কলকাতা শহরের গলিতে জীবন কাটাতে রাজি হলেন না,নামে জমিদার কিন্তু কাজে অ্যাটর্নি সোমেন্দ্র বাবু।সাহা বাবু সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলেন।সেখানকার পরিবেশ অন্যরকম ছিল।বেশিরভাগ ছাত্র ছাত্রীর মনেই বামপন্থী চিন্তাধারা এবং দর্শনের প্রভাব পড়েছিল। চারপাশে বর্ধিত ইসলামীয় গোড়ামির বিপরীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজ করছিল ধর্মনিরপেক্ষ,সমাজবাদী চিন্তাধারা। ধূ ধূ মরুভূমির মধ্যে মরুদ্যান।পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা রাজাকার এবং পূব পাকিস্তানের মৌলবাদীর বিরুদ্ধে সবল প্রতিবাদ গড়ে তোলার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাত্রের একটি বিরাট দল দেশের কোণে কোণে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিল।
‘মুজিবর রহমানকে সরকার গঠন করার জন্য রাষ্ট্রপতি ডেকে পাঠালেন না।এক মাস ধরে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে সাহা বাবুদের দলটি সেদিনই দুপুর বেলা বিশ্ববিদ্যলয় ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছে।বিকেলে ছাত্র ইউনিয়নের কার্যালয়ে বসতেই ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদক আমিনুল ইসলাম খবর দিলেন।উপস্থিত সবারই মুখের কথা বন্ধ হয়ে গেল।
‘এখন কী হবে?’নিস্তব্ধ ঘরের নীরবতা ভঙ্গ করে কাবেরী পাল নামে ছাত্র কাউন্সিলের সভাপতি জিজ্ঞেস করলেন।
‘মুজিবুর রহমানকে জেলে ভরিয়েছে।মুজিবরের জেল এবং রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ দল দেশজোড়া বন্ধের কার্যসূচি হাতে নিয়েছে’।আমিনুল যতটুকু খবর পেয়েছিল সব বিস্তারিত জানাল। দুইপক্ষই যুযুধান অবস্থিতি নিয়েছে।মুজিবরের সমর্থনে লক্ষ লক্ষ পূব পাকিস্তানী নাগরিক রাজপথে বেরিয়ে এসেছে।রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার দায়িত্ব নিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনির লেঃজেনারেল নিয়াজী নব্বই হাজার সৈ্ন্য নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছেন।দুই একদিনের মধ্যেই তার ঢাকা পৌছানর কথা।তাকে রাষ্ট্রপতি পূব পাকিস্তানের মার্সাল আডমিনিস্ট্রেটর নিযুক্ত করেছেন।
মার্সাল আডমিনিস্ট্রেটর?’সাহা বাবু আকাশ থেকে পড়লেন।মাত্র দুই মাস আগে নির্বাচন ঘোষণা করে রাষ্ট্রপতি কথা দিয়েছিল সাধারণ নির্বাচনের পরেই জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে বিজয়ী হবে এই কথাটা আগে থেকেই জানা ছিল।তাহলে এখন পুনরায় কেন মার্সাল শাসনের কথা বলা হচ্ছে?কাবেরীর প্রশ্নের উত্তর আমিনুল দিতে পারল না।
সাহাবাবুর মনের ভেতরে তুফান চলতে লাগল।মুজিবর রহমানকে পূব পাকিস্তানের হিন্দু সংখ্যালঘুরা সম্পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল,নির্বাচনের পরে মুজিবই দেশের প্রধানমন্ত্রী হবে এই আশায়।সরকার গড়ার জন্য মুজিবরের সংখ্যা গরিষ্ঠতাও ছিল।কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জাতীয় সরকার গঠন করার প্রস্তাব দিল,মুজিবরকে উপ-প্রধান মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করতে বললেন।মুজিবরের পক্ষে কোনো ভাবেই এই প্রস্তাব মানা সম্ভব নয়। মুজিবরকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হল।
কথাটা বাতাসের মতো দেশের বিভিন্ন কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়ল।স্বতঃস্ফুর্তভাবে মানুষ রাজপথে বেরিয়ে এল।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসীমায় থাকা ছত্রাবাসের আবাসিকরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল প্রবেশদ্বারের সামনে জমায়েত হল। মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে।স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার নিচে সমবেত হওয়ার জন্য সমস্ত বাংলাদেশীকে জেল থেকেই রহমান সাহেব আহ্বান জানিয়েছেন।প্রবেশদ্বারের সামনে সমবেত হওয়া হাজার হাজার ছেলে-মেয়ের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঘোষণা করলেন।
উপাচার্যের ঘোষণা শুনে ছেলে-মেয়েরা ‘জয়-বাংলা’বলে চিৎকার করে উঠলেন।‘মুজিবর রহমান জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস আলোড়িত হল। মহানগরের রাজপথ ধরে এগিয়ে চলল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা,শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীরা,শুভাকাঙ্খী কর্মচারীদের বৃহৎ মিছিল।সাহা বাবু ছিলেন মিছিলের মধ্যভাগে।
ঢাকা শহরের আকাশ-বাতাস নিনাদিত করে এগিয়ে চলছিল স্বাধীনতার দাবীতে আত্মহারা হওয়া ছেলে-মেয়েরা।মিছিল খুব বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারল না।মিছিলের সামনের দিকে হঠাৎ গুলির আওয়াজ শোনা গেল।মিছিলের মানুষগুলিকে লক্ষ্য করে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বৃষ্টি হতে লাগল।কিছুক্ষণ আগেই ‘জয় বাংলা’ধ্বনিতে চারপাশ মুখরিত করে তোলা ছেলে-মেয়েদের মুখ থেকে কেউ যেন তাদের বাক্য হরণ করে নিল।চোখের সামনে ঢলে পড়া শত শত ছেলে-মেয়ের দেহ গুলিকে জুতোর দ্বারা মাড়িয়ে দৌড়ে এল রাজাকারের দল।
চোখের সামনে সহপাঠীদের ঢলে পড়তে দেখে সাহাবাবুর হাত-পা শক্ত হয়ে গেল।পরের মুহূর্তেই কেউ তার কানের কাছে চিৎকার করে বলল,ভাগ ভাগ এখন মরবি।‘চারপাশে হতে থাকা ধুম-ধাম শব্দগুলিকে হাপিয়ে তার কানে প্রতিধ্বনিত হল গুলি লেগে ঢলে পড়া কবেরী পালের মরণ কাতর আর্তনাদ।সাহা বাবু সম্বিৎ ফিরে পেলেন।বেঁচে থাকার তাড়নায় তীব্র বেগে সে সেখান থেকে দৌড় লাগাল।কোথায় গিয়েছিল,কোথায় গিয়ে পৌছাবে,কেউ তাড়া করেছিল নাকি,কোনো কথাই তার মনে পড়ল না।যেদিকে খোলা পেল সেদিকেই দৌড় লাগাল।ঢাকা শহরের প্রতিটি অলি গলি তার পরিচিত ছিল।তবুও মাথা তুলে সে কোনোদিকে তাকায়নি।বাঘে তাড়া করা হরিণের মতো প্রাণের মমতায় কেবলই দৌড়াচ্ছিল,দৌড়াচ্ছিল আর দৌড়াতে দৌড়াতেই একটা সময়ে ঘরের উঠোনে গিয়ে দাঁড়াল।
অন্ধকারে ডুবে ছিল সোমেন্দ্র সাহার সাতপুরুষের দুই মহলা বাড়ি।চারপাশে শ্মশানের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল।উঠোনে দাঁড়িয়ে লম্বা করে শ্বাস নিয়ে সাহা বাবু চারপাশে তাকালেন।ঢাকা শহরের চারপাশে আগুন আর ধোঁয়া বেরোতে দেখা যাচ্ছিল।কালবৈশাখীর মতো দূর থেকে চিৎকার চেঁচামিচি ভেসে আসছিল।সাহা বাবু নিঃশ্বাস বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুনলেন,কিসের শব্দ এটা?বাতাস তো নয়।তাহলে?ওগুলো মানুষের কথা,অনেক মানুষ একসঙ্গে কথা বললে বা পদচারণা করলে এই ধরনের শব্দের সৃষ্টি হয়।কে ওরা?কোথায় এসেছে মানুষগুলি?কি কথা বলছে বিশাল শোভাযাত্রার সঙ্গে আসা মানুষগুলি?
সাহা বাবু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন।সমস্ত শরীরটা ঘামে ভিজে গিয়েছিল।পরনের জামা পেন্ট শরীরের সঙ্গে আঁটো হয়ে বসেছিল।পায়ের স্যাণ্ডেল জোড়া পা থেকে খুলে গিয়ে কোথায় পড়েছিল বুঝতেই পারেনি।ধানবানা ঢেঁকির মতো সাহা বাবুর বুকটা উঠানামা করছিল।পায়ের ব্যথা আর গায়ের ঘাম দেখে সে অনুমান করেছিল কমেও সে দুই মাই দৌড়ে এসেছে।
কোথায় একটা শব্দ হল।পেছনের বাগান থেকে নিশাচরদের কলরবের শব্দ ভেসে এল।সাহা বাবুর এতক্ষণে খেয়াল হল অনেকক্ষণ কোনো মানুষের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন না।অন্ধকারে ডুবে থাকা নির্জন ঘরের দিকে তাকিয়ে তার বুকটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল।
সাহা বাবু সন্তর্পণে পা ফেলে বারান্দায় উঠে এলেন।সদর দরজার একটা পাট খোলা।তিনি দরজাটা এক হাতে ঠেলে দিলেন।সম্পূর্ণ দরজাটা খুলে গেল।সাহা বাবু অভ্যস্থ হাতে ইলেক্ট্রিক বোর্ডের সূইচে হাত দিলেন।না কোথাও আলো জ্বলল না।দ্রুততার সঙ্গে তিনি সবগুলি সূইচ টিপে গেলেন।ফেন,লাইট কোনোটাই কাজ করছে না।
বাবা,মা,আপনারা কোথায়?দৌড়ে দৌড়ে শুকিয়ে যাওয়া গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছিল না।সাহা বাবু সজোরে চিৎকার করে ডাকলেন,মা,বাবা আপনারা কোথায়?
নিস্তব্ধ অন্ধকারে সাহাবাবুর কণ্ঠস্বর নিশাচর পাখির শব্দের মতো প্রতিফলিত হয়ে চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।হন্তদন্ত হয়ে সাহা বাবু এঘর থেকে ও ঘরে খুঁজে বেড়ালেন।কেউ কোথাও নেই।মাত্র কয়েক মিনিটের আতঙ্ক দ্বিগুণ হয়ে তার বুক পিঠ বিদ্ধ করল।এতক্ষণ পর্যন্ত তিনি আশেপাশের বাড়িগুলির দিকে তাকান নি।এবার ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকালেন।
ঢাকা শহরের ধানমুণ্ডি এলাকার হিন্দু পাড়া অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল।সাহা বাবুর বুঝতে বাকি রইল না,রাজাকাররা এদিকটাতেও এসেছিল।পাড়ার প্রতিটি মানুষ হয় পালিয়েছে না হয় রাজাকাররা তাদের বন্দি করে নিয়ে গিয়েছে।কোনো অদৃশ্য যাদুকরের হাতের স্পর্শে যেন জীবন্ত মানুষগুলি বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
সুমিত সাহা নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ষষ্ঠ বার্ষিকীর  ছাত্রটি কী করবে কী না করবে কিছুই বুঝতে পারল না।বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে যে পরিস্থিতি দেখে এসেছে তাতে সেখানে ফিরে যাবার প্রশ্নই উঠে না।অন্ধকারে দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে রইল ভয়ে শঙ্কায় কাঠ হয়ে যাওয়া ছেলেটি,একা।
বড় বেশি সময় নয়,খুব বেশি আধ ঘন্টা।এক দল কুকুর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে চিৎকার করে উঠল।সাহা বাবু মাথা তুলে তাকালেন।বাড়ির সামনের রাজপথ দিয়ে গাড়ির পরে গাড়ি গিয়েছে।ছেলেটি কিছুক্ষণ সেদিকে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রইল।গাড়িগুলির পেছনের নাম্বারপ্লেটগুলি পেছনের গাড়ির আলোকে জ্বলজ্বল করছে।চোখ দুটি সে নাম্বার প্লেটগুলি পড়ার চেষ্টা করল।
সেনার গাড়ি।একসঙ্গে এতগুলি গাড়ি যেতে দেখে সাহা বাবুর চিন্তা হল।এতগুলি গাড়ি কোথায় গিয়েছে?পরিবারের চিন্তা বোবা করে রাখা মানুষটা সেনার গাড়ির সংখ্যা দেখে সচকিত হয়ে উঠল।যুদ্ধ,নিশ্চয় যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে।আওয়ামী লীগ সর্বাত্মক বন্ধ ঘোষণা করেছে,রাজাকার বাহিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে,শত শত প্রতিবাদকারীকে বন্দুকের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে।ঢাকা শহরের অভিজাত অঞ্চল ধানমুণ্ডিতে থাকা হিন্দু পাড়ার সমস্ত বাড়ি খালি হয়ে গেছে।সুমিত সাহা নামে বাইশ বছরের ছেলেটি এই পরিস্থিতিতে কী করতে পারে?নিখোঁজ হওয়া পরিবারের সন্ধানের খোঁজে কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে?পুলিশ,থানা,ডিসি,অফিস,পার্লামেন্ট হাউস,রাজভাণ্ডার,সবকিছুই রাজাকারের দখলে।বিদ্রোহী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর কিছু সংখ্যকদের সঙ্গে পরিচয় আছে সুমিত বাবুর।কিন্তু কোথায় দেখা পাওয়া যাবে,কার সঙ্গে দেখা করবে,এই দুর্দিনে কিছুই তো বলতে পারছে না।
সেনার গাড়ির সারি তখনও শেষ হয় নি।সৌ্মেন্দ্র সাহাকে যখন ভারতে চলে আসার জন্য আশেপাশের মানুষেরা দেখা করেছিল তখন প্রত্যেকেই অল্প দূরের আগরতলা নামে শহরটির কথা বলেছিল।ঢাকা শহর থেকে বাসে মাত্র তিন ঘন্টার দূরে থাকা আগরতলা নামে শহরটি ত্রিপুরা নামে ছোট্ট প্রদেশের রাজধানী।বাঙ্গালি মানুষের শহর আগরতলা।বেশিরভাগ মানুষই দেশ বিভাজনের সময় পূর্ববঙ্গ থেকে পালিয়ে আসা।এখন ও সৌ্মেন্দ্রবাবু পরিবার সহ সেখানেই গিয়েছে নিশ্চয়।কিন্তু বড় ছেলের জন্য কেন অপেক্ষা করলেন নে সৌ্মেন্দ্র বাবু?না কি?ভাবতেও ভয় হল সুমিত সাহার।অন্ধকারে ডুবে থাকা বাড়িটা থেকে নিঃশব্দে সে রাজপথে বেরিয়ে এল।গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে অন্ধকারে ডুবে থাকা বাড়িটার দিকে ফিরে তাকালেন।তারপর কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন।রাজপথ দিয়ে যাওয়াটা নিরাপদ নয়।আগরতলা ঠিক কোন দিকটায় অন্ধকারের মধ্যে নির্ণয় করে নিলেন।মাঠে মাঠে হেঁটে চললে রাতের মধ্যে সীমান্ত অতিক্রম করে যাওয়া সম্ভব।ভারতের মাটিতে পা দিতে পারলেই নিরাপদ।হয়তো নিখোঁজ হওয়া পরিবারটিকে সেখানেই পেয়ে যাবে,কোনো শরণার্থী শিবিরে,না হলে কোনো পুরোনো পরিচিত মানুষের বাড়িতে।কিছুক্ষণ আগের নিরাশার কালো অন্ধকার ঘিরে ফেলা সুমিত সাহার মনে আশার আলো ফিরে এল।
রাজপথ ছেড়ে মাঠে নেমে এলেন সাহা বাবু।মিলিটারি গাড়িগুলি তখনও সার বেঁধে যাচ্ছিল।সাহা বাবুর মনে পড়ল,দিনটা ছিল ২৬ মার্চ,১৯৭১।সেদিনই আরম্ভ হয়েছিল তিন নিযুত মানুষের হত্যায় কালকে কলঙ্কিত করে রেখে যাওয়া পশ্চিম পাকিস্তানী সরকারের ‘অপারেশন সার্চলাইট’।
           ---------------                             

লেখক পরিচিতি -
১৯৫৪ সনে অসমের নগাঁও জেলার সামগুড়িতে গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক দিলীপ বরার জন্ম হয়।চাকরি সূত্রে অসম সরকারের সঙ্গে জড়িত।অসম আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত শ্রী বরার ‘কলিজার আই’উপন্যাসটি অসম আন্দোলনের এক নিরপেক্ষ দলিল হিসেবে বিবেচিত।ভস্মাচলর ছাই,বধ্যভূমিত একলব্য লেখকের সাম্প্রতিক উপন্যাস।
 
   

No comments:

Post a Comment