Friday, May 3

মেহেবুব আলমের গদ্য



স্মৃতির পাতা থেকে


কখনও মনে হয় সারাদিনান্তে আমি একটি বার নিজের কাছেই ধরা পড়ে যাই, যখন ডায়েরি লিখতে বসি। সকলের থেকে লুকিয়ে গোপনে আমি যদি কিছু করি, তাহলে আমি ও আমার ওপরওয়ালার বাইরেও আরো একজন তা জেনে যায়, সে হল আমার ডায়েরি। আয়নায় আমি আমার নিজের অবয়ব দেখি ঠিকই, তবে নিজের মনকে যখনই দেখতে ইচ্ছে করে এবং স্মৃতিকে তাজা রাখতে আমি এই ডায়েরি নিয়েই বসে পড়ি। এমনই একদিন ডায়েরির পাতা উল্টোতে গিয়ে হঠাৎ একটি পাতায় চোখ আটকে গেল।

দিনটি ছিল ২০১৮-র লক্ষ্মীপূজা। আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে এক জেঠুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম গত লক্ষ্মী পূজায়। জেঠু ও জেঠিমণি দুজনেই প্রাইমারী স্কুলে চাকরি করেন। দুজনেরই উপার্জনে এবং কিছু টাকা লোনে তারা এক বিরাট অট্টালিকা খাড়া করেছেন। তবে বাড়িতে শুধু মাত্র মোটে তিন জন সদস্য। আর এক পরিচারিকা আছে লোপা। অনেক আগেই শুনেছি, তাদের একটি মাত্র পুত্র সন্তান। সে নাকি ভালো ভাবে কথা বলতে পারেনা, ঠিক করে হাঁটতে পারেনা, এমনকি ভালোমত দেখতেও পারেনা। এক কথায় যাকে আমরা প্রতিবন্ধী বলে থাকি। তার নাম ঋক। বার্ধক্যের কারণেই হোক বা লোকহাস্যের কারণেই হোক জেঠু ও জেঠিমণি আর দ্বিতীয় সন্তান নেননি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ঋক-ই ছিলো তাদের কাছে পৃথিবীসম। ঋক-ই তাদের যাবতীয় শান্তির ঠিকানা। চাকরি সূত্রে দিনের বেশির ভাগ সময়ই তাদের বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। তাই তাদের অনুপস্থিতিতে ঋকের দায়িত্ব সামলায় লোপা। তার জন্য অবশ্য সে বেশি অর্থের দাবী করে। বাড়ির কর্তা তাতে সম্মতিও জানিয়েছে। তবে বেতন বাড়লেও ঋকের প্রতি লোপার দায়িত্ব কতটা বেড়েছে তা বলা ভার। লোপার দায়িত্ব শুরু হয় জেঠু ও জেঠিমণির স্কুলে যাবার পর থেকে। আর শেষ হয় তাদের স্কুল থেকে ফিরে আসার সাথে সাথেই। তার বাইরে আর এক মিনিটও বেশি নয়। সময় হিসেবে নির্ধারিত হয় তার দায়িত্ব বোধ। তবে লোপার মত চরিত্রের বাইরেও অনেক চরিত্রই আছে, যাদের মধ্যে অন্তত আন্তরিকতা বোধটি আছে। আর এমনি এক চরিত্র হল অনিল। ঋকের এই বয়ঃজ্যেষ্ঠ বন্ধু অনিল প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিয়ম করে ঋককে শরীরচর্চা করায়, হাঁটতে ও কথা বলতে অভ্যাস করায়। উভয়ের বন্ধুত্বের মাঝে ‘সময়’ কোনো ভাবেই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা।
গত লক্ষ্মীপূজোর দিনেই ঋকের সাথে আমার প্রথম দেখা ও কথা হল। ঋকের বয়স হবে আনুমানিক পনের-ষোল। আমি গিয়ে ঋকের পাশেই বসে পড়লাম। জেঠু ও জেঠিমণিও রিকের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঋকের সাথে ভাব জমাতে আমি ঋককে একটি প্রশ্ন করলাম-
-ঋক, তুমি পড়াশুনা করো…?
-ঋক উত্তর দিল- হ্যাঁ…।
ঋকের থেকে এত সহজেই প্রত্যুত্তর পাবো, এটা আমার আশাতীত ছিলো। তাই আমি আমার পরবর্তী প্রশ্ন করলাম-
-কী পড় তুমি ?
-ABCD -পড়ি…।
-আর কী কী পড় তুমি ?
-১,২,৩,৪,৬,৭,৫,৯…পড়ি।
ঋকের ভাষা অস্পষ্ট হলেও কিন্তু তা বুঝতে আমার বিশেষ অসুবিধা হয়নি। আমি ঋকের আগ্রহ দেখে একের পর এক প্রশ্ন রিকের দিকে ছুঁড়তে লাগলাম এবং তার উৎসাহ বাড়াতে বললাম- বাহ্‌, তুমি তো অনেক কিছু শিখেছ ঋক !
-মণি (ঋকের দিদিমণি) আমা...য়  পড়ি...য়েছে।
-আচ্ছা ঋক, তোমার কোন্‌ খেলা ভালো লাগে ?
-বল খে...লা। বুঝলাম ও ক্রিকেট খেলার কথা বলছে।
-তুমি গান শোনো ?
-হ্যাঁ...হিন্দী গান। পাশ থেকে ঋকের মা ঋকের উদ্দেশ্যে বলল- বাবু নতুন হিন্দী গানটা করো তো। যেটা তুমি সব সময় গাও। কিন্তু ঋক অপরিচিত লোকের সামনে গান করতে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিল বলে, সে গান না করে শুধুই হাসছিল। আমিও খুব একটা জোর করলাম না। বরং আরও একটি প্রশ্ন রিকের কাছে তুলে ধরলাম-
-আমি কিন্তু আজ তোমার বাড়িতে, তোমার বিছানায় থাকব ঋক। তুমি কি আমায় তোমার বাড়িতে থাকতে দেবে ? এ কথা শুনে রিক খুব খুশি হয়ে হাততালি দিয়ে হাসতে হাসতে জানাল-
-হ্যাঁ…।
ইতিমধ্যেই আমি ঋকের কাছে এক পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছি। আমি যে ওর খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এটা তখনই বুঝলাম, যখন রিক আমাকে দুম করে একটি প্রশ্ন করে বসল। বুঝলাম যে, ঋক এখন আমাকে তার আপন ভাবতে শুরু করেছে। আমার প্রতি রিকের প্রশ্ন-
-তোমা...র   বা...ড়ি   কো...থায়…?
আমি ঋকের প্রশ্নে খুশি হয়ে তাকে জানালাম- তোমার বাড়ির ঠিক পাশেই তো আমাদের বাড়ি। বাবার সাথে একদিন এসো আমাদের বাড়িতে। আমরা দুজনে মিলে অনেক গল্প করব এবং অনেক খেলব।
আমি বললাম - ঋক, সত্যি তুমি খুব ভালো ছেলে।
অনেক গল্পের পর জেঠিমণির দেওয়া পূজোর প্রসাদ খেয়ে, বাড়ি আসব বলে উঠে ঋকের সাথে হ্যাণ্ড শেক করার জন্য আমার হাত বাড়িয়ে দিলাম। ঋক আমার হাত ওর চোখের কাছে নিয়ে অনেক্ষণ ধরে ভাল করে দেখতে লাগল। গভীর মনযোগে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে। যেন সে এখনই আমার হাতে কিছু খুঁজে পাবে। কিন্তু ঋক আমার হাত নিয়ে বার বার চুমু খেতে লাগল। তারপর মন খারাপ করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ যোগে বিড়বিড় করে বলতে লাগল-
-দাদা, তুমি আমা...র   সা...থে   থা...কো। তুমি বাড়ি  যে...ওনা।
ঋকের সেই অনুরোধ তীরের মত তীব্র ভাবে আমার বুকে বিঁধতে লাগল। সাথে সাথেই আমার চোখের কোণা দুটি রীতিমত ভরে উঠল। দ্রুত ঋকের মন খারাপ যেন আমার মনেও সঞ্চারিত হল। ঋকের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে শব্দ-বাক্য ও ভাষা যেন আমি সেই মুহূর্তে হারিয়ে ফেলেছি। শুধুই ভাবতে লাগলাম, এতক্ষণ ধরে ঋককে আনন্দ দেবার জন্য নানান চেষ্টা চালিয়ে থাকলেও, এখন ওর মন ভালো করার জন্য বা ঋকের মুখে পূর্বের সেই হাসি টুকু ফিরিয়ে দেবার জন্য আমি কিছুতেই কিছু করতে নিতান্তই ব্যর্থ। ঋকের মাথায় ও পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে আমি শুধু মাত্র এই টুকুই বলতে পেরেছি যে-
-ঋক, আমি আবার আসব। আমি আবার এসে তোমার সাথে অনেক গল্প করব এবং খেলব।
 আর এর থেকে বেশি কিছুই আমার মুখ থেকে সেসময় বের হল না। শুধু মাত্র এইটুকু বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে বাইরে আমি জুতো পড়ছি, ঠিক তখনই বাইরে থেকে আমি ঋকের গলার স্বর শুনতে পেলাম-
-দাদা ক...ই গেলো…? আমি দাদা...র কাছে যা...বো।
ঋকের কথার জবাব হিসেবে আমার মুখে যেমন কোনো শব্দ ও বাক্য ছিলনা, তেমনই একই রকম ভাবে ছিলনা রিকের মায়েরও। আমি নিঃশ্চুপ হয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। তারপরেও যতটুকু শুনতে পেয়েছি তাতে বুঝেছি, ঋকের আবদার এবার কান্নায় পরিণত হল।
বাড়ি এসেও ঋকের সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলি বার বার মনে পড়ছিল। ঋকের মত ভাই-বোনদের ভবিষ্যৎ কী তা বার বার আমায় ভাবিয়ে তুলছিল। আজ ঋকের অভিভাবক জীবিত আছেন, বার্ধক্য হবার পরেও বেশির ভাগ সময় তারা ঋককে দেবার চেষ্টা করেন ঠিকই। কিন্তু  আগামী দিন গুলিতে জেঠু ও জেঠিমণির অনুপস্থিতিতে ঋকের দায়িত্ব কে নেবে ? কে-ই বা ঋককে তার অভিভাবকের মত নিজের পৃথিবী বলে মনে করবে ? রিকের মত এমন অনেকেই আছে আমাদের চারপাশে, যারা আমাদের কাছে অবহেলার পাত্র হতে চায় না। বরং আমাদের কাছে চায় শুধু মাত্র আমাদের একটু মূল্যবান সময় আর একটু ভালবাসা। যা আমরা তাদের দিতে নিতান্তই ব্যর্থ।
আমরা অল্প কিছুতেই অনেক বেশি ক্রুদ্ধ হই, অভিমান করি, অনাহারে থাকি, অন্যের সাথে দুর্ব্যবহার করি, বাবা-মায়ের মনে কষ্ট দেই। কখনও কখনও এতটাই অবসাদে ভুগি যে আত্মহত্যার পথ বেছে নেই। কিন্তু এই ঋকদের দেখলে আমরা বুঝতে পারি যে, সত্যি আমরা কতটা ভুল করে থাকি যারা এমন করি। আমাদের থেকেও এই পৃথিবীতে অনেক দুখী মানুষ আছে, যাদের দুঃখের কাছে আমাদের যাবতীয় দুঃখ নিতান্তই তুচ্ছ। নিজে সুখে থাকলে হয়ত চোখের ওপর একটা প্রলেপ পড়ে যায়, তাই অন্যের দুঃখ সহজেই চোখে পড়ে না। ঋকের সাথে পরিচয় না হলে এই অপ্রিয় সত্যের সন্ধান আমিও যে ঠিক কবে পেতাম তা আমি জানিনা। তবে ২০১৮-র লক্ষ্মীপূজোর সেই দিনটি স্মৃতির পাতায় আজীবন থেকে যাবে এভাবেই।

3 comments: