Wednesday, May 1

উত্তরবঙ্গের জনজাতি : মণিদীপা নন্দী বিশ্বাসের গল্প





ওজা পাখির ঘর


  ১.
 স্রগ্ধরার বাড়ীতে আজ হুলু স্থূলু।বিকেল,বিকেল পেরিয়ে সন্ধে,সন্ধে পেরোনো রাত,ঘড়ির কাঁটা চর চর ঘুরছে তো ঘুরছেই।চোখে টলটলে জল বার বার মুছছে তিতির।গেট খোলাই আছে।গ্রীলে তালা পড়েনি।বার কয়েক চম্পক ঘর থেকে বেরিয়ে চৌরাস্তা,আবার কিছুটা হেঁটে পোষ্ট অফিস মোড়...আবার ফিরে আসা হতাশ্বাসে ওরা ফিরলেই তিতিরের ফোঁস ফোঁস বাড়ছে।ইতিমধ‍্যে হাওয়ায় কথা ভাসে বড় দ্রুত।ছুট লাগিয়েছে খবর হয়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত।রাত দশটাতেও তাই কেরানী পাড়ার জেঠু জেঠিমা,শান্তিপাড়ার মাসী মেসো সব জুটেছেন,সঙ্গে পাড়ার এদিক ওদিক চেনা পরিচিত জনেরা তো আছেই,উঁকিঝুঁকি,তারপর এসে দাঁড়ানো,সান্ত্বনা ঝরছে যেন'মধু মধু চিনি চিনি'...এসব চম্পকের একদম ভালো লাগেনা।এইসব দিদিভাইটার জন‍্য।সে আর সমীরণ মোটামুটি চুপ।সমীরণের কোন তাপ উত্তাপ নেই।আর চম্পক দুশ্চিন্তার পারদের নাড়া খেয়ে মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ছে,কিন্তু কোন কুল কিনারা না পেয়ে আবার ফিরে আসছে।-কি ব‍্যাপার...কি হয়েছেরে সমীরণ?
মাঝু কাকু এলেন এতক্ষণ পর।ফ‍্যামিলি ফ্রেন্ড বলে কথা।আর সবচেয়ে বড় কথা স্রগ্ধরা মিসিং।কোথায় গেছে তোদের বলে যায়নি?এবার তিতিরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা।তিতির একটু রুক্ষ স্বরেই জবাব দেয় ,তা সেটা হলে তো চিন্তাই ছিলনা।আজতো চার পিরিয়ডের পর ছুটি হয়ে গেছে স্কুল,আমি বন্ধুদের সঙ্গে অনেক আগেই ফিরি,আর মা তো স্কুল ছুটির পর ও বহুক্ষণ খাতা দেখা,কাজকর্ম সেরে ফেরে।প্রথমে তো অত ভাবিনি,...এবার আর চোখের জল বাধ মানেনা।..ঐ পিউ,মৌলী ওরা সব পড়তে এসেছে মার কাছে,ঘড়িতে আটটা পেরোলো যখন,তখন থেকেই চিন্তা শুরু হল।আর এখনতো দশটা...দেখ,বাবা কেমন চুপচাপ!এবার ঝেঁঝে ওঠে তিতির।...ঠিক হয়েছে।মা কোথায় গেল গেলনা,কি খেল,খেলনা কিচ্ছু তো দেখনা,এখন বোঝো...আমরা কি করব এখন!
  মাঝু রায় ধীরে  সমীরণের ঘরে যায়।-কিরে,ঝগড়া করেছিলি নাকি? তিতির ফুট কাটে।...সেত লেগেই আছে।মার তো সব কাজেই খুঁত।যেটা মা ভালো বলবে,সেটাই ওনার খারাপ,এবার...আর বোধহয় সময় নেই,পুলিশে...চম্পক দ্রুত কথাটা কানে যেতেই একটা কথাই বলে,না না,ওসব থানা পুলিশ  এখন ই করা যাবেনা।তলিয়ে ভাব কোথায় যেতে পারে,ফোনটাতো সুইচ স্টপ বলছে।যা মা কখনোই করেনা।...এমন কোথাও হয়তো আছে যেখানে নেট ওয়ার্ক ই নেই।ফোন কাজ করছেনা।
একথা বলেই কেমন চুপসে গেল চম্পকের মুখ।আর তিতির শব্দ করে ফুঁপিয়ে ওঠে।মৌলী,পিউ কিছুক্ষণ দেখে রিক্সা করে বাড়ী ফিরেছে।
    সমীরণের অসহ‍্য লাগতে থাকে।অফিস থেকে ফিরে এখন ও চা খায়নি।তিতিরকেতো বলাই যাবেনা চা কর।মা সোহাগী একেবারে।মনে মনে ফিস ফিস করে,আসবে আসবে।যাবে আর কোন চুলোয়? এইতো শুধু এদিক ওদিক,বাড়ীতে মন আছে নাকি!পায়ের নীচে সর্ষে দানাতো লেগেই আছে।উত্তরের কি এক সংস্থা বানিয়ে দিয়ে গেল ভদ্রলোক...ড:প্রীতম বিশ্বাস...ওনাকে করলেন সেক্রেটারী।কেন,না খুব ভালো ছাত্রী,প্রিয় ছাত্রী ছিল যাদবপুরের,তা এখন এত বেড়ে উঠেছে,আর সামলানো যাচ্ছেনা,আর ছেলে মেয়ের সামনে বলবেই বা কি!অপছন্দ তো বহুবার জানিয়েছে,আর তত ই বেড়েছে স্রগ্ধরা।আশ্চর্য!
-মাঝুদা বসুন।চা করি খান।দাদারাও চলে যাবে এখন।তিতির লাল চোখে তাকিয়ে থাকে ততোধিক নিষ্ঠুর বাবাটির দিকে।দপদপ করে রান্নাঘরে ঢুকে চা বসায়...মাঝু কাকুও যেন কি,যেন কত চিন্তা,একে তাকে ফোন করতে লেগেছে।চায়ের কাপ সহ ট্রে ঠকাস করে নামিয়ে রেখে,চম্পকের হাতে এক কাপ ধরিয়ে দিয়ে ছাদে চলে যায় কাঁদবে বলে।অসম্ভব আঁকুপাকু করছে মন।শেষমেশ মা ওদের ও ছেড়ে গেল,ভাইকেও!!কেমন অসহায় লাগে,আর বাবার উপর উষ্মাগুলো বাড়তে বাড়তে আগ্নেয়গিরি।
   মাঝু রায় ততক্ষণে সিনিয়র সাংবাদিক 'প্রভাত'পত্রিকার,যোগাযোগ করে ফেলেছে।-আচ্ছা,আপনাদের সঙ্গেতো স্রগ্ধরা দেবী প্রায়  প্রতিদিন ই কাজ করতেন,আজ কি প্রেসে গিয়েছিলেন?...না,মানে আজ এখন ও স্কুল ফেরৎ বাড়ী ঢোকেননিতো,তাই বলছি।...সমীরণ চায়ের কাপ হাতে উৎকর্ন তখন। একটু যে চিন্তা এখন হচ্ছেনা,তা নয়,আসলে তলিয়ে ভাবনা করা ওর স্বভাব ই না।তার উপর স্ত্রীর এত এদিক ওদিক কাজ,নামডাক কটা পুরুষের আর সহ‍্য হয়!মুখে যত ই স্বধীনতার বুলি কপচাক,বুক ঠুকে নিজের বৌয়ের কথা শুনতে হলেই কবজা করে রাখ পাঁচ আঙুলের মুষ্ঠিতে এটাইতো অভিপ্রায়।
...একটু যেন সূত্র পেয়েছে মাঝু।দাঁড়িয়ে পড়েছে।-হ‍্যাঁ বলুন,...বাসে উঠেছে?বিকেলের দিকে?...কোনদিকের বললেন,আলিপুর দুয়ার?ওও কোন সার্ভেতে গেছে?
তেমন পরিষ্কার করে জানা না গেলেও,এটুকু বোঝা গেল স্রগ্ধরা আলিপুরদুয়ারগামী বাসে উঠেছে পোষ্ট অফিস মোড় থেকে,কোন বিষয়ের সার্ভে করতে।...তিতিরের ফোঁপানি খানিক থেমেছে,চম্পক চুপচাপ।আর মায়ের এদিক ওদিক বেরিয়ে যাওয়ায় ওরা অভ‍্যস্ত।কিন্তু এরকম না বলে রাত করে বাড়ী না ফিরে আসা,এমন কখনো হয়নি।
সমীরণ তলিয়ে তাকায় নিজের দিকে।কিন্তু স্রগ্ধরার উপর রাগতো কমছেইনা,বরং ইগোতে লেগে রাগের পারদ ক্রমশ চড়ছে।সেইসঙ্গে তিতিরের সবটুকু বুঝে ফেলা,মার ভালো কাজ গুলোও যে বাবার কাছে উপেক্ষার এটা তিতির বার বার ধরে ফেলে বলে রাগ একেবারে চরমে পৌঁছে যায়।...তবু যা হোক,পুলিশে তো যেতে হলোনা।অবশ‍্য এখন ও সঠিক জানা যায়নি কোথায় আছে,ওদিকের প্রত‍্যন্ত গ্রামগুলোয় নেট ওয়ার্ক থাকেনা।...মাঝুদাও সকলে চলে যাবার পর ফিরে গেছে।ঘরের তিনটে প্রাণী যে যার বিছানায় বিনিদ্র ই এখন।প্রহরে প্রহরে পাখিরা যেমন ডাকে ডাকছেই।যত ভোরের দিকে যাবে,তত ই ডাকগুলো বদলে যাবে।

২.
আলিপু্রদুয়ার পৌঁছলো যখন বাসটা,ঘড়িতে সাড়ে তিন পেরিয়ে গেছে।এত সময় দেখে তো কাজকর্ম করা যায়না।তাছাড়া সব কাজ একা করলেই কাজটা এগোয় বেশী স্রগ্ধরা মিলিয়ে দেখেছে।গেল সাতদিনে টিফিন পিরিয়ডে,অফ পিরিয়ডে চৈতালি,তিস্তা,মহুয়ার কত গলা ফাটানো।কি,না...এবার তোর সঙ্গ আমরা নেব ই নেব।একাই ঘুরে আসিস সর্বত্র,তারপর খবরের কাগজের মুখ হয়ে উঠিস,ব‍্যাপার কি বলত?এতো এনার্জি পাস কোথায়?এ প্রশ্নটা এতবার শুনেছে,এখন আর খুশী হয়না,বিরক্ত লাগে।তাহলে বলছ কি!অভিপ্রায় কি,আমার ইচ্ছেগুলো বাক্সবন্দী করে রেখে দেব?আশ্চর্য!তা এবার ওগত দুবারের পুনরাবৃত্তি।যেই ছুটির ঘন্টা বাজলো,নারে,আজ আর হচ্ছেনা স্রগ্ধরা,বাপির স্কুলে কাল পরীক্ষা,না থাকলেতো পড়বেইনা।...চৈতালি উক্ত।একটু পর মহুয়া,তিস্তাও নানা অজুহাত খাড়া করে কেটে পড়ল।স্রগ্ধরা চিন্তায় পড়ে,আজ ওরা না বললে কোন্ ভোরবেলায় গাড়ী ধরে বেরিয়ে যেত। এখন কখন পৌঁছবে আর ফিরবেইবা কখন!কোচিং ক্লাস ও আছে।সে থাক,তবে বাড়ীতে ফোন লাগালেই চিত্তির,আর বেরোনো যাবেনা।মাথাটা কলিগদের নেগেটিভনেসে এত ঝাঁঝা করছে যে আর কিছু ভাবলোনা।স্কুল লকারে এতক্ষণের দেখা খাতাগুলো ঢুকিয়ে বড় ডায়রী আর কলম,কয়েকটা তা কাগজ ঢুকিয়ে নিল।আর ক‍্যামেরাতো সঙ্গেই আছে।ওর মোবাইলে ফটো তোলা যায়না।এ পেপারসটা তৈরি করতেই হবে দ্রুত।আর ইলেভেনের ছাত্রী সতি আর শোভনা কবে নিমন্ত্রণ দিয়ে রেখেছে।আজ লক্ষ্য করেছে ওরা স্কুলেও আসেনি।দিদিমণি ওদের টোটোপাড়ায় যাবে বলে।আরনা,কিচ্ছুটি না ভেবে সোজা হেঁটে পোষ্ট অফিস মোড়।একখনা ব‍্যাগ ই সঙ্গে,কাঁধের

     মাদারীহাটের দিকে যখন অন‍্য বাসে  চেপে চলতে শুরু করেছে বিকেল তখন।আবছা অরন‍্য অন্ধকার রাস্তার দুপাশে।এই ছায়া ছায়া অনুভূতি  কি যে টানে স্রগ্ধরাকে।বাসে সব খেটে খাওয়া মানুষেরা,কেউ চলেছে হাটের পসরা নিয়ে,কেউ পাইকারী জিনিস কিনে ফিরছে হান্টাপাড়া,লঙ্কাপাড়ার দিকে।হাসিমারা পর্যন্ত যাবে কেউ কেউ।মাদারীহাটে কয়েকজন শিক্ষিকার সঙ্গে দেখাও হলো,তারা আলিপুরদুয়ার কেউ কোচবিহারগামী বাসের জন‍্য অপেক্ষা করছে।স্রগ্ধরা এদের চেনে।হাত নাড়ে,আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারীহাট থানা থেকে ২৩কিলোমিটার দূরে অবস্থান টোটোপাড়ার,ঠিকঠাক বাস যদি পেয়ে যায়,মিস যদি না করে তাহলে ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে।ফেরার কথাটাও মাথায় আছে,তবে একটু আগে দীপু ফোন করেছিল কলকাতা থেকে,ও কয়েকবার এসেছে টোটোপাড়ায়,আর দিনের ভেজা ভেজা ঠান্ডা সৌন্দর্য আর রাতের চাঁদের জ‍্যোৎস্নায় টং ঘরে থাকালর দুরন্ত অভিজ্ঞতা এমনভাবে গল্পে গেঁথে দিয়েছে স্রগ্ধরার মাথায় বসে গেছে,বড় লোভ হচ্ছে বহুদিন থেকেই। দেখা যাক যাওয়া কপালে আছে কিনা।
   বাসে সাধারনত চোখ বুজে আসে।এখানে অরন‍্যের সৌন্দর্যের ঘন নিবিড়তা ওকে সচেতন করে রাখে।আপ্লুত হয়ে তাকিয়ে থাকে অরন‍্যে,শাল সেগুন মহল্লায় মাঝে মাঝে কাঠের আড়তখানা,কাঠুরেদের কাঠ কুড়োনোর ছবি মাঝে মধ‍্যে চোখে পড়ছে।চাইকি,বাইসন হরিণ ময়ূর সব ই মিলতে পারে...বরাত জোর থাকলে হাতি।কয়েকবার শোভনা ফোন করেছে বড় উৎসাহে।'আজ আর স্কুলে যাইনি দিদি,আপনি আসবেন বলে,আনন্দ হচ্ছে খুব।ঠিকঠাক আসুন...হান্টাপাড়ায় নেমে বাস পেয়ে যাবেন।'   আর কিছুক্ষণের পথ।টোটো জাতির ই হাতে গড়া গ্রাম'টোটোপাড়া'।পাশেই প্রতিবেশী দেশ ভুটান।ইতিহাস যেটুকু জেনেছে স্রগ্ধরা,তাতে আছে,আলিপুরদুয়ার সলসলাবাড়ী এলাকায় টটপাড়া গ্রামে টোটো জনজাতি বাস করত।সুদূর মঙ্গোলীয় থেকে পানা হিমালয় ভূটান পেরিয়ে তারা এই সলসলা বাড়ি টটপাড়ায় এসে যাত্রা থামায়।আবার যথাস্থানে ফিরে যায়।ডুয়ার্স অঞ্চলে বিভিন্ন জায়গায় অস্থায়ীভাবে বাস করতে থাকে।দীর্ঘ যাত্রায় প্রাকৃতিক দুর্যোগতো সঙ্গী ছিল ই,সঙ্গে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক টোটোজাতির পুরুষ নারী,শিশু মারা যায়।ভুটানের ভোদে নামের এক জায়গায় তারা বাস করে সে সময়।এখন ভোদের নাম হয়েছে জন্তু।ভুটানে থাকার সময় ই ভুটানের প্রাচীন জনজাতি ডয়া জাতি টোটো জাতির সঙ্গে গোষ্ঠী সংঘর্ষে মাতে।ডয়া জাতি টোটো জাতির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি করতে চাইলে টোটোরা তা নাকচ করে দেয়।কারণ ডয়াদের সঙ্গে তাদের সামাজিক নিয়ম নীতির কোন মিল ছিলনা।পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সাতি নামের নদীতে ডয়া জাতির রক্ত মিশেছিল বলে তারা সে সাতি নদীর জল পান করেনি কোনদিন।তাদের কাছে সাতি নদীর জল তখন থেকেই অপবিত্র।যাঁরা বেঁচেছিল দক্ষিণ পশ্চিম কোণে সরে গিয়ে বৌদ্ধ গাওয়ে বসতি গাড়ে।পরে আর ও দক্ষিণে গ্রাম বাড়িয়ে নেয়।জঙ্গল কাটে,অনেকগুলো ঝোরা আবিষ্কার করে।কতগুলো নাম দীপুর কাছে শুনেছে স্রগ্ধরা। নিতেনতি,চুয়াতি,দীপ্তি,দাতেনতি,...ইত‍্যাদি।প্রথমে দীপ্তি নদীর জল তারা ব‍্যবহার করত,এখন ওদের বাঁচিয়ে রেখেছে দাতেনতি।
     স্রগ্ধরা যত ওদের কথা শুনেছে তত বেড়েছে ওদের উপর আগ্রহ।আহা! বহুদিন পর্যন্ত অশিক্ষিত বন‍্যজাতি নিজেরা কিন্তু নিজেদের রীতি নিয়ম নিজেরাই তৈরি করেছে।সবচেয়ে ভাল লাগে বিবাহরীতির কথা শুনলে।নারীদের যথেষ্ট মর্যাদা এরা প্রথম থেকেই দিয়েছে।বিয়ের আগে পাঁচ ছ মাস তারা শ্বশুর বাড়িতে স্বামীর ঘর করতে পারে,যদি পছন্দ না হয় বা থাকা অসহ‍্য মনে হয়,পাত্রী বেরিয়ে আসতেই পারে। এই জনজাতি এ ব‍্যাপারে অনেক সভ‍্য মানুষ,সমাজ থেকে  কতটা এগিয়ে বোঝা যায়।আজো বোধহয় শোভনা টোটোর কাকার মেয়ের বিয়ে।ওদের রীতি,পূজা,নিয়মনীতি সম্পর্কে স্রগ্ধরার আগ্রহ অত‍্যন্ত বেড়েছে।বিশেষ করেস্কুলে শোভনা আর সতী ভর্তি হ ওয়ার পর।ওদের দিদি সুনীতা প্রথম বি এ পাশ করে টোটোদের মধ‍্যে।শহরে এসে কলেজে পড়ে চাকরীও পেয়ে গেছে।সেই পথ অনুসরণ করছে এখনকার পরের প্রজন্ম।তাই টোটোপাড়া গ্রামে গড়ে ওঠা সভ‍্যতার ছোঁয়া একটু ছুঁয়ে আসতে লোভ হয় বৈকি!
    ভাবতে ভাবতে আর অরণ‍্য সৌন্দর্য নিতে নিতে কখন যে পৌঁছে গেছে বাস।দেহাতি কিছু মানুষ,অন‍্যান‍্য জনজাতি,কিছু ঘর নেপালিও এদিক ওদিক নেমে ছড়িয়ে গেল। এবার কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই হবে।পাঁচটার সময় একটাই বাস টোটোপাড়ায় যাবে।স্রগ্ধরা খুঁজে খুঁজে একখানা চায়ের দোকান পেয়ে গেল।ওর তেমন কোন বাছবিচার নেই,অনেকেই চা খেতে ঢুকেছে।তারমধ‍্যে দু একজন টোটো জনজাতির মানুষ ও আছে।তারাও ঐ বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই যাচ্ছে।ওদের কাছেই জেনে নিল স্রগ্ধরা ওদের উপগোষ্ঠির কথা।টোটোদের প্রধান গোষ্ঠিরা-বহোবে,বৌদুবে,বুদুবে,ধিরিংচাংনকোবে,নরিনচাংনকোবে,মাংএবে,মাংনচিবে,দাংএবে,দাংকোবে,রেংকাইচিবে,নুবেবে,পিশোচানকোবে,..চট করে ব‍্যাগ থেকে ডায়রীটা বের করে।ক‍্যামেরা তো আগেই বেরিয়েছে।
       বিয়েতে যোগ দেবে বলে বিশেষ পোষাক ও পরেছে ওরা।এদের মধ‍্যে একজন কাইজিও আছেন।মানে সমাজের প্রধান পুরোহিত।তিনি আবার যোগ করলেন,বৌদুবে গোষ্ঠীর তিনটি উপগোষ্ঠী।ম ইপা,জাপা,স ইপা,থাপা ইত‍্যাদি।প্রত‍্যেক গোষ্ঠীর কুল দেবতা আলাদা ,এক গোত্রে বিবাহ ও নিষিদ্ধ।একটি গোষ্ঠির সঙ্গে মোট পাঁচটি গোষ্ঠীর বিবাহ হতে পারে।নিজস্ব সামাজিক রীতি মেনেই বিবাহ হয়।আলোচনা আর গল্পে গল্পে চা শেষ,ঝমঝমিয়ে লজঝড়ে ছোট গাড়ীটা চলে এল।স্রগ্ধরাকে ফিরে ফিরে দেখছে যাত্রীরা।আসলে,এদিক থেকে একটু অন‍্যরকম সাজপোশাকে একা একজন মহিলা চলেছে,একটুতো আগ্রহ হবেই।ওরাও নিজেদের মধ‍্যে কথা বলে যাচ্ছে,স্রগ্ধরাকে সামনের দিকেই একখানা সিট ছেড়ে দিল।ভাড়া মিটিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সে...আরে!এইযে টোটোপাড়ায় যাচ্ছে বলে র ওনা...রাস্তা কোথায়,!এইতো বোধহয় তিতি ঝোরা,বর্ষায় বিরাট চেহারা,এখন ও জল আছে,জলের উপর দিয়েই সিনেমাটিক ঢঙে ড্রাইভার গাড়ী চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব মুন্সিয়ানায়।হঠাৎ করে হড়কা বানের কথা মনে হল।শুনেছিল এ পাহাড়ী ঝোরা নদীতে হঠাৎ করে জল নামলে সব ভাসিয়ে নেয়।এইসব গাড়ী টাড়ি তখন তুচ্ছ।একটু কি কেঁপে ওঠে স্রগ্ধ রা! অল্প সময়ের জন‍্য ও কি মনে পড়ে তিতির আর চম্পকের মুখ,তাড়াতাড়ি ফোন বের করে,আরে!চার্জ আছে কিনা বোঝাই যাচ্ছেনা,নেট ওয়ার্ক ভোঁভাঁ।হ‍্যাঁ এরকম ইতো বলেছিল দীপু।জনসংযোগহীন কিন্তু, মনে রাখিস।এত শত তো আর ভেবে ওঠেনি।যেতে হবে,দেখতে হবে,ব‍্যস।শোভনাকেও এখন আর ফোন করা যাচ্ছেনা।গাড়ীটা ঢুকছে।দক্ষিণ দিকে বিশাল জঙ্গল।এ জঙ্গল ই লঙ্কাপাড়া,চা বাগান ও পশ্চিমে তিতি ভুটান পর্যন্ত প্রসারিত,প্রাচীনকালে টোটোরাতো শিকার ই করত।আবার শিকারজাত বস্তুর একাংশ কাইজি আর মোড়লকে উপহারের রীতি ছিল,এখন অবশ‍্য শিকার ছেড়ে চাষবাস করছে বলেই শোভনার বাবা জানিয়েছে।তিনিও মেয়েকে ভর্ত করতে এসে কতবার নিমন্ত্রণ করেছেন।এমনকি,নিজের বাড়ীতেই তৈরি করেছেন অতিথি গৃহ।আজতো শোভনা বোধহয় ওখানেই নিয়ে যাবে স্রগ্ধরা দিদিমণিকে।

      শোভনা,সতী,সুনীতা ওরা ছোট থেকেই দেখেছে শিকারীরা বম শিকারে যাবার আগে ঘরের বারান্দায় শিকারী পূজা(সাই)করত।
পূজারী লাল মোরগ বলি দিয়ে ছেড়ে দিত,মরার আগে মোরগটি পূর্বদিকে প্রাণত‍্যাগ করলে মনে করা
হত,শিকার নিশ্চিত।হাতি বাঘ,গন্ডার শিকার নয়,যেটুকু প্রয়োজন তাই শিকার করেছে তারা।
    বাইরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধ হ ওয়ার মতো,সেইসঙ্গে বেলাও কমে আসছে,আর যত ভিতরে ঢুকছে আলো যেন মরে যাচ্ছে।এবার যেখানে থামলো বাস সেখান থেকেই একটু এগিয়ে গ্রামীণ ব‍্যাঙ্ক দাঁড়িয়ে আছে।এখানেই শোভনার বাবার চাকরী।স্রগ্ধরা মাটিতে পা দেওয়া মাত্র ই শোভনা বাবাকে নিয়ে ছুটে এসেছে,আন্তরিকতায় মুগ্ধ আবিষ্ট সে।কিন্তু বেলা যে পড়ে আসছে তাহলে আজ ফিরবে কি করে!একথা বলতেই হৈ হৈ করে শোভনা,বলে তড়িঘড়ি,আজতো ম‍্যাম ফেরা হবেনা।বিয়ের অনুষ্ঠান দেখবেন না?আপনার জন‍্য ঘর ঠিক করে রেখেছি।এবার একটু শঙ্কিত হয় মনে মনে,মূলত তিতিরের জন‍্য,কোন ফোন ই ঢোকেনি,আর এখানে নেট ওয়ার্ক নেই।

৩.
অন্ধকার হয়ে এসেছে।একটু আগে চা বিস্কুট চলে এসেছে শোভনার বাবা গিরিধারী টোটোর অতিথি আবাসনের কাঠের দোতলায়।বড় গোল ঝকঝকে পালিশ করা টেবিলে ধূমায়িত চা।একটু আগেই আকাশ পরিষ্কার ছিল,একটুকরো কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছে তাকে,ঠিক স্রগ্ধরার মনের মত,যতখানি  ঝোঁকের মাথায় উৎসাহ নিয়ে ছুটেছিল,একদিকে দীপুর উৎসাহ,অন‍্যদিকে শোভনা সতিকে কথা দিয়ে সেটা তখনিই রাখতে হবে,এমন ই মানুষ স্রগ্ধরা।এ শিক্ষাই তো পেয়েছে ছোট থেকে।ওর আগ্রহ,সব কাজে বেদম উৎসাহ আর মিশুকে স্বভাবে পরিবার,স্কুল,সমাজ কোনখানেই বন্ধুত্ব,এ্যাডজাষ্টমেন্ট,এসবের অভাব হয়নি।এখানেও যে হবেনা জানতো নিজেই।তবে অন‍্য এক কাঁটা খচ খচ করছে।কোনভাবে,বাড়ীতে একটা খবর দেওয়া উচিত ছিল,কিন্তু সেটা বহু চেষ্টা করেও শোভনা,গিরিধারী বা ও নিজেও পারলোনা।এবার দুশ্চিন্তার কালো মেঘ নিয়ে বসে থাকা ওর স্বভাব নয়।তাহলে যে জন‍্য থাকা সেটাও তো মাটি হবে।আর গিরিধারীতো যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।এত চিন্তা আর করবেনা এমন প্রত‍্যয় নিল মনে মনে।
   একটু আগেই শোভনা দিদিমণিকে নিয়ে একটু দূরে যে বাড়ীতে বিয়ে হচ্ছে,সেই মেয়ের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।ছেলেও পাস দিয়ে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ‍্যালয়ের অফিসে আছে।অবাক হয়ে যায় স্রগ্ধরা,কিভাবে সভ‍্যতার অগ্রগতিতে উঠে আসছে ছেলে মেয়েগুলো মূল স্রোতে।ভাল লাগে মন ভরে যায়।স্রগ্ধরা ঔৎসুক‍্য নিয়ে বিয়ের যে রিচুয়াল সবটা ওরা মেছে কিনা জানতে চায়।শোভনা বোঝে দিদিমণি কি জানতে চাইছেন।বাইরে এসে বলে,সত‍্যিই দিদি,এদের বেলায় এমনটাহয়নি।কারণ দুই পরিবার দুই পরিবারকেআগে থেকেই চিনত,আর সীমাদিদিওতো এসি কলেজে পড়ছে,আর পাত্র যোগেশদাকে ও নিজেই পছন্দ করেছে।তাই ওর বাড়ীতে আগে থেকে থাকতে চায়নি ও।
-বা: বেশতো।..সকাল সকাল তোদের বিয়ের অনুষ্ঠান একটুক্ষণ যোগ দিয়েই আমায় বেরিয়ে পড়তে হবে,কিযে হচ্ছে ওদিকে,বেশ চিন্তা হচ্ছে বুঝলি!
--হ‍্যাঁ দিদি,একটু যদি বলতে পারতেন।
--যাক্ এখন আর চিন্তা করবনা।চল দোতলায়,তোদের প্রকৃতি পূজা,বিশ্বা এসব কথাগুলো বল্।
--হ‍্যাঁ ,দিদি, সতিকেও ডেকে নেব।ও আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে কতদূর থেকে হেঁটে হেঁটে চলে এসেছে।
       অন্ধকার পথের অদূরে আঙুল তুলে শোভনা দেখায়...ঐযে জঙ্গল,ওখান থেকে টোটোরা নানারকম জঙ্গলী শাক,মাশরুম,জংলী আলুর কন্দ সংগ্রহ করত আগে,এখনও কেউ কেউ করে।অঞ্চু ঝোরা ও হাসি ঝোরার পাশে প্রচুর জংলী বাঁশের চারা হালকা করে কেটে সব্জি বানাত, শোভনা জানিয়ে রাখে,আজ ডিনার হবে চিশাইয়ের সঙ্গে মাংস মিশিয়ে রান্না করা সুস্বাদু খাবারে।ওরা আর ও
খাবারের কথা জানায়।কাল সাধারণ মাছ মিষ্টি এসবতো থাকছেই,এছাড়া ওদের মাসরুম খুব প্রিয়,সে দারুন মাসরুমে একখানা পদ তৈরি হবেই।স্রগ্ধরার একটু ক্ষিধে ক্ষিধে পাচ্ছিল,এসবের টেষ্ট জানা না থাকলেও,নাম শুনেও ক্ষিধেটা জেগে উঠল।'বাড়িতে আজ মাসী না ঢুকলে কি খাবে ওরা...চিন্তা ঢুকতেই মনে পড়ল ফ্রিজে ডিমের ঝোল বানিয়ে রাখা আছে।আর স্রগ্ধরা না থাকলে সমীরণ বেশ রাঁধতে টাধতে পারে,তিতির বলেছে সে সময় ওদের বেশ পিকনিক পিকনিক ফিলিং হয়।আজও হোক। স্ত্রী নেই ফিরছেনা বলে মুষড়ে পড়ার লোক নয় মোটেই।

বাইরের আবছা আলো,আর সামান‍্য গ‍্যাসের আলোয় বেশ মায়াময় হয়ে উঠেছে বারান্দাখানা।এত সুন্দর আর ও হয়ে উঠেছে সময়গুলো শোভনা আর ওর পরিবারের আতিথ‍্যে।এক রাত থাকলো বলে বিকেল পেরোনো নদীতে পুজো,প্রধান পুরোহিতের বাড়িতে মিটিং(ওরা বলে লাচিজান-ওয়া)এর মধ‍্যমেই পুজোর সময় দিনক্ষণ ঠিক হয়।ওরা দৌড়ে এসে স্রগ্ধরাকে জানিয়েছে।আর পুজোতেও অক্টোবরের আগে পরে আবার আসার নিমন্ত্রণ।সকালে বিয়ের বাসরের আগে অন্চু পুজোর বাকিটা সেরে নেবে ওরা,তাই সকাল সকাল স্রগ্ধরার স্নান টান সেরে নেওয়া চাই।শোভনার এমন ই দাবী দিদিমণির কাছে।একসঙ্গে খাওয়া পর্ব সেরে গল্প গুজবে রাত কখন গভীর হয়।শোভনা জানায়,দিদি আমি পাশের ঘরেই আছি,একটু নীচে নেমে কলঘর,বাথরুম,আমাকে ডাকবেন উঠতে হলে। স্রগ্ধরা জানে,এখন শুয়ে পড়লে ওর আর ওঠার প্রশ্ন নেই।এতটাই ক্লান্তি লেগে আছে।
 পালিশ করা শক্ত কাঠের পাটাতনে তৈরি ঘরের ভিতর রাত্রিযাপন করলেও একলাটি সাদা চাদরে কেমন শির শির অনুভূতি,পাশের বেডখানা ফাঁকা, শোভনাকে বললে ও থেকে যেত,কিন্তু ওর সংকোচ হবে ভেবে শোভনাকে আর ডাকেনি।রাত পোষাক না পরে একটু প্রস্তুতি না নিয়ে কি করে ঘুমোবে,সে সব কথা আর ভাববেনা।কাপড়টা আলগা করে খুলে সরিয়ে রাখে।পাশের ঘরটায় সব আছে বলেছিল শোভনা।সত‍্যিইতো,একখানা নতুন নাইটি রেখে গেছে।একটু খিতখিতে অনুভূতি হলেও জামাকাপড় না ছাড়লে কি ঘুম হবে!পরে নেয় নাইটিটা,নতুনের একটা গন্ধ পায় বটে।অদ্ভুত সুন্দর পরিচ্ছন্ন এক ঘরের নির্জনতা যেন আর ও জোর শব্দ করে।আশ পাশ থেকে যেন নি:শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ ভেসে আসে।চোখ বুজে শোভনা,সতী,ওর বাবা একজন ব‍্যাঙ্ককর্মী,অন‍্যজন ব‍্যবসায়ী...এদের কথা ভেবে ,অঞ্চলটার প্রতি একান্ত আনুগত‍্য দেখে মনে হয়,এই নতুন যারা শিক্ষা পাচ্ছে ছড়িয়ে পড়ছে টোটোপাড়া ছেড়ে অন‍্য কোথাও কলকাতা,কিংবা অন‍্যান‍্য কর্মস্থলে,ওদের সংস্কৃতিকে কি ওরা ধরে রাখবে শেষ পর্যন্ত!ভবিষ‍্যৎই বলবে সেকথা।কি অদ্ভুত এদের দৃষ্টিভঙ্গি,অন‍্যান‍্য আদিবাসী,উপজাতি বন্ধুদের মত এরাও প্রকৃতি পূজায় বিশ্বাস করে,ওরা জানে পাহাড়কে,গাছপালাকে সন্তুষ্ট না করলে পরবর্তী দিনগুলো শুভ হবেনা।
সামাজিক,পারিবারিক আর গোষ্ঠী পূজাতো ছিল ই,জল নিমন্ত্রণ ওরা করে অন‍্যভাবে।কি অদ্ভুত ভাবে কলস হাতে সরে গেছে ঝোরার ধারে বিয়ের আসর থেকে।
গ‍্যাস ল‍্যাম্পখানা নিভিয়ে দেয়।ও বুঝতে পারে,এইযে পরদিন সকালে সীমার আর যোগেশের বিয়ে নিয়ে হৈ চৈ ওদের,এইযে আনন্দ এসব ই ওদের বিশ্বাসে সংস্কারে তেমন করে আঘাত লাগেনি বলে,দুজনেই এক ই এলাকার,এক ই গোষ্ঠী ভুক্ত বলে।একটু অন‍্যরকম হলে এ আয়োজন হত!টোটোরা বিশ্বাস করে,অন‍্য জাতির পুরুষ বা মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা গুরুতর অপরাধ।এই ধরণের ব‍্যভিচার যদি ওরা প্রশ্রয় দেয় তাহলে টোটোপাড়ায় হবে অজন্মা।বিনা রোগে মানুষ মরবে,কলেশ্বর ক্রুদ্ধ হবেন,শিলাবৃষ্টি হবে,শস‍্য নষ্ট হবে,দুগ্ধবতী গাই দুগ্ধহীন হয়ে যাবে,মানে টোটো জাতির অমঙ্গল ও ধ্বংস নেমে আসবে বলে টোটোদের বিশ্বাস।তবে এ বিশ্বাসগুলো কালে কালে থাকবে কি!এই শোভনারাও কি সংস্কারে বিশ্বাস করবে,মনে হয়না।
      এখানে এই গ্রামে ঢোকার পর থেকেই মনে হচ্ছে পাহাড়,নদী,অরণ‍্য,ভূমি সবাই যেন এক একজন প্রাণসত্তা।সজীব চলে ফিরে বেরানো জীব।জীবনযাত্রার প্রয়োজনে মানুষ এদের সঙ্গে মিশে ওদের আত্মীয় করে নিয়েছে,তুষ্ট রাখতে চেষ্টা করছে।...বাইরে অন্ধকার ঘন।কাঠের ঘরে ফাঁক ফোকর গ'লে বাইরের প্রকৃতি যেন ঢুকে পড়তে চাইছে।হঠাৎই টোটোদের অপদেবতা পিদুয়ার কথা মনে হয়,মাথা জুড়ে খানিক ভয় দৌড়ে আসে। ওদের বিশ্বাস অদূরে উত্তরে যে বাদু পাহাড় ঐ পাহাড় সংলগ্ন তিতি নদীর ধারে তিত্রীং নামে গভীর অরণ‍্যে পিদুয়া,মৈশিং অপদেবতারা আছে। পিদুয়া কে তাই ওরা পুজো করে। সেখানেও প্রকৃতি যেন মিশে আছে। গভীর অরণ‍্যের মধ‍্যে পিদুয়ার পুজো দিলে তারা ভূত,প্রেত,দানবের হাত থেকে বাঁচবে।
      এখনতো শ্রাবণ।তাই বোধহয় কাল ওরা অঞ্চু পুজোর আয়োজন করেছে। এই যে প্রকৃতি পুজো,ফসলের পুজো,বিশ্বাস এর সঙ্গে স্রগ্ধরার কোথায় যেন এক টুকরো ভালো লাগা তৈরি হয়েছিল আগেই।এবার কাল যে সেসব বিশ্বাসের ছবি চোখের সামনে দেখবে ভেবেই উদ্বেলিত স্রগ্ধরা ভেবেছিল,আজ না ঘুমোলে কেমন হয়, বারান্দায় বেরোবে বলে দরজাটা খুলতেই...কে যেন ফিস ফিস করে,বাতাসের উদ্দামতায় ঝোরো দাপটে এক ধাক্কায় কপাটে শব্দ তোলে,একা কেঁপে ওঠে শরীর।ছিটকিনি তুলে দেয় সঙ্গে সঙ্গে।চাদরের উষ্ণতায় ধিকি ধিকি নানা ভাবনায় কখন ঘুমিয়ে পড়ে।
----------------------
৪.খুব সকাল সকাল কিচির মিচির হৈ হুল্লোরে ঘুম ভেঙে গেছে অনেক্ষণ।দরজায় শব্দ করে শোভনা যখন এসে ঢোকে ওর ঘরে,বোঝা যায় ওর স্নান হয়ে গেছে।হাতে বোনা এক নতুন বুনটের সুতির শাড়ীতে ফুলো চোখ ছোট নাক আর ফরসা রঙে প্রকৃতি কন‍্যা মনে হচ্ছে,একগাল হেসে জানায়,দিদিমণি,ডাকিনি তোমাকে,হয়তো অনেক রাতে ঘুম এসেছে,আর বাবা "প্রভাতে"র সাংবাদিকের ফোনে অফিস থেকে জানিয়ে এসেছে তুমি আজ ই ফিরছ,আমাদের সঙ্গে আছ।...আহা!নিশ্চিন্তির সুবাস ছড়ালো।রবীন্দ্রনাথের সেই কথা মনে এল,"প্রাচীন হয়েও চির নতুন"।লোকায়ত মানুষের জীবন চর্যা আর মানস চর্চাইতো লোক সংস্কৃতি।এতো ঐতিহ‍্য নির্ভর।এ সংস্কৃতি মৌখিক ভাবে,হাতে কলমে অথবা বংশানুক্রমেই প্রবাহিত হয়।এতো অতীতের প্রতিধ্বনি হয়েও বর্তমানের বলিষ্ কন্ঠস্বর।নিজেকে স্রগ্ধরার অত‍্যন্ত পরিপূর্ন মনে হয়,শোভনা আর গিরিধারী,সতী,ওর বাবা এরা তো সেই সংস্কৃতিকেই বয়ে নিয়ে চলেছে শ্রদ্ধার সঙ্গে।ওর হাতের পাত্র একটু দ্বিধা নিয়ে হাতে নিল স্রগ্ধরা।সঙ্গে সঙ্গে শোভনা বলে ওঠে,দিদি,কাল গল্প করেছিলাম বলে ভেবনা তোমাকে 'ইউ'দিয়েছি,তোমার জন‍্য চা এনেছি,একেবারে গ্রীণ টি।এগুলো বাবার স্টকে থাকে,কত অতিথি কলকাতা থেকে ফোন টোন করে মাঝে মাঝে চলে আসেন তো!এবার একটু লজ্জিত স্রগ্ধরা অপ্রস্তুত।
-নারে,তা ভাবব কেন!
ওদিকে চায়ের গোল মত কাঠের রঙের পাত্র হাতে নিয়ে দুজনে রেলিঙে দাঁড়ায়। নীচে ঝুঁকে দেখে একটু দূরে গাছঘেরা এক বাড়ীর প্রঙ্গণ আর সামনের কাঁচা পাথুরে রাস্তায় মানুষের জটলা,হৈ হৈ।আনন্দের হৈ চৈ দেখলেই বোঝা যায়।জিজ্ঞাসু চোখে শোভনার দিকে তাকাতেই ও বলে,"আরে দিদি,আজ শুধু বিয়েই না।মাদি-পাই-পো-আ অনুষ্ঠান।"-সেটা কি?
-ঐ যে তোমরা নামকরণ অনুষ্ঠান করোনা...ঐরকম নতুন জন্মানো শিশুর নামকরণ অনুষ্ঠান হচ্ছে গো।
তাড়া তাড়ি চা আর মেরি বিস্কুট শেষ করে স্রগ্ধরা।
....চল্ তো শোভনা,একটু দেখি।কাছে যেতে বাধা দেবেনাতো কেউ?
-না না,তা কেন? কাল ইতো যারা বাকি ছিল সকলেই জেনে গেছে তুমি এসেছ,থাকছ আমাদের উৎসব অনুষ্ঠান গুলোয়।
মাঝ উঠোনে দুটো চেয়ার পেতে দিল ওরা।স্রগ্ধরা একা বসলে খারাপ দেখায়, গিরিধারী টোটোও পাশের চেয়ার খানা একটু টেনে নিয়ে বসেছে। শোভনা আর সতী দাঁড়িয়ে দিদিমণির পিছনে।এক এক করে কি হচ্ছে বুঝিয়ে চলেছে ওরা।- ওই যে দেখ দিদিমণি,বাচ্চাকে ঠান্ড জলে স্নান করিয়ে পবিত্র 'ইউ' বা মদ ছুঁইয়ে দিচ্ছে ওরা ওর মুখে।...অজান্তেই স্রগ্ধরার মুখ থেকে "ইস্"কথাটা বেরোয় আফশোসের মত।...আসলে দিদি,এত বিশ্বাস।...ঐ দেখ দিদি,শিশুর মা নিজে হাতে দূর্বা ঘাসের মালা তৈরি করেছেন আর কার্পাস তুলো থেকে নিজের হাতে সুতো কেটেছেন।এর নাম শংভি।স্রগ্ধরা ডায়রীতে লিখে নেয় সঙ্গে সঙ্গে।ঐ সুতো আবার হলুদ রঙে রাঙিয়েছে।দেখ, এর নাম "মাদি'।সুতোয় ব়াধা হশ ঝাটার ক্ষুদ্র অংশ দূর্বা ঘাস,এক খন্ড গোটা হলুদ,তারপর ঐ সুতো শিশুর হাতে বেঁধে দেওয়া হল।আর দূর্বার মালাটি ঐ দেখ,বাচ্চার গলায় পরিয়ে দিল।নামকরণ ও হয়ে গেল। কি নাম দিল রে? এখনিই জানা যাবেনা দিদি।...আর ঐ যে মাকে দেখছনা, ওতো কয়েকদিনের মধ‍্যেই গৃহস্থালির নানা কাজে যোগ দেবে।তখন আবার'বদি-লংমি'অনুষ্ঠান হবে।প্রসূতি মাকে একখন্ড কাপড় গ্রহণ করানো হয়, সে বস্ত্রখন্ডে শিশুটিকে পিঠে বেঁধে সে সংসারে্য কাজকর্ম করবে।
বাবা!....এত নিয়ম!
হ‍্যাঁগো দিদি,অনেকেই ধরে রাখে,আর টোটো সংস্কৃতি,বিভিন্ন ধর্ম ,আচার,পূজা রীতি অনেকেতো জানেইনা।তাই আমরাও পরবর্তীরা এই অনুষ্ঠানগুলোয় সময় মেনে ক্লাস ট্লাস বন্ধ থাকলে চলে আসি,যোগ দিই।যেমন সীমা দিদির বিয়ের জন‍্য এবার আসা।স্কুল হোষ্টেলে বলে এসেছি দুজনেই।
...চল তাহলে সীমাদের বাড়ির ধর্মীয় অনুষ্ঠান দেখে নিই।বাবাকে বল,এরপর ই আমি বেরিয়ে পড়ব সকাল সকাল।
-হ‍্যাঁ দিদি,স্নানতো হয়েই গেছে,আমাদের সঙ্গে একটু খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন।সতী বলে ওঠে।

যখন ওরা সকলে টোটো পাড়া প্রাথমিক বিদ‍্যালয়ের পাশ দিয়ে সীমাদের বাড়ীর সাজানো গেট দিয়ে ঢুকলো ততক্ষণে কতগুলো ধর্মীয় পুজোর রীতি আচার,প্রকৃতি পুজো,অঞ্চুর বাকি পর্ব,আর ময়য়ূ দুটোই সেরে ফেলেছে ওরা।দুটোই ঈশ্ পা পুজো। অঞ্চু(ওংজু)ছোট পুজো,আর ময়য়ূ বড় পুজো। সকলেই নতুন জামা পরে আনন্দে ঘুরছে ফিরছে।

আসলে সীমা আর যোগেশ দুজনেই টোটোপাড়ার মান অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে,তাই কাইজি আর সমাজের মোড়ল স্থানীয়রা ওদের বিয়ের আগেই ঐ দুটো পুজো করে তারপর এই বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে।
পুজোয় নৈবেদ‍্য সাজিয়ে, অতি ভোরে মোরগ-মুরগী বলি হয়ে গেছে।রক্তের ধারা সে চিহ্ন রেখেছে মাটিতে।শোভনা যোগ করে, অঞ্চু পুজো আগেই করে নেওয়া হয়েছে দিদি,উনিশ দিন পর আজ ময়য়ূ পুজো দেখলে তুমি।
     ঘরের ভিতর চাটাইয়ের উপর বসে সীমা।সুন্দর শাড়ী পরেছে।পুরো অনুষ্ঠান দেখা হবেনা,একটু খুঁত খুঁত করছে মন।কিন্তু নিজস্ব নিয়ম রীতি যাই থাক,যোগেশ কিন্তু রেজিষ্ট্রীকরণের ব‍্যবস্থা করেছে,মাদারীহাট হয়ে জলপাইগুড়ির দুজন ম‍্যারেজ রেজিষ্ট্রার উপস্থিত হয়েছেন। দেখে ভালো লাগলো স্রগ্ধরার।ব‍্যাগ থেকে দুটো পাঁচশো টাকার নোট খামে ভ'রে সীমার হাতে দেওয়ার আগে ধান দুব্বো,গোটা পান সুপুরী এগিয়ে দিল সীমার মা,
-আশীর্বাদ করতে বলছে দিদি...শোভনা বলার আগেই দু হাত দিয়ে সেসব তুলে আশীর্বাদ দিল স্রগ্ধরা।সীমা একটু হেসে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে।
    টোটোদের সংস্কার বিশ্বাস লোক লৌকিকতা যে একেবারে হারিয়ে যায়নি এতে মন  ভরে যায় ওর। সবচেয়ে ভালো লাগে ওদের ঈশ্বরের নাম থাকলেও কোন আকার নেই,এই বিরাট প্রকৃতিই তাদের ঈশ্বর।
সকলের সঙ্গে বসে সাধারণ ফল প্রসাদ,নৈবেদ‍্য গ্রহণের পর মাংস ভাতের আয়োজনে...সামান‍্য ই মুখে দেয় স্রগ্ধরা।মুখ ধুয়ে ব‍্যাগ হাতে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরিয়ে দেখে গিরিধারী দাঁড়িয়ে।শোভনাও এগিয়ে দিতে প্রস্তুত।গাড়ীও যোগাড় করে ফেলেছে গিরিধারী,এ এলাকায় সে যে প্রভাবশালী বুঝতে অসুবিধে হয়না।শোভনা,সতী দুজনেই ভীষণ খুশী দিদিমণি এসেছিল বলে,ওরাও প্রণাম করে স্রগ্ধরাকে।ওর একটা ব‍্যাপার আছে,এক রাত বা একটু বেশীক্ষণ কোথাও কাটানোর পর চলে আসার সময় এলে কেমন যন্ত্রণা হয়।মিলে মিশে ডায়রী ভরা পচুর তথ‍্য আর মনে এই প্রকৃতির ভালোবাসা ভরে সে যখন বেরিয়ে যাচ্ছে টোটোপাড়ার বৌ ঝিয়েরা গৃহস্থালির কাজে ব‍্যস্ত,কেউ কুয়ো থেকৈ জল তুলছে,কেউ কাপড় কাচছে।ওর ই মধ‍্যে উৎসব বাড়ী ফেলে ওদের পিছু পিছু অনেকেই দিদিমণিকে বিদায় জানাতে এসেছে।বড় বড় সুপারি গাছ লম্বা হয়ে ছায়া
দিচ্ছে।অরণ‍্য সঙ্কুল এ টোটোপাড়া অঞ্চল বাড়ছে জন সংখ‍্যায় যেমন,তেমনি শিক্ষায়।গাড়ী যত এগিয়ে চলে স্রগ্ধরার কানে টোটোপাড়ার মেয়ে পুরুষের 'দেমসায়' নৃত‍্য গীতের আওয়াজ জোরালো থেকে মৃদু হতে থাকে।ঢোলকের আওয়াজ ঘুরে ঘুরে এসে শ্রুতি ঘিরে থাকে তার।
বাইরে ততক্ষণে লাল রঙের মারুতি ভ‍্যানখানা তিতিঝোরার স্বচ্ছ জলের নীচে নুড়ি পাথর ছাড়িয়ে,খানিক জল ছিটিয়ে ওপাড়ে হান্টাপাড়া পেরিয়ে হাসিমারার সাদাটে পথ ধরে মাদারীহাটের দিকে চলতে শুরু করেছে..শব্দ উঠছে হুঁস..
কখনো ভোঁস
-------------------
৫.আজ এ গ্রাম তো কাল ও গ্রাম।সংগ্রহণের সংরক্ষণের ঝুলি ভরছেই।অধ‍্যাপক ড: প্রীতম বিশ্বাসকে মনে মনে প্রণাম না জানিয়ে পারেনা।নিজের জায়গা,নিজস্ব উত্তরবঙ্গ,কতটুকু জানে তাকে মাটির মানুষ জন!শুধু পিছিয়ে যাওয়া অন্ধকারে ঢেকে রাখা মাটির সম্পদ গুলো নিয়ে বিত্তবানদের হুল্লোড়।অদ্ভুত বেয়াদপি।কার আগে কে আকাশ ছুঁয়ে দেবে তার প্রতিযোগিতা।অসহ‍্য হয়ে উঠেছে ঐ ফেসবুক পেজ। স্রগ্ধরা ঐ পেজ চম্পক খুলে দিয়েছিল বলে,আর এদিক ওদিক কি হচ্ছে,কে কি কাজ করছে জানার জন‍্য এক আধবার খুলত দিনে  অথবা রাতে।এখন আর ইচ্ছে করেনা।ঢাক পেটানোর জায়গাটা মানুষ পেয়েছে ভালো।অজস্র লাইক।অজস্র কমেন্টস্,এহব পড়তে পড়তে  স্রগ্ধরা কেমন অসার হয়ে পড়ছে ধীরে।নিজের ক্ষমতা,কাজ সব আটকে থাকে,চিন্তায় বিষাদ বাড়ছে শুধু।বাড়ীতে সিরিয়ালের পোকা সমীরণ অসীম আগ্রহে টিভির দিকে যখন তাকিয়ে থাকে,ঠিক সে মুহূর্তে মনে হয় এর একচুল ও যদি সে চম্পক বা তিতিরের পিছনে ব‍্যয় করত!সঙ্গে সঙ্গে সদর্থক ভাবনায় নিয়ে যায় নিজেকে,না না এইজন‍্য ই তো ওরা কত স্বাবলম্বী,কতটা আত্ম সচেতন।তিতিরের জন‍্য এবার ভীষণ কষ্ট হতে থাকে।জানিনা কাল রাতে কি দু:সহ চিন্তা ওদের কুরে খেয়ছে।চম্পকতো একেবারে চুপচাপ।নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা,কারোর দোষ না দেখা এক মহৎ ছেলে।ওদের জন‍্য ই এত দৌড়ে বেড়াতে পারে স্রগ্ধরা।এক বছর যাদবপুর তো অন‍্য বছর কল‍্যানী ইউনিভার্সিটিতে পেপারস্ পড়তে যায়।মূলত লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজের প্রায় পঁচিশ বছর পেরিয়েছে।স্কুল ছাত্রী সামলে,ওদের ই সাহচর্যে কি দারুন সব অনুষ্ঠান একের পর এক।ড:প্রীতম বিশ্বাস যে বছর প্রথম জলপাইগুড়ি এলেন,স্রগ্ধরা ওর সহকর্মী রুহাকে নিয়ে ঠিক রাভা এক লোকসংস্কৃতি গ্রুপ যোগার করে ফেলল। অতিথিরা তোরণ ছাড়িয়ে ঢুকছেন রবীন্দ্রভবনে,সঙ্গে রাভা জনজাতির নাচ আর মুখা বাঁশির অপূর্ব আওয়াজ।ড: বিশ্বাস সত‍্যিই অবাক হয়েছিলেন।-কি করে এত অল্পদিনে সবটা আয়োজন করলে?জিজ্ঞেস করেছিলেন।স্রগ্ধরা শুধু জানে উত্তরের জনজাতির বিশাল সম্পদের কথা।নিজস্ব সংস্কৃতি লোকায়ত বৈশিষ্টের কথা।ওদের রীতি,পূজা গান,ভাষা তুলে ধরতে হলে ইচ্ছেটাই তো বড় কথা,তাই কোন উত্তর দেয়নি।শুধু ধীরে বলেছিল,'সঙ্গে থাকবেন স‍্যার'।
      সেই তখন থেকেই চলছে অনুসন্ধান।একে গবেষনা বলে কিনা তলিয়ে ভাবেনি স্রগ্ধরা কোনদিন।ওর নানা কাজের মধ‍্যে যোগীন রায়কে খুঁজে নিয়েসাহায‍্য করে আসা যেমন,সান্তালিখোলায় রুহাকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে মেচেদের সংস্কৃতি খুঁজে আনা এটাও এক কাজ।
  আজ এতদিন পর হঠাৎই টোটো ছাত্রী দুজন আবার যেন মনের গোপন জায়গাটা ধরে বেদম নেড়ে দিয়েছে।কি কষ্ট,কত কায়িক,মানসিক শ্রমে উঠে দাঁড়িয়েছে,প্রতিষ্ঠা করেছে অধিকার।
ভাবতে ভাবতেই প্রখর আলোর মত সূর্যটা মধ‍্যগগন ভরে থাকে।টোটো পাড়ার ছায়া ছায়া শীতলতা কমে গেছে কখন।এখন গরম লাগছে।মাদারীহাটের মূল‍্যবান কাঠের রক্ষণাবেক্ষণ,গাছগুলোকে কড়া পাহারায় রাখে বীট অফিসার।ড্রাইভারের সঙ্গে গল্প করতে করতে আসে বাকি পথ, যেটুকু জানা যায়।আর একটু পর আলিপুর।নতুন জেলা।...চা খাবেন দিদি?..
নানা ভাই আমার একটু তাড়া আছে।তুমি খেয়ে এসো।পরে বীর পাড়া বা ধূপগুড়িতে ভাল মিষ্টির দোকান এলে দাঁড় করাবে।
-ঠিক আছে ।আমি এক ছুটে যাব আর আসব,পাঁচ মিনিট দিদি।
একা হতেই বাড়ীর জন‍্য ম কেমন ই করে এবাআর।হুট ছুট বেরিয়ে পড়া,কাজ কর্মে এখানে সেখানে আর সবচেয়ে বড় এখনকার যে কাজ ওর সংস্থা করছে রবীন্দ্র গান নিয়ে,বহু ছেলে মেয়ের ভীড়,এর মধ‍্যে শোভনাও হোষ্টেলের মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে ওদের অনুষ্ঠান দেখে গেছে রবীন্দ্রভবনে।
ভাবতে ভাবতেই ড্রাইভার ফিরে আসে।এবার সোজা চল ।কোন রাস্তা ধরবে কে জানে!খুব যান জট ইদানীং।ফোন এতক্ষণে কাজ করছে।প্রথমে বেজেই যায় দুবার।সমীরণকে ট্রাই করে পায়না।এবার তিতির।দুবার তিনবার...হুঁ,ঘুম ঘুম জড়ানো গলা।হুম্ মা,...কোথায় গিয়েছিলে তুমি?...একেবারে কাঁদছে দেখ,বোকা মেয়ে,আমি ভালো আছিরে। কাল ভীষণ ভাবে আটকে গেছিলাম।কাজ সেরে ফেরার গাড়ী ছিলোনা।...এখন ও শুয়ে কেন?জ্বর এসেছে নাকি?ভাই কোথায়?...এক নি:শ্বাসে কথাগুলো বলে ওদিকের ফোঁস ফোস শব্দ শোনে।বাইরে তাকায়।...আর কতক্ষণ লাগবে বলোতঝ ভাই?..এইতো বীরপাড়া ম‍্যাডাম,গয়েরকাট দিয়ে ধূপগুড়ি হয়ে বেরিয়ে যাব।আর বাইপাস রাস্তায় বেশীক্ষণ লাগবেনা।আর দেড় ঘন্টা।
    চম্পকের চুপচাপ গম্ভীর মুখখানা এসে ছুঁয়ে যায়।যাক,উড়নচন্ডী হলে কি হয়,মনতো সেই মায়ের ই।....গাড়ীটা ছাড়তেই দুদিকের সবুজ চা বাগান মন ভরে রাখে।যখন ই ডুয়ার্সের আনাচ কানাচ গেছে তখন ই চেষ্টা করেছৈ চা বাগানের মাঝ বরাবর রাস্তা ধরতে।বীরপাড়া,গয়েরকাটা জুড়ে সবুজছ সবুজ।গয়েরকাটা পেরিয়ে যেতেই মনে পড়ছিল হৈ হৈ করে উরশুল লাইন হিন্দী হাই স্কুল আর স্রগ্ধরার সাংস্কৃতিক সংস্থার ছেলে মেয়ে সব মিলে গয়েরকাটায় সাদরি ভাষায় চন্ডালিকা পরিবেশন।কি যে মন ভাল হয়ে যাওয়ার দিন সব।সবুজের দিকে তাকালেই মন অকারণেই ভাল হয়ে যায়।
 শোভনারা কাল স্কুলে পৌঁছে যাবে।বিয়ের অনুষ্ঠান নিশ্চয় ই এতক্ষণে মধ‍্যপথে। রাতে মূল ভোজ পর্ব।ওরাতো প্রকৃতির ই সন্তান।গাছপালা,নদীনালা,পাথরকেইতো দেবতা ভেবেছে তারা।প্রবাহিত স্বচ্ছ ঝোরার জল তারা কখনো নোংরা করেনা।এমনকি,প্রাতকৃত‍্য ও নয়।নদীকে এইযে মাতৃ রূপে পূজা করা এযেন শিখিয়ে দেওয়া সভ‍্য সমাজকে...ভালোবাসো ভালোবাসো।অন‍্যের ধর্মের প্রতি কোন বিদ্বেষ নেই তাদের। শোভনা সতীকে দেখলেই বোঝা যায় বড় স্নেহ কেড়ে নিতে জানে ওরা।পড়াশুনোতেও ভালো।ওরা স্রগ্ধরাকে অনেক গল্প করেছে কি করে মাছ ধরে ওরা,মূল নদী থেকে প্রবাহিত ছোট শাখানদীর মুখ বন্ধ করে টোটোরা মাছ ধরত।মাছেদের নামগুলো ওদের মুখে মিষ্টি শুনিয়েছে।টুপর্চুন ওয়া,তান্ গা(সাটি),জায় ইগা(শোল),জোবেন,দেপ্রেন,আবার কি তাড়াতাড়ি ওরা বলেছে,ডায়রীর পৃষ্ঠায় তবু লিখেছে।...জাসাসি,নিবে,পালগা,বারোবুটি,য়ুঙগা...ইত‍্যাদি।
    কি অদ্ভুত ভাবে শোভনা চোখ বুজে বলেছিল এই প্রকৃতি এই সবুজ থেকেই তো আমরা সব শিখেছি।ওজা পাখির পাতায় ঢাকা উঁচু ঘর বানানো দেখে ঘর বানানো শেখা।কি সুন্দর ওরা পাতার বারান্দা বানায়।উড়ে ঘর ছাড়ার আগেও বারান্দায় দাঁড়ায়,আবার ফিরে এসেও বারান্দায় বসে জিরিয়ে ঘরে ঢোকে।ময়ূরের নাচ দেখে নাচ শিখে নেওয়া,আর গান?বসন্ত বাউড়ির কাছে,আর জানো আমরা ময়ূরকে বলি পেখং,আর বসন্ত বাউড়ির নাম 'পত্র'।....সব লিখেছে স্রগ্ধরা,শুধুকি নিজের জন‍্য!নাতো।সভ‍্য সমাজের সদস‍্য হয়ে উঠছে যে ওরা ,ওইযে স্রগ্ধরার ছেলে মেয়ে,তিতির চম্পক ওরা কি জানবে কখনো?এসব কি নেট ঘেঁটে জেনে। নিতে পারবে,কখনো না।
শিকারের গান ও লিখে এনেছে।বাঘের সঙ্গে বন‍্য প্রণীর সঙ্গে যেন কথা বলছে ওরা।আহা!
               যা-টামু-মেতো পুওয়াআলাগা
               সেনা-হো-মেলাগে দাংতো
                নেদা-সংদা-লামা-চাউযে, 
                মিঠা ও সো হি: বাসো
                ওয়া লাগা-সুদা(বনের রাস্তায় যেতে যেতে ছানা সহ বন মুরগীর দেখা পেল,তাকেও টোটো শিকারী দল সতর্ক করছে,ওহে বন মুরগী তুমি তোমার ছাড়া সব সাবধানে থাকো।তোমার উপরে বিল।বাজপাখি আকাশ থেকে নজর দিচ্ছে)

চলে এসেছে। আকাশটা মুখ ভার করে আছে। কিছুতেই মুখ ভার করে ঢোকা চলবেনা।পরের মোড় পেরোলেই বাড়ির গলি রাস্তা।গাড়ীটাকে বড় রাস্তার মাথাতেই দাঁড় করায় স্রগ্ধরা।উৎসুক পাড়া প্রতিবেশীর উঁকি ঝুঁকি চলেই।সেসব কখনো তাকিয়ে দেখেনি,আজ একটু খচ খচ করছে।চারদিকে চোখ চলে যাচ্ছে।প্রথমেই মাঝুদা,...কি ব‍্যাপারকি বলোতো!বন্ধুটিকে একেবারে হতভম্ব করে দিয়েছ যা হোক।
একটু চুপ করে থেকে বলে,আপনারা হননি?বন্ধুর থেকে বুঝি বেশী রকম ই।এত চিন্তা করবেননা‌। একজন  পুরুষ হলে কিন্তু এত ভাবতেননা,তাইনা?হেসে ফেলে দুজনেই।
আসলে ফেরা হতোনা।দেরীতে পৌঁছনো,গাড়ী নেই...এসব আরকি!
একজন দুজন এগিয়ে আসছিল বটে,খেয়াল করেছে স্রগ্ধরা,একেবারেই তাকায়নি সে,সোজা বাড়ীর সামনে।কলিংবেল বেজে ওঠে বার দুয়েক।
 চম্পক গম্ভীর হলে ওকে কাতুকুতু দিলে বেশ হেসে ওঠে,পালায় ।আজ আর ইচ্ছে করেনা।কেনরে বাবা!এত জবাবদিহির কি আছে,কিছুই বললষবেনা সে,মনে মনে ভেবে নেয়।
চম্পক তালা খোলে,তাকিয়ে থাকে,এবার দুহাতে জড়িয়ে ধরে ছেলে...এক দীর্ঘশ্বাস চুলের উপর দিয়ে বয়ে যায়...।স্রগ্ধরা কি কেঁদে ফেলবে,মুহূর্তে স্টেডি।....চম্পু কি খেয়েছ আজ?দেখ কি এনেছি,বীরপাড়ার মিষ্টি...ইয়া বড় ছানার জিলিপি।দেখ।চম্পক হাত বাড়ায়,ফিক করে হেসে নিয়ে হাঁক দেয়,দিদিভাই....মা এসেছে
সেই ভার হয়ে থাকা শ্রাবণ মেঘ এবার ঝর ঝর জল...গুমোটের পর এইযে বরষণ,এত উত্তরের ই বৈশিষ্ট।
-তিতির,তোকে আজ একখানা শিকারের গান,মানে সাইরার গান শেখাবো।টোটোরা শিকারকে বলে যে 'সাইরা'....দেখ,চার ঘন্টার ওপর জার্নি করে এসেছি,চা খাবো।....
কোথায় গুমোট? তিতির বলে,চা বসাচ্ছি মাম মাম,আগে গানটা গাও দেখি...
শোন্,টোটো ভাষায় বন মুরগীর গান...
         'যা চাউজে চনতুনু ওয়ালাগা
         সেনা হো মেলা সেই দাংতো
         নেদা সুদালামা চাউজে
         মিটাও চো হিংবা সোওয়লা
          সুদা।মিসে নামু সিং সিং পাগা....'
বন‍্য সুর  তখন ভাসে একঘর থেকে অন‍্যঘর।
--------------------------------------------------------------
**সহায়ক গ্রন্থ

১.উত্তরবঙ্গের লোক সংস্কৃতির নানা দিগন্ত: সম্পাদনা,প্রমোদ নাথ,ড:জীবন রানা। ২.তরাই ডুয়ার্সের লোকসংস্কৃতি,:সম্পাদনা,আবদুর রহিম গাজী। ৩.বিশেষ কৃতজ্ঞতা:আমার টোটো ছাত্রীরা ও টোটোপাড়ায় বসবাসকারী মানুষেরা।
'










উওরবঙ্গের জনজাতি : সসীমকুমার বাড়ৈয়ের গল্প



কারানল


-মা ওরা এসেছে।
-কারা?
-মধুশিলা কাকারা।
-ঘরে আসছে না কেন? ডাক অদের।
-ঠিক আছে,, ডেকে আ-ন--তস্রায় যেতে যেতে থেমে গেল। পাঁজর কাঁপানো গুমগুম শব্দ করে একটি বাইক ক্রম আগুয়ান। বাইকটা এসে ঘরের  গা ঘেঁষে থামল।  সে বুঝল দাদা ফিরে এসেছে। মধুশিলাকে ডাকতে যাওয়ার তাড়া হারিয়ে সে বাবার মাথার দিকে চৌকির পাশে দাঁড়াল।

নির্মল ঘরে ডুকে চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলল-মা, ফাদার আসবেন খানিক বাদেই। বাবার জন্য প্রার্থনা করবেন। জিনৌ, তুই  রৌন্তুক দেবদেবীর আসন পত্র সরিয়ে রাখ। কতবার বলেছি, আমাদের ঘরে যীশু বাদে আর কিছু থাকবে না। ফাদার এসব পছন্দ করেন না। তিনি এই জইন্য আমাদের বাড়ি আসতে চান না। বাবার অবস্থার কথা বলে কয়ে আজ রাজি করিয়েছি।

-আমরা ফাদারকে সম্মান করি। তোর বাবার জন্য প্রার্থনা করলে আমাদের ভালো লাগবে, কিন্তু আমাদের কোচদের দেবীকে সরানোর কী দরকার। খড়খড়ে গলায় তার মা হিরা রাভা বলল।
-মা, তোমরা অদিম বিশ্বাস থেকে কিছুতেই সরতে চাও না কেন। জঙ্গলি বিশ্বাস কি খাওয়ায় না পড়ায়? বাড়ি ঢোকার পথে দেখলাম মধুকাকা সঙের মতো দলবল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা অসুস্থ বাবার ঘরে আসর বসাবে নাকি?
-তোর বাবা মধুকে ডেকেছে।
-ওরা আবার কি করবে?
-মধুকাকা এলে তোর বাবা একটু শান্তি পায় রে বাপ। বৃদ্ধ মানুষটা এই আছে এই নাই। মানুষটার ইচ্ছা মিটাতে দে। মায়ের কথা শুনে নির্মলের মুখ ব্যাজার হয়ে গেল।

তস্রায় চট করে ঘরটা গুছিয়ে ফেলল। তাদের বাড়িটা অন্যদের বাড়ি থেকে অনেকটাই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, গুছানো। মাচার মতো পাটাতনের উপর দোতলা কাঠের বাড়ি। আগে খয়ের গাছের কাঠ দিয়েব বাড়ি বানানো হতো। বনবাসীদের বন্যপ্রাণী, বৃষ্টি বাদলের হাত থেকে রক্ষার প্রাচীন প্রচলিত পদ্ধতির ঘর। আজকাল কাঠের অভাবে কেউ কেউ ইটের বাড়ি বানাচ্ছে। কাঠ জোগাড় করা কঠিন, দামি। জঙ্গল নিঃশব্দে উজার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কাঠ বনবাসীদের অধরা। বনরক্ষীরা শ্যেণদৃষ্টিতে মাপে অদিবাসীদের গতিবিধি। পোষা কাঠচোর নিঃশব্দে সাবাড় করে দেয় জঙ্গল। রায়ডাকের স্রোতে সমতলে ভেসে যায় কাটা কাঠের গুড়ি। তারা বহুকষ্টে কাঠের বাড়িটা বাঁচিয়ে রেখেছে। বাকি দু’টো ঘরে দাদা-বৌদি আর ভাই থাকে। পাদ্রির জন্য বসার জায়গা থেকে অন্য সব কিছুতের তস্রায়ের হাতের জাদুতে পরিপাটি রূপ নিতে সময় লাগল না। সে অন্য ঘরে গিয়ে কাপড় চোপড় পালটে এলো। মেয়ের দিকে তাকিয়ে মায়ের চোখ আটকে গেল। ঊর্ধ্বাঙ্গে পড়েছে কাম্বাং আর  নিম্নাঙ্গে লৗফুন। উজ্জ্বল কোচ-রাভা পোশাকে মেয়েটাকে ফুল ফুলপরির মতো মনে হলো। মেয়েটা তার কাছে ফুলপরিই তো, মা-বাবাকে এতো চমৎকার বোঝে। তিন কিলোমিটার দূরে লোকনাথপুর ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে সবার প্রিয় দিদিমণি সে। অনাদিবাসীরাও তাকে গুণগানে পঞ্চমুখ। চোখের সামনে হারিয়ে যাচ্ছে সব কিছুই আর মেয়েটা প্রাণপনে বাঁচাতে চায় হারানো সব। নিজের চেষ্টায় ‘কন্টং’ তাঁতে বুনতে শিখেছে  কাম্বাং-লৗফুন। তস্রায়ের পোশাক দেখে মায়ের মনে হল মেয়ে বিয়ের যোগ্য হয়েছে। নিজের পোশাক নিজেই বুনতে শিখে গেছে।  কিন্তু তাকে এই সাজে দেখে তড়াক করে  নির্মলের  মেজাজ বিগড়ে গেল-তস্রা, শাড়ি পরতে পারতিস না, এটা একটা ড্রেস হলো। সঙের মতো না সাজলে চলত না?
মা উত্তর দিল-তাঙি রামি কাপচা, বিয়ৌ সায়ি নাপচা। যে যুবতী কাপড় বুনতে পারে না, তাকে বিয়ের জন্য কেউ পছন্দ করে না। মেয়ে সমত্ত হয়েছে, এখন তো আমাদের পোশাকই পরবে। আমাদের কাপড়ে খারাপ লাগছে তোর জিনৌকে?
নির্মল কিছু বলল না কিন্তু তস্রায় বলল-দাদা, তুমি তো সার্ট প্যান্ট পরে আছো, আমি কিছু তো কিছু বলিনি। এ রাভা-পোশাক পরতে আমার ভালো লাগে। আদিবাসী পরিচয়ে আমার হীনমন্যতা নেই। আমরা কোচবিহারের রাজাদের কোচ বংশধর।

হিরা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখনই ছোটছেলে সুরেন পাদ্রি লরেন্স প্রভাস কলিতাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। পাদ্রি কলিতা ষাটের দশকের শেষে আসাম থেকে এসেছিল। সেই থেকে বনবস্তিই তার বাড়িঘর। তখন জঙ্গলবস্তি ছিল ভয়ানক দুর্গম। ডুয়ার্সের অরণ্যবাসী ছোট ছোট আদিবাসী সম্প্রদায়ের চেনা জগতের সীমানা বনবাদাড় যেন খড়িরগণ্ডিতে ঘেরা। ঝিলটং, রায়ডাকবস্তি, ইন্দ্রবস্তি, আন্দুবস্তি, সরাকালচিনি, মেন্দাবাড়ির কোচদের  জীবন মরণ সবই জঙ্গল ঘিরে। বাইরের জগৎ একটু একটু করে খুলছিল মিশনারীদের হাত ধরে। পাদ্রি প্রভাস কালিতা রায়ডাকবস্তিতে একটি টালির ঘর বানিয়ে শুরু করেছিল যীশুর আশ্রম, এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্যাপটিষ্ট চার্চ। স্কুল, ছোটখাটো দাতব্য চিকিৎসালয়।

 বনবস্তির সর্বপ্রাণবাদী ধর্ম ছেড়ে অধিকাংশ কোচ –রাভারা বিভিন্ন চার্চের ছায়ায় যীশুর অনুসারী। রায়ডাক, ইন্দ্রেরবস্তি জুড়ে ভিন্নপন্থী মিশনের স্থাপনের প্রতিযোগিতা চলে আড়ালে আবডালে। সমতলের কোচ-রাভারা সর্বপ্রাণবাদ বিশ্বাসে অটল, কিন্তু ঢুকে পড়ছে হিন্দুয়ানী বৃত্তে। রায়ডাকের বয়স্ক মানুষের মনে ঝর্ণার মতো প্রায়সই কলকল করে ওঠে  সর্বপ্রাণ সত্তা। তস্রায় মিশনারী স্কুলে পড়লেও তার ভাল লাগে রাভা জনজাতির আলেক আচার।
ঘরটা চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিল পাদ্রি।  তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। চেয়ারে বসতে বসতে সে  নির্মল আর সুরেনকে উদ্দেশ্য করে বলল- মাই সন্স, ক্যান ইয়ু হেল্প মি?
সুরেন বলল-বলুন, ফাদার।
-তোমরা বাবাকে একটু উঠিয়ে বসিয়ে দাও।

হিরা আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠল-না না, পুরো বসতে পারবে না। বসার ক্ষমতা নাই। মাথার দিকটা উঁচু করে দে তোরা।
আশি ঊর্ধ্ব বৗলাকে দুই ছেলে কোনোক্রমে উঠিয়ে ঠেস দিয়ে বসিয়ে দিল। তার বলিরেখায় ঝুলেছে কষ্ট। কষ্টের মধ্যেও দু’টি উজ্জ্বল চোখে পাদ্রির দিকে মিটমিট করে তাকাচ্ছে।

পাদ্রি বলল-বৌলা, ঈশ্বরের পুত্র যীশুর দয়ায় আপনি দীর্ঘ জীবন ভোগ করেছেন। আকাশ বাতাস, জল, সন্তান-সন্ততি সকলই তাঁর দান। মানুষ মাত্রেই পাপ করে। জীবনে যা কিছু অন্যায় করেছেন তা যীশুর কাছে স্বীকার করেন, ঈশ্বরের কারে প্রার্থনা করুন। ঈশ্বর আপনাকে বাকি জীবন কষ্টমুক্ত রাখবেন, স্বর্গে থাকবেন অনন্ত সুখে।

বৌলা বুঝতে পারল না সে জীবনে কী পাপ করেছে। বনবস্তিতে পরিবার প্রতি দুই একর করে জমি দিয়েছে সরকার। চাষবাস করেছে, বনবিভাগ ডাকলে বনের কাজ করেছে। পেটের প্রয়োজনে বা বায়খো উৎসবে শিকার করেছে জংলি শুয়োর, বনমোরগ বা ছোট হরিণ। তাও ত্রিশ চল্লিশ শিকার উৎসব প্রায় বন্ধ। তার পৃথিবীই বা কতটুকু? পাপের বোঝা খুঁজে না পেয়ে পাদ্রির মুখের দিকে খানিকক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
পাদ্রি তাগাদা দিল-কি হলো? কনফেস করো  বৗলা।

বৗলা ভাবল জঙ্গলে পশু শিকারই তাহলে পাপ। দোকান থেকে হাঁস মুরগি শুয়োরের মাংস কিনে খাওয়া পাপ নয়। সে দুর্বল গলায় বিড়বিড় করে বলল-আমরা পানীকোচ রাভা আদিবাসী মানুষ, দুর্গম জঙ্গলবাসী। খিদা আর আনন্দ-ফুর্তি বাদে আমাদের জীবনে কিছু ছিল না।

সিঙ্গারাবুড়ার পার্বণে সাগর-মাইচক  শিকার করছি জঙ্গলে, মাছ ধরছি রায়ডাক নদীতে, ঝর্ণায়। গাছ কাটছি রান্নার লাকড়ির জন্য, বাড়ি বানাইতে। সবার প্রাণ আছে। না বুঝে এতগুলা জীবন মারয়্যা মনে হয় পাপ করছি। ঋষিবায়, যীশু ভগবান, রৗন্তুক মা, মা তামায়,  আমারে ক্ষমা করে দাও। ঘরে রাখা রৗন্তুক দেবী আসনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে সে প্রণাম করল।

পাদ্রি যান্ত্রিকভাবে উঠে পড়ল। তার পিছন পিছন নির্মল, সুরেন কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত উঠনে নেমে এলো। সুরেন বলল-ফাদার, বাবা রোগ ব্যধি, বার্ধক্যে বড় কষ্ট পাচ্ছে। তার জন্য প্রার্থনা করলেন না?
-মাই সন্স, তোমাদের বাবা, মা-বোনের মধ্যে এখনও আদিম জড়ত্ব রইয়েছে। ঈশ্বরের রাজ্যে যেতে হলে তাঁর ভালবাসার শরিক হতে হয়। তোমরা ঈশ্বরের পথিক হয়েও ওদের ঠিকঠাক বুঝাইতে পার নাই।  মৃত্যুর আগে যীশুর চরণে আশ্রয় নিতে বলো।

পাদ্রি চলে যেতেই তস্রায় মধুশিলাকে ডেকে আনল। সঙ্গে তার দোসর মারু আর অজয়। ঘরে ঢুকতে মধুশিলা ইতস্তত করছিল কিন্ত আজ সে পণ করে এসেছে বৗলা দাদার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাবেই। এই বাড়িটা ছিল তার প্রাণের দখিন দুয়ার। কয়েক বছরের বড় হলে বৌলা যে প্রাণের আত্মা। একবেলা না দেখা হলে পাহাড়ি শুকনো ঝরণার মতো রুখা শুখা হয়ে যেত অনুভূতি, এখন এ বাড়ির অদৃশ্য দেওয়াল টপকাতে আড়ষ্ঠ লাগে। তাদের দেখে নির্মল গজগজ করতে করতে তার ঘরে চলে গেল। মধুশিলা নির্মল, সুরেনকে ছোট থেকে নিজের ছেলের মত ভালবাসে। দুই ভাই ধর্মান্তিত হওয়ার পর সম্পর্কগুলোর মধ্যে কেমন যেন আলগা হয়ে গেছে। ভাইয়েরা তাকে পছন্দ করে না এ বোধ তার জন্মেছে, প্রথম প্রথম কিছুতেই খুঁজে পেত না তার মনেও কী অপছন্দের মেঘ জমেছে। হয়ত ধর্ম বিশ্বাস ভাঙায় মেলামেশার সুযোগ কমে গেছে, আবার সেই সুযোগে ভালবাসায় ফাটল বাড়ছে। তার মনে হল ধর্ম সংস্কৃতির বন্ধনটাই আসলে আলগা হয়ে গেছে। নির্মলের ওভাবে চলে যাওয়া দেখে মধুশিলার মনটা আরো বিগড়ে গেল।
মধুশিলা ঘরে ঢুকতেই বৗলা চনমনিয়ে উঠল।  সে সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করতেই মধুশিলা এগিয়ে গিয়ে তাকে থামাল-না না আদা, তুমি ঠেস দিয়েই থাকো। কষ্ট হলে শুয়ে পরো।

বৗলা পূর্বাবৎ আধ শোয়া অবস্থাই রয়েছে। সে বলল-আজং, তুই আইছস তাতেই আমার বুড়া শরীলের ব্যথা কমে গেছে। তোরে দেখলে পরাণে নরম জলের মতো আরাম পাই। কতোকাল তুই এদিকে আসছ না ভাই। আগে একবেলা না আইলে তুই বাঁচতে পারতস? খক্‌খক্‌ খক্‌খক্‌-ই আজং ...
-আদা, তোমার লাইগ্যা পরাণের মধ্যে পরাণ লুকাইয়া কাঁদে। মাছ ধরা, শিকার করা, বিয়া থা, বায়খো উৎসবে চকৎ খেয়ে নেশায় আমরা চূড় হয়ে নাচতাম, গাইতাম। আমাগো জন্ম মিত্যু সব কিছুতেই আনন্দ, উৎসবের জন্য আলাদা করে বসে থাকতে হইত না। দাদা, নির্মলের বিয়া হলো গির্জায়। আমাগো আলেকা আচার, ৠষি ‘রসং কিছুই হইল না। ছোটখাটো অনুষ্ঠান হইলো বটে, সবই কেমন গির্জার গানের মতো ঠেকল। আমারা কোচা-রাভারা মরার দুঃখ পর্যন্ত ভুলে থাকি আনন্দে। আমার মনে হয় কী জানো দাদা,  ধর্ম মরে গেলে আচার বিচারও মরে যায়, গান শুকাইয়া যায়।
বৗলা হা করে শুনছি মধুশিলার কথা, ক্রমে তার বলিরেখায়  চিন্তার ভাঁজ দীর্ঘ হলো– আমি ওসব কিচ্ছু ভাবতে চাই না আজং। তোর বাঁশি না শুনে শুকনা ডাঙ্গায় মাছের মতো হয়ে রয়েছে শরীল মন। টের পাইছি জীবন একেবারে তলানিতে ঠ্যাকছে। খুব ইচ্ছা হয় তোর কারানলের সুর শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাই চিরতরে।

মধুশিলা আঁতকে উঠল-এ সব কি কও আদা!
-আজং, আমার বয়সের কথা, শরীলেরর কথা ভাব। বেশ কয়েক বছর ধরে বুকের মধ্যে কেমন শূন্য শূন্য লাগে, আনচান করে। প্রথম প্রথম বুঝতাম না, অস্থির লাগত। এখন বুঝি, সমাজ নমাজ হারিয়ে ফেলায় যন্ত্রণা। তুই আজকাল প্রায় আসস না, মন খুলে দু’টো কথাও বলতে পারি না। বাজা না আজং তোর বাঁশিখান।

বৗলার চৌকির গায়ে হেলান দেওয়া ছিল মধুশিলার বাঁশি। কারানল। ছয় থেকে আট ফু্টের ফুটহীন লম্বা পাহাড়িয়া নল বাঁশের বাঁশি। উপরে নিঃছিদ্র। ভিতরের গাটগুলো ফেলে দিয়ে এমাথা ওমাথা একটি মাত্র ছিদ্র করে নেওয়া হয়েছে। মধুশিলা কারানল তুলে নিল। বারোমাস শয়নে স্বপনে বাঁশিটি তার সঙ্গে থাকে। মাঠে গেলেও সঙ্গে  যায় কারানল। কাজের ফাঁকে বিশ্রামে বাজায়। তস্রায় প্লাস্টিকের বোতলে জল এগিয়ে দিল। কারানলের সরু দিকটায় খানিকটা জল ঢেলে দিয়ে বাঁশির ভিতরটা ভিজিয়ে নিল মধুশিলা। সে বাঁশিতে ফুঁ দিতেই পাশের ঘর থেকে নির্মল ছুটে এলো-কাকা, মাথাটা কি একেবারে গেছে, বে-আক্কেল হয়ে গেছে না কি? বাবা কতটা অসুস্থ সে বোধ আছে তোমার? চিরকাল আদিম থেকে যাবে?

হিরার  চোখে মুখে তীব্র একটি জেদি ভাব ফুটে উঠল। সবাইকে চমকে দিয়ে সে মোটা স্বরে বলল -তুই তোর বাবা ভিতরে ভিতরে কতটা অসহায় তা বোঝস? মিশন ইস্কুলে পড়তে গেলি আর নিজের সমাজ খোয়াইয়া আইলি। আমাদের বাড়িতে পুরানো কুটুম আসতে চায় না। আমরা রক্তের অভ্যাস হারিয়ে কোথায় যাম। তুই তোর ঘরে যা, মানুষটা আজ কাল চলে যাবেই, যাওয়ার আগে একটু শ্বাস নিতে দে।

-এই বাদ্য বাজনার আওয়াজ তো বাবার ক্ষতি করছে মা।
-যাবেই তো মানুষটা, সুরের মধ্যে যাউক। মধুশিলা বাজাবে।

নির্মল ভড়কে গেল। ঘরে উপস্থিত মানুষগুলোকে তার কেমন অচেনা মনে হলো। সুরেন বরাবরই একটু দমোনা মনের মানুষ। তস্রায় একেবারে মা ঘেঁষা।

 নির্মলের কাজে বাবা-মায়ের সায় নেই, তাদের উদাসিনতাই বলে দিত, কনোদিন মুখ ফুটে কিছু বলত না। ছেলে দু’টি মিশনের দয়ায় ছোটোখাটো কাজ জুটিয়েছে। মেয়েটা জেদি, নিজের চেষ্টায় সরকারি স্কুলে মাস্টারি পেয়েছে। নির্মল সবার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। তাকে বেশি অবাক করছে মধুশিলা কাকা। নিজে লেখাপড়া জানে না বলে শিক্ষিত লোকদের থেকে নিজেকে একটু দূরে রাখে। মধুশিলা কাকার চোখে মুখে খেলে যাচ্ছে উচ্ছ্বাস। সে করানলে ফুঁ দিয়ে বাজিয়ে যাচ্ছে, শ্বাস ফেলার ফুরসত নেই। বাঁশিতে আলাদা করে ফুটো নেই বলে শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কারানল অবিরাম বেজে চলা বাঁশি, বাজতে শুরু করলে অনর্গল বেজে চলে। এখন অবশ্য কারানল বাদক ঝিলটং তো দূরের কথা আর কোনো বনবস্তি এলাকায় নেই বললেই চলে। কারও কারও বাপ দাদার বাঁশি স্মৃতি ফলকের মতো ঝুলে আছে ঘরের চালে। আর কে এমন কষ্ট করে বাজাবে কারানল? বড়দিনে যুবক যুবতি নাচে, অঙ্গ দোলায় ডিজের তালে বা পাঁজর কাঁপানো হিন্দি গানে। তস্রায় এসবের থেকে থেকে দূরে থাকে, বনবস্তির বাইরে যায় উৎসব, পার্বণে। সে ‘বেবাক রাভা ক্রৌরাং রুঞ্চুম’র সদস্য। সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে সেও প্রাণপনে চেষ্টা করে যাচ্ছে রাভাদের পরম্পরা বাঁচাতে। তন্দ্রায় কাম্বাং-লৗফন-এর ওপরে কোমরে পরে লবগ  হার। সাপের মেরুদণ্ড থেকে তৈরি লবগ হতো, এখন মেলানো কঠিন।

 বহুদিন হলো মধুশিলা কাকাকে বলেছে, মরা সাপের মেরুদণ্ড যোগাড় করে দিতে। হার মানেনি সে, এখন প্লাস্টিকের লবগ কোমর-বন্ধনী পরেই নাচে শস্য তোলার গানে, যুদ্ধের নাচে। স্বপ্ন দেখে হাঁড়ের লবগ পরে বাড়িতেই  তাদের দলবল নিয়ে বায়খো পরবে নাচবে। ডাকবে গ্রামের যুবক যুবতীদের। ইচ্ছা ছিল বাবাকে বলে বায়থানে আসর বসাবে। কিন্তু বাবা বয়সের ভারে নূহ্য, শয্যাশায়ী। তবু তস্রায় মানে, বাবা যতদিন বেঁচে আছে সে-ই এই গ্রামের সাঙতাঙ্গাম। গাঁওবুড়া। তল্লাটের কোচ-রাভাদের সমাজ চলত বাবার পরামর্শে, এখন নিজের ছেলেরাই তাকে মানে না। ঘরে যতই ঢুকুক চেরাজিভের অবিশ্বাস, সমাজ ভাঙা অবিশ্বাস, মায়ের হৌসুগ অনুসারে চলবে তাদের গোত্রধারা।   তস্রায়-র মন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। যদিও একটা  চাপা ভয় কাজ করে তবু বিদ্রোহী মনকে সে চেনে। মানবে না সে পাদ্রির ফরমান।

-আঃ মধু, এখন আমার চলে গেলেও দুঃখ নাই। তোর পাহাড়ি ঝুমুর আমার রক্তে নেশা চাগাড় দিয়া উঠছে, খুব ইচ্ছা করছে মরার আগে এক চুমুক চকৎ খায়ে মরি। হিরা মায়রাং থেকে যা চকৎ বানাইতো না! এই কাজটা পাদ্রিবাবু ভালো করেছে, পোলাপানরে মদের নেশা ছাড়াইছে। আগে মদ বানাতেই চালের তিন ভাগের একভাগ চলি যাইত, নেশায় খাইয়া নিত আমাগো সুখ, আহ্লাদ। খক্‌খক্‌ ...অগো দেইখ্যা মুইও ঋষিবায় বাবার দিব্যি দিয়া মদ ছেড়ে দিছি। রক্তে নেশা চাগাড় দিয়া উঠলেও আর মুখে চকৎ তুলম না। মধু ওদের বল, কেউ একজন বংশ্রী বাজাক। তোমার মনে আছে হিরা, আমার বংশ্রীর কেমন সুর ছিল। খক্‌খ্‌ক, খ্‌কখ্‌ক। ও মা. .আ। কেশে কেশে বৌলার দমবন্ধ হবার দশা।

হিরা উঠে গিয়ে স্বামীর বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল-তুমি অত কথা কইও না গো। কষ্ট বেড়ে যাবে। আমার সব মনে আছে।

মধুশিলা কারানলের মাথাটা সামান্য উঁচু করে শুনল কিন্তু উত্তর দিল না। জীবনের মতো আবিরাম বেজে চলা বাঁশিতে ছেদ দিতে চায় না সে। ছেদ বা বিরতি তো সুরের মৃত্যু, জীবন জানে শ্বাসের কত দাম। সে লম্বা বাঁশিটার মাথা দুলিয়ে মারুকে ইঙ্গিত করল। মারু দলে খাম বাজায় আর অজয় টেমাক বাজায়। ছেলেপিলে জোগাড় করতে পারলে তাদের বাইদং-এ হাতে খড়ি দেয় মধুশিলা। মারু মধুশিলার ঈঙ্গিত বুঝতে পারল। সে বলল-আদা’গদা, তুমি আমাদের দলের মাথা ছিলা। আহা, কী চমৎকার বংশ্রী বাজাইতা। তুমি অসুস্থ হওয়ায় মোরা কাউরে দলে নিই নাই। কেডা আছে তোমার ধারেকাছে বংশ্রী বাজায়। জঙ্গলবস্তিতে দুই চাইরজন খাম বাজাইলেও কেউ বংশ্রী শিখতে চায় না। ওটা নাকি কিষ্ণের বাঁশি তাই বারণ। তুমি বাঁইচা থাকতে আর কাউরে বংশ্রী বাজনদার নিম না আজং।

মারুর কথা শুনে হিরার বুকের মধ্যে খাঁ খাঁ করে উঠল। লোকটার বাঁশিই তো দংশেছিল তাকে। লোকটাই ছিল হৃদয় ঝাড়ার ওঝা। বৗলা তাদের বাড়ি এলো। কামিন হিসেবে। চাষাবাদ থেকে বাড়ির যাবতীয় কাজ করত। হেমাগুড়িতে বাড়ি, সেখান থেকে আসার রাস্তাঘাট দুর্গম। ছিল ঝড় বৃষ্টির রাতবিরেত। তবু সে জল কাদা ভেঙে ঠিক সময়ে আসত, প্রাণখোলা উদ্যমে কাজ করত, কোনো কিছুতে না ছিল না তার। হিরার বাবা গণাথ রাভা বৌলার কাজে বেজায় খুশি। সে বলেছিল, আমার বাড়িতেই থেকে কাজ কর। আপত্তি ছিল না বৗলারও, থাকতে শুরু করল হিরাদের বাড়ি। সারাদিন কাজের শেষে সন্ধ্যায় মালিক আর কামিন বসে চকৎ খেতে খেতে হারিয়ে যেত রাভাদের বাপ-দাদার চোদ্দ পুরুষের কাহিনিতে। বাবা বলত-বৗলা তুই হলি নৌঙ ননোঙি কাহিনির রাজা।
বৌলা হা করে থাকত। বলত-বৗলা রাজাটা আবার কে বৗতৗই?

-হা হা, বৗলা রাজার কথাই জানস না, আমাগো সৃষ্টিতত্ত্ব লেকা আছে রে ‘হাসং টাকৌ’ আর ‘হা-তাঙি’তে। বৗলাদেবই তো ধরতী বানালো।

 -আমি তো পৃথিবীর কিছুই চিনি না খুড়া।
-তুইও আস্তে, আস্তে চিনবি। মুই কি ছাই লেখাপড়া জানি। প্যাটের জোগাড় করতেই বুড়া হইয়া গেলাম। বাপ-দাদার মুখে মুখে শুনি শুনি এখন একটু আধটু জানি। আমি তোরে আমাগ কোচগো জগৎ চিনাইয়া দিম।

-খুড়া, আমারে একবার চাঁন্দরডিঙা পাহাড়ে নিয়া যাবা।

গণাথ হাত জোড় করে প্রণাম করেছিল-তোরে চাঁন্দরডিঙা পাহাড়ের কথা কেডা কইছে?
-আমাগো গাঁওবুড়া কইছিল।
-চাঁন্দরডিঙা কি এখানে রে বাপ, পুব দিকে আসামের ধুবুরী জেলায়।

 চান্দসাউদের  সপ্তডিঙা মধুকর ওখানে পাহাড়ের মতো উপুড় হইয়া আছে।

-সাত পাহাড়ের তলায় নাকি সোনা রূপা মোহর ঠাসা এখনও। আমরা খুব গরিব মানষি খুড়া, চাঁন্দরডিঙা পাহাড়ের ধনরত্ন কিছু যদি মেলে মোর ভাগ্যে। মোরা লেঙ-হৗসুগের মানুষ। চান্দসাউসও ছিল লেঙ-গোত্রের। আমাগো গোত্রের মানুষের বোয়াল মাছ খাওয়া নিষেধ। জানো খুড়া, ওই বোয়াল মাছটা সাক্ষাইত একটা রাক্ষস। রাক্ষসটা লক্ষিন্দরের মালাই-চাকি খাইয়া ফেলাইছিল।

-ধনরত্ন তো মিলতেই পারে, চান্দসাউদের ডিঙা বলে কথা, সোনা রূপার ভরা ছিল সপ্তডিঙা। এক মধুকরেই কত ছিল। কিন্তু লোভ করিস নারে বৗলা বাপ,  তোর বুদ্ধি আছে, গতর খাটতে পারস। দেখবি তুই একদিন গাঁওবুড়া হবি। লোভ করলে বিষহরি’র মা মনসার কোপে ছারখার হয়ে যাবি। অশোকাষ্টমিতে ব্রহ্মপুত্তুরে নেতা ধোপানীর ঘাটে হাঁড় বিসর্জন দিলে লক্ষিন্দরে মতো জীবন বাড়ে। সেই তিথীতে তোরে নিয়া যাম চাঁন্দরডিঙি পাহাড়ে।

 জমে যেত এক একটা সন্ধ্যা। হিরার মা’র বানানো মায়রং থেকে দেশি মদ চকতে মৌজ হয়ে যেত মুনিব-মুনিষ। শিশু বাদে সবাই মিলে এক পঙতিতে চকৎ খেতে বাধা নেই, কোনো দিন মা-মেয়েও বসত আসরে। চালের দেশী মদে বুঁদ হয়ে যেত সবাই। মাতাল মাতাল। হেঁড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে গণাথ ঘুমাতে আসত আর বৌলা মাচায় বসে অন্ধকারে ভাসিয়ে দিত বাঁশির সুর। বৌলার বাঁশিতে নিবিড় হয়ে আসত অরণ্যবস্তির গভীর রাত-নাম্পার ফেয়ং ফেয়ং/ আনি তৗলৗই রৗম্বকি. . .বাতাস এসো এসো/ আমার অরণ্য মেঘে/ ওগো আকাশে উঁকি দেওয়া তারা। কিশোরী হিরার মনে গজাত প্রাজাপতি পাখা, চোখে ঘুম আসত না। বৗলা রাজার বাংশী তাকে একটু একটু করে যুবতী করে তুলছিল প্রতিরাতে। হিরার ভয় অন্য জায়গায়, সে বৌলার গোত্র জানে না। সমগোত্র হলে রাভা নরনা্রীর প্রেম অলঙ্ঘনীয়। মনকে শিকল পরাতে চেষ্টা করে, কিন্তু বেহায়া বাঁশি শিকলের আংটা ছোট করে দিচ্ছিল।
গণাথের মনেও খুব আনন্দ, সে বৌলাকে বলেছিল-বায়থানে লাগারে বেটা বায়খো পরব। তোর এলেম দেখি।

গণাথের পা ছুঁয়ে সটান বৌলা বলল-দেখ তবে খুড়া।

ষাটের দশকেও বায়খো উৎসবের ভাটা পড়েনি কোথায়ও। হিরা সবে টগবগে ষোড়শী আর বৌলা চব্বিশ পঁচিশের যুবা। তাদের বাড়িতে থেকে তিন চার বছরে গোটা বনবস্তি জয় করে নিয়েছে সে। ইতিমধ্যে গড়েছে একটা গান বাজনার দল। মধুশিলা বৗলার থেকে বেশ খানিকটা ছোট, সেই বালক প্রাণপনে চেষ্টা করে তার বাবার কারানল বাজাতে। তার লম্বা বাঁশিতে একটু করে ফুটে উঠত-ধতি-হি-হি-তি, হি-হি-হিতি। মাত করেছে বৗলা, সব বনবস্তির ছেলেবুড়ো গাঁ উজার করে জড়ো হয়েছে বায়থানে। বায়খো উৎসবে বাদ্যের আওয়াজ বনবস্তি ভাসতে ভাসতে মেখে যাচ্ছিল বন জঙ্গল। ডুং ডুং করে খাম বাজছে, সঙ্গে সমান তালে বাইদং, টেমাক বাজছে। সমস্ত সুরকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল বৌলার বংশ্রী। নৃত্য-গীতরত রাভা যুবতীরা যত না উচ্ছ্বল তার চেয়ে বৌলা বেশি ফুটছে। মাতোয়ারা যুবক যুবতীদের মাঝে হঠাৎ বৗলা হিরার হাত ধরে বলেছিল-তুই আমাকে বিয়া করবি হিরা? বিদ্যুৎ বেগে স্পর্শানুভূতিতে শিহরিত হয়েছিল কিশোরীবালা। কিন্তু পরক্ষণে সে স্থির হয়ে গিয়েছিল- তোমার হৗসুগ?
-ভয় পাস না। মুই জানি তোর হৗসুগ, মোহতক। তোরা কাছিম খাস না। আমার গোত্র লেঙবারায়, আমরা বোয়াল রাক্ষসকে ছুঁয়েও দেখি না। বল হিরা বল, আমায় . . .
হিরার মুখে বুলি ফোটে না। মনে হচ্ছে তার কানে বৗলার বাঁশি বলছে, বল হিরা বল. . .
গাঁওবুড়া বায়খো উৎসবে পতি-পত্নী নির্বাচন মেনে নিয়েছিল। গোত্র এক হলে প্রেমের মৃত্যু হতো। রাভা সমাজ কিছুতেই মেনে নিত না। এক হৌসুগে যে বিয়ে অচল। বৌলা যেন তখন সবার ঘরের পোলা। বিয়ে হলো তাদের। মাতৃতান্ত্রিক সমাজের রীতি মেনে বৌলা থেকে গেল হিরাদের বাড়ি। মায়ের গোত্রে সন্তানের গোত্র পরিচয়। হিরার ভাইকে চলে যেতে হয়েছিল শশুরবাড়ি। ঘরজামাই হলেও বৌলার কোনো অসুবিধা হয়নি এবাড়িতে, সে একটু একটু করে জয় করেছিল সবাইকে। রায়ডাক বনবস্তি, আন্দুবস্তি। গাঁওবুড়া মারা যাওয়ার পর গোটা গ্রাম এক বাক্যে তাকে গাঁওবুড়া বাছতে সময় নেয়নি। শশুর গণাথ রাভা ফোঁকলা দাঁতে শিশুর মতো হেসেছিল-কি বৌলা রাজা, মনে পড়ে কইছিলাম, তুই একদিন সাঙতাঙ্গাম হবি।

মানুষটা এখন শুয়ে আছে মৃত্যুশয্যায়। বুকে একরাশ যন্ত্রণা। বনবস্তিগুলো প্রায় আস্তে আস্তে অধিকাংশ ধর্মান্তরিত হয়ে গেল। বৌলা দুঃখ করত, আমাদের সর্বপ্রাণবাদী ধর্মে আলেক আচার, লোকসংস্কৃতি লেপ কাঁথার মতো জড়িয়ে থাকে। আচার বিচার না বাঁচলে বিশ্বাস বাঁচে কি? গাঁওবুড়ার অস্তিস্ত্ব বলতে কিছুই নেই আর। মানুষটা যা আছে। পাদ্রির হাতে সমাজের চাবি কাঠি। মানুষটি নিজের ছেলেদের দেখে আরো গুটিয়ে যেত। ঘরের মধ্যে অদৃশ্য দেওয়ালের এপাশে থেকে নীরবে দেখে যেত সব। কারানলের বিরামহীন সুরটা কেমন বিষাদগ্রস্থ হয়ে উঠেছে। হিরার মনে হচ্ছে, ঋষিবায় দেবতা  অভিশাপে নলুয়াকে নলগাছ বানিয়েছিল, আদি অভিশপ্ত নলগাছের বুক চিরে করুণ সুর ঝরছে। নালুয়া-চালুয়া-গন্ধশ্রীকে ঋষিবায় পৃথিবীতে পাঠিয়েছিল রাভাদের নৃত্যগীত শিখাতে কিন্তু সুন্দরী যুবতীদের দেখে ভুলতে বসেছিল তাদের পৃথিবীতে আসার হেতু। ঋষিবায় অভিশাপ দিয়ে তাদের তিনটি বৃক্ষ বানিয়ে দেয়। নলগাছের বাঁশি কারানলে যেন এখন ভড় করেছে প্রবহমান কান্না।

ঘরের মধ্যে ঢুকেই জিমরী হাউমাউ করে কেঁদে উঠল-ও আদা গো, তুমি কেমন আছো? সে বিছনার কাছে গিয়ে দাদার হাত ধরে পাগলের মতো নিজের গালের সঙ্গে ঘষতে লাগাল।

কান্নার শব্দে হিরার সম্বিত ফিরল। সে মাথা তুলে দেখল ননদ জিমরী কাঁদছে। সে বৗলার ছোট বোন। অস্ফুষ্টস্বরে বৗলা জিজ্ঞেস করল-একা আইছ জিনৌ?
-না, সঙ্গে মেয়ে দেবকী আইছে।

-আ –আ-মি তোগো আশায় পরাণডা ধরয়্যা রাখছি।  জিনৌ একটু চিকা কি আইনছ? বড় সাধ তোগো হাতে চিকা খাইয়ে মরি। অঃ অঃ. . .খক্‌খক্‌ খক্‌. . .
-হ, মা মাইয়া মিলি পাহাড়ি ঝোরা থেকে এক ঘড়া জল আনছি। বিকালে তস্রায় ফোনে কইল- বাবার অবস্থা খুব খারাপ, পিসি জল নিয়া আসো। ইচ্ছা ছিল নদী থাকি চিকা আনি, কিন্তু  সন্ধ্যা হয়ে আইল, জলই আনতে পারব কিনা চিন্তায় আছিলাম। না হইলে কলাগাছ কেটে জল বার করে নিতাম।

এতক্ষণ নির্মল চুপচাপ ছিল। সে ফোঁস করে উঠল-এখানে চিকাবৌরৌই ঠরই হবে না। যত সব বুজরুকি।

তস্রায় বলল – হ, দাদা হবে।

-তুই কি মাতব্বর হইছস এই বাড়ির? এই সব অচল কুসংস্কার এখানে চলবে না। ফাদার বলেছেন, মৃত্যুর পর আর কেউ ফেরেনা। বাবাকে বল যীশুর নাম নিতে। তাঁর রাজ্যে জায়গা পাওয়ার জন্য আমরা সবাই বাবার জন্য প্রার্থনা করি।

-ঋষিবায়, রৗন্তুক দেবী, যীশু ভগবান সকলের কাছেই প্রার্থনা করেছি বাবা যেন শান্তি পায়। কিন্তু আমাদের চালু আচার বিচার ছাড়ব কেন? এই বাড়ির মালিক মা। তুই আমি ভাই মা’র গোত্রের সন্তান। আমাদের সমাজটা এভাবে না ভেঙে গেলে আমিই তো এই বাড়ির মালিক হতাম। বাবা, এখনও বেঁচে আছে, সে গাঁওবুড়া। বৗলা রাজ। তুই আমি ভাই বৗলা রাজার সৃষ্ট সন্তান। তাঁর ইচ্ছাকে মান্যতা দিতে হবে। বাবার তৃপ্তির জন্য যা যা করতে হয় আমরা করবই। তোর পছন্দ না হলে নাও মানতে পারস। আমাদের কিছু করার নেই। এভাবে বিশ্বাসকে মরবি না দাদা।

-মা, বোনের হাতে মাতব্বরি ছেড়ে দিছ নাকি? তোমার কি মত?
হিরা বলল-আমার আবার আলাদা কী মত হবে। তোর বাবার ইচ্ছা তো আমাদের কোচ-রাভাদের ইচ্ছা।
-এই সুরেন, তুইও কি শয়তানের পথে হাঁটবি নাকি?
সুরেন মিনমিন করে উত্তর দিল-আমি আর কী বলব। রাভা খ্রিস্টানরাও তো এখন আবার গোত্র মানতে শুরু করেছে। রক্ত আমাদের ভুলতে দেয় কিছু? বাবাকে আমারা সবাই ভালবাসি। তোর হৃদয়েও তো মায়া আছে দাদা।

ঘরে উপস্থিত সকলের চোখের ভাষা পালটে গেছে দেখে নির্মল পা দাপাতে দাপাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সুরেন বলল -মারু কাকা, চলো আমরা পুরুষেরা ঘরের বাইরে যাই। মেয়েরা থাক ঘরে, এটা তো মেয়েদের গোপন অনুষ্ঠান।

ঘরের মধ্যে তস্রায় আর তাদের মা থাকলেও জলদানে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। মৃত্যুপথযাত্রীর শুধু মা বোন আর ভাগনি চিকাবৗরৗই-এ অংশ নেওয়ার অধিকার। কেউ না থাকলে গোত্রের অন্য কোনো মহিলা জলদানের অধিকারী। জিমরী আর দেবকী বৗলার গোত্রের মহিলা, আর  থাকতে পারত বৗলার মা। মা গত হয়েছে ছোটবেলায়। মা-মেয়ে ঘড়া থেকে বৗলার মুখে জল দিয়ে তার কানে ফিসফিসিয়ে বলল-আন্দু ঝোরার থেকে জল আনছি। ই-চিকা’ নৗঙিমৗন কৗঞ্চৗক সায়. . .এই জল পান করে তুমি তৃপ্ত হও। তোমার আত্মার মুক্তি হউক। আবার বান্ধা গোত্রে ফিরে এসো পৃথিবীতে, তোমার জন্য সব সুখ অপেক্ষা করে থাকবে। পৃথিবীর জল বাতাস মিষ্টি, নারীরা সুন্দরী।
বৗলার মুখে ফুটে উঠল ক্লেশহীন এক চিলতে তৃপ্তির হাসি।

মধুশিলা ঘর থেকে কারানল বাজাতে বাজাতে বেরিয়েছে। বাঁশিতে বিরাম দেয়নি। জ্যোৎস্না নেমেছে বনোবিথীর মাথা জুড়ে। বাইরে এসে মারু তার লম্বা ঢোলকের মতো লম্বা বাদ্যযন্ত্র খামে বোল তুলল- মৗর গৗঞ্জাং মৗর গৗঞ্জাং। চাকার নাকার, চাকের চাং. . .তা-ধিন’না-ধিন। খামের এই বোল শুনে উপস্থিস সকলের সর্বাঙ্গে আনন্দ উল্লাস ফুটে উঠল।

 মৃত্যুপথযাত্রীরও হৃদয়ে খামের বোল চুইয়ে পড়ছে মৃতসঞ্জিবনীর ফোটার মতো। অজয় ধরল টেমাক। বহুদিন কারানল বাজেনি এই বস্তিতে। সারা বনজুড়ে ফিরে এসেছে মোম জ্যোৎস্না মায়া। ভেসে যাচ্ছে দূর দুরান্তের চা বাগান গালিচা। বাজনা শুনতে শুনতে তিরতির করে উঠল সুরেনের ছোটবেলা। সে লাগাল দৌড়। দৌড়ে গিয়ে তার বাবার গুছিয়ে রাখা বংশ্রী নিয়ে এলো। সুরেন ছোটবেলায় একটু আধটু বাঁশি বাজাত। মাঝে মাঝে সুর কেটে যাচ্ছে তার কিন্তু অচ্ছেদ্য কারানল ভরাট করে দিচ্ছে কাটা সুর তাল। সুরটা একটু একটু করে দানা বাঁধছে তার হৃদয়ে। সুরেনের মনে হচ্ছে বাবা যেন মৃত্যুভয় ভেঙে উঠে এসেছে। কানের মধ্যে বৗলা রাজা বলে চলছে- বাজা রে বাজা বেটা। সুর কখনও মরে?

অরিন্দম রায়ের গল্প







পাকা বুড়ো


নৃপেন বুড়ো ভবিষ্যৎ দেখে, ধংসাত্মক ভবিষ্যৎ। বুড়ো অনুভব করে তার রক্ত জল করা সংসারটি যোগ্য উত্তরসূরির অভাবে বোধয় টিকবে না। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বুড়োর চিন্তা বাড়ে তার ঝুলে পড়া চামড়ার শতজীর্ণ ভাজগুলোর মতো। কিন্তু চলার শক্তি না থাকলেও বুড়ো চিন্তা এবং বলার শক্তি হারায়নি। সকাল থেকে টিনের ঘরের পিছনের বাঁশের চাংড়ায় বসে সে তার অযোগ্য উত্তরসূরিদের সতর্ক বার্তা দিয়ে যায়- ‘আজিকার ভালে ভাল নাহয় রে বাও ভাল আছে কাইল আর নয় মাসতে না উঠবে মুখত খিসিড়ি কালাইর ডাইল।’ 
                                       
বুড়োর প্রতিদিনের পাঁচালি পাঠ একান্নবর্তী পরিবারে গা-সওয়া হয়ে উঠেছে। বাড়ির বৌ-ছেলে-নাতি-নাতনি কেউ বুড়োকে তেমন পাত্তা দেয় না। নৃপেন বুড়ো এ অবজ্ঞা বুঝতে পারে। রাগে চৈত্রের টিনের মতো গরম হয়ে ওঠে তার শরীর, নড়তে না পারা সেই গরম টিনে কেউ ইচ্ছে  করে গা ঠেকায় না। সকালের এক কাপ চা থেকে শুরু হয় বুড়োর চণ্ডীপাঠ; চলে শুতে যাবার আগ পর্যন্ত। দিনে দুই একবার করে সেই আসরে যোগ দেয় প্রতিবেশী লালচাঁদ,  প্রাণেশ্বর, কান্ত বুড়োরা। প্রাণেশ্বর বুড়োটা প্রতিদিনই আসে, আর আসলেই মেজ ছেলের মেয়ে নীলার ডাক পড়ে-‘দুই কাপ চা করতো রে চেংরি।'

 এটা বুড়োর দেওয়ানি গিরির অভ্যাস। সারা জীবন যে মানুষটা অর্ডার দিয়ে আসছে  দু-কাপ  চায়ের অর্ডারেও তার খানিকটা আভাস ফুটে উঠে। নীলা রাগে গজ গজ করতে করতে পাটকাঠি ভাঙে আর বিড়বিড় করে বলে-‘ মরার বুড়াটা মরেও না।’
                                             
বাড়ির বাইরে থেকে বুড়ো আঁচ করে নাতনির রাগ। এবার একটি জামা কিনে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও দেওয়া হয়নি তাই তার এই রাগ স্বাভাবিক। নৃপেন বুড়ো দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। একটু পড়ে চা আসে, চায়ের কাপ দুটো জোরে নামিয়ে রেখেই নীলা চলে যায়। সেই চায়ের ধোঁয়ায় নৃপেন অতীত দেখে।

একদিন বুড়োর বাড়িতে কাজের লোকের অভাব ছিল না। চা-জল খাবারের পালা লেগেই  থাকত একের পর এক লোক সমাগমে। আজকের এই দিনটাকে বুড়ো অতীতের দিনগুলোর সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করে যে দিন গুলোতে তার কথায় বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত।  সবার কাছে দেওয়ানি বলে পরিচিত লোকটির সামর্থ্য বার্ধক্য যেন খর্ব করে দিয়েছে। সহায়হীন  একাকীত্ব আর ছেলেদের দায়িত্বহীনতা তাকে কাতর করে। চোখের সামনে এই অরাজকতা দেখতে না পেরে বুড়ো ব্যর্থ আস্ফালন করে যায়। নৃপেন বুড়ো প্রাণেশ্বরকে বলে-‘দ্যাখরে প্রাণেশ্বর মুই না মইরতে মানষিলা মোক ভূত বানাইল রে!’
                                                 
‘কি করবুরে দাদা, শ্যাষকালে এলা বেটা বউয়ের কথা শুনিবারে নাইগবে; না হইলে আরও কপালত দুঃখ আছে। এলাতো তাও চাইলে এক কাপ চা ঢাকলাউ করি দিয়া যায় নচেৎ হোকনাও না পাবু।’                                                                                    বুড়ো গলায় বিষাদের সুর এনে বলে-‘মুই মোর বেটালাক সংক্ষেপে লাখোটিয়া বানে থুছুং রে, কিন্তু শালার ঘর রাখির পাবে নারে! আরে বানার জল আর বাপের সম্পত্তি একে রে প্রাণেশ্বর, বেশি দিন থাকে না।’
                                                                                     ‘তুই হিল্লা কথা না কইস রে দোয়ানী। মানষি কবে বুড়াটা শেষ বয়সে ছাওয়া-পোয়ালাক অভিশাপ দিবার ধইরচে।’                                                                               ‘পিতা মাতার আশীর্বাদ খাও বাছা দুধ ভাত’-হিল্লা অভিশাপ না হয় রে প্রাণেশ্বর; অভিশাপ না হয়। এইল্ল্যা যে হবে মুই চৌকের সামনে দেখির ধরছুং। কথাটা তুই মিলি নিস দেখিস এই  বুড়াও যাবে এই বাড়ির ভিটাত ঘুঘু নাইচবে।’
           
দুপরের রোদ মাথার ছায়াকে পায়ের নীচে আনলে প্রাণেশ্বর চলে যায়। নৃপেন বুড়ো  বাঁশের  চাংড়ায় বসে স্মৃতি আওড়ায়। রাস্তায় চলতে থাকা লোকগুলোকে দেখে আর ভাবে এই সংসারটা তার তিলে তিলে গড়া, কত সুখ-দুঃখ এর সাথে জড়িয়ে। সংসারটার ভাবি আশঙ্কার কথা ভেবে বুড়ো তার বয়সের কথাও ভুলে যায়।       তিনটা ছেলের একটাও বাপের মতো হয়ে ওঠে নি। সবার ছোট জিনিসের প্রতি লক্ষ্য। এতো বড় একটা সংসার চালাতে গেলে যে একটু বড় করে ভাবতে হয় সেটা কারো মাথায় নেই। বড় ছেলেটা হাটুরে। সে বলে ‘আমি মাছের তেল দিয়ে মাছ ভাজি।’- ছোটো ছেলেটা হাতুড়ে ডাক্তার। সে সারাদিনের ডাক্তারির টাকায় আখের গুছায় আর বৌ কে খুশী করে। খেটে মরে মেজো ছেলেটা। সারাদিন গাধার খাটনি খাটে আর বিড়ি টানে। সে সাদাসিধে, তাকে নিয়ে বড় ভাবনা করা যায় না। তার প্রতি বুড়োর মায়া আছে, তাই শেষ বয়সে বুড়ো তারই দিকে গরেছে। সবচেয়ে ক্ষোভ বুড়োর পরের বেটি গুলোর প্রতি। বৌ দের আচরণ একেবারেই সহ্য হয় না তার। বুড়ো থেকে থেকে বলে ওঠে--‘কাঙ্গালের ছাওয়ার ঘর সংসারটাক শ্যাষ কইরলেক। ভাতারের সাথে একে পাতত বসি খায়। হিল্লাক ত্রিস্যকুলে আইটবে না।’

বুড়োর এ রাগ অসঙ্গত নয়। চল্লিশ বিঘা জমি, বাগান, তিন তিনটে পকুর ছেলেদের নামে করে দিয়েও বুড়োর কপালে আজ চায়না ধানের মোটা ভাত জোটে। অথচ ভোগধানের ভাত ছাড়া এই বুড়ো একদিন খেত না। সঙ্গত কারনে নৃপেনের রোষের আগুন থেকে  কেউ বাদ যায় না। সেদিন বড় নাতি বড়শি নিয়ে পুকুরে মাছ ধরতে যাচ্ছিল। আড় চোখে ক্ষীণ দৃষ্টি মেলে বুড়ো দেখে আর বলে-‘নেও মুইও মরিম দিঘিও না শুকাবে, ততদিন খেয়া নেও দাদার ঘর।’ 

আজি এক বছর হল পুকুরে মাছ ছাড়া নাই। কিন্তু রাজার ছেলেদের ভালো মন্দ না হলে খাওয়া হয়না। এসব চোখের সামনে যতই দেখে ততই নৃপেনের অসহ্য বোধ হয়, আর সইবেই বা কেন সম্পত্তি তো আর তারা করেনি যে এর মর্ম বুঝবে । কান্ত বুড়ো কাছ থাকে একটা বিড়ি নিয়ে ধরিয়ে নৃপেন বলে-‘তিনটা বেটার একটাও মোর সাথে বসি একনা পরামর্শ নেয় না, পুঁছেও না বাবা কেমন আছিস কি কোনো!’

বুড়োর চোখে জল আসে। পরক্ষণেই নীলা কে ডেকে বলে-‘দিদি এক কাপ চা করত।’     নীলা আসে রাগ ভুলে। নৃপেন বুড়ো নাতনির চোখে ভবিষ্যৎ দেখে; অজানা ভবিষ্যৎ।

আজ সারাদিন ধরে বুড়োটা বকেই চলেছে শ্রাবনের অবিশ্রান্ত ধারার মতো। এ ধারায় কেউ ভিজতে চায়না জ্বর হতে পারে বলে। কিন্তু এ ধারা জমিকে যে চাষ যোগ্য করে দিয়ে যায় সেদিকে কার খেয়াল আছে। প্রাণেশ্বর সত্যর বাড়ি আসে, দেখে বুড়টাকে নিয়েই ছেলে-বৌ রা কথা বলছে। প্রাণেশ্বরকে দেখে বড়ছেলে সত্য বলে-‘দেখতো কাকা বুড়াটা মানষির আগত কি কি কয়, মানষি কবে হামা বোধয় বুড়াটাক দেখি না।’

   
প্রাণেশ্বর বুড়ো হেসে বলে-‘আরে নেও নেও কয়টা দিন আর বাঁইচবে সহ্য কর। জানেন না আম পাকলে মিঠা আর মানষি পাকলে তিতা।’


মণিদীপা দাসের গল্প




টানাপোড়েন


(১)

"চলো রাই খেয়ে নেবে চলো।"

"না আআ.. আমি যাব না। তোমরা খাওগে। আমার ক্ষিদে নেই।"

"কেন মিছিমিছি রাগ করছ রাই? সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এত রাগ করার কোনো মানে হয়, বল?"

"কোনটা সামান্য বিষয়? তোমার মায়ের আজকের আচরণ টা? তোমার কাছে সব কিছুই তো সামান্য বিষয়.. আমার মোটেও সামান্য লাগছে না।"

" ঠিক আছে ।আগে খেয়ে নাও। তারপর এ নিয়ে কথা হবে। "

"না আমি কিছুতেই খাব না। তোমার মা আমাকে যা খুশী তাই বলবেন আর আমি সব সহ্য করব তুমি তা ভাবলে কিকরে? "

বেডরুম থেকে বেরিয়ে সামনের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় ঋষভ। একটা সিগারেট ধরিয়ে চুপ করে ভাবতে থাকে পুরো ঘটনাটা। কিসের থেকে যে কি হয়ে যায় মা আর বউয়ের মধ্যে সে বুঝেই উঠতে পারে না। আজ মাত্র দু'মাস হল তাদের বিয়ে হয়েছে। এই দু' মাসে শাশুড়ি বউমার অশান্তি এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছতে চলেছে যে সে রীতিমত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। কাকে সামলাবে বুঝতে পারে না। আশ্চর্যের বিষয় এই যে দুজনেই সমানে তাকে দায়ী করে চলেছে। অথচ ঘটনার যখন সূত্রপাত ঘটে সে তখন বাড়িতে থাকেই না।

ঋষভ অফিস থেকে ফিরলে কোনো দিন মা দরজা খুলে দেয়। কোনো দিন রাই। যেদিন মা দরজা খোলে সেদিন ঘরে গিয়ে রাইয়ের গোমড়ামুখ দেখে আর যেদিন রাই খোলে সেদিন মা মুখভার করে সোফায় বসে থাকে। কি আশ্চর্য ব্যাপার! অথচ এই রাইকে তো মা- ই  পছন্দ করেছিল ছেলের বউ হিসেবে। বাবা তো বেশ কয়েক বছর ধরে প্রায় শয্যাশায়ী বিভিন্ন অসুখে। মা বাবা ছেলের সংসারে আছে একজন আয়ামাসী। আর ঠিকে কাজের লোক আর রান্নার মাসী। রাই আসার পর একজন সদস্য বাড়ল।

 (২)

"মা তুমি কাল বলেছিলে না কি একটা কাজ আছে ব্যাঙ্কে.."

"না না আমি কিছু বলিনি। কিচ্ছু বলতে চাইনা আর.."

"এরকম করে বলছ কেন? তুমি তো বলেছিলে সকালে। তখন আমার অফিসে যাওয়ার তাড়া ছিল তাই শুনতে পারিনি।"

"আমার কোনো কথা শোনারই  কি সময় তোমার এখন হয় বাবু? এখন তো তুমি শুধু একজনের কথাই শোনো। বাড়িতে আর কেউ আছে নাকি সে ছাড়া? "

" ধুর! তুমি অকারণে রাগ করছ মা। কি হয়েছে বলতো? "

" কেন কি হয়েছে তুই জানিস না? নাকি সব জেনেবুঝেও না জানার ভান করছিস রে? "

" আচ্ছা মা সারাদিন কি আমি বাড়িতে ছিলাম বলো? হ্যাঁ এটা বুঝতে পারছি যে তোমার আর রাইয়ের মধ্যে কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কি হয়েছে সেটা কিকরে জানব বলো? "

" কেন রে? তুই শুনতে পেলিনা তোর সামনে তোর বউ আমাকে যা নয় তাই বলল? "

" হ্যাঁ সেটা শুনেছি। আর তুমিও তো ওকে অনেক কিছু বলে দিলে তাইনা? "

" ওওও! এখন থেকেই বউয়ের পক্ষে চলে গেছিস? ভালো। ভালো। খুউউউব ভালো ।এটাই তো আমার পাওয়ার ছিল রে! "

" উফ্ তোমাদের নিয়ে আর পারিনা মা। আমি কারোর পক্ষেই কথা বলছিনা কিন্তু এটা তো সত্যি যে তোমরা দুজনেই দুজনকে অনেক কথা বলেছ? আমি বাড়িতে ফিরে কিছুটা শুনেছি। কিন্তু কি হয়েছে তাতো ভালো করে জানিনা। আটটার সময় বাড়িতে ঢুকেই তো তোমাদের ঝামেলা দেখলাম। তারপর আমি ফ্রেশ হলাম ।বাবাকে তুমি রাতের খাবার দিলে। তুমি তোমার সিরিয়াল দেখলে আর রাই আমাকে এককাপ চা দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। তারপর খাবার টেবিলে তোমার আর রাইয়ের কিসব কথা কাটাকাটি হল। এখন রাই বলছে সে খাবেনা আর তুমি তোমার ঘরে আলো নিভিয়ে শুয়ে রয়েছ। কি যন্ত্রণা বলতো? "

" শোনো বাবু তোমার বউ আমাকে যা খুশী তাই বলবে তা কিন্তু আমি কোনোমতেই সহ্য করতে পারব না। এটা আমি পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি। "

অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ঋষভ। দুজনেই একই রকম ডায়ালগ ঝাড়ছে কিকরে? অদ্ভুত ব্যাপার তো! বিয়ের পর থেকেই তো ঋষভ দেখছে দুজনের মধ্যে ঝামেলা লাগতে সময় লাগে না। তা বলে দুজনেই একরকম অবস্থানে চলে যাচ্ছে কিকরে? এই নালিশ আর পাল্টা নালিশ নিয়ে কিকরে চলবে? এরকম ভাবে চলতে থাকলে তো তার অবস্থা টাইট হয়ে যাবে। কত সকালে বেরোতে হয় অফিসে। তাড়াতাড়ি রাতে ঘুমিয়ে পড়তে হয়। কাজের যথেষ্ট চাপ। অফিস থেকে ফিরে বড্ড ক্লান্ত লাগে। এসে কোথায় একটু রেস্ট নেবে, একটু শান্তি পাবে, তা নয়, এসব কি উৎপাত শুরু হল কে জানে?

 (৩)

"শোনো মা আমি কাল বাড়ি যাচ্ছি। এই বাড়িতে আর থাকতে পারছি না। ঋষির মা যা আরম্ভ করেছে না.. উফ্!"

স্নান করে বাথরুম থেকে বেডরুমে ঢোকার মুখে রাইয়ের অভিযোগ শুনে ফেলল ঋষভ। মোবাইলে কথা বলছে নিজের মায়ের সঙ্গে। খাট থেকে নিজের জামাকাপড় নিয়ে মায়ের ঘরে ড্রেস আপ করতে ঢোকে ঋষভ। এসব যে হবে জানাই তো ছিল। ওই ঘরের কাছে যেতেই কানে এল," শোন ঋতু, তোর বাড়িতে কাল যাব ।আর ভাল্লাগছে না রে, তোর বউদি যা শুরু করেছে না.. এখানে আমি বোধহয় থাকতে পারব না।"

খানিক হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেল ঋষভ। বেরোনোর টাইম হয়ে গেছে ।ডিনার টেবিলে তাকিয়ে দেখল, তার খাবার দেওয়া হয়েছে কিন্তু সেখানে কেউ নেই। তার স্নান করে বেরোনোর সময় টুকুতে যে যার মত কাজ সারতে চলে গেছে। বড্ড অসহায় লাগছে আজ। পুরুষ মানুষ হওয়ার কি জ্বালা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে।

অফিসের লাঞ্চ করতে করতে একটু অনলাইন হয়েছিল ঋষভ ।ফেসবুক খুলতেই চোখে এল, রাইয়ের ওয়ালে কয়েকটা পোস্ট। এক ঘন্টার তফাতে তিনখানা --- "শ্বশুরবাড়ির জন্য সব করেও কারোর মন পাওয়া যায় না।" একশো লাইক ।আশিটা কমেন্ট ।
" শাশুড়িরা শুধু নিজের মেয়েকেই মেয়ে ভাবে।
পরের মেয়ে আপন হয়না।
আসল গলদ তো স্বামী নামক প্রাণীটার,
বউয়ের দোষ চোখে পড়ে, মায়েরটা পড়েনা। "---বাহাত্তর লাইক, দুশো কমেন্ট ।
" ঘরের বউয়ের নির্যাতন কারোর চোখে পড়ে না। রাস্তায় মহিলারা নির্যাতিত হলেই সকলের কত কষ্ট!!! "---এই পোস্ট টা দেখে সকলে অনেকটা সতর্ক। তাই মাত্র আঠেরোটা লাইক আর তেত্রিশটা কমেন্ট।

প্রথম দুটো পোস্টে ঋষভের আত্মীয়দের অনেকেরই প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল তার। এসব কি করছে রাই? ওর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? মাথাটা টিপে ধরে চোখ বুজে একটু বসতেই জ্যেঠিমার ফোন, "হ্যাঁ রে কি খবর তোর? ব্যস্ত নাকি? তোর টিফিন টাইম দেখেই ফোন করলাম রে.."

দুটো তিনটে কথার পর জ্যেঠিমা বললেন, "শোন না ঋষি, ঋতু আজ ফোন করেছিল, তোর মায়ের সাথে নাকি আজকাল তোর বউয়ের.."

"আমি এখন রাখছি জ্যেঠি। পরে ফোন করব" ---ঝট করে ফোনটা কেটে দেয় ঋষভ। ভেতরটা কেমন যেন করছে। মা আর রাই দুজনেই বড্ড বাড়াবাড়ি করছে।

 (৪)

"শোনো বাবা ঋষভ, তোমার মা কিন্তু যা করছেন ঠিক করছেন না। আমার মেয়ে বলে এরকম আচরণ! ওনার তো নিজেরও একটা মেয়ে আছে। কিকরে পারেন আমার মেয়ের সাথে এরকম করতে? অবশ্য শাশুড়িরা এরকমই হয়। কিন্তু তুমি? তুমি কেন চুপ করে থাকছ? কেন তোমার মাকে সামলাচ্ছো না? তুমি তো রাইয়ের স্বামী। ওর ভালো মন্দের দায়িত্ব তো আমরা তোমার হাতেই ছেড়ে দিয়েছি ভরসা করে। তাইনা? "
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু বিরতি দিলেন রাইয়ের মা।

" দেখুন, আমি সারাদিন বাড়িতে থাকিনা। চাকরির চাপ যথেষ্ট। সেটা আপনারা জানেন। ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে এসব ভালো লাগেনা। রাইয়ের সাথে মায়ের রোজ কিকরে গন্ডগোল হচ্ছে আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। আমি চাই দুজনেই একটু মানিয়ে নিক। ঘরোয়া ব্যাপারে আমি থেকে কি করব বলুন তো? "

" ওসব বললে তো চলবে না বাবা! তোমার মা সেদিন বলেছেন যে রাই নাকি শুধু আমাকে নিয়েই আমার, তোমার আর রাইয়ের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে। ওখানে তোমার মায়ের জায়গা নেই কোনো। উনি তোমার জন্ম দিয়েছেন আর ওনার ছবি নেই এটা ওনার খারাপ লেগেছে। আমি তো বাপু এতে দোষের কিছু দেখি না। আমি তো রাইয়ের মা। আমিও তো আমার মেয়ের জন্ম দিয়েছি তাইনা? আমার ছবি দিলে সমস্যা কোথায় তাতো আমার মাথায় ঢুকছে না। "

" ফেসবুকের ছবি মা কিকরে দেখল? মা তো ওসব করতে পারে না? "

" নিশ্চয়ই তোমার বোন লাগিয়েছে। "

লজ্জায় মুখ নীচু করে ঋষভ। এই কথাটায় যে যুক্তি আছে সেটা সে জানে। দু'মিনিট পর বলে, এই কাজটা যে ঠিক হয়নি সেটা আমি মানছি। কিন্তু আজ রাই ওর নিজের ওয়ালে যে পোস্ট গুলো করেছে তাতে কি আমার সম্মানটা রইল? আমার মা যদি অন্যায় করে থাকেন তাহলে কি রাইকেও অন্যায় করতে হবে? সমস্ত রিলেটিভদের মধ্যে যে জানাজানি হয়ে গেল। এটা কি ঠিক হল? "

" ওমা তুমি দেখছি উত্তর টা রেডি করেই রেখেছিলে! খুব তো মায়ের পক্ষে কথা বলছ বাবা! আচ্ছা শাশুড়ি যদি বউমাকে নির্যাতন করে তাহলে সেটা নিয়ে তো লোকে নানা কথা বলবেই। "

" আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? আপনার মেয়ের বয়স কম হতে পারে কিন্তু আপনার কাছ থেকে আমি এই কথা আশা করিনি মা। এই বিষয়টা কি নির্যাতনের মধ্যে পড়ে? "

" অবশ্যই পড়ে। তোমার মা এরকম অনেক অনেক কথা রোজ বলেন। আমার মেয়ে আমাকে সব বলেছে ।এটাকে মানসিক নির্যাতন বলে।"

"আপনার মেয়ের বিয়ে হয়েছে মাত্র দু'মাস হয়েছে। এর মধ্যে অষ্টমঙ্গলার পর এখানেই এসে ছিল। তারপর এখান থেকেই আমরা হানিমুনে গেছি। হানিমুন থেকে ফিরে ও এখানেই ছিল। প্রায় মাসখানেক তো আমাদের বাড়িতে ছিলই না। তারপরের মাসে দিনপনেরো ওখানে থেকেছিল। তারপর আবার এখানে এসেছিল। ওই মাসের শেষ সপ্তাহে আবার ওই বাড়িতে যায়। আর এই মাসের দিন দশেক ওখানে রয়েছে। এর মধ্যে আমার মা ওকে মানসিক নির্যাতন করে ফেলল? "

" নিশ্চয়ই করেছে। আমার মেয়ের সাথে এসব অন্যায় আমি বরদাস্ত করব না এই আমি বলে রাখছি। "

" আর আমার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আছে আপনাদের? "
" না না। তুমি ওরকম করে বলছ কেন? তুমি তো খুব ভালো ছেলে। শুধু নিজের মাকে একটু শাসন করতে হবে বাবা। তুমি একটা শিক্ষিত ছেলে হয়ে যদি বউয়ের সম্মান রক্ষা করতে না পারো তাহলে কিকরে চলবে, বলো? "

" তাহলে আমি আজ উঠি। দেরী হয়ে যাচ্ছে। "

" মিষ্টি গুলো তো পড়েই রইল। খেলে না তো কিছুই। আমি যে তোমাকে অফিস ফেরত এই বাড়িতে আসতে বলেছি এটা রাইকে বলতে যেওনা কিন্তু। "

 (৫)

"এত দেরী হল যে? তিনি কোথায়?"

"একটু কাজ ছিল আমার । কার কথা বলছ?"

"কার কথা আবার? তোমার বউয়ের কথা বলছি। ঘন্টা তিনেক আগে সাজুগুজু করে কোথায় যেন বেরিয়ে গেল। ভাবলাম তুই অফিসফেরত ওকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে বেরিয়েছিস।"

"সত্যি মা। তোমরা পারোও বটে! মনে মনে কত কিছু কল্পনা করে নাও। আজ তো সারাদিনে রাইয়ের সাথে আমার ফোনে একবারো কথা পর্যন্ত হয়নি। "

" সে তো আমার সাথেও হয়না। আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি রে। এই আমাকেই তো স্কুল থেকে ফিরে এসে জড়িয়ে ধরতিস। এখন তো কিছুই মনে পড়ে না। "

" কেন এরকম করে বলছ মা? চাকরি পাওয়ার আগে পর্যন্ত তোমার আর বাবার সব কথা শুনে চলেছি। চাকরি পাওয়ার পর ঋতুর বিয়ের জন্য তোমাদের সাথে সাথে সমস্ত কিছু করেছি। তারপর তোমার পছন্দেই রাইকে বিয়ে করেছি। কোনো দিন কি নিজের ইচ্ছেতে কিছু করেছি বলো? "

" কেন আমরাও কি তোর জন্য সবকিছু ত্যাগ করিনি? তোদের পড়াশোনা, বিয়ে, ভবিষ্যৎ সবকিছু গুছিয়ে দিইনি? এত কথা শোনাচ্ছিস যে বড়? "

" উফ্ মা তোমার সাথে তো কথাই বলা যায় না দেখছি। কি বললাম আর কি বুঝলে বলতো? "

" হ্যাঁ হ্যাঁ এখন তো মাকে খারাপ লাগবেই। সুন্দরী বউ ঘরে এসেছে। তার পা চাট বসে বসে। "

" ছিঃ মা! তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেল নাকি?"

অসহ্য খারাপ লাগায় ভিতরটা ভরে যায়। ঘরে ঢুকে দ্রুত জামাকাপড় ছেড়ে বাথরুমে ঢোকে ঋষভ। শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঠান্ডা করতে থাকে। রাগে দুঃখে চোখে জল এসে যায়। মনে পড়ছে, টিভি তে কতবার দেখেছে, ধর্ষিতা নারী শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে নিজেকে ধুয়ে যাচ্ছে আর কাঁদছে। ওই পরিস্থিতিতেও ওদেরকে কত সুন্দর দেখায় কিকরে কে জানে! চোখের জলের ফোঁটাগুলো মুক্তোর মত লাগে। সবকিছু কত যত্ন করে স্টুডিওতে বানায়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ছেলের করুণ পরিস্থিতি এভাবে কেউ তুলে ধরে না। ছেলে মানেই কারোর পুত্র। কারোর স্বামী। দু'পাশ থেকে চাপ খেতে খেতে তাদের যে কি পরিস্থিতি হয় তার খবর কে রাখে?

 (৬)

আজ রাতের খাওয়া একটু দেরী করেই হল। রাই ঘরে ফিরেছে ঋষভ ঢোকার ঘন্টা খানেক পরে। সাথে কিছু প্যাকেট। বোধহয় কিছু কেনাকাটা করেছে। তাই রাতের খাওয়া শেষ হতে হতে এগারোটা বেজে গেল।

বাবাকে একটা ওষুধ দিয়ে এসে ঋষভ বিছানায় শুয়ে পড়ল। কাল সকালে উঠে অফিসের তাড়া আছে।

ঘুমটা এসে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই ভেঙে গেল। রাই ব্যাগে জামাকাপড় গোছাচ্ছে। মনে হচ্ছে কালই বাপের বাড়ি চলে যাবে।

"তুমি কি কাল ওবাড়িতে যাচ্ছ নাকি?"

"হ্যাঁ"

"কই আগে বলনিতো?"

"তোমার বোঝা উচিৎ ছিল। তুমি কি ভেবেছ এখানে পড়ে থেকে আমি তোমার মায়ের কথা শুনব?"

"তুমি এভাবে কেন কথা বলছ রাই? আর আমাদের মধ্যে প্রতি মুহূর্তে মা চলে আসে কিকরে?"

"তোমার মা তো চান যে আমি এখানে না থাকি ।আমাকে তো সহ্যই করতে পারেন না। এভাবে চলতে পারে না আর বুঝেছ? "

" আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না তোমাদেরকে কিভাবে সামলাবো? তোমরা একজনও তো আমার কথা শুনছ না। শোনো একটা দিন থেকে যাও। আমি কাল মা আর তোমার সাথে একসঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করব। দরকার পড়লে কাল আমি অফিস যাব না। কিন্তু তুমি প্লিজ এভাবে চলে যেওনা।"

" তুমি কি করবে? তুমি তো একটা ভেড়া। তোমার মায়ের কথায় চলো। আমি কে? বউকে কিভাবে যত্ন করতে হয় তা তো জানোই না! আমার মা অবশ্য বলেছিল যে শাশুড়ি জিনিষটা এরকমই হয়। মা চেয়েছিল যে আমার যেন শাশুড়ি না থাকে। আমি বোকার মত তোমাকে দেখে গলে গেলাম। তোমার মায়ের মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলে গেলাম। তাই আজ এই অবস্থা! "

" তুমি একথা বলতে পারলে রাই? আমাকে এতটা হার্ট করতে তোমার এতটুকু বাধল না? "

" না বাধল না। আমি তোমার মায়ের সাথে থাকতে পারব না। এখানে আমি আমার মত করে থাকতেই পারিনা। উনি যখন যেটা বলবেন সেটাই করতে হবে। এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি কোনোদিন এভাবে চলিনি। আমার ওপর দিয়ে কেউ কখনো কথা বলেনি। আমি আমার বাবা মা ছাড়া কিছু ভাবতে পারিনা। আমি ওদের সাথেই থাকব। শাশুড়ি জিনিষটা রিয়েলি বড্ড বাজে। একটা ব্যাড এক্সপিরিয়েন্স হল আমার। "

আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে রাই। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়েও পড়ে। বিছানায় খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুয়ে থাকার পর আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ায় ঋষভ। রাত দেড়টা বেজে গেছে। নিঝঝুম পাড়ার গলিতে একটা কুকুর কেঁদে যাচ্ছে একটানা। ছোটবেলা থেকে ফিরে দেখতে লাগল ঋষভ নিজের জীবনটা। কোনো দিনই কাউকে জোর করতে পারেনি। মা বাবা বোন সবাই তো তাকে নিজেদের ইচ্ছেমতো চালিয়ে গেছে। বাবার ইচ্ছেতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া। মায়ের ইচ্ছেতে চাকরিটা কলকাতাতেই নেওয়া । বোনের ইচ্ছেতে এই পাড়ার ফ্ল্যাট। পরিবারের দেখা সম্বন্ধে বিয়ে। তারপর একটু একটু করে চারপাশের চাপে পিষ্ট হয়ে যাওয়া।

রাইকে প্রথম দিন দেখে মনে হয়েছিল একটু অধৈর্য্য। কিন্তু সুন্দরী বলে মা পছন্দ করেছিল। হানিমুনে গিয়েও ওর কিছু একগুঁয়ে আচরণ সহ্য করেছে ঋষভ। তবু ভেবেছিল, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না। কিছুই বোধহয় ঠিক হবে না। অন্যকে শোধরানো খুব মুশকিল। নিজের মা যেখানে অবুঝ সেখানে দু'মাসের পরিচিত স্ত্রী কতটা সংবেদনশীল হবে? পুরুষ হিসেবে আজ নিজেকে সত্যিই পরাজিত বলে মনে হচ্ছে। যে পুরুষ জোর খাটাতে পারে না, কথা কাটাকাটি করতে পারে না, দুই বিবাদমান পক্ষের মহিলারা তাকে নিয়ে নির্মমভাবে লোফালুফি করে চলেছে । রাতের অন্ধকারে ডুবে যায় ঋষভ। তার ভবিষ্যৎটা কি গভীর অনিশ্চিতার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে না ক্রমশ :?

পার্থ প্রতিম পালের অণুগল্প




পাখি ও আমি


হাই ভোল্টেজ ইলেকট্রিকের তারে দুটি ঘুঘু, বসে আছে দীর্ঘক্ষণ। মধুরিমা নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে ---- ব্যালকনির ইজি চেয়ারে বসে। হাতে ওয়ান টাইম পেন আর লেটার প্যাড।  লিখছে আর কাটছে.. মুখে পেন স্পর্শ করাতে করাতে কমলার খোশার মত ঠোঁট শ্রাবণের আকাশের মত কালচে হয়ে উঠেছে; তবু গল্প লেখার প্লট পেলোনা। হঠাৎ, ইয়েস ইয়েস বলে লিখে ফেললো.... হাই ভোল্টেজের তারে দুটি পাখি বসে থাকতে পারে  অথচ শান্তনু! আমরা ইজি চেয়ারে বসে পাশাপাশি বসতে পারলাম না। তুমিতো পাখিদের খুব ভালোবাসতে... ভালোবাসতে হলদে গোলাপ, ভ্যানিলা আইসক্রিম, শাম্মী কাবাব,শক্তির কবিতা,ডেনিম ডিও,রিমলেস গ্লাস,আর অ্যাডভেঞ্চার।

৩২ বছর পর,প্রাণহীন ভালোবাসাগুলো সবই তোমার কাছে বর্তমান....

পাখিও নেই,আর..... আমি!!


ফাল্গুনী সিনহা মহাপাত্রের গল্প




নিমগাছ                                             

গ্রীষ্মের চড়া রৌদ্রে জ্বলে পুড়ে কালি একবোজা ঘাস মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরল। দেখে তার ছেলে লখাই বউয়ের সদ্য বেড়ে দেওয়া ভাত খাচ্ছে তার মেয়েকে নিয়ে।
  ছোট্ট একচালা ঘর। যার চারটি দেওয়াল ইঁট-সিমেন্টের হলেও এসবেসটসের চাল। খুব উঁচুও নয়। বাড়ির পাশে নিমগাছটা আছে বলেই সারাবছর রক্ষে। যার বয়স লখাইয়ের প্রায় সমান। কালির অনাদরের ‘সন্তান’। কালি ভালবাসে ওর উপকারের কথা ভেবে। বউকে এই ক’বছরে কতবার বকেছে ঝাঁট ধূলো গাছের গোড়ায় দেওয়ার জন্য; গাছের গায়ে ঝাঁটা লাগাবার জন্য।

  কালির মরদ বাড়ি ফেরেনা। পাশেই প্রসাদপুরের বাজারে কখন সবজি বেচে, কখনো এটা ওটা করে। নিজের খরচ নিজেই চালায়। তবে কাজের চেয়ে অকাজ করে বেশি। প্রতিদিন দুবেলা চুল্লু না খেলে ওর দিন চলে না। আগে ঐ সব খেয়ে ঘরে এসে কালির অকথ্য গালাগাল খেয়ে কালিকে যাবদা করে পেটাত। কালিও পেটাত। কালিকে কতবার মেরে দিতে গেছে – হয়তো নেশার ঘোরে পারেনি। তবে পুরুষ মানুষ তো বউয়ের হাত বার বার মার খাওয়াটা হজম করতে পারেনি। তাই শেষমেষ ঘর ছাড়া।
  লখাই ফ্যানের গরম বাতাস গায়ে নিয়েও ঘামতে ঘামতে ভাত খায়। দূর থেকে তার খাওয়া দেখলে বুঝতে পারা যাবে না, যে ও ভাত খাচ্ছে! নাকি কোদাল চালাচ্ছে। বাইরে যদিও চল্লিশ ডিগ্রী তাপমাত্রা। লু বইছে অল্প অল্প।

  লখাইয়ের মাথার তাপমাত্রাও কম নয়। ভাল ভাবে মনের থার্মোমিটারে দেখলে হয়তো ধরা পড়তে পারে আশি কিম্বা একশ ডিগ্রী তাপমাত্রার রেজাল্ট। কেননা, কালি আজ বউকে সকালে বাপের বাড়ি যাওয়া নিয়ে কথা শুনিয়েছে।

  লখাই আর পাঁচটা বাঙালি ছেলের মতো স্ত্রৈণ স্বামী – হয়তো ছোটবেলায় লিবোডো চরিতার্থ হয়নি বলেই এ কান্ড! দিনে দুপুরে বউকে নিয়ে দরজা দেয়।

  লখাই কালির দিকে একবার বড়ো বড়ো লাল চোখে তাকায়। কিছু বলেনা। বাকি ভাত প্রায় গোগ্রাসে খায়।

কালিও ছাড়ার পাত্রী নয়। ছেলের চোখের ভাষা বুঝতে পারে। দাঁত বের করে আঁত জ্বালানো হাসিতে ছেলেকে একবার দেখে, ঘাস বোজাটার ওপর বসে পড়ে।

 নিমগাছটার তলা দিয়ে একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায়। কালি চোখ বুজে জলের জন্য অপেক্ষা করে। তেষ্টায় অধীর সে এখন।

  বউ জল এনে নামিয়ে দেয় সামনে। ছোট মেয়েটা হাসিমুখে দিদির দিকে তাকিয়ে বলে— ‘দিদি আমি বাত খাচ্চি!’
কালি— ‘খাও। খাও। তুমি ত খাতেই আসেচ।’

লখাই মেয়েটাকে ধমকে বলে—‘খাইলে ভাতগুলা। না বকে।’

  চাড়ি ব্যাপারটা অল্প বয়সে বুঝতে না পেরে আপন মনে ডাল মাখা ভাত খেতে থাকে। হঠাৎ বলে— ‘দিদি। আমি মামাগর গেছলম।’

  কালি আধময়লা গামছা নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে – ‘বেশ করেছ নানি। ই খেনে সব ফুটে শেষ হোক, তুমরা মামাঘরে ভাত খাও। তালেই পেট ভরবেক সবার।’

  লখাইয়ের আর সহ্য হয়না। কালিরও কথার ঝাঁজ বাড়তে থাকে। কিছু যেন একটা না বলতে পারলে ওর সুখ হচ্ছে না। মাঠে ধান সব জলের অভাবে মরছে। আর বেটা ছেলে-মেয়েকে নিয়ে শ্বশুর ঘরে ফূর্তি করছে। কিসের জন্য কালি এতো করবে। একটা পেট এমনি চলে যাবে ওর বিশ্বাস। ব্যাটার দিকে তাকিয়ে একটা আক্রোশের সুরে হুমকার দেয়।

  লখাই এবার আর সহ্য করতে না পেরে ভাতের থাল ছুড়ে ফেলে দেয়। বলে – ‘ধূর শালা! এই সংসারে মানুষ থাকে।’

 কালি সঙ্গে সঙ্গে যেন জ্বলে উঠে। ভাতের থালা ছোড়া ওর সহ্য হয়না। বলে, ‘হ ই সংসারে কী মানুস থাকে! থাকবি যা মানুসের ঘরে। শ্বশুর ঘরে থাকবি যা। পেট ভরবেক তবে।’

 লখাইও গলা চড়ায়। মাকে বেশ কয়েকটা অভদ্র ইঙ্গিত করে বলে, ‘বেশ করব যাব। হাজার বার যাব। আবার যাব। আজই যাব। এখনই যাব। তুই থাক তোর ঘরে। ই খানে কী কেউ মানুষ থাকে।’

 কালি যেন আরও বল পায়। চিৎকার করে বলে, ‘হ হ অমন ফুটানি ঢের দ্যাখেছি। তোর বাপ পারে নাই। তুইও পারবি নাই আমাকে বশ করতে। আমি কারও গতরে খাই নাই। যা যা দেখব কদিন কে খাওয়াই। হুম, পঁদে নাই চাম, আর সেনাপতি নাম।’

 লখাই কথা বলেনা। মেয়েকে হাত মুখ ধুইয়ে জামা পরায়। বউকে রেডি হতে বলে। বউ নিমেষে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে। মনে হয় তৈরি ছিল আগে থেকেই। ছোট্ট মেয়েটা দিদির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে। লখাই জোর করে বাইকে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। কালি রাগে দুঃখে অভিমানে ক্ষোভে স্তম্ভ হয়ে নিমগাছের তলায় বসে পড়ে। দুচোখ বেয়ে জল আসে। একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায় ধীরে ধীরে।



কালি সেদিন ভাত খেয়েছিল কিনা জানিনা। আজ অনেক বছর হল। এখন সে একবেলা রান্না করে। প্রতিদিনের মতো সমস্ত কাজ সেরে রাতে নিমগাছের তলায় শুয়ে ঘুমোয়।

   ব্যাটার বিয়ে দেওয়ার পর থেকে নিমতলায় কালির জায়গা। তাই অভ্যাসে এখনও কালি ওখানে শুয়ে থাকে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা। বর্ষায় টিনের চালাটায় শোয়। কনকনে শীতে একটা কাপড় আঁড় দিয়ে ঢাকা নিয়ে শুয়ে পড়ে। ঝড় হলে ভীজে ভীজেও নিমতলায় শুয়ে থাকে। ঘরে শোয় না। ভাবে ছেলে বউ ফিরে এলে শোবে। নিমগাছের তলায় তাই তার একমাত্র আশ্রয়।

  ছেলের খবর পেয়েছে কিছু কিছু। লখাই দক্ষিণ ভারতে একটা কী কাজ করে। বউ নাতনি তার টাকায় বাপের ঘরে ভালোই আছে। আবার নাকি কিছু একটা হবে। তার জন্য কালি সকাল-সন্ধ্যে ঠাকুরকে ডাকে। ভাবে নাতি হোক। তাহলে নাম রাখবে নিমাই। লখাইয়ের ব্যাটা নিমাই।

কালির সংসারে ওকে সব ছেড়ে গেছে একে একে। স্বামী। ব্যাটা বউ নাতনি। শুধু নিমগাছটা যেতে পারেনি। দুহাতে কালি তাকে যেন আগলে রেখেছে। সব ভালোবাসা দিয়ে। নিমগাছটাও হয়তো তাই। নাহলে গতবার ঝড়ে ভেঙে যাওয়া ডালটা এবার নতুনভাবে গজিয়ে উঠে!

  নিঃসঙ্গ কালি অনেক বছর পর ভর দুপুরে কাঁদতে বসে নিমতলায়। যার কেউ নেই তার দুঃখ হয়তো গাছটা বোঝে। ও শুনেছে গাছের প্রাণ আছে। গাছ শত বাধা ঠেলে সোজা হয়ে বেঁচে থাকতে পারে। সমস্ত আবর্জনা জঞ্জালের মধ্যে নিঃসঙ্গ ভাবে। কালির স্বপ্নের নিমাই যেন এই নিমগাছ। যার কাছে সে সমস্ত মান অভিমান না পাওয়া ব্যক্ত করতে চায়। সমস্ত না পাওয়া দিয়ে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। যে সব ছেড়ে পূর্বপুরুষের ভীটে আগলে রাখবে। কালিকে মাথায় করে রাখবে। কালি সেই ভাবি পুরুষের কথা ভাবে আর অজান্তে নিমগাছটাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে এক নাগাড়ে – ‘তুই যাতে লারবি রে নিমাই। তুকে আমি ছাড়ব নাই নিমাই। আমি জানি তুই লারবি। তুই আমার হয়ে থাকবি নিমাই।’ কালি ভাবি কালের স্বপ্ন আর সংশয়ে হাউমাও করে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরে আরও জাপটে – আপন মনে বলে – ‘‘তুই লারবি যাতে আমাকে ছাড়ে। তুই লারবি...’’