Wednesday, December 11

বাসুদেব দাসের অনুবাদ গল্প : মৈথুন সঙ্গীত








অরুন্ধতী দত্ত
মৈথুন সঙ্গীত

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস


কত দিন হল?
সত্যিই কত দিন হল?—বুকের ভেতরে বুলবুলি পাখিটা যে তোলপাড় করে না।মনের
মধ্যে এরকম একটি ভাব আসায় লনিমা চমকে উঠল।বুক থেকে বেরিয়ে আসা
দীর্ঘশ্বাসটাকে বাধা দেবার জন্য যেন সে মাথাটা জোরে জোরে ঝাঁকাল।হালকা
করে বেঁধে রাখা খোঁপার বাঁধন থেকে খুলে যাওয়া দীর্ঘ চুলগুলি মুহূর্তের
মধ্যে তাঁর কাঁচা সোনার বর্ণের গাল-মুখ ঢেকে ফেলল।
        ‘মেঘে ঢাকা চন্দ্রমা’-রূপকের কথা এটি।তাঁর চুল,তাঁর রূপ নিয়ে কত যে
উন্মাদনা রূপকের।দুহাতে তাঁর চুলগুলি তাঁর মুখের চারপাশে সাজাতে সাজাতে
সে বলে –মেঘে ঢাকা চন্দ্রমা।সেই মুহূর্তে তাঁর বুকের ভেতরে বুলবুলি
পাখিটা ছটফট করতে থাকে।
        রোমন্থনের পথে এগিয়ে চলা মনটা বাধ্য হয়ে বাস্তবে ফিরে এল।ফোনের শব্দ।সে
রিসিভারটা তুলে নিল।
        ‘হ্যালো?’
‘হ্যালো-হ্যালো-হ্যালো-ক্লিয়পেট্রা,স্বপ্নবাসবদত্তা,লেডিডায়েনা,মেরিলিন
মনরো’অন্যপাশে বন্য ঝরনার কলধ্বনি—নন্দিতা!তাঁর বাল্যসখী।
‘হবে,হবে।বিশেষণগুলি রাখ।তোর মতলব কী তাই বল।‘
‘নাথিং সিরিয়াস।চল ‘ফায়ার’দেখতে যাই,অপ্সরায় দিয়েছে।‘
‘ও-দীপা মেহতা-শাবানা আজমীর প্রগ্রেসিভ কম্বিনেশন?সরি-ইছা করছে না।
‘কেন?’
‘না,আমার কোনো কিছুই ভালো লাগছে না।’
‘ও’-তার মানে রূপকের ওপরে ফায়ার হয়ে আছিস?ভালোই হয়েছে।ফায়ার দেখে
ইনস্পায়ার্ড হতে পারবি।এই এরা সব না হলেও যে আমরা চলতে পারি,সে কথাটা
ওরাও এবার বুঝতে পারবে—হিঃহিঃহিঃহিঃ-কী বলিস?’
না,না,গা ছাড়া উত্তর দিয়ে তাঁর হাসতে ইচ্ছা করল না।নন্দিতার একনাগাড়ে
বকুনি শুনে সে ফোনটা রেখে দিল।
নন্দিতা সম্পূর্ণ মজা করে বললেও তাঁর কথাগুলি এই মুহূর্তে লনিমার একেবারে
অসহ্য লাগছিল।কিছু বিষয় সম্পর্কে সে অত্যন্ত স্পর্শকাতর।তেমনই এক বিষয় হল
প্রেম।কোনো কারণে প্রেম সম্পর্কে হালকা আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়ার ইচ্ছা বা
মানসিকতা তাঁর নেই।
দীপা মেহতার ‘ফায়ার’সে দেখবে না।লনিমা একটা কথা বুঝতে পারে না।এই
প্রগ্রেসিভ মানুষগুলি নিজের প্রগ্রেসিভনেস প্রতিপন্ন করার জন্য সমাজের
কথা ভেবে দেখে না কি?সেই সময় সামাজিক দায়বদ্ধতাকে বন্ধ ডিবেতে বন্ধ করে
রাখে নাকি?হয়তো নিজের প্রগতিশীল চিন্তাধারার ঘূর্ণি বাতাস সমাজে কীভাবে
ধ্বংসলীলার সৃষ্টি করতে পারে।-তার জন্য ভ্রূক্ষেপ করার ও প্রয়োজন বোধ করে
না।ভারতীয় মানসিকতাকে এই ধরনের কথাছবি  যে ছোট্ট শিশুকে ঝাল মাংস খেতে
দেওয়ার নামান্তর।বদহজম।সাঙ্ঘাতিক বদহজম হওয়ার আশঙ্কা।সমকামী প্রেমের
অস্তিত্ব বা অপ্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাঁর কোনো বিদ্বেষ নেই।তাঁর বিশ্বাসের
জগতে প্রেমের সীমা দিগন্ত বিস্তৃত-এপার ওপারের আন্দাজ করতে না পারা।
পুরুষ-প্রকৃতি,শরীর আর আত্মা যেখানে একাকার হয়ে যায় সেই প্রেমের পূজারিনী
সে।প্রেম এক আত্মিক অনুভূতি।আত্মার ও তো কোনো লিঙ্গ নেই।তাহলে আত্মার
প্রেমে,স্বলিঙ্গের মাঝের প্রেমকে স্বাভাবিক বলে গণ্য করার পরিবর্তে ভিন্ন
লিঙ্গের অস্তিত্বকে স্বাভাবিক বলে ধরা হয় কেন?
আচ্ছা,আত্মার কোনো লিঙ্গ না থাকলেও রক্ত,মাংস,অস্থি-মজ্জার এই খাঁচাটির
যে বিপরীত ধর্মী আকার আছে –রূপ আছে,যে বৈপরীত্য সৃষ্টি করে আকর্ষণের
কেন্দ্রবিন্দু—প্রেমের অনুভব।
তার যে কতজনের সঙ্গে প্রেম,ফুলের সঙ্গে প্রেম,গাছ পালার সঙ্গে প্রেম,নদীর
সঙ্গে প্রেম,দুব্বোর সঙ্গে প্রেম,ঝরা পাতার গালিচার সঙ্গে প্রেম,আর প্রেম
রূপকের সঙ্গে।সমস্ত প্রেমের নানারঙী অনুভবের কোমল গালিচায় লাফিয়ে লাফিয়ে
এসে সে রূপকের প্রেমের মহাসমুদ্রে ডুব দিয়েছে।সেই মহাসমুদ্রে সমস্ত
ইন্দ্রিয়ের অবগাহনের সুখানুভূতির দ্বারা সে পরিতৃপ্ত হয়েছে।এই ধরনের
অনুভব -এই ধরনের প্রেম কি কোনো নারীর সঙ্গে সম্ভব?কার ও কার ও কাছে হতে
পারে।এটা এক প্রাচীনতম সত্য।সবক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম
রয়েছে।রীতি-নীতি,সংস্কার,বিশ্বাস এবং স্বাভাবিক নিয়মের সামান্তরালভাবে
ব্যতিক্রমও থাকে।সেরকম দুই একটি ব্যতিক্রম সাগর সংকাশ সামাজিক রীতি-নীতির
বুকে দুই-একটি বুদ্বুদ তুলতে পারে।দুকুল প্লাবিত বন্যার সৃষ্টি করতে পারে
না।এই ধরনের বুদ্বুদে সে ভ্রূক্ষেপ করে না। তাই সে ‘ফায়ার’দেখতে যাবে না।
‘দিদি।’
দৈবকীর ডাকে সে ভাবের জগত থেকে বাস্তবে ফিরে এল।এতক্ষণ হাতে বইটা নিয়ে সে
নিজের মধ্যে মগ্ন হয়েছিল।‘সাগরতলীর শঙ্খ’-ডঃহীরেন গোঁহাই সম্পাদিত কবি
নীলমণি ফুকনের কবিতা সঙ্কলন।বইটা বন্ধ করে রেখে সে দৈবকীকে ডাকল—
‘ভেতরে আয়-দৈবকী।‘
শোবার ঘরের পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দৈবকী এসে মেঝেতে লেপ্টে বসল।লাল
হয়ে উঠা চোখ দুটিতে তাঁর উদভ্রান্ত চাহনি।অনেকক্ষণ কাঁদার চিহ্ন।
‘সে কোথায়?’
‘ওকে পাঠিয়ে দিয়েছি।লাগবে না।ছেলেটিকে আমি নিজেই বড় করব।সে যেখানে মজেছে
সেখানেই থাকক।‘
‘সে থাকার ব্যবস্থা করেছে কি?’
‘করবে,করবে।এতটা করতে পেরেছে যখন বাকিটাও করবে।আমাদের চিন্তা করার দরকার
নেই।আপনাদের গরু-গাই দেখাশোনার কাজের জন্য সে একজন ভালোমানুষ যোগাড় করে
দিয়েছে-স্যার জানেন।–দৈবকী উষ্মার সঙ্গে কথাগুলি বলে হাঁটু দুটি তুলে
বসে,থুতনিটা হাঁটুতে রেখে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল।তাঁর দৃষ্টিতে মরুভূমির
শূন্যতা।লনিমার বুকটা হাহাকার করে উঠল।
এই হল দৈবকী।দেহে যৌবন ঝলমল করছে।মিষ্টি দেখতে,আঁটো-সাঁটো দেহ,হাসতে থাকা
চোখ আর মুখে প্রাণবন্ত। দৈবকী লনিমার সংসারে নানা কাজে সাহায্য করে।তাঁর
স্বামী অনন্ত লনিমাদের গরু-ছাগল দেখার সঙ্গে সঙ্গে পাশের বাড়ির বাগানেও
কাজ করে।লনিমাদের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে বসবাস করা অনন্ত দৈবকীকে পালিয়ে
এনে বিয়ে করার দিন থেকে দুজনের সুখ-দুঃখের সমস্ত বিষয়েই লনিমা অংশগ্রহণ
করে এসেছে।চোখের সামনে আজ দশটা বছর নিজের নিজের ধরনে পরিপক্ক হয়ে উঠেছে
দুটি সংসার।লনিমা এবং রূপকের পুত্র সতেরো বছরের ঋষির সঙ্গে অনন্ত এবং
দৈবকীর বারো বছরের বাবলুও বড় হয়েছে।দৈবকীদের ছোট পরিবারটির মধ্যে
ভালোবাসার কী অপূর্ব বন্ধন।আর-অনন্ত আর দৈবকীর প্রেম?লনিমা তারও অজস্রবার
প্রকাশ দেখেছে—তাঁর ছোট ছোট প্রশ্নের উত্তরে দৈবকীর লাল হয়ে উঠা দুইগালের
সিদূঁরের আভায়।অনন্তের বিরুদ্ধে তাঁর কাছে দৈবকীর ছোট ছোট অভিযোগের
আবরণের আড়ালে থাকা প্রশ্রয়ের সুরে,সব সময় জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখের
দৃষ্টির পরিপূর্ণতায় এবং দুই চোখে দুলতে থাকা পরিতৃপ্তির প্রচ্ছায়ায়।অথচ
এই দৈবকীর দুই চোখে আজ মরুভূমির শূন্যতা।তপ্ত বালির শুষ্কতা যেন তার রোদে
ঝলমলে মুখটাকে দহে নিয়েছে।অনন্তের পরকীয়া প্রেমের লালসার আগুন যে তাকে
জীবন্ত পুড়িয়ে মারছে।অনন্তের কাণ্ডটা জানাজানি হওয়ার পরে দৈবকী আজ
কয়েকদিন ধরেই লনিমাকে জিজ্ঞেস করছে ’দিদি,আমি কি ওই মেয়েটি থেকে দেখতে
খারাপ?কেন?আগে তো আমার চেহারা নিয়ে বন্ধুদের কাছে অহঙ্কার করে বেড়াত।এখন
আমি সেই ভূতনি থেকেও দেখতে খারাপ হয়ে গেলাম?’
অনন্ত কেলেঙ্কারি করল।সে যেখানে মালির কাজ করে,সেই মানুষটার বাড়িতে কাজের
মেয়েটার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে পড়ল।ষোলো বছরের,কালো উঁচু দাঁতের
বেঁটে খাট মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ল।দৈবকী কীভাবে সহ্য করবে?তাঁর
তুলনায় মেয়েটি যে সত্যিই পেত্নী।তাহলে?তাহলে কী দেখে মজল অনন্ত?দৈবকী
বুঝতে পারে।কেন পারবে না।লনিমাও বুঝতে পারে।
শোনা নাশোনার মতো করেই লনিমা এক ক্ষীণ পদধ্বনি শুনতে পায় তার বুকের
মাঝখানে। অনিশ্চয়তার পদধ্বনি,সংশয়ের পদধ্বনি।মনটা হাহাকার করে উঠে। রূপক
কে তো কখনও তার মনের মধ্যে এই ধরনের সংশয়ের বোঝা  বহন করে বেড়াতে হয় না।
যত্নে রাখা ধনের মতো মূল্যবান নারীর জীবন-যৌবন। যতদিন যত্নে রাখা যায়
ততদিনই সম্পদশালী। ক্ষয় হলেই দেউলিয়া –মূল্যহীন।
তাঁর কারও একজনের সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে ইচ্ছা করছে।কাকে বলবে?কোনমুখে
বলবেন?শরীর আর আত্মার একান্ত প্রেমের পূজারিনী সে। রূপ যৌবনের বিনাশ
প্রক্রিয়ার জন্য সে শঙ্কি্ত হবে কেন?
অরণ্যে,অরণ্যের ভেতরে
সারেং পাখির আওয়াজ
মেলে দাও দুটি বাহু
দূরে যাক
তোমার চুলের গন্ধে
পদ্মপুকুরে মন্দ্রিত বাতাস
দেহে,তোমার দেহের ভেতরে
একটা লাল ফুল
অঙ্কুর মেলা তালপাতাটাতে
ধারাসার বৃষ্টি
তোমার স্তনের রক্ত তোমার ঠোঁটে
এখন তোমার বাস্তব
অন্ধকারের আরক্তিম মুখ
পাহাড়ে মেঘের গর্জন।’
কিছুক্ষণ আগে সে নীলমণি ফুকনের মৈথুন সঙ্গী্ত কবিতাটি পড়ছিল।নারী পুরুষের
দৈহিক মিলনের সমস্ত বিষ্ময়,পুলক আর রহস্য যেন কবিতাটিতে উৎসারিত
হয়েছে।গভীর অরণ্যের মধ্যে সারস পাখির নিনাদিত কণ্ঠ যেন নর-নারীর চূড়ান্ত
মিলনের শব্দময় প্রতিবিম্ব।যেন মৈথুনের মুহূর্তে চেতনার সীমান্তে মৃত্যু
বা অবলুপ্তির দরজার সামনে বেজে উঠে জীবন এবং সত্তার শঙ্খ্নাদ।‘কবিতাটির
অর্থ ভূমিকায় এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
তাঁর সমগ্র সত্তায় অনুভূত হল প্রেমময় স্বর্গীয় অনুভবের তীব্রতা।অথচ আজ
কতদিন ধরে তাঁর দেহ-মনে এই ধরনের তীব্রতা  ঝঙ্কৃত হয়নি।আসলে ভেতরে ভেতরে
সে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে কি?ধীরে ধীরে রূপকের দৃষ্টির মুগ্ধতা স্তিমিত হয়ে
আসার উপলদ্ধি কি তাকে শঙ্কিত করে তোলেনি?সে নিজেকে জিজ্ঞেস করে
দেখে।না,না।এটা অন্যায়।রূপকের মানসিকতা সম্পর্কে এভাবে ভাবা সত্যি অন্যায়
অথচ তাঁর মনে ধীরে ধীরে এক শীতলতার আস্তরণ পড়েছে।গরম দুধে পড়া সরের
আস্তরণের মতো।সরের আস্তরণের নিচে তপ্ত হয়ে থাকা দুধের মতো তার বুকের
ভেতরেও চাপা পড়ে আছে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস আর ভমান ভরা চোখের জলের সাগর।ক্রমশ
নিরুত্তাপ,নিঃতরঙ্গ,আর বেপরোয়া হতে পারা রূপকের ব্যবহারের কৈফিয়ত এর
খোঁজে তাঁর মন হাহাকার করে উঠছে।
        গত দুই বছর লনিমা অসুখে ভুগছে।রূপকের সর্বক্ষণের যত্নের জন্য রোগ তাঁর
রূপকে গ্রাস করতে পারেনি,কিন্তু ধীরে ধীরে সন্তর্পণে ভরা দুপুরের রোদে
বিকেলের অস্তায়মান ছায়া পরিদৃশ্যমান হয়েছে। তাঁর মনেও ছায়া পড়েছে।রূপক আর
তাঁর সম্পর্কের অভ্যস্ত লয় আর গতির যাত্রাপথে রূপকের মধুর বাক্যও তাঁর
বুকের ভেতরে আগের মতো উত্তেজনার সৃষ্টি করে না। বুলবুলি পাখিটা নীরবে
শুয়ে থাকে।এখন অনন্তের ক্রিয়াকাণ্ড তাকে যেন অধিক চিন্তিত করে তুলেছে।
        না,না সে কী করছে-অনন্তের সঙ্গে রূপকের তুলনা?আচ্ছা,রূপক তো অনন্ত নয়।সে
ও দৈবকী না।মানুষরূপে উৎকৃ্ষ্ট,স্বামীর রূপে একনিষ্ঠ এবং প্রেমিকের রূপে
দুরন্ত রূপকের সঙ্গে অনন্তের তুলনা যে পাগলামি।তবু একটা বিন্দুতে ওরা
এক।ওরাপুরুষ।নিজের রূপ-লাবণ্য নিয়ে পুরুষের কোনো সংশয় নেই।সংশয় থাকে
নারীর মনে,পিতৃতন্ত্রের আবহাওয়ায় লালিত-পালিত নারীর মনে।সংশয়ের এই
বিন্দুতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছে -লনিমা আর দৈবকী-দুটি ভিন্ন
সমাজের,ভিন্ন পরিবেশের,ভিন্ন চিন্তা-ধারার দুটি নারী।
        ‘আমি কী করিনি-- ওর জন্য?আপনিই বলুন দিদি।’
        ‘হ্যাঁ’ দৈবকীর কথায় সে চমকে উঠল।তারপর দৈবকী তাকে অনেক কিছু বলছিল।তার
শুকনো কণ্ঠস্বরের ভয়ঙ্কর শীতলতা লনিমাকে আতঙ্কি্ত করে তুলেছিল।নিজের
অজান্তেই তাঁর সত্ত্বা পলায়ন করেছিল দৈবকীর জগত থেকে নিজের জগতে।সে আপন
বিভোর হয়েছিল।এখন দৈবকীর কণ্ঠের আর্দ্রতা তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল।
        ‘আমি তার জন্য,সংসারের জন্য কী করিনি?আপনার কাজ থেকে অবসর বের করে,তাঁত
বুনে,আপনি বন্দোবস্ত করে দেওয়া অনুসারে কত দিদিমণিদের শাড়িতে ফলস লাগিয়ে
দিয়ে দুই পয়সা রোজগার করে একটু জমি কেনার জন্য পয়সা জমিয়েছি।গ্রামের
বাড়িটা তৈ্রি করার জন্য আমি কত টাকা খরচ করেছি তার সবই তো আপনি জানেন
দিদিমণি।দেহকে কষ্ট দিয়ে রোজগার করা ধন আমি তো আমার মা-বাবাকে খাওয়ানোর
জন্য খরচ করিনি – করেছি ওর জন্য,ওর পরিবারের জন্য।এখন এই দেহটা –এই দেহটা
ওর কাছে পুরোনো হয়ে গেল?ও এখন কোমল দেহ খুঁজে বেড়াচ্ছে?’
        দৈবকীর মুখের এক একটি শব্দ যেন কান্নায় মাখামাখি হয়ে ঘরের ভেতরে ছটফট
করে বেড়াচ্ছে।সান্ত্বনার কোনো ভাষা খুঁজে না পেয়ে লনিমা হতবুদ্ধি হয়ে বসে
রইল।এই মুহূর্তে দৈবকীকে সান্ত্বনার বাণী শোনানো নিরর্থক।নেশাগ্রস্ত
মানুষের মতো একটা আবেশের মধ্যে বিভোর হয়ে দৈবকী এক নাগাড়ে কথা বলে চলেছে।
        আমি তার জন্য শরীর দিয়ে কাজ করতে পারব,না খেয়ে থাকতে পারব,ছেঁড়া কাপড়
পরে কাটাতে পারব,ভিক্ষা করতে পারব,মরে যেতেও পারব।কিন্তু আমি তো দিদি
ফোঁপাতে ফোঁপাতে কথাগুলি বলে দৈবকী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।শেষের কথাগুলি
তাঁর বুক ভাঙ্গা কান্নার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে বাতাসে একটা কম্পনের সৃষ্টি
করল এবং সেই কম্পন গুলি তাঁদের দুরন্ত গতিতে লনিমার বুকে এসে ক্রমাগত
ধাক্কা মারতে লাগল।ইস অসহ্য।লনিমা দুহাতে বুকটা চেপে ধরল।কী বলল?কী
বলল?দৈবকী কী বলল?
        দুহাতে অঞ্জলি পেতে লনিমা কম্পনগুলি সামলাতে চেষ্টা করল।কম্পনগুলি সামলে
লনিমা দুহাতের অঞ্জলিতে সত্যের নগ্ন রূপ প্রত্যক্ষ করল।অনেকক্ষণ দৈবকী আর
লনিমা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন।এক চিরন্তন সত্যের পরিচিত উপলদ্ধিতে সে
দৈবকীর চোখে চোখ রেখে কম্পনগুলি পুনরায় ছেড়ে দিল-বাতাসে।ইথারের সাগরে
কম্পনগুলি একে অপরের গায়ে ধাক্কা মেরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল দৈবকীর
কণ্ঠস্বর—
        আ-মি তা-র জ-ন্য স-ম-স্ত ক-র-তে পা-র-ব কি-ন্তু আ-মি-তো এ-খ-ন ও-র জ-ন্য
যু-ব-তি হ-য়ে উ-ঠ-তে পা-র-ব না আ-মি-তো এ-খ-ন ও-র জ-ন্য যু-ব-তি হ-য়ে
উ-ঠ-তে পা-র-ব না।

        আমি তো এখন আর ওর জন্য যুবতি হয়ে উঠতে পারব না।
--------------



লেখক পরিচিতি :

১৯৫৫ সনের ৩১ জুলাই গুয়াহাটির মালিগাঁওয়ে ঔপন্যাসিক,গল্পকার,অনুবাদক এবং শিশু সাহিত্যিক অরুন্ধতী দত্তের জন্ম হয়।
পিতা পূর্বাঞ্চলীয় পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নিবারণ চন্দ্র বরা।মাতা
স্বাধীনতা সংগ্রামী কিরণময়ী বরা।১৯৮৭-২০০৩ পর্যন্ত আকাশ বাণী বেতার
কেন্দ্র এবং দূরদর্শনের সংবাদ পরিবেশিকা।৭ অক্টোবর ২০১৬ সনে লেখিকার
মৃত্যু হয়।

অমিতাভ দাসের অণুগল্প : তালপাতার পাখা





অমিতাভ দাস
তালপাতার পাখা


এই বস্তুটির সঙ্গে বুবলাইয়ের বিরাট শত্রুতা । জিজ্ঞেস করো কেন ?
--কেন ?
এই তালপাতার পাখা দিয়ে ঠাকুরমা হাওয়া খেতেন , পিঠ চুলকোতেন , দুষ্টুমি করলে পাখাটা ছুঁড়ে মারতেন । বাবা কাজ থেকে ফিরে হাওয়া খেতেন , পিঠ চুলকোতেন এবং অন্যায় দেখলেই পাখার ডাট দিয়ে পেটাতেন । মা'ও তাই করতেন । মাস্টারমশাই'ও তাই করতেন ।
  --তার মানে তালপাতার সঙ্গে সব-ই খারাপ স্মৃতি ? ভালো স্মৃতি নেই কিছু , বলায় বুবলাই  কান চুলকে বললে , আছে-- বেশ কিছু স্মৃতি আছে বটে ।
--শুনি কেমন সেই স্মৃতি ।
--শুনবে ? বলে বুবলাইয়ের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল ।

   মা যখন ছাদে আচার রোদে দিত , আমার কাজ ছিল তালপাতা দিয়ে হাওয়া দেওয়া ,  যাতে মাছি না বসে । কাক বা অন্য পাখি এসে মুখ না দেয় । সে ছিল খুব আনন্দের সময় । ষষ্ঠীর সময় মা  তালপাতার পাখাটা গঙ্গার জলে ভিজিয়ে আমাদের হাওয়া দিত মাথায় । বলত , ষাট ষাট...ঠাকুমাও তাই করতেন । এসব বড় ভালো লাগত ।

  দুপুর বেলা বাবা ঘেমে-নেয়ে বাড়ি ফিরলে আমি হাওয়া করতে বসতাম । বাবা রুমালের মধ্যে শালপাতায় মোড়া তালশাঁস নিয়ে আসত । দাওয়ায় বসে হাওয়া খেত । মা খুব যত্ন করে সেই পাখার চারিদিকে লাল কাপড়ের কুচি লাগিয়ে সেলাই করে রাখত । আহা , দেখতে কী যে ভালো লাগত ।
  --ওই দ্যাখো , আইসক্রিমঅলা যাচ্ছে । খাবে নাকি এক পিস ?
--কত দাম ?
--কত আর , ত্রিশ পয়সা চল্লিশ পয়সা হবে । আমার কিন্তু সবুজ রঙের আইসক্রিমটা বেশ লাগত ।
--আমার কমলা...


কথা চলছে । কথা উড়ছে । কাঁচা আমি আর পাকা আমির মধ্যে কথা । এসির ঠান্ডা ঘরে বসে বুবলাই এখন নিজের সঙ্গে নিজেই অনেক কথা বলে । অবসর জীবনে এইসব নিয়েই বেঁচে আছেন বুবলাই বোস । বাইরে ৪২ ডিগ্রি উত্তাপ  । ফ্ল্যাট । বড় বড় বাড়ি । গাড়ি । মোবাইল টাওয়ার । আকাশ নেই । গাছ নেই । মাটি নেই । সবুজ নেই...

সনৎ বসুর অণুগল্প : পাগল





সনৎ বসু
পাগল

লোকটা কবিতা লেখে
সংসারের কিছুই বোঝে না
ভূত ভবিষ্যৎ বোঝে না
সারাদিন রসের খোঁজে মাতাল
আর বিড়িতে শিল্পের টান
ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জারে কবিতার চাষ
ফ্রেন্ড লিস্টে দুজন প্রেমিকা
ভিডিও কলে শরীর দেখায়, দেখে
লোকটার তাতেও শিল্পের নেশা

বৌ বলে কাজে যাও,  আয় করো
ছেলে বলে টাকা দাও, ফিস দেবো
ভাই বলে সই দাও, জমি দেবো ৷
লোকটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়
কিছুই বলে না
যুৎসই শব্দ খোঁজে  ৷

এক ভোরে দরজায় টোকা ৷
কে?
ঘর ছাড়ুন দাদা,  বাড়ি ভাঙবো ৷
রাস্তায় গাড়িতে বৌ, ছেলে, ভাই  ৷
বিপদটা তখনো বোঝেনি ৷

কবিতায় চমৎকার হাত লোকটার ৷


তরুনার্ক লাহার অণুগল্প : মাসুল





তরুনার্ক  লাহা
মাসুল
                           
অসহ্য!আর না।সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় কণিকা ।কতদিন আর জোড়াতালি দিয়ে চলবে।অন্য কেউ হলে অনেক আগেই.....
নন্দ যদি একবার ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে তার কাছে আসত তাহলে সবকিছুই মিটে যেত।এই কটা দিন ঘরেই আবদ্ধ রেখেছিল নিজেকে ।তাকিয়ে থাকত দরজার দিকে।কান পেতে থাকত নন্দ'র কণ্ঠস্বর শোনার জন্য --এই কণি,আমি এসেছি।
কণিকার মনে পড়ে তাদের পরিচয়ের প্রথম দিনটা।বেশ ঘটনা বহুল ।হন্তদন্ত হয়ে ভিড় বাসে উঠতে যাচ্ছিল কণিকা ।পাদানিতে পা দিতেই হঠাৎ বাস ছেড়ে দেয়।বেসামাল হয়ে পড়ে যাচ্ছিল সে।লোকজনের চিৎকারে বাস থামে।ততক্ষণে নন্দ এসে কণিকাকাকে ধরে ফেলে।সে যাত্রায় বেঁচে যায় কণিকা ।পরের বাসে দুজনেই দুর্গাপুরে ফেরে।একই সিটে পাশাপাশি দুজন ।পরের দিন থেকে সহযাত্রী ।মাসচারেক পরে চার হাত এক হয়।কণিকা খুশী ।নন্দও।বছর ঘুরতে না ঘুরতে দেখা দেয় সম্পর্কে ঘুণপোকা।প্রতি ব্যাপারেই বাবাকে টানে।নন্দ একেবারেই পছন্দ করে না।শুরু হয় কথা কাটাকাটি।কণিকা একদিন তল্পিতল্পা গুটিয়ে সোজা বাপের বাড়ি।
দিন যায়।কণিকা ভাবে তাকে ঠিক নিতে আসবে নন্দ ।নন্দ আসে না,তার ফোনও আসে না।কণিকার মনে অভিমানের আরাবল্লী ।পরে বাবার চাপেই কণিকা সিদ্ধান্ত নেয় নন্দ'র সাথে ডিভোর্স।
কণিকা উকিলের কাছে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ।সাথে তার বাবা।এমন সময় পিয়ন এসে একটা চিঠি দিয়ে যায়।নন্দ'র লেখা ।কণিকা তাড়াতাড়ি চিঠিটা খুলে পড়তে থাকে।স্তব্ধ হয়ে যায় সে।পিছন ফিরে তাকায় বাবার দিকে।যাকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করত সে মানুষটা এত নীচ?দশ বছর আগেই সামান্য স্বার্থের কারণে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয় নন্দ'র বাবাকে।সেই কারণেই নন্দ তার বাবাকে.....
কণিকা তার বাবাকে পেছনে রেখে স্বামীর বাড়ির পথ ধরে।মনে মনে ভাবে-চিঠিটা না এলে কি ভুলটাই না করতে যাচ্ছিল !তার মাসুল গুনতে হতো সারাজীবন ।
                     

সায়ন্তনী বসু চৌধুরীর অণুগল্প : পরি






সায়ন্তনী বসু চৌধুরী
পরি
                             

খুকু তখন কোলে করে তুলোর পুতুল আঁকড়ে ঘুমোতে যাবে। হঠাৎ জানালায় চাঁদ এসে হাজির।
-কই গো, ঘুমোলে বুঝি?
ঝুঁটি ঝাঁকিয়ে মাথা দুলিয়ে খুকু বলল,
-না তো। ঘুম তো আসেনা সহজে!
-কেন কেন?
-সারা মাথায় কিলবিল করছে কঠিন কঠিন অঙ্কের নিয়ম। আমার মাথা ব্যথা করেনা বুঝি?
চাঁদের গলা গম্ভীর হল। সে বলল,
-তাই তো! তাই তো! সমস্যা তো জটিল!
খুকুদের ঘরের জানালায় ছাই ছাই বিষণ্ণতা ছেয়ে গেল বেশ কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু খুকু স্বভাবচঞ্চল। একটু পরেই মনখারাপের পর্দা ছিঁড়ে গোল গোল চোখ বের করে সে উঁকি দিল। মুক্তার মত হাসি ছড়িয়ে রিনরিনে গলায় জিজ্ঞেস করল,
-আমাকে পরি দেখাবে বলেছিলে না? ভুলে গেলে?
বৃদ্ধ চাঁদের গলা অমনি সরল হয়ে গেল। বিজ্ঞের মত হেসে সে জবাব দিল,
-রোসো রোসো! ইচ্ছে হলেই কি পরি দেখা যায়? সে এক অদ্ভুত সময়! রাতের কালো কেটে দিনের আলো যখন ফুটব ফুটব করে, সে সময় চোখ খুলে থেক। যদি চোখে ঝিলমিল লেগে যায় বুঝবে পরি এসেছে।
খুকু তারপর জেগে রইল। চোখ বন্ধ করেই জেগে রইল। জেগে জেগে অনেক ভাবল। পরিরা এলে বুঝি চোখে ঝিলমিল আলো খেলে যায়? গায়ে কাঁটা দেয় কী না চাঁদ তো বলে গেল না! আচ্ছা, পরিরা কি কথা বলে? গান গায়? অঙ্কও কষে তার মত?
     
***
নদীর ধারে, পাহাড়ের গায়েই এক বিশালায়তন বটবৃক্ষ। অনেকটা মায়ের মত অবয়ব। মাটির অনেক অনেক গভীরে তার শিকড়। ঘন সবুজ তার পাতায় ঢাকা আঁচল। গাছের কোটরে কোটরে রংবেরঙের পাখিদের বাস। পরিযায়ীরাও আসে মাঝে মাঝে। গাছ তাদেরও ঘর দেয়। খিদে পেলে ফল দেয়। কিন্তু এহেন গাছ আজ শূন্য, বিবস্ত্র। পাতার আঁচল খসে পড়েছে তার পায়ের কাছে। মাথা নীচু করে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে গাছ। একে একে উড়ে গিয়েছে সব পাখি। 
বেলা হতেই খবর ছড়িয়ে পড়ল। লোকজন দলে দলে ছুটে গেল। গাছ মানুষের মা। মায়ের এমন অবস্থা হল কী করে? একদল জল ঢালল। একদল আনল ডাক্তার। ঔষধে পথ্যে মায়ের শুশ্রূষা শুরু করল কেউ কেউ। দিন, মাস বছর পেরিয়ে গেল, গাছ মা সাড়া দিল না। শেষে একদিন উৎকট দুর্গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল এলাকাবাসীর। সাফাইকর্মীরা দিকে দিকে খবর ছড়িয়ে দিল। মানুষ স্তম্ভিত হয়ে দেখল, পচে যাওয়া পাতার স্তূপ থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি পরির কঙ্কাল। তার গোটা শরীরে এতটুকু মাংসও অবশিষ্ট নেই। শুধু খুবলে খাওয়া ছেঁড়াখোঁড়া গোপনাঙ্গটা এখনও জীবিত। সেটাই সকলের দিকে তাকিয়ে দাঁত বার করে হাসছে।