Wednesday, January 1

আহসান হাবিবের গল্প : ইলিশ







আহসান হাবিব
ইলিশ

এই বাড়িতে শেষ কবে ইলিশ মাছ রান্না হয়েছে, কেউ তা ঠিক মনে করতে পারে না, বছর দুয়েক তো হবেই । তবে শেষ ইলিশের ঘ্রাণ যে নাকে এখনো লেগে আছে, এটা ঠিক ঠিক তারা টের পায় । অন্তত এই বাড়ির ছোট দুই ছেলে মাঝে মাঝেই সেই ঘ্রাণ মনে করে এক ধরণের সুখ অনুভব করে । তারা তাদের অজ্ঞানতায় মস্তিস্কের যে স্মৃতির নিউরন যা ঠিক ধরে রেখেছে সেই স্মৃতি, সেজন্য এক ধরণের কৃতজ্ঞতা জানায় তাদের কিংবা চোখে মুখে সেই স্মৃতির কৃতজ্ঞতা চিহ্ন ফুটে থাকে । তারা অচিরেই বুঝে যায় স্মৃতি খুব সহজেই হারিয়ে যায় না ।যদিও আবার কবে এই বাড়িতে ইলিশ আসবে, কেউ তা জানে না ।

ইলিশ না আসলেও প্রতিদিন ঠিকই মাছ আসে এ বাড়িতে, সে মাছ বাজারের সবচাইতে সস্তা, সে মাছ পুঁটিমাছ । দেখতে আহামরি কিছু নয়, স্বাদেও না । কিন্তু এই বাড়ির কর্তা ফয়েজ মণ্ডলের এর চেয়ে দামী মাছ কিংবা সুদৃশ্য মাছ আনার ক্ষমতা রাখেন না । তার আয় খুব সামান্য, এদিকে পরিবারে ছেলেমেয়ের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে সাতে এসে ঠেকেছে । বাড়িতে মোট নয়জন মানুষ, নয়জন মানুষের খাবার জোটানো কি চারটে খানিক কথা ! কোনরকমে তাদের দিন কেটে যায় । ভাগ্যিস যে বাড়ির কাছেই ছিল সরকারী প্রাইমারী এবং হাইস্কুল যেখানে সবাই একে একে পড়ালেখা শুরু করে । ফয়েজ মণ্ডল নিজে খুব বেশি লেখাপড়া করেন নাই, কিন্তু বাচ্চাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস । তার সাফ কথা- সবাইকে লেখাপড়া করতে হবে । লেখাপড়া করতে কোন খরচ নাই, সরকারী স্কুল, কোন বেতন নাই, আর কোন ফিস নাই । শুধু কিছু বই আর খাতা কলম কিনে দিলেই হয়ে যায় । ফয়েজ মণ্ডলের সব ছেলেমেয়ে আবার লেখাপড়ায় ভাল, সব বড় ছেলে এবার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে । খুব জোরসে লেখাপড়া চলছে । ক্লাশ এইটে বৃত্তি পরীক্ষা পেয়েছিল, স্কুলের সবাই ধারণা করছে ম্যাট্রিকে ঠিকই স্ট্যান্ড করবে কাজল, এই বাড়ির বড় ছেলের নাম কাজল । কাজলের দেখাদেখি আর সবাই লেখাপড়ায় একই রকম ভাল, ফলে ফয়েজ মণ্ডল এদিক থেকে খুব, খুব ভাগ্যবান । এলাকার লোকজন তাকে সমীহ করে এমনকি স্কুলের শিক্ষকগণও তাকে সম্মান করে থাকেন ।

স্থানীয় বাজারে ফয়েজ মণ্ডলের একটা ছোট্ট দোকান আছে, চাল ডাল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে তার দোকান । দোকানে সারাদিন কাজ করেন, সকালে বেরিয়ে রাতে ফেরেন । দুপুরে একবার বাড়িতে এসে খেয়ে আবার দোকানে গিয়ে বসেন । সকাল সকাল এই বাজারে বিভিন্ন ধরণের মাছ নামে, ফয়েজ মণ্ডল বেছে বেছে পুঁটি মাছ কিনে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন । লাউ, পেঁপে, কুমড়া, শশা, টমেটো বেগুণ নিজের বসত বাড়ির পেছনে যে টুকরো জায়গা আছে সেখানে চাষ করে তার মেজো এবং সেজো ছেলে । এই দুই ভাই খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে এইসব শব্জী চাষে লেগে পড়ে । বাড়ির মধ্যে একটা পেঁপে গাছ আছে, চালের উপরে কুমড়ো আর রান্নাঘরের কোন বেয়ে উঠে গেছে একটা পুঁই গাছ । বাড়ির পেছনে নানা উদ্ভিদ, তার মধ্যে কচুর গাছের ছড়াছড়ি, তাই এই বাড়িতে কচুর শাক প্রায় রোজ রান্না হয় । একটা সজিনার গাছ আছে বাড়ির আর দিকে, সজিনার শাক এ’বাড়ির আর একটা প্রধান খাবার ।
দীর্ঘদিন পুঁটি মাছ খেতে খেতে ততদিনে এই বাড়ির লোকজনের মুখে চরা পড়ে গেছে যেন । বাড়ির গৃহিণী ফরিদা বেগম তাই একদিন সাহস করে বলে ফেললেন-
‘ছেলেমেয়েরা কতদিন ভালমন্দ খায় না, রোজ রোজ একই মাছ, সেই পুঁটি, একদিন একটা ইলিশ আনবেন তো’।

স্বামী তখন দোকান যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, গায়ে ফতুয়াটা জড়াতে জড়াতে ফরিদা বেগমের দিকে তাকালেন, না কোন রাগী দৃষ্টি নয়, কেমন যেন একটা অসহায়ের দৃষ্টি । মুখে কিছু বললেন না, দোকানের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন । ফরিদা বেগম কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন, মনে মনে বলতে লাগলেন- কথাটা বলা মনে হয় ঠিক হয় নাই, লোকটা কত কষ্ট করে যে সংসার চালাচ্ছেন, তা শুধু তিনিই জানেন । অনেকক্ষণ বারান্দায় মন খারাপ করে বসে রইলেন ।

দিন যায়, মাস যায় । ইলিশ আসে না, আসে সেই পুঁটি । কিন্তু একদিন আসে সেই একটা দিন, যেদিন সত্যি সত্যি এই বাড়িতে ইলিশ আসে । বাজারে হাট বসে সপ্তাহে দুইদিন, সেই দুইদিন হাটে ইলিশ মাছ ওঠে । বিকাল তিনটার পর হাটে মানুষ আসতে শুরু করে । সন্ধ্যা হতে হতে হাট জমে ওঠে । সেদিন দুপুরে খেতে গিয়ে ফরিদা বেগমকে ফয়েজ মণ্ডল বলেন- ‘আজ সন্ধ্যায় তোমার মেজো ছেলেকে একটু দোকানে পাঠিও তো’।

ফরিদা বেগম কিছুটা আঁচ করতে পারেন, আজ নিশ্চয় ভালমন্দ খাবার বাড়িতে আসবে, হতে পারে ইলিশও আসতে পারে । ‘আচ্ছা’ বলে চুপ করে থাকে ।
সন্ধ্যার একটু আগেই মেজো ছেলে কালাম হাতে একটা বাজারের থলে নিয়ে বাজারে উপস্থিত হয়ে পড়ে ।ফয়েজ মণ্ডল তাকে দেখেন, তখন তিনি সামান্য ব্যস্ত, হাতের ইশারায় বসতে বলেন কালামকে, কালাম সামনে একটা বেঞ্চ, সেখানে বসে পড়ে । ব্যস্ততা কমে গেলে তিনি দোকানের ভেতর থেকে নেমে আসেন এবং কালামকে দোকানের ভেতর উঠে গিয়ে বসতে বলেন, কালাম ইতস্তত করে, এটা বুঝতে পারেন ফয়েজ মণ্ডল, তিনি তখন তাকে নিষেধ করেন-
‘থাক বসতে হবে না, তুই আমার সঙ্গে চল’ বলে তিনি দোকানটা বন্ধ করে ফেলেন । সন্ধ্যায় কখনো দোকান বন্ধ করেছেন, ফয়েজ মণ্ডলের মনে পড়ে না । আজ বন্ধ করলেন, কারণ তিনি আজ মাছের বাজারে যাবেন এবং যদি একটা ইলিশ পেয়ে যান তার সাধ্যের মধ্যে, কিনে ফেলবেন । সকাল থেকেই তাঁর মনের ভেতর একটা আলোড়ন চলছে, এর আগে এই বাড়িতে কখনো ইলিশ মাছই রান্না হয় নাই । কালামকে বলেন- ‘চল, আমার সংগে, মাছের বাজারে চল’
‘মাছের বাজারে’ কথাটা শুনেই কালামের ভেতর একটা আনন্দের শিহরণ খেলে যায় । সেও ভাবতে থাকে আজ বাবা নিশ্চয় ইলিশ মাছ কিনবে । সে বাবার পিছনে পিছনে থলে নিয়ে হাঁটতে থাকে । বাজার জমে উঠেছে, এক এক জায়গায় এক এক জিনিসপত্র । সবাই সারি সারি হয়ে বসে আছে, কেউ হলুদের গুঁড়া নিয়ে, কেউ আবার মরিচের গুঁড়া, আবার কেউ সরিষার বোতল নিয়ে বসে আছে । অন্যদিকে নানারকম শব্জীর বাজার, একদিকে ধান এবং অন্য আর দিকে চালের বাজার । বাজারের ঠিক মধ্যিখানে দুই সারি মিষ্টির দোকান, হরেক রকম মিষ্টি । রসগোল্লা, জিলাপী, ঝুরি, বাতাসা, দমমিষ্টি ইত্যাদি । কালাম সেদিকে তাকায়, তার লোভ জাগে, কিন্তু বাবাকে মুখ ফুটে বলতে পারে না । ফয়েজ মণ্ডল সেটা দেখতে পান, কিন্তু মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়ান না । একদম চলে যান মাছের বাজারে ।

খুব বেশি মাছ বাজারে আজ নামেনি, তবে ইলিছ মাছ বিক্রি করে যে আজমল, সে ঠিকই ইলিশের ঝাঁপি নিয়ে বসে আছে । সে ফয়েজ মণ্ডলকে দেখতে পেয়েই বলে ওঠে-
‘কি ফয়েজ মিয়া, আজ যে বড় মাছের বাজারে, তুমি তো পুঁটি মাছ কেনো সেই সকাল বেলা’
ফয়েজ মিয়া এই কথার কোন জবাব দেন না, ঝাঁপির উপরে রাখা কয়েকটা ইলিশ মাছের দিকে তাকান, একই রকম সাইজ, বড়জোর ৭০০ কিংবা ৮০০ গ্রাম করে হবে এক একটা ইলিশ । দাম কত হবে ফয়েজ মণ্ডল আন্দাজ করতে পারেন না ।কেননা এই প্রথম তিনি পুঁটি মাছ ছেড়ে ইলিশ কিনতে এসেছেন । একটা মাছের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন-
‘আজমল মিয়া, এই মাছটার দাম কত, বল’ ?
‘তুমি যদি লও, ১৭০ টাকা হলেই হবে’
‘১৭০ ? খুব বেশি বলছ আজমল, ১২০ টাকা হলে দাও’
‘না, ফয়েজ মিয়া, এতো কমে হবে না, আর একটু বাড়াতে হবে’
‘কততে পারবা তুমি বল’ ?
‘যাও তোমার জন্য আমি ১৫০ টাকায় রাখবো’
‘আর দশ টাকা কম নিও আজমল মিয়া’
‘না, আর কমে দিতে পারবো না’
‘ঠিক আছে দাও, এই ব্যাগে ভরে দাও’ কালামের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ফয়েজ মণ্ডল ইলিশ মাছটা ব্যাগের মধ্যে রাখতে বলে, আজমল রেখে দেয় । মাছের দাম মিটিয়ে তারা আবার দোকানের দিকে হাঁটতে থাকে । হাঁটতে হাঁটতে মিষ্টির দোকানের সামনে এসে ফয়েজ মণ্ডল দাঁড়িয়ে পড়েন । মিষ্টির বাজারে সবচাইতে নামকরা মিষ্টি বানায় সুধীর ঘোষ । সুধীর ঘোষের মিষ্টির সুনাম এই অঞ্চল ছাড়িয়ে রাজধানী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে । মাঝে মাঝে রাজধানী থেকে অর্ডার আসে, বিশেষ করে সুধীর ঘোষের চমচমের কোন তুলনা হয় না । ফয়েজ মণ্ডল কালামের দিকে তাকিয়ে বলে-
‘কি মিষ্টি খাইবা, বেটা’ ?
কালাম কি বলবে ভেবে পায় না, সুধীর ঘোষের চমচম কবে খেয়েছে মনে করতে পারে না, আসলে কোনদিনই খায়নি, মাঝে মাঝে বড়জোর ঝুরি বা দু’একখান জিলাপী খেয়েছে । কালাম মুখ ফুটে বের করে ফেলে-
‘চমচম’।

ফয়েজ মণ্ডল চমচম শুনে কিছু বলেন না, সুধীর ঘোষকে চারটা চমচম দিতে বলেন একটা পলিথিনে মুড়ে । সুধীর ঘোষ চারটা চমচম পলিথিনের প্যাকেটে মুড়ে ফয়েজ মণ্ডলের হাতে দেয় এবং তাঁর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন । এর আগে কোনদিন ফয়েজ মণ্ডলকে চমচম কিনতে দেখেনি । মিষ্টির প্যাকেট কালামের হাতে দিয়ে বলেন-
‘বাড়ি নিয়ে যাও, সবাইকে নিয়ে খাবা’
কালাম মিষ্টির প্যাকেট হাতে পেয়ে মনে হল যেন চাঁদ হাতে পেয়েছে । তার এক হাতে তখন ইলিশের ব্যাগ, আর এক হাতে মিষ্টির প্যাকেট, সে ভাবতেই পারে না এমন একটা দিনের কথা । সুধীর ঘোষকে মিষ্টির দাম ৩ টাকা বুঝিয়ে দিয়ে দোকানের দিকে হেঁটে যেতে যেতে কালামকে বলেন-
‘তুমি বাড়ি চলে যাও’
কালাম বাড়ির পথ ধরে, তার ভেতর তখন উত্তেজনার শেষ নাই, তাঁর এক হাতে ইলিশের ব্যাগ, আর এক হাতে মিষ্টির প্যাকেট ! অনেক জোরে জোরে পায়ের কদম ফেলতে থাকে কালাম, ফয়েজ মণ্ডল দোকানে গিয়ে আবার বসেন ।

সেই রাতে এই বাড়িতে খুশীর বন্যা বয়ে যায় । মা ফরিদা বেগমের খুশি কেউ দেখতে পায় না কিন্তু সাত ভাইবোনের চোখমুখ যেন খুশিতে টগবগ করে ফুটছে, আজ তারা ইলিশ খাবে, শুধু ইলিশ নয়, মা বলেছে আজ যে মিষ্টির প্যাকেট এসেছে এই বাড়িতে্ খাওয়ার পর সবাইকে এক টুকরো করে চমচমও খেতে দেবে । যে যার লেখাপড়া শেষ করে বসে আছে । কেরোসিনের কুপি জ্বলছে ঘরে ঘরে, বাইরে একটা লম্বা কাঠের টেবিল, সেখানে একটা লণ্ঠন জ্বলে, এই আলোতেই সব ভাইবোন লেখাপড়া করে । রান্নাঘর থেকে মাছ রান্নার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে, ইলিশের গন্ধ যে এমন মন মাতানো, এর আগে কেউ জানে না । এই প্রথম এই বাড়িতে ইলিশ এসেছে । ইলিশের গন্ধে এখন এই বাড়ির প্রতিটি কোণ ম ম করছে । মাঝে মাঝে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখছে কেউ কেউ, বিশেষ করে ছোট দুই ভাই, যাদের বয়স একজনের ছয়, একজনের আট । একজনের নাম রাজু, আর একজনের নাম কাজু । রাজু আর কাজু একসঙ্গে একটা খাটে শোয়, এদের মধ্যে দারুণ মিল, ভাব । ওদের দুজনের যেন দেরি সহ্য হচ্ছে না, মাঝে মাঝেই পড়ার টেবিল ছেড়ে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে আসছে । যত তারা রান্নাঘরের দিকে যায়, ইলিশের ঘ্রাণ তাদের জেঁকে ধরে, তারা পাগল হয়ে ওঠে । ফয়েজ মণ্ডল আজ একটু আগেই বাজার থেকে চলে এসেছেন, তিনিও হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে বসেছেন একটা মোড়ার উপর । এখন বাড়িতে একটা নীরবতা বিরাজ করছে, কিন্তু সবার মনের মধ্যে চলছে তুমুল উত্তেজনা, একটু পরেই তারা ইলিশ দিয়ে ভাত খাবে ।
মা আজ ঘোষণা দিয়েছেন সবাইকে একসঙ্গে খেতে হবে । কিন্তু একসঙ্গে বসার মত এতো বড় জায়গা কই ? টেবিলে বড় জোর ছয়জন ধরবে, আর দুইজন ? তখন মা সিদ্ধান্ত দিলেন আঙিনায় একটা বড় মাদুর পেতে দিতে । তাই হল, একটা বড় মাদুর পেতে দেয়া হল, সব ভাইবোন মাদুর ঘিরে বসে পড়লো, একপাশে বাবা ফয়েজ মণ্ডল । এসে পড়লো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ- মা সব খাবার একে একে মাদুরের একপাশে এসে রাখলেন, সব শেষে আসলো ইলিশের বাটি । সেদিকে সবাই একবার তাকাল, আহ, কি সুন্দর দেখতে ! মা সবাইকে ভাত বেড়ে দিতে শুরু করলেন, প্রথমে শব্জী, তারপর প্রত্যেকের পাতে এক টুকরো করে ইলিশ, সঙ্গে ঝোল । সবাই খেতে শুরু করলে ফয়েজ মণ্ডল বলে উঠলেন-
‘তুমিও আজ আমাদের সঙ্গে বসে যাও, ফরিদা’
ফরিদা বেগম যেন লজ্জা পেলেন, বললেন-
‘পাগল নাকি, তোমরা আগে খেয়ে নাও, আমি পরে খাবো’
‘তোমার জন্য কিন্তু ইলিশের টুকরা রাখতে ভুইল না’
ফরিদা বেগম স্বামীর দিকে তাকান, সামান্য হাসেন,
‘সে চিন্তা তোমাকে করতে হবে না’
সেই রাত যেন এই বাড়িতে একটা উৎসব এসেছিল, পেট পুরে ভাত খেয়েছিল, ইলিশ মাছ খেয়েছিল । আর ইলিশের গন্ধে তারা মনে মনে মাতাল হয়েছিল । খাওয়া শেষ হলে মা যখন প্রত্যেকের পাতে এক টুকরো করে চমচম তুলে দিল, আনন্দ যেন উপচে পড়েছিল, কোন ভাষাই সেই আনন্দকে অনুবাদ করতে সক্ষম নয় ।


প্রথম সেই ইলিশ খাওয়ার স্মৃতি দিনে দিনে ফিকে হয়ে এসেছে এই বাড়িতে । আবার বছর ঘুরে ঘুরে আসতে শুরু করেছে সেই পুঁটি মাছের ঝোল খেয়ে খেয়ে । দুবছর তো হবেই ? আবার তাদের ইলিশ খাওয়ার কথা মনে হয়েছে, কিন্তু ততদিনে ফয়েজ মণ্ডলের আয় কিছুটা কমে এসেছে, মাঝে মাঝেই গ্রামের এক ধনী বিধবা মাজু পিরাইনের কাছ থেকে ধান ধার করে আনেন, সঙ্গে কিছু পরিমাণ সুদ । ফয়েজ মণ্ডল এর মধ্যেই অনেক ঋণী হয়ে পড়েছেন কিন্তু সেটা ছেলেমেয়েদের বুঝতে দেন না । তাদের লেখাপড়া ঠিকমতই চলতে থাকে । এদিকে বছর বছর একটা উপদ্রব তো আছেই- বন্যা । প্রতিবছর বন্যা হয়, কোন বছর কম কোন বছর খুব বেশি । যে বছর বেশি বন্যা হয়, সে বছর মাটির তৈরি বাড়ির দেয়ালের একদিক ধ্বসে পড়ে, বন্যা নেমে গেলে আবার সেই দেয়াল তুলেন ফয়েজ মণ্ডল ।তখন তার অনেক খরচাপাতি হয়ে যায় ।
এবার সেই বন্যা অন্যান্য সব বছরকে ছাপিয়ে গেছে । ইতোমধ্যেই পাগলা নদী রুদ্র রুপ ধারণ করেছে, চারদিক ভাসিয়ে নিতে শুরু করেছে । ফয়েজ মণ্ডলের কপালে বড় ফাটল দেখা দিতে শুরু করেছে । এবার যদি তার পুরো বাড়িটাকেই ধ্বসিয়ে দিয়ে যায়, কি করে তিনি মেরামত করবেন ? পাগলার যে পাশ দিয়ে একটা খাল চলে এসেছে ফয়েজ মণ্ডলের বাড়ির লাগোয়া বিশাল ফসলের মাঠে, সেটা দিয়ে পানি এসে মাঠটিকে প্রায় ডুবিয়ে দিয়েছে এর মধ্যেই । পানি এখন ফসলের কোমর পর্যন্ত, আর কয়েকদিনেই মধ্যেই মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দেবে । গ্রামের কৃষক ব্যস্ত হয়ে পড়েছে খালের মুখে বাঁধ দিতে, আর কয়েকদিন পরেই ফসল পেকে উঠবে । এই কয়দিন যদি পানিকে ঠেকিয়ে না রাখা যায়, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে । ফয়েজ মণ্ডলের কোন জমিজমা নাই, তার এসব চিন্তা নাই, কিন্তু গ্রামের মানুষের কথা চিন্তা করে তিনিও বিষণ্ণ । তাছাড়া জমি জমা না থাকুক তার বাড়িতো আছে, বন্যায় সেটা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তার বিপদ কারো চেয়ে কম হবে না ।

গ্রামের সব মানুষের চেষ্টাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাঁধ উপচিয়ে পানি এসে মাঠকে সয়লাব করে দিল, এখন মাঠের দিকে তাকালে মনে হয় এখানে কোন ফসল ছিল না, ছিল শুধু পানি । যেদিকে তাকানো যায়, পানি আর পানি । রাজু আর কাজু এই পানি দেখে কিন্তু দারুণ শিহরিত । তারা শুনেছে বন্যার পানিতে প্রচুর মাছ আসে, তাদের বাড়ির পাশেই একটা পুকুর, সেই পুকুরেও মাছ আছে, মাঝে মাঝেই তারা ছিপ নিয়ে মাছ মারতে বসে যায় ।রাতে যে পানি ছিল হাঁটু বরাবর, ভোরে উঠে দুই ভাই দেখে সেই পানি গলা পর্যন্ত উঠে গেছে । মাঠ ছাপিয়ে এখন পানি তাদের বাড়ির খুব কাছে চলে এসেছে ।ফয়েজ মণ্ডল পানি ঠেকাবার কোন উপায় খুঁজে পান না । বাজারে যাবার উৎসাহ ঢিলে হয়ে আসে, কিন্তু না গেলেও চলে না । ভোর হতেই তিনি ফজরের নামাজ শেষ করে বাড়ির বাইরে এসে তাকিয়ে দেখেন পানি আর পানি । পুকুরও পানিতে উপচিয়ে পড়া শুরু করেছে । ফয়েজ মণ্ডল প্রমাদ গুণতে শুরু করলেন ।

কিন্তু রাজু আর কাজু পানি দেখে বেজায় খুশি । কতদিন তারা ইলিশ খেতে পায়নি, এবার নিশ্চয় খেতে পাবে । দুভাই সলা করে মাঠে মাছ ধরতে যাবে । কিন্তু কি দিয়ে তারা মাছ ধরবে ? তাদের তো মাছ মারার জাল নাই ? ছিপ দিয়ে কি মাছ মারা যাবে ? কোথায় দাঁড়িয়ে তারা মাছ মারবে, সব জায়গায় তো শুধু পানি আর পানি ।তারা দুভাই খুব চিন্তায় পড়ে যায়- কিভাবে তারা মাছ ধরবে ? যেমন তেমন মাছ নয়, তারা ইলিশ মাছ ধরবে । খুব চিন্তা করে ছোট ভাই রাজু একটা বুদ্ধি বের করে-
‘কাজু, শুন, মায়ের একটা পুরানা শাড়ি আছে, সে শাড়ি দিয়ে মাছ ধরবো’
কাজু হাসে,
‘শাড়ি দিয়ে কি মাছ মারা যায় বোকা’ ?
‘যাবে না কেন ? জাল দিয়ে যদি মাছ মারা যায়, তাহলে শাড়ি দিয়ে কেন যাবে না’ ?
‘তা ঠিক বলেছিস। কিন্তু শাড়ি আনবি কিভাবে’ ?
‘তুই দাঁড়া, আমি নিয়ে আসছি’ বলেই রাজু এক দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে গেল । কয়েক মিনিট পরে ঠিকই সে মায়ের পুরানা কাপড় নিয়ে এসে হাজির । এখন খুব ভোর, মা টের পায়নি । মা এখন রান্না ঘরে ঢুকে রান্না করছে, দেখতে পায়নি ।

দুই ভাই মায়ের পুরানা শাড়ি নিয়ে মাঠের দিকে দৌড় দেয়, যেখানে পানি বেশি । মাঠ আর বাড়ির মধ্যে কোন দূরত্ব নাই, তবে মাঠের মাঝখান সামান্য নীচু, সেখানে পানি অনেক বেশি । তারা সেইদিকে দৌড়াতে শুরু করে । মাঠের দিকে যেতেই তাদের চোখে পড়ে গ্রামের সব মানুষ যেন এখানে এসে জড় হয়েছে । দূরে তাকিয়ে তারা দেখতে পায় বাঁধ ঠিক করার জন্য কোদাল নিয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করছে । কিন্তু কোনমতেই পানির স্রোত বন্ধ করতে পারছে না, বাঁধ উপচিয়ে পানি তীব্র বেগে ছুটে আসছে মাঠে । যত সময় যাচ্ছে ফসল পানির তলায় তলিয়ে যাচ্ছে । একটা হাহাকার যেন সারা মাঠকে ঘিরে ফেলেছে । এরি মধ্যে কেউ কেউ আবার বড় জাল নিয়ে নেমে পড়েছে মাছ ধরার জন্য । রাজু আর কাজুও নেমে শুরু করে শাড়ি দিয়ে মাছ মারার কাজ । দুইভাই দুদিকে শাড়ি ধরে টানতে থাকে । বেশ কিছুদুর টেনে নিয়ে যায়, তারপর উপরে উঠিয়ে দেখে কোন মাছ ধরা পড়েছে কি না । না কোন মাছ ধরা পড়ে নাই । তারা আবার শাড়ি টানতে থাকে, আবার দেখে, না এবারও কোন মাছ শাড়ির জালে উঠে আসে নাই । মাছ উঠে নাই বলে তারা মন খারাপ করে না, তারা ভাবে মাছ উঠবেই ।এদিকে বেলা বেড়ে উঠতে থাকে । সূর্য অনেকটা উপরে উঠে এসেছে ।
হঠাৎ রাজুর খেয়াল হয় স্কুলের বেলা হয়ে গেছে, স্কুলে যেতে হবে-
‘এই কাজু স্কুল যাবি না’ ?
কাজু চট করে জবাব দেয় না, একটু ভাবে, বলে-
‘না, যাবো না, দেখবি আজ কেউ স্কুলে আসতে পারবে না’
‘হ্যা, তুই ঠিকই বলেছিস, স্কুল যাওয়ার সব রাস্তা তো বন্ধ হয়ে গেছে’
‘চল মাছ মারি’
‘চল’
আবার দুভাই শাড়ির দুদিক ধরে টানতে থাকে । তাদের আশেপাশেই কেউ কেউ ধান কাটতে শুরু করে দিয়েছে যদিও ধান এখনো সম্পূর্ণ পেকে উঠেনি । তাদের একটাই চেষ্টা যদি কিছু ধান বাঁচাতে পারে ! রাজুর এইসময় ক্ষুধা লাগে, পেট মোচড় দিয়ে ওঠে । এইসময় তারা নাস্তা খেয়ে রোজ স্কুলে চলে যায় ।
‘খুব ক্ষুধা লেগেছে, কাজু’
‘আমারও তো’
‘বাড়ি যাবি’ ?
‘আরে না, বাড়ি গেলে তুই মাছ মারবি কিভাবে ? মা তো আর আসতে দেবে না’
‘তাহলে’ ?
‘একটু কষ্ট কর, আর একটু দেখি’
রাজু ‘ঠিক আছে’ বলে শাড়ি টানা শুরু করে । তাদের একটাই লক্ষ্য- ইলিশ । একটা ইলিশ মাছ পেলেই তারা মাছ মারা ছেড়ে দিয়ে বাড়ির দিকে দৌড় দেবে । কিন্তু সেই মাছের দেখা নাই । সময় বয়ে যায়, সূর্য আরও উপরে উঠে এসেছে, গনগণে রোদ, ক্ষুধাও বেড়ে চলেছে । ইতোমধ্যে দুভায়ের মুখ শুকিয়ে এসেছে, পানিতে বোঝা যাচ্ছে না । তারা লক্ষ্য করে বানের পানি ক্রমাগত বাড়ছে । সকালে যতটুকু পানি ছিল এখন তার চাইতে অনেক বেড়ে গেছে । যত পানি বাড়তে থাকে তারা পিছাতে থাকে । ক্রমে তারা বাড়ির দিকে আসতে থাকে । দুভায়ের শাড়ি ধরে টানার বিরাম নাই, পানি বাড়ারও বিরাম নাই, যেন দুদিক থেকে একটা অসম যুদ্ধ চলছে । সেই যুদ্ধে রাজু কাজুর জিততেই হবে ।

এখন তারা বাড়ির খুব কাছাকাছি চলে এসেছে, না এসে উপায় নাই, পানি তাদের এখন গলা বরাবর । এখনো কোন মাছ তাদের শাড়িতে আটকায়নি । একবার কয়েকটা ছোট ছোট চিংড়ি মাছ ধরা পড়েছিল, তাদের লাফানি দেখে দুভাই খুব খুশি, কিন্তু তারা তো ইলিশ ছাড়া কোন মাছ ধরবে না । বাড়ির কাছাকাছি আস্তেই তারা লক্ষ্য করে ইতোমধ্যে পুকুর পানিতে ছাপিয়ে বাড়ির দেয়াল বরাবর চলে এসেছে । তারা শেষবারের মত শাড়ির টান দেয়, মাছ উঠে আসে, বেশ কয়েকটা মাছ শাড়িতে ধরা পড়ে । কিন্তু সেই মাছ ইলিশ নয়, কয়কেটা ছোট ছোট পুঁটি মাছ ।




No comments:

Post a Comment