Wednesday, May 8

সুজয় চক্রবর্তীর অণুগল্প




একাল সেকাল


সামান্য কথা কাটাকাটি থেকে রাগের পারদ যে এতটা চড়ে যাবে, বোঝেনি কেউ-ই ; না নীলাঞ্জন , না অনিতা ।
সকালে বাজারে যাওয়ার সময় অনিতা বারবার করে বলে দিলো, ‘ আজ কিন্তু মাছ এনো না। আমার শরীরটা খারাপ ।‘

বাজারে গিয়ে তা একেবারে ভুলে গিয়েছিলো নীলাঞ্জন । সবজি বাজারের শেষে এক কেজি দেড়শো গ্রামের একটা কাতলা নিয়েই ঘরে ঢুকলো সে ।

রাগে গজগজ করতে করতে মাছ কাটতে বসলো অনিতা ।

আজ রবিবার । অফিস ছুটি ।

দুপুরে খাওয়ার টেবিলে অনিতা কেবল নীলাঞ্জনের জন্যই ভাত বাড়লো । “শরীর খারাপ । খেতে ইচ্ছে করছে না ‘ বলে অনিতা যেই বাটিতে মাছের মুড়োটা রাখতে যাবে, অমনি নীলাঞ্জন বলে উঠলো, ‘ আমি ভাত খাবো না । খিদে নেই ।‘

এরপর উত্তর-প্রত্যুত্তর, অনুনয়-বিনয় চললো কিছুক্ষণ । রাগের পারদ চললো নীলাঞ্জনের। এক সময় সে ভাতের হাঁড়িটা ধরে আছাড় মারলো মেঝেতে ! সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়লো ভাত ! ডুকড়ে কেঁদে উঠলো অনিতা । স্তম্ভিত নীলাঞ্জনও ! এতটা করা ঠিক হয়নি । একটু মানিয়ে নিলেই তো ...।

হঠাৎ দেওয়ালে টানানো মায়ের ছবিটার দিকে চোখ গেলো নীলাঞ্জনের । কেঁদে ফেললো ।

একটা সময় পাশের বাড়ি থেকে পান্তা চেয়ে এনে মা খাইয়েছে তাদের দুই ভাইবোনকে । আর আজ একটা সরকারি চাকরি পেয়েই .........!

মায়ের হাসি হাসি মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে এখন । চেয়ারে বসেই মাথাটা নিচু করে ফেললো নীলাঞ্জন।


গোপা মুখোপাধ্যায়ের গল্প






সম্পর্ক
গোপা মুখোপাধ্যায়

স্কুল থেকে ফিরে ইচ্ছা খেতে বসে আবার সেই একই প্রশ্ন করবে মাকে। একথা ভাবতে ভাবতে সেই দুপুর থেকে অপর্ণা কেমন যেন আনমনা হয়ে যাচ্ছে। আজ কটা দিন মেয়েটার মুখে ঐ একটাই কথা, যার উত্তরদেবার মতো সৎ সাহস এবং যুক্তি কোনটাই অপর্ণার নেই। যথারীতি স্কুল ছুটি হবার পর ঠিক বিকেল পাঁচটায় ইচ্ছা বাড়ি ফিরলো। সাইকেলটা ঠিক করে রেখে ইচ্ছা মাকে ডাক দিয়ে বলল, “মা তাড়াতাড়ি খেতে দাও,খুব ক্ষিদে পেয়েছে।’’
অপর্ণা ও খুশী মনে বলে আয়,“তোর জন্যই বসে আছি।’’
এই বলে ইচ্ছাকে খেতে দেবার জন্য রান্নাঘরে গেল। কিন্তু মনের মধ্যে সেই এক ভয় ওকে তাড়া করে যাচ্ছে। খেতে খেতে ইচ্ছা কতো কথাই না বলল মাকে।কিন্তু একবার ও মায়ের ভয়ের প্রশ্নটা করলো না। তাই অপর্ণা মনে একটা বেশ স্বস্তি পেল।মেয়ের খাওয়া শেষ হলে ওর বাসনপত্র নামিয়ে টেবিল পরিষ্কার করে নিল।

এবাড়িতে অপর্ণা আর ইচ্ছা ছাড়া আরো দুটো প্রাণী থাকে।একজন অপর্ণার কাকু আখিলেশ বাবু, যিনি প্যারালাইসিসে পঙ্গু আর কুকুর টমি। এই টমি ইচ্ছার সুখ দুখের সাথী। প্রতিদিনের মতো আজ ও অপর্ণা আখিলেশবাবুর জামাকাপড় পাল্টে বিকেলে চা দিয়ে খবরের কাগজ পড়ে শোনালেন।

বসন্তের সন্ধ্যা।অপর্ণা ঘরের একচিলতে উঠোনে কতোই না গাছ। ছোটো ছোটো ফুলগাছ,দরজায় মালতীলতা ঝাঁকে ঝাঁকে ফুটে আছে। তুলসীমঞ্চের পাশে একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছে অজস্র ফুল। আর তার গন্ধে সারা ঘর মো মো করছে। এর ছায়াতে সারাদিন টমি বসে থাকে আর এ বাড়ীটা লক্ষ্য রাখে। দরজার বাইরে ছোট্ট আমগাছটাতে অনেক বকুল এসেছে, ভাল আম হবে এবার। সব গাছে রোজ অপর্ণা নিজে হাতে জল দেয়।আর তুলসীমঞ্চের ধারে একটা বালতিতে জল রাখে,যাতে তৃষ্ণার্ত পাখপাখালি জলপান করতে পারে।

সারাদিন বাড়ীটায় শূন্যতা ভর করে থাকে। অপর্ণার স্কুল এখান থেকে পনের কিলোমিটার দূর তাই বাসে যেতে হয়,আধঘণ্টা লাগে। আর ইচ্ছার স্কুল সাইকেলে মিনিট পনের। পরানপুর গ্রামে কোনো হাইস্কুল নেই। সন্ধ্যেবেলায় রান্না শেষ করে অপর্ণা কাকুকে খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে মেয়ের পাশে এসে বসে। ইচ্ছা পড়ছে, তাই ওর দিকে নজর দিতে হয়। হঠাৎ মেয়ে বাঁকা চোখে অপর্ণার দিকে তাকায়। মেয়ের দৃষ্টির ধার মা বেশ বুঝতে পারে তাই একটু অপ্রস্তুত হয়েই বলে ওঠেন,
“কি পড়ছিস? বায়োলজি?”
“হ্যাঁ,কেন?”
“না মানে এমনি বললাম। বলছি ইংরাজী বাংলাগুলোর দিকেও নজর দিবি। ওগুলোতে ও যে ভালো নম্বর তুলতে হবে।’’
“মা,আমার প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু তুমি দাও নি।’’
অপর্ণা এড়িয়ে যাবার জন্য বলে, “কাকুকে ওষুধটা দিয়ে আসি”। এই বলে অপর্ণা উঠে যায়। কোথায় যেন একটা দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে মা মেয়ের মধ্যে তা অপর্ণা বেশ বুঝতে পারছে। ইচ্ছা ও আজকালকার মেয়ে। কোনো কথা শে ভোলার পাত্রী নয়। তার উপর যথেষ্ট বুদ্ধিমতী এবং একাদশ শ্রেণী সায়েন্সের ছাত্রী। তাই হয়তো ম্যাচুরিটি ও একটু বেশিই।

অপর্ণা এসে আখিলেশবাবুর খাটের পাশে বসে। আর ঐ অসহায় মানুষটার দিকে তাকায়। মনে পড়ে যায় সব কথা। আজ থেকে প্রায় পনের বছর আগেকার ঘটনা। অপর্ণা তখন তারকেশ্বরের প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করত,তাই ওখানেই থাকতো। একদিন ঐ ষ্টেশনেই এই অখিলেশবাবুকে দেখতে পান অপর্ণা। সেদিনের কথা মনে করে দুচোখে জলের ধারা নেমে আসে ওর। আখিলেশবাবুর চোখে তা ধরা পড়ে যায়। বৃদ্ধের শীর্ন হাত আপ্রাণ চেষ্টা করে অ ব্যর্থ হয় অপর্ণার চোখের জল মুছিয়ে দিতে।
মাথার উপর ফ্যানটা বনবন করে ঘুরছে। আর শয্যাশায়ী অখিলেশবাবুর মনের মধ্যে স্মৃতিগুলো ও যেন সেই তালে বারবার ঘুরে ফিরে আসছে। সেই শ্রাবন মাসের সকাল,সদ্য তাঁর মমতাময়ী স্ত্রী মারা গেছেন।হঠাৎ অখিলেশবাবু জানতে পারলেন তাঁর ডির্ভোসি মেয়ে মানসী নিজের কন্যা সন্তানকে ফেলে নতুন করে অন্যের সাথে ঘার বাঁধার জন্য রেজিষ্ট্রি করে ফেলেছে। এই বেদানাদায়ক ঘটনায় ওঁর মন ভেঙে পড়ে। তখন তাঁর নিজের বাঁচার ইচ্ছেটুকু ও নিঃশেষ হয়ে যায়। তাই মানসীর রেখে যাওয়া কন্যা অর্থাৎ নাতনীর মায়ায় জড়াতে না চেয়ে পরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়েন। সেদিন কাঁধে ছিল সেই পুরনো ছিটের ব্যাগ আর হাতে চিরসঙ্গী কালো ছাতা মাথায় নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন অখিলেশবাবু। তারকেশ্বর ষ্টেশনে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে ভেবে পাচ্ছিলেন না কোথায় যাবেন। এমন সময় পিছন থেকে এক পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে তাকিয়ে দেখেন মেয়ের ছেলেবেলার বান্ধবী অপর্ণা। সেই মিষ্টি স্বভাবের একগুঁয়ে মেয়েটা। যে ছোটবেলায় বাবা মাকে হারিয়ে মামাবাড়িতে মানুষ।
অপর্ণা কাকাবাবুকে নিজের বাসায় নিয়ে তুললো সেদিন। রাতে অখিলেশবাবুর মুখে সব শুনে অপর্ণা তাঁকে আর বাড়ী ফিরে যেতে দেন নি। নিজেই যোগাযোগ করে মানসীর খোঁজখবর নেয়। মানসীর পথের কাঁটা ওর এক বছরের মেয়েকে নিজে সরকারীভাবে দত্তক নেবার সিধান্ত নেয়,তাতে অখিলেশবাবুর ও সম্মতি ছিল। অপর্ণা একবার ও নিজের সংসার পাতার কথা ভাবতেই পারেন না। তাঁর জীবনেও যে আছে এক দুঃখময় স্মৃতি। ভালোবাসায় চরম আঘাত পাওয়ার পর থেকে সে একাকিনী।

আজ রবিবার। সকালথেকেই আকাশটা বেশ গুম হয়ে আছে। কোথাও কোথাও কালো মেঘের ঘনঘটা। অপর্ণা তাড়াতাড়ি স্নান সেরে বাজারে যায়। ইচ্ছা গলদা চিংড়ি খেতে খুব ভালোবাসে আর কাকাবাবু মোচার ঘন্ট। তাই নিজে বাজার থেকে টাটকা এসব এনে রান্না করবে বলে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যায়।
পরানপুরের বাজারটা বেশ বড়। ওদের বাড়ী থেকে বেরিয়ে সোজা বড়রাস্তার মোড়। সেখান থেকে ডান দিকে বেঁকে চওড়া সিমেন্টের রাস্তার শেষ মাথায় দুপাশে বট আর অশ্বথ গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে,আর এখানেই রোজ হাট বসে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় অপর্ণা। একটা অতি পরিচিত গন্ধ নাকে আসে। বাঁদিকে চোখ যেতেই দেখে ইচ্ছা সারা মুখ ওড়না দিয়ে ঢেকে একটি ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। ছেলেটি ও অপর্ণার চেনা। ওদের সামনে না গিয়ে অন্য দিকে গিয়ে বাজার করে অপর্ণা বাড়ী ফিরে আসে। রান্না সেরে দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে অপর্ণা অখিলেশবাবুর পাশে এসে বসে। কাকাবাবু তাঁর চোখের তারা দুটো নাড়িয়ে কিছু জানতে চায়। অপর্ণা জানায় তাঁর মনটা ভালো নেই। আবার কাকাবাবু চোখের তারা দুটো নেড়ে জিগ্যেস করেন,কি হয়েছে? এবার অপর্ণা কান্নায় ভেঙে পড়ে। ইচ্ছার সব কথা জানায় কাকাবাবুকে।

ঘড়ির কাঁটা তিনটের ঘরে। পশ্চিমের আকাশটা কালো মেঘে ছেয়ে আছে, যেন এক্ষুনি ঝড় উঠে সব তছনছ করে দেবে। তাই সবাই যে যার জানালা দরজা বন্ধ করতে ব্যাস্ত। যাতে তার সাজানো গোছানো ঘর ঝড়ে তছনছ না হয়ে যায়। অপর্ণার ঘরেও তার ব্যাতিক্রম নেই। ওদিকে টমি চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। আর ইচ্ছা একা জানালা খুলে কালো মেঘের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। ঘরে অপর্ণা ঢুকতেই ইচ্ছা প্রশ্নটা মায়ের দিকে ছুঁড়ে দিল। বলল, “আমার বাবা কে?”
অপর্ণা আচমকা এই প্রশ্নে হকচকিয়ে যায়। বলেন,“কি বলছিস তুই?’’
“বলছি,আমার বাবা কে?”
“আমিই তোর বাবা। তুই শোন মা,আমার কথা শোন।’’
“না,এক্ষুনি বলো কে আমার বাবা?
       
অপর্ণা গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। বিনা ঝড়েই যেন ওর সাজানো গোছানো ঘর মুহূর্তে তছনছ হয়ে যাবে। এই ভেবে ছুটে আসে ইচ্ছার কাছে। পরম স্নেহে ইচ্ছাকে বুকে টেনে নিতে চায়। ইচ্ছা চিৎকার করে বলে উঠে,“না..., আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও,” এই বলে সে এক ঝটকায় অপর্ণাকে ছিটকে মেঝেতে ফেলে দেয়। নিজের অজান্তে ‘ইন্দ্রনীল’ নামটা বেরিয়ে আসে অপর্ণার মুখ থেকে। মেঝেতে পড়ে থাকে অপর্ণা।টমি আরো জোরে চিৎকার করে। ইচ্ছা মায়ের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করে,সে এখন কোথায়? ঘরের এককোণে রাখা শোকেসের দিকে আঙ্গুল বাড়ায় অপর্ণা,ভালো করে ইচ্ছা দেখে শোকেসের একদম ভিতরের দিকে রাখা এক সুপুরুষের ছবি। তা বের করে অপর্ণাকে দেখায় ইচ্ছা। অপর্ণা ও ঘাড় নাড়ে। ধীরে ধীরে অপর্ণা উঠে বসে। ইচ্ছাকে জানায় তার নিজের মা আসলে মানসী আর বাবা ইন্দ্রনীল। ধীরে ধীরে বিস্তারিতভাবে জানায় ওর ফেলে আসা জীবনের গল্প। অপলক দৃষ্টিতে ইচ্ছা দেখে অপর্ণাকে। একটা অপরাধবোধ গ্রাস করে ওকে। তাও জিগ্যেস করে অখিলেশবাবুর সম্পর্কে। অপর্ণা কিচ্ছু লুকায় না। ইচ্ছাকে জানিয়ে দেয় যে,‘ঐ মানুষটিই ওর নিজের দাদু।’ আর হারাবার ভয় হয় না অপর্ণার। ভাবে, ‘যে সর্বহারা তার আবার হারানোর ভয় কি?’ এবার সে মুখ তুলে আকাশের কালো মেঘের দিকে তাকায়,মনে করে মা যশোদার কথা। নিজের একাকীত্বের বোঝা বয়ে চলার কথাও মনে হয়।
মুহূর্তে ইচ্ছার জীবন অঙ্কের সমীকরণটা বদলে যায়। সে অনুভব করে সম্পর্কের টাণাপোড়েন। বুদ্ধিমতী ইচ্ছার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, ‘ওঘরের বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটার কাছে ওর  রক্তঋণ আর স্নেহময়ী পালিতা মা অপর্ণার কাছে ওর হৃদয়ের আত্মীয়তা। দুটোই আজ তার সমান প্রয়োজন। সে এসে জড়িয়ে ধরে এসে অপর্ণাকে। কাঁদতে কাঁদতে কাতর স্বরে বলে উঠে,“মা তুমি একা নও,এই তো আমি আছি।’’
অপর্ণা দুহাত দিয়ে বুকে চেপে ধরে ইচ্ছাকে। সে যেন কিছুতেই আর ওর বুক থেকে সরে না যায়। বাইরে তখন আঝোরে বৃষ্টি। নরম মাটির নির্মল সোঁদা গন্ধে ভরপুর পরানপুরের সন্ধ্যে। অপর্ণার বুকে ও এক পরম তৃপ্তিময় আর্দ্রতা।