Tuesday, April 30

সৌরভকুমার ভূঞ্যার গল্প







মুক্তি

পূবের আকাশে সূর্যটা সবে উঠব উঠব করছে। সহসা করুণ কান্না আর হাহাকারের শব্দে ভেঙে খানখান হয়ে যায় সকালের নীরবতা। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে একটা ভয়ভয় ভাব। পাড়ার পুরুষ-মহিলারা যে যার প্রাত্যহিক কাজকর্ম সারছিল। অকস্মাৎ কান্নার শব্দে স্বাভাবিক জীবন-ছন্দ থমকে যায়। এ-তো যেমন তেমন কান্না নয়। এই কান্নার সঙ্গে জুড়ে আছে মৃত্যুর গন্ধ। আশেপাশের প্রায় সকলে এসে হাজির হয় পরিমলের বাড়িতে। কান্নার কারণটা জানতে পেরে সকলেই স্তম্ভিত হয়ে যায়। ভয় আর উত্তেজনার একটা অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায় শরীরের শিরায় শিরায়। একে মৃত্যু, তাও আবার আত্মহত্যা...পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে হয়ে যায়। একটা গা-ছমছম অনুভূতি জড়িয়ে থাকে ভোরের বাতাসকে।
গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে পরিমলের মা বিজয়া। রোজকার মতো তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিল বিজয়া। শরীর ভালো নেই বলে রাতে খাওয়া-দাওয়া করেনি। প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই তার ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। কিন্তু আজ সকাল হয়ে যাওয়ার পরও যখন তার ঘুম ভাঙে না তখন পরিমলের বউ কাবেরী বাইরে থেকে বেশ কয়েকবার ডাক দেয়। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পায় না। দরজায় ধাক্কাধাক্কি করেও যখন কোনো সাড়া আসে না তখন এক অজানা ভয়ে তার বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। তার ডাকে পরিমল ছুটে আসে। তার বুঝতে বাকি থাকে না খারাপ কিছু ঘটেছে। দরজা ভেঙে ঘরের মধ্যে ঢুকতেই সারা শরীরে শীতল শিহরণ বয়ে যায়। দেখে কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে মায়ের নিথর শরীর।
ষাট ছুইঁছুঁই বিজয়া একে বিধবা, তার ওপর দীর্ঘ্যদিন ধরে অসুখে ভুগছিল। সুতরাং ছেলে-বউমার সংসারে অনেকটা পরগাছার মতো বেঁচে থাকা। কোনো কারণে মনোমালিন্য হওয়ায় এমন ভয়ংকর পথ বেছে নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে এমন একটা ধারনা সবার মধ্যে জেগে ওঠার কথা এবং এর জন্য পরিমল বা কাবেরী কিংবা দুজনেই অভিযুক্ত হিসেবে আলোচিত হওয়ার কথা। কিন্তু তা হল না। বরং মনে হল উপস্থিত মানুষের মধ্যে যেন একটা স্বস্তি ভাব। এমনটা হয়ে যেন ভালোই হয়েছে। মৃত্যু নয়, তাদের মনে হল এ-আসলে মুক্তি। যদিও আত্মহত্যার ব্যাপারটা কেউ কেউ সমর্থন করতে পারে না তবুও তেমন করে সমালোচনার ঝড় বইল না। উল্টে পরিমলদের ওপর বর্ষিত হল মানুষের সমবেদনা। মোড়ল দীননাথ ভেঙে পড়া পরিমলের মাথায় হাত রেখে বলে, ‘কষ্ট পেয়ো না। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। বেচারি শান্তি পেয়েছে।’
চোখ তুলে তাকায় পরিমল। ঘোলাটে দু-চোখ যন্ত্রণার ছবি স্পষ্ট কিন্তু মুখে কোনো শব্দ নেই।
‘মনকে শান্ত করো। ওর যাওয়াটাই তো ভবিতব্য ছিল।’
‘তাই বলে এভাবে...!’
‘বেচারি আর কোনো পথ পায়নি। খুব ভালোবাসত তোকে। মরে সেটা আরও একবার প্রমাণ করে গেল।’
চকিতে মুখ তুলে দীননাথের দিকে তাকায় পরিমল। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা তাকে দগ্ধ করতে থাকে। ভালোবাসা শব্দটি যে কতখানি যন্ত্রণাদায়ক তা বুঝতে পারে।
সময় গড়ায়। ভীড় বাড়তে থাকে। নানাবিধ কথাবার্তা ভেসে থাকে বাতাসে। যে কথাবার্তার অধিকাংশটা জুড়ে থাকে বিজয়ার আত্মত্যাগ আর ভালোবাসার কথা। একটি মহিলা কত গভীরভাবেই না ভালোবাসত সংসারটাকে। আত্মহত্যা ব্যাপারটা একটা অপরাধ। কিন্তু এই অপরাধের তত্ত্বটি বুদবুদের মতো হারিয়ে যায় তার আত্মত্যাগের মহত্বে। আর এ-সবের পেছনে বড়ো ভুমিকা বিন্দুবালার। কেননা বিজয়ার আত্মহত্যার কারণটা সেই কেবল জানত। বিক্ষিপ্তভাবে সে-কথাই শোনাচ্ছিল একে-ওকে।
একটু বেলা হতে পুলিশ আসে। বিজয়া যতই মহত্বের কাজ করুক না কেন, আইনকে তার পথে চলতে হবে। তাই সকল অনুরোধ-উপরোধ সরিয়ে একটা লাশ হয়ে তাকি পাড়ি দিতে হয় মর্গের পথে।

২.
বিন্দুবালা গ্রামের সবথেকে বয়স্কা মহিলা। মাঝবয়সিদের কাছে বিন্দুমাসি। পাড়ার প্রায় সব ঘরে তার যাতায়াত। অনেকে তাকে খুব ভালোবাসে, খাতির করে। অনেক বাড়ির অনেক খবর সে জানে। দোষের মধ্যে একটাই সে ছিল পেট পাতলা স্বভাবের। কোনো কথা গোপন রাখতে পারে না। এ-কারণে অনেকে তাকে অপছন্দও করত।
সকাল গড়িয়ে এখন দুপুর। একটা মৃত্যু পারিপার্শ্বিক শোক আনে ঠিকই কিন্তু তার জন্য আশপাশের রোজকার স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায় না। তাই সকলের উত্তেজনা একটু একটু করে থিতিয়ে গেল অনেকটাই। কিন্তু দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর পাড়ার মহিলাদের হাতে যখন কিছুটা অলস অবসর তখন আবারও আলোচনায় উঠে এল বিজয়া। সেটাও বিন্দুবালার মাধ্যমে।
বিজয়ার আত্মহত্যার কারণটা সকালেই বিক্ষিপ্তভাবে বলেছিল বিন্দুবালা। কিন্তু সকালে পরিবেশটা এমন গা-ছমছমে ছিল যে নিজের কথাগুলো ঠিকঠাক বলতে পারেনি। অনেকে আবার তার কথা ঠিকঠাক শুনতে পায়নি। কৌতূহল থাকলেও এই নিয়ে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ হয়নি। হাজার হোক, একটা মহিলা গলায় দড়ি দিয়েছে। এখন হাতে অনেকটা সময়। শোকের পরিবেশও তেমন আর নেই। সবাই বিন্দুবালাকে ঘিরে ধরেছে। বিজয়ার ত্যাগ আর মহত্বের কথা শুনতে সকলেই বেশ আগ্রহী।

৩.
দীর্ঘ্যদিন ধরে মরণ রোগে আক্রান্ত ছিল বিজয়া। প্রথমটা কম ছিল। চিকিৎসা চলছিল। বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করার সামর্থ নেই পরিমলের। তবুও সাধ্যমতো চেষ্টার কসুর করেনি সে। একটি কোম্পানিতে শ্রমিকের কাজ করে সে। যা উপার্জন হয় তাতে সংসারটা হেসেখেলে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। বিজয়ার রোগের পেছনে প্রতি মাসেই অনেকগুলো করে টাকা খরচ হয়। কম বয়সে বাবাকে হারিয়েছে পরিমল। মাকে আঁকড়ে তার বড়ো হয়ে ওঠা। বড়ো হওয়ার পরও অনেকটাই আঁকড়ে ছিল মাকে। সাধ্যমতো চেষ্টা করে মায়ের চিকিৎসার। কিন্তু রোগের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার অবস্থাও আয়ত্বের বাইরে চলে যেতে থাকে। প্রথমে টুকটাক ধার। তাতে কাজ হয় না। বিঘে তিনেক জমি ছিল। তার মধ্যে নিজের কেনা দেড় বিঘে জমিটা প্রায় জলের দরে বিক্রি করে দেয়। সে জানত এ-রোগ সারবে না। তবে ডাক্তাররা আশ্বাস দিয়েছিল অবস্থা যা, তাতে চিকিৎসা করালে আরও কয়েক বছর বাঁচবে। চেষ্টা করেছিল মায়ের চোখের আলো যতদিন বাঁচিয়ে রাখা যায়। বিজয়া লড়ছিল রোগের সঙ্গে আর পরিমল নিজের সঙ্গে। দুজনের যুদ্ধটাই ছিল অসম। বিজয়া বেঁচে রইল ঠিকই কিন্তু রোগ তার শরীরে ডালপালা বিস্তার করতে থাকে। পরিমলের দেনাও মায়ের রোগের পথ অনুসরণ করে। তবুও হার-না-মানসিকতায় লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছিল।
কয়েকদিন আগে বিজয়ার অসুস্থতা হঠাৎ বেড়ে যায়। গোটা শরীরে ভয়ংকর যন্ত্রণা। মাকে ডাক্তার দেখায় পরিমল। ডাক্তার জানায় এখন পরিস্থিতি যা তাতে চিকিৎসার জন্য তাড়াতাড়ি লাখ তিনেক টাকা লাগবে। পরিমল ভেবে পাচ্ছিল না কোথা থেকে আসবে এতগুলো টাকা। নতুন করে ধার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। থাকার মধ্যে বাবার রেখে যাওয়া জমিটুকু। তা বেচলেও এতগুলো টাকা আসবে কিনা সন্দেহ। যদি আসেও, তারপর?
তারপর কি জানা ছিল না পরিমলের। এদিকে সংসারের অন্দরমহলেও বিদ্রোহের সূচনা হয়েছে। ঘরে বাইরে যুদ্ধ। অসহায়ত্ব আর যন্ত্রণার অক্টোপাশে ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছিল সে। বিধ্বস্ত পরিমল যখন জমিটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না, তখন যেন মুশকিল আসান হয়ে হাজির হয় বিজয়া।
‘তুই কি জমিটা বিক্রি করার কথা ভাবছিস?’
দ্বিধাগ্রস্ত পরিমল হ্যাঁ-না কি বলবে ভেবে না পেয়ে অদ্ভুত চোখে চেয়ে থাকে মায়ের দিকে। তার জবাবের অপেক্ষায় না থেকে বিজয়া বলে চলে, ‘ওটা তোর বাবার অনেক কষ্টের ওই জায়গা। ও আমি বেচতে দেব না।’
‘তাহলে তোমার চিকিৎসা হবে কী করে?’ পরিমলের গলার সুর মিনমিনে।
‘আমি আর চিকিৎসা করাব না।’
‘তা হয় নাকি!’ বলল বটে কথাটা কিন্তু তাতে যেন উত্তাপের অভাব।
‘বললাম তো, আমার যা হয় হোক, ওই জমি তুই বেচবি না।’
মা-ছেলের কথাবার্তা আরও কিছুটা সময় চলে। যন্ত্রণাদগ্ধ মায়ের জেদি মুখের দিকে তাকিয়ে পরিমলের মনে একটা খটকা জেগে ওঠে। ভাবে মা কি তবে কিছু আভাষ পেয়েছে?’
সত্যি বলতে জমি বিক্রি করায় বাধাটা কেবল মায়ের কাছ থেকে আসেনি। তারও আগে এসেছিল স্ত্রী কাবেরীর কাছ থেকে। এত দেনার পর একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাওয়াটা সে মানতে পারে না। বিজয়া যেমন মা, সেও একজন মা। নিজের দুই ছেলেমেয়ের কথা ভাবার মধ্যে সে কোনো অপরাধ দেখেনি। সব হারিয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে পথে নামার পক্ষে সায় ছিল না তার। কিন্তু পরিমল তার কথা মানতে চায়নি। স্বামী-স্ত্রীতে তীব্র কথা কাটাকাটি হয়। সংসারের আদালতে কঠিন রায় শুনিয়ে দেয় কাবেরী। বিধ্বস্ত পরিমল গৃহযুদ্ধ মোকাবিলার কোনো পথ খুঁজে পায় না। নিদারুন অসহায়ত্ব তিন প্রজন্মের বেঁচে থাকার অধিকারে প্রশ্নচিহ্ন তুলে দেয়। পিতা-পুত্র-স্বামী, ত্রিমুখী দাবির মাঝে নিজের কর্তব্য গুলিয়ে যায় পরিমলের। জীবনের আলো-অন্ধকারের মাঝে ঈশ্বর আর শয়তানের নীরব যুদ্ধে প্রতিনিয়তই বিধ্বস্ত হতে থাকে সে।
এখন মায়ের কথা শুনে তার ভাবনাচিন্তাগুলো তাগগোল পাকিয়ে যায়।

৪.
গতকাল বিন্দুবালা গিয়েছিল বিজয়ার বাড়ি। বিন্দুবালাকে দেখে খুব খুশি হয়েছিল বিজয়া। তার সঙ্গে নিজের জীবনের অনেক সুখ-দুঃখের কথা ভাগ করত সে। এই দুঃসময়ে বিন্দুবালাকে পেয়ে তার মনের সমস্ত আগল যেন খুলে যায়।
‘আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না দিদি।’
‘একথা বলিস না।’
‘সারা শরীরে ভীষণ যন্ত্রণা। আর সহ্য করতে পারছি না।‘
‘সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘না দিদি, তা আর হবে না। এ-শরীর আর সারবে না। আর কি জানো দিদি, শরীরের যন্ত্রণা তবু সহ্য করা যায়, কিন্তু মনের মধ্যে যে যন্ত্রণা তা কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না। সে যন্ত্রণা আরও ভয়ানক। তার থেকে যে মুক্তি নেই। দিনরাত ঈশ্বরকে ডাকছি আমাকে তুলে নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি যেন যমেরও অরুচি হয়ে গেছি।’
‘এভাবে বলিস না। পরিমল দুঃখ পাবে। তোর জন্য কী না করছে ছেলেটা!’
‘যন্ত্রণাটা তো ওখানেই দিদি।’
কিছু বুঝতে না পেরে নির্বাক চোখে বিজয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে বিন্দুবালা। মুহূর্তক্ষণের নীরবতা কাটিয়ে আরও বিষণ্ণ সুরে বিজয়া বলে, ‘আমার চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বশান্ত হয়ে গেছে ছেলেটা। বাজারে দেনা। অর্ধেক জমি গেছে। বাকিটাও বেচতে চাইছে। ওর বাবার শেষ স্মৃতি। জীবন থাকতে ওটা আমি বেচতে দিতে পারব না।’
‘মানছি তোর কথা। কিন্তু ভাব এমন ছেলে কজনের কপালে জোটে!’
‘ওই ভেবেই তো শান্তি পাচ্ছি না। আমি বুঝতে পারছি না আমার কপালটা ভালো না মন্দ। মা হয়ে ছেলেটাকে ক্রমশ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। আমার কথা ভেবে ভেবে ছেলেটা শুকিয়ে যাচ্ছে। সংসারটা তছনচ হয়ে যাচ্ছে। আর কিছুদিন বেঁচে থাকলে হয়তো ওদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেখতে হবে। পারছি না দিদি, কিছুতে সহ্য করতে পারছি না। নিজেকে এখন আমার খুব অপরাধী মনে হয়। আমার জন্য এতগুলো মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে।’
‘এসব কী আবোল-তাবোল বলছিস!’
‘আবোল-তাবোল নয় দিদি। যা সত্যি তাই বলছি। এমনিতে রোগের যন্ত্রণা। তার ওপর এই মানসিক যন্ত্রণায় আমি শান্তি পাচ্ছি না। এখন মরলে আমি শান্তি পাই।’
‘ছি, ছি! এমন কথা মনে আনতে নেই। বুঝতে পারছি তোর মন ভালো নেই, তাই মাথায় এসব কথা আসছে।’
‘না দিদি, সত্যি সত্যি আমি মরতে চাই। বাঁচার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই। অনেক তো বাঁচলাম। আর কেন! এই রোগ সারবার নয়। কিছুদিন বেশি বেঁচে কেন একটা সংসারকে একেবারে ভাসিয়ে দিয়ে যাব? তার থেকে নিজেকে শেষ করে দেওয়া ভালো। তাহলে সব জ্বালা জুড়োয়। সংসারটাও বাঁচে।’
‘ষাট ষাট! এসব কী বলছিস পাগলের মতো!’
‘পাগল নয় দিদি, আমি সত্যি সত্যি মরতে চাই।’ বিজয়ার নীরব কান্না অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে। বিন্দুবালা তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে স্নেহমাখা সুরে বলে, ‘তুই মরলেই কি সংসারে শান্তি ফিরে আসবে? ছেলেটার কথা অন্তত একবার ভাব। এসব কথা ও যদি জানতে পারে...।’
কথা শেষ হয় না সহসা পরিমল এসে ঘরে ঢোকে। চমকে ওঠে বিন্দুবালা। বিজয়াও। বিন্দুবালা বুঝে পায় না পরিমল তাদের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছে কি না। শুনলেও কতটুকু। তার চোখের দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে যায় বিন্দুবালা। সেখানে বিরক্তি না ক্রোধ বুঝতে পারে না। এমনিতে পেট পাতলা স্বভাবের জন্য তাকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না পরিমল। তার ওপর মায়ের সঙ্গে এইসব মৃত্যুর ব্যাপার নিয়ে আলোচনা সে নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখবে না। পাছে এই নিয়ে কোনো অপ্রীতিকর অবস্থা তৈরি হয়, সেই ভয়ে ব্যস্তভাবে সেখান থেকে উঠে আসে।

৫.
আসব না আসব না করেও শেষপর্যন্ত পরিমলের বাড়ি আসে বিন্দুবালা। একটা অস্বস্তি তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। পরশু বিকেলে তার সঙ্গে মরা নিয়ে কথাবার্তা বলছিল বিজয়া আর সেই রাতেই সে আত্মহত্যা করে। বিন্দুমালার মনে এমন একটা ধারনা জন্মাতে থাকে, মায়ের মৃত্যুর জন্য পরিমল হয়তো মনে মনে তাকেই দোষী ভেবে থাকতে পারে। ভাবতে পারে সে হয়তো এমন কিছু কথা বলেছে যাতে করে তার মা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। পুরো কথাবার্তা সে শোনেনি। বিন্দুবালার মনে হয় সেদিন বিজয়ার সঙ্গে তার কী কথাবার্তা হয়েছিল সেটা পরিমলকে খোলসা করে বলা দরকার। নাহলে একটা মিথ্যে অপরাধের বোঝা তাকে বয়ে বেড়াতে হবে।
বাড়ির দাওয়ায় বসেছিল পরিমল। গতকাল মায়ের সৎকার হয়েছে। পরিমলের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে বিন্দুবালা। একেবারে বিপর্যস্ত চেহারা তার। এমনিতে মাথার ওপর দিয়ে ঝড়ঝাপ্টা যাচ্ছিল অনেক দিন। শরীরটা ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু মাত্র দু-রাতের ব্যবধানে যেন অনেকটা বুড়িয়ে গেছে সে। চোখের কোনে কালি। মাথার চুল উস্কোখুস্কো, চোখ-মুখ ফোলা। দেখে পরিস্কার গত দুরাত চোখের পাতা এক করতে পারেনি বেচারা। একটা ভয়ংকর ঝড় বয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে।
মনে মনে যে ভয় করছিল বিন্দুবালা তা ঘটে না। পরিমল শান্ত। একবার শুধু তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকায় কিন্তু কিছু বলে না। তার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে বেশ ঘাবড়ে যায় বিন্দুবালা। যে কথা বলতে এসেছিল তা আর বলতে পারে না। পরিমলের মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনার সুরে বলে, ‘এভাবে ভেঙে পড়িস না বাবা। মনকে শান্ত কর। বেচারি খুব ভালোবাসত সংসারটাকে। তুই ভেঙে পড়লে ওর আত্মা শান্তি পাবে না।’
অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে বিন্দুবালার দিকে তাকিয়ে থাকে পরিমল। বিন্দুবালা আগের সুরে বলে চলে, ‘খুব কষ্ট পাচ্ছিল বেচারি। শরীর, মনে অসম্ভব যন্ত্রণা ছিল। মুক্তি পেয়েছে ও।’
মুক্তির কথায় চমকে ওঠে পরিমল। নিজেকে আর স্থির রাখতে পারে না। যে বিন্দুবালাকে সে একদম সহ্য করতে পারে না, সহসা তারই দুহাত নিজের দু-হাতের মধ্যে চেপে ধরে তাতে মাথা ঠুকে অশ্রু ঝরায় অনেকক্ষণ। বিন্দুবালা তাকে সান্ত্বনা দেয়। এভাবে কেটে যায় কিছুটা সময়।
বিন্দুবালা চলে যেতেই পরিমল অশ্রুভেজা হাত দুটো মেলে ধরে চোখের সামনে। একদৃ্ষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সহসা ভীষণ চমকে ওঠে সে। বুঝে পায় না সে হাতে মুক্তির আলো নাকি মৃত্যুর দাগ। নিজের সঙ্গে নিজেই লড়তে থাকে পরিমল কিন্তু হার মানে বারবার। অপরাধী মন বিন্দুবালার ফেলে যাওয়া হাতের স্পর্শে নিবিড়ভাবে অনুভব করে মুক্তির কৃতজ্ঞতা।








দেবাশিস দে'র অণুগল্প








মুখে আগুন

আমার অবিবাহিত মেজ দাদুর কথা বলছি। সারা জীবন শুধু চিন্তাই করে গেল – এত টাকা রোজগার করছি , খরচ করছি কিন্তু শেষ সময়ে আমার মুখে আগুন কে দেবে !! দাদুর সঙ্গে কথা বলতে গেলে কিছুক্ষণ কথা চলার পর দাদুর সেই চিন্তা কথার মাঝ খানে ভাগ বসাতে চলে আসতো। আমরা অনেকেই মজা করবার জন্য বলতাম – আমরা সবাই মিলে আগুন দেব দাদু। দাদু বলত তোরা মুখেই বলছিস কাজের সময় তোদের টিকিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বোঝাতাম যতক্ষণ বেঁচে আছো ততক্ষণ জীবনটাকে ভালো ভাবে উপভোগ কর।  মারা যাওয়ার পর দেখবে একজন ঠিক যোগাড় হয়ে যাবে মুখে আগুন দেবার জন্য। তখন খুব খারাপ লাগত মানুষের এই অদ্ভুত পাগলামির কথা ভেবে -  সুন্দর শরীর।  সুন্দর মুখ, কত প্রসাধনী দিয়ে তাকে নিখুঁত করার চেষ্টা অথচ মারা গেলে তাতে আগুন দিয়ে নষ্ট করার কি প্রক্রিয়া। আর মজার কথা মানুষের সন্তানের আকাঙ্কাও এই অন্তিম কালের মুখাগ্নির জন্য।

       আজকের দৃশ্যটা দেখে দাদুর কথা খুব মনে হচ্ছে । দাদুর সময় যদি এমন জিনিস থাকত - দাদু বোধহয় নিশ্চিন্তে মরতে পারতেন। মানে এত-চিন্তা করতে হত না।  আর এটা হলে  দাদুর মুখে নিশ্চয় তৃপ্তির হাসি দেখতে পেতাম।

       আজ দুপুরে একটা অন্নপ্রাশন বাড়িতে আমার নিমন্ত্রণ ছিল । বেশ ভালো খাওয়া  দাওয়া হল।  বুফে সিস্টেমে খাওয়া।  ফিস ফ্রাই, কাতলা মাছের ঝাল, পেল্লাই সাইজের গলদা চিংড়ি, পোলাও, চাটনি, পাঁপড় পায়েস, রসগোল্লা সব এক এক পেটে সংগ্রহ করতে লাগলাম। শেষে আইসক্রিমও ছিল। কিন্তু পান নেই বা পানের মশলা নেই। বাড়িতে পান খাওয়ার  অভ্যাস নেই। কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতে গেলে একটা মিষ্টি পান পাওনা থেকেই যায়। কিন্তু এখানে না  আছে পান না আছে পান-মশলা। একটু কিন্তু কিন্তু লাগছিল। হঠাৎ দেখি বুফে কাউন্টারের উল্টোদিকে ছোটো একটা ঘরের মধ্যে  বিশাল লাইন। ঘাবড়ে গেলাম এ আবার কি  আজকাল কি অনুষ্ঠান বাড়িতেও - ‘এখানে নতুন আধার কার্ড হইতেছে’ – জাতীয় কিছু চালু হয়েছে নাকি ? উঁকি ঝুঁকি দিয়ে চোখ খুব একটা সুবিধা করতে পারল না। এগিয়ে  গেলাম ব্যাপারটা  বোঝা দরকার ‘ওই পড়তে হয়, নাহলে পিছিয়ে পড়তে হয়’ গোছের কৌতূহলী চোখ নিয়ে লাইনের মাঝে একজন একটু বোকা বোকা লোক দেখে সাহস করে জিজ্ঞাসা করলাম – এটা কিসের লাইন দাদা ? ভদ্রলোক আমাকে বলল এখানে না ওই যে শেষে লাইন দিন। আরে যে জিনিসটা জানেইনা  সে কেন বেলাইনের সুবিধা নেবে ? লাভ হল না, অগত্যা দু’জন পরের এক ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম যদি কিছু মনে না করেন এটা কিসের জন্য লাইন যদি বলেন – ভদ্রমহিলা আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে একটা বোর্ডের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল – আমি তাকিয়ে দেখে অবাক ‘ফায়ার পান’।  ব্যাস  পায় কে আমায়, ঠেলে ঠুলে একবারে  সামনে। পান খিদে পরিত্যাগ করে মোবাইলে প্রথমে ছবি পরে ভিডিও তুলতে লাগলাম । দেখলাম আমার মতো আরো তিনজন  মোবাইলে  ছবি তুলছে। পান কর্তা মিষ্টি  পাতায় বিভিন্ন মশলা দিয়ে সম্ভবত তাতে কর্পূর দিয়ে আগুন ধরিয়ে পানটা ভাঁজ করে একেক জনের মুখে আগুন সমেত ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এইভাবে একের পর এক আগুন পান দিয়ে যাচ্ছে ।

       জীবিত অবস্থায় মুখাগ্নির এই অভিনব পদ্ধতি আমার অবিবাহিত মেজদাদুর  সময়ে থাকলে দাদু কতই না তৃপ্তি পেতেন। যদিও আমার মেজদাদুর  মৃত্যুর পর অনেকেই ওঁর  মুখাগ্নি করতে চেয়েছিল,  কিন্তু সেজদাদুর  ছোটো ছেলে ঐ প্রতিযোগিতায় জিতেছিল।

দীপক মান্নার গল্প







কড়ুইগাছার বউ কথা কও


তিন মাস কলকাতায় এসে রজত যেন খুব বেশি করে কমার্শিয়াল হয়ে পড়েছে। সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠে চান খাওয়াদাওয়া সেরে, নটার মধ্যে অফিসে বেরিয়ে পড়ে। সারাদিন অফিসের কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে দুটো টিউশন পড়িয়ে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দশটা বেজে যায়। কোন কোন দিন টিউশন না থাকলে বাড়ি ফেরার পথে কফিহাউস অথবা সাহিত্যের আড্ডা সেরে আসে। ছোটবেলা থেকে অভ্যেস। সময় সুযোগ পেলেই খাতা পেন নিয়ে সবার চোখের আড়ালে চলে যায় অথবা কবিতার বই নিয়ে বসে পড়ে। এছাড়াও তার আর একটা নেশা আছে আর তা হল পাখির নেশা। এই পাখির নেশায় সে গ্রামে গঞ্জে বিভিন্ন জায়গায় ছুটে যায়। ক্যামেরা নিয়ে পাখির ছবি তোলে এবং ল্যাপটপে ভরে রাখে। কোন পাখির ছবি নেই তার কাছে- চড়াই, বুলবুলি, টিয়া থেকে শুরু করে শ্যামা, দোয়েল সবই আছে। বাড়ির কাছে কিছুটা দূরে একটা জলাশয় আছে। প্রতিবছর শীতে ভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি সেখানে উড়ে আসে। রজত সেখানে ছুটে গিয়ে তাদের ক্যামেরাবন্দি করে। দুঃখ একটাই সে কোনদিন ‘বউ কথা কও’ পাখি দেখেনি। মানে ছবিতে দেখেছে কিন্তু নিজের চোখে দেখেনি। সে কিছুতেই তার সীমানার মধ্যে আসে না।

বেশ কিছুদিন হল কোথাও একটু বেড়িয়ে আসার জন্য মনটা চঞ্চল হয়ে উঠছিল রজতের। অফিসেও ভীষণ কাজের চাপ থেকে একটু রেহাই পেতে চায়। তাছাড়া, সৌম্য বলেছে তাদের গ্রামে নাকি বউ কথা কও হামেশাই দেখা যায়। তাই সে কয়েকদিনের ছুটি ম্যানেজ করে সৌম্যর বাড়িতে যাবে ঠিক করে। সৌম্য তার কলেজের বন্ধু। একসাথে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে বেরিয়েছে। সুখদুঃখে সবসময় দুজনে একসাথে থেকেছে। বাড়ি নদীয়ার প্রত্যন্ত এক গ্রামে। গ্রামের নাম কড়ুইগাছা। চারিদিকে শুধু গাছ আর গাছ। রজত গাছে বসে থাকা পাখিদের সাথে মনে মনে কথা বলে। প্রকৃতির নিবিড় ঘন ছায়ার মধ্যে নিজেকে লিপ্ত করে রাখতে ভীষণ ভালোবাসে। এই কয়েক মাসে যান্ত্রিক শহরে থেকে সেও যেন কেমন যন্ত্রের মতো হয়ে উঠেছে, তাই একটু নিরিবিলি খুঁজতে সে সৌম্যদের গ্রামই বেছে নিয়েছে। তার ওপর সৌম্য বলেছে তাকে ‘বউ কথা কও’ পাখি দেখাবে। রজত শুনেছে সৌম্যদের ওখান থেকে নাকি বাংলাদেশের বর্ডার দেখা যায়, ইছামতী নদীর ওপর। সে কোনদিন বর্ডার দেখেনি। ওর আশপাশের মানুষের জীবনযাত্রা দেখার ইচ্ছা ছিল বহুদিনের। তাই আর ভাবনা চিন্তা না করে লাগেজ নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে।

সকাল সাতটার মধ্যে শিয়ালদায় পৌঁছে যায়। সাড়ে সাতটা নাগাদ ট্রেন। রজত উঠে জানলার ধারে একটা সিটে গিয়ে বসে। এটা ওর চিরকালের স্বভাব, ট্রেনে উঠেই জানলার ধার খোঁজা, প্রকৃতির দৃশ্য দেখা আর মনে মনে গান গাইতে গাইতে যাওয়া।

অলিখিত প্রথা অনুযায়ী ট্রেন যথারীতি বেশ কয়েক মিনিট দেরিতেই ছাড়ল। দেরিতে ছাড়লেও ট্রেন বেশ জোরেই ছুটছিল। রজত জানলা দিয়ে লাইনের ধারে পড়ে থাকা নুড়ি পাথর গুলো দেখতে থাকে। চোখের সামনে আবছা হয়ে ছুটে যাওয়া সেই পাথরগুলোকে কিসের সঙ্গে তুলনা করবে ভেবে পায় না। কখনও মনে হয়েছে এক একটা সময় যেন ছুটে চলেছে, কখনও মনে হয়েছে অত্যন্ত গভীর প্রেমও এই নুড়ি পাথরের মত জীবন থেকে দ্রুত সরে যায়, সবকিছু উপেক্ষা করে। দুটো ধারনাই রজতের মনের মধ্যে গভীর ভাবে আঁকড়ে বসে। সে ভাবতে থাকে ছোটবেলাতেই বাবা-মায়ের মায়া মমতা হারিয়েছে।, দাদা বৌদিদের ভালবাসার মধ্যে যেন ঘনত্ব ছিল না। সে জন্য অবশ্য কারোর কাছে তার কোন অভিযোগ নেই। কারণ, সে অবসর তাদের ছিল না। তাদের কাছে যেটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তা হল দুমুঠো অন্ন।

এ সব ভাবতে ভাবতে ট্রেন কখন রানাঘাট স্টেশনে ঢুকে গেছে। এখানে ট্রেনটা প্রায় একঘণ্টার কাছাকাছি দাঁড়ায়। কারণ, এরপর থেকে ইলেকট্রি-ফিকেশন হয়নি। ডিজেল ইঞ্জিন ট্রেন টিকে টেনে নিয়ে যায়। রজত সেই ফাঁকে ট্রেন থেকে নেমে স্টেশন লাগোয়া পান বিড়ির দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনে ধরায়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে এখান থেকে তার গন্তব্যস্থল আর কতদূর। লোকটি উত্তর দেয় – তা প্রায় ঘণ্টা খানেক হবে। রজত ভদ্রলোকটির কাছে জেনে নেয় সামনাসামনি কোন মিষ্টির দোকান আছে কিনা। তারপর, প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে কিছুটা দূরে একটা দোকান থেকে কিছু মিষ্টি কিনে নেয়। জায়গাটা ভীষণ জমজমাট। চারিদিকে কোলাহল আর ব্যস্ততা। রজতের মনে হয় এ যেন আর এক কলকাতা। এত দূরে এসে এখনও শুদ্ধ বাতাস তার ফুসফুসে নিতে পারছে না। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে আসে। রজত গিয়ে নিজের জায়গায় বসে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সবুজ সিগন্যাল পেয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। ট্রেন লাইনটা রাণাঘাট স্টেশন ছেড়েই গুলতির ডাঁপের মতো দু দিকে বেঁকে গেছে। রজতের ট্রেন ডানদিকের লাইন ধরে ছুটতে শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশটা বদলে যায়। কোথায় সেই জনাকীর্ণ কলকাতা! চারিদিকে সবুজ ধানের ক্ষেত, যেন সবুজ সমুদ্র আর সেই সমুদ্রে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে চিৎকার, চেঁচামেচি কোলাহল। রজতের মনটা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। কিছুদূর যাবার পর সর্ষের ক্ষেত। হলুদ সর্ষে ফুলে সারা মাঠ ভরে গেছে আর তার ওপর দিয়ে মৌমাছির দল মধুর লোভে উড়ে বেড়াচ্ছে। আরও কিছুদূর যাবার পর সে দেখতে পায় তিল ক্ষেত। মাথায় বেতের টুপি দিয়ে কৃষকেরা মাঠে লাঙ্গল দিচ্ছে। রজত তিল ক্ষেতের সেই মনোরম দৃশ্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। তিলগুলো দেখে তার মনে হয়, এক একটা তিল যদি ভালবাসা হত, তাহলে এই পৃথিবীতে নিষ্ঠুর প্রেমহীন মানুষগুলোর বুকে বসিয়ে দেওয়া যেত।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন ট্রেন গন্তব্যস্থল পৌঁছে গেল রজত টেরই পেল না। সে ট্রেন থেকে লোহার সিঁড়ি বেয়ে প্ল্যাটফর্মে নামে। ঠিক প্ল্যাটফর্ম বলতে যা বোঝায় তা নয়। লাইন বরাবর সরু ইটের রাস্তা। তাতেই হ্যান্ডেল ধরে কোনপ্রকারে নামতে হয়। পাশেই একটা পান গুমটির মতো টিকিট কাউন্টার। একটু দুরে একটা মিষ্টির দোকান আর পান গুমটি ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়ে না। রজত মিষ্টির দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘দাদা এখানে সৌম্য নায়েকদের বাড়িটা কোথায় একটু বলতে পারেন?’ দোকানদারটি চট করে বুঝে যায়, তারপর বাঁহাতি একটি মাটির রাস্তা দেখিয়ে বলে –‘এই রাস্তা ধরে সোজা চলে যান, কিছুদূর যাবার পর বাঁদিকে দেখবেন কয়েকজন তাঁত চালাচ্ছে, ওখানে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবে নায়েকদের বাড়ি কোনটা’।

রজত দেখল এখানে রিকশা নেই, ভ্যান অথবা গরুর গাড়িই ভরসা। সে হাঁটা লাগাবে মনস্থির করল। পকেট থেকে সিগারেট বের করে মুখে দেয়। হাঁটতে হাঁটতে গাছের ডালে বসে থাকা পাখিগুলোর দিকে মাঝে মাঝে তাকায়। কখনও ক্যামেরা দিয়ে দু একটার ছবিও তুলে রাখে। রজতের চোখে একটাই মাত্র পাকা দোতলা বাড়ি পড়ল। বাকি সব দরমার অথবা টিনের। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে দেখে মিষ্টির দোকানের লোকটির কথা ঠিক। দুজন মেয়ে এবং বছর বত্রিশের একটি যুবক তাঁত মেশিন চালাচ্ছে। লোকটিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করাতে সে একটু দূরে একটা বাঁশঝাড় দেখিয়ে বলে – ওর পিছনের বাড়িটাই সৌম্যদের বাড়ি। রজত ঘন বাঁশবনের ফাঁক দিয়ে আবছা কয়েকটা দর্মার ঘর দেখতে পেল। ঘরের কাছে আস্তেই সৌম্যকে দেখতে পায়। সৌম্যও রজতকে দেখতে পেয়ে প্রথমটা অবাক হয়ে যায়, তারপর দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে – ‘কিরে হঠাৎ এভাবে চলে এলি? একটা খবর দিয়ে আসবি তো!’ রজত বলে –‘তোকে সারপ্রাইজ দেব বলে তো জানাইনি। শোন, তোর এখানে আসার একটা মস্ত কারণ আছে’। - ‘কি কারণ?’ – ‘ভুলে গেলি? তুই বলেছিলি আমায় ‘বউ কথা কও’ পাখি দেখাবি।’ - ‘ও হ্যাঁ’, মনে পড়েছে।’- ‘আমি কিন্তু ‘বউ কথা কও’ পাখি দেখে তবেই যাব’। - ‘আচ্ছা, বেশ বেশ তুই এখন ঘরে চ।’ এই বলে সৌম্য রজতকে ভিতরে নিয়ে যায়।  মা বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। রজত তাদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। বেলা তখন প্রায় একটা বেজে গেছে।

দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে দুজনে বিছানায় গিয়ে বসে, তারপর চলে জমিয়ে আড্ডা, পুরনো স্মৃতিচারণ। গল্পে গল্পে রজতের চোখে ঘুম নেমে আসে। কয়েক ঘণ্টার জার্নি তাকে ক্লান্ত করে দিয়েছে। আবহাওয়াটাও বেশ সুন্দর। গত কয়েকদিন প্রচণ্ড গরমে সবাই আইঢাই করেছে। আজ একটু মেঘলা আকাশ। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে।

বিকেল হতেই রজত বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। সৌম্য তখনও এক কোণে বালিশ আঁকড়ে পড়ে আছে। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বিস্তৃত খোলা জলাভূমি। ঝিরঝিরে সুন্দর বাতাস বইছে। দূরে উঁচু বাঁধের ওপর রেললাইন পাতা। একটা ডিজেল ট্রেন তার ওপর দিয়ে ঝিক ঝিক সুর তুলে ছুটে চলেছে আর তার ধোঁয়া সাপের ফণার মতো হেলতে দুলতে আকাশে গিয়ে মিশছে। এমন মনোরম দৃশ্য এর আগে রজত কখনও দেখেনি। সে এক ছুটে জলার ধারে আসে তারপর একটা খেজুর গাছের গোড়ায় গিয়ে বসে। দূরে মাঠের মধ্যে কয়েকটা মেয়ে বউ ধান ঝাড়ছে। সে কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে থাকে। হঠাৎ দেখে দূরে সেই ধান ঝাড়াই করা মেয়ে বৌগুলোর মধ্যে থেকে একটি যুবতী মেয়ে তার দিকে ছুটতে ছুটতে আসছে আর ইশারা করে কি বলছে। রজত তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারে না। কাছে আসতে তার কানে এলো, সে বলছে - ‘বাবু, ওখানে বসিস না, কাল ওখান থেকে দুটো কেউটে বেরিয়েছে’। গ্রাম্য ভাষায় হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে সে কথাগুলো বলতে থাকে। রজত ধিড়পিড় করে সেখান থেকে উঠে পড়ে। মেয়েটি নিজের খেয়ালেই গড়গড় করে বলতে থাকে –‘এর আগেও ওখান থেকে আরও দুটো সাপ বেরিয়েছিল, আমাদের গ্রামের ছেলেরাই অগুলোকে মেরেছে। তুই আর কোনদিন ওখানে বসিস না’।

রজত সাপের কথা শুনে যত না অবাক হল তার চেয়েও বেশি অবাক হল সেই গ্রাম্য মেয়েটির কথা বলার সাবলীল ভঙ্গিমা দেখে। সে কোন কথার উত্তর না দিয়ে এক ঠায়ে তার কথা শুনতে থাকে আর তার সংক্ষিপ্ত সরু কোন এক নদীর মত ভুরুর দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে এ নদী যেন তার বহু পরিচিত। সেই নদীর কূলে পানসির মত দুই চোখ হেলেদুলে উঠছে। মেয়েটির অনর্গল কথাবার্তা থামতেই রজতের তন্দ্রা কেটে যায়। তার দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে থাকাতে মেয়েটিও কেমন যেন লজ্জা পায়। রজত হঠাৎ প্রশ্ন করে –“ তোর নাম কিরে? সে মাথা নিচু করে লাজুক স্বরে উত্তর দেয় –‘কুসুম’। ‘তোর বাড়ি কোথায়?’ – ‘ওই যে লম্বা জমিটা দেখছ, ওর ঠিক পরেই’। -তোর বাড়িতে কে কে আছে? – বাড়িতে আমি আর আমার দাদু থাকি। কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ তার দুচোখ জলে ভরে আসে। রজত বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে – ‘কিরে কাঁদছিস কেন’? মেয়েটি কোন কথার উত্তর না দিয়ে ফোঁপাতে থাকে। রজত তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। সে কান্না থামিয়ে বলে – ‘আমার একটা ছোট্ট ভাই ছিল, একবার প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টিতে সে এই জমিতে আটকে পড়েছিল। আমরা সারারাত ধরে খুঁজেও তাকে পাইনি। পরদিন সকালে ওই যে দূরে একটা ডোবা দেখছ, ওই ডোবার জলে ভাইয়ের মরা দেহটা ভেসে ওঠে’। কথাগুলো বলতে বলতে কুসুম জমির ওপর বসে পড়ে। রজত দেখে ছোটো ছোটো শিশির বিন্দু কিভাবে ফুলের চিবুক বেয়ে ঝরে পড়ছে। কিভাবে ভায়ের মৃত্যু তার কোমল হৃদয়ে যন্ত্রণার রেখা টেনে গেছে। কুসুম উঠে দাঁড়ায়, তারপর বলে –‘আমি আসি, দাদু চিন্তা করবে’। এই বলে সে ছুটতে ছুটতে দূরে সেই মেয়ে বউদের দলে মিশে যায়। যেতে যেতে একবার পিছন দিকে তাকায়। রজতও তার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ তারপর ঘরে ফিরে আসে।

সৌম্য বিকেলে বাজার থেকে আস্ত একটা জ্যান্ত রুইমাছ কিনে এনেছিল। রাত্রের খাওয়াটা তাই একটু ভারির ওপর দিয়েই গেল। রাতে শোবার আগে দুজনে কলেজের পুরনো কিছু স্মৃতি আওড়াতে লাগল। শোবার আগে রজত সৌম্যকে বউ কথা কও পাখির কথা একবার মনে করিয়ে দেয়। সৌম্য কথা দিয়ে চোখ বোজে। রজতের শোবার আগে বই পড়ার নেশা। ঘুম আসতে আসতে রাত প্রায় একটা বেজে যায় প্রতিদিন। আজ আর বইয়ের পাতায় তার মন বসছে না। শব্দগুলো ইঞ্জিনের ধোঁয়ার মত মিলিয়ে যাচ্ছে। সে মাথার কাছে খোলা জানলা দিয়ে দূরে আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকে। কি এক অদ্ভুত মায়াটান তার ওপর ভর করেছে। দূরে খোলা জমিটার দিকে তাকিয়ে ভাবে কুসুম হয়তো তার ভাইয়ের জন্য ওই ডোবাটার পাশে বসে কাঁদছে। ওর চোখের জল বড়ই বেদনাদায়ক। সে ভাবে এখুনি ছুটে গিয়ে তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে আসে। বলে আসে ‘ওই দ্যাখ, আকাশের দিকে তাকিয়ে, যেটা সব থেকে উজ্জ্বল তারা, ওটাই তোর ভাই।’ রজতের চোখে তন্দ্রা নেমে আসে।

পরদিন সৌম্যর বউ কথা কও পাখি দেখানোর কথা। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখে সৌম্য নেই সে জরুরি কাজে একটু বেরিয়েছে আসতে দেরি হবে। রজত ভাবল, আজও আর তার বউ কথা কও পাখি দেখা হবে না। কি আর করে, তাই সে ঠিক করে মায়াপুর যাবে। সে মাসিমার তৈরি করা চা আর টিফিন খেয়ে বেরিয়ে পড়ে। বেশ কিছুটা হাঁটার পর সে বগুলা বাসস্টপে এসে দাঁড়ায়। ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে তখন। বাসে দু-তিন ঘণ্টার রাস্তা। মহাপ্রভুর মন্দিরের বেশ খানিকটা দূরে বাস থেকে নেমে তারপর কিছুটা হেঁটে মন্দিরে প্রবেশ করে। মন্দিরে তখন আরতি ঘণ্টা ধ্বনি হচ্ছে। রজত মন্দিরের ভিতরটা কিছুটা সময় কাটায়। তারপর, বেরিয়ে গঙ্গার দিকটা যায়। এখানের গঙ্গাটা বেশ সরু। ওপারে বেশ খানিকটা ফাঁকা জমি, তারপর সারি সারি গাছ। কিছুদূর গেলে জলঙ্গি নদী আর গঙ্গার মিলনস্থল। রজত সেই দিকে হাঁটতে থাকে। কাছে এসে দেখে জলঙ্গির সবুজ জল কিভাবে গঙ্গার ঘোলাটে জলের সাথে মিশেছে। হঠাৎ তার মনে হয় ঠিক এভাবে যদি কুসুমের সাথে তার ভাইয়ের মিল হয়ে যেত...।
ধিরে ধিরে বেলা গড়িয়ে আসে। রজত সৌম্যদের বাড়ি ফিরে আসে। আজ বিকেলেও তার একবার জলায় যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সে জানে না কেন তার সেই ইচ্ছা জাগরিত হচ্ছে। হয়তো বউ কথা কও পাখি তার জন্য গাছের ডালে অপেক্ষা করছে। কখনওবা মনে হচ্ছে কি এক অসম্পূর্ণ কাজ যেন সে ফেলে এসেছে। এই মাঠ তাকে ডাকছে বার বার। অথচ দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠের থেকেও তার বেশি পছন্দ নদী, পাহাড়, পাখি আর গাছ।

সে মাঠের ধারে একটা লম্বা আলের ওপর গিয়ে বসে। সঙ্গে আনা ডাইরির পাতা উলটে একটা কবিতা লিখবে ঠিক করে। অনেকদিন কোন কবিতা লেখা হয়নি। সাহিত্যের আড্ডায় পুরনো কবিতা অনেকে শুনতে চায়না। হঠাৎ দেখে কুসুম ছুটতে ছুটতে এসে তার পায়ের কাছে বসে পড়ে তার পর প্রাণোচ্ছল ভাবে জিজ্ঞেস করে –‘কিগো বাবু! তুমি আজ আবার এসেছ? রজত উত্তর দেয় – ‘হ্যাঁ, আমি তো বেড়াতে এসেছি কদিনের জন্য’। - তোমার ঘর কোথায়? – কলকাতায়। কুসুম অবাক হয়ে বলে – ‘কলকাতায়!’ – হ্যাঁ, তুই কলকাতায় কোনদিন গিয়েছিস? কুসুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে – ‘না গো, আমি লেখাপড়া জানিনা, শুনেছি ওখানে সব বড় লোক থাকে, ভালো জামাকাপড় পড়ে, ভালো ভালো কথা বলে। জানো! আমার খুব কলকাতায় যাবার ইচ্ছে হয় কিন্তু লোকে বলে ওখানে নাকি অনেক বাজে লোকও থাকে’। রজত বলে – ‘কি! আমাকে তোর বাজে লোক বলে মনে হয়? কুসুম রজতের মুখের দিকে তাকায়, তারপর মাথা নিচু করে লাজুক ভঙ্গিমায় বলে –‘না’। ‘তুই কলকাতায় যাবি? –‘কার সাথে যাব?’ – ‘যদি আমি নিয়ে যাই?’ কুসুম উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে। রজত জিজ্ঞেস করে –‘আচ্ছা, তুই সারাদিন কি করিস?’ সে বলে – ধান সেদ্দ করি, শুকোতে দিই, আনাজ কাটি এই সব। - তোর কোন বন্ধু নেই? –‘ছিল, দাদু এখন আর তাঁদের সাথে মিশতে দেয় না। বলে আমি নাকি বড় হয়ে গেছি, দুদিন পরে বিয়ে হবে, এখন আর কারোর সাথে বেশি মেলামেশা করা ঠিক নয়।’ রজত বলে- আমাকে তোর বন্ধু করবি? সে এক কথায় ঘাড় নেড়ে বলে –হ্যাঁ, তুমি খুব ভালো। বেশ সুন্দর সুন্দর কথা বল। জানো, আমার কোন সঙ্গী নেই, সারাদিন শুধু কাজ। ধান সেদ্দ করা, শুখনো করা আবার তুলে ঠিক জায়গায় রাখা। আমার আর এ সব ভালো লাগে না গো। আমার সাথে গল্প করার কেউ নেই। তুমি বন্ধু হলে আমার খুব ভালো লাগবে। হঠাৎ তার খেয়াল হয় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। ‘আচ্ছা বাবু, আজ আমি যাই’ – এই বলে সে এক ছুট লাগাল। কিছুদূর যাবার পর আবার ফিরে এসে তার সামনে দাঁড়ায়, এবং আঙ্গুলের মধ্যে একটা খড়কুটো পাকাতে পাকাতে মাথা নিচু করে বলে – ‘কাল আবার আসবে তো।’ রজত হ্যাঁ বলাতে সে খুশি হয়ে একছুটে দূরে মিলিয়ে যায়। রজত তার ছুটে যাওয়া পথের দিকে এক ঠায়ে তাকিয়ে থাকে।

সেদিন সকাল থেকে আকাশটা মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে। এক ফোঁটা সূর্যের আলো নেই। গরমে সকলে আইঢাই করছে। বিকেলের দিকে বৃষ্টি আসতে পারে। ঠিক তাই, চারটে বাজতে না বাজতেই আকাশটা কালো মেঘে ছেয়ে গেল। তার সাথে ঝড়ো হাওয়া বইতে লাগল। পশ্চিম আকাশে উদয় হওয়া বিশাল মেঘের কালো চাদর যেন পৃথিবীটাকে এখুনি ঢেকে দেবে। এমন সুন্দর দৃশ্য এর আগে রজত কখনও দেখেনি। তার মনে হয় যারা পরমাণু বোমা তৈরি করে পৃথিবীটাকে ধ্বংস করে দিতে চায় তারাও যদি এ দৃশ্য দেখে, তাহলে সমস্ত ফর্মুলা ভুলে যাবে। রজত ছুটে যায় খোলা মাঠের দিকে। আবছা আলোর মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হল। তুমুল বৃষ্টি। সে সারি দেওয়া একটা খেজুর গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ দেখে ঘন বৃষ্টির মধ্যে দিয়েই কে যেন দুটো বড় মানকচুর পাতা মাথায় দিয়ে তার দিকে ছুটে আসছে। কাছে আস্তেই দেখে কুসুম। - ‘বাবু এই নাও, এটা মাথায় দাও’ এই বলে সে একটা রজতের মাথায় দেয় আর একটা নিজের। রজত দ্যাখে, কুসুমের সারা শরীর ভিজে গেছে। গায়ের কাপড় শরীরের সঙ্গে লেপটে গেছে ফলে তার নিষ্কলুষ যৌবন কাপড় ভেদ করে উঁকি দিয়ে উঠছে। এসব দেখে রজতের মনে কেমন যেন এক হিল্লোল বয়ে যায়। সে দ্যাখে তার দুই ভুরু ঝড় বৃষ্টিতে গতিপথ বদলেছে। ভেজা পাখির মতো ঠক ঠক করে সারা শরীর কাঁপছে। রজত তার দিকে দু হাত বাড়িয়ে দেয়। কুসুম বাঁধা দেয় না, রজতের মুখের দিকে কিছুক্ষণ ভেজা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তারপর অবলীলায় তার বুকের মধ্যে মিশে যায়। হঠাৎ বিদ্যুতের চমকে তন্দ্রা কেটে যায় রজতের। সে আমতা আমতা করে কুসুমকে বলে – ‘যা বাড়ি চলে যা, আর বৃষ্টিতে ভিজিস না। আর শোন, আমার ছুটি ফুরিয়ে গেছে। কালই কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি। ভালো থাকিস।’ রজতের কথায় কুসুমের মাথায় বজ্র ভেঙে পড়ে। সে অবাক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে। রজত দ্যাখে, তার চোখের জলের স্রোতে জীবনের অনাস্বাদিত সমস্ত সুখও যেন ধুয়ে যাচ্ছে। সরু নদীর মতো দুই ভুরু যেন ছিন্নভিন্ন আর সেই পানসি চোখ কোন এক দুঃখের সাগরে ডুবে গেছে। কুসুম চোখ থেকে চোখ নামিয়ে একছুটে বৃষ্টির ধোঁয়ায় হারিয়ে যায়।

সৌম্য বৃষ্টি শেষে বাড়ি ফিরে আসে। এসে দ্যাখে রজত বিছানায় শুয়ে। বলে- ‘কিরে! এই ভর সন্ধ্যেয় শুয়ে। শরীর ঠিক আছে তো? রজত বলে – কেমন যেন শীত শীত লাগছে। সৌম্য কপালে হাত দিয়ে দ্যাখে গা বেশ গরম। বলে – এ কিরে! তোর গা যে পুড়ে যাচ্ছে! এক কাজ কর, তুই চুপচাপ শুয়ে থাক, আমি ওষুধ নিয়ে আসি। এই বলে যাবার উপক্রম করতেই রজত বাধা দেয়। বলে- ‘ও ঠিক হয়ে যাবে, তুই ব্যস্ত হোস না। তুই বরঞ্চ হাতমুখ ধুয়ে রেস্ট নে।’ সৌম্য বলে – ‘তোর মাথা খারাপ হল নাকি! একেই এত জ্বর তার ওপর রাত বিরেতে বাড়াবাড়ি হলে?’ এই বলে সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

রাত্রে মাসিমা গরম দুধ আর রুটি করে রজতের জন্য। সে তাই খেয়ে শুলো। রাত্রি গভীর হতেই রজতের শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। প্রায় বেহুঁশ অবস্থা। একই ভাবে পরের দিনও কেটে গেল। এই দুদিন মাসিমা তার খুব যত্ন করেছেন, একদম নিজের মায়ের মতো। প্রায় সারারাত ধরে কপালে জলপট্টি দিয়েছেন। রজত তার কাছে চির কৃতজ্ঞ।

পরদিন, রজত সকালে ঘুম থেকে উঠেছে একটু দেরিতেই। সৌম্য তার আগে চান খাওয়া করে কাজে বেরিয়ে গেছে। আজ আর শরীরে জ্বর নেই। শুধু মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে আছে। তার ‘বউ কথা কও’ পাখি দেখা হল না। জানলা দিয়ে দূরে ফাঁকা জমিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ কানে একটা গুঞ্জন এলো। মাসিমা কাকে যেন বলছে – ‘মেয়েটির দুর্দশার শেষ নেই। আপনজন বলতে ওই একমাত্র বুড়ো দাদুটাই ছিল, সেও গেল। মেয়েটা একেবারেই অনাথ হয়ে গেল’। রজত উঠে এসে মাসিমাকে জিজ্ঞেস করে – ‘কার কথা বলছেন মাসিমা?’ – ‘ওই যে ধান জমিটার ওপারে কুসুম বলে একটা মেয়ে থাকে। ওর দাদু গতকালের ঝড়বৃষ্টিতে কুসুমকে খুঁজতে বেরিয়েছিল। হঠাৎ একটা মোটা খিরিস গাছের ডাল এসে মাথায় পড়ে আর তখনই মারা যায় বেচারা। বছর চারেক আগে সাপের কামড়ে মা-বাবা দুজনেই মারা যায়। ভাইটাও এরকম ঝড়বৃষ্টিতে ডোবার জলে মরে পড়েছিল। এখন একা মেয়েটা কি করবে কে জানে’! রজতের বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল। দু চোখ ছল ছল করে উঠল। কুসুমের কাছে সে-ও বোধহয় শহরের বাজে ছেলেদের মধ্যে একজন হয়ে উঠেছে। না এটা অন্যায়। এ ভুল সে কিছুতেই করতে পারে না। এই অসহায় অবস্থায় সে কিছুতেই তাকে ফেলে যেতে পাড়বে না। সে বোঝেনি যে, এই কদিন তার নাগালের মধ্যে দিয়ে ‘বউ কথা কও’ কতবার উড়ে গেছে। অথচ সে দেখেও দেখতে পায়নি। তার আর এক মুহূর্তের জন্যও তর সইছিল না। সে তড়িঘড়ি করে জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়ে মাসিমাকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়ে। বলে – ‘আমাকে এখুনি যেতে হবে একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে।’মাসিমা তাকে দুমুঠো খাবার কথা বললে- সে বলে ‘পরে আবার একদিন আসব তখন না হয় খাব। সৌম্যকে বলে দেবেন যে আমি বউ কথা কও পাখির দেখা পেয়ে গেছি তাকে নিয়ে আজ সোজা কলকাতায় ফিরব।’ এই বলে সে ফাঁকা জমিটার ওপর দিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে দূরে মিলিয়ে গেল।

প্রদীপ রায়ের অণুগল্প



স্বপ্নের ভাষা


নুকু বর্মন, রোল নম্বর...... চা...ই । উফঃ ! কী যে লিখিস ?
চাইর ছার চাইর— মোর রোল নাম্বার।
এসব ভাষা আর তোদের চলবে না রে।
ক্যানে চইলবে না মাস্টার, ক্যানে চইলবে না ?

আগেও বলছি এসব ভাষা দিয়ে আন্দোলন বা আর যাই হোক, লেখাপড়া চলে না।

ওই এক দুখান কথায় তো লেখিচোং মাস্টার মশাই।

তোকে কতবার বলছি ‘ডাল’ আর ‘ঠেইল’ এক জিনিস নয়.........

ক্যানে মাস্টার মোশাই— মুই যে দেখিচোং বাড়ির বগলোত কাঠোলের ঠেইলোত পখি বোসিয়া শুন দুপরোত ফটিক জল, ফটিক জল করে— উনায় তো মোর মনের ভাষাৎ কথা কয়। উনায় তো সোনার পখিও নোয়ায়, হীরার পখিও নোয়ায়। তোমার ‘ডালে’ বোসি থাকা ‘পাখি’লা কী বোইয়ের ভাষায় কথা কয় ?

দ্যাখ, দ্যাখ— মুখের ওপর তর্ক করিস না, ‘ডালের’ বদলে ‘ঠেইল’ লিখলে তোকে নম্বর দেব না— যতই তোর চোদ্দ গুষ্ঠির ভাষা হোক। হু—  হতচ্ছারা, পাখির ভাষা শেখাচ্ছে ।

তোমরায় না একদিন কইলেন মাস্টার, ভাষা দিবস না কি কয়, ইস ! ভুলি গেলুং। তা কইলেন, সগাকে মাঠত ড্যাকেয়া যে ‘মাতৃভাষা’ক সম্মান দিবার নাগে, এইলা হোইল আমার স্বপ্নের ভাষা।

কিন্তুক মাস্টার ! সেদিনকার কথালা মোর মনটাত চিন্তাত ফ্যালেয়া দিচে। রাতিবেলা যে স্বপ্ন দেখং সেইলা তো বইয়ের পাতাত ছাপা লেখালা নোয়ায়। তাইলে ক্যানে মাগোর (মায়ের) ভাষাক সম্মান দিবার কয়্যা ‘ঠেইল’ লেখিচোং বুলিয়া নোম্বর দিবার না চান।

ও হো হো... !
ক্যানে মোর শুন দুপরার পখিটাক ঠেইলোত মারিয়ে ‘সোনার পাখি’ বানেয়া ‘ডাল’ত বসেয়া দিবার চান, ক্যানে চান, মাস্টার !

শুভাশিস দাশের গল্প








সারপ্রাইজ

সকাল থেকেই আকাশের মুখটা ভার l কেমন একটা বিশ্রী পরিবর্তন ওয়েদারের
অবশ্য এখন এরকমই হয় কাল বৈশাখীর সময় তো !ছোটবেলায়ও  এমন হতো কিন্তু অকালবৈশাখী হতো না ! নিজের মনেই ভাবতে ভাবতে হাতের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছিল সুমনা !আজ রবিবার কিন্তু হলে কী হবে ছুটি নেই রিপনের l কাগজের অফিস তার উপর ভোটপর্ব চলছে। ওদের রবিবার বলে কিছু নেই তবে রেস্ট আছে ! বেশির ভাগই কেন জানি রিপন রাতের শিফট বেছে নিচ্ছে ইদানীং !
অবশ্য কোনদিন রিপনের দায়িত্বের খামতি দেখেনি সুমনা ! ওদের বিয়ে হয়েছিল দেখে শুনেই ! বিয়ের আগে কেউ কারো মুখ দেখেইনি ! মিমি হবার পরই রিপন রাতের শিফটটে ডিউটি টা বেশি করে নিচ্ছে ! কী জানি !
কলিং বেলের শব্দে এগিয়ে গিয়ে সুমনা দরজা খুলল ,বললো -আজ এত দেরী করলে বড় ?

রিপন ঘরে ঢুকতে ঢুকতে উত্তর দিলো,  একটু কাজ ছিল তবে অফিসের না !

যাও রেষ্ট নাও আমি চা আনছি !
না না চা না ,এখন দশটা বাজে এরপর বাজারে কিছুই মিলবে না, বলে রিপন বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো !

মিমির বয়সও দেখতে দেখতে তিনে পড়ল ! সংসারের খরচ বেড়েই চলেছে l সুমনার মনে হয় যদি সংসারের জন্য কিছু করতে পারতো l একবার প্রাইমারী স্কুলের ইন্টারভিউর কল লেটার এসেছিল ,পাড়ার পরি দা বলেছিল রিপন চিন্তা করিস না তোর বউয়ের চাকরিটা এবার করে দেব !পরিতোষ দত্ত ,ডাকসাইটে নেতা l কিচ্ছুই হয়নি উল্টে একটি সাব এডিটেরিয়াল পড়ে সম্পাদক মহাশয়কে রিপনের নামে কমপ্লেন করেছিল আসলে নেতারা চায় একটু তল্পি ধারক হোক লিখিয়েরা ! সবাই তো আর মাথা বেঁচে না আর রিপনের আদর্শ সুমনার অজানা নয় সে ভাঙ্গবে অথচ মচকাবে না l

দুপুরের খাবার টেবিলে বসে সুমনা বললো, কাল মিমির জন্মদিন মনে আছে তো ? কাল আবার রাতের শিফট  নিও না যেন !

ধুর !পাগল !আমার মায়ের জন্মদিন আর আমি রাতে ডিউটি করবো ?তোমার কি মনে হয় আমার কোন চেতনা নেই ?
রাতে ডিউটি কেন করি তা সময় এলেই টের পাবে !

রিপনের কথাগুলো শুনে সুমনা আবার বলতে শুরু করে, জানো, তোমাকে না এখন অবধি বুঝে উঠতে পারলাম না !কলেজ জীবনে শুনতাম লেখালিখির জগতের মানুষেরা একটু বোহেমিয়ান টাইপের হয় ! তুমি দেখছি সম্পূর্ণ উল্টো !

রিপন আর হাসি চেপে রাখতে পারলনা l
সুমনা বললো, হাসছো যে ?

তা হাসব না ! লিখলেই কী তাঁরা অগোছালো হয় ? আর আমি কী এমন লেখক ? করি তো একটা দৈনিক পত্রিকার আফিসে মাস মাইনের চাকরি !খবর লিখি আর দু চারটে ফিচার ! অবশ্য ছাত্র জীবনে কবি হবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সত্যি বলতে কি সেরকম কবিতা আজ অবধি লিখে উঠতে পারিনি !

সুমনা এবার বললো, হ্যাগো তোমাদের কাগজের অফিসে মেয়ে কর্মী নেই ?

হ্যাঁ ! আছে তো ! কেন সেদিন কাগজে দেখালে না সিএম এর ইন্টারভিউ ?
ওই সুতপা সরকারই তো আমাদের সুতপা দি ! উনি আমাদের অনেক সিনিয়র ! আমি তো ওনার কাছেই সমস্যা হলে যাই !
উচ্চ শিক্ষিতা আর খুব বিনয়ী ! একদম আমার বারাসাতের বড়দির মতো !

বাব্বা ! আমি অন্য কারণে বললাম আর তুমি একদম ইতিহাস শুরু করে দিলে !সুমনা বললো -বললাম আমাকে তোমাদের আফিসে নেবে না ? সম্পাদকের সাথে তোমার তো বেশ খাতির আছে শুনেছি !

রিপন প্রায় লাফ দিয়ে ওঠার মতো..বললো, তোমাকে ? না তুমি মিমিকে মানুষ করো তোমার মাথা থেকে চাকরির ভূত তাড়াও তো !

সুমনা বললো, তাহলে আমার এতগুলো ডিগ্রি কি কেবল ট্রাংকের ভিতর ঘুন পোকা কেটে যাবে সারা জীবন !

সে হবে ক্ষণ বলে উঠে পড়ল রিপন !


আজ ঘনঘন লোডশেডিং হচ্ছে অবশ্য আফিসে তা টের পাবার উপায় নেই l রাত বারটা বাজে ! প্রবল ঝড় শুরু হলো l কোথাও ভয়ংকর আওয়াজ করে বাজ পড়ল ! অফিসের লাইটটাও হঠাৎ নিভে গেলো কিন্তু নীচে তো জেনারেটর চলছে !রিপন হাতড়ে টেবিলে রাখা মোবাইলটা নিয়ে আলো জ্বাললো কিন্তু এরকম কখনো হয়নি উপরের পুরোটাই আলো হীন হয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো l কাগজ রেডি l পাশের টেবিলের মলয়দা সবে কালকের কাজ সেরে মাথা টেবিলে রেখেছেন ! হুড়মুড় করে উঠে বললো, রিপন কী হলো ?

রিপন বললো, দাদা বাইরে দুর্যোগ ! আলো নিভে গেছে !

তা নাইট গার্ড নরেশ কে ডাকো !

নিচে তো সব ঠিকঠাক চলছে ! রিপন ফোনে নরেশ কে ডাক দিলো l

নরেশ এসে রিপন কে বললো, পাশেই বাজ পড়েছে দাদা ! হয়তো আমাদের উপরের সার্কিটে কোন ফল্ট হয়েছে।  আমি নীচ থেকে ইমার্জেন্সি লাইনটা দিয়ে দিচ্ছি !

কাগজের অফিস আলো ছাড়া চলবে না দু তিন রকমের ব্যবস্থা আছে l
ভাগ্যিস মেশিন ঘরের ফল্ট হয়নি নইলে কালকের কাগজ তো মার খেয়ে যেতো l
মিনিট দশেক অন্ধকার ! যেন ভূতপুরী !
বাইরের ঝড়ের দাপট একটুও কমেনি l আলো চলে এলো ! নরেশও এলো l
নরেশ বললো, দাদা আজ আর পড়ব না !বাইরের যা অবস্থা তার উপর কাগজ রেডি হতে সময় নেবে তো !

তা তুই কি কাগজ রেডি করবি ?

হঠাৎ সুমনার ফোন এলো, রিপনের বুকটা কেমন করে উঠলো। এই ঝড় বাদলের রাতে একা একা ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে থাকে !

অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো -ঠিক আছো তো ?
হ্যাঁ তোমরা ?
ঠিক আছি ! ঝড়ের গতি বড় মারত্মক মনে হচ্ছে ! সুমনা বললো l
সাবধানে থেকো !শুভ রাত্রি !

রিপন ফোন রাখতেই নরেশ জিজ্ঞেস করলো বৌদিমণি ?

হ্যারে ! একা বাচ্চা নিয়ে থাকে !এই ঝড় বাদলের রাত একটু তো ভয় পাবে তারউপর বাড়ির মালিকরা আজ সকালেই দিল্লি গেছে !

রিপন বললো -কালকের পড়া হয়েছে ?
নরেশ উত্তর দেয় -হ্যাঁ ! তবে ভালো হয়নি !ঠিক আছে কাল তাহলে পুরো চ্যাপ্টার টা দিবি ! মনে থাকবে ?

নরেশ মাথা নেড়ে চলে যায় !

ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে নিজে এককাপ আর মলয় দার দিকে এককাপ এগিয়ে দেয় রিপন l

এক চুমুক দিয়েই মলয় বোস বলে বসে আচ্ছা রিপন তুমি নরেশ কে কী পড়াচ্ছ গো ?রোজ রাতে কাজের শেষে কী সব বুঝিয়ে দাও ?শুনেছি ওতো ম্যাট্রিক মাস করেছে ?

রিপন বলে -না গো দাদা ও বি এ  পাশ !নকশাল আন্দোলনের সময় পুলিশের খাতায় লাল দাগ পড়েছিল তাই চাকরি হয়নি সরকারি আফিসে তবে আমাদের অফিসে আসার আগে ও কাগজের সম্পাদক কে সব খুলেই বলেছিল l বিভাস দা আপত্তি করেনি !তবে দেখেননি অনেক সময় ও আমার পাশে বসে খবর এডিটিং করছে ?

ওর ইচ্ছে প্রাইভেটে এম এ  দেবে তাই দেখিয়ে নেয় !

ও তাই তো তুমিও তো সেটা পাশ করা !
আর কী !কপালে যা লেখা থাকে তার বাইরে কেউ যেতে পারে না বুঝলেন দাদা ?

মলয় বাবু বললেন -তুমি ভাগ্য বিশ্বাস কর ?

হ্যাঁ !একশ ভাগ !রিপন উত্তর দেয় l জানেন ভাগ্য না সহায় হলে কেউ এক চুল নড়তে পারে না আর এর প্রমাণও আছে ভুরি ভুরি !

ভোরের পাখিরা ডাকছে !দু চোখ কচলে নিয়ে রিপন বললো, কাল তো দেখা হচ্ছে না মলয় দা !

মলয় বাবু বলেন, কেন ?
আমি একটু ইমার্জেন্সি ছুটি নিয়েছি একদিনের !

কী আছে ?
আর বলবেন না ....কাল আমার মেয়ের জন্মদিন ! গিন্নি আগেই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে ! আর কিছুই না ! এদিন টা বাড়িতে থাকা আর কি ! ওই ঘুপচি একটু ভাড়া বাড়ি !


আজ" ভোরবেলা "দৈনিকের জন্মদিন !অফিসে অনুষ্ঠান আছে রিপন জানে আজকে একটা সারপ্রাইজ আছে সবার জন্য ! সন্ধ্যায় সবাই এলো অফিসের হল ঘরে ! আজ প্রধান সম্পাদক অমরেশ সেন আসবেন কলকাতা থেকে l

যথা সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হলো l হল ভর্তি কাগজের কর্মী দিয়ে l নরেশ আগেই হিসেব করে প্যাকেট আনিয়ে রেখেছিল ,এসব কথা কেবল রিপন এবং সম্পাদক মহাশয়  জানত।

অনুষ্ঠান শুরু হলো l ভাষণ পর্বে অমরেশ সেন বলতে উঠলেন l উপস্থিত সবাইকে কাগজের অগ্রগতির জন্য অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানালেন l এইবার সেই সারপ্রাইজ !অমরেশ সেন নরেশ কে স্টেজে ডাকলেন l রিপনের চোখ দুটো চক চক করে উঠলো কেননা নরেশের এই সাফল্য যে কিছুটা তারই জন্য l অমরেশ সেন বললেন, নরেশ আমার নাইট গার্ড পদে থেকেও কাজের ফাঁকে পড়াশুনা করে আজ এম এ পাস করেছে l ওর যোগ্যতা কে মূল্য দিয়ে আমি কাল থেকে ওকে আমাদের সাব এডিটর পদে নিয়োগের নির্দেশ দিলাম আর ওর এই সাফল্য যাঁর জন্য তিনি আমাদের রিপন ল

হল ঘর করতালিতে মুখর হয়ে উঠলো l
নরেশ কিছু বলতে গেল ....কিন্তু ওর গলা ধরে এলো। রিপন পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখের কোণে স্পর্শ করল l

মলয় মজুমদারের গল্প



আচানক


সকালে ঘুম ভাঙতেই অভয়া সোজা উঠে গেলো চিলে কোঠায় । তবে ঠিক চিলে কোঠা নয় । অভয়ার ‘ছবি ঘর’ । বেশ বড়ো ঘর । বারো বাই চব্বিশ । বাবার মৃত্যুর অনেক আগেই বানিয়ে দিয়েছিলেন । নামটা বাবাই দিয়েছিলেন ‘ছবি ঘর’ । কোলকাতা গর্ভমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে পাশ করেছে প্রায় পনের বছর আগে । ফিরতে চায়নি । কিন্ত ফিরতে হয়েছে । মায়ের জন্যে । বাবা মারা যাবার পর মা একদম একা । দাদা চাকরি নিয়ে বিদেশে,বিয়ে করে ওখানেই সংসার পেতেছে  । এখন বাড়িতে মা ও অভয়া ।  বিয়ে করাটা হয়নি । অনির্বাণ অনেকদিন অপেক্ষা করেছে ।  তারপর ফিরে গেছে ।


ঘরের দরজা খুলে কাল রাতের ছবির ক্যানভাসটার কাছে চলে এলো । এক দৃস্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ । কি এঁকেছে সে ভোর তিনটে অব্দি ? নিজের কাছেই প্রশ্ন করলো । যত গভীর ভাবে ছবিটার মধ্যে ডুবতে থাকলো , মাথার মধ্যে একের পর এক প্রশ্ন মাথাচারা দিতে থাকলো । অনেক অনেক দিন ধরে এই থিমটা নিয়ে সে ভেবেছে । অনেক কিছু বলার ইচ্ছে ছিল । কিন্তু মনে হচ্ছে কিছুই বলতে পারেনি । যে অবগাহন আঁধার ও আলোর পথটার মাঝে অন্য একটা পথের সন্ধান করতে বেড়িয়েছিল ক্যানভাস আর তুলিতে , তার কিছুই চোখে পড়ছে না । মনে হচ্ছে শুধু কিছু ছোপছোপ দাগ,ক্যানভাসের শরীরে দাগিয়ে রেখেছে । আলো বা অন্ধকার অথবা তার মাঝের যে দিশা সে দেখেছিল চিন্তার অবগাহনে , কোন কিছুই সে ছবির ক্যানভাসে মধ্যে খুঁজে পাচ্ছে না । অথচ কত রাত কত দিন কত মূহুর্ত শুধু ভেবেছে এই একটা ছবির জন্যে । কিন্তু আজ তার চোখের সামনে যা আছে , সেটা যে তার ভাবনার ধারে কাছে আনতে পারেনি, খুব ভালো করে অনুভব করতে পারছে অভয়া । সে ধপ করে বসে পড়লো  ক্যানভাসের সামনে রাখা একটা চেয়ারে ।


চারিদিকে ছবির ছড়াছড়ি । দু’তিনটে ক্যানভাসের স্ট্যান্ড । দেওয়াল জুড়ে ছবি । কিন্তু একদম গোছানো না । ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা । মেঝেতে রঙের দাগ । দু’তিনটে চেয়ার ও কিছু টুল । একদিকে গাদা করে রাখা কিছু ছবি । কিছু মেয়েলি জিনিস পত্তর । বেশ কিছু বই । কিন্তু  সাজানো নয় । যেভাবে মেয়েদের রাখার স্বভাব । সেই স্বভাবের কোন চিহ্ন নেই । একদম অন্য রকম ।  অগোছালো পুরো । কিছুটা বিভ্রান্তের মতো বসে থাকতে থাকতে ছোট্ট টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে ফেললো । একরাশ ধোঁয়া টেনে আবার ছেড়ে দিলো । প্রথম টানেই মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠলো । ক্লান্তির ডানা ছাঁটা রোদের মতো পুরো শরীরটাকে এলিয়ে দিলো চেয়ারের উপর । বহুদিনের অভ্যাস , কিন্তু সকালে উঠে প্রথম সিগারেট অভয়ার শরীরের এই রকম ক্লান্তি এনে দেয় । এই অবস্থায় অভয়া কোন চিন্তা করতে পারে না । ক্লান্তির সাথে সুখটাও অনুভব করে সে ।


মায়ের ডাক কানে আসতেই, অভয়া, সিগারেটটা নিভিয়ে উঠে পড়লো চেয়ার থেকে । মনটা ঠিক নেই । একটা যন্ত্রণা বুকের কাছে এসে আটকে আছে । ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে এসে দেখলো, তার ফোনে চারটে মিস কল জমে আছে । অভয়াকে দেখে মা বললো,’সেই কখন থেকে ফোনটা বাজছে, ডেকে তো সাড়া পাছিলাম না তোর । কি করছিলি ?’ অভয়া কিছু না বলে ফোনটা তুলে নাম্বারগুলো দেখলো । তিনটে নাম্বার পরিচিত । একটা তার কন্টাক্ট লিস্টের বাইরের নাম্বার । প্রথম সেই নাম্বারেই ডায়াল করলো । ওপার থেকে এক পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো । চেনা কন্ঠ ।

কিরে কেমন আছিস ?

ভালো । মে আই নো হুম ইজ অন দ্য লাইন ?

ওরে চিনতে পারলি না ? আমি অনির্বাণ ।

তুই... ?

এই মাত্র কোলকাতায় নামলাম । এখনো এয়ারপোর্টে । ট্যাক্সির জন্যে দাঁড়িয়ে আছি ।

বউ কোথায় ?

আসেনি সাথে । আর আসবে না ।

অনির্বাণ । লন্ডন প্রবাসী হয়েছে অনেকদিন, বউ নিয়ে । অভয়া কিছুটা থামলো । হঠাৎ এই রকম একটা কথা শুনতে হবে ভাবতে পারেনি ।

আর আসবে না , মানে ?

কি ভাবছিলি । আমি হেলো হেলো করে যাচ্ছি ! মানে সে আর আমার সাথে থাকতে পছন্দ করছে না । তাই আমেরিকায় চাকরি নিয়ে  চলে গেছে ।

আর ছেলে মেয়ে ? ওরা কোথায় ?

আমার সাথে । ওরাও এসেছে । তুই কোথায় কোলকাতা নাকি শিলিগুড়ি ?

শিলিগুড়িতে । কিন্তু তোর কথা গুলো ঠিক হজম করতে পারছি না ।

দেখা হলে হজম করিয়ে দেবো

কিন্তু তার জন্যে তো তোকে শিলিগুড়ি আসতে হবে ।

শোন ! ট্যাক্সি পেয়ে গেছি । তোকে পরে ফোন করবো । বাই ।


আগের স্বভাবটা এখনো যায়নি অনির্বাণের । কথার মাঝ পথেই ফোন কেটে দেবে । কিন্তু অভয়ার মনটা একটু কেমন ঘোরালো হয়ে উঠলো । ছেলে মেয়ে নিয়ে একা অনির্বাণ । আবার কোলকাতায় নেমেই ফোন, কেমন যেন অস্বস্তিদায়ক । সকালটা কেমন যেন নষ্ট হয়ে গেলো সবদিক দিয়ে । ছবির ব্যাপারটা ভাবতে পারছে না আর আবার অনির্বাণকেও ভাবতে পারছে না ।  ছবির ব্যর্থতা এতক্ষণ তার মনকে জাপ্টে ছিল, কিন্তু অনির্বাণের ফোনটা সব কিছু তছনছ করে দিলো,ভাবনা এখন বিকলাঙ্গ জীবনের মতো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে ।


প্রথম প্রেম ব্যাপারটা অভয়ার কখন হয়নি । প্রেমের ঈশারার আগেই , শরীর বিনিময়টা হয়ে গেছিলো । শরীর বিনিময় হলে, প্রথম প্রেমের গল্প হয় না । সেটা রেপ ছিল, না শরীরের চাহিদা, এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি । শরীরে সুখ পেয়েছিল । ভালো লেগেছিল । কিন্তু মন ?  সেখানে কোন মনের কথা ছিলো না । শুধু শরীর ছিল ।  তখন সে সতেরো ।


অনির্বাণ যেদিন প্রথম চুমু খেয়েছিল । ঠোঁট থেকে ঠোঁট আলগা হবার পর অনির্বাণকে বলেছিল,’তুই হয়তো ভুল বুঝবি । কিন্তু তোর কাছে সত্যটা গোপন করতে চাই না। সত্য হলো এটা যে আমি ভার্জিন না’। মানতে পারেনি ।  দু’সপ্তাহ কথা বলেনি । সে কি রাগ । চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছিল । মুখের কথাগুলো কেমন যেন আটকে যাচ্ছিল অনির্বাণের । অভয়া সেদিন অনির্বাণের চোখে ঘৃণা দেখেছিল । সে ঘৃণার ভাষা কি ভয়াবহ, তা সেদিন সে কোন শব্দের নিরিখে আনতে পারেনি । শুধু অনুভব করেছিল মনে, একটা যেন তরল বিষ অর্নিবাণের চোখ দিয়ে ধেয়ে এসেছিল অভয়ার দিকে । সব কিছু দেখেও অভয়া নিশ্চুপ ছিল । কথা বাড়ায় নি । ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে , অনির্বাণ হেঁটে চলে গিয়েছিল একা একা ,পিছন ফিরে তাকায়নি একবারও  । পার্কস্ট্রীট মোড়ে একা একা দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছিল অনির্বাণের চলে যাওয়া ।


নিজের ঘরে এসে আবার একটা সিগারেট ধরালো । কিছুটা ভাবার চেষ্টা , অন্যকিছু বা অন্য রকম । সব কিছুর থেকে আলাদা । অনির্বাণ অথবা ওই ছবিটা । কিন্তু ভাবনাতে কিছু আসছে না । শুধু সিগারেটে অনর্গল টান মুখটাক  কেমন বিস্বাদ তিতকুটে হয়ে পড়েছে । জীবটা কেমন যেন পোড়া পোড়া লাগছে । স্বাদহীন যেমন হয় ।


সকালের রান্নাটা মা করে । তাই ওই দিকে খেয়াল দিতে হয় না । সিগারেটের গন্ধ পেয়ে এরই মধ্যে মায়ের কাছ থেকে ধমকের শব্দগুলো কানে এসেছে । কিন্তু উত্তরে কিছু বলেনি । শুধু ফোনটা হাতে নেড়ে কখনো ফেসবুক অথবা হোটাসঅ্যাপের মেসেজগুলো দেখেছে , কিছু উত্তর দিয়েছে , কিছু দেয়নি ।


কলিং বেলটা বাজতেই ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা খুলে দেখলো, দাদা । ভীষণ অবাক ভাবে তাকিয়ে । সাথে ঝরণা ও মিঠু । আর সার সার করে দাঁড়া করানো প্রচুর লাগেজ ।



কি ব্যাপার । হঠাৎ ? কোন খবর তো দিসনি যে তোরা আসবি ?

হা । হঠাৎ করেই সব কিছু হয়ে গেলো । পরে বলছি ।

বউদি কেমন আছো । আসো আসো । মিঠু তোর খবর কি ?


সবাই এক প্রকার ঘাড় নেড়ে  ভেতরে ঢুকে পড়লো । অভয়াও কথা বাড়ালো না । দেখেই বোঝা যাচ্ছে সবাই ক্লান্ত ও বিষাদগ্রস্থ । মাও ততক্ষণে রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে সবাইকে দেখে একদম অবাক । অবাক হলেও খুশির উজ্জ্বলতা মায়ের মুখটা বেশ ছাপিয়ে গেছে । ছেলে অন্ত প্রাণ , আর সেই ছেলেকে দুম করে চোখের সামনে দেখলে কার না মুখ উজ্জ্বল হবে ! কিন্তু অদ্ভুত ভাবে কেউ সে রকম বেশি কথা না বলেই দোতালায় চলে গেলো । মায়ের হাঁটুর ব্যথার জন্যে সিঁড়ি ভাঙতে পারে না । না হলে মাও ওদের পেছন পেছন উঠে যেতো । সিঁড়ি অব্দি গিয়ে মা ফিরে তাকালো অভয়ার দিকে । চোখের ইশারায় কিছু জানতে চাইলো । অভয়া কিছু বললো না। বলবেই বা কি, সেও তো কিছুই বুঝতে পারছে না ।


স্নান খাওয়া দাওয়া করে বেড়িয়ে যাবার সময়, দাদা ঘরে এসে ঢুকলো । চোখে মুখে একটা ক্লান্তির ছাপ, সাথে জড়িয়ে আছে বিষাদ ।

এখন বেরুবি নাকি ?

হা , আজ একটু দেরী হয়ে গেলো ।

কিন্তু তোর সাথে একটু যে কথাছিল । মানে বিষয় একটু জরুরী । বুঝতে পারছি না কোথা থেকে শুরু করবো ।

দাদার এই ভণিতা দেখে বেশ অবাক হলো অভয়া । এই রকম ভাবে কথা বলতে কখনো দেখেনি । বিশেষত মাল্টিন্যাশাল কোম্পানীতে সিনিয়র অ্যানালিসিসের চাকরি ফাইনাল হতে, দাদার অহংটা বেশ বেড়িয়ে এসেছিলো খোলস ছেড়ে ।

আজ না গেলে হবে না, বা একটু দেরীতে । কথাছিল ।

আছিস তো, রাতে না হয় কথা বলা যাবে  আরাম করে ।

জানিনা থাকবো কিনা , যে কোন সময় চলে যেতে হতে পারে ।

তুই এমন ভাবে কেন কথা বলছিস । কি হয়েছে ? খুলে বল । না বললে তো কিছুই বুঝতে পারছি না । এলি আর এসেই উপরে চলে গেলি ।

ঠিক আছে, তুই যা , যদি থাকি রাতে কথা হবে ।

কথাগুলো বলে দাদা ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো । সোজা উপরে । কোনদিকে তকালো না ।  বউদি বা মিঠু কারো দেখা নেই । গৃহ বন্দির মতো নিজেদেরকে গুটিয়ে রেখেছে দোতলার ঘরে । বেড়িয়ে যেতে যেতে অভয়ার মনে হলো, একবার দোতালায় গেলে ভালো হয় । কিন্তু গেলো না । গেটের দিকেই এগিয়ে গেলো চুপচাপ ।


বাড়ি থেকে বেরিয়েই রিকশা পেয়ে গেলো । অনেকটা দূর স্কুল । রাস্তা জ্যাম না থাকলে পনের থেকে বিশ মিনিট লেগে যায় । তবু রিকশাতেই যায় । টোটো বা অটো কোনটাই তার ভালো লাগে না । অনেক দিনের অভ্যাস ।  বেশ লাগে । কিন্তু আজ মনটা ভারাক্রান্ত । সকাল থেকে সব কিছুই কেমন উলটোপালটা হয়ে গেছে । অনির্বাণের ফোন, ছবির অপূর্ণতা । সব শেষে দাদা । দুম করে বিশাল লাগেজ নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ । তারপর গৃহবন্দির মতো দোতলায় আশ্রয় স্ত্রীকন্যাসহ । এমনটা কোনদিন হয়নি । দাদা এসেছে । পুরো বাড়ি হইহই করে গিফট বিতরণ । তারপর সারা দুপুর আড্ডা । দাদা বউদির লোক দেখানো বিদেশী প্রেমের খুনসুটি । কত কি ! মিঠুর ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে বউদির গর্ব । কিন্তু আজ একদম আলাদা ।  একটু অচেনা মনে হলো ওদেরকে ।


চিরকালই স্বার্থপরের স্বভাবের দাদা সৌরভ । ছাত্র জীবন থেকেই দেখেছে । নিজের কেরিয়ার ছাড়া আর কিছু ভাবেনি কোনদিন । বাবার খুব প্রিয়ছিল । অভয়া একদম উল্টো । তবে বাবা কিছু বলতেন না কখনো । মেয়ে তো । দেখতেও তো বেশ সুন্দরী । সেই তো ঘর সংসার করবে । এই রকম একটা ভাব অভয়া লক্ষ্য করেছে বহুবার । বাবা ও মায়ের মধ্যে । কিন্তু অভয়া সেই সব চিন্তাকে কোনদিন আমল দেয়নি । ছবি নিয়ে নিজের একটা আলাদা জগত গড়েছে । যেটা তার একদম নিজের । প্রায় জেদ করেই কোলকাতায় আর্ট শিখতে গিয়েছিল । অনেক বার বারণ করেছিল সবাই । কিন্তু সে শোনেনি । তবে শেষ পর্যন্ত বাবা মেনে নিয়েছিল । ওই ‘ছবিঘর’টা বাবা নিজেই বানিয়ে দিয়েছিল অভয়ার জন্যে ।  তখনও আর্ট কলেজের পড়া শেষ হয়নি । ছুটিছাটাতে আসলে, ওই ঘরটাতেই সে তার কাজগুলো করতো । ভালো লাগতো । তবে চিরকালের ইচ্ছেটাকে সে পারেনি পরিপূর্ণ করতে । বাবার হঠাৎ মৃত্যুতে অভয়ার ইচ্ছেটা অসমাপ্ত থেকে গেলো জীবনে ।


ইচ্ছেগুলো কেমন যেন ভঙ্গুর হয়ে গেছে ।  স্কুলে এসেও চিন্তার রেশটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না । ছবি-অনির্বাণ-দাদা । তিনটে যেন রহস্যের মহাপ্রলয় । বেশছিল । উদভ্রান্ত সে চিরকালই । বিশেষ করে বাবা মারা যাবার পর থেকে । পরিচিত অনেকেই খেপী বলে ডাকে মাঝে মাঝে । অনির্বাণ জীবন থেকে চলে যাবার পরে যে জীবনে কোন পুরুষ আসেনি । তা নয় । কিন্তু কেউ দাগ রাখতে পারেনি । কেউ কেউ তো স্মৃতির এতো আড়ালে চলে গেছে । মনেই পড়ে না । অনির্বাণকেও তো ভুলে গিয়েছিল প্রায় । কিন্তু আজ আবার শুকিয়ে যাওয়া ঘায়ে , যেন একটা সূঁচের ফুটো ঢুকে বসলো । ছবির ঘাটা দগদগে । কিন্তু কে জানে, সেটা কিন্তু মনের মধ্যে সে রকম ক্রিয়া করছে না । তবে মনটা হতাশায় ছেয়ে যাচ্ছে ।


বাড়ি রওনা দিতে দিতে বিকেল পাঁচটা বেজেই গেলো । আসার সময় ভেবেছিল জরুরী কাজগুলো সেরে বাড়ি চলে যাবে । কিন্তু সে ভুলে গেছিলো, যে কেরালা থেকে কিছু আর্টিস্ট আসবে । আর সেই একমাত্র আর্টের টিচার এই স্কুলে । সকালে ঘটনাগুলো নিয়ে চিন্তা করতে করতে ভুলে গেছিলো বিষয়টা । বেশ কয়েকজন । প্রত্যেকেই ছবি আঁকা জগতে পরিচিত নাম । এদের মধ্যে যতক্ষণ ছিল । কিছুটা শান্তি এসেছিল । কিন্তু স্কুল থেকে বেড় হতেই, সেই চিন্তাগুলো মৌসুমী বায়ুর মতো দখল করে বসলো, মনের মধ্যে ।  স্কুল থেকে বেরিয়ে সেই রিকশা ।  দাদার কথা শুনে না আসলে, ভীষণ কেলেঙ্কারী হয়ে যেতো ।


(২)


বাড়ি ঢুকেই অভয়া কিছুটা অবাক ।  যে ভাবে এসেছিল  দাদা, বিরাট লাগেজের বোঝা নিয়ে । ঠিক সেই ভাবেই সব লাগেজ বাড়ির গেটে কাছে নামিয়ে এনেছে ।  বউদি,মিঠু ও দাদা, সবাই রেডি ।

কিরে এই এলি , আবার চলে যাচ্ছিস ।

হা ।

হঠাৎ এলি , আবার  হঠাৎ চলে যাচ্ছিস । ব্যাপারটা কি ? খুলে বলবি ?

কিছু না । আমাদের তো যেতেই হবে । তাই দেরি করে লাভ নেই । এখান থেকে কোলকাতা , কোলকাতা থেকে জার্মান ।

বেশ । কিন্তু অবাক করা কান্ড কিন্তু দেখালি । কিছু বললি না । আমেরিকার বদলে জার্মান । সব কেমন যেন গোলমেলে ।

তুই বুঝবি না । থাকিস তো শিলিগুড়িতে , পৃথিবীর খবর রাখবি কি করে ?

তুই আবার পৃথিবীর খবর নিয়ে কবে থেকে ভাবতে শুরু করলি । তোর তো একটাই মন্ত্র ছিল ‘আপন সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’ ।

বাদ দে তোর সাথে তর্ক করতে চাইনা । ভালো থাকিস ।


কথাগুলো শেষ করেই তিন জনে বেরিয়ে গেলো । অভয়া ওদের চলে যাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো অবাক দৃস্টিতে । পাশে মা, চোখে জল নিয়ে দাঁড়িয়ে । স্বাভাবিক । 


পৃথিবীতে অনেক পুরুষ দেখেছে । কিন্তু দাদার মতো স্বার্থপর মানুষ আর চোখে পড়েনি ।  সে কিনা বলে পৃথিবীর খবরের কথা । অদ্ভুত লাগলো শুনতে ।  বাবা ও দাদার স্বভাব প্রায় একি রকম । এরা দুজনেই কখনো নিজের প্রয়োজন ছাড়া কোন কাজ করেছে বলে মনে পড়ে না । দু’জনের স্বভাবের এতো মিল । অভয়াকে অবাক করেছে দিনের পর দিন । বাবার পুরো মনটা যেন দাদার মধ্যে কেউ বসিয়ে দিয়েছে ।  বউদি কিন্তু এমন ছিল না । কিন্তু একদিন আবিস্কার করলো, বউদির ভাষাতেও দাদাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে । এটা প্রেম না প্রয়োজন । কে জানে ।


অনির্বাণের স্বভাবটা প্রথমে মনে হয়েছিল একটু আলাদা । রাজনীতির সাথে যুক্তছিল । তাও আবার বাম-রাজনীতি । কিন্তু সেটা যে একটা মুখোশ বুঝতে অনেকটাই সময় লেগেছিল । শুনেছিল সত্তর দশকে অনির্বাণের বাবা আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকেছিল বহুকাল । প্রথম সারির নেতাদের সাথে । দেখাও হয়েছিল একবার । অনির্বাণের মধ্যে অনির্বাণের বাবার কোন লক্ষণ খুঁজে পায়নি । দরাজ এক পুরুষ । রাজনীতি থেকে সমাজ জীবন । এতো সুন্দর করে তুলে ধরেছিলেন । আজো ভুলতে পারে না অভয়া । মনে মনে সেই পুরুষটাকে খুঁজেছিল অনির্বাণের মধ্যে । কিন্তু পায়নি কোনদিন । যতদিন গেছে ধীরে ধীরে অনির্বাণের মনকে বুঝতে পেরেছে । দাদা-অনির্বাণ-বাবা, তিনজনকে একি আসনে বসাতে দেরি হয়নি অভয়ার । একদিকে অনির্বাণের বাবা , আর অন্যদিকে তিনজন । মাঝখানে অভয়া । অভয়ার জীবনের গল্প । পুরুষের প্রেম পর্ব । বাকি সব পুরুষরা সব আচানক, যারা এসেছিল জীবনের খাতায় । তারা শুধুই বিছানা পর্যন্ত । প্রেমে নেই । অনির্বাণ ? প্রেম ? কে জানে? তবে এটা বুঝতে সময় লাগেনি, অভয়ার পুরুষ অনির্বাণ না । সেটা অভয়া বুঝে গেছে অনির্বাণের বাবাকে দেখার পর ।


গীর্বাণী চক্রবর্তীর গল্প




আমি সুলগ্না বলছি


এই যে শুনছেন?  হ্যাঁ আপনাদের বলছি। একটা গল্প বলতে খুব ইচ্ছে করছে। শুনবেন? বলি তাহলে……… আমি সুলগ্না। আজকে আমার বিয়ে। ভেবেছিলাম সানাই বাজবে, রজনীগন্ধা, গোলাপের সুবাসে আমোদিত হবে চারিদিক। হাজার আলোর রোশনাইয়ে ভেসে যাবে বাড়ির আনাচ কানাচ । জানি না নিজের লোকজন এত নিষ্ঠুর হয় কি করে! শুধুমাত্র সৌম্যর সাথে বিয়ে দেবে না বলেই আমাকে লুকিয়ে রেখেছে ছোট পাহাড়ী জনপদের এই বাড়িটাতে। আমারও জেদ জানে না। সৌম্যকে যে আমি কথা দিয়েছি ওর কাছে আমি যাচ্ছি।
                                                                       

সৌম্য, আমার পল অনুপলে মিশে যাওয়া এক সত্ত্বা। আমার পরম প্রিয়, আমার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। বিয়ে পাগল ভাবছেন তো আমাকে। আসলে কি জানেন, মফস্বলের মেয়ে আমি। প্রথমবার বাবা মাকে ছেড়ে নিজের শহর থেকে বহুদূরে পড়তে যাই। আমি ছিলাম ওই যাকে বলে ঘরকুনো। বাড়ির বাইরে কিছুতেই মন বসাতে পারতাম না। সেই সময় সৌম্যই আমাকে আগলে রেখেছিল।
                                                                         

আমি যে বাড়িটাতে পেইংগেস্ট থাকতাম সেই বাড়ির ছেলে সৌম্য।একদিন ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে হঠাৎই ওর সাথে পরিচয়। ফাল্গুনের উথাল পাতাল হাওয়ায় সৌম্য উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। বিশাল ছাদে সৌম্যকে প্রথম বার দেখে একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। কে ওখানে ?  বলতেই ও আমার দিকে ঘুরে তাকায়। টানাটানা চোখের রোগা পাতলা ফরসা ছেলেটার মধ্যে ছিল কেমন যেন এক অমোঘ আকর্ষণ। নিজেই এগিয়ে গিয়ে আলাপ করি।
                     
তারপরে বহুবার সবার অলক্ষ্যে সৌম্যর সাথে দেখা হয়। তবে ওর বাড়ির ছাদেই বেশিরভাগ সময় দেখা হোত আর নয়ত বাড়ির বাইরে, তবে সেটা কদাচিৎ। ওদের বাড়িটা একটা অদ্ভুত বাড়ি ছিল জানেন ! বাড়ির নানা জায়গায় তাবিজ কবজ ঝোলান থাকত। আর ছাদে লাল শালু বাঁধা অজস্র তুলসীগাছ। সৌম্য অবশ্য বলেছিল ওর মা খুব ধার্মিক তাই এইসব তাবিজ কবজ আর তুলসী গাছের ছড়াছড়ি বাড়িতে।
                                                     
সেদিন সৌম্যের বাড়িতে নাম সংকীর্তনের আয়োজন করা হয়েছিল। পুরো একটা দিন ওর দেখা নেই। একটু অভিমান হয়, এত কি ব্যস্ততা একবার দেখা করা যায় না আমার সাথে। সত্যি বলছি তখন সৌম্যকে না দেখে  একদিন থাকতেও আমার ভীষণ কষ্ট হোত।আর থাকতে না পেরে সৌম্যদের ঘরে গেলাম। যদিও আমরা যারা পেইংগেস্ট তারা দোতলায় থাকতাম। একতলায় সৌম্যরা। খুব একটা দেখা হোত না ওর বাবা মা'র সাথে। ওনারা কারোর সাথেই খুব একটা মেলামেশা করতেন না। কেমন যেন নিঝুম হয়ে থাকত ওদের বাড়িটা। সৌম্যর টানেই গেলাম ওদের ঘরে।
                                                           
সৌম্যর মা ভীষণ ধার্মিক জানতাম কিন্তু মাথাটাও যে খারাপ সেদিন না গেলে জানতেই পারতাম না। সামনের বিশাল হল ঘরটাতে যজ্ঞ হচ্ছিল। সৌম্যর বাবা মা হোমকুন্ডের সামনে বসেছিল।বেশ কিছুক্ষণ এদিকওদিক দেখতে থাকি। ওদিকে নাম সংকীর্তন শুরু হয়ে গেছে।কিন্তু সৌম্যর দেখা নেই। শেষে একপ্রকার বাধ্য হয়েই সৌম্যর মাকে জিজ্ঞাসা করি, সৌম্য কোথায়?  ওকে তো দেখতে পাচ্ছি না।
                                                           
এক আশ্চর্য নিস্তব্ধতা সবাইকে যেন গ্রাস করে। তারপর যা হলো এখনও ভাবতে আমার অবাক লাগে। যাচ্ছেতাই ভাষায় সৌম্যর মা আমাকে অপমান করে ঘর থেকে বের করে দিল। আমি নাকি পাগল ! আমি নাকি নেশাগ্রস্থ ! বাবাকে মনে হয় ওরাই খবর দিয়েছিল।পরের দিন বাবা এসে আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। পরে শুনেছি সৌম্যকেও নাকি ওরা ঘরে আটকে রেখেছিল যাগযজ্ঞের বাহানা করে। কিন্তু আটকে রাখা অত সহজ নাকি ! সৌম্যও চলে এসেছে আমার সাথে। কত করে বাবা মাকে বললাম বিয়েটা দিয়ে দিতে।কে শোনে কার কথা ! তার বদলে আমাকে পাঠিয়ে দিল পাহাড়ি এলাকার এই বাড়িটাতে। এখানেও সৌম্য এসেছে আমার সাথে। একদিকে ভালোই হয়েছে, সৌম্য আর আমি এখন অনেকটা সময় কাটাতে পারি নিজেদের মত করে।
         
বলেছিলাম না আজকে আমার বিয়ে। কিন্তু সাজগোজ করার মত কিছুই হাতের কাছে নেই। শুধু ব্যাগে আমার খুব প্রিয় একটা লাল শারি ছিল। মা বোধহয় দিয়ে দিয়েছিল। ওটাই পড়েছি। আর সুন্দর করে একটা খোঁপা করেছি। ওহো বলতে তো ভুলেই গেছিআপনাদের, যেদিন আমাকে ওদের বাড়ি থেকে বের করে দিল সেদিন সৌম্যর মা তারস্বরে চেঁচাচ্ছিল আর  বলছিল, সৌম্য না কি সাত বছর আগে ছাদ থেকে পা পিছলে পড়ে গিয়ে মারা গেছে। বুঝুন কান্ড ! এটা কখনো হয় ?
                                                     
শুনতে পারছেন পায়ের আওয়াজ ? সৌম্য মনে হয় এসে গেছে । ওই যে দরজায় টোকা পড়ছে……………


সেন্ট মেরিজ এসাইলেমের দশ নম্বর ঘর সকালের নরম আলোয় তখন আলোকিত। তবে অন্যদিনের মত একবুক নিস্তব্ধতায় ডুবে নেই আজ ঘরটা। চারিদিকে এক অস্পষ্ট গুঞ্জন আলোড়িত হচ্ছে। একে একে জড়ো হওয়া ডাক্তার, নার্স এবং আরও অনেকে হতভম্ব বিহ্বল চোখে দেখে এসাইলেমে মাস কয়েক আগে আসা মানসিক ভারসাম্যহীন রুগী সুলগ্না একমাথা সিঁদুর নিয়ে নিথর দেহে খাটের ওপর পড়ে আছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ, যেন কারও হাত নিজের হাতের মধ্যে শক্ত করে ধরে আছে।



মহম্মদ লতিফ হোসেনের প্রবন্ধ






ছিটমহল সমস্যা এবং আমিনুর রাহমানের দুটি গল্প


ছিটমহল চর্চায় আঞ্চলিক লেখক হিসেবে আমরা যে সকল আখ্যানকারদের পাই, আমিনুর রাহমান তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বৃহৎ কোনও সৃষ্টি আমিনুর রাহমানের কলমে উঠে না এলেও, একজন সম্পাদক হিসেবে তাঁর খ্যাতি কোচবিহারের সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী মহলে সুপ্রশংসিত। দীর্ঘ পঁচিশ বৎসর ধরে তিনি সম্পাদনা করে চলেছেন বৈঠা  নামক একটি হাতে লেখা পত্রিকা।

 কোচবিহারে অবস্থিত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চল গীতালদহে তাঁর বেড়ে ওঠা এবং আজ অবধি সেখানে বসেই তিনি নিরন্তর সাহিত্য চর্চা করে চলেছেন। সীমান্ত কেন্দ্রিক সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায় বৈঠা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। আমরা আমিনুর রাহমানের লেখা ‘ছিটমহল’ এবং ‘নালাটুর ভাষা, সাকিনার চখুর পানি’ –এই দুটি গল্পকে খুঁজে পাই। দুটি গল্পই প্রকাশিত হয় বৈঠা  পত্রিকায়। 
আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের কারণে গল্প দুটির আখ্যান বাস্তবতায় নতুনত্বের ছোঁয়া লক্ষ করা যায়।

‘ছিটমহল’ গল্পটিতে নির্দিষ্ট কোনও কাহিনি নেই। কিছুটা প্রতিবেদনধর্মী এই রচনায় ‘স্থল সীমান্ত চুক্তি’ বিনিময় পূর্ববর্তী ছিটমহলের প্রকৃত বাস্তবতাকে কয়েকটি কথায় তুলে ধরা হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে বহিরাগত দুষ্কৃতিরা অপরাধ কর্মে লিপ্ত হয়ে ছিটমহলের বুকে আশ্রয় গ্রহণ করে। পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে তারা নিজেদেরকে আড়াল করতে পারে। শুধু বাইরের দস্যুরাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে ছিটমহলের মানুষেরাও এই অপরাধ কর্মে লিপ্ত থাকে। গল্পে কথাকার তাই বলেছেন –
এপাকে-ওপাকে অকাম-কুকাম করিয়া মানষি থানা-পুলিশের ভয়ে ছিটমহলত যায়া ছোপে থাকে। ছিটমহলের গিলাক মানষি কম না হয়। সুযোগ পাইলে উমরাও দোনোপাকে জল ঘোলা করি আইসে।                         
এর বাইরেও রয়েছে ছিটমহল আন্দোলনের প্রসঙ্গ। দরিদ্র শ্রমজীবী ছিটবাসীদের নিত্য দিনের সংকট প্রকটতর, তারা দেশ চায়, স্থায়ী নাগরিকত্ব চায়। দেশের দাবিতে তাই তারা জোটবদ্ধ হয় – ‘যে কোন দ্যাশের নাগরিক হওয়ায় খাইবে, হওয়ায় খাইবে’। আমিনুর রাহমান এই গল্পে গাঁজা চাষের প্রসঙ্গও উল্লেখ করেছেন। বলাবাহুল্য বিনিময় পূর্ববর্তী কালে গাঁজা চাষের বাড়বাড়ন্ত ছিটমহলগুলিতে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের পথকে চিহ্নিত করেছিল। সংবাদ পত্রের প্রতিবেদনেও এ জাতীয় খবরের শিরনাম বারবার আমাদের সামনে উঠে এসেছে। সাংবাদিক রক্তিম দাশের কলমে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আমরা দেখছি – ‘বাংলাদেশি ছিটমহলে ব্যাপক গাঁজার চাষ, নির্বিকার প্রশাসন।’ বিনিময় পরবর্তীকালেও আড়ালে আবডালে কোথাও কোথাও তা সক্রিয় থেকেছে। ৩১ মার্চ, ২০১৭-য় এই সময় –এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন – ‘আফিমের নয়া ডেরা কোচবিহার।’ এখানে আমরা দেখতে পাই ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগও ছিটমহল গুলিতে গাঁজা চাষের আধিক্যের কথা স্বীকার করেছেন। শুধু ছিটমহলের বাসিন্দারাই নয়, ভারত-বাংলাদেশের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও এর সাথে যুক্ত। ক্ষেত্র বিশেষে দেখা গেছে রাজনৈতিক দলের পরোক্ষ মদতও এতে রয়েছে। ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে একদিকে যেমন আন্দোলন সক্রিয় হয়ে উঠেছিল, অন্যদিকে তেমনি এই বিনিময় পক্রিয়াকে স্তব্ধ করবার জন্যও একশ্রেণীর অসাধু চক্র সর্বাত্মকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। অমর মিত্রের আখ্যানে আমরা এ জাতীয় চিত্রকে খুঁজে পেয়েছি। আমিনুর রাহমানের লেখাতেও আমরা এরকম ইঙ্গিত পাই –
গাঁজার চাষি, দুই দ্যাশের ব্যাঙ্কত জমা, কাচা টাকার পাহাড়ত বসি ফুক্কুৎ করি হাসে। দশের বাদে, দ্যাশের বাদে উনার নাই কোন মাথার বিষ। উনার কাছাত গোটায় দুনিয়া যে এখান ছিটমহল।                                         
ছিটমহল এভাবেই একদিকে অসহায় মানুষদের নিরন্তর সংগ্রামকে তুলে ধরে, বৈধ দেশের কাছে যে অঞ্চল, যে মানুষ এতদিন ব্রাত্য ছিল। আবার এই ছিটমহলই হয়ে ওঠে বৈধ দেশের দুষ্কৃতীদের অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রভূমি। এই গল্পে তেমন কোনও ব্যঞ্জনা নেই। প্রবাদ প্রবচনের ব্যবহার হলেও লোকায়ত জীবনের চালচিত্র তেমন খুঁজে পাই না। বিশেষ করে স্বল্প আয়তনের কারণে সামগ্রিকতায় পৌঁছানো সম্ভব হয়ে ওঠে না।

আমিনুর রাহমানের অপর একটি গল্প - ‘নালাটুর ভাষা, সাকিনার চখুর পানি’। এই গল্পটি কথাকার ‘সূর্যময় সিরাজ’ ছদ্মনামে লিখেছেন। নামকরণেই বোঝা যায় গল্পকার এখানে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী ভাষার ব্যবহার করেছেন। দুই দেশের পরিবেশ-সমাজ-ভাষা-সংস্কৃতি এক হলেও অদৃশ্য প্রাচীর কেন ছিটমহলকে আলাদা করে রেখেছে – এই আক্ষেপ থেকেই গল্পের ভূমিকাটি উঠে এসেছে –
ভারত আর বাংলাদ্যাশের ছিটমহলের মানষিগুলার ভাষা-সংস্কৃতি, জীবন-আচার অ্যাকে নাকান। অ্যাকে বাংলা ভাষা। অ্যাকে মাটির ঘেরান। নরম মাটির ভিতরাত, কোনপাকের গাছের শিপা যে কোন গাছের শিপাক ধরিছে সাপটে – ন্যাকা জোকা নাই। গাছের ছায়াত দোনোপাকে – মন জুড়ায়, পেরান জুড়ায়। তবু বলে ভূখণ্ড আলেদা।   
                               
স্বল্প আয়তনের এই গল্পে সাকিনা আর নালাটুর পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন প্রকট হয়ে উঠেছে। অজান্তেই বাংলাদেশের কন্যা সাকিনার বিয়ে হয় ছিটের অধিবাসী নালাটুর সাথে। বিয়ের পর সাকিনার সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে যায়। সে ভাবে –
এটা কোন দ্যাশ ? আজা নাই। মন্‌তিনী নাই। নাই শিক্ষা, নাই স্বাস্ত্য, নাই আইনের কোনো শাসন। 
সাকিনার এই মানসিকতায় অস্বাভাবিকতা নেই। ছিটনারীদের চেনা সংকট এখানে স্পষ্ট। দীর্ঘদিন বাদে নালাটু শ্বশুরবাড়ি যাবার পথে বি.এস.এফ-দের দ্বারা ধৃত হয়। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে নালাটুর জেল হয়, দীর্ঘদিন বাদে তাকে হয়তো পুশব্যাক্‌ করা হবে। কিন্তু নালাটুর কাছে বাংলাদেশেরও কোনও পরিচয়পত্র নেই। তাই তাকে হাজতবাস করতে হয় দিনের পর দিন। ছিটমহল বিনিময় পূর্ববর্তীকালে ভারত-বাংলাদেশে যে বিপুল সংখ্যক ছিটবাসী অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে কারাগারে নির্বাসিত হয়েছিল, আখ্যান বাস্তবতায় আমিনুর রহমান তারই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়েছেন।

পুশব্যাকে জীবনের কোনও নিশ্চয়তা থাকে না। অনেক সময় ধৃত ব্যক্তিদের নো ম্যান্‌স ল্যান্ডে এনে ছেড়ে দেওয়া হত। কেউ বাসভূমিতে ফেরে কিনা – এ বিষয়ে কোনও প্রশাসনই মাথা ঘামাত না। অনেক সময় অসহায় নিরাপরাধ ছিটবাসীদের গুলি করেও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এই গল্পে আমিনুর রাহমান নালাটুর মুক্তিলাভের ক্ষেত্রে   ভাষাকে কেন প্রতিবন্ধক করে তুলেছেন, তা নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে। তবে আমাদের মনে হয় ‘নালাটুর ভাষা’-কে কথাকার রূপক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আসলে নালাটুর ভাষাই তো ছিটমহলের ভাষা, আর সে ভাষা বোঝবার মতো সামর্থ্য দুই বাংলার কারোরই হয়তো ছিল না। দেশ হীন মানুষ গুলির মুখের ভাষাও যেন কোনও বিচ্ছিন্ন ছিটে পরিণত হয়েছে। গল্প কথকের কণ্ঠে আমরা তাই শুনতে পাই –
বাংলা ভাষার বাদে দুনিয়ার সৌগ ভাষার আজি জ্যাতো মান। সম্মান। কিন্তু দিল্লী তো বহু দূর। ঘরের কাইণ্ঠার দুই বাংলাও নালাটুর মনের ভাষা বুঝির পাইলেক না।                                       
শেষ অবধি নালাটুর আর ঘরে ফেরা হয় না। দিল্লী থেকে ঢাকা কোনও রাজধানীই নালাটুর বন্দীত্ব নিয়ে মাথা ঘামায় না। গল্পের ব্যঞ্জনাময় সমাপ্তিতে কথাকার ‘নেই দেশ’-এর মানুষ গুলির আঁতের কথাকেই যেন তুলে ধরতে চেয়েছেন –
চাইর পাকের মানী মানষি কি সন্দোর নিন্দত পড়ি আছে। সভ্য-স্বাধীন-প’জাবহুল, এক আচানক পিথিমীত নালাটু আর সাকিনার কোন দ্যাশ নাই ! জীবন আছে। ভিতর কুঠিত নদী আছে। আছে পানিও। কিন্তুক সতায় না। ঘুমসি ঘুমসি তুসের অগুণ জ্বলে !                   
এ আগুন কবে নিভবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বিনিময় পরবর্তী কালেও বদলে যাওয়া সংকটের সাপেক্ষে ছিটবাসীদের অন্তরতম অংশের দহন আর কত প্রজন্ম ধরে নিরন্তর সক্রিয় থাকবে – সে বিষয়ে আমরা পাঠকেরাও কোনও নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি না। আমিনুর রাহমানের আখ্যান আমাদের পাঠকদেরও এ জাতীয় প্রশ্নেরই মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়।     

অহি বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প




ইন্টারভিউ

দৈনিক 'নগর সমাচার' এমনিতেই বেশ নামকরা কাগজ।তার ওপর যখন বৈশাখের বিশেষ সংখ্যার জন্য সদ্য সাহিত্য একাডেমী পুরষ্কার প্রাপ্ত বিখ্যাত লেখক সুষেন মান্ডী'র ইন্টারভিউ নিতে আমায় পাঠানো হল তখন বেশ টেন্সড ছিলাম।

সত্যি বলতে কি আমার চাকরিটা হয়েছিলো বেশ কষ্ট করে।
খুব সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হলেও বাংলা সাহিত্যে একটা মাস্টার্স ডিগ্রি আর গল্প,কবিতার জগতের সাথে কিছু আলাপ থাকার জন্যই ওপর মহল থেকে হয়তো এই সুযোগটা আমায় দেওয়া হল!
সুষেন মান্ডীর ভাড়া বাড়ি মধ্য কলকাতার এক অপরিসর গলির মধ্যে।
এত নামকরা লেখক যে এমন ঘরে থাকবেন তা আগে থেকে আন্দাজ করতে পারিনি।

অবশ্য লেখক মাত্রেই তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার ধার ধারেন না শুধুমাত্র পরিবেশের গুণে একথা শুনেছিলাম বটে।
ঘরটা গলির ভেতর বলে বেশ নিরিবিলি।
সাধারণত লেখকদের ঘর যেমন হয়।ঘরের একদিকের দেওয়াল পুরোটাই আলমারি।যার কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে বই এর সারি তাছাড়া এদিক -ওদিক ছড়িয়ে আছে এমন কিছু বই যা নিয়ে সাম্প্রতিক কালে হয়তো উনি কাজ করছেন।

তার মধ্যে একটা শ্রী অমিয়নাথ স্যান্যালের লেখা 'স্মৃতির অতলে' আর একটা বই এর উপরে স্যার অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের ছবি দেওয়া।একটু দূরে রয়েছে বলেই নামটা পড়া যাচ্ছে না। উঠে গিয়ে বইয়ের নামটা দেখব কি না ভাবছি,এমন সময় ঘরে ঢুকলেন ঢুকলেন ভদ্রলোক।

সুষেন বাবুর চেহারায় কোন বিশিষ্টতা নেই। মধ্যে ষাটের এই ব্যক্তির পরনে সাধারণ লুঙ্গি,ওপরে পাতলা ফতুয়া।
হাইট আন্দাজ পাঁচ ফুট দশ কি এগারো।
গায়ের রঙ বেশ চাপা।

আমায় দেখে হাল্কা হেসে বললেন,আমার সম্মন্ধে কিচ্ছু নতুন বলার নেই মশাই।
আমার যা বাহ্যিক পরিচয় তা তো আপনারা একেবারে সব ঘেঁটে বের করেছেন। সমস্তটাই নিউজে দেখিয়েছেন পুরষ্কার পাওয়ার আগেই। একাডেমির পুরষ্কার কি আমায় একদিনেই বদলে দেবে নাকি,এ্যাঁ? হাঃ হাঃ হাঃ।

আমিও হেসে ফেললাম। বললাম না, স্যার, আসলে ব্যপারটা ঠিক তা নয়,এই দক্ষিণপন্থার জয়জয়কারের যুগে সবাই স্রেফ বাহ্যিক আবরণটা সকলে দ্যাখে,প্যাকেজিংটাই মুখ্য।

তা তুমি কি পেঁয়াজের খোলা ছাড়িয়ে আসল মানুষটা কে বুঝতে চাইছো?
বলেই আবার এক প্রস্থ হাসি।

হাসি থামিয়ে সুষেন বাবু জিজ্ঞেস করলেন,"কবিতা পড়া হয়?"

বললাম হয় একটু-আধটু।
ওই কিছু জয় গোঁসাই,কিছু রবীন্দ্রনাথ,কিছু সুভাষ মুখুজ্যে।

শুনে উনি খানিক্ষণ গম্ভীর থেকে বললেন,কবিতা এক ধরনের মানসিক উওরণের পথ জানো তো!
যারা একেবারেই কবিতা পড়ে না বা কবিতার মাধুর্য সম্বন্ধে যাদের কোন ধারণাই নেই তারা কিছুতেই "শখের লিখিয়ে"হওয়ার পরের চৌকাঠ টা ডিঙোতে পারে না। তা বলো তোমার কি প্রশ্ন করার আছে।

স্যার, আপনি প্রথমে রাজনৈতিক সাহিত্য লিখতেন। আপনার প্রথম উপন্যাস 'চিংড়ি' তে আপনি তুলে ধরেছিলেন যে কিভাবে ধানী জমিতে জোর করে নোনা জল ঢুকিয়ে দিয়ে চিংড়ি মাছের ভেড়ি বানিয়ে দেওয়া হয়। সেই উপন্যাস পাঠক মহলে তো বটেই এমনকি রাজনৈতিক মহলেও হুলুস্থুল ফেলে দিয়েছিলো।
শোনা যায় আপনাকে নাকি প্রচুর থ্রেটও শুনতে হয়েছে এই জন্যে! তারপর আপনি দীর্ঘকাল নিরুদ্দেশ ছিলেন। যদিও আদিবাসী জীবন এবং প্রকৃতি নিয়ে সেই সময় 'জঙ্গুলে' নামে একজন অজ্ঞাত পরিচয় লেখকের বই প্রকাশিত হয়।
দীর্ঘ সময় বাদে জানা যায় সেটা আপনারই ছদ্মনাম। লেখার মাধ্যম ও বিষয় নিয়ে এই মারাত্মক এক্সপেরিমেন্ট এর সিদ্ধান্ত কি হঠাৎই?

এই প্রশ্নে সুষেন বাবুর মুখে আবার হালকা হাসির আভাস দেখা গেল। খানিক্ষন অপেক্ষা করে যেন গোটা বিষয়টা সাজিয়ে নিয়ে উনি শুরু করলেন-
সাহিত্য মানেই তাতে কোন না কোন রাজনৈতিক মতামত থাকবেই। তা বলে তা কখনোই কারুর ধামা ধরার জন্য নয়।সেটা থাকবে সৃষ্টি কর্তার নিজস্ব বিশ্বাস,নিজস্ব সত্ত্বার জন্য। যাক সে কথা,
আমার পদবি শুনেই বুঝতে পারছো যে আমি এই বাংলার প্রান্তিক জঙ্গলমহলের মানুষ।তবে আমাদের বাড়ি ছিলো মফস্বলে,যাকে বলে জঙ্গল ঘেঁষা ছোট শহর। 'চিংড়ি' প্রকাশের পর নানা ভাবে আমাদের বাড়ির ওপর চাপ আসছিলো।
একদিন সামান্য দেওয়াল লিখন নিয়ে গঞ্জের কাছেই কিছু লোক আমার বাবা কে মারধোর করে,কেউ বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। ছোটবেলা থেকেই আদিবাসী দের পরব,তাদের বিশ্বাস,জীবনযাত্রা আমায় আকৃষ্ট করতো। দাদা তো সংসারের ভার আগেই নিয়েছিলেন। তাই আর কোন পিছুটান না রেখেই ঠিক করি সভ্যতার অবদান এই সমাজ আমার জন্য নয়। একদিন রাত্তির বেলা বাড়ি থেকে একরকম পালিয়েই অরণ্যের গভীরে চলে যাই। প্রথম প্রথম একটু সমস্যা হত। তবে মুখোশ আঁটা 'ভদ্দরলোকে'দের প্রতি আমার বিতৃষ্ণাই আমায় সাহায্য করেছিলো ওখানে টিকে থাকতে।
অবশেষে একদিন শাল গাছের ছায়ায় সূর্যাস্ত দেখেছিলাম। আদি-অনন্ত প্রকৃতির কাছে অ-কৃত্রিম সেই সব উপলব্ধি,নানকি মাহাতোর মাদলের বোল,সেখানকার অপার্থিব সমস্ত দৃশ্যময়তা আর আমায় ফিরে যেতে দেয় নি। এক-আধ দিন যা গেছি তা শুধুই পরিবারের সাথে দেখা করার জন্য। আসলে তখন অন্তরের ঘৃণা মুছিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি। ওই কষ্টি পাথরের মতো মানুষগুলোর কাছে জেনেছি সোনা আসলে গলায় বা কানে নয় থাকে মানুষের মনের গভীরে। তাই জন্যই আবার নতুন করে শহরে আসতে পেরেছিলাম।

জিজ্ঞেস করলাম শহরে এলেন কেন?

সেই প্রকৃতিকেই জানবার জন্যে ।শহুরে প্রকৃতি,শহুরে মানুষ কে দেখার সৌভাগ্য হয়নি কখনো।
--শহরে অসুবিধা হয়নি?
একটু অসুবিধা হত,মনে হত কি লিখব!
সমস্তটাই গতে বাঁধা। প্রথম প্রথম এই ঘরটায় যখন আসি তখন একে লোকে বলতো ভুতুড়ে ঘর,এই ঘরে দেওয়াল নাকি কথা বলে। আগে আগে আমল দিইনি। একদিন মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম চাঁদের আলো আর নভেম্বর মাসের কুয়াশা মিলে অপার্থিব ঔজ্জ্বল্যে ভরে আছে ঘরটা। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা কুকুর আর একটা মাতাল প্রায় গলাগলি করে ঘুমাচ্ছে। কাছের চার্চটায় ঘন্টা বাজলো,ঠিক যেন শমনের শব্দ। কাল নিদ্রায় আচ্ছন্ন সভ্যতার অবচেতনকে প্রহরে প্রহরে ঘা দেওয়ার জন্যই যেন ওর সৃষ্টি। জানিনা তখন কটা বাজে,একটা নাকি দুটো!
ধন্ধে পড়েছিলাম। সময়ের এই অনন্ত প্রবাহে স্থির মুক্তো বিন্দুর মত একি আমি না আমি রুপী অর্ধ-জাগ্রত চিরন্তন মানব সত্ত্বা? চারিদিকে এক অদ্ভুত বাঙ্ময় নিরবতার মধ্যে হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেকে। তার পরদিন থেকে ঘুরতে শুরু করি তিলোত্তমার পথে পথে। ক্রমশ উপলব্ধি হয় প্রকৃতি যেমন বন প্রান্তরে আছে তেমনই শহরেও আছে। শুধু তার প্রকাশ আলাদা,চেহারা আলাদা।
অন্তর বস্তুর ঐশ্বর্যে মানুষের মনকে মোহিত করে রাখার ক্ষমতা কিন্তু পুরোপুরি সমান। শহরে অন্ধি-সন্ধি,পথে ঘাটে চারদিকে কবিতা,গল্প ছড়িয়ে আছে।খুঁজে কুড়িয়ে শুধু কুড়িয়ে নেওয়ার অপেক্ষা। ইচ্ছে হলে গল্পের ওপর গল্প গেঁথে উপন্যাসের রুপ দাও।

ইন্টারভিউ শেষে বাড়ি ফেরার জন্য সুষেন বাবু নিজেই এগিয়ে দিতে চাইছিলেন গলি মুখ পর্যন্ত। আমি বাধা দিলাম, কারণ ক্যাব বুক করাই ছিলো। বাড়ি ফেরার পথে বারবার মানুষটার কথা যত মনে পড়ছিলো তত ভালোবেসে ফেলছিলাম আমার চিরচেনা কোলকাতাকে।
বারবার কৃতজ্ঞ হচ্ছিলাম আসন্ন বৈশাখের প্রথম দিনটার কাছে।




সত্যম ভট্টাচার্যের গল্প




বাসে একদিন


সুযোগটা যে এভাবে একদিন চলে আসবে প্রলয় তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।

এইশহরে ওরা এসেছে প্রায় বারো বছর হয়ে গেছে।আসার কিছুদিন পরেই মলিদির সাথে এক হেয়ার স্পেশালিস্টের চেম্বারে দেখা হয়ে গিয়েছিলো প্রলয়ের।বলা ভালো একদম কাকতালীয়ভাবেই।মলিদি এসেছিলো ওর বরকে সেখাতে।সেদিনই মলিদিকে দেখে প্রলয় জানলো বা বুঝলো যে মলিদির বিয়েও এই শহরেই হয়েছে।সেই ছোট্ট চেম্বারে মলিদির বর আর প্রলয় দুজনে দুজনকে দেখে আশ্বস্ত হয়েছিলো,কারণ চারিদিকে সেসময় সেখানে গিজগিজ করছিলো প্রমীলাকুল,আর কেবলমাত্র ওরা দুজনেই পুরুষ। তখোনো কিন্তু প্রলয় জানেনা যে সেই ভদ্রলোকই মলিদির বর।

যাই হোক সেদিন মলিদি কথা বলেনি প্রলয়ের সাথে।তার কারণও আছে।সদ্য সদ্য তখন প্রলয়ের নীলার সাথে ব্রেকআপটা হয়েছে।আর ওদের দুজনেরই খুব ভালো বন্ধু ছিলো মলিদি।তিনজন একসাথে মিলে কত আড্ডা মারা সেই মফস্বল শহরের চায়ের দোকানে, মাঠেঘাটে,রাস্তায়,কলেজে,রিক্সাভ্যানে যাতায়াতে।মলিদির বাড়িতেও নীলা আর প্রলয়ের ব্যাপারটা জানতো। হাঁটতে হাঁটতে ওরা দুজনে চলে যেত কোনদিন মলিদির বাড়িতে আড্ডা দিতে।মলিদিও এসেছিলো প্রলয়ের বাড়িতে।এমত অবস্থা থেকে যেদিন প্রলয় নীলার সাথে সম্পর্কটার ইতি ঘটাতে চেয়েছিলো,খুব গন্ডগোল হয়েছিলো ওদের মধ্যে। মলিদি প্রলয়কে ফোন করে খুব ধমকেছিলো। আর নীলা তো বলেইছিলো যে দেখে নেবে।দেখে নিতে খানিকটা পেরেওছিলো নীলা।আর তার কিছুদিন পরেই প্রলয় ওর মাকে নিয়ে ওদের পুরোনো বাড়ি ছেড়ে এই শহরে চলে আসে।

এরপর থেকে মাঝেমাঝেই বাসে মলিদিকে দেখতো প্রলয় আর ভগবানকে মনে মনে বলতো-প্লিজ,একটি বার আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দাও।ওর শুধু মনে হোতো মলিদিকে যদি বোঝানো যেত ওর সেই সময়ের পরিস্থিতি তাহলে মলিদিই হয়তো একমাত্র বুঝতো।বেশীরভাগই প্রলয় মলিদিকে দেখতো বাসে অফিস যাবার সময়।ও যেখানে বাস থেকে নামে সেখান থেকে আরো খানিকক্ষণ যাত্রাপথ মলিদির।প্রলয় জানে মলিদি কোন স্কুলে পড়ায়।শুধু মলিদিই না,ওদের তখনকার বন্ধুদের সবার খবরই রেখেছে ও।প্রলয় ভাবে শুধু ওরই খবর কেউ রাখেনি।খারাপ লাগে ওর মাঝেমাঝে।নীলা ওর সাথে এত গন্ডগোল করবার পরও প্রলয় ওর খবর রাখে।বাসে উঠেই প্রলয় খোঁজে মলিদি আছে কিনা বাসে।দেখলে আর বাসে জায়গা থাকলে প্রলয় চেষ্টা করে মলিদির সিটের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে যাতে কথা বলা যায় একটু।কিন্তু আজ অবধি পেরে ওঠেনি।ভয় লাগে ওর।যদি মলিদি রিএক্ট করে কোনো।যদি চেঁচিয়ে বলে ওঠে-আমি তোর কোন কথা শুনতে চাই না।কোথায় যাবে প্রলয় তাহলে।বাসে মানসম্মান বলে আর কিছু থাকবে না ওর ডেলিপ্যাসেঞ্জারদের মধ্যে।আবার মাঝেমাঝেই নিজেকে বলে প্রলয় কারো কি সম্ভব এতদিন ধরে মনে রাগ ধরে রাখা।আবার ভাবে মলিদির মনে আছে তো ওকে।যেভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে,ওকে দেখে বা না দেখে জানালা দিয়ে।কে জানে কোনটা ঠিক?এই এতগুলি বছরে মলিদি শুধু একদিনই তাকিয়েছিলো ওর চোখের দিকে।এসব ভাবতে ভাবতে এভাবেই কেটে গেছে প্রায় বারোটা বছর।কথা আর বলা হয়ে ওঠেনি।প্রলয়ের এখন প্রায় মাথা জোড়া টাক।মলিদিরও কয়েকটি পক্ককেশ দেখা যায় এদিক সেদিক।

সেদিন সকাল থেকেই মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছিলো।ছাতা নিয়ে আধভেজা হয়ে প্রলয় যখন বাসস্টপে এসে দাঁড়ালো তখন সেই বাসটাই এলো যেটাতে মলিদি বেশীরভাগ দিন থাকে।বাসটা আজ অদ্ভূত রকম ভাবে ফাঁকা ফাঁকা।মাত্র এক দুজন দাঁড়িয়ে আছে।সাধারণত এই বাসটায় এই স্টপেজে এত ভিড় থাকে যে সিঁড়ির খুব একটা ভেতরে প্রলয় যেতে পারে না।আজ উঠতেই প্রলয় দেখলো যে মলিদি সিঁড়ির একদম উল্টোদিকে একটা থ্রিসিটারের মাঝে বসে আছে।জানালার দিকে আরেক দিদিমণি।প্রলয় চেনে।মলিদিরই কলিগ।আর এদিকে একজন অচেনা ভদ্রলোক।বাসটা অনেকদূর যায়।অতএব আজও বসা বা কথা বলা হোলো না মলিদির সাথে।ভাবলো প্রলয়।কাছাকাছি এক দুজন চেনা লোক আছেন,বসে বা দাঁড়িয়ে।তাদের সাথেই টুকটাক কথা বলছিলো প্রলয়।এই যেমন স্কুল-গরম-ছুটি-বৃষ্টি এইসব নিয়ে।স্রেফ সময় কাটানো আর মুখচেনাটা বজায় রাখা।

আপাতত প্রলয় মলিদির সিটের দিক থেকে একটু সামনের দিকে চলে এসেছে।সিটটার পাশে এখন সঞ্জীবদা বলে একজন দাঁড়ানো।প্রলয় ওর দিকে ঘুরে ওর সাথেই কথা বলছিলো।ওর আধঘন্টার যাত্রাপথের প্রায় কুড়ি মিনিট চলে গেছে।এখানে একটা রেলগেট আছে।বাসটা ঘুরলো।প্রলয় নীচু হয়ে দেখলো আজ রেলগেট পড়েনি।ভালো।সময়ে পৌছনো যাবে।ঠিক এই সময়ই মলিদির পাশের ভদ্রলোক উঠে দাড়ালেন।প্রলয় ভাবলো হয়তো মানিব্যাগ বা মোবাইল বের করবেন পকেট থেকে তাই।কিন্তু না,উনি নামবেন।নিজের উপর খুব রাগ হোলো প্রলয়ের।ভাবলো আজ যদি ও দাঁড়ানো থাকতো ওখানেই,বসতে পারতো তাহলে মলিদির পাশে একটু।সুযোগটা এত কাছে এসেও চলে যাওয়াতে নিজের কপালকেই দুষলো প্রলয়।এখন স্বাভাবিকভাবেই সঞ্জীবদা বসবে ওখানে।যাবে অনেকটা দূর।কিন্তু একি?প্রলয় অবাক।সঞ্জীবদা ওকে বসার জন্য বলছে।

ডেলিপ্যাসেঞ্জাররা তো বলেনা এরকম বসতে কাউকে।প্রলয় যেন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে গেলো।তাহলে ও বসতে পারবে এতদিন পর মলিদির পাশে?একদুবার অনিচ্ছা সহকারে সঞ্জীবদাকে বললো বসতে।তারপর গিয়ে নিজেই বসে পড়লো মলিদির পাশে।

বাস চলছে।প্রলয় শুনতে পেলো অনেকদিন পর আজ আবার ওর বুকের ভেতর সেই আওয়াজটা হচ্ছে যেটা খুব উত্তেজনা হলে কৈশোর বা যৌবনে ও শুনতে পেতো।পারবে কি আজ ও মলিদির সাথে কথা বলতে?সিটটা দিয়ে ভগবান আজ ওকে একটা সুযোগ দিয়েছে,বারো বছর পর।মলিদিও কি বলবে ওর সাথে কথা।আপাতত মলিদি কথা বলছে  পাশে বসা ওর কলিগের সাথে।প্রলয় একটু জল খেলো ব্যাগ থেকে বোতল বের করে।হাতে সময় আর প্রায় একদমই নেই।প্রলয় নামার আগে নদীর ওপর যে ব্রীজটা পড়ে,বাসটা সেটা পার করলো।প্রলয় ভাবলো আর দেরী করা ঠিক হবে না।মলিদি কথা না বললেও তাড়াতাড়িই বাস থেকে নেমে যেতে পারবে ও।দরজা কাছেই আছে।আর বাকি সব পরে ভাবা যাবে।
           
নীচু গলায় প্রলয় বললো-কেমন আছো মলিদি?মলিদি ঘুরে তাকালো। প্রলয়ের বুকের মধ্যে তখন কেউ যেন হাতুড়ি পিটছে।কি করবে মলিদি এখন।প্রলয়কে কি বলে দেবে-আমি তোর সাথে কথা বলতে চাই না।কোনদিন কথা বলার চেষ্টা করবি না তুই আমার সাথে।কিন্তু তেমন কিছু হোলো না।মলিদি নীচু গলায় সেই বারো বছর আগের মতো করেই বললো-ভালো।তুই?পরের দু তিন মিনিট মলিদির সাথে জীবনের এই বারো বছরের গ্যাপটা নিজেই শেয়ার করে নিলো প্রলয়।মলিদির কাছেও জানতে চাইলো।মলিদিও বললো।বৃষ্টি তখন অনেকটা কমে গিয়ে চারিদিক আলো করে রোদ উঠছে।স্টপেজ এসে গেছে প্রলয়ের।কন্ডাক্টর বিকাশদা তাড়া দিচ্ছে গেটের কাছে যাবার জন্য।মন চাইছে না,কিন্তু নামার জন্য প্রলয় উঠে দাড়ালো সিট থেকে।মলিদিকে বললো-ভালো থেকো।মলিদিও স্নিগ্ধ হেসে বললো-তুইও ভালো থাকিস।মলিদির সেই হাসিতে বাইরের রোদ যেন আরো ঝলমল করে উঠলো।

দেবপ্রিয়া সরকারের গল্প




পুনশ্চ


রাতে বোধহয় খানিক বৃষ্টি হয়েছে। ঘাসগুলো কেমন ভিজে ভিজে। সেই ভিজে ঘাসে পা ডুবিয়ে এগিয়ে চলেছেন স্বর্ণেন্দু। তাঁর ঠিক পেছনেই ধীর পায়ে হাঁটছেন কুহেলি। একখণ্ড সবুজ ঘাসের মাঠের শেষেই দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া, বাতাবিলেবু, পেয়ারা গাছের ছায়া ঘেরা ‘শ্যামলী’- স্বর্ণেন্দু আর কুহেলির তিল তিল করে গড়ে তোলা সুখের ঠিকানা।

হালকা সবুজ রঙের দোতলা বাড়িটার সব দরজা-জানালা খোলা। সাদা লিনেনের পর্দা উড়ছে অনবরত। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন স্বর্ণেন্দু। যেন কতকাল পরে দেখছেন! আচমকাই সদর দরজার পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে এল ছোট্ট টুপাই আর টিপলু। হাতে একটা গোলাপি রঙের কেক। তাদের কচি গলার স্বরে জুড়ে দিল চেঁচামিচি, - বাবা এসো, দেখবে এসো, কেমন কেক এনেছি! আজ তো তোমার জন্মদিন। এসোই না ঘরে এসো.........স্বর্ণেন্দুবাবু! বলি ও স্বর্ণেন্দুবাবু এই অসময়ে ঘুমোলেন নাকি?

টুপাই আর টিপলুর কথার সঙ্গে আর একটা গলার স্বর মিশে কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল স্বর্ণেন্দুর। আচমকা ভেঙে গেল ঘুমটা। ঘোর লাগা চোখে দেখলেন তার দিকে উদ্বিগ্নভাবে তাকিয়ে আছেন নির্মল সাঁতরা। টুপাই, টিপলু, কুহেলি কেউ নেই তো! আর শ্যামলী! কোথায় গেল সব?

বালিশে ভর দিয়ে উঠে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন স্বর্ণেন্দু। টুপাই তাঁর একমাত্র ছেলে সুদূর আমেরিকায়। ডেট্রয়েটে এক নামী কারখানার অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার। স্ত্রী, কন্যা নিয়ে সেখানেই সেটেল্ড। তাঁর আদরের মেয়ে টিপলু আছে চেন্নাইতে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের ঘরণী হয়ে জমিয়ে সংসার করছে। কুহেলিও কথা রাখেনি। তাঁকে একা ফেলে আজ তিনবছর হল চলেগেছে পরপারে। সেরিব্রাল অ্যাটাক। চিকিৎসার সুযোগটাও দায়নি। তাঁদের সাধের শ্যামলীও আর নেই। গুঁড়িয়ে গিয়েছে। সেখানে এখন পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ি।

কুহেলির চলে যাবার পর কিছুদিন টিপলুর কাছে গিয়ে ছিলেন স্বর্ণেন্দু। টুপাইও বলেছিল কয়েকমাস ডেট্রয়েটে গিয়ে থাকতে। কিন্তু পারেননি। নিজের মাটির গন্ধ, ঘরের টান তাঁকে আবার ফিরিয়ে এনেছে নিজের শহরে। শ্যামলীকে শেষের দিকে কেমন যেন অচেনা মনে হত। কুহেলির সাজানো ঘরদোর, প্রতিটা আসবাব যেন বদলে ফেলেছিল নিজেদের চেহারা। সব কিছুই অপরিচিত ঠেকত স্বর্ণেন্দুর। তাই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললেন। পর হয়ে গেল শ্যামলী। আর তিনি বেছে নিলেন এই স্বেচ্ছা নির্বাসন।
-কী হল? তখন থেকে কী ভাবছেন? আর এই অবেলায় কেউ ঘুমোয়?
-ও ডাকছিলেন বুঝি?
কেমন একটা অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলেন স্বর্ণেন্দু। নির্মল বিচলিত হয়ে বললেন,
-শরীরটরীর খারাপ নয় তো?
-না না তেমন কিছু না। দুপুরে খাবার পর একটা বই পড়ছিলাম। ওটা পড়তে পড়তেই একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল। তা ডাকছিলেন কেন?
-আবীর খবর পাঠিয়েছে। আজ পঁচিশে বৈশাখ। তাই কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বোধহয়। আমাদের সকলকে যেতে বলেছে। আসুন, তাড়াতাড়ি আসুন।
-ও আচ্ছা। আপনি এগোন, আমি আসছি।
সাদা পাজামার ওপর একটা হলদে রঙের পাঞ্জাবি পরে, হালকা হয়ে আসা সাদা চুলে আলতো করে চিরুনি বোলালেন স্বর্ণেন্দু। ঘরের একফালি আয়নাটায় নিজেকে দেখে একটু যেন থমকালেন। হুমায়ূন আহমেদ পড়তে বড্ড ভালবাসত টিপলু। স্বর্ণেন্দু যখনই হলুদ পাঞ্জাবি পরতেন সে মুখ টিপে হেসে বলতো, “আজ আবার হিমু সাজা হয়েছে, তাই না!”
এলোমেলো মন নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন স্বর্ণেন্দু। একটা বড় টেবিলে রবি ঠাকুরের পূর্ণাবয়ব ছবি রাখা। পাশে ফুলদানীতে রজনীগন্ধা। ধূপকাঠির মায়াবি সুবাসে ভরে আছে চারপাশ। আলোর মালায় ঝলমল করছে সবুজ লনটা। পাশের নার্সারি স্কুল থেকে এসেছে কচিকাঁচার দল। তাদের ওপরই ভার আজকের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।

ছোট ছোট শিশুদের নাচ, গান, আধো আধো বুলিতে আবৃত্তি ভরিয়ে রাখল পুরো সন্ধেটা। তাদের স্কুলের প্রিন্সিপাল আর একজন শিক্ষিকা যৌথ ভাবে শোনালেন ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’। মনটা বড় ভাল হয়ে গিয়েছিল স্বর্ণেন্দুর। অবেলায় দেখা স্বপ্নটাকে কখন যেন ভুলে গিয়েছিলেন। রবির আলোয় দূর হয়ে গিয়েছিল মনের ভেতর জমাট বাঁধা সকল অন্ধকার।
অনুষ্ঠান তখন প্রায় শেষের পথে। আচমকাই ছোট ছেলেমেয়েগুলো দৌড়ে এল তাঁর কাছে। হাত ধরে আদুরে গলায় বলল,
-দাদু চলো না আমাদের সঙ্গে একটু।
বিস্মিত স্বর্ণেন্দু বললেন,
-কোথায়? কোথায় যাব আমি?
-এসো বলছি আমাদের সঙ্গে। এসোই না, এসো।
স্বর্ণেন্দুর দুহাত ধরে তাঁকে টেনে এনে দাঁড় করালো রবীন্দ্রনাথের ছবির পাশে। হতভম্ব স্বর্ণেন্দু উসখুস করছিলেন। কী করবেন, কী বলবেন ঠিক ভেবে পাচ্ছিলেন না। আর তখনই এগিয়ে এলো আবীর। হাতে একটা গোলাপি রঙের কেক। গলাটা একটু চড়িয়ে, হাসি মুখে সে বলল,
-উপস্থিত সকলকে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আজ শুধু কবিগুরুর জন্মতিথি নয়। আজ আমাদের চোদ্দ নম্বর ঘরের আবাসিক স্বর্ণেন্দুবাবুরও জন্মদিন। আসুন আমরা সকলে মিলে তাঁকে এই শুভদিনে অভিনন্দিত করি।

একে একে এগিয়ে এলেন নির্মল, কস্তুরি, অমল, অলকানন্দা, সুধীর আরও অনেকে। অশ্রু সজল চোখে স্বর্ণেন্দু দেখছিলেন তাঁর সহ-আবাসিক, ছোট ছোট বাচ্চাগুলো আর ম্যানেজার আবীরকে। তাঁর গাল বেয়ে নেমে আসছিল বড় বড় জলের ফোঁটা। তার মধ্যে কতটা আনন্দ ছিল আর কতটা দুঃখ, তা হয়তো স্বর্ণেন্দুরও অজানা।

গোলাপি রঙের হৃদয়ের মাঝে জ্বলতে থাকা আগুনটাকে জোরে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে মাথার ওপর ঝরে পড়ল রঙবেরঙের টুকরো টুকরো খুশি। ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু স্বর্ণেন্দু’র সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হল সাউন্ড বক্সে বেজে চলা, “চিরনূতনেরে দিল ডাক/পঁচিশে বৈশাখ......হে নূতন,’’
আজ আরও একবার রিক্ততা ভুলে আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত হল ‘পুনশ্চ’- শহরের একপ্রান্তে গড়ে ওঠা এই বৃদ্ধাবাস।

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অণুগল্প





আমার মৃত্তিকা


কফিতে চুমুক দিতে দিতে কৌশিক সদ্য প্রকাশিত নিজের কবিতার বইটা মৃত্তিকার হাতে তুলে দিল।

বইয়ের পাতা উল্টেই মৃত্তিকা বলল, " এভাবে দিলে হবে না। কিছু লিখে দাও। "
কৌশিক ব্যাগ থেকে পেন বার করে খুব দ্রুত লিখে ফেলল কয়েকটা শব্দ ----- " কফি হাউসে আমার মৃত্তিকাকে, কৌশিক বসু ।"

কৌশিকের হাত আড়াল করা ছিল বলে লেখার সময় মৃত্তিকা দেখতে পায় নি। এখন বইটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টেই বলল, " এটা কি লিখলে ! তুমি মাঝে মাঝে এমন সব কাজ করে বসো না ! "
 " কি লিখেছি ? "
 " আমার মৃত্তিকাকে ------ ! "
 " কেন ? ঈ দিয়ে ফেলেছি বুঝি ? "
 " সব ব্যাপারেই তোমার রসিকতা ! "
 " তোমার সমস্যাটা বলবে তো ।"
 " বইটা তো আমি আলমারির মধ্যে লুকিয়ে রাখব না। 'আমার' লেখাটা দেখে ছেলে কি ভাববে ! "
 " সেটা আমি কি করে বলব মৃত্তিকা, ছেলে তার মাকে কি চোখে দেখবে। "
" কিন্তু শুধু শুধু এটা কেন লিখলে ?"
" মৃত্তিকা, আমার বলে আমি ব্যক্তিগত সম্পত্তির কথা বলতে চাই নি। "
 " সে যাই হোক, তুমি লিখতে গেলে কেন ? "
" তোমার যদি আপত্তি থাকে আমি কেটে দিচ্ছি। কিন্তু এটা তো ঠিক, আমি তোমাকে আমার চোখ দিয়ে দেখছি। তোমাকে আঁকছি আমার মতো করে। "

 " কৌশিক বইটা নিয়ে কালো কালি দিয়ে লেখাগুলো কেটে দিল। আর কিছুই বোঝার উপায় নেই। দাম মিটিয়ে কৌশিক উঠে দাঁড়ালো ----- " আর দেরি নয়, এবার উঠতে হবে। "

 সামনে কৌশিক। পিছনে মৃত্তিকা কি যেন বলতে বলতে আসছে। কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কফি হাউসের সম্মিলিত কন্ঠস্বরে মৃত্তিকা মিশে গেল।



               

বিপ্লব বসাকের অণুগল্প



পুনর্জন্ম

প্রায় একবছর হতে চলল, দীপালী দেবী বহির্জগতের সাথে সম্পুর্ণ যোগাযোগ বিহীন। এই এক বছরে তিনি না কারও বাড়িতে গেছেন, না কাউকে বাড়িতে ডেকেছেন। রজতবাবু নিজেও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন প্রথমে। কিন্তু স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে সামলে নিয়েছেন নিজেকে। দীপালিকে অনেক বুঝিয়েছেন, সবসময় পাশেপাশে থেকেছেন। যদিও এখনো স্ত্রীকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে পারেননি। তবে হাল ছাড়েননি তিনি।
মিঠির জন্মমাস পড়তেই বায়না ধরেছেন, জন্মদিনের অনুষ্ঠান করবেন। দীপালি দেবী চমকে তাকিয়েছিলেন একবার। তবে বারণ করেননি। শুধু বলেছেন.."আমি দোতলায় থাকব, আমাকে বিরক্ত করবে না।"

রজত বাবু আবারও বোঝানোর চেষ্টা করেছেন.."মিঠির জন্মের পর থেকে প্রত্যেক বছর ওর জন্মদিন পালন করছি আমরা। এবারেই বা কেন বাদ দেব? আর সবাইকে তো আর বলতে যাচ্ছিনা, শুধু চারজন.. সলমা, রৌনক, বিরজু আর ডেভিড।"

নামগুলো শুনে স্তব্ধবাক হয়ে গেলেন দীপালি দেবী। গত দশ মাসের ঘটনা প্রবাহ বিদ্যুৎবেগে ঝড় তুলে গেল মস্তিষ্কে। বেশ কিছুক্ষণ থমথমে মুখে বসে থাকার পর ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন তিনি। রজত বাবুর ভীষণ ইচ্ছে করছিলো খেলোয়াড়দের মত হাত মুঠো করে ইয়াপ বলে চিৎকার করে উঠতে। নিজেকে সামলে সেদিন থেকেই যোগার-যন্ত্রে লেগে পড়লেন।

আজ মিঠির জন্মদিন। বাড়ি সাজানো থেকে শুরু করে বাজার করা, উপহার কেনা, সব নিজে হাতে করেছেন রজত বাবু। সকাল হতেই রান্নার কাজে হাত লাগিয়েছেন দীপালির সাথে। বেলা এগারোটা নাগাদ কলিং বেলের আওয়াজ শুনে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললেন। চারমূর্তি একসাথে হাজির। আদর করে ওদের ঘরে এনে বসালেন। দীপালিও ততক্ষণে ড্রইংরুমে এসে গেছেন। একে একে চারজনই দীপালি দেবীকে প্রণাম করলো।

সলমাই মুখ খুললো প্রথমে.."কেমন আছো মা?"
স্মিত হাসলেন দীপালি দেবী.."হ্যা-রে, তোর  চোখে আর কোনো অসুবিধা নেই তো?"
"না, মা। মিঠির চোখে আজ আমি পৃথিবীর সব রঙ দেখতে পাচ্ছি, আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি মা।"
সলমার ঝকমকে চোখের দিকে তাকিয়ে সব কষ্ট ভুলে গেলেন দীপালি দেবী। রৌনকের দিকে তাকালেন তিনি.."তুই?"
"আমাকে আর বিরজুকে আর ডায়ালিসিস নিতে হয় না মা। আমরা দুজনেই এখন পুরো সুস্থ।"
"ডাক্তার বাবু বলেছেন, আমি আর কিছুদিনের মধ্যেই ক্রিকেটে ফিরতে পারবো, মা"...ডেভিড বললো।
দীপালি দেবীর দু-চোখ বেয়ে অশ্রুর ঢল। এ অশ্রু দুঃখের নয়, আনন্দের। একসাথে চারজনকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি.."আজ মনে হচ্ছে, মিঠিকে আমি হারাইনি। মিঠি বেঁচে আছে, তোদের সবার মধ্যে মিঠি বেঁচে আছে। তোরা সবাই মিলে মিঠিকে বাঁচিয়ে রেখেছিস।"

পরের পর ঘটনা প্রবাহে কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পরেছিলেন রজত বাবু। এতদিন ধরে চেপে রাখা কান্নাগুলো বাধ ভাঙবে ভাঙবে করছে, দীপালি দেবীর ধমকে সম্বিত ফিরলো তার।

"বোকার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছো?ছেলে-মেয়েগুলো রোদে তেতে-পুড়ে এসেছে, সে খেয়াল আছে? ওদের জন্য ঠান্ডা সরবত নিয়ে এসো।"
তারপর আবার ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন.."তোরা বোস। রান্না প্রায় শেষ , একটু পরেই টেবিলে দিচ্ছি।"
"আমিও তোমার সাথে রান্না করবো"...সলমা লাফিয়ে উঠলো।

রজত বাবু ঝাপসা চোখে দেখলেন, মিঠি তার মায়ের কোমর জড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। চোখ থেকে চশমাটা খুলে পাঞ্জাবিতে মুছে আরেকবার তাকালেন, নাহ, ভুল নয়..মিঠি...হ্যাঁ, মিঠিই তো।

অমিতাভ দাসের গল্প




মুখোমুখি দুই রানি


নৌকা এসে দাঁড়াল বংশবাটির খেয়াঘাটে । ক্লান্ত অপরাহ্ন । শীত শেষ হয়েছে । দু-চারটি কোকিলের ডাক । মৃদু-মন্দ বাতাস বইছে ।পতপত করে উড়ছে নৌকার পতাকাগুলি ।

যে নৌকাটি এসে প্রথমে দাঁড়াল সেইটি অধিক সজ্জিত । তার পিছু পিছু আরো গোটা দশেক নৌকা  ।

অদূরে ঘাটে দাঁড়িয়ে আছেন এক প্রবীন মানুষ । তিনি বংশবাটি  এস্টেটের দেওয়ান । হাত জোর করে আছেন ।

সজ্জিত নৌকা থেকে বেরিয়ে এলেন রানীমা । সঙ্গে খাস দাসী পদ্মা ও যমুনা ।
রানীমাকে দেখেই লালমোহন এগিয়ে গেল । বললে ,আস্তে আস্তে নেমে আসুন মা । রানীমা এগিয়ে এলেন । লালমোহন রানীমার বিশ্বস্ত কর্মচারী ।

ইতিমধ্যে দেওয়ানজীও এগিয়ে এসেছেন ।
রানীমা বললেন , লালমোহন খবর পাঠিয়েছিলে তো ?

--জি ।পাঠিয়েছি । ওঁনারা এসেছেন আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ।
রানীমা অর্থাত্ জানবাজারের বিখ্যাত ব্যবসায়ী ও জমিদার প্রীতিরাম দাসের পুত্রবধূ , রাজা রাজচন্দ্রের স্ত্রী রানী রাসমণি  । যাঁর দান ও সেবার কথা লোকমুখে চারিদিকে প্রচারিত । রানী না হলেও তাঁর প্রজারা তাঁকে রানীমা বলেই ডাকে । যাঁর জীবনের নানান অলৌকিক কথা লোকমুখে দেওয়ানজীর কানে এসেছিল । তিনিও এই প্রথম দেখলেন রানী রাসমণিকে ।

রানীমাকে দেখে তিনি বিস্মিত ও মুগ্ধ ।যেন দেবী জগদম্বা । কী প্রবল ব্যক্তিত্ব ! দর্শনেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায় । সাদা থান পরা । গলায় পদ্মবীজের মালা । মধ্য বয়সেও অসামান্য রূপের দ্যুতি যেন ঠিকরে পড়ছে পড়ন্ত দুপুর  বেলার খেয়াঘাটে ।
দেওয়ানজী কাছে এসে প্রণাম জানালেন করজোড়ো । বললে ,আসুন মা --আসুন--পালকি প্রস্তুত ।
--পালকির কী প্রয়োজন ছিল ।হেঁটেই তো যেতে পারতুম ।বললেন রানী রাসমণি  । সহজ সরল কথা আন্তরিকতায় পূর্ণ । পদ্মা আর যমুনার দিকে তাকিয়ে বললেন , সকলকে নিয়ে তোরাও দ্রুত মন্দিরে চলে যায় । আর হ্যাঁ ,পুজোর ডালা ও অন্যান্য পুজোর সামগ্রী কেলোর মায়ের হাতে পাঠিয়ে দিস । সে বেচারি উপোস করে আছে ।পুজো দিয়ে তবে প্রসাদ খেয়ে উপোস ভাঙবে ।
--তুমিও তো উপোস করে আছো মা ।কত বেলা হল ,বললে যমুনা ।
--সে তো আমার অভ্যেস আছে । নে আর কতা বলিস নে । তাড়াতাড়ি আয় দিকিনি । বলে পালকিতে উঠলেন ।

রানী রাসমণির মন বড়ো অশান্ত । নৌকাযোগে তিনি জগন্নাথ দর্শন করে এলেন গত বছর১৮৫০ সাল । সেও এক ঘটনাবহুল যাত্রা ।  গঙ্গার মোহনায় তাঁর নৌকাটি অন্য নৌকাগুলি থেকে বিচ্ছিন হয়ে যায় । অচেনা জায়গা । তবে রঘুবীর যাঁর সহায় বিপদ তাঁকে কী স্পর্শ করতে পারে ! এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের কুটিরে আশ্রয় পান ।প্রাণ রক্ষা হয় । তিনি ব্রাহ্মণকে দান করেন একশোটি টাকা । তারপর আবার তাঁর চলা । তিনি নিজের টাকায় সুবর্ণ রেখা থেকে পথ তৈরী করতে করতে পৌঁছলেন জগন্নাথ ধাম । পড়িয়ে দিলেন তিনটি হীরক খচিত মুকুট প্রিয় দেবতা জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার মাথায় ।

এ বছর আবার এসেছেন স্নান করতে সাগর সঙ্গমে । এ যাত্রাও কম ঘটনাবহুল নয় ।পড়েছিলেন ডাকাতের খপ্পরে । সর্বদাই অবিচলিত রানী রাসমণি । ভাবলেন ,দেখি এ যাত্রায় রঘুবীর বাঁচান কী না ! ডাকত দাবি করলে মুক্তিপণ । রানী স্মিত হাসলেন ।বললেন , যে টাকা তুমি চাইছ তা আমার কাছে এ মুহুর্তে নেই । তবে তুমি পাবে ।রানী রাসমণি মিথ্যে বলে না । ডাকাত রানীকে বিশ্বাস কবলে ।পরে অবিশ্যি রানী কথা রেখেছিলেন ,মুক্তিপনের বারো হাজার টাকা তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ।

পালকি এসে দাঁড়াল হংসেশ্বরী মন্দিরের সামনে । রানী রাসমণি নেমে এলেন । সামনে তাকিয়ে দেখলেন কী অপূর্ব মন্দির মা হংসেশ্বরীর । খুব কাছেই দাঁড়িয়ে প্রাচীন অনন্ত বাসুদেবের মন্দির ।অসামান্য  টেরাকোটার কাজ । রানী  মুগ্ধ ।
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলেন । মন্দিরের ঠিক সামনেই এক অশীতিপর বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে ।গায়ে সাদা একটি চাদর । রানী রাসমণিকে দেখেই এগিয়ে এলেন এক পা ,দু পা করে । চোখে ভালো দেখেন না । বললেন  , এসেছো তুমি রাসমণি ,তুমি এসেছো...কী যে ভালো লাগছে আমার...

রাসমণি বুঝলেন এই সেই রাণী শঙ্করী । যিনি এই মন্দিরের প্রকৃত নির্মাতা । স্বামীর ইচ্ছায় তাঁর  অসমাপ্ত কাজকে যিনি পূর্ণতা দিয়েছেন । যিনি এখনো বংশবাটির সকলের ছোটমা ।আজো তাঁর কী অপার্থিব রূপ--সত্যিই এককালে অসামান্যা রূপবতী ছিলেন রাণী শঙ্করী ।

এগিয়ে এসে রানী রাসমণি রানী শংকরীর হাত দুটি স্পর্শ করে বললেন , দিদি--আমি তোমায় চিনেছি দিদি--
--আজকাল চোখে ভালো দেখতে পাই না । তবে ভালো শুনতে পাই ।তুমি আমায় দিদি বললে রাসমণি । প্রাণ জুড়িয়ে গেল ভাই--
তোমার গুণের কথা শুনি । তোমার দানের কথা ।কত স্বাদ ছিল তোমাকে দেখার । মা আমার সে স্বাদ  পূর্ণ করেছে ।

পুজো শেষে সকলে এসে দাঁড়ালে মন্দির চাতালে । যেখানে হাড়াকাঠ ,তার আশেপাশে অনেক নারী-পুরুষ জানবাজারের রানীমাকে দেখতে এসেছে । কত কথা তাঁরা শুনেছে । এই রানীমা নাকি এক বিরাট মন্দির তৈরী করছেন । তিনি নাকি কাশী যাবার পথে স্বপ্নে দৃষ্ট হন ।আর তারপরেই জামাইকে নির্দেশ দেন কালী মন্দির নির্মাণের ।
সকলের চোখে অসীম কৌতুহল । এক বৃদ্ধ চুঁচুরা নিবাসী এসেছিল হংসেশ্বরী মন্দিরে পুজো দিতে ।সে বললে , রানীমা ইংরেজদের জব্বর সায়েস্তা করেছেন । তাঁকে খুব মান্যি করে ইংরেজ সরকার । একবার হল কী...
কথা শেষের আগেই খোল-কত্তাল বেজে উঠল । সবাই তাকাল অনন্ত বাসুদেব মন্দিরের দিকে । রানী রাসমণি এখন সেখানে পুজো দিচ্ছেন ।
রানী রাসমণির চোখে জল ।পাশে বসে আছেন রানী শংকরী । ফুল-মালা আর ধূপের গন্ধে মুখরিত মন্দির প্রাঙ্গন ।
রানী রাসমণি বলছেন , প্রভু কত সাধ ছিল তোমাকে দেখার । রঘুবীর এও তোমার এক রূপ...
রানীর চোখে ভক্তিঘন আনন্দাশ্রু । রানী শংকরী আলতো করে হাত রাখলেন রাসমণির পিঠে ।

বিকেল হয়ে এল ।সন্ধ্যায় আরতি ।তারপর ভাগবত্ পাঠ অন্তে কীর্তন ।তার আগে পথ শ্রমে ক্লান্ত রানী গেলেন শংকরী ভবনে । কারণ তিনি আজ বংশবাটি রাজবাড়ির অতিথি ।
.
রুপোর গ্লাসে দুধ । রুপোর থালায় নানা রকমের ফল ও মিস্টি । বড়ো যত্ন করে রানী শংকরী খাওয়ালেন রাসমণিকে । নাম মাত্র খেলেন তিনি । তবু আন্তরিকতা আর যত্নে তাঁর মন ভরে গেল । বললেন , দিদি তোমার পাশে এই ছোট্ট মেয়েটি কে ? ভারী মিষ্টি দেখতে ।
--ও তো ছুটকি । মানে ওই তো এখন রানী । ভালো নাম মৃন্ময়ী । ও হল আমাদের রাজা দেবেন্দ্রর বৌ... রাসমণি মুগ্ধ হয়ে দেখলেন সেই  নতুন রানীকে  ।
.
রাসমণি শুনছিলেন হংসেশ্বরী মন্দির তৈরীর উপাখ্যান । রানী শংকরীর আত্মত্যাগ । এই মন্দিরের জন্য লড়াই--যা আদালতে গিয়ে থেমেছিল । জয়ী  হয়েছিলেন রানী শংকরী । শেষ করেছিলেন স্বামীর শেষ ইচ্ছা --মা হংসেশ্বরীর মন্দির ।
.
রাজ হলেও অন্তরে সন্ন্যাসী নৃসিংহ দেব রায় । শোনা যায় তিনি শ্যামামায়ের দর্শন পেয়েছিলেন ।নিজের জননীর নামানুসারে এই মন্দিরের নাম । তিনি মন্দিরের কাজ শেষ করে যেতে পারেন নি ।কাজ শেষ করেন ছোটরানী শংকরী । ১৮১৪  সালে রথযাত্রার প্রাক্কালে স্নানযাত্রার দিন হংসেশ্বরী  বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয় ।

মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন রাসমণি । বাইরে কে যেন ডাকলে ।মৃন্ময়ী বললে , ঠাকমা চলো , সন্ধ্যা আরতির  সময় হল ।
রানী রাসমণির দিকে তাকিয়ে বললেন , চলুন রানীমা...

রাসমণি প্রদীপের আলোয় দেখলেন অশীতিপর বৃদ্ধার দুচোখ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অশ্রুধারা । স্মৃতি কত যে বিষাদের  আর কত যে আনন্দের তা রাসমণি জানেন । এই সে সেদিন যে ঘাটে তাঁর পিতা স্নান করতেন সেটি বাঁধিয়ে দিয়ে এলেন । চোখে জল এসেছিল বারবার । বাবার কথা মনে পড়েছিল তাঁর । কত ভালোবাসতেন । দরিদ্র অথচ সত্ একজন মানুষ ছিলেন তাঁর বাবা । কী সুন্দর কন্ঠ ছিল বাবার ! কে বলবে ,এই লোকটি সকালে ঘরামির কাজ করতেন  আর সন্ধ্যার পর মেতে উঠতেন খোল-কত্তাল নিয়ে কীর্তন গাইতে ।
রাসমণির মনে পড়ে বাবার থেকেই তো  পেয়েছি যা কিছু আমার সংস্কার --গান--ভক্তিপ্রেমরাশি...
.
সন্ধ্যারতি শেষ হয়েছে । শুরু হয়েছে ভাগবত্পাঠ । রাসমণি শুনছেন ।শুনতে শুনতে তাঁর বালিকা বয়সের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে । ছোটবেলা কেমন চমত্কার গাইতেন তিনি । কত বছর হয়ে গেছে ,তিনি আর গান করেন না । ইচ্ছেও করে না ।তাছাড়া জমিদারী আর ব্যবসা সামলে সময় কোথায় !

ভোর হয়েছে । স্নান সেরে মন্দিরে পুজো দিলেন রাসমণি । অনেকক্ষণ বসে থাকলেন হংসেশ্বরীর মূর্তির সামনে । তন্ময় হয়ে দেখছেন মাতৃরূপ । শিবের নাভি থেকে প্রকাশিত  প্রস্ফুটিত পদ্মের ওপর আসীন দেবী । বাঁ পা মুড়ে ডান পা ঝুলিয়ে রেখেছেন । চতুর্ভুজা । দুই ডান হাতে অভয় ও বরাভয় মুদ্রা ।দুই বাঁ হাতে অসি ও মুন্ডমালা ।নীল বর্ণের বিগ্রহ নিমকাঠে নির্মিত । করজোড়ে প্রণাম করলেন রাসমণি ।
.
এবাবে যাবার ক্ষণ উপস্থিত । রাণী শংকরী বললেন ,আর দুটো দিন থেকে যাও বোন ।
রানী বললে ,তা হয় না দিদি । বিস্তর কাজ পড়ে আছে আমার ।ঐ দিকে মন্দিরের কাজ দেখছে মথুর । সে একা কত দিক দেখবে । আমাকে যে যেতে হবে দিদি...
রানী শঙ্করী বললেন , যাবে যখন, বাধা দিই কীভাবে ।  তাহলে  কথা দাও আবার আসবে--
সম্মতি জানিয়ে রানী বললেন  ,আমার একটা ইচ্ছা ছিল দিদি...
--কী ইচ্ছা--
--আমি বংশবাটির ব্রাহ্মণদের কিছু দক্ষিণা দিতে চাই ।

রানী শংকরী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন ।তারপর বললেন , তা হয় না বোন । তুমি আজ আমার অতিথি । তাছাড়া এখানে তুমি যদি আজ দান করো ,আমি যা দান করি সে দানের আর মর্যাদা থাকবে না  ভাই ।তাই ওইটে কোরো না--

রানি রাসমণি বুঝলেন রানি শংকরীর মনের  কথা ।বললেন ,তাই হবে দিদি । তোমার কথাই থাক । বলে সৌজন্য হেসে শংকরীর হাত দুটো স্পর্শ করে বললেন ,আসি দিদি...

ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন রানি রাসমণি । পেছনে মন্দির চাতালে দাঁড়িয়ে রানি শঙ্করী । একটু একটু করে সকালের প্রথম রোদ্দুর এসে  ছুঁয়ে যাচ্ছে  হংসেশ্বরী মন্দিরের চূড়া ।