Monday, May 6

তিস্তা রায়চৌধুরীর প্রবন্ধ

তিস্তা রায়চৌধুরীর প্রবন্ধ 


‘অরূপের রাস’: একটি পুনর্পাঠ

আচ্ছা, মুখোশের খেলা দেখেছেন কখনো? কিংবা নিজের মুখোশটাকে দেখেছেন কখনো? যদি, এক লহমায় সেই মুখোশটা ছিঁড়ে নগ্ন মুখটা যদি দেখা যায়, তবে কী দেখবো আমরা?! অন্তর্দ্বন্দ্ব, সংঘাত বৈ তো কিছুই নয়!! লেখক হিসেবে জগদীশ গুপ্তের (১৮৮৬-১৯৫৭) সৃষ্ট পাত্র-পাত্রীরা যে কাফ্‌কার মতো কিছুটা সংশয়, দ্বিধায় আক্রান্ত তা বলা যায়। কুলিশ কঠোর বাস্তবের রুক্ষ কঠিন মাটিই তাঁর কথাসাহিত্যের background হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তাঁর চরিত্ররা হয়ে উঠেছে দ্বিধাগ্রস্ত পথের পথিক।

লক্ষণীয়, এই সংশয় বা দ্বিধার জন্মের জন্য দায়ী ধনতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক সভ্যতার উদ্ভব। বিশেষত আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে আধুনিকতা-বিতর্ক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে পশ্চিমি আধুনিকোত্তরবাদের ছায়া বাঙালি-মনে ক্রমশ গাঢ়তর হয়ে ওঠাতে। সেইসঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে নব্য ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশোত্তরবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। পাশাপাশি তত্ত্ববিশ্বে যে জোয়ার তৈরি হয়েছে বিনির্মাণ পন্থা—নারীচেতনাবাদ—মনোবিকলনবাদ—অস্তিত্ববাদ-এর মতো সজীব চিন্তাপ্রণালীর দ্বারা, তা অস্বীকার্য নয়। এই প্রেক্ষিতে জগদীশ গুপ্তের সাম্প্রতিক পাঠ-প্রবন্ধ কার্যত হয়ে ওঠে পাঠোদ্ধার। একমাত্র সার্বিক পুনঃপ্রসঙ্গায়নের মধ্য দিয়ে নির্ণয় করা যায় তাঁর কথাবিশ্ব কতখানি সময়জীর্ণ আর কতটুকুই বা সময়াতিসারী।

বুদ্ধদেব বসু তাঁর ছোটগল্পের শরীরকে চিহ্নিত করেছেন, ‘সাহিত্য তীর্থযাত্রার হোল্ডল’ বলে। কারণ “তারমধ্যে নাটক, প্রবন্ধ, উপদেশ, বিদ্রূপ, সাময়িক টিপ্পনী, সবই কিছু কিছু মাত্রায় যেন মানানসই করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এমনকী কবিতাও ঢোকানো যায়— কবিতা না হোক, কবিত্ব।” জগদীশ গুপ্তের লেখনী এই সকল উপাদানকে ছাপিয়ে গিয়ে যেন অন্য কোনো এক সত্যের দ্বন্দ্বকে সামনে তুলে আনে। ‘কল্লোল যুগ’-এর প্রসঙ্গে জগদীশ গুপ্তের পরিচয় দিয়ে অচিন্ত্যকুমার লিখছেন, “বয়সে কিছু বড় কিন্তু বোধে সমান তপ্তোজ্জ্বল। তাঁরও যেটা দোষ সেটাও ঐ তারুণ্যের দোষ— হয়তো বা প্রগাঢ় প্রৌঢ়তার।”

আলোচ্য ‘অরূপের রাস’ গল্পে তাই খোঁজার চেষ্টা চলবে এই ‘প্রগাঢ় প্রৌঢ়তা’র। আত্মকথকের কথনে কাহিনীক্রমটি এরকম— ছোটোবেলার খেলার সঙ্গী পাড়ার কানুদাকে ভালোবাসে রাণু। কিন্তু ব্রাহ্মণ কানুর সাথে অব্রাহ্মণ রাণুর বিয়ে হয়নি। রাণুর পিতা-মাতার মৃত্যুর পর ঘটনাচক্রে বসন্তবাবুকে নিয়ে সংসার পেতেছে বাপের ভিটেয়। কানুর স্ত্রী ইন্দিরার সঙ্গে রাণুর সম্পর্ক বড় মধুর। রাণু তাঁকে বলে, “আয় বৌ, তুই আর আমি এক হয়ে যাই।” বসন্তবাবুর বদলির খবর এল। চলে যাওয়ার আগের দিন কানুদাকে সে বলে— “কানুদা কাল আমরা যাবো। তোমার বৌ আজ রাত্তিরে আমার কাছে শোবে।” পরদিন ইন্দিরা কানুকে বলল রাণুর পাগলামির কথা। “ইন্দিরা বলিল— যেন স্বামী আর স্ত্রী, সে আর আমি।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস চাপিয়া গেলাম। — ইন্দিরার অঙ্গ হইতে আমার স্পর্শ মুছিয়া লইয়া সে ত্বক রক্তপূর্ণ করিয়া লইয়া গেছে। ... আমি তৃপ্ত।”

এইবার কাহিনীটিকে একটু বিস্তারিত করে দেখা যাক। কাহিনীর শুরুতেই দুটি বিষয় দৃষ্টি আকর্ষক। একটি; প্রত্যকেবার রাণু ও কথকের বয়সের পার্থক্যকে নির্দেশ দেওয়া— “সে সাত, আমি চৌদ্দ বছরের”, “রাণুর বয়স দশ, আমার সতেরো” অর্থাৎ; বয়সের সাথে মনের বদলের হদিশ যেন জানিয়ে যাওয়া বা আলতো করে ছুঁয়ে যাওয়া। বুঝিয়ে দেওয়া শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলো। রাণুর বিয়ের সম্বন্ধ দেখতে আসলে, রাণুর সাজ দেখে অচিরেই তাই কথক ভাবতে পারেন “কিন্তু আমার বুকের ভিতরকার বাকস্ফূর্তি যেন অকস্মাৎ অবরূদ্ধ হইয়া গেলো...।” রাণুর বিয়ের অনতিপরেই তাই কথকের আত্মোপলব্ধি, “অন্তরের তৃষ্ণার্ত কলুষ অগ্নি-তরঙ্গের মতো আমার বুক জুড়িয়া গড়াইয়া বেড়াইতে লাগিলো।” — এই কামনা ঠিক কতটা গ্রহণীয়; বিশেষ করে বিবাহিত এক রমণীর প্রতি এই কামনা যেন ঠিক চিরাচরিত স্রোতে খাপ খায় না। অন্যদিকে রাণুর ভাবনা যদি দেখা যায় তাহলে তা পূর্বেই উল্লিখিত। এখানে, বেশ অনেকগুলি দ্বন্দ্ব বা সংঘাতকে লেখক খুব আলতো করে অথচ অসম্ভব প্রজ্ঞায় স্পর্শ করেছেন। প্রথমত, রাণু ও কানুর সামাজিক প্রেম যেন বৈধতা পায়নি কারণ কানু ব্রাহ্মণ। অন্যদিকে, একটি সামাজিক ধর্মীয় প্রশ্নকে দাঁড় করায় এই কাহিনী যখন বিনাপণে রাণুর বিয়ে হয়। এছাড়া, ইন্দিরার চরিত্রটি এক ভিন্নমাত্রার সংযোজন। রাণুর ছেলে বেণুর জন্য ইন্দিরার যে ‘লালসা’ তা কি কেবল অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা থেকে? সন্তানহীনতার গ্লানি নাকি একাকীত্বের যন্ত্রণা ইন্দিরাকে বারবার দহন করে? এই প্রশ্নের সদুত্তর কথক দেননি। অন্যদিকে, ‘বেণু’-কে কেন্দ্র করে কথকেরও যে লালসা জন্মায় তা আসলে “তাহারই সুনিবিড় আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তির এই বিগ্রহ”। রাণুর “প্রাণের স্পন্দন দেহের বিন্দু বিন্দু ক্ষরিত রক্ত, হৃদয়ের আনন্দ-রস স্থানান্তরিত হইয়া আমার অঙ্গ স্পর্শ করিয়া আছে। ...” — এই না পাওয়ার মধ্যে পাওয়ার যে পরিতৃপ্তির আস্বাদ বারবার এই কাহিনীতে ফিরে ফিরে আসে তা আসলে অপূর্ণ, অবদমিত কামের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। গল্পের শেষ দুটি বাক্য, “ইন্দিরার অঙ্গ হইতে আমার স্পর্শ মুছিয়া লইয়া সে ত্বক রক্তপূর্ণ করিয়া লইয়া গেছে। ... আমি তৃপ্ত।” এই তৃপ্তি ঠিক কীরকম? কানু - রেণু ও ইন্দিরা এই তিনটি চরিত্রের এক অদ্ভুত, অদৃশ্য ত্রিকোণ ও বৈপরীত্য চোখে আসে যা বিস্ময়কর। ‘কানুদার’ শরীর না পাওয়ার যন্ত্রণায় রেণু কানুদার স্ত্রীকেই স্পর্শ করতে চেয়েছে। ‘কানুদার’ স্ত্রীকে গভীর আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে কানুদার শরীরের স্বাদ নিয়েছে। ‘কানুদাও’ এতে তৃপ্ত হয়েছে। কিন্তু ইন্দিরা? ইন্দিরার সংঘাতটাই যেন একটা প্রশ্নচিহ্ন দাঁড় করায়। কানুর সন্তানহীনতার কারণ এবং ইন্দিরার রাণুর সাথে মিলন — এই দুইয়ের মধ্যেই আছে অতৃপ্ত, অবসমিত আকাঙ্ক্ষা, লালসা। এই ‘লালসা’-র contrast তিনটি চরিত্রের তিনরকম, তা সত্ত্বেও ইন্দিরার অভাববোধের প্রশ্নটাই সামনে আসে। রাণুর এই মিলন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলেও ইন্দিরার এই মিলন ঠিক কী ইঙ্গিত করে? বলা বাহুল্য, লেখক এই প্রশ্নের নিরসন করেননি। এই সংশয়টি তাই কাহিনীর শেষেও রয়ে যায়।

ফ্রয়েডীয় মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, গল্পটিতে বস্তুকাম(Fetichism) ব্যক্ত হয়েছে। প্রিয়জনের অভাবে প্রিয়জনের ব্যবহৃত উপকরণের দ্বারা কামতৃপ্তি এর মূল কথা। প্রাথমিকভাবে, এটি নারীর সমকামিতার কাহিনী মনে করলেও আদপে, ইন্দিরার Fetish চরিত্রটিকে পরিষ্ফুট করে। লক্ষ্যণীয়, এই কাহিনীর কোথাওই সমকামী মিলনের কথা স্পষ্টত বর্ণনা দেওয়া হয়নি— কেবল ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। তাই এটি ‘Homosexuality’ এর তকমা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে, হয়ে উঠেছে ‘Homo Eroticism’-এর যথার্থ বাহক। এ প্রসঙ্গে, বলা ভালো এই ব্যতিক্রমী যৌনিতা ও প্রেমের ধারণা অন্তত ‘কল্লোল পর্ব’-এ সাধারণ ছিল না। এখানেই জগদীশ গুপ্ত একজন যথার্থ ন্যাচারালিস্ট কথাসাহিত্যিক হয়ে ওঠেন।

 ‘ন্যাচরালিজম’ কী এই প্রসঙ্গে যেতে হলে আরেকবার ফিরতে হবে পূর্বপাঠে অর্থাৎ ধনতান্ত্রিক বুর্জোয়া সভ্যতার প্রেক্ষাপটে। ‘রিয়েলিজম’ তত্ত্বের প্রয়োগটির চূড়ান্ততম রূপভেদ হলো ‘ন্যাচারালিজম’। দর্শনে আর সাহিত্যে ‘রিয়ালিজম’ ভিন্নার্থবাহী হলেও, ওই দুই ক্ষেত্রে ন্যাচারালিজম প্রায় সমার্থক। ‘ন্যাচারালিজম’ তত্ত্ব এই ভাবনার উপর প্রতিষ্ঠিত যে, মানুষ বিশেষ কোনো গুণের অধিকারী নয়— যে কেবলমাত্র উন্নত শ্রেণীর এক প্রাণী, যার কোনো অধ্যাত্ম বা শারীরিক প্রবৃত্তি-অতিরিক্ত কোনো উচ্চতর স্তরের সম্পর্ক নেই। মানুষের চরিত্র ও ভবিতব্য বা পরিণাম নির্ধারিত হয়, দুটি প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা— বংশগতি ও পরিবেশ। মানুষের ব্যক্তিগত লক্ষণ—বৈশিষ্ট্য স প্রবৃতিতগুলি (ক্ষুধা, কামজবাসনা, লোভ ইত্যাদি) বংশগতির সূত্রে আসে। এবং সে তার সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবেশ, নিজের পরিবার, শ্রেণি ও প্রতিবেশের অধীন। শারীরবিজ্ঞানী Claude Bernard–এর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, ইতিহাসবিদ্‌ Hippolyte Taine-এর পর্যবেক্ষণমূলক তত্ত্ব এবং Charles Robert Darwin–এর ‘থিওরি অফ ইভোলিউশন’-এর তত্ত্ব ‘ন্যাচারালিজম’-এর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। শুধু অভিজ্ঞতাসঞ্জাত বিবৃতি নয়, নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে মোহমুক্তভাবে বৈজ্ঞানিক বীক্ষণ দ্বারা মানুষের আচরণ ও জীবন-পরিণতির সামাজিক ও মনোস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে ‘ন্যাচারালিজম’। ভারতবর্ষে; বিশেষত বাংলা সাহিত্যে যখন এই ‘রিয়ালিজম’, ‘ন্যাচারালিজম’- ইত্যাদি তত্ত্বগুলির অনুপ্রবেশ ঘটছে ততদিনে কলোনিয়াল পিরিয়ড, বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল, ধনতন্ত্র ও পুঁজিবাদ সভ্যতার উত্থান— তথাকথিত ‘আধুনিকতা’ বা ‘modernism’-এর অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে।

সমাজবিকাশের ধারায় পুরোনো ও নতুন সমাজব্যবস্থার দ্বন্দ্বে, যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে, মূল্যবোধের রূপান্তরে, অতীন্দ্রিয়তায় ঋদ্ধ রোম্যান্টিক রবীন্দ্রসাহিত্যের বিরোধিতায় বাংলা গল্প উপন্যাসে জন্ম নিল বাস্তবতা, অনিবার্য সূত্রে প্রকৃতিবাদ ও বিষণ্ণ-বাস্তবতা। “The metaphysical men is dead; our whole demand is transformed with the coming of the Physiological man”— এমিল জোলার এই ঘোষণাই গ্রহণীয় হল। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র এই ‘প্রকৃতিবাদ’কে স্বীকৃতি দিলেন না কিন্তু অদ্ভুত ভাবে রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে রাবীন্দ্রিকতার মোড়কের আড়ালে যেন স্বীকৃত হল মহেন্দ্রের কামজর্জর অবস্থা এবং বিনোদিনীর কামপীড়িত উত্তেজনা ও আশালতার প্রতি তার অনুরাগ। সেই দেহজ অতিরিক্ত অনুরাগ যেন নীরবে সমর্থন করলো আমাদের আলোচ্য ‘ইন্দিরা’ আর ‘রাণু’-র অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষিত মিলনকে। এখানেই, এই শারীরিক প্রবৃত্তির সরাসরি প্রকাশ একজন যোগ্য ন্যাচারালিস্ট সাহিত্যিকের লক্ষণ। ‘অরূপের রাস’ সেই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে স্বীকার করে, বহন করে। এ প্রসঙ্গে, ইসমত চুখতাই-এর ‘লিহাফ’ গল্পটি স্মরণীয়। এই কাহিনীতেও কোথাও সমকামীত্বের বর্ণনা নেই, কিন্তু কিছু বিবরণ সেই ‘Homo Erotic Sense’টি’কে বহন করে ঠিক যেমন আমরা দেখি ‘অরূপের রাস’-এ। কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক— “He, however, had a strange hobby... He kept an open house for students— young, fair and slender-waisted boys whose expenses mere borne by him.”  অর্থাৎ, বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কিশোর রাই নবাব সাহেবের অধীনে থাকতো। অন্দরমহলে, বেগমজান ও রাব্বুর কাহিনীটি সেই বাচ্চা মেয়েটির জবানীতে এরকম— “I woke up at night and Begum Jaan’s quilt was shaking vigorously as though an elephant was struggling inside”... “Go to sleep Child... There’s no thief.” that was Rabbu’s voice.” এই কাহিনীতেও কোথাওই কোনো সমকামিত্ব বা যৌন মিলনের কথা বলা নেই কিন্তু তবুও যে অতৃপ্তি ও আকাঙ্ক্ষার থেকে এই দেহজ বাসনার পরিপূর্ণ রূপ প্রস্ফুটিত হয় তা বোধহয় ‘রাণু’ আর ‘ইন্দিরা’র সাথে সমতুল্য। বাণী বসু-র ‘সংবাহ’ গল্পেও তাই ‘শোভা অগ্রবাল’ ‘রেণু’কে ত্যাগ করতে পারেন না। রেণুর হাতের স্পর্শই যেন কামনার দ্রবায়ণে পরিণত হয়। বারবার এই ছুটে চলা, ফিরে আসা, অতৃপ্তি, অবদমিত আকাঙ্ক্ষা, যৌনতা, লালসা এই সব নিয়েই তাই ‘অরূপের রাস’ যথার্থ হয়ে ওঠে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প সৃষ্টির মূলে সুন্দরের জন্য উৎকণ্ঠা আছে, কিন্তু অসুন্দরের অস্তিত্ব সম্পর্কে এক আগ্রহী সচেতনতাই যেন সেখানেও মুখ্য সুর। জগদীশ গুপ্তের কথাবিশ্বে পর্যটক হওয়াই শ্রেয়। আধুনিক কাল-এর মর্মে যে অস্তিত্বের উপাসনা করছিলেন কল্লোলীয়েরা, তার অন্তর্বর্তী কৃষ্ণবিবর শুধুমাত্র জগদীশের অনুভবে ধরা পড়েছিল। জগদীশের দৃষ্টিতে জীবন মূলতই ছিল অর্থহীনতায় আক্রান্ত। ডব্লিউ. বি. ইয়েটস-এর কয়েকটি পংক্তি তাই যেন দিশা দিয়েছিল— “Things fall apart; the centre cannot hold;/ Mere anarchy is loosed upon the world,/ The blood-dimmed tide is loosed, and everywhere/ The ceremony of innocence is drowned;” বস্তুত, জগদীশ গুপ্তের প্রতিভায় যে প্রবল ক্ষমতা ছিল। রচনার কাঠিন্য ও মর্মভেদী প্রাঞ্জলতার দীপ্তিতে সেই দুর্লভ সামর্থ্যের নিছক বহিরঙ্গ প্রকাশ। ভয়ানককেও সংবেদনীয় করে তোলার প্রবণতাই অনুপস্থিত ছিল জগদীশ গুপ্তের তীব্র প্রখর জীবনানুভাবে। এখানেই তাঁর প্রতিভার গ্রন্থি ও সীমাবদ্ধতা।




উল্লেখপঞ্জি –
১। জগদীশ গুপ্তের গল্প; সম্পাদক : সুবীর রায় চৌধুরী, দে’জ পাবলিশিং,
প্রথম প্রকাশ : অগস্ট ১৯৭৭
প্রথম দে’জ সংস্করণ : জানুয়ারি, ১৯৮৩

২। Lihaaf [The Quilt];
Ismat Chughtai, translated from urdu by M. Asaduddin;
Manushi

৩। সংবাহ; বাণী বসু
দেশ, শারদীয় ১৪১৫

৪। The Second Coming
W.B.Yeats

মানিক সাহার অণুগল্প





ইঁদুরের কল

বুকের ভেতর এই বিকেল বিকেল ভাবটা খুব ভালো লাগে টগরের। সারাদিন কাজের ব্যস্ততা, চিন্তা, দুশ্চিন্তা। তার ফাঁকে এই দুপুরবেলার অবসরটুকু তার কাছে খুব প্রিয় মনে হয়। মনে হয় কোন দূর দেশের একজন বণিক এসেছে তাদের গাঁয়ে। ক্লান্তি দূর করার ঘুম আর গল্প বিক্রি করছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে। টগরের সামর্থ কম তাই তার ঘুম আর গালগল্পের পরিমানও কম। তাতে অবশ্য তার কোন অভিযোগ নেই।

ইংরেজিস্যার বলেছিল, কাট ইয়োর কোট একোর্ডিং টু ইয়োর ক্লোথ। কথাটা ভারী মনে ধরেছিল টগরের। তারপর অবশ্য আর পড়া হল না। কণ্যাশ্রীর জন্য স্কুলে নাম আছে বটে, কিন্তু লেখাপড়ার সময় নেই। তাও মাঝে মাঝে চেষ্টা করে।  আসলে মা-টা মরে গিয়ে সব এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। যখন ছিল তখন বাড়ির বৌয়ের, বাচ্চার মায়ের গুরুত্ব কেউ বোঝেনি।  আর কে-ই বা বুঝতে চায়!

টগর বারান্দায় ছেড়া চাদরখানা বিছিয়ে নেয়। এখানে বেশ হাওয়া আসে। উঠোনের এককোণে নিমগাছ। হাওয়া লেগে তার পাতা ঝিরঝির করে। গোয়ালঘরের পেছনে খচখচ করে শব্দ হয়। লালি কুকুরটা বাচ্চা দিয়েছে ওখানে৷ তার শব্দই হবে। তার পাশে টগরের প্রিয় দুটি গাছ গায়ে গায়ে বেয়ারে উঠেছে। একটা জারুল আর একটা অমলতাস। অমলতাসকে 'বান্দরেরনেটু' নামেই চেনে গ্রামের সবাই।

হলুদ রঙের ফুল ফুটলে মনে হয় গাছের ভেতরে হয়তো একটা দুপুর চুপ করে বসে আছে। জারুল ফুলগুলি যখন বাতাসে উড়ে উড়ে ওদের উঠোনে এসে পড়ে টগর সেই পাপড়িগুলো তুলে নিয়ে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে জমা করে। ওর মনে হয় এইসব ফুল, পাতা, আলো, বাতাস সবকিছুই তার কাছে কিছু বলতে আসে।  অথচ সে তাদের ভাষা বোঝে না। অনেক কিছুই বোঝে না সে। এই যেমন ওর লেখাপড়া।

টগর পড়তে চায়। কিন্তু ওর বাবা চায়না। তাহলে বাড়ির কাজ কে করবে। কে সামলাবে ঘরদোর। টগর বাবাকে বোঝাতে চাইত লেখাপড়া চালিয়েও সে ঘর সামলাতে পারবে। বাবা মানে না, "লেহাপড়া কইরা কি জজ ব্যারিস্টার হবা ?  আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দাও। যা কই তাই শোন। মা নাই তুমি হইলা বড়। তোমার মেলা দায়িত্ত। বুচচো? "

"তালে ইস্কুলে নাম রাখসো ক্যা? খালি ট্যাহার জইন্য? "

"মাইয়া মানুষের বেশি পড়ালেহা করা ভালা না। তোমার দুই ভাই আছে। অরা পড়ুক। তুমি মাঝে মাঝে দ্যাহায় দিবা।...বড় হইচ কিয়ের লাইগ্যা?"

টগরের কান্না পায়। রাগ পায়। কিন্তু বাবার সাথে পেরে ওঠে না। জারুল গাছে গুটগুট করে ঘুঘু ডাকে। কয়েকটা পাখি ডানা ঝাঁপটা মেরে উড়ে যায়। টগর ভাবে আকাশ কত্ত বড়! নিজের জন্য একটা জায়গা খোঁজে সে।  মায়ের কথা মনে পড়ে। মা বলতো," টগর লেহাপড়া বাদ দিবি না। কারো কথা হুনবিনা। কেউ চায়না মাইয়ারা বেশি লেহাপড়া করুক। তোর কিন্তু চাকরি করন লাগবো, কয়া দিতাছি। "

টগর মাটির দিকে তাকায়। মনে মনে বলে, "মাইয়ালোকের জায়গা নাই। কেউ জায়গা দেয়না। জায়গা কইরা নেওন লাগে।"

ঘরে গিয়ে বইখাতা বের করে। এখন তো বইখাতার জন্য বাপের কাছে টাকা চাইতে হয়না। সুতরাং...

  টগর পড়বে এবং পরীক্ষাও দেবে। স্কুলে গিয়ে হোক আর না-গিয়ে হোক।এই দুপুরটুকু, ভোরেরবেলাটুকু, রাতেরকিছুটা সময়,  টগর হিসেব করে নেয়। পড়ার সময় সে ঠিক বের করে নেবে। চাকরি করবে। একটা আলো করা ঘর থাকবে...।

বিকেল গড়িয়ে গেলে বাবা ঘরে আসে। টগরকে ডাক দেয়। "কাইল তোমারে দেখতে আসবো। একটু পরিপাটি হয়া থাইকো। তোমার কাকিরে কইছি। তোমারে সাজায় দিবেনি।"

সারা শরীর অবশ হয়ে যায় টগরের।"কী কও ইগলা? আমি তোমার কথা হুনচি। ইস্কুল বাদ দিছি। কিন্ত মাধ্যমিক..."

"আহ! যা কইছি তার যেন নড়চড় না হয়। ছেলে ভাল৷ বন্দরে পানের দোকান। ভালোই রোজগার করে। আর তোমার অতসব ভাবার কিছু নাই। যা কইলাম সেইডাই করবা।... লেহাপড়া পরেও করন যাইবো যদি তোমার শ্বশুরবাড়ি থিকা পারমিশন দেয়।"

"আর ইস্কুলে নাম? "

"নাম থাকবো। আঠারো বচ্ছর না হইলে তো আর নাম কাটানো যাবো না। ট্যাহাগুলা নষ্ট কইরা কি লাভ কও!"
ঘরের ভেতরে ঠাস করে শব্দ হয় ৷ একটা ইঁদুর মনে হয় কলে পড়ল। টগরের চোখে জল আসতে চায়। আটকে রাখে।

বাবা কল নিয়ে বাইরে আসে- " হালাডারে আইজকা পাইচি। খুব অইত্যাচার করছিস। আজ তোরে হালা জলে ডুবায়া মারুম।"

টগর নির্বাক হয়ে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকে। দম বন্ধ হয়ে আসে।