Tuesday, December 31

অনুরঞ্জনা ঘোষ নাথের অণুগল্প : জিঙ্গল বেলস





অনুরঞ্জনা ঘোষ নাথ
জিঙ্গল বেলস
       

সুরম্য আজ দারুণ মজায় কাটাচ্ছে দিনটা। সান্তা আজ ওকে ওর পছন্দের আয়রনম্যান টয়, নতুন ফুটবল আর স্পাইক শু দিয়েছে। যদিও ক্লাস টু তে উঠে ও এখন জানে ওর মাম্মা আর বাবাই হল সান্তা। তবুও ও সান্তাকে চিঠি লেখে গ্রিটিংস কার্ডে। আজ ২৫ ডিসেম্বরের  সকালে কেক কেটে, গিফ্ট পেয়ে, দুপুরে বাবা মার সঙ্গে ঘুরে বাড়ি ফিরছিল ও।  ফেরার সময়ে গোলপার্কের পাশে বাবা একটু গাড়ি পার্ক করেছিলো রাতের খাবার কেনার জন্য। তখন ও দেখল রাস্তায় গাছের তলায় ল্যাম্প পোষ্টের আলোতে দুটো বাচ্চা মেয়ে পড়াশোনা করছে। আর তার মধ্যে একটা মেয়ে লিখছিল আর একজন ছবিতে একটা ভাঙ্গা রঙের বাক্স থেকে রং নিয়ে রং করছিল। ও গাড়ি থেকে দৃশ্যটা দেখতে পেয়ে বাবাকে বললো, 'বাবা আমায়  দুটো রঙের বাক্স আর একটু ড্রয়িং পেন্সিল আর দুটো ড্রইং খাতা কিনে দেবে?'
বাবা জিজ্ঞাসা করাতে ও বলল, 'সামনের ফুটপাতে দেখো দুটো বাচ্চা মেয়ে বসে পড়াশোনা করছে। ওদেরকে কিছু দেয়নি সান্তা। চলনা বাবা, আমরাই সান্তা হয়ে ওদের কিছু...।'

ওর কথা শুনে ওর মা-বাবার চোখে জল এসে গেল প্রায়। সঙ্গে সঙ্গে ওর মা আর বাবা মিলে গোলপার্কের একটা খেলনার দোকান থেকে দুটো পুতুল আর পাশের বইখাতার দোকান থেকে দুটো ড্রইং খাতা, আঁকার পেন্সিল ও মোম রং কিনে সবকিছু সুরম্যকে দিল আর বলল, 'যাও,  তুমি গিয়ে ওদের দিয়ে এসো।' সুরম্য খুব খুশি হয়ে ওদের দুজনকে হাতে করে গিফট গুলো দিয়ে দিল এবং ওরাও খুব খুশি হয়ে নিল। মেয়ে দুটির নাম রুবি সুবি। রুবি সুবি জানালো যে ওরা একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। ওরা সুরম্যকে 'থ্যাংক ইউ' জানালে সুরম্য ওদের 'ওয়েলকাম' বলল।

খুব খুশি হয়ে গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করতে করতে সুরম্য গুনগুন করে  গেয়ে উঠল, 'জিংগেল বেল, জিংগেল বেল,  জিংগেল অল দ্য ওয়ে/ ও হোয়াট ফান, ইজ টু রাইড ইন আ ওয়ান হর্স ওপেন স্লেজ......


Monday, December 30

জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যের অণুগল্প : উচিত অনুচিত




জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য
উচিত অনুচিত


তনিমা কিছুতেই মনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে না । অরিত্রর সঙ্গে সম্পর্কটা ভেঙ্গে যাবার পর ওর আর কিছুই ভাল লাগে না ।কেবল মনে হয় সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার মত অনুচিত কাজটা কী করে অরিত্র করতে পারল!

বাড়ির লোক, বন্ধুরা ওকে খুশি রাখার অনেক চেষ্টা করে কিন্তু তবু ওর মনের ভার লাঘব হয় না ।

আজ ফোনে তনিমার বন্ধু সুজাতা রেগে গিয়ে বলল, 'তোর কী করা উচিত কী উচিত নয় সেটা তুই বুঝতে পারছিস না,  তাই এখনও এই যন্ত্রণা নিয়ে পড়ে আছিস । যে তোকে ছেড়ে গেছে, অনুচিত কাজ করেছে তোর ও উচিত তাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলা ।'

ফোন শেষ হলে চুপ করে বসে থাকে তনিমা । ও জানে ওর কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয় । তবুও মন মানে না ।ওর যা করা উচিত তা বুঝেও করতে পারে না।

আজ তনিমার মনে হয় কাজটা অরিত্র উচিত অনুচিত যাই ভেবেই করুকনা কেন তার জন্য ওকে আর দোষ দিয়ে লাভ নেই ।

Sunday, December 29

অভিজিৎ দাশ - সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘স্তন’ গল্পটি জটিল মনের মানচিত্র





অভিজিৎ দাশ
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘স্তন’ গল্পটি জটিল মনের মানচিত্র

‘স্তন’ শব্দটি শুনলেই মনে হয় যেন আলাদা সুর বেজে ওঠে। কিন্তু স্তনগ্রন্থি ও স্তনবৃন্ত কর্ডাটা পর্বভূক্ত ম্যামেলিয়া বা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের অমোঘ অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গ। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের স্ত্রী বা পুরুষ দুই দেহেই স্তন দেখা যায়। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের দেহেও এর উপস্থিতি আছে। তবে পুরুষ দেহে স্তন নিষ্ক্রিয় অঙ্গের মতো অবস্থান করে। নারীদেহে এর গুরুত্ব সর্বজনবিদিত। এর মধ্যে মানুষ যৌনতার গন্ধ খোঁজে। নারীর স্ফীত স্তন দেহের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। আর তা নারীর সৌন্দর্যের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এর পরিচর্যা নিয়ে নারীর যেমন ভাবনা পুরুষরাও তেমনি কম ভাবেন না। সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর সৌন্দর্য নানাভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। সুদূর প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত এই সৌন্দর্য নানাভাবে হাজির করা হয়েছে মানুষের সামনে। ভারতের প্রাচীন ভাস্কর্য, দেওয়াল চিত্র, মুরাল ইত্যাদিতে একে জীবন্ত করে রাখার চেষ্টা ইতিহাসগতভাবে সত্য। খাজুরাহো কিংবা লিঙ্গরাজ মন্দিরের দেওয়ালগাত্র তাই মানুষের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। আবার শুধু ভারতে নয়, সারা বিশ্বের এরকম সৃষ্টিকর্ম আছে।
সাহিত্যে তো উজাড় করে লেখা হয়েছে স্তনের সৌন্দর্য বর্ণনা পর্ব। ধর্মগ্রন্থ, কাব্য, মহাকাব্য, গদ্য, নাটক- সাহিত্যের প্রতিটি শাখা এতে মুখর। আদম ও ইভের আপেল খাওয়ার ঘটনায় আপেল কি প্রতীক নয় ? আর এর জন্যই তাদের প্যারাডাইস লস্ট (Paradise Lost) হয়েছে। নারীর স্তন অনেক মুণী-ঋষিকেও কামমোহিত করেছে। নারীদেহের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ নিয়ে ‘ইন্ডিয়া টুডে’ (India Today) পত্রিকা একটি সমীক্ষার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে দেখা যায় আটচল্লিশ শতাংশ (৪৮%) পুরুষ স্তনকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। সিনেমাগুলিতে প্রয়োজকরা দর্শক টানার মাধ্যম হিসেবে এই সৌন্দর্যকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। এতে হলিউড, বলিউড, টলিউডের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই। সাহিত্যগুলিতে কখনো আপেল, কখনো বেল, কখনো দাড়িম্ব, কখনো টমাটো ইত্যাদি প্রতীক ব্যবহার করে এই অঙ্গটিকে সাহিত্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু এখানেই তো এর ভূমিকা শেষ নয়, বরং এর আসল সৌন্দর্য ফুটে ওঠে মাতৃত্বের মাধ্যমে। কোনো শিশুর প্রথম খাদ্য যোগান দেয় এই স্তন। স্তন নিঃসৃত ক্ষরণ (দুধ) পুষ্টিকর খাদ্য। সদ্যোজাত শিশুর পক্ষে এই খাদ্যের বিকল্প নেই। আসলে এজন্যই তো আমরা  স্তন্যপায়ী প্রাণী। এ প্রসঙ্গে তুলসী লাহিড়ী রচিত ‘ছেঁড়া তার’ নাটকে ফুলজানের একটি সংলাপ উল্লেখ করলে অত্যূক্তি হবে না। সংলাপটি হল- “বাচ্চা পয়দা হবার আগে আল্লা মায়ের বুকে দুধ আনি রাখি দ্যায়। বাপের বুকে তো দ্যায় না।” এ নিয়ে নারীদের গর্ব হওয়াই স্বাভাবিক, আর এখানেই বোধ হয় নারীর প্রকৃত সৌন্দর্য। নারী বিকৃত রুচির দেহলোলুপ পুরুষকে চোখে আঙুল দিয়ে বলতে পারে-তুমিও তো কোনো নারীর স্তন পান করেই জীবনধারণ করেছ, তোমার এই বিকৃতি কি তাকে অপমান করা নয় ?
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একটি গল্প ‘স্তন’। গল্পটি তাঁর ‘দুই তীর এবং অন্যান্য গল্প’ গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ওয়ালীউল্লাহর মাত্র দুটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থটি ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে ঢাকা থেকে থেকে প্রকাশিত হয়। অপর গল্পগ্রন্থটি হল ‘নয়নতারা’। এটি মার্চ ১৯৪৫-এ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। আরো কয়েকটি গল্প বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পরে সেগুলি তাঁর ‘গল্পসমগ্র’-তে স্থান পেয়েছে। তবে সব মিলিয়ে গল্পের সংখ্যা পঞ্চাশটিও ছোঁয়নি। তাছাড়া তিনটি উপন্যাস, তিনটি নাটক এবং বাংলা ইংরেজি ভাষায় কয়েকটি প্রবন্ধ এই শিল্পীর নির্মাণ। তবে নির্মাণের স্বল্পতা থাকা সত্ত্বেও তাঁর চিন্তাধারা, দার্শনিকতা, মনঃসমীক্ষা তাঁকে ভাস্বরতা দান করেছে। তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসটি তো এককথায় অনন্য। গল্পগুলির সম্বন্ধে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় সুশীল জানা লিখেছেন-
“ওয়ালীউল্লাহ সাহেবের ঝোঁক মনঃসমীক্ষণের দিকেই বেশি। এতে বিপদ আছে। বিশেষ করে যে শ্রেণির মর্মকথা তিনি লিখেছেন সেক্ষেত্রে। মধ্যভিত্তিক ভাব প্রবণতা আবেশের ঝোঁকে ঘাড়ে চেপে বসে গিয়ে নিপীড়িত শ্রেণি জীবনের ওপরে। জীবন আড়াল হয়ে যায়। যা বর্তমান সাহিত্যে খুবই সুলভ। এতে রচনা জীবনধর্মী না হয়ে হয়ে পড়ে ভাবধর্মী।” (১৩৫৩ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত)
চট্টগ্রামের ষোলকাহারে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের পরিবেশে তিনি মানুষ হয়েছেন। ফলে তাঁর মনে একটি রুচিশীল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল। বাল্যকালে পিতার কর্মসূত্রে এবং নিজের কর্মজীবনে তিনি দেশ, বিদেশের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই বহু মানুষের সাথে তিনি মেলামেশার সুযোগ পেয়েছিলেন। এগুলির প্রভাব তাঁর সাহিত্যের মধ্যে পড়েছে। সংবাদপত্র ও বেতারে সাংবাদিকতা বা বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করার সূত্রে জীবনকে জানার পরিধি বেড়েছে। মানুষের জীবন চর্যা, মন ও মননের সাথে নিবীড় যোগসূত্র তাঁর সৃষ্টিতে বৈচিত্র দান করেছে। ১০ই অক্টোবর ১৯৭১ প্যারী শহরের উপকন্ঠে তাঁর জীবনাসন ঘটে।
তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে জনমত গঠনে তিনি সক্রিয় ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের তহবিলে তিনি নিয়মিত অর্থদান করতেন।  দেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা, আশঙ্কা ও হতাশা তাঁর অকাল মৃত্যুর কারণ বলে তাঁর পরিবার মনে করে। দেশের মানুষকে যে তিনি কত ভালোবাসতেন তার জ্বলন্ত উদাহরণ তাঁর সাহিত্য। এখানে দেশের মানুষ, দেশের সমাজ, পটভূমিকায়ও দেশের ছবি পাঠক মাত্রই সহজে বুঝতে পারবেন। তাঁর ছোটগল্পগুলি যেন এরই প্রতিচ্ছবি।
‘স্তন’ গল্পটির মূল বিষয় আবর্তিত হয়েছে এক মা-হারা সদ্যোজাত শিশুকে দুধ খাওয়ানোকে কেন্দ্র করে। আবু তালেব মোহাম্মদ সালাহ্‌উদ্দিনের ছোট মেয়ে খালেদা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। ফলে তার আদরের মেয়ের সদ্যোজাত ছেলেটি মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত হয়। ঠিক একই সময়ে দূর সম্পর্কিত আত্মীয় কাদেরের ষষ্ঠ সন্তান জন্মানোর কয়েক ঘণ্টা পরেই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেয়। একদিকে তার নাতি মা হারা, অপরদিকে কাদেরের স্ত্রী সন্তান হারা। তাই সালাহ্‌উদ্দিন সাহেবের মনে হয়েছিল এই শিশু এবং কাদেরের স্ত্রী পরস্পরের পরিপূরক হতে পারে। এই ভাবনা থেকেই তিনি কাদেরের বাড়ির বৈঠকখানায় হাজির হন।
কম বেতন পাওয়া কেরানী কাদেরের ঘরে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। ঘরের চারদিকে নোংরা, তার চার বছরের মেয়েটির মুখেও ময়লার স্পর্শ। অপরদিকে সালাহ্‌উদ্দিনের অবস্থার কথা গল্পে না থাকলেও তার নিজস্ব একট গাড়ি আছে। নাতির জন্য দাই রেখেছেন। সুতরাং তিনি অবস্থাপন্ন না হয়ে পারেন না। তাই কাদেরের বাড়ি দেখে তিনি নারাজ হন। তার মনে হয় “যে প্রস্তাবটি নিয়ে তিনি কাদেরের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন, সেটি উত্থাপন করা সমীচীন হবে কি না সে-বিষয়ে ক্ষণকালের জন্য তার মনে একটা সন্দেহ জাগে। কিন্তু গরজ বড়ো বালাই। তাই দ্বিধা ঝেড়ে বলেন, “ আপনার কাছে একটা কথা নিয়ে এসেছি। আমার নাতিকে দুধ দেবার কেউ নেই। এটুকু বলেই তিনি থামেন। ...শুনেছি আপনার স্ত্রীর স্বাস্থ্য খোদার ফজলে ভালোই। ভাবছিলাম, আমার মা-হারা শিশু-নাতিকে তার বুকের দুধ দিতে রাজি হবেন কি ? হলে বাচ্চাটিকে এখনই নিয়ে আসি। ...আপনার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে আসবেন ?”
কাদের ফিরে এলে তার মুখে সম্মতির চিহ্ন দেখে তিনি উঠে পড়েন। সাথে নিজের প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি দেন, “ডাক্তার অবশ্য বোতলের দুধ দিতে বলে। ওসব আধুনিক পন্থায় আমার বিশ্বাস নেই। দুধের শিশু বুকের দুধ খাবে, প্রকৃতির রীতি তাই।” ডাক্তার হয়তো মা-হারা শিশুকে বিকল্প খাদ্যের যোগান দিতে বোতলের দুধ পান করানোর কথা বলেছিলেন, কিন্তু মায়ের দুধের বিকল্প তা হতে পারে না। অনেক মানুষ-মাকে দেখা গেছে মা-হারা পোষ্য ছাগল বা কুকুরকেও নিজের স্তন থেকে দুধ খাইয়ে বাঁচিয়েছেন। সুতরাং সালাহ্‌উদ্দিন সাহেবের এই প্রস্তাব কোনো সৃষ্টিছাড়া প্রস্তাব নয়। আর তাছাড়া বাচ্চা জন্মানোর পর তাকে স্তনের দুধ খাওয়াতে না পারলে মায়ের শারীরিক সমস্যাও দেখা দেয়। সেদিক থেকে ভাবতে গেলে এই প্রস্তাব কাদেরের স্ত্রীর কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। শিশুটি যেমন মাকে পাবে (স্বপ্ল সময়ের জন্য হলেও), তেমনি কাদেরের স্ত্রী মাজেদাও সন্তানকে পাবে। সুতরাং মনস্তাত্বিক দিক থেকে পর্যালোচনা করলে এতে উভয়ের ভালো হবার কথা। এজন্যই কাদের ও মাজেদা রাজি হয়েছে। নাতিকে বাঁচাতে ঘরে, গায়ে যত নোংরাই দেখুন না কেন সালাহ্‌উদ্দিন সাহেবও তৃপ্ত। কিন্তু মনের গলিঘুজির সন্ধান পাওয়া এত সহজ নয়। এখানেই মনোবিকলন তত্ত্বের কথা এসে পড়ে। আবদুল মান্নান সৈয়দ তাই গল্পটিকে মনোবিকলনধর্মী বলে চিহ্নিত করেছেন।১
গল্পের বাস্তবে মনোবিকলন প্রভাব বিস্তার করেছে। তাই সেদিন বিকেলে শিশুটিকে দুধ খাওয়ানোর জন্য মাজেদা কোলে তুলে নেয়। তার মনে হয় “উন্নত স্ফীত স্তনে ঝরণার মতো আওয়াজ করেই যেন দুধ জমেছে। তার স্তনে সঞ্চিত দুধের বেদনা। সে বেদনা জীবনেরই বেদনা; বুকে যা জমেছে দৃষ্টির অন্তরালে তা স্নেহ-মমতার সুধা। মনে আছে তার অন্যান্য সন্তানের বেলায় যখনই শিশুর কান্না কানে পৌঁছুত, তখন কুচাগ্র দিয়ে দুধ বেরিয়ে আসত, পেটের নীচে কেমন সঙ্কোচন-প্রসারণও শুরু হত। তার এখন মনে হয়, কোলের শিশুটির কান্নার আওয়াজে কুচাগ্র যেন তেমনি সিঞ্চিত হয়ে উঠেছে, তেমনি সংকোচন-প্রসারণ শুরু হয়েছে পেটের তলে। শিশুটি যে তার নয়, তাতে বাঁধা পড়েনি।” কিন্তু শিশুটি তার ইপ্সিত দুধ পায়নি। মাজেদার মন তো আসলে ভরে আছে তার মৃত শিশুর কথায়। তাই শিশুটি দুধ পায়নি। মনের জটিলতাই তার দুধ ক্ষরিত না হবার কারণ। মাজেদার মনে হয়েছে ‘দুধ জমে গেছে’। পরদিন মাজেদা শিশুটিকে দুধ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়। তার মনে আবার দুধ জমে যাওয়ার কথা আসে। তার মনে প্রশ্ন জাগে এবং সে এভাবে উত্তর খোঁজে- “কিন্তু কেন তার স্তনের এই অবস্থা হয়েছে ? এ কি সম্ভব যে, যে-দুধ তার সন্তানের জন্যই এসেছিল, তার সন্তানটি আর নেই বলে সে-দুধ এমনভাবে জমে গেছে।” এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। একমাত্র মনস্তত্ত্বগত ব্যাখ্যাই শুধু হতে পারে।
মাজেদার মনের জটিলতায় আর একটি বিপরীত কথারও উদয় হয়। “তাই শীঘ্র একটি তীব্র অনুশোচনার জ্বালা সে বোধ করে। কী করে সে এমন নির্মম কথা ভাবতে পেরেছে? শিশুটি
নিজের গর্ভের না হোক সে শিশু। তাছাড়া মা-হারা অসহায় শিশু। এমন শিশুকে কেউ কখনো দুধ থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। তাছাড়া কথাটি যে সত্য নয় তার প্রমাণ সে নিজেই দেখতে পায়। শিশুটিকে স্তন দেবার জন্য সে মনে-প্রাণে-দেহে একটি তীব্র আকাঙ্ক্ষা বোধ করে। সে আকাঙ্ক্ষা কি ভুল হতে পারে ?” বাস্তবিক মাজেদার মাতৃত্ব এক্ষত্রে দেহে সঞ্চারিত হয়েছে। কিন্তু শিশুটি জন্মের চতুর্থ দিনেও দুধ পায়নি। পরিবর্তে দাই ওর মুখে জল দিয়েছে। এরকম অবস্থায় শিশুটিকে বাঁচানো বড়ো প্রশ্ন চিহ্নের সন্মুখীন হয়ে পড়েছে।
আসলে শিশুটি অন্যের হলেও ওর প্রতি মাজেদার মাতৃত্ব প্রকাশে একটুও কার্পণ্য ঘটেনি। কিন্তু সবই নিষ্ফল হয়ে গেছে। তাই “তার মনে হয় শিশুটিকে স্তন পান করানোর জন্য সে যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা বোধ করে, সেটি আসল সত্যটি ঢাকার জন্য তার মনেরই একটি কৌশলমাত্র। আসল সত্যটি এই যে, তার নিজের সন্তানের মৃত্যু হয়েছে বলে সে চায় না যে, পরের শিশু বেঁচে থাক। সেজন্যেই তার বুকভরা দুধ এমন করে জমে পাথর হয়ে গেছে।” মাজেদার নিজের মনে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে যে সত্য উঠে এসেছে তা পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করা যায় না। তবু একথা বলা যায় যে, তাহলে মাজেদা প্রথমে এবং পরেও দুধ দিতে চাইত না। কিন্তু কখনো তা করেনি। এই প্রসঙ্গে ‘Home They Brought Her Warrior Dead’ নামে টেনিসন রচিত বিখ্যাত কবিতাটির কথা মনে পড়ে। কবিতাটিতে এক যোদ্ধার বাড়িতে তার মৃতদেহটি বয়ে নিয়ে আসার কথা আছে। তা দেখে  মৃত যোদ্ধার স্ত্রী এমন হয়ে যায় যে তার বাস্তবজ্ঞান লোভ পায়। সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে না ঠিকই কিন্তু তার জীবনে কী ঘটেছে বা তার চারপাশে কী ঘটছে তা তার মস্তিষ্ক গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। তাই স্বামীর মৃত্যু তাকে স্পর্শ করতে পারে না। এরকম পরিস্থিতিতে তার শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষজন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। শেষে একজন তার শিশুটিকে কোলে তুলে দিলে সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে-তার বাস্তবজ্ঞান ফিরে আসে।
এই গল্পে মাজেদা মনের টানাপোড়েনে ভুগতে ভুগতে তবে কি অ্যাবনরমাল হয়ে পড়ল? এর জন্যই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তারবাবু বলেন, “মাজেদার দুধ এখনো আসেনি। সেটা নাকি বিচিত্র নয়। আকস্মিকভাবে গভীর আঘাত পেলে দুধ আসতে দেরী হয়।” তারপর তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের দুর্বোধ্যতায় এর ব্যাখ্যা করেন। ডাক্তারবাবুর কথা তাঁকে আরও ভীত করে তোলে তার মানসিক চাপ আরও বাড়ে।
অপরদিকে সালাহ্‌উদ্দিন সাহেব এইনির্মম সত্য জানতে পারেননি। তাই তিনি মাজেদার উপকারকে মনে রেখে তাকে ভালো খাবার পাঠাতে চেয়েছেন। তার মুন্সীরহাটে থাকা জমি মাজেদার নামে লিখে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু কারো কোনো শুভ মানসিকতা বা মানবিকতাই শিশুটির মুখে দুধ দিতে পারেনি।
মাজেদার মনে হয় সব ঘটনাই আসলে তার পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় সে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য অদম্য হয়ে ওঠে। আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন, “সন্তানের মৃত্যুর পর স্তনে দুধহীন নারী কী করে অস্বভাবী (abnormal) মানসতায় পৌঁছোল, এখানে তার অনুপুঙ্খ ক্রমিক বর্ণনা আছে। শেষ পর্যন্ত মাজেদার মনে দুধের আকাঙ্ক্ষা এমন তীব্র হয় যে তার ধারণা হয় কুচাগ্রে কী যেন আটকে আছে বলে দুধ সরছে না।” তখন সে মাথার চুলের কাঁটা দিয়ে দুই স্তনাগ্রই তীব্রভাবে বিদ্ধ করে। আর তারপর ? গল্পের শেষে দুটি বাক্য ; ‘তার স্তন থেকে দুধ ঝরে, অশান্তভাবে দুধ ঝরে। আর সে দুধের বর্ণ সাদা নয়, লাল।’ দুধের আকাঙ্ক্ষায় স্তন থেকে রক্তপাতের বর্ণনা মাজেদার অস্বভাবী অদ্ভুত মানসতার সাক্ষ্যে গল্প শেষ হয়।”২
হায়াৎ মামুদ ওয়ালীউল্লাহর ‘স্তন’ এবং আরো কয়েকটি গল্প নিয়ে মন্তব্য করেছেন, সেগুলি “মিলবে যেখানে গল্প-কবিতা মেশামিশি হয়ে আমাদের মনের বুদ্ধি বা চেতনার স্তরে নয়, অন্য কোনো গহীন অচেতন স্তরে বা বোধে অনুরণন তোলে। ...তিনি বস্তু জাগতিক বিশ্বের ভিতরেই স্বপ্ন ও বাস্তবের মাঝামাঝি এক প্রদোষান্ধকারে নিয়ে যান আমাদের।”৩
এখানেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অনন্যতা। ছায়াৎ মামুদ আরো বলেছেন, “সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মনের প্রবণতা ছিল, আমার ধারণায়, দার্শনিকের।”৪ তাঁর এই ‘স্তন’ গল্পটিতে মাতৃত্ব, মনোবিকলনত্ব ইত্যাদির মধ্যেও দার্শনিকতার স্বাদ থেকে পাঠকরা বঞ্চিত হননি। এখানেই আর সৃষ্টির সার্থকতা নিহিত আছে।
তথ্যসূত্র-
১) আবদুল মান্নান সৈয়দ- সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ছোটগল্প (প্রবন্ধ), দিবারাত্রির কাব্য, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সংখ্যা, জানু-মার্চ ২০০৮, পৃ. ১২২
২) প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৩
৩) সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘গল্প সমগ্র’-এর ভূমিকা, প্রতীক প্রকাশনা, ঢাকা, মার্চ ২০১৭
৪) প্রাগুক্ত

রণজিৎ শীল - ইলিয়াসের দুধে ভাতে উৎপাত : মানবতার প্রতীকী সংকট




রণজিৎ শীল
ইলিয়াসের দুধে ভাতে উৎপাত : মানবতার প্রতীকী সংকট   


আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) বাংলাদেশ তথা বাংলা সাহিত্যের এক ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক ।দেশভাগের কিছু পূর্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের  সময়  তৈরি করা মন্বন্তর , কালোবাজারি , খাদ্য সংকটের মতো কালো মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে  জন্ম নেওয়া সাহিত্যিকের রচনার শিরা উপশিরায়  ঘুরে ফিরে বাংলাদেশের নানা সময়ের ঘটনা  ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছে একটু লক্ষ করলে বোঝা যায়  ।আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর ৫৪ বছরের জীবনে মাত্র দুটি উপন্যাস  ও  ২২-২৩ টি গল্প রচনা করেছেন সত্য  ।সংখ্যার বিচারে নয় ভাবনার গভীরতায় , ভাষার দৃঢ়তায়, শৈলীগত নবনির্মাণে  ইলিয়াস এক বলিষ্ঠ লেখক এবিষয়ে সংশয় নেই। বাবা স্কুল হেডমাস্টার অর্থাৎ নিজে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হলেও মধ্যবিত্ত জীবনচর্চার স্বাভাবিক পরিণতিতে তাঁর অবস্থান দৃঢ় ছিলনা ।তাই পরবর্তী জীবনে মধ্যবিত্তের  খোলস ছেড়ে বেরিয়ে ফিরে যান চাষি মজুরের জীবনে ।তাঁর এই সময়ের গল্প গুলিতে এই বীক্ষা ও চিন্তনের পরিবর্তন অন্যমাত্রা দান করেছে ।তাঁর  গল্পে দেখা যায়  আপসহীন  আক্রমণের ভঙ্গী যেমন স্বতন্ত্র  ,তেমনি  আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাষা তীরের ফলার মতো  শানিত ,সজারু কাঁটার মতো তীক্ষ্ণ ।তার গল্পের মুল  কাহিনী বাস্তবের কপি পেস্ট নয় বরং গল্পের চরিত্ররা অনেক বেশি  স্বপ্রতিভ।একজন সাহিত্যিকের সাথে কথোপকথনে  ইলিয়াস নিজেই বলেছিলেন যে- তার গল্পের চরিত্ররা আগের থেকে ভাবনার ফলশ্রুতি নয় বরং তার গল্পের চরিত্ররাই গল্পকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ।আখতারুজ্জামান নিজে ওতপ্রোত ভাবে রাজনীতি করেননি সত্য কিন্তু রাজনৈতিক উত্থানপতন ,আন্দোলনের গতিপথ ,বিপ্লবের ভয়াল রুপ প্রত্যক্ষ করেছেন।ঢেউ লেগেছে তার অতল হৃদয়ে , তার হৃদয়কে আরথিন ছাড়া বিদ্যুৎ এর মতো ঝলসে দিয়েছে পূর্ব  পাকিস্থানের মুক্তি যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি কৃষক ,মজদুর ,সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার  কঠিন  লড়াই ।  অনুভব কয়েছেন এপার  বাংলার নকশাল আন্দোলনের তীব্রতা ।সাহিত্য ক্ষেত্রে ইলিয়াস মানিক বন্দোপাধ্যায়ের   উত্তরসূরী হলেও অনেক জায়গায় তিনি মানিকের পথ থেকে অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখেছেন অটুট রেখেছেন আপন ঘরানা ।মানিক সাম্যবাদে বিশ্বাসী । তাঁর  বিশ্বাস জায়গা করে নিয়েছে তাঁর  সাহিত্যে ।শ্রমিক শ্রেণি, মজদুর সমাজ হয়ে উঠেছে  তাঁর  রচনার নিয়ন্ত্রক ।কিন্তু সুকৌশলে ইলিয়াস সেই মোহ কাটিয়ে বাংলা সাহিত্যে  এক নব নির্মাণ করলেন মজদুর নয় অভিজাত নয় তাঁর গল্পের নায়ক সময়  ।গল্পের চরিত্ররা শ্রেণি ভিত্তিক  নিয়ন্ত্রক না হয়ে, হয়ে উঠল  সময় কেন্দ্রিক নায়ক ।কিন্তু সাম্যবাদের কথা সরাসরি না বললেও  অধিকারের কথা ,জীবনের প্রয়োজনীয়  প্রাপ্য আদায়ের অঙ্গীকার  ।তাঁর গল্পের পাঠক মাত্রই বুঝতে পারবেন দেশভাগের যন্ত্রণা ,পাকিস্থান সরকারের পূর্ব পাকিস্থানের বাংলা ভাষী মানুষের প্রতি বৈষম্য মূলক  আচরণ,খাদ্য সংকট ,গ্রামের নিঃস্ব মানুষের হাহাকার ,তার গল্পের ধমনীতে নিত্য প্রবাহিত ।এর আগেই বলা হয়েছে ইলিয়াস নিজেই বলেছেন যে তার গল্পের চরিত্ররা আপন গৌরবেই মহীয়ান । যেখানে লেখকের আর কর্তৃত্ব চলেনা, চলেনা রিমোড কন্ট্রোল।তার-ই এক প্রতিভাস আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের “দুধে ভাতে উতপাত”    নামক গল্পটি ।গল্পটি  রচিত হয়েছে ১৯৬৫-৭৮ সালের মধ্যে কোন এক সময়ে ।অর্থাৎ দেশভাগ , পাকিস্থান ,স্বাধীন বাংলাদেশ হাতে পেয়েছে ততদিনে পূর্ব বঙ্গের সাধারণ মানুষ ।এই    গল্পের মূল প্লট অতি সাধারণ হলেও এর প্রতীকী আবদার অনেক গভীর ।হাশমত  মহুরি   পেশায়  ব্যবসায়ী  ।জয়নাবকে  সন্তানের বা সংসারের খাবার জোগারের জন্য ধারে চাল নিতে হয়।আধ্মন চালের দাম শোধ না করতে পারায় জরদস্তি জয়নাবের কালো  দুধেল গরু হাশমতের  বোন জামাই  হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায়  ।প্রতিবাদ করার প্রয়াস পর্যন্ত তখন সে পায় না ।মানসিক দ্বন্দ্ব  যন্ত্রণা  তার পাজরের হাড় ভেঙ্গে দিয়েছে । তাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে ,সন্তান সন্ততির অতিসাধারণ প্রত্যাশা একটু খানি দুধ ও ভাত  না দিতে পারার   আক্ষেপ ।শেষে জয়নাব রোগ যন্ত্রণার বিষময় দেহ   নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বিছানায় ।জয়নাবের ও   তার সন্তানের দুধভাত খাওয়ার স্বপ্ন ভঙ্গ শুধু তার ব্যক্তিগত যন্ত্রণা  বললে ভুল হবে ।সেদিনের তামাম পূর্ব পাকিস্থানের সাধারণ মানুষের অন্তরের আর্তি –ই নয় রীতি মতো ক্ষোভ ভাবলে অত্যুক্তি হবেনা বলেই আমার মনে হয় ।যে আশা নিয়ে বাঙালি নতুন সূর্যের আলোতে অবগাহন করবে বলে আনন্দে আতখানা হয়ে পড়েছিল সে স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে ।জয়নাবের দুধ ভাত খাবার ও সন্তানদের খাওয়ানোর  আশার অন্তরালক্ষে  কোথায় যেন  ঘুরে দাঁড়াবার প্রয়াস ,অধিকার লাভের তীব্র বাসনা ,ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার রক্তিম মুখ ভেসে উঠেছে  পাঠকের কল্পনালোকে ।তাই তো জয়নাব বারবার ছেলেকে বলে ওঠে “ওইদুল্লা   বাবা আমার কালা গাইটা আনতে পারলি না? হাশমত  মউরির পোলায় দড়ি ধইরা টাইনা  লইয়া গেলো ।একটা বছর পার হইয়া গেলো একটা   দিন দুগা ভাত মাখাইতে পারলাম না ।“ মাতৃ হৃদয়ের এই যে হাহাকার এটা শুধু ব্যক্তি জয়নাবের নয় ।দেশভাগ  পরবর্তীপূর্ব বাংলার  বাঙালি জাতির মাতার  আর্তনাদ ছাড়া আরকী?।
                   
ইলিয়াস অতি সন্তর্পণে পাঠকের ভাবালুতাকে এড়িয়ে নিয়ে আবেগে মাতিয়ে দিতে  সক্ষম এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ।মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্য,বস্ত্র বাসস্থানের মতো ন্যূনতম বিষয় যখন প্রশ্নের মুখে পড়ে তখন আর মানুষের ধর্ম ,জাতি  লিঙ্গ , আপন -পর মাথায় থাকে না ।পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ কল্পনায়  আপন সন্তান সন্ততি নিয়ে স্বপ্নের নীড় রচনা করে। , যখন সে তার সামান্য অংশটুকু হাতের কাছ থেকে দূরে চলে যায় তখন সে অসহায় বাইসনের   মতো হিংস্র  হয়ে ওঠে । যখন কালো  গরুটিকে  হারুন মৃথা  নিয়ে যেতে নেয় তখন জয়নাব হুঙ্কার দিয়ে বলে ওঠে ছেলেকে  “বুইড়া মরদটা কী দ্যাহস ? গরু লইয়া যায়  খাড়াইয়া খাড়াইয়া কী দ্যাহস “ অর্থাৎ জয়নাব প্রতিবাদের বিষ শল্য নিক্ষেপ করেছেন সুকৌশলে এটা সচেতন পাঠকের বুঝতে  বিন্দুমাত্র  অসুবিধা   হয়না  ।  এ যেন নিজের প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার  ,নিজের অধিকার আদায়ের এক সূক্ষ্ম ইঙ্গিত ,পৃথিবীতে বাঁচার সংগ্রামের  এক প্রতীকী ডাক । অবহেলিত ,বঞ্চিত , প্রলেতারিয়াৎ মানুষের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সংকল্পটি সুচালো সূচের মতো ফুটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন ইলিয়াস ।এইখানেই ইলিয়াস স্বতন্ত্র  ,এইখানেই ইলিয়াসের লেখক সত্তার অনন্য  ব্যক্তিত্ব ।


                    এখানেই গল্প শেষ করেননি   লেখক ।জয়নাব  ছেলে ওইদুল্লাকে  শেষ বারের মতো আদেশ দিলে   ছেলে বেরিয়ে পড়েছে  মাতার  আদেশ কায়েম করার সঙ্কল্প নিয়ে।গল্পে কোথাও সরাসরি বিদ্রোহের কথা নেই তবে ঝাঁঝ চোরাস্রোতের মতো প্রবহমান  ।  তাইতো এই গল্পের গতি বুঝতে তিন সেকেন্ড সময় লাগেনা পাঠকের ।এইখানেই ইলিয়াসের কলম  স্বাতন্ত্র্য ।

এই গল্পে  যখন দেখা যায়  দরিদ্র ঘরের   ওইদুল্লা  মহুরির বাড়িতে যায়  তখন দেখে সেখানে  অ্যালুমিনিয়াম  থালা থেকে গম ছিটিয়ে মুরগিকে খাওয়াতে তা দেখে তার মনে হয়  সব কটা মুরগির  ঠোঁট কামড়িয়ে  গম গুলি দাঁতে চিবিয়ে ফেলে ।এই বক্তব্যের  অন্তরালে  ওইদুল্লার শুধু নয় সেই সময়ের অস্থির দোলাচল সময়ের  বাঙালি জাতির অন্তরের এক হিম -শীতল কষ্টের আগুনকে  আবিষ্কার করা  যায় ।  এখানেই যা মানুষের প্রয়োজন তা যেন হয়ে উঠেছে  বিলাসিতা ।দুধ ভাত বাঙালি জাতির অতি প্রাচীন কাল থেকেই প্রত্যাশিত বিষয় ।আমরা কবি রায়গুণাকর  ভরত চন্দ্রের মুখেও  অষ্টাদশ  শতকে শুনেছি ঈশ্বরী পাটনির বর প্রার্থনা “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে” অর্থাৎ ন্যূনতম   প্রয়োজন টুকু মিটলেই তারা সুখী-খুশি ।এই গল্পে দেখেছি  আমরা যখন ওহিদুল্লা  মহুরির বাড়িতে গিয়ে নিজেদের বিক্রি করা গরুর দুধ আবদার করে  মাতা জয়নাবের শেষ ইচ্ছে দুধ ভাত খাওয়ার  ইচ্ছে  পূরণের জন্য। সে বলে তার মায়ের হাউস অর্থাৎ শখ হয়েছে দুধ ভাত খাওয়ার । দু দুটো আন্দোলন হয়েছে ।নতুন স্বাধীন সূর্যও  উঠেছে কিন্তু  বাঙালি সাধারণ মানুষ সূর্য গ্রহণের গাঢ়  অন্ধকার কাটিয়ে উঠতে পারেনি ।বাংলাদেশের কৃষকদের এই খাদ্য সংকট , অভাব অনটন  এক নির্মম সত্য এইভাবেই ইলিয়াস সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই গল্পের শাখা প্রশাখায়।

  এই গল্পে আমরা  অবাক হই  না যখন  দেখি মহুরির অনুপস্থিতিতে  হারুন মৃথার কটূক্তি শুনি  ” তর মায়ের প্যাট খারাপ , তগো হইছে মাথা খারাপ ।“ এ তো ৭০ দশকের বাংলাদেশের কঠিন নিরেট সত্য ।ইলিয়াস ধরতে চেয়েছেন এই সময়কে ,বোঝাতে চেয়েছেন দেশভাগ ,স্বাধীনতার পর   মেকি ভেগ ধারীদের আসল রুপ ।আখতারুজ্জামান ইলিয়াস  এই গল্পে এই  সময়ের মানুষের প্রতিদিনের  জীবন যাপনের   একটি স্পষ্ট ছবি এঁকে আঘাত করেছেন মানবতার সোনালী অট্টালিকায় ।ইলিয়াস বাংলাদেশের  সাধারণ মানুষের নাড়ীর যন্ত্রণা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তো  তিনি ইলিয়াস ।





          

সুকুমার রুজের অণুগল্প : জামা






সুকুমার রুজ
জামা

 সোনাদা, পঞ্চাশ হাজার  টাকার খুব দরকার, ধার দেবে? সামনের মাসেই তো ভোট, ভোট পেরোলেই শোধ দেব!
 ---- এত টাকা কী করবি রে!
 ---- একটা জামা কিনবো।
---- জামা! পঞ্চাশ হাজার টাকার!
 ----- পঞ্চাশ হাজার নয়, ষাট হাজার টাকার। দশ হাজার জমিয়েছি।
 ----- সেতো তোর তিন মাসের রোজগার। তোর মাথার ঠিক আছে তো!
 ------ হ্যাঁ, তার জন্যই তো ওই জামা কিনবো। ওই জামা গায়ে দিলে আর আমার টাকার চিন্তা করতে হবে না।
 ----- কী রকম! জামার এত বিশেষত্ব কী?
----- ওই জামার রং বদলায়। যখন যেখানে যে মিটিং - মিছিলে যাব,
তখন প্রয়োজন অনুযায়ী সেটা লাল, নীল-সাদা, গেরুয়া কিংবা সবুজ রঙের হয়ে যাবে। ভোটের আগে এক মাস মিটিং-মিছিলে গেলেই...
 ------ চল, আমিও তোর সঙ্গে যাবো জামা কিনতে।


Saturday, December 28

মহম্মদ লতিফ হোসেন - আউয়াল আহমদ-এর ‘ছিটগ্রস্থ’ : বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটবাসীদের প্রবহমান জীবনযাত্রার চড়াই-উৎরাই-এর চালচিত্র






মহম্মদ লতিফ হোসেন -
আউয়াল আহমদ-এর ‘ছিটগ্রস্থ’ : বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটবাসীদের প্রবহমান জীবনযাত্রার চড়াই-উৎরাই-এর চালচিত্র


‘দ্রষ্টব্য ও করাতকল’ পত্রিকার সম্পাদক আউয়াল আহমদ (জন্ম-১৯৭৮) মূলত কবি। আমরা পেয়েছি তাঁর কাব্যগ্রন্থ – ‘সদ্যপুরাণ রূপকথা’। পাশাপাশি গল্পকার হিসেবেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ হল – ‘একটি জন্মদিনের মৃত্যু এবং একজন মৃতের জন্মদিন’। আউয়াল আহমদ-এর ছিটমহল বিষয়ক একটি গল্পই আমরা খুঁজে পাই। ‘ছিটগ্রস্থ’  নামক এই আখ্যানটি প্রকাশিত হয়েছিল রাজা সহিদুল আসলাম সম্পাদিত ‘চালচিত্র’ পত্রিকায়, ২০১৬ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায়। গল্পটি পুনরায় সংকলিত হয় ২০১৮-য় বরেন্দু মণ্ডল সম্পাদিত ‘ছিটমহলের গল্প’  সংকলনে।   
‘ছিটগ্রস্থ’ গল্পটিতে সরাসরি কোনও কাহিনী নেই। জটিল বাক্যবন্ধের উপস্থাপনে কথাকার অজস্র ইঙ্গিতে গল্পের শরীর নির্মাণ করেছেন। কিছুটা রিপোটার্জ ধর্মী এই গল্পে তথ্য দেবার মানসিকতা কোথাও সুপ্ত হয়ে আছে। গল্পের আখ্যানপট ‘শালবাড়ি’ নামক বাংলাদেশে অবস্থিত একটি ভারতীয় ছিটমহল। তবে কেবল একক স্থানিক সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ রেখে গল্পের সংকটগুলিকে মেপে দেখা সম্ভব নয়। ‘শালবাড়ি’ কেবল তাই শুধু শালবাড়ি নয়, শালশিরি, শালবাহান, ঝলইশালশিরি হ’য়ে ‘ইতিহাস সন্ধানী গবেষণার উপাদেয় খোরাক’-এ পরিণত হয়। এই কাল্পনিক পটেই মিশে থাকে এক’শ বাষট্টিটি ছিটমহলের প্রবহমান যাপন যন্ত্রণার হালহকিকত। আভ্যন্তরীণ সংকটের দাবানলে ক্ষয় পেতে থাকা ছিটমহলগুলি তাই বাহ্যিকভাবে রাষ্ট্র ব্যবস্থার চোখে একরকম গবেষণাগার, একাডেমিক ডিসিপ্লিনের উল্লেখযোগ্য চর্চিত বিষয় মাত্র। যাদের উৎস, ইতিহাস, সংকটের ইতিবৃত্ত পিএইচ.ডি থিসিসের গ্রহণযোগ্য টপিক হ’তে পারে, কিন্তু এই চিন্তাচর্চা, এই অনুসন্ধান সাত দশকের আইডেনটিটি-হীন মানুষগুলির যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ হ’তে পারে না কোনও অজ্ঞাত কারণেই। নাগরিকত্বের সংকট, আত্মপরিচয়হীনতার ক্রাইসিস-গুলিকে কথাকার উপস্থাপন করেছেন তাঁর আখ্যান নির্মাণের নিজস্ব স্টাইলে –
পিতৃ/মাতৃকুলের লেজুড়সমেত/ বিবর্জিত একটা নাম যে ছিল, থাকতে পারে, ভুলে যায়, ভুলে যেতে চায়, হয়তো, তারা। উত্তর প্রজন্মের পরিচয়টাই তখন প্রকট হয়ে ওঠে, নিজের অজান্তে, কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শনের মতো, ভ্রম অথবা সম্ভাবনা নিয়ে। বুধারু, আকালু, ফাকতাল – এসবও ওদের প্রকৃত নাম কিনা, তদন্তের অবকাশ রাখে না। কেননা মহম্মদ ইউনুছ, খগেন্দ্রনাথ বাড়ৈ বা আব্দুর রহিম প্রমাণের আপাত কোনো দলিল-দস্তাবেজ, সাক্ষী-সবুদ না থাকায় রিপোর্ট ফাইনাল। সময়/ঘটনাবিজড়িত, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্বলিত কিংবা নিতান্তই অকারণে জুড়ে যাওয়া এই সকল সামাজিক/অসামাজিক নামেই আমরা সম্বোধন করতে থাকব আমাদের চরিত্রগুলোকে, জন্ম নিবন্ধন সনদ/নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট/ জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যু হওয়ার আগে পর্যন্ত।                         
এরই মাঝে গল্পে প্রবেশ করে ছিটমহল বিনিময় চুক্তির রাজনৈতিক টানাপোড়েনের আবহ। আখ্যানের নামহীন চরিত্রটি যখন ফাকতালের বাপ আকালুকে প্রশ্ন করে –
তুই আছস খালি তোর লেপটিন আর কম্বল লেহেনে ! খবর পাইচি, না নাই ? তোর কিবা কহচে, নরেন মদি ত রাজি হোই গেইচে। ছিট বিনিময় এলা টাইমের ব্যাপার।
তখন এই স্বল্প ইঙ্গিতেই কথাকার দীর্ঘ সাত দশকের রাজনৈতিক চড়াই-উৎরাই-কে যেন স্পর্শ করতে চেয়েছেন। নেহরু-নুন চুক্তি (১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮), ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি (১৬ মে, ১৯৭৪), হ’য়ে ২০১৫-য় পৌঁছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন ক’রে ছিটমহল বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ এবং শেষ অবধি কেন্দ্র এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সদিচ্ছা ও সক্রিয়তায় স্থল সীমান্ত বিনিময় চুক্তি সম্পাদন – এই জার্নিটি নেহাত কম নয়। আন্তর্জাতিক এবং উভয় দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের এই অস্থিরতা গ্রাস করেছে ছিটবাসীদের ব্যক্তিগত যাপনকেও। ‘বিনিময়’ শব্দটি তাই অশীতিপর বৃদ্ধের কর্ণকুহরে প্রবেশ ক’রেও হৃদয়পটে খুব বেশী আলোড়ন সৃষ্টি ক’রে না। যোগীনের বাপের মতো প্রচার বিমুখ মুক্তিযোদ্ধা শেষ অবধি কোনও বিশ্বাসের কাছেই আশ্বস্ত হ’তে পারে না। ‘ছিটমহলবাসী’ ছাড়া যেন তাদের আর কোনও পরিচয়পত্র নেই। তবুও রাষ্ট্রবেত্তাদের পারস্পরিক ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আপোষ নীতির গ্যাঁড়াকলে বদলে যায় ছিটবাসীদের ছাপোষা জীবন। বাংলাদেশে অভ্যন্তরে অবস্থিত ১১১টি ভারতীয় ভূখণ্ড রূপান্তরিত হয় বাংলাদেশী ভূখণ্ডে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ হেড কাউন্টিং ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণে অপশন প্রদান, অপশন প্রত্যাহার, পুনরায় অপশন প্রদানের মধ্য দিয়ে একদা রাজা-নবাবদের পাশা খেলা – দাবা খেলার ফসল ছিটমহল একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে অসহায় ছিটমানুষদের দেশবদল, জাতীয়তা বদলের নিয়তিতে পরিণত হয়। পতাকা উত্তলন, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্রেকিং নিউজ, সরাসরি সম্প্রচার, স্থানীয় দৈনিকের বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ, ফেসবুক লাইভের ভিড়ে হারিয়ে যায় কারও স্বপ্ন, কারও দেশ, কারও সম্পর্ক, কারও জন্মভিটে। ছিটমহলের আখ্যান কোথাও পরিবর্তিত হ’য়ে যায় দেশ বদলের গল্পে। না-নাগরিক থেকে নাগরিকে রূপান্তরের পরেও অজস্র হারানো, অজস্র বেদনা, সম্পর্কের দোলাচলতা, ‘ছিটগ্রস্থ’-র মতো গল্পকে মাল্টিডাইমেনশনাল্‌ ক’রে তোলে।
এ গল্পের বাঁকবদল ঘটে ২০১৫, ২৬ নভেম্বরের ঘটনায়। পুশব্যাক নয়, নব্যভারতীয়র সম্মান নিয়ে বাংলাদেশে বসবাসকারী ভারতীয় ছিটমহলের কোনও কোনও ছিটবাসীরা নতুন দেশে যাত্রা ক’রলে অশীতিপর বৃদ্ধ যোগীনের পিতা শেষবারের মতো জন্মভূমিতে প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাঁটু গেরে বসে। মিডিয়ার কোলাহল, ক্যামেরার ক্লিক্‌, বাহ্যিক অস্থিরতা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। অজস্র প্রশ্নের মিছিলেও নিরুত্তর বৃদ্ধ জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে দশ আঙুলে আঁচড় দিতে থাকে তার জন্মভূমির শরীরে। এভাবেই তিনি যেন খুঁজে পেতে চান তার নিজস্ব অস্তিত্বকে, তার নিজস্ব ‘দেশ’-কে, যে দেশ কেবল ভৌগোলিক বেষ্টনী কিংবা কাঁটাতারে বিভক্ত কোনও রাষ্ট্র নয়, এ দেশ আসলে তার হৃদয়ে আজন্ম লালন ক’রে চলা ‘বাস্তু দেশ’। যেখানে মিশে থাকে পূর্ব পুরুষের শেকড়, আত্মসত্তা আর অজস্র স্মৃতির সিরিজ। নিশ্চল বৃদ্ধের ফ্ল্যাশব্যাকে ভিড় ক’রে আসে সাতচল্লিশ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ হ’য়ে ছিটমহল বিনিময়ের পূর্বেকার অতিক্রান্ত সাত দশক, নির্মিত হয় নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ব্যাংক — ‘পাঁজাকোলা করে বাসে তুলতে হয়, যোগীনের বাপকে, ডানহাতের তর্জনী তখনো ভূমি নির্দেশক।’ ভূমি নির্দেশক এই তর্জনীর বিপরীতেই দাঁড়িয়ে থাকে অজানা দেশ, প্রশ্নময় ভবিষ্যৎ। অধ্যাপক বরেন্দু মণ্ডল তাই যথার্থই বলেছেন—
অনাথ-ইতিহাসের সেইসব প্রাকৃতজনেরা এভাবে হারিয়ে যায় সময়ের অগোচরে। এই সব প্রাকৃতজনদের কথকতা নিয়েই এনক্লেভ স্টাডিজের স্বতন্ত্র পরিসরটি নির্মিত হয়ে ওঠে।           
এভাবেই অনাথ ইতিহাসের সেইসব প্রাকৃতজনদের হাত ধরেই যেন ‘ছিটমহলের গল্প’ দেশভাগের অনুষঙ্গ ছুঁয়ে ‘মানুষ ভাগ’-এর আখ্যানে পরিণত হয়। আউয়াল আহমদ স্পষ্ট কাহিনীর বুনটে নয়, স্বল্প ইঙ্গিতের আলো-আঁধারিতেই যেন নির্মাণ করেছেন এক টেনশনাল সিমট্রি। শৈল্পিক উৎকর্ষতার প্রশ্নে দ্বন্দ্ব থাকলেও পাঠকৃতিতে মিশে থাকে বিকল্প এক অনুভব, যে অনুভবের জারণ-বিজারণে ছিটবাসীদের প্রবহমান জীবনযাত্রার চড়াই-উৎরাইগুলিকে ধরা যায়, স্পর্শ করা যায়।


Friday, December 27

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অণুগল্প : আত্মজ






হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
আত্মজ

     বাসস্টাণ্ডে এসে দাঁড়াল অলকেশ। বেশ জোরেই হেঁটে এসেছে সে। আজ বেশ গুমট। ভাদ্র মাসে এটাই তো স্বাভাবিক।
     অলকেশ গলার কাছে জামার একটা বোতাম খুলে দিল। মাথাটা নিচু করে জামার ভেতরে মুখের হাওয়া ঢোকাল। বেশ অস্বস্তি লাগছে। সামনের দিকটা বেশ ভীড়। সামান্য একটু যা হাওয়া দিচ্ছে ভীড়ের জন্য তা গায়ে লাগার উপায় নেই।
     অলকেশ ভীড়ের পিছনে চলে গেল। হ্যাঁ, এখানটা বেশ খালি। হাওয়াও আছে। আসলে বাসে তাড়াতাড়ি উঠে জায়গা ধরার জন্য সবাই সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
     হঠাৎ পাশের লোকটির তাকিয়ে অলকেশ কিছুটা চমকে উঠল। নরেনবাবু না? দেশবন্ধু বিদ্যাপিঠের ইতিহাসের শিক্ষক। মুখের সাদা দাড়িতে চেনার উপায় নেই। অলকেশ নিশ্চিত হলো ডানহাতের কাটা দাগটা দেখে। স্যারই গল্প করেছিলেন, ওই দাগটা যৌবনে ডাকাতদের সঙ্গে লড়াইয়ের চিহ্নস্বরূপ।
     ------"কেমন আছেন স্যার?"
     ------"আমি তো ঠিক চিনতে পারলাম না!"
     ------"স্যার, আমি অলকেশ ।"
     ------"অলকেশ! যে তার উত্তরে কম নম্বর পেলে খেপে যেত?"
     অলকেশ কিছুটা লজ্জা পেয়ে বললো, ------"হ্যাঁ স্যার। আপনার এখনও মনে আছে?"
     ------"শুধু এটাই নয় অলকেশ, তোমাদের কেবলই বলতাম কিচ্ছু হবে না!"
     ------"আমাদের ভালো চাইতেন বলেই তো বলতেন। হয়তো আমাদের পথ চলাটা আপনার ঠিক পছন্দ হতো না।"
     ------"না অলকেশ, তোমার এই ধারণা ঠিক নয়। আজ আর মিথ্যে বলে কোনো লাভ নেই। নিজের ছেলেকে নিয়ে আমার একটা অহংকার ছিল। মনে হতো লেখাপড়া সে-ই শুধু করছে। তার কাছে তোমরা কিছু নও।"
     ------"তাতে কী হয়েছে স্যার? আর সত্যিই তো, আমরা আপনার ছেলের যোগ্যতার ধারে পাশেও ছিলাম না।"
     ------"ছেলে আমার অহংকারকে একেবারে ঘুচিয়ে দিয়েছে। এখন আমার ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম। ছেলে আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়েছে। মাসে মাসে টাকা পাঠিয়েই খালাস। গতবছর তোমার কাকিমা মারা গেল। তখনও আসে নি।"
     ------"স্যার, জোর করে মানুষকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করানো যায় না। দাদার কাছে এটাই হয়তো শ্রেষ্ঠ পথ বলে মনে হয়েছে। কিন্তু স্যার, আপনার কী একটা ছেলে? মাথায় আপনার ছেলের সাথে পেরে উঠব না ঠিকই, কিন্তু মনে তো পারতেই পারি। আমি কী আপনার ছেলে নই?"
     স্যার অলকেশকে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। অলকেশ স্যারকে বাধা দিল না। আজ অন্তত মানুষটা একটু প্রাণখুলে কাঁদুক।

                       

নীহারুল ইসলাম : যে গল্পটি আমাকে গল্প লিখতে উসকে ছিল






নীহারুল ইসলাম
যে গল্পটি আমাকে গল্প লিখতে উসকে ছিল

 
সাহিত্য পড়ার নেশা সেই স্কুলজীবন থেকে। এই নেশা আমি পেয়েছিলাম আমার আব্বার কাছ থেকে। তাঁর একটি ছোট সংগ্রহ ছিল। ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘ইলিয়াড-ওডিসি’, ‘মধুসূদন রচনাবলী’, ‘রামমোহন রচনাবলী’, ‘দীনবন্ধু রচনাবলী’, ‘সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী’, কবি বিমলচন্দ্র ঘোষের অনুবাদে ‘খৈয়ামের রুবাইয়াৎ’, সেক্সপীয়ারের ‘রচনাসমগ্র’, ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’, ইংরেজি কবিতার বিখ্যাত সিরিজ ‘GOLDEN TRESARY’, John Millington Synge-এর বিশ্ববন্দিত একাঙ্ক  ‘Riders to the Sea’, ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র এবং  অবশ্যই ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ ছাড়াও আলাদাভাবে ছিল ‘সঞ্চয়িতা’ এবং ‘গল্পগুচ্ছ’। আরও আরও কত  বই! তার মাঝে ওই রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ ও ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’  ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় গ্রন্থ। স্কুল ছেড়ে কলেজে উঠে কবিতা লেখার চর্চা করলেও আমার প্রথম প্রেম ছিল ছোটগল্পকে কেন্দ্র করেই। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প তো ছিলই। সঙ্গে ছিল জাতকের গল্প। পাশাপাশি সমকালের লেখকদের গল্প। ‘দেশ’, ‘কথাসাহিত্য’, ‘রবিবাসরীয় আনন্দবাজার’-এর গল্প। তাছাড়াও শারদ সংখ্যার গল্প কতক্ষণে পড়ে শেষ করব তা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত। আমার বিকেল কাটত লাইব্রেরিতে। যেখানে মোঁপাসা, হেমিংওয়ে, মার্ক টোয়েন ছাড়াও রাশিয়ান বিখ্যাত সব লেখকদের ছোটগল্প অনুবাদে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। কিন্তু কবিতা-চর্চা ছেড়ে আমি যে গল্প লিখব, এমন ভাবনা স্বপ্নেও ছিল না।

আমি যে খুব পড়ি এটা আমার এই গঞ্জশহরে অনেকেই জানতেন। একদিন আমাদের লালগোলা বিডিও অফিসের বড়বাবু মানিকদা হঠাৎ একদিন আমাকে ধরে বললেন, নীহারুল- তুমি তো খুব পড়। আমাদের রাজ্যসরকারী কর্মচারীদের একটি মুখপত্র নিয়মিত প্রকাশিত হয়। যার শারদ সংখ্যা সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। যদি একটি কপি নাও!

আমি বললাম, দেবেন।

সেদিন সন্ধ্যাতেই তিনি পত্রিকাটি আমাকে দিয়ে গেলেন। পত্রিকার নাম ‘সমন্বয়’। শারদ সংখ্যাটি সাজানো হয়েছে খুব সুন্দর ভাবে। কবিতা, প্রবন্ধ এবং ছোটগল্প। আগেই বলেছি সাহিত্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় ধারাটির নাম ছোটগল্প। তো, সেখানে প্রথম যে গল্পটি পড়লাম তার নাম ‘শকুন’। লেখকের নাম হাসান আজিজুল হক।
গল্পের শুরুটা এরকম- “ কয়েকটি ছেলে বসে ছিল সন্ধ্যার পর। তেঁতুলগাছটার দিকে পিছন ফিরে। খালি গায়ে ময়লা হাফশার্টকে আসন করে। গোল হয়ে পা ছড়িয়ে গল্প করছিল। একটা আর্তনাদের মতো শব্দে সবাই ফিরে তাকাল। তেঁতুলগাছের শুকনো ডাল নাড়িয়ে, পাতা ঝরিয়ে সোঁ-সোঁ শব্দে কিছু একটা উড়ে এল ওদের মাথার ওপর। ফিকে অন্ধকারের মধ্যে গভীর নিকষ একতাল সজীব অন্ধকারের মতো প্রায় ওদের মাথা ছুঁয়ে সামনের পড়ো ভিটেটায় নামল সেটা।”

শুরুর এটুকু পড়ে আমি চমকে উঠলাম। কেন-না, আমি নিজেই তেঁতুলগাছের পাশে খালি গায়ে হাফশার্টকে আসন করে বসে থাকা ওই কয়েকটি ছেলেদেরই একজন। শৈশব-কৈশরে যে বন্ধুদের সঙ্গে আমি এরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি বহুবার। প্রসঙ্গত বলে নেওয়া ভাল, আমার শৈশব-কৈশর কেটেছিল মাতুলালয়ে। সেটা রাঢ়ভূমির সাগরদিঘী থানার হরহরি গ্রাম। তখন গরু মরে গেলে মাঠে ফেলে দেওয়াটাই ছিল নিয়ম। চর্মকার সম্প্রদায়ের মানুষেরা সেই মৃত গরুর চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে যেত দু’পয়সা উপার্জনের আশায়। তারপর কোথা থেকে খবর পেয়ে মরা গরুর মাংসের লোভে প্রচুর কাক-শকুন-কুকুর এসে জড় হতো সেখানে। আর আমরা জড় হতাম সেই এক-দেড় দিনের পশু-পক্ষীদের লড়ালড়ি করে ভোজ খাওয়া দেখার জন্য। যেটা ছিল আমাদের কাছে খেলা দেখার মতো একটা ব্যাপার। শুধু তাই না, আমরা অপেক্ষা করতাম আর একটা কারণে, সেটা হল- কুকুরের সঙ্গে লড়ালড়ি করতে গিয়ে শকুনের খসে পড়া পালক কুড়নো। যা দিয়ে আমরা তীর বানাতাম আদিবাসী ভাই-বন্ধুদের সঙ্গে শিকার-উৎসবে যোগ দেব বলে। এবং শেষমেশ আমরা যে খেলাটা খেলতাম তা হল, দলের সেই একটি-দু’টি বৃদ্ধ শকুন যারা বেশি খাওয়ার ফলে উড়ে নিজের আস্তানায় ফিরে যেতে পারত না, তাদের মাঠ মাঠ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো।

হাসান আজিজুল হকের ‘শকুন’ গল্পটি পড়ার আগে ব্যাপারটা আমার স্মৃতি-কোঠায় খেলা হিসেবেই গচ্ছিত ছিল। কিন্তু সেটা যে এতটা নিষ্ঠুর-এতটা নির্মম ছিল, তা কখনও বুঝতে পারিনি। যদিও কখনও রফিক হয়ে, কখনও জামু হয়ে, কখনও বা এদাই হয়ে কিংবা কখনও পল্টু হয়ে এক বৃদ্ধ শকুনকে বাগে আনতে নিজের দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ, কষ্ট, রাগ, দ্বেষ, আক্রোশ দেখাতে দেখাতে ‘আল টপকে টপকে, উঁচুনিচু জমির উপর দিয়ে ক্ষতবিক্ষত মনে আর দাগরা ঘায়ে, শেয়ালকুল আর সাঁইবাবলার বনে, লম্বা শুকনো ঘাসে, পগারে, সাপের নিশ্বাসের মতো ফাটা মাটির উষ্ণ ভ্যাপসা হাওয়ায়, আখ আর অড়হর-কাটা জমির বল্লমের মতো ছুঁচলো সরল গুঁড়ির আক্রমণে ও আর্তনাদে, একটা মাটির ঢেলার মতো গড়িয়ে, শক্তির বেদনাবোধের অতীত অবস্থায়, আচ্ছন্ন চেতনাহীন তন্দ্রার মধ্যে’ আমিও যেন চলতে চলতে হঠাৎ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠছিঃ
‘কত তারা উঠেছে দ্যাক।’
‘কিন্তুক আলো তো হচে না।’
‘চাঁদ নাইকো যি।’
‘বাতাস দিচে লয়রে?’
‘দিচে, তা শালার গরম বাতাস।’
‘আমার কিন্তুক জাড় লাগচে।’
‘তোর ভয় লেগেচে।
‘কতদূর  এ্যালোম র‍্যা?
‘উরে সব্বোনাশ, মাঝমাঠে এসে পড়িচি, মানুষমারীর মাঠ যে র‍্যা!’

যে-গল্প পাঠ শেষে আমাকে মানুষমারীর মাঠে দাঁড় করিয়ে দেয়, কিছু ভাবতে শেখায়, এমনকি খেলা শেষ করে ‘গাঁয়ে ঢুকতেই এপাশে তালগাছ ওপাশে ন্যাড়া বেলগাছের যে ছোট তোরণটি আছে তারই আবছা ছায়ায় শাদামতো কী’ দেখি, এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি ‘উ হচে জমিরুদ্দি আর কাদু শ্যাখের রাঁঢ় বুন’, সেই গল্পের লেখক কে, জানতে কৌতুহল হয়। খুব জানতে ইচ্ছে করে, কোথায় তাঁর বাড়ি? তিনি কোথায় থাকেন? কী করেন?

খোঁজ শুরু করি এবং জানতে পারি তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। দর্শনের অধ্যাপক।

বিদেশ হলেও রাজশাহী আমার বাড়ির পাশেই। শুধু পদ্মা পেরোতে হবে। আমি পদ্মা পেরিয়ে গিয়ে হাজির হই সেই লেখকের কাছে। জিজ্ঞেস করি, আপনার ‘শকুন’ গল্পের পটভূমি রাঢ়ভূমি। অর্থাৎ ভাগীরথীর পশ্চিমপাড়। যেখানে আমার শৈশব-কৈশর কেটেছিল। আর আমি এখন যেখানে থাকি সেটা বাগড়িভূমি। আর আপনি যেখানে থাকেন সেই রাজশাহী হল পদ্মাপাড়ের বরেন্দ্রভূমি। তাহলে বরেন্দ্রভূমিতে বসে রাঢ়ভূমির পটভূমিতে এমন গল্প লিখলেন কী করে? প্রত্যক্ষ যাপন ছাড়া কি এমন গল্প লেখা সম্ভব?

আমার প্রশ্ন শুনে হাসান আজিজুল হক হাসছেন। আর আমি বলে চলেছি, আপনার ‘শকুন’ গল্পের চরিত্র, সংলাপ সব আমার চেনা। শুধু তাই না, এই গল্পের এক একটি চরিত্র যেন আমি নিজেই!
অবশেষে হাসান আজিজুল হক মুখ খুললেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, রাঢ়ভূমির কোথায় কেটেছিল তোমার শৈশব-কৈশর?
বললাম, সাগরদিঘী থানার হরহরি গ্রাম। মামাবাড়িতে।

তারপর তিনি যা বলেছিলেন তা হল, আদতে তিনি রাঢ়ভূমির মানুষ। বর্ধমানের যবগ্রামে তাঁর জন্ম-বেড়ে ওঠা। তাছাড়াও আমার মামার বাড়ির পাশেই একটি গ্রামে ছিল তাঁর দিদির বাড়ি। সেখানে নিয়মিত এসে থাকতেন তিনি। দিদির খুব কাছ-লাগা ছিলেন। আশপাশের গ্রামে ফুটবল খেলে বেড়াতেন। এমন কী, আমার মামার গ্রামের ফুটবল মাঠেও তিনি ফুটবল খেলেছেন।

আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছিলাম। আর সেদিনের পর বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী লেখক হাসান আজিজুল হক আমার শুধু অতি অন্যতম প্রিয় লেখক হয়ে ওঠেননি, কখন কিভাবে আমার অতি প্রিয় দাদা হয়ে উঠেছেন তা ভাবতেই গর্ব অনুভব করি। 
 

আলমগীর কবীর বাবলুর অণুগল্প : মানুষ বনাম.....





আলমগীর কবীর বাবলু
মানুষ বনাম.....

ঘোষপাড়ায় ঢুকতেই আমার মনে একটা সন্দেহ ঘনীভূত হল। ও মাথায় অবাঞ্চিত কিছু একটার আঁচ পাচ্ছিলাম। ষণ্ডামার্কা কিছু লোক রাস্তার দু' পাশে ঘোঁট পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে যাব কি যাব না ভাবছিলাম। শেষপর্যন্ত, কি হয় হবে ভেবে যাওয়াই মনস্থির করলাম। কিন্তু কপাল খারাপ, যা ভাবছিলাম এবং যার গন্ধ পাচ্ছিলাম শেষতক তাই ঘটে গেল। অর্থাৎ রিকশাটা যেই না ষণ্ডাদের কাছাকাছি এলো, অমনি ওরা পথ আগলে রিকশার গতিরোধ করল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতভম্ব। ভেতরে ভেতরে ঘামছি আর ভাবছি, দিনে দুপুরে এ কেমন বর্বরতা, প্রকাশ্য মাস্তানি! কিন্তু আমার ভাবনার পালে আচানক ঘাই বসিয়ে, রাগে কটমট করে তাকিয়ে ওদের পালের গোদাটি গর্জে উঠলো- ওই তোর নাম কি?
সন্ত্রস্ত আমি ঈষৎ আমতা আমতা করে বললাম-শরৎ। আর যায় কোথা! ওরা বুঝি এমন কিছুর জন্যই ভয়ানক মুখিয়ে ছিল! আমার নাম উক্ত হওয়া মাত্রই মানুষ অবয়বিক ঐ হিংস্র প্রাণীগুলো বাঘের মতো হালুম করে আমার উপর সবলে ঝাঁপিয়ে পড়ল! ব্যাপার কি, বুঝে ওঠার আগেই কিল-ঘুষি-লাথির এলোপাথাড়ি তান্ডব আমার সর্বাঙ্গে আছড়ে পড়ল! সঙ্গে না-খাস্তা গালির তুবড়িও ছুটল! ওদের সাঁড়াশি আক্রমণে আমি বোবা ও বোকা বনে গেলাম। ক্ষণিকের হতাশায় ডুবতে ডুবতে বোধবুদ্ধিশূন্য আমি অতঃপর অস্পষ্ট শুনলাম- মালুর বাচ্চা মালু, হিন্দু হয়ে মুসলমানের গায়ে হাত! আজ সব কয়টারে প্যাকেট করে ইন্ডিয়ায় পাঠাব। ওদের ভেদরেখাসূচক কথাগুলো কিংবা না-খাস্তা খিস্তিগুলো আমাকে যেন খেজুর কাঁটার মতো অনবরত খোঁচাচ্ছে। ফলে, কী এক দুর্বোধ্য কষ্টে-যন্ত্রণায় আমি পাথরের মতো নির্বাক, নিস্তব্ধ, প্রতিক্রিয়াহীন। বরং রাগে-ক্ষোভে,দুঃখে-অপমানে,ঘেন্নায়-ধিক্কারে নিজের জাত-পাত-সমগোত্রতা সব লুকালাম। তাছাড়া দেবতাতুল্য বাবাকে দোষ দিতেও মন চাইল না। যে বাবার অনেক কষ্টের ফসল এই আমি শরতের শুভ্র এক সকালে জন্মেছিলাম বলে বাবা তাঁর প্রিয় ঋতুর নামানুসারে আমার নাম রেখেছিলেন শরৎ; যিনি কর্মে-চিন্তায়-বিশ্বাসে ছিলেন উদার, মানবতাবাদী,অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল এবং যার দর্শন ছিল- ধর্মের চেয়েও মানুষ বড়, সেই পূজনীয় বাবার দর্শনকে মিথ্যে প্রমাণ করে কেন এই ধর্মান্ধ-বিকারগ্রস্ত-নরপশু-হায়েনাদের কাছে স্বীয় ধর্মপরিচয় দিয়ে নিজেকে এবং স্বর্গবাসী বাবাকে ছোট করব, খাটো করব! তাহলে কি মানুষের চেয়েও ধর্ম বড়? নাম বড়?

আমার বুকটা পাতাঝরা বৃক্ষের মতো হু হু করে উঠলো।




মেহেবুব আলম - সেলিনা হোসেনের ‘নারীবিশ্ব’ : নারীর অন্তঃস্বর







মেহেবুব আলম -
সেলিনা হোসেনের ‘নারীবিশ্ব’ : নারীর অন্তঃস্বর


সেলিনা হোসেন বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির একজন অগ্রগণ্য লেখক। বৃহত্তম পাঠক সমাজে তাঁর পরিচয় একজন সার্থক কথাশিল্পী হিসেবেই। তাঁর রচনার মূল সুর হল সমাজ ও মানুষের কল্যাণ সাধনা। মানবতাবাদী এই লেখক মানুষকে দেখেছেন সমাজ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে। কথাসাহিত্যের আঙ্গিনায় তিনি বহুদিন ধরে বিচরণ করেছেন। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা একশোরও বেশি। তিনি তাঁর কথা সাহিত্যে মূল্যায়ন করেছেন ‘সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির দ্বন্দ্বময় জীবন-প্রবাহ’। তবে আমরা যদি সেলিনা হোসেনের প্রবন্ধগুলির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তাহলে একটু ভিন্ন বাস্তবধর্মী সেলিনা হোসেনকে দেখতে পাবো।
সেলিনা হোসেন তাঁর এক নির্দিষ্ট দর্শন থেকে কথাসাহিত্যের চরিত্রগুলি নির্মাণ করে থাকেন। যার ভিত্তিভূমি তাঁর প্রবন্ধগুলি। তাঁর প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ ‘স্বদেশে পরবাসী’র (১৯৮৫) দ্বিতীয় মুদ্রণের মুখবন্ধে তিনি বলেছেন, যে-কথা তিনি কথাসাহিত্যে বলতে পারেন নি, তা বলতে তাঁকে প্রবন্ধের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। তিনি আরও বলেছেন, প্রবন্ধগুলি তাঁর ব্যক্তিগত ভাবনার বহিঃপ্রকাশ, কোনও বড় ক্যানভাস নয়, ছোট ছোট পরিসরে টুকরো টুকরো চিন্তা। ফলে সেই সব চিন্তাসূত্র ও যুক্তির শৃঙ্খলা নির্মাণ করেছে নারীবিশ্ব-র পরিসর।
সেলিনা হোসেন যে তাঁর সমকালের একজন বিশিষ্ট চিন্তক তা অনস্বীকার্য। কেননা স্বাধীন বাংলাদেশের একজন অগ্রগণ্য চিন্তক হিসেবে তিনি নিজেকে তৈরি করেছেন তিল তিল করে। দেশ, কাল ও সমাজের কথা যে তিনি কতভাবে ভেবেছেন তার স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছে বিবিধ বিষয়ে লেখা তাঁর প্রবন্ধগুলিতে। আবার সমাজের নারীর অবস্থান নিয়েও তিনি অত্যন্ত গভীরভাবে ভেবেছেন। তাঁর নারীর অধিকার, নারী-মুক্তি, নারী-প্রগতি, নারী-পুরুষের সম্পর্ক বিষয়ক চিন্তা-চেতনা তাঁকে সমকালের বিশিষ্ট নারীবাদী লেখক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সেলিনা হোসেন তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন-
নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমার প্রথম চিন্তাটি হল নারীকে নিজের শক্তিতে তৈরি করতে হবে।...তারপর নিজের ভেতরের শক্তিকে চিনতে হবে নারীকেই।১
নারীবিশ্ব গ্রন্থটি অধ্যাপক ড. বরেন্দু মণ্ডলের সম্পাদনায় ‘অভিযান পাবলিশার্স’ থেকে ২০১৯ এর জানুয়ারি মাসে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছে। অধ্যাপক মণ্ডল তাঁর সম্পাদিত এই গ্রন্থটি গৌরী আইয়ুবকে উৎসর্গ করেছেন। ভূমিকা অংশে তাঁর বক্তব্য থেকেই এই গ্রন্থটির বিশেষ গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা জানতে পারি-
বাংলাদেশের অন্যান্য লেখকদের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে সেলিনা হোসেনের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। অন্যদিকে, বাংলাদেশের বই পশ্চিমবঙ্গে আজও সহজলভ্য নয়। সেলিনাদির আগ্রহে ও ‘অভিযান পাবলশার্স’-এর তরুণ প্রকাশক মারুফ হোসেনের উদ্যোগে সেলিনা হোসেনের নারী-অধ্যয়ন বিষয়ক প্রবন্ধগুলো একত্রে নারীবিশ্ব নামে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হল।২
এই গ্রন্থে সেলিনা হোসেনের বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলিকে গ্রন্থসম্পাদক অধ্যাপক মণ্ডল পাঁচটি বিভাগে সুন্দরভাবে সজ্জিত করেছেন। বিভাগগুলি হল যথাক্রমে-
-সমাজ, সংস্কৃতি ও নারী প্রগতি,
-দেহ রাষ্ট্র নৈতিকতা ও নারী-অধ্যয়ন,
-নারীর প্রতিবেদন : প্রতিবেদনে নারী,
-ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা,
-আলোকিত নারী : নারী মহিয়সী।
প্রথমটিতে সাতটি, দ্বিতীয়টিতে দশটি, তৃতীয়টিতে চারটি, পঞ্চমটিতে চারটি, শেষ অধ্যায়টিতে ছয়টি প্রবন্ধ সন্নিবিষ্ট হয়েছে।
অন্যান্য রচনার মতোই লেখকের এই প্রবন্ধগ্রন্থেও ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সারল্য ও সাবলীলতা লক্ষ্য করা যায়। ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার তাঁর রচনার একটি বড় বৈশিষ্ট্য। যা এখানেও দৃশ্যমান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রবন্ধের শুরুর বাক্যটি সংক্ষিপ্ত সত্য কথন। যেমন- ‘ঘর গেরস্থির রাজনীতি’ প্রবন্ধের প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতেই আমরা এটি লক্ষ্য করব। ‘অবলা’ অধ্যায়ের শুরুতেই লিখেছেন-
“এটি একটি স্ত্রীবাচক শব্দ। ...নারী, ললনা। অর্থ থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, বলহীন, অক্ষম যে সে নারী।”৩
‘রত্নগর্ভা’ অধ্যায়ের শুরুতে রত্নগর্ভা সম্পর্কে লিখছেন-
“রত্নগর্ভ অর্থ যার মধ্যে রত্ন আছে। এই শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রত্নাগর্ভা। ...গর্ভধারণ একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। নারী এককভাবে গর্ভধারণ করতে পারে না।”৪
‘হুরপরি’ অধ্যায়ের শুরুতেই লিখছেন-
“হুর আরবি শব্দ...পরি ফারসি শব্দ। বাংলা অভিধানে পরি অর্থ পক্ষ বিশিষ্ট কল্পিত সুন্দরী, অতিশয় সুন্দরী নারী।”৫
এরকম বাক্যের সজ্জাতেই তিনি তাঁর যুক্তিজাল সজ্জিত করেছেন।
নারীবিশ্ব গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ হল ‘সংস্কৃতি ও নারী’। আটটি পরিচ্ছেদে পরিসমাপ্ত কুড়ি পৃষ্ঠাব্যপি এই দীর্ঘ প্রবন্ধে সেলিনা হোসেন সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার জন্য নারী ও পুরুষের যৌথ অনুশীলন প্রয়োজন বলে মনে করেছেন। যদিও সংস্কৃতি রক্ষার গুরু দায়িত্ব যেন নারীর কাঁধেই রয়েছে। সমাজের পঁচাশি ভাগ নারীকে বাড়ির মাননীয় পুরুষ সদস্যের খাওয়া-দাওয়ার পর বেড়ালের মতো চেঁছেপুছে খেতে হয় হাড়ির তলানিটুকু। আবার অসংখ্য পুরুষ অবলীলায় ছেড়ে চলে যায় তার সন্তানকে। তবে একজন নারীর পক্ষে সম্ভব নয় বলবান পুরুষের মতো শিশুদের মাতৃহীন করে নিজের সুখের খোঁজে চলে যাওয়া। তথাপি এই দুঃখ নির্ভর পৃথিবী শুধুমাত্র নারীর, আর স্বর্গ ও স্বর্গের যাবতীয় সুখ শুধু পুরুষের এমন ভাবনা প্রাবন্ধিক কখনই সমর্থন করতে পারেন নি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি যে নারীর গৃহস্থালির চেতনাকে কোণঠাসা করে রেখেছে, তা তিনি নির্দ্বিধায় পাঠককে জানিয়েছেন। ‘ভাগ্যবানের বউ মরে আর অভাগার গোরু মরে’ -নারীর প্রতি এই বঞ্চনা ও ব্যঙ্গাত্মক প্রবাদ গোটা বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে। এই প্রবাদে অনেকেই  প্রফুল্ল হয়ে থাকেন বিশেষত পুরুষ সমাজ কিন্তু প্রাবন্ধিক সেলিনা হোসেন প্রফুল্ল হতে পারেন নি। কেননা এই প্রবাদের অন্তর্নিহিত যে অর্থ নারীকে গোরুর চেয়েও কম মূল্যবান ভাবা তা তিনি ভুলে যান নি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে সংসারের চার দেয়ালের ভেতর বন্দি করে রাখার নানাবিধ উপায় খোঁজে। তাই আমাদের সমাজে একটি সংস্কৃত শ্লোক খুবই জনপ্রিয়-‘পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতা হি পরমন্তপ’।
‘সীমান্তে কাঁটাতার : নারীর কথা’ প্রবন্ধ থেকে আমরা জানতে পারি যে, নববর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার দুপাশে মিলনমেলা আয়োজিত হয়। দুদেশে বাস করা আপনজনদের সঙ্গে দেখা হয় নববর্ষের এই দিনেই। তবে সত্তর দশক পর্যন্ত দুই দেশের মানুষ বিনা বাধায় যাতায়াত করতে পারত। দেখা হত স্বজনদের সঙ্গে। কয়েক বছর আগেই ভারতীয় কতৃপক্ষ সীমান্তে কাঁটাতার দিয়ে সুরক্ষিত করার ফলে ইচ্ছে মত যাতায়াত ও যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ফলস্বরূপ অসুবিধায় পড়ে সাধারণ গরিবেরা। এই গরিব মানুষেরা পাসপোর্ট-ভিসা করে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে পারে না বলেই নববর্ষের এই উৎসবের জন্য তারা অপেক্ষা করে গোটা বছর।
এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য কাঁটাতারের সঙ্গে সম্পর্কিত সেলিনা হোসেনের ‘মধ্যরাতের ঘর বদল’ নামক একটি ছো্টগল্পও আমরা পাই। একথা ঠিক ‘ভারত-বাংলাদেশ স্থল সীমান্ত বিনিময় চুক্তি’র ফলশ্রুতিতে ৩১ জুলাই ২০১৫-য় ছিটমহল স্বাধীনতা পেইয়েছে। কিন্তু একদিকে যেমন উদ্বাস্তু ছিটমানুষদের অসহায় জীবনযাপন আজও আমাদের দেশভাগের সমকালীন বাস্তবতাকে মনে করায়। তেমনি অন্যদিকে, ছিটবাসীদের এতদিনের মিথ্যা পরিচয়ের আবরণ সরিয়ে প্রকৃত সত্য পরিচয়ে আসতে পারবে কিনা, এ প্রশ্নও আমাদের ভাবিয়ে তোলে। এই গল্প ছাড়াও আমরা সেলিনা হোসেনের কাঁটাতার সম্পর্কিত ‘ভূমি ও কুসুম’ নামক উপন্যাস পাই। যেখানে তিনি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বদলে যাওয়া অসহায় ছিটবাসীদের জীবনযাত্রার নবতর সংকটগুলিকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।
‘যে কথা অনবরত বলতে হবে’ প্রবন্ধে ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের সময় থেকেই নারীর মর্যাদা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা কতটা উন্নত ও উন্মুক্ত ছিল তা প্রাবন্ধিক সেলিনা হোসেন দেখিয়েছেন। বিবি খাদিজা ছিলেন হজরত মুহাম্মদ(সঃ) এর থেকে পনেরো বছরের বড়ো, তিনিই মহানবীকে বিবাহের প্রস্তাব দেন এবং পরবর্তীকালে যখন মুহাম্মদ(সঃ) চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়তপ্রাপ্ত হন তখন সেই বিশেষ উপলব্ধির কথাও তিনি বিবি খাদিজাকেই সর্বপ্রথম জানান। এই উদাহরণ পাঠকের সামনে রেখে ইসলামে নারীর মর্যাদার পাশাপাশি মানুষ হিসেবে মৌলিক অধিকারের প্রসঙ্গটি সেলিনা হোসেন ব্যাখ্যা করেছেন।
এছাড়াও এই বিভাগে যে প্রবন্ধগুলি রয়েছে সেগুলি হল- ‘নারী প্রগতির ভিন্ন দিক’, ‘ঘরগেরস্থির রাজনীতি’, ‘ঘরগেরস্থিতে নোনাজল’, ও ‘নারীর প্রজ্ঞা’ প্রভৃতি।
নারীবিশ্ব গ্রন্থের প্রবন্ধের দ্বিতীয় বিভাগটি হল- ‘দেহ রাষ্ট্র নৈতিকতা ও নারী-অধ্যয়ন’। এই বিভাগের ‘নারীর জীবন ও নারী-অধ্যয়ন’ প্রবন্ধে সেলিনা হোসেন বলতে চেয়েছেন, নারীর জীবনকে ঘিরে মিথ তৈরি করেছে পুরুষ। প্রাচীনকাল থেকেই নারীর জীবনকে বৃত্তাবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করেছে পুরুষ। নানাভাবেই এটা বলার চেষ্টা করেছে যে, নারী যৌনতার আধার এবং যৌনকর্ম ও সন্তানধারণ করাই তার জীবন। প্রসববেদনা নারীর জন্য ঈশ্বর প্রদত্ত শাস্তি। তাই এই শাস্তি নারীকে পেতেই হবে। এই অজুহাতের পাশাপাশি প্রায় তিনশো বছর ধরে নারীকে ডাইনি আখ্যায়িত করে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ নারীকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। সেলিনা হোসেন আমাদের জানিয়েছেন স্থান কাল ভেদে শোষকের পরিবর্তন হলেও শোষিত নারীর কোনও পরিবর্তন নেই। শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্ব জুড়েই নারী নির্যাতনের স্বীকার হয়ে এসেছে। এই প্রসঙ্গে তিনি ব্রিটেনের কথা উল্লেখ করে নারী নির্যাতনের বিষয় তুলে ধরেছেন। খ্রিষ্টীয় ১৩৪৭ থেকে ১৩৪৯ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনে প্লেগের মহামারির ফলে মৃত্যুর যে বিপর্যয় ঘটেছিল তার জন্য দায়ী করা হয়েছিল নারীদের। নারীরা ডাইনি, তারা প্লেগ ছড়ায়। তাই প্লেগ দমন করার জন্য অসংখ্য নারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল- ‘Women are by nature instrument of Satan. They are by nature cruel, a structural defect rooted in the original creation.’৬
তিনি আরও জানিয়েছেন যে, মনুসংহিতা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম একটি স্মৃতিশাস্ত্র , সেখানেও নারী-বিদ্বেষমূলক নীতি প্রবলভাবে দেখা যায়। মনু বিধান দিয়েছিলেন যে, মেয়েরা শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী ও বার্ধক্যে পুত্রের অধীনে থাকবে। বিশ্বস্ত স্ত্রীর দায়িত্ব স্বামীকে দেবতা হিসেবে পুজা করা।
‘জেন্ডার, ক্ষমতায়ন ও বাংলাদেশ’ প্রবন্ধে সেলিনা হোসেন জানিয়েছেন, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে জেন্ডার প্রত্যয়টি একটি উন্নয়নের ইস্যু। নারী-পুরুষের জেন্ডার ভূমিকা নির্ধারিত হয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক আলোকে। সেক্স নারী-পুরুষের লিঙ্গ নির্ধারণ করে। আর জেন্ডার নারী-পুরুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয় নির্ধারণ করে। তিনি এই প্রবন্ধে জেন্ডারের সঙ্গে ক্ষমতায়ন প্রত্যয়টির গভীর সম্পর্কের কথা বলেছেন। ক্ষমতায়ন ব্যক্তির ভেতর আত্মবিশ্বাস দৃঢ় করে, যার দ্বারা সে সমস্যা সমাধান করতে শেখে। পরমুখাপেক্ষী না হয়ে স্বনির্ভর হয়। নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে তিনটি ভাগের কথা তিনি বলেছেন- অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, সামাজিক ক্ষমতায়ন ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। তবে নারীর ক্ষমতায়ন পুরুষের পাশাপাশি একই অর্থে ব্যাখ্যা করা যায় না। সেজন্য ক্ষমতায়নের ধারণা পুরুষের জন্য এক রকম, নারীর জন্য অন্য রকম।
এছাড়াও এই বিভাগের অন্যান্য প্রবন্ধগুলি হল- ‘দুর্নীতি ও নারী’, ‘প্রান্তিক নারী ও নিরাপত্তা’, ‘নারী ও নির্বাচন’, ‘যাতে বঞ্চিত না হই’, ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি’, ‘শক্ত হোক নারীর শক্তির জায়গা’, ‘তোমারে বধিবে যে...’, ‘বেইজিং কর্মপরিকল্পনা ও নারীর ক্ষমতায়ন’ প্রভৃতি।
‘মঙ্গোলিয়ার নারীরা’ নামের প্রবন্ধটি আসলে একটি গ্রন্থ সমালোচনা। Martha Avery-এর লেখা ‘Women of Mongolia’-বইটি পড়ার অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন লেখক সেলিনা হোসেন। এখানে তিনি দেখিয়েছেন নারী মুক্তি কেবল পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্রমাগত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যে আসে তা সর্বদা ঠিক নয়। সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই যে প্রকৃত সাম্যবাদ তার মধ্য দিয়েই নারীর প্রকৃত সমতা ও ক্ষমতায়ন সম্ভব।
এই প্রবন্ধটি ছাড়াও এই বিভাগে আছে ‘কিশোরীদের জন্য কিছু করা’ নামক আরও একটি প্রবন্ধ এবং আছে লেখকের দুটি সাক্ষাৎকার।
সেলিনা হোসেন তাঁর লেখক জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে দেশভাগ ও তার প্রভাব, ভাষা আন্দোলন ও তার প্রভাব, আবার কখনোবা মুক্তিযুদ্ধ ও তার প্রভাব নিয়ে তাঁর কথাসাহিত্যের অবয়ব গঠন করেছেন। দেশভাগের প্রভাব নিয়ে লিখেছেন ‘সোনালি ডুমুর’ এর মতো উপন্যাস। যেখানে লেখক অনিমেষের ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার মধ্যদিয়ে দেশভাগের ভয়ঙ্কর দিকটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ভাষা আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে লিখেছেন ‘যাপিত জীবন’ এর মতো উপন্যাস। যেখানে জাফরের স্বচ্ছ প্রতীকচিত্রে বাঙালির শেকড় আর অস্তিত্বের কথা লেখক ঘোষণা করেছেন। আবার ‘পরজন্ম’, ‘যুদ্ধজয়’, ‘সখিনার চন্দ্রকলা’ বা ‘শকুনের ছায়া’র মত গল্পগুলি এবং ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’, ‘গেরিলা ও বীরাঙ্গনা’র মতো উপন্যাসগুলি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত। যার ভিত্তিভূমি হল ‘মাতৃভাষা দিবস ; নারীর ভূমিকা’, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও নারী’র মত প্রবন্ধ। যেখানে তিনি ভাষা আন্দোলনে নারীর ভূমিকা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন-
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে সূচিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নারী ধর্মের ধুয়া তুলে নিষ্ক্রিয় থাকেনি। সভায় মিছিলে অংশগ্রহণ করেছে। এমনকি স্কুলের ছাত্রীরাও মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্য রাস্তায় নেমে এসেছে।  ...পরিবারের বাঁধার কারণে মেয়েরা অনেক সময় বোরখা পরে মিছিলে আসত।৭
‘মুক্তিযুদ্ধ ও নারী’ প্রবন্ধে আমরা পাই করুণা বেগম, মিরাসি বেগম, কাঞ্চনমালার মতো মুক্তিযোদ্ধা নারীচরিত্রের কথা। করুণার স্বামী মুক্তিযুদ্ধে মারা যাবার ঠিক এক মাস পরেই তিনি তার তিন বছরের শিশুকে মায়ের কাছে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। শুধু যোগদানই নয়, পঞ্চাশ নারীযোদ্ধার তিনি কমান্ডার পদে উন্নীত হন। এমন আর এক চরিত্র হল মিরাসি বেগম। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি তার চার ছেলেমেয়ে নিয়ে মিরাসি ক্যাম্পে একদিকে রান্নার কাজ করে সংসার সামলাতেন, আর অন্যদিকে ছদ্মবেশে অস্ত্র-গোলাবারুদ আমদানী ও সরবরাহ করতেন। তিনি মদন, কান্দাইল, বাজিতপুর ও কাপাসাটিয়ার যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং একাত্তরের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিজেকে যুদ্ধে যুক্ত রাখেন। এই প্রবন্ধে সর্বোপরি যে চরিত্র আমাদের দৃষ্টি আকর্ষন করে তা কাঞ্চলমালা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ঠিক দুবছর আগে পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর জাহিদের হাতে ধরা পড়েন। দীর্ঘদিন ধরে চলে পাশবিক অত্যাচার। পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলে চলে আবারও অকথ্য অত্যাচার। তাঁকে অর্ধমৃত অবস্থা থেকে উদ্ধার করে মুক্তিযোদ্ধারা। তাই সুস্থ হয়ে উঠেই কাঞ্চনমালা যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। আবার বাকি সময় তিনি নার্স হিসেবে আহত যোদ্ধাদের শুশ্রূষাও করেন। তিনি এমন এক নারীর উদাহরণ, যিনি ধর্ষণের শিকার, সশস্ত্র যোদ্ধা এবং সেবিকা। তবে এই সমস্ত নারীরা কেউই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি, পাননি যথার্থ মর্যাদাও। বরং অদৃশ্য হয়ে গেছে তাঁদের বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয়। এই প্রবন্ধের একেবারে শেষে প্রাবন্ধিক বলেছেন-
আমি আমার ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসটি শেষ করেছি এভাবে : যুদ্ধে একটি পা হারিয়ে প্রেমিক ফিরে এসেছে স্বাধীন দেশে। প্রেমিকা তখন পাকিস্তান সেনা কতৃক ধর্ষিত হয়ে গর্ভবতী। দুজনের যখন দেখা হয় তখন প্রেমিকা প্রেমিককে বলে, ‘ভালো কইরে দেখো হামাক। তুমহি দেছো পা। হামি দিছি জরায়ু। তুমহার পায়ের ঘা শুকায়ে গেছে। কয়দিন পর হামারও জরায়ু ঘা শুকায়ে যাবে। হামি ভালো হয়ে যাবো।৮
এছাড়াও এই বিভাগে যেসমস্ত প্রবন্ধ রয়েছে সেগুলি হল- ‘জসীমউদ্‌দীনের আশমনি ও অন্যরা’, ‘বধ্যভূমিতে চোখ বাঁধা সেলিনা পারভীন’ প্রভৃতি।
সেলিনা হোসেনের ‘বেগম রোকেয়াকে আমাদের কেন প্রয়োজন’ প্রবন্ধে পাঠককে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আমাদের বর্তমান সমাজে বা জীবনে বেগম রোকেয়ার উপস্থিতি যে অনিবার্য তা বিনা দ্বিধায় আমাদের স্বীকার করতেই হবে। কেননা তিনি তাঁর বুদ্ধি, মনন ও দার্শনিক চিন্তা নিয়ে নিজের সময়ের চেয়ে একশো বছর এগিয়ে। প্রাবন্ধিক সেলিনা হোসেন মনে করেন, আমাদের এক অন্ধকারময় সময় গ্রাস করেছে, আর সেই অন্ধকার থেকে আলোর পথের দিশা শুধুমাত্র বেগম রোকেয়াই দিতে পারেন। পাশাপাশি সেলিনা হোসেন নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তির কথাও জোর দিয়ে বলেছেন-
হত্যা, খুন, ধর্ষণ এবং যৌতুকের কারণে নির্যাতন আজ এই সমাজ ব্যবস্থার ভেতরে গা-সওয়া হয়ে গেছে।... যতদিন নারীজাতির অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব না হবে, ততদিন পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় এই পীড়ন তাদের নিয়তি। ...শক্তি অর্জনের জন্য তাঁকে আমাদের প্রয়োজন।৯
নারীর আত্মশক্তি জাগরণের জন্য সেলিনা হোসেন উপমহাদেশের প্রথম নারীবাদী লেখক হিসেবে ‘বাঙালির জাগরণে রোকেয়ার আত্মশক্তি’ প্রবন্ধে রোকেয়া সাখাওয়াতের প্রসঙ্গ টেনেছেন।  রোকেয়া সাখাওয়াত নারীর শিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদের স্কুলে ভরতি করানোর জন্য অভিভাবকদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তবে শুধু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেই তিনি ক্ষান্ত হন নি, বরং তিনি মেয়েদের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। আবার ‘আঞ্জুমানে-খাওয়াতীনে-ইসলাম’ স্থাপন করে মেয়েদের কুটিরশিল্পে নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি মেয়েদের জীবনকে শুধু পতি-দেবতার মনোরঞ্জনেই সীমাবদ্ধ রাখার তীব্র বিরোধী ছিলেন। তিনি উন্নয়ন বলতে বুঝেছিলেন নারী-পুরুষের সামগ্রিক উন্নয়ন। পিছিয়ে থাকা নারীসমাজকে জেগে উঠে পুরুষের সাথে এক সারিতে আসতে বলেছেন।
‘ইতিহাসের প্রীতিলতা, বাংলাদেশের প্রীতিলতা’ প্রবন্ধে সেলিনা হোসেন দেখান যে, ১৯১১ সালের ৫ মে তারিখে বাংলাদেশের চট্টোগ্রামে গায়ের রং কালো নিয়ে প্রীতিলতা জন্মেছিল জন্য তার বাবার মন খারাপ হয়ে যায়, সেই প্রীতিলতা মাত্র একুশ বছর বয়সে নিজের জীবন দিয়ে ইতিহাসকে সাক্ষী করে প্রমাণ করেছে যে, মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ কোনো অপরাধ নয়।
এছাড়াও এই বিভাগে যেসমস্ত প্রবন্ধ রয়েছে সেগুলি হল- ‘সুফিয়া কামাল : জীবন ও শিল্পের কবি’, কিংবদন্তি ইলা মিত্র ও তাঁর তেভাগা আন্দোলন’, ‘গণিতের হিসাব ও সাহিত্যে নারীর বিস্তার’ প্রভৃতি।
‘নারীবিশ্ব’ নামের মধ্যেই রয়েছে নারীবাদের দ্যোতনা। নারীবাদী চেতনাকে দার্শনিক জগতে মানবতাবাদের চরম পরিণতির ক্ষেত্রে প্রথম ও সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সোপানরূপে গ্রহণ করা হয়ে থাকে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে প্রায়শয়ই নারীবাদ নারীর অধিকারের আন্দোলন এবং পুরুষ-বিদ্বেষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। সেখানে সেলিনা হোসেনের দৃষ্টিকোণ অত্যন্ত স্পষ্ট ও প্রসারিত। তিনি সার্বিক ভাবেই মানবমুক্তি তথা সমাজমুক্তির প্রয়োজনেই নারীবাদকে গ্রহণ করেছেন। সেটা এই সংকলনগ্রন্থের প্রথম ও প্রতিনিধিত্বমূলক প্রবন্ধটিতেই স্পষ্ট। যেকথাগুলি রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শার্ল্ট পারকিন্স গ্রিনম্যান সকলেই নিজের মতো করে বলেছেন। ‘নারীকে আপন বিশ্ব জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার’ জাতীয় বক্তব্যে ফুটে ওঠে প্রচ্ছন্ন নারীবাদ, সেখান থেকে বাংলাতেই আমরা দেখেছি মল্লিকা সেনগুপ্ত বা বাণী বসুদের রচনায় স্পষ্ট দাবী বা কখনো কখনো তীব্র অভিযোগও। সেসব বিচারে সেলিনা হোসেনের দৃষ্টিভঙ্গিতে স্পষ্টই একটা পথের অনুসন্ধান। প্রথমত নারীকে উপযুক্ত পরিস্থিতিতে পুরুষের সমশক্তি সম্পন্না রূপে আবিষ্কার করা, নারীর প্রতি বঞ্চনার দিকগুলিকে চিহ্নিত করা এবং সর্বোপরি সমাজগঠনে পুরুষের সমান নারীর ভূমিকার দিকটিকে তিনি তুলে ধরেছেন এবং সবটাই তিনি করেছেন আমাদের এই উপমহাদেশের পরিপ্রেক্ষিতেই। এটাই তাঁর বিশিষ্টতা।
নারীবিশ্ব গ্রন্থটির কোনও কোনও প্রবন্ধগুলির প্রকাশকাল উল্লেখ থাকলেও বেশিরভাগ প্রবন্ধগুলিরই প্রকাশকাল উল্লেখিত হয়নি। সাধারণ পাঠকের পক্ষ থেকে সম্পাদকের কাছে এই একটি মাত্র দাবী থেকে গেল।



নারীবিশ্ব : সেলিনা হোসেন ✪ সম্পাদনা : বরেন্দু মণ্ডল ✪ প্রকাশনা : অভিযান পাবলিশার্স ✪ প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০১৯ ✪ মূল্য : ৪০০ টাকা


তথ্যসূত্র-
১)  অগ্রবীজ, ৩য় বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ২০০৯
২)  হোসেন সেলিনা নারীবিশ্ব (ভূমিকা অংশ), বরেন্দু মণ্ডল (সম্পাদিত), অভিযান পাবলিশার্স, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০১৯
৩)  ঐ, পৃ. ৫৪
৪)  ঐ, পৃ. ১০৭
৫)  ঐ, পৃ. ১১৪
৬)  ঐ, পৃ. ১৭২
৭)  ঐ, পৃ. ২৫১
৮)  ঐ, পৃ. ২৬২
৯)  ঐ, পৃ. ২৭৪

Thursday, December 26

রাব্বীনূর আলী - তেভাগা আন্দোলন এবং আবু ইসহাকের ‘জোঁক’ : একটি বিকল্প প্রস্তাব




রাব্বীনূর আলী
তেভাগা আন্দোলন এবং আবু ইসহাকের ‘জোঁক’ : একটি বিকল্প প্রস্তাব



পরাধীন ভারতবর্ষের অবিভক্ত বাংলায় জমিদারি প্রথায় কৃষক-শ্রমিকদের উৎপাদিত পণ্যের তিন ভাগের দুই ভাগ দিতে হতো জমিদারকে। সেই ভাগের অর্থ দিয়ে জোতদার-জমিদাররা শহরে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতো। ফলত এর বিরুদ্ধে আপামর কৃষক-শ্রমিকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের দুই তৃতীয়াংশের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে, যা ইতিহাসে তেভাগা আন্দোলন নামে পরিচিত। তেভাগা শব্দের প্রচলিত অর্থে ভাগচাষী তাদের ভাগচাষের অধিকারস্বরূপ উৎপাদনের সমান অংশ বা দুই ভাগের এক ভাগ পাওয়ার অধিকারী। ১৯৪৬-৪৭ সাল নাগাদ স্বাধীনতার প্রাক্‌ মুহূর্তে ভূমি মালিক এবং ভাগচাষীদের মধ্যে উৎপাদিত শস্য সমান দুই ভাগ করার পদ্ধতির বিরুদ্ধে বর্গাদাররা প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। তৎকালীন পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়। মূলত এই আন্দোলন সংগঠিত করেন বাংলার প্রাদেশিক কৃষকসভার কম্যুনিস্ট কর্মীরা। তাদের নেতৃত্বে বর্গাচাষীরা ভূমি মালিক শ্রেণির বিরুদ্ধে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়। বাংলার ১৯ টি জেলায় এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ভূমি মালিকরা ভাগ-চাষীদের দাবি প্রত্যাখ্যান করে পুলিশ দিয়ে আন্দোলনকারীদের অনেককেই গ্রেফতার করে। কিন্তু জমিদারের দমনেও আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়নি। রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ, যশোর, জলপাইগুড়ি এবং চব্বিশ পরগনা প্রভৃতি জায়গায় আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। জলপাইগুড়ি, যশোর এবং দিনাজপুর তেভাগা এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আন্দোলনের চাপে অনেক ভূস্বামী তেভাগা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালে তদানীন্তন মুসলিম লীগ সরকার বিধানসভায় বর্গা প্রথা সংস্কারের উদ্দেশ্যে একটি বিল উত্থাপন করে। এই বিল বর্গাদার আন্দোলনে যেমন উৎসাহের সঞ্চার করে, তেমনই তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে একটা সহজ মনোভাবও গড়ে তোলে। শেষ পর্যন্ত এই নিপীড়িত আইনের বিরুদ্ধে লড়াই করে কৃষক-শ্রমিকরা জয়লাভ করে।
      তেভাগা আন্দোলনের এই কৃষক অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে  বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়েছে অজস্র শিল্প-সাহিত্য-নাটক। প্রথিতযশা সাহিত্যিকেরা তেভাগা আন্দোলনের ওপর অসংখ্য কবিতা-উপন্যাস-ছোটগল্প রচনা করেছেন। বাংলা ছোটগল্পে তেভাগা কৃষক সংগ্রামের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হারানের নাত জামাই’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বন্দুক’, সমরেশ বসুর ‘প্রতিরোধ’, সৌরি ঘটকের ‘কমরেড’ প্রভৃতি গল্পে। এছাড়াও আরও অনেক গল্পকার তাঁদের লেখায় তেভাগা কৃষক সংগ্রামকে তুলে ধরেছেন।
        আমাদের আলোচ্য বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩) সেই তেভাগা কৃষক আন্দোলনকে তুলে ধরেছেন তাঁর ‘জোঁক’ গল্পে। গল্পটি ‘মহাপতঙ্গ’(১৯৬৩) গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত। রচিত হয় ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। আবু ইসহাক তখন পুলিশ বিভাগের পরিদর্শক হিসেবে করাচিতে কাজ করছিলেন। গল্পকার হিসেবে আবু ইসহাকের চল্লিশের দশকে উত্থান ঘটলেও তিনি সর্বদা নিজেকে অন্তরালে রাখতেন। তাঁর সাহিত্য পরিধি বিবেচনা করলেই আমরা খুঁজে পাব বাস্তবতা। মূলত বাস্তবধর্মী গল্পকার তিনি। যারা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে তাদেরকে তিনি তাঁর গল্পের উপাদান করেছেন। সেই চিত্রই আমরা খুঁজে পাই তাঁর ‘জোঁক’ গল্পে। দেশের শোষক শ্রেণির দ্বারা নির্যাতিত, নিপীড়িত কৃষক সমাজকে আবু ইসহাক তাঁর এই গল্পে তুলে ধরেছেন। জোঁক একটি পতঙ্গ হলেও গল্পকার সেটিকে একটি রূপক হিসেবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। গল্পে ভূমিহীন দরিদ্র কৃষক ওসমান জোতদার ওয়াজেদ চৌধুরী এবং তার ছেলে ইউসুফ চৌধুরীর ছল চাতুরির দ্বারা প্রতারিত হয়েছে। ওয়াজেদ চৌধুরী শহরের প্রতিভাবান চাকুরীজীবী। ওসমান তার জমিতে ফসল আবাদ করে। গল্পের শুরুতেই গল্পকার ওসমানের উক্তির মাধ্যমে একজন কৃষকের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনাচারকে তুলে ধরেছেন-
          ‘সেদ্ধ মিষ্টি আলুর কয়েক টুকরো পেটে জামিন দেয় ওসমান। ভাতের অভাবে অন্য
          কিছু দিয়ে  উদরপূর্তির  নাম চাষী-মজুরের  ভাষায় পেটে জামিন দেয়া। চাল যখন
          দুর্মূল্য তখন এ ছাড়া উপায় কি?’
                  (আবু ইসহাক, নির্বাচিত গল্প সমগ্র, নওরাজ সাহিত্য সম্ভার, প্রথম সংস্করণ,
                   ২০০৫, পৃ- ১৩০)
এই খেয়েই ওসমানদের কাজে যেতে হয় স্ত্রী-সন্তানের মুখে অন্ন জোগানোর আশায়। ওসমান জোতদার ওয়াজেদ চৌধুরীর জমিতে চাষাবাদ করে। কাজে যাবার সময় সঙ্গে নেয় তার দশ বছরের ছেলে তোতাকে, পড়াশুনার পাশাপাশি তোতা পিতার কাজে সহযোগিতা করে। শ্রাবণের ভরা বর্ষায় ওসমানের আবাদ করা পাটক্ষেত স্বল্প জলে ডুবে থাকে। ওসমান তাই নৌকা করে তার  পাটক্ষেতে যায় এবং পাটক্ষেত দেখে আনন্দে আপ্লুত হয়ে উঠে। গল্পকার লিখেছেন-
         
            ‘পাট গাছগুলোর  দিকে  তাকিয়ে  ওসমানের  চোখ তৃপ্তিতে ভরে ওঠে। যেমন
            মোটা হয়েছে, লম্বাও হয়েছে প্রায় দুই-মানুষ সমান। তার খাটুনি সার্থক হয়েছে।’           
                                                                         (তদেব, পৃ- ১৩০)
কিন্তু সুপুষ্ট পাট গাছ দেখে আনন্দ হলেও ক্ষণিকেই তার মুখ ম্লান হয়ে যায়। কেননা এতো কঠোর পরিশ্রমের ফসল তার একার নয়। সে শুধুমাত্র এই আবাদের ভাগচাষী। জোতদার ওয়াজেদ চৌধুরীর গোমস্তা সঠিক সময়ে এসে সেই চাষের অর্ধেক ভাগ নিয়ে যায়। প্রতি মরশুমের সময় ওয়াজেদ চৌধুরীর ছেলে ইউসুফ ঢাকা থেকে এসে ধান-পাট বিক্রি করে সেই ভাগের টাকা নিয়ে আবার ঢাকায় চলে যায়। তাই সে আক্ষেপ করে ভাবে, তার মেহনতের ফসলে যদি কেউ ভাগ না বসাত তাহলে সবটাই সে পেত। এসব ভাবতে গিয়ে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কারণ পাট কাটতে গিয়ে তাকে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়েছে, পানি কামড়ানো, জোঁকের কামড়ও খেতে হয়েছে। রাগ করে সে তার আবাদি পাট গাছগুলোকেই গালাগাল দিয়ে ওঠে-
             ‘আমরা না খাইয়া শুকাইয়া মরি, আর এই শালার পাটগুলা মোট্টা অইছে কত।
             কাচিতে ধরে না। ক্যান্‌ চিক্কণ চিক্কণ অইতে দোষ আছিল কি? হে অইসে এক
             পোচে দিতাম সাবাড় কইরা।’  (তদেব, পৃ- ১৩২)
ওসমান জলের তলায় পাট কাটার দরুণ ক্রমাগত ওঠা-নামা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। খিদার চোটে সে জমিদারের উপরেও ক্ষিপ্ত হয়ে বিড়বিড় করে বলে-
             ‘ব্যাডা তো ঢাকার শহরে ফটেং বাবু অইয়া বইসা আছে। থাবাডা দিয়া আধাডা
             ভাগ লইয়া যাইব। ব্যাডারে একদিন পচা পানির কমড়া খাওয়াইতে পারতাম!’
                                                                           (তদেব, পৃ- ১৩২)
এ শুধু ওসমানের নয়, এ যেন সমগ্র কৃষক সমাজের সংগ্রামী মনোভাবাপন্ন দৃষ্টিভঙ্গী। যারা প্রতিনিয়ত জুলুমকারীর শোষণ-বঞ্চনাকে সহ্য করে চলেছে। আর তাই ওসমানের পায়ে জোঁক লাগার ফলে তার রক্ত দেখে তোতা যখন বলে ওঠে-
            ‘ইস্‌, কত রক্ত!...বাজান কেমুন কইর‍্যা জোঁক ধরল তোমারে, টের পাও নাই?’
                                                                         (তদেব, পৃ- ১৩৩)
এর প্রত্যুতরে ওসমান তার ছেলেকে বলে-
           ‘ এইডা আর এমুন কী জোঁক। এরচে বড় জোঁকও আছে।’ (তদেব, পৃ- ১৩৪)
বলার অপেক্ষা রাখে না এ জোঁক আর কেউ নয়, এরা হল সমাজের শীর্ষস্থানীয় শোষকশ্রেণি। এরা
দিনের পর দিন ওসমানের মতো কৃষকের রক্ত খেয়ে জোরপূর্বক তাদের অধিকার কয়েম করে নেয়। জোঁক যেমন ফাক পেলে মলদ্বার দিয়ে পেটের মধ্যে গিয়ে নাড়ী কেটে দেয় ঠিক তেমনি এই শোষকশ্রেনিরা কৃষকদের দিয়ে কাজ করিয়ে তাদের প্রাপ্য পাওনা না দিয়ে তিলে তিলে তাদের জীবনকে ধুলিস্বাৎ করে দেয়। গল্পকার জোঁক-কে তাই রূপক হিসেবে ব্যবহার করে সমগ্র গল্পে  শোষকদের দ্বারা শোষিত, নির্যাতিত কৃষক সমাজকে তুলে ধরেছেন।
       গল্পের শেষ পর্যায়ে ওসমান তার কষ্টের ফলানো ফসল যখন ঘরে নিয়ে আসে ঠিক তখনই ওয়াজেদ চৌধুরীর গোমস্তা ওসমানের বাড়ির ঘাটে দাড়ি-পাল্লা নিয়ে হাজির হয়। গোমস্তার কয়াল উৎপন্ন পাট মেপে মেপে তিন ভাগ করে। ওসমান ভাবে হয়তো তেভাগা আইন পাশ হয়ে গেছে এবং উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ সে পাবে- এ আশা করেছিল। কিন্তু না; গোমস্তা ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ দাবি করে। এই কথা শুনে ওসমানের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। পচা পানিতে নেমে বিষাক্ত প্রাণীর কামড় খেয়ে  অক্লান্ত পরিশ্রম করে সে চাষাবাদ করেছে, সেই ফসলের সাথে জড়িয়ে আছে তার জীবনের সুখ অথচ অত্যাচারী শোষকের এই নির্মম আচরণে ওসমান বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। সে তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে উঠে ওয়াজেদ চৌধুরীর ছেলে ইউসুফ চৌধুরীর বৈঠকখানায় চলে যায় এর কারণ জানতে। কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগেই ইউসুফ চৌধুরী  ফসলের সিংহভাগ দাবি করার কারণস্বরূপ জানায়, ওসমান লাঙল গরু কেনা বাবদ তাদের কাছ থেকে গত বছর টিপসই দিয়ে ৫০০ টাকা নিয়েছিল। তাই ওসমান ফসলের এক ভাগ পাবে। অথচ ওসমান এসবের কিছুই জানে না। কারণ টিপসই সে গত বছর দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু সেটা ছিল জমি বর্গা নেওয়ার বন্দোবস্তস্বরূপ একটা লিখিত দলিল। নিরীহ ওসমান বুঝতে পারেনি এটা ছিল জমিদারের ধোঁকাবাজি। আর আইনের একটা ধারায় বলা ছিল- ‘জমির মালিক লাঙ্গল-গরু সরবরাহ করিলে বা ঐ উদ্দেশ্যে টাকা দিলে উৎপন্ন শস্যের অর্ধাংশ পাইবেন।’ (তদেব, পৃ- ১৩৫) সেই সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে জোতদার ওয়াজেদ চৌধুরী তার ছেলেকে দিয়ে ওসমানদের মতো নিরক্ষর ভাগ-চাষীদের কাছ থেকে কাগজে টিপসই নিয়েছিল। তাই তাদের কাছে গিয়ে ওসমানের লাভ হয় না কিছু। ইউসুফ চৌধুরীও তার পিতার মতোই রক্তচোষা জোঁকে পরিণত হয়েছে। আইনের পরোয়া করে না তারা। আইন তাদের হাতের মুঠোয়-
             ‘আইন! আইন করে কি আর আমাদের আটকাতে পারে। আমরা সূচের ফুটো
             দিয়ে আসি আর যাই। হোক না আইন। কিন্তু আমরা জানি, কেমন করে
             আইনকে ‘বাইপাস’ করতে হয়। হুঁ হ্‌ হুঁ।’ (তদেব, পৃ- ১৩৫)
       জমিদারের বঞ্চনার শিকার অসহায় ওসমান প্রতাড়িত হয়ে বিলাপ করতে থাকে। তার মন থেকে রঙিন স্বপ্নগুলো হারিয়ে যায়। সে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। আর জোঁকরূপী রক্তশোষক ভূস্বামীরা এভাবেই ওসমানের মতো অসংখ্য ভূমিহীন কৃষকের উপর দিনের পর দিন নির্যাতন করতে থাকে।
       পরিশেষে এই ঘটনার আকস্মিকতায় ওসমান ছেলে তোতাকে নিয়ে পাগলের মতো টলতে টলতে চৌধুরীবাড়ির সীমানা পার হয়। সে সময় দেখা হয় আরেক চাষী করিম গাজীর সঙ্গে। নবুখাঁ সহ আরও দশ-বারো জন চাষীও তার সঙ্গে ছিল। এরা কেউই অত্যাচারী জোতদারের কালো হাতের আস্ফালন থেকে রেহাই পায়নি। তাই তারা সমবেত হয়ে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করে। ইউসুফ চৌধুরীর মিথ্যার কাছে নেতিয়ে পড়া ওসমান ভুয়া টিপসই দিয়ে চাষীদের কাছ থেকে উৎপাদিত শস্যের তিন ভাগের দুই ভাগ লুফে নেওয়ার প্রতিবাদে শামিল হওয়ার সাহস পায় না দেখে করিম গাজী ওসমানকে তাড়া দিয়ে বলে-
              ‘চল আমাগ লগে দেখি কি করতে পারি!...আরে এমনেও মরছি অমনেও
              মরছি। একটা কিছু না কইড়্যা ছাইড়্যা দিমু?’  (তদেব, পৃ- ১৩৬)
তাদের ঝিমিয়ে পড়া রক্ত আবার জেগে ওঠে। তারা তাদের স্বাধিকারের দাবিতে এবং জমিদারের এই ঘৃণ্য প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে পড়ে। ওসমান গা ঝাড়া দিয়ে বলে-
            ‘হঁ, চল। রক্ত চুইষ্যা খাইছে। অজম করতে দিমু না, যা থাকে কপালে।’
                                                                       (তদেব, পৃ- ১৩৬)
        যুগ-যুগান্তর ধরে বঞ্চিত ও শোষিত মানুষের জোতদার-জমিদারের বিরুদ্ধে এই যে রুখে দাঁড়ানো, এই যে প্রতিবাদী মনোভাব- তেভাগা আন্দোলনের প্রকৃত সাফল্য এখানেই। আর এখানেই ওসমানের মতো কৃষকেরা জয়ী।







সহায়ক গ্রন্থ
১. আবু ইসহাক। নির্বাচিত গল্প সমগ্র। নওরাজ সাহিত্য সম্ভার। ঢাকা। ২০০৫।
২. জয়ন্ত ভট্টাচার্য। বাংলার তেভাগা,তেভাগার সংগ্রাম। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি। কলকাতা। ১৯৯৬।
৩. ধনঞ্জয় রায়। তেভাগা আন্দোলন। আনন্দ। কলকাতা। ২০০০।
৪. সোমনাথ হোড়। তেভাগার ডায়েরি। সুবর্ণরেখা। কলকাতা। ১৯৯১।




তন্বী হালদারের অণুগল্প : পাষাণ কন্যার কথকতা






তন্বী হালদার
পাষাণ কন্যার কথকথা


শুনেছিলাম, কার যেন অভিশাপে আমি পাষাণ হয়ে যাব বলে, বহুদিন আগেই টেলিকাস্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রথমটা গুজব বলে কান দিই নি - ভেবেছিলাম এমনটা তো কতই হয়। যে মহিলার গর্ভে ভ্রূণ হয়ে গুটিসুটি মেরে যখন ছিলাম তখন শুনেছিলাম সেই মহিলা খেদোক্তি করছেন – ও যদি ভূমিষ্ঠ হয়ে পাষাণ হয়েই যায় তাহলে জন্ম দিয়ে কী লাভ? ঐ মহিলার স্বামী যিনি পাবলিকলি আমার পিতা বলে স্কুলের খাতায় নাম লেখা আছে, তিনি বললেন – থাক্‌ তবুও .........। এখন তো নানারকম আধুনিক চিকিৎসা বেরিয়েছে যদি কিছু ব্যবস্থা করা যায়! এরপর যা হয় আর কি – পাষাণ, পাষাণ, পাষাণ কন্যার নামের পাশে থাকে লজ্জা, ঘেন্না, অবহেলা, অত্যাচার, লাঞ্ছনা, অপমানের সমস্ত রকম যতিচিহ্ন। ঐ মহিলা আর তার স্বামীর প্রবল ক্ষোভে এতগুলো থেরাপি দেওয়া হচ্ছে তবু পাষাণ জেগে ওঠে কই?
স্কুলে কোনোদিন প্রথম দশজনের মধ্যেও থাকা হল না। কোনও বন্ধু হল না। কেমন শক্ত শক্ত হাত পা নিয়ে জীববিজ্ঞানের ক্লাসে মানুষের হৃদয়ে রক্ত সঞ্চালনের ছবি আঁকবার পর দিদিমণি কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করেন – হ্যাঁরে তোরও কি আমাদের মতই হৃদয় ......। আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকি। পাষাণ বলেই হয়তো আমার সমস্ত অনুভূতি খুব প্রবল। গ্রীষ্মে অসম্ভব তপ্ত হয়ে উঠি। শীতে পুরো জমে যাই। বর্ষায় হাজার ভিজলেও সর্দিকাশি কিছু হয় না।
কলেজ যাওয়ার পর সে এক অভিজ্ঞতা – থার্ড ইয়ার কেমিস্ট্রি অনার্সের একটা ছেলে বললো – আচ্ছা তোমার সমস্ত অরগ্যানও কি আর সব মেয়েদের মতো। ছেলেটা অনায়াসে আমার জামার ভিতর তার হাত রেখে বলে – ছ্যাঁ – এতো পাথর! সে ছেলের বিয়েতে মেয়ের বাড়ির পরিচয় সূত্রে নিমন্ত্রণ হয়েছিল। গিয়েছিলাম।
এরপর কত আলোকবর্ষ সময় পার হয়ে আজ এখানে পৌঁছেছি। শুনেছি যে মহিলার গর্ভে ভ্রূণ হয়ে একসময় আমি ছিলাম, তার স্বামী মারা গেছেন। মহিলা এখন অ্যালঝাইমারের পেসেন্ট। সব ভুলে গেছে। এমন কি এক সময় এক পাষাণ কন্যা জন্ম দেওয়ার জন্য তার লাইমলাইটে আসার ঘটনাও। পাষাণ বলেই আমার বয়স বাড়ে নি। চোখের নীচে রিংকেল আসেনি। টোন্‌ড দেহ। শুধু একটু উজ্জ্বলতা কমে গেছে। কিছুদিন হল আমি একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি, তা হল - আমার শক্ত বুকের নীচে নরম তলতলে কী যেন একটা আছে। কী সেটা? সেটাই কি ব্ল্যাক বোর্ডে আঁকা মানুষের হৃদয়! ইউরেকা! তার মানে –
আমাকে জন্মের পর থেকে মানবী করে তোলবার জন্য যে সমস্ত থেরাপিগুলো চলেছিল, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রত্যেকটার সম্পর্কে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে একটা জার্নালে জানলাম - আসল এবং প্রধান থেরাপিটাই নাকি আমার উপর প্রয়োগ করা হয়নি। তা হল ভালোবাসা। ভালোবেসে কেউ যদি আমাকে স্পর্শ করে তবেই নাকি আমি অন্যরকম হয়ে যাব। যেমনটা ত্রেতাযুগে অহল্যা হয়েছিলেন। কিন্তু এতগুলো দিন পরে আমার কি আর মানবী হয়ে বাঁচতে ইচ্ছা করবে? আমিই বা ভিক্ষুণীর মতো কারও পথ চেয়ে বসে থাকবো কেন? আমারও তো আমার মত করে বাঁচবার অধিকার আছে। তাই না?

খোকন বর্মন - মধ্যরাতের ঘরবদল : সেলিনা হোসেন


খোকন বর্মন
মধ্যরাতের ঘরবদল : সেলিনা হোসেন


আকাশের সীমান্ত নেই।মেঘেদের কি কখনো দেশভাগ হয়? তবে ধরণীর সীমান্ত আছে ,মানুষের তৈরি সীমান্ত  সেই সীমান্তের অংশ ছিটমহল ।
আমরা হিন্দুরো শুয়োর নোয়াই আর মুসলিমেরও গরু নোয়াই আজকের মধরাতের  পর থেকে আর এই অন্তর্দ্বন্দ্ব কাজ করবে না। কিছুক্ষন পর আমরা পাব নতুন সূর্য, একটা  নতুন ভোর সেই ভোরের আলো গায়ে মেখে  আমরা শামুকের মতো খোলস ছড়াব।এখন থেকে আমরা শক্ত পায়ে হাঁটব ,হামাগুড়ি দেওয়ার দিন ফুরিয়ে এসেছে ,আজ থেকে আমরা বন্দী মানুষ না মধ্যরাতের পর থেকে আমরা স্বাধীন আমরা স্বাধীন।
ছিটমহলের কথা শুনলেই আমাদের হৃদয়ের রংমহল যেন মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে আসে । এই মানবজীবন ,ধরলা নদী, প্রেমপ্রীতি ,গাঢ় স্মৃতিকে এক সূত্রে গেঁথে ছিটজীবনের সাতরং আঁকলেন  ওপর বাংলার গল্পকার সেলিনা হোসেন। ছিটবাসীদের গ্লানিময়জীবন এবং স্বাধীনতার আকাঙ্খাকে   তুলে ধরলেন "মধ্যরাতের ঘরবদল " এ। ইউনিক একটি সমস্যাকে তুলে ধরলেন জীবনের কঠোর বাস্তবতায়। ছিটমহলবাসীদের আঁতের কথা তুলে আনলেন আমাদের সামনে। নাগরিকত্ব এবং নিখাদ প্রেমের মধ্যে
স্বাধীনতা প্রাপ্তির স্বাদকে সামনে রেখে তিনি বের করে আনলেন  আঁতের কথা, সৃষ্টি করলেন একটি স্বতন্ত্র ধারার।সোলেমান মিয়া মনে করেন এতদিন বাদে সে মানুষ হল অন্যদিকে  অবনীশ জন্মভূমি  কিছুতেই ছাড়বে না  প্রয়োজনে প্রেম ছাড়বে
খুব সহজেই যেন তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে প্রথম প্রেমের স্মৃতি আঁকড়েই সে না হয় বেঁচে থাকবে ।প্রেমকে উপেক্ষা করে অবনীশের কাছে বড়ো হয়ে ওঠে আত্মপরিচয়,দেশপরিচয়।
আশায় বাঁচে চাষা ।এতদিন পাটগ্রামের ভুয়ো ঠিকানা নিয়ে লেখাপড়া করেছে, এতদিন তার মনে ছিল প্রবল ভয়। সে এখানকার ডিগ্রি দিয়ে চাকরি করতে পারবে না কিন্তু আজ মধ্যরাতের পর থেকে সে ভয় আর তার মধ্যে থাকল না।এখন সে দেশ পাবে ,নাগরিকত্ব পাবে ,চাকরি পাবে, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করবে ।
সেমন্তী চায় না কেউ তাকে ছিটমহলের বাসিন্দা বলুক ,এখন সে দেশ পাবে ।এ আশায় যেন মিশে রয়েছে তার স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ। এসবের ঘোর কেটে গেলে সে আবার দুঃখে ডোবে।এভাবেই একটি প্রেম   মধ্যরাত্রে  অগ্রসর হতে থাকে মৃত্যুর দিকে।
সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় ভারত ও পাকিস্তান দুটো দেশ তৈরি হয় কিন্তু ছিটবাসীরা কোনো দেশ পায় নি তখন থেকেই তাদের মনে দেশপ্রাপ্তির আকাঙ্খা  ।সেই দিন টিও ছিল শুক্রবার আর আজকের মধ্যরাত্রের স্বাধীনতার দিনটিও শুক্রবার  ,মাঝখানের আটষট্টি বছরের স্মৃতি রোমন্থন করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে হারাধন। তাদের জীবনের আর একটি শুক্রবার এবং মধ্যরাত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার আনন্দ মিলে মিশে এক হয়ে যায়,স্মৃতি তাদের কাঁদায়  ,আনন্দে চোখের জল বেরিয়ে আসে । ছিটবাসীদের তীব্র যন্ত্রণার কথা তিনি তুলে আনলেন।মেঘলা আকাশে যেন পূর্ণিমার আলোছায়া সৃষ্টি হয়। হারাধন এবং সোলেমান মিয়ার মধ্যে ।
ধরলাতে জল নেই,ঢেউ নেই ,এর পর আর ধরলা নদীকে দেখতে পাবে না সোহন বণিক।
ধরলা তাকে কত সুখ দিয়েছে দুঃখ দিয়েছে,কতবার তাকে কাঁদিয়েছে ,কতবার তাকে দিয়েছ সুখ  এসব  তার কাছে শুধুই স্মৃতি নয় ,ধরলা তাকে যেন বাঁচতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম । এই নদী তার ভিটেমাটি ভেঙেছে বহুবার ,সে গাছতলায়  থেকেছে। আবার ধরলার পাশে বসেই সে পেয়েছে আনন্দ ।ধরলা এখানে যেন একজন মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ। মধ্যরাতের পর থেকে সে আর ধরলা নদীকে দেখতে চাইলেও দেখতে পাবে না ,তার মন ভারী বিষণ্ণ ।মায়ের উপর রেগে গিয়ে আবার মায়ের কোলে মাথা ঠেকিয়েই যেন চিরসুখ। এবার সে কার কোলে মাথা ঠেকাবে?এভাবে পরিচয়হীন মানুষের কষ্ট দূর করেছে ধরলা।তার নেওয়ার মতো কিছু নেই এই ধরলার স্মৃতি ছাড়া।
একদিকে নিখাদ ভালোবাসার টান এবং অন্যদিকে জন্মভূমির টান ,সালমা ও মনোয়ারকে সামনে রেখে  তাদের মনস্তত্ত্বকে আবিষ্কার করলেন গল্পকার।অনেকেই জন্মভূমিকে ছাড়তে নারাজ ,যে জমির ধান খেয়ে বেঁচে আছে ,যে জমি বাঁচিয়ে রাখে তাকে কি ছেড়ে যাওয়া যায় । কোনো মুসলিম তো এই সুনীলের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে নি তবে কেন আমি এই জন্মভূমি ছাড়ব ।আমি  কি ভারতে যাওয়ার আবেদন করবে পারি?
যারা একবার ইন্ডিয়া যাওয়ার আবেদন করেছিল তারা ইচ্ছে করলেও বাংলাদেশে থাকতে পারবে না। ওপারে গিয়ে আদৌ ঘরবাড়ি মিলবে কি না সে বিষয়েও সন্দেহ থাকলে নাগরিকত্বের টানে অনেকে বুক বেঁধেছে আশায়। মনোয়ার তার স্ত্রী পুত্রকে পর্যন্ত ছাড়তে রাজি নাগরিকত্বের টানে,জন্মভূমির টানে অন্যদিকে সালমা তার জন্মভূমি বাংলাদেশ ছাড়তে নারাজ তাই সে ঝগড়া করে তার দুই পুত্রকে নিয়ে বাপের বাড়ি রওনা দিয়েছিল । কিন্তু শেষ অবধি তারা। ভালোবাসার টানের কাছে পরাভূত হল জন্মভূমির টান-
"  আমি এতকিছু বুঝতে পারি না ।আমি আমার তমাল তুষারকে বুকের মধ্যে চাই ।নইলে আমি কেমন বাবা -- ও চিৎকার করে কেঁদে উঠলে ওর চারপাশে দাঁড়ানো মানুষেরা চোখের পানি মোছে ।সোহান বণিক ওর মাথায় হাত রেখে বলে সালমা তোকে ছাড়া থাকতে পারবে না রে মনোয়ার ।ও তো জন্মভূমির টানে থাকতে চেয়েছে ।কিন্তু ওর তো ভালবাসার টান আছে।
এখানেই যেন অস্পষ্ট হয়ে আসে ছিটমহল ,  মনোয়ারের চোখে সালমার ছবি ছাড়া কিছুই ফুটে ওঠে না।তাদের মধ্যে আর কোনো কাঁটাতারের বন্ধন নেই ,রয়েছে শুধুই ভালোবাসার পারিবারিক বন্ধন।
গল্পকার এখানে ছিটমহল বাসীদের সুখ দুঃখে ভরা কিছু স্মৃতি এবং নিখাদ ভালোবাসা দিয়ে আঁকলেন ছিটমহলবাসীদের শরীরেই আঁকলেন নতুন মানচিত্র।  একদিকে ভালোবাসা ও অন্যদিকে অধিকার , সব কিছুকে মিলিয়ে মিশিয়ে গল্পকার সৃষ্টি করলেন এক নতুন মানচিত্র যেখানে কোনো কাঁটাতার নেই, রয়েছে শুধুই ভালবাসা।
গল্পকার একদিকে একটি প্রেমকে বলি দিলেন অন্যদিকে প্রেমকে ঘিরেই গড়ে তুললেন এক গভীর মনস্তত্ত্বকে। যেখানে কাউকে তিনি দিলেন জন্মভূমির নাগরিকত্ব আবার কাউকে তিনি দিলেন ভালোবাসার নাগরিকত্ব। একদিকে ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়া , প্রেমিকাকে ছেড়ে যাওয়া অন্যদিকে   আত্মপরিচয় পরিচয় পাওয়া ,নিজের দেশ পাওয়া ।গল্পকার এখানে যেন একটি প্রশ্ন চিহ্ন  দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন পাঠকের হাতে। একদিকে সেমন্তীর ভালোবাসার বন্ধন কে ছিঁড়ে দিয়েছেন আবার অন্যদিকে জন্মভূমির টানে বাংলাদেশে থাকতে চাওয়া সালমা হেরে যায় মনোয়ারের নিখাদ প্রেমের সামনে। সব গ্লানি ভুলে সোহন বণিক বলে ওঠে-" ছিট মানচিত্র পেয়েছে এজন্য আমরা সবাই খুশি"
এভাবে ছিটবাসীদের  আঁতের কথা বের করে আনলেন গল্পকার সেলিনা হোসেন ,তুলে আনলেন জীবনধারীনি ধরলার কথা, প্রেমের পরিণতির কথা।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির স্বাদের আড়ালে লুকোনো তীব্র যন্ত্রণাকে ও স্মৃতিগুলোকে জাগ্রত করে দিয়ে তিনি "মধ্যরাতের ঘরবদল " এর মাধ্যমে  ছড়িয়ে দিলেন বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আবার কারও মনে ছড়িয়ে দিলেন তীব্র বিষাদ। এভাবেই গল্পকার বের করে আনলেন ছিটবাসীদের আঁতের কথা। ছিটবাসীদের ইউনিক একটি সমস্যাকে তুলে ধরতে গিয়ে তিনি ছিটবাসীদের পুরো শরীর জুড়েই সৃষ্টি করলেন মানচিত্র।


তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অণুগল্প : খিদে






তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
খিদে

পাঁচিল-ঘেরা বিশাল মাঠ, মাঠটা এক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের, সেখানে ভোর থেকে বেলা ন'টা-দশটা পর্যন্ত স্থানীয় মানুষজন আসেন স্বাস্থ্যোদ্ধারের আকাঙ্ক্ষায়। মুক্ত আকাশের নীচে কেউ ব্যায়াম করেন, কেউ মাঠের চারদিকে ঘোরেন, কেউ ব্যস্ত প্রাণায়ামে।

তাদের মধ্যে চোখে পড়ে দোহারা চেহারার একজনকে যার ব্যায়াম দেখে মনে হয় অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী। তাকে দেখলেই এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে থাকা তিনটে কুকুর ছুট্টে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে।

আসলে তার পকেটে থাকে বেশ কয়েকটি বিস্কুট, কুকুর তিনটে এলেই তিনি পকেট থেকে বার করে দেন সেই আহার্য। কুকুর তিনটে মহানন্দে খেতে থাকে আর লেজ নেড়ে কৃতজ্ঞতা জানাতে থাকে লোকটিকে। লক্ষ্যনীয় এই যে, বাইরের অন্য কোনও কুকুর গেট টপকে সেই বিস্কুটে ভাগ নিতে এলে তিনজনে একযোগে তাকে এমন তাড়া করে যে, সে প্রাণপণে ছুটে গেটের বাইরে।

দৃশ্যটা গা সওয়া হয়ে গেছে সবার।

হঠাৎ সেদিন একটি বাচ্চা কুকুর কী করে যেন গেটের মধ্যে ঢুকে পড়ে চলে এল বিস্কুটের গন্ধ শুঁকে শুঁকে। সাদা ধবধবে লোম, মিষ্টি তার হাবভাব। কুকুর তিনটেকে বিস্কুট খেতে দেখে কুইঁ কুইঁ। কুইঁ কুইঁ। হয়তো বলতে চাইলো, আমাকেও একটা বিস্কুট দাও না!

কুকুর তিনটে প্রথমে পাত্তাই দিতে চাইল না তাকে। বাচ্চাটা তবু ঘুরঘুর ঘুরঘুর। ঘ্যানঘ্যান। ঘ্যানঘ্যান। কুকুর তিনটে তাকে ঘেউ ঘেউ করে তাড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু বাচ্চাটা তখনও কুইঁ কুইঁ। কুইঁ কুইঁ। তিনটে কুকুর তখন তাকে চেপে ধরে এমন আঁচড়ে-কামড়ে দিল যে, বাচ্চাটা প্রায় মরো-মরো।

কোনও ক্রমে ছাড়া পেয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে, গোঙাতে গোঙাতে গেটের বাইরে গিয়ে কুইঁ কুইঁ করে কী যেন বলতে লাগল। হয়তো বলছিল, আমারও তো খিদে পায়!



Wednesday, December 25

সুজয় চক্রবর্তীর অণুগল্প : লাগাম







সুজয় চক্রবর্তী
লাগাম


রিক্সা স্ট্যান্ডের প্রায় সবাই এখন টোটো কিনে ফেলেছে। শুধু নিত্য পারেনি। জমানো টাকা কিছুই নেই।

এখন টোটোরই বাজার! কয়েকবার ভেবেছে ভাড়ায় টোটো চালাবে। বাজারে প্রবোধ তোকদারের পাঁচটা টোটো খাটছে। আরও পাঁচটা নামাবে সামনের মাসে। কিন্তু মন সায় দেয়নি। হাজার হোক, রিক্সাটা তো তার নিজের! যাও না যাও কারও কাছে কোনও কৈফিয়ত দেওয়া লাগে না।

তবে টোটো আসাতে রিক্সা মার খেয়ে গেছে। আগে যখন সবার রিক্সা ছিল তখন দিনে তিনশ' সাড়ে তিনশ' নিয়েও বাড়ি ফিরেছে নিত্য। এখন দেড়শ'ও হয় না। কালই তো মোটে সত্তর হয়েছিল!

কেন নিত্য'র রোজগার ইদানীং কমে গেছে বউ মধুও জানে। কিন্তু ছেলে দুটো বুঝলে তো! আজ এটা দাও, কাল ওটা দাও। সব সময় কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান।

ছেলেগুলোর চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে যখন মুখ থুবরে পড়ে নিত্য, একমাত্র তখনই বউ মধুর মুখ আর 'মিষ্টি' থাকে না। খিচিয়ে ওঠে। যেমন আজ উঠেছে।

---- আমার তো কোনও শখ-আহ্লাদের কথাই বলি না। ওরাও কি মুখে লাগাম দিয়ে থাকবে? 

রেগে যায় নিত্য। বলে, 'হ্যাঁ, দরকারে লাগাম দিতি হবে।'

----- তা, জন্ম দেওয়ার সময় তুমিও তো দিতি পারতে!

নিত্য চুপ করে গেল । একেবারে চুপ। লাগাম দিলো মুখে!




অদিতি রায় : মৃত্যুই ধ্রুব জীবনের পরপারে - একটি রেপ ন্যারেটিভ







অদিতি রায়
মৃত্যুই ধ্রুব জীবনের পরপারে : একটি রেপ ন্যারেটিভ


সালটা ১৯৭৬, ক্যালিফোর্নিয়ার ক্ল্যারেমন্ট গ্র‍্যাজুয়েট ইউনিভার্সিটি। একজন ছাত্র তার পিএইচডি -র গবেষণাপত্র লিখছেন ধর্ষকদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে। কিন্তু কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন তাদের মানসিকতা? চাই কিছু ধর্ষকদের জবানবন্দী। লস এঞ্জেলসের পেপারে একটি বিজ্ঞাপন দিলেন তিনিঃ

ARE YOU A RAPIST?
Researcher Interviewing anonymously by phone to protect your identity.
Call- ********

সারাদিন বসে রইলেন ফোনের সামনে। রাত হয়ে গেল। কোনো ফোন এলোনা। অবশেষে তিনি যখন প্রায় নিরাশ সে সময় হঠাৎ বেজে উঠলো ফোন। ফোনের ওধারে একজন ধর্ষক স্বয়ং, যার মুখ থেকে জানা যাবে তাঁর মানসিকতা!  আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ছাত্রের মুখ। এরপর একে একে আরো প্রায় ২০০ খানা ফোন তিনি পেয়েছিলেন। যাদের মধ্যে কেউ ধর্ষণ করেছে নিজের প্রেমিকাকে, কেউ পরিচিত কারো স্ত্রীকে, কেউ বা স্কুলের বাচ্চাকে। পেশায় এরা কেউ কম্পিউটার প্রোগ্রামার, কেউ চিত্রশিল্পী, কেউ ব্যবসায়ী কেউ বা আবার দারোয়ান। দেখে বোঝা যায়না তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে কোন ধর্ষকাম প্রবৃত্তি।

তাহলে কীভাবে তারা হয়ে উঠেছে ধর্ষক? কী বা তাদের ধর্ষণের মানসিকতা? এদের মধ্যে থেকে পঞ্চাশজনের জবানবন্দি বেছে নিয়ে তার বিশ্লেষণ করে তিনি তৈরী করলেন তাঁর গবেষণাপত্র। কাজ শেষ হলো ১৯৭৮ সালে। বিখ্যাত সেই ডিজারটেশনের নাম হলো "The Undetected Rapist" আর ছাত্রটি হলেন প্রসিদ্ধ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড. স্যামুয়েল স্মিথম্যান।

এ তো গেল ক্যালিফোর্নিয়ার কথা। বিজ্ঞানের কথা। কিন্তু সাহিত্যে? সাহিত্যিক তো স্বয়ং ঢুকে বসেন একজন চরিত্রের অন্তর সত্তায়।
তাই করলেন বাংলাদেশের অন্যতম সাহিত্যব্যক্তিত্ব  বিপ্রদাস বড়ুয়া। (জন্মঃ ১৯৪০)

ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ মধ্যবর্তী সময় পর্যায়ে কেটেছে তাঁর কৈশোর এবং যৌবন। এই তোলপাড় সময়ের সামগ্রিক রুপচ্ছবি প্রতিফলিত হয়েছে বাংলাদেশের সামগ্রিক সাহিত্যেই। এই রাজনৈতিক পালাবদলই বাংলাদেশের সাহিত্যের নিজস্ব ধারা সৃষ্টি করেছে, বলা ভালো একপ্রকার সাহিত্যের বুনিয়াদ গড়ে তুলেছে।
অন্যথা হয়নি বিপ্রদাস বড়ুয়ার ক্ষেত্রেও। অসামান্য দক্ষতায় "মৃত্যুই ধ্রুব জীবনের পরপারে" ছোটগল্পে এই সামাজিক পটভূমিতে তিনি মিশিয়েছেন মনস্তত্বের মশলা এবং জাদুবাস্তবতার সুগন্ধ।

সামরিকবাহিনী শাসিত বিধ্বস্ত বিচূর্ণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সামাজিক রাজনৈতিক উত্তাল পরিস্থিতির চিত্রপটে তিনি ফুটিয়ে তুললেন অনবদ্য এক রেপ ন্যারেটিভ। যেখানে কথক নিজেই একজন ধর্ষক এবং এক অর্থে একটি প্রাণের হত্যাকারী।

ভোলা অঞ্চলের একটি মেয়ে, গল্পের এক তৃতীয়াংশ অব্ধি যার কোনো নাম নেই, কারণ সে কেবলই একটি বস্তুদ্রব্য সম "মেয়ে", বরিশাল কলেজে সে ছিল পাঠরতা অর্থাৎ শিক্ষিত - বাবার কাছে টাকা নিতে এসে দাঙ্গার কবলে পড়ে তিন পরিচিত যুবক দ্বারাই অপহৃত হয় সে। কাকুতিমিনতি করে বা "দাদা" ডেকেও লাভ নেই জেনেও অসহায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল মেয়েটি। কেবল হাসি দিয়ে লঘু করতে চেয়েছিল নিজের ভয় তথা পরিবেশের বীভৎসতা এবং ক্রিয়াকলাপের ভয়াবহতা। হ্যাঁ, ভয়ই তো পেয়েছিল সে, যদিও সেই ভয় ফুটিয়ে তুলতে চায়নি প্রকাশ্যে আর সেই ভয়ই সে ক্রমে সঞ্চারিত করে দিয়েছে ধর্ষকদের মনে। আর তারপর তা সঞ্চারিত হয়েছে গল্পের বিগ্রহে, অজানা শিহরণ সংক্রামিত হয়েছে পাঠকের মননে।

প্রথমেই জানা যায় মেয়েটির উপমা তার চমৎকার ক্ষুরধার শরীর, গুচ্ছ খোঁপা, পিঠের তিল। রিক্সায় দুই পুরুষের মধ্যিখানে গাদাগাদি করে বসিয়ে নিয়ে আসা হয় তাকে। রিক্সাওয়ালা পর্যন্ত সোৎসাহে প্ররোচনা দেয় ঘটতে চলা এই অনৈতিক ভোগোল্লাসের ঘটনাটিতে।

"প্রথমজনের বেলায় সে হাসিখুশি ছিল। দ্বিতীয়জনের বেলায় একটু সবুর করতে বলেছিল। তৃতীয়জনের বেলায় পানি চেয়েছিল। তার বদলে ওকে আমরা চুমু খেয়েছিলাম। পরিত্যক্ত ঘরে কোনো কলসী ছিলোনা।"

মেয়েটি যে একজন সম্পূর্ণ মানবী, ধর্ষণের কালে তা খেয়াল হয়নি তিন ধর্ষকের। তার জলের জন্য আকুলতা, হাসিমুখে অথচ কান্নাভরা গলায় তিনজনকে ডাকা...তাদের কারো কানে পৌঁছায়নি। এমনকি তার "আমি আর বাঁচবোনা".. এই আর্ত কথাটুকুও বিচলিত করেনি কাউকে।

কিন্তু মেয়েটি শেষে মারাই যায় আর তার মারা যাওয়াটুকুই শেষ পর্যন্ত বিস্মিত ও ভাবিত করে তোলে ধর্ষকদের। কথক লিখেছেন, বাংলাদেশের দাঙ্গা পরিস্থিতিতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর ঘটনার মধ্যে একটি সাধারণ মেয়ের প্রাণ যাওয়াও অতি তুচ্ছ ঘটনা৷ মেয়েটির বাবা মা ছাড়া এক্ষেত্রে তার জন্য কাঁদারও কেউ নেই। কিন্তু তবু, মেয়েটির মৃত্যুই কার্যত কথকের বেঁচে থাকাকেই মিথ্যে করে দিয়েছে।

মানসিক ও শারীরিক উন্মাদনা কেটে গিয়ে তিনজন যখন স্বাভাবিক চৈতন্যে ফিরেছে তখন তারা মৃতদেহটুকুর মধ্যে প্রাণ ফিরিয়ে আনার অসম্ভব আকাঙ্ক্ষায় অনুশোচনাবিদ্ধ হয়েছে। আর বারবার তাই আত্মসমালোচনার মাধ্যমে, কৃত কার্যের পুনঃ পুনঃ বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজেদেরকে অজুহাত দিয়ে শান্ত করতে চেয়েছে, প্রবোধ দিতে চেয়েছে। আর ততই তারা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে আত্ম দংশনে।

" ওর মুখের হাসি হাসি ভাবটুকুই আমাদের বিভ্রান্ত করেছে। আমরা বুঝতে পারিনি ও এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাবে। আমরা আরো ভেবেছি ওর যৌবন ফুরাবার নয়। ওর মতো মেয়ের কাছে তিনজন যুবক কিছুই নয়।"

মারা যাওয়ার সময় মেয়েটি বলেছিল, "সমুদ্র তোমাদের নিয়ে যাবে।"

সে মুহুর্তে একথা তাদের কাছে হেঁয়ালী বলে মনে হলেও, এক অমোঘ অভিশাপের মতো এ কথা সত্যি হয়ে  ফলে গেছে। কাকতালীয়ভাবে হোক অথবা অখন্ডনীয় পরিণতি হিসেবে মেয়েটির কথাই তাদের জীবনে ধ্রুবক হয়ে উঠেছে।

মেয়েটি মারা যাওয়ার পর অনুশোচনার সাথে সাথে এক তীব্র ভয় এসে মেশে তিনজনের মনেও। কারণ গভীর প্রত্যয়ের সাথে মেয়েটি উচ্চারণ করেছিল কথাগুলো। তাছাড়া তারা কোনোভাবেই ভাবতে পারেনি তাদের অত্যাচারে মেয়েটির মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে যাবে। তাই অন্ধকার রাত্রে কাছে দুরে থেকে আসা লুটপাট আর ঘর পোড়ানোর চীৎকারের সাথে সাথে তারা শুনতে পায় সমুদ্রের গর্জন। এমন করে রাতের চড়ায় সাগরের ডাক আগে কখনো শোনেনি তারা।

ত্রিভুজের মতো তারা মেয়েটিকে ঘিরে বসে, যেন নিভে যাওয়া যজ্ঞের চারিদিকে তিন যজ্ঞকর্তা। তাদের একান্ত ইচ্ছেতে, একনিষ্ঠ প্রার্থনায় যেন আবার সাগ্নিক হয়ে উঠবে হোম, প্রাণ ফিরে পাবে মেয়েটি। নিজেদের "কুৎসিত হিমশীতল অত্যাচার", ইডের ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তিকে আহুতি দিতে প্রস্তুত তারা সেই যজ্ঞে।

তারা ভাবে, মেয়েটি বেঁচে উঠলে তাদের পকেটে থাকা লুটের বিশ পঞ্চাশ হাজার টাকা, সোনাদানা সবকিছু তাকে তারা দিয়ে দেবে। এমনকি মেয়েটির দেওয়া যে কোনো শাস্তিও মেনে নেবে তারা নির্দ্বিধায়!

কিন্তু মেয়েটি স্পন্দনহীন! দয়াভিক্ষা না করে, হাসি মুখে, অবিচলিত ভাবে নেমেসিসের মতো একটি স্তোত্র উচ্চারণ করে সে মারা গেছে, সেই মৃত্যুর চেয়ে বড় শাস্তি আর নেই এই তিনজনের পক্ষে।

মেয়েটি বাধা দিলেও তারা হয়তো বল-প্রয়োগ ই করতো, তবু এ অবস্থায় তিন ধর্ষক মায়ার বশবর্তী হয়ে ছোটবোনের মতো তাকে পোশাক পরিয়ে দিয়েছে, মরদেহ কাঁধে তুলে নিয়েছে যথাসাধ্য যত্ন ও আয়োজন সহকারে, তারপর তারই কথা মতো সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছে তাকে।

তার তীব্র কঠিন আদেশে তারা যেমন বারান্দায় চলে গিয়েছিল ধর্ষনের শেষে, তেমনই মরে গেলে সে যে সমুদ্রে যাবে..তার সেই কথা আদেশের মতো অনুরণিত হয়েছে তাদের মনে। আদেশ পালন করেছে তারা কোনো এক অজানা আশঙ্কা থেকে, আবার বিবেকের দংশন থেকে, আবার হয়তো সহজাত এক মনুষ্যত্বের মায়া থেকে, ইডের উপরে জেগে ওঠা বলিষ্ঠ ইগো এবং সুপার ইগো থেকে।

এরপরই কথক জানান, মেয়েটির নাম নাম  "মালতী" এবং বলেন, "এরপরই ওর সব কথা ফলতে শুরু করলো"...
এখানে এসেই পাঠকের মনে পড়ে যেতে পারে রবি ঠাকুরের বাংলাদেশের সাধারণ মেয়ে মালতীর কথা, যারা ফরাসী জানেনা, জার্মান জানেনা, কেবল কাঁদতে জানে। কিন্তু তাদের মধ্যেই লুক্কায়িত যেসব অসাধারণত্বের স্ফুলিঙ্গ.. তাতে মালতীর গণিতে প্রথম হওয়ার ইচ্ছে পূরণ হয় কিনা তা জানা না গেলেও,  সেই আগুনেই এই গল্পের ধর্ষিতা মালতীর ইচ্ছে নিয়তির পরিহাসের মতোই ফলতে শুরু করে।

মাঝগাঙে ডুবে মারা যায় দুই ধর্ষক। সমুদ্রগ্রাস থেকে কোনোক্রমে  রেহাই পেয়ে যান কথক। আর তারপর থেকে তীব্র মৃত্যুভয় ধাওয়া করতে থাকে তাঁকে। মালতী মারা গেছে, সাথে নিয়ে গেছে কথকের ধর্ষক দুই সঙ্গীকেও। তিনি জানেন, এরপর হাঁটুজল নদীতে পরলেও আর প্রতিরোধের শক্তি তিনি পাবেননা। তার অবচেতনে কীভাবে যেন গেঁথে গিয়েছে, হয়তো তিনি সাঁতার জানেননা। মৃত্যু যে তার জলে ডুবেই হবে, দুই সঙ্গীর সলিল সমাধিতে সেই প্রত্যয় দৃঢ় হয়ে গিয়েছে তার মনে।

আর নিজের এই অনিবার্য পরিণতির কথা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হয়ে গিয়েই বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহুর্তই তার কাছে হয়ে উঠেছে মৃত্যুর অধিক। তিনি হয়ে উঠেছেন জীবন্মৃত।

"কৃষ্ণকান্তের উইল" -এ ভ্রমরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র দেখিয়েছিলেন, অনুতাপ অনুশোচনার চেয়ে বড়ো শাস্তি আর হয়না। আলোচ্য গল্পটির ক্ষেত্রে অনুশোচনার সাথে ভরাকোটালের জোয়ারের মতো এসে মিশেছে মৃত্যুভয়।

"আমার স্নায়ু স্নায়ুতন্ত্রীকে, ইন্দ্রিয় ইন্দ্রিয়কে, রক্তকণিকা রক্তকণিকা সমূহকে, কোশ কোশকলাকে ধ্বংস করে যাচ্ছে।"

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের "নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে" উপন্যাসেও মালতী ছিলো এক তরুণী বিধবা নারী। সারা উপন্যাস জুড়ে অমলিন থাকা একটি চরিত্রকে শেষাংশে গণধর্ষিত, লাঞ্ছিত হতে হয় দেশভাগের বিক্ষুব্ধ দাঙ্গার পটভূমিকায়।
এ মালতী আসলে নির্দিষ্ট একজন মালতী নয়, এ আসলে "আত্মজা ও একটি করবী গাছ" এর রুকু, "মানুষের জন্য" গল্পের দুইভাইয়ের অসহায় মা তথা যুদ্ধবিদ্ধস্ত বুভুক্ষু  দেশের অসহায় নারী। বড় অর্থে বিত্রস্ত, লাঞ্ছিত বাংলাদেশ। অত্যাচারে মৃতপ্রায় বাংলাদেশ। হাসতে ভুলে যাওয়া বাংলাদেশ।

এই সমুদ্র হতে পারে সময়ের প্রতীক, হতে পারে পরিস্থিতির প্রতীক, অথবা শুধুই নিয়তি। ম্যাজিক রিয়ালিজমের আতসকাঁচে দেখলে এ আসলে ধর্ষিত অসহায় জীবনের অন্তর্নিহিত প্রতিশোধস্পৃহার গল্প, নেমেসিসের চূড়ান্ত প্রকোপের গল্প।

উইলিয়াম ফকনারকে উদ্ধৃত করে নোবেল পুরস্কার ভাষণে ম্যাজিক রিয়েলিজমের জাদুকর মার্কেস বলেছিলেন, ‘মানুষের অবসান মেনে নিতে আমি অস্বীকার করি। ’ তিনি বলেছেন, ‘সমস্ত দমনপীড়ন, নির্যাতন, লুটতরাজ, আত্মবিক্রয় সত্ত্বেও আমাদের উত্তর হচ্ছে- 'জীবন'। না বন্যা, না মহামারী, না বুভুক্ষা, না প্রলয়ঝড়, এমনকী শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়ে চিরকাল বয়ে চলা যুদ্ধবিগ্রহেও মৃত্যুর ওপর জীবনের নাছোড় প্রাধান্যকে হ্রাস করে দিতে পারেনি।"

এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে, মালতীর সমুদ্র হয়ে যাওয়া এবং ধর্ষকদের পরিণতিও আসলে আলোকিত জীবনের জয়ধ্বনির কথাই সূচীত করে।
সমাজ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রেপ ন্যারেটিভের পাশাপাশি অসামান্য প্রতীকি অর্থে এক আলো আঁধারময় ভাবনার প্রাঙ্গণ লেখক পাঠকদের জন্য রেখে যান গল্পটির ক্ষেত্রে। চৈতন্যের স্তর ভেদ করে মগ্নচৈতন্যের কড়া নাড়া দেয় গল্পটি।

গল্পটির কথনকৌশল অনবদ্য। উত্তমপুরুষ বয়ানে একজন ধর্ষকের জবানিতে এমন ধর্ষকাম মনোপ্রবৃত্তি এবং ধর্ষণোত্তর মানসিকতা প্রকাশক গল্প ভীষণই বিরল।

একজন মৃতাকে মাঝে রেখে তাঁর তিন প্রেমিকের আলাপ আলোচনা ও মনস্তত্ব নিঁখুত ভাবে লিপিবদ্ধ করেছিলেন কথাসাহিত্যিক বিমল কর "আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন" গল্পে।
এখানে একজন ধর্ষিতা নারীর মৃতদেহ সামনে রেখে অনুশোচনা ও আশঙ্কায় বিদ্ধ তারই তিন ধর্ষক পুরুষ। বাইরের আঙ্গিক এবং গভীর সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক নিহিতার্থের পাশাপাশি প্লট নির্বাচনের ক্ষেত্রেও অনবদ্যতার দাবি রাখে এই ছোট গল্প।

মৃত্যুই জীবনের পরপারে একমাত্র ধ্রুব। আর এ গল্পের ধর্ষক তথা কথকের জীবনে সমুদ্রগর্ভে মৃত্যুই অনিবার্য এবং ধ্রুব। তাই বরিশাল থেকে ভোলা গামী স্টিমারের পথে প্রতিটা মুহুর্ত আতঙ্কে এবং আশঙ্কায় পার করতে হয় বেঁচে যাওয়া ধর্ষককে।