Monday, December 31

প্রবন্ধ : মহম্মদ লতিফ হোসেন





 ‘ছোটোগল্প: নূতন রীতি’ এবং বিমল করের ‘গগনের অসুখ’
-
‘ছোটোগল্প: নূতন রীতি’ বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে যে প্রশ্নটি আমাদের সর্বাগ্রে ভাবিয়ে তোলে সেটা হল- এই নূতন রীতি কি বাংলা সাহিত্য আন্দোলনের কোনও আভাগার্দধর্মী প্রয়াস ? প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতিষ্ঠান বিরোধীদের দ্বন্দ্বটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানে থেকে প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করবার সাহসটিই নতুন। আর এই সাহসটিই দেখাতে পেরেছিলেন বিমল কর। আলোচনার শুরুতেই তাঁকে তথাকথিত প্রতিষ্ঠানের ভেতরে রেখে দেখতে চাইলাম তার কারণ ১৯৪২ থেকে ১৯৯৭- এর সময়কালে তাঁর রচিত প্রায় ২০০টি গল্পের মাত্র ৩৩টি লিটল ম্যাগে প্রকাশিত হয়েছিল, বাকি সব গল্পই বড় পত্রিকা তথা বাণিজ্যিক কাগজে জায়গা নিয়েছে। কাজেই সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে তাঁকে তথাকথিত প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় কর্মী বলতেই হয়। কিন্তু একজন সক্রিয় কর্মীর এহেন বিপ্লব কি প্রতিষ্ঠানের নিয়মতান্ত্রিকতাকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করায় না ? বিমল কর এই প্রশ্নটিকেই তুলতে পেরেছিলেন। আর পেরেছিলেন বলেই  ‘ছোটোগল্প: নূতন রীতি’(১৯৫৮-১৯৫৯) হয়ে উঠেছে ছোটোগল্পের তথাকথিত নিয়মতান্ত্রিক নীতিবাদী শুদ্ধতার বিরুদ্ধে এক তীব্র জেহাদ।

   প্রতিটি শিল্পীই জীবনের একটি পর্যায়ে এসে নিজেকে, নিজের সৃষ্টিকে ভেঙ্গে-চুরে দেখতে চান। নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে যাচাই করে নিতে চান। ‘ছোটোগল্প:নূতনরীতি’–এরমাধ্যমে বিমল করও হয়ত সেই experiment-ই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বুঝতে হবে তাঁর এই প্রয়াস শুধু নিজেকে যাচাই করবার জন্য নয়, বরং শতবর্ষ অতিক্রান্ত সমগ্র বাংলা ছোটোগল্পের জগতকেই তিনি পরীক্ষাগারে ঊল্টে-পাল্টে দেখতে চেয়েছিলেন। সেই হিসেবে একে বলতেইহয়-এ যেন বাংলা ছোটোগল্পের এক অনন্য অবিনির্মাণ (deconstruction)। ফার্দিনান্দ দ্য স্যসুর বলেছিলেন- ‘deconstruction is also a construction’। সে দিক থেকে ছোটোগল্পের নতুন রীতিও বাংলা ছোটো গল্পের জগতে একটি নতুনconstruction নয় কি ?

 ছোটোগল্প একজন মননপ্রধান লেখকের আত্মপ্রকাশের তীব্রতম বাহন –এ সত্য বিমল করের গল্পে প্রতিষ্ঠিত। গল্পপত্র পত্রিকা পরিচালনায় বা তরুণ গল্পকারদের গল্প সংকলনে বিমল করের যে সচেতন শিল্পবোধ ও অতৃপ্ত জীবন জিজ্ঞাসার পরিচয় পাওয়া যায়, আমরা বলতে পারি তাঁর গল্পগুলি তারই জীবন্ত চালচিত্র হয়ে উঠেছে।১ ‘আত্মজা’, ‘উদ্ভিদ’, ‘সোপান’, ‘পিঙ্গলার প্রেম’, ‘জননী’, ‘সুধাময়’, ‘ইঁদুর’ এমনকিআমাদের আলোচ্য ‘গগনের অসুখ’ গল্পটিও এ ধারার উজ্জ্বল সংযোজন। গল্পগুলি যেমন প্রেম, সমাজসত্য, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের এবং মনোজগতের তীব্র বিশ্লেষণে তৎপর তেমনি ভাষা ও আঙ্গিকের নিত্যনতুন ব্যবহারেও অনন্য।

‘গগনের অসুখ’ আখ্যানটি ধারণ করেছিল শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকাঅক্টোবর, ১৯৬২। সময়কালটির দিকে লক্ষ রাখলে বোঝা যাবে তার মাত্র তিন বছর আগেই ১৯৫৮-৫৯ সালে ছোটোগল্পের নতুন রীতির propaganda প্রকাশিত হয়েছিল, যার প্রধান manifesto-ই ছিল-
আমরা আমাদের মনোমত করে গল্প লিখতে চাই, যে লেখা সাধারণত চলতি পত্রিকা গুলির পক্ষে ছাপা সর্বদা সম্ভব নয়।



লক্ষ করবার বিষয় এটাই যে প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকায় ছাপানো অসম্ভবের দোহাই দিয়ে যে গল্প আন্দোলনের সূচনা, ‘গগনের অসুখ’ গল্পটি কিন্তু সেই প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল। কাজেই প্রশ্ন উঠতে পারে নতুন রীতির আন্দোলনের প্রভাব কি তবে ‘গগনের অসুখ’ গল্পে পড়েনি ? আমরা বলতে পারি পড়েছে, কিন্তু তা খানিকটা তির্যকভাবে। আসলে নিজেদের মনোমত করে গল্প লেখবার যে উদ্যম ও সক্রিয়তা নতুন রীতি আন্দোলনের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছিল, ‘গগনের অসুখ’ সেই তল থেকেই উঠে এসেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলতে হয়, এই নতুন রীতির আলোকেআমরা যেভাবে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘দুঃস্বপ্ন’ কিংবা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিজনের রক্তমাংস’ –কে পাঠ করি, ‘গগনের অসুখ’-কে কিন্তু সেই একই সমতলে রেখে পড়তে পারি না। ‘গগনের অসুখ’ গল্পে ‘অসুখ’ কথাটিতে যদি আমরা জোর দেই তাহলে বলতেই পারি এই অসুখ আসলে সমাজে বসবাসকারী অথচ সমাজ বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ মানুষের একান্তই ব্যক্তিগত মানসিক অসুখ। গগনের যে অসুখ তা হয়ত শারীরিক সেই সাথে মানসিকও। লেখক কোনও স্পষ্ট চিহ্নিত অসুখের নাম উচ্চারণ করেন নি। কিন্তু প্রশ্ন উঠতেই পারে কি এমন অসুখ যা গগনকে তার পরিবার থেকে, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় ? লেখক কেনই বা তার নাম উচ্চারণ করেন না ? এখানেই হয়ত external reality–কে ছোটো করেinternal reality–এর ক্ষেত্রটিই বড় হয়ে ওঠে, যেখানে লুকিয়ে আছে ‘ছোটোগল্প: নূতন রীতি’ আন্দোলনের অন্যতম বীজটি।

   গগনের অসুখ গগনকে ভারাক্রান্ত করেছে। তার মধ্যে অভিমান আছে, রাগ আছে। এ রাগ, এ অভিমান তার অভ্যস্থ কুলিশ কঠোর জীবনযাত্রার প্রতি। যে জীবনযাত্রায় শীত, বাতাস, অন্ধকার কিংবা বিষন্নতা আত্মীয়ের মতো তার সাথে সহাবস্থান করে। কিন্তু এর বাইরেও তার মধ্যে আশাবাদী মনোভাবও সুপ্ত আছে। এ আশা নিঃসঙ্গ জীবনকে অতিক্রম করে সমাজ জীবনে প্রবেশ করবার আশা। কিন্তু বাস্তবে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা অতিক্রান্ত হলেও গগনের আর পারিবারিক জীবনে ফিরে আসা হয়না। সে কেবলই ভেবে চলে –
নয়নরা থাকলে...তার গগন এত শূন্য হত না।


আসলে বাহ্যিক ঘটনার ঘনঘটা নয়, লেখকের অন্তর্লীন ভাবের বহিঃপ্রকাশের মধ্য দিয়েও এখানে ছোটোগল্পের চিরাচরিত কাহিনি সর্বস্বতাকে অস্বীকার করবার ক্ষেত্রটি তৈরি হয়েছে। হয়তো কথকের মুখ থেকেই তাই শুনতে পাই –
বাইরে হাত বাড়ান গেলনা বলেই গগন ভেতরে হাত রাখল।


মনের ভেতরের এই রহস্যকেই আলো ফেলে নতুন ভাবে দেখতে সক্ষম হয়েছিল নতুন রীতির লেখকেরা।

 ১৯৯০ সালে দেশ পত্রিকার একটি সাক্ষাৎকারে বিমল কর বলেছিলেন –
শুধু গল্পের জন্য গল্প তো আমি লিখতে চাইনা। যদি তেমন কোনও কথা আমার নতুনভাবে না জোটে, অকারণ মামুলী গল্প লিখে কী লাভ ?


‘গগনের অসুখ’ কিন্তু মামুলী কোনও গল্প নয়। শুধু গল্পের জন্য গল্প লিখবার প্রয়াসেও এটি লেখা হয়নি। এখানেও অনেক নাবলা কথাকে বলতে চাওয়ার সদিচ্ছা আছে, implied author -এর সাথে implied reader–এর যোগসূত্র স্থাপনের কৌশল আছে। লক্ষ করবার বিষয় এখানে আদি-মধ্য-অন্ত্য সমন্বিত কোনও কাহিনি নেই, ‘মধুরেণ সমাপায়েৎ’-এর মধ্য দিয়ে যার পরিণতি ঘটছে। বরং গল্পের শেষে এক রাশ প্রশ্ন আর অনিশ্চয়তা পাঠককে গ্রাস করেছে। এই গল্পটি শেষ অবধি  প্রতিবেদনধর্মী কোনও রচনা হয়ে থাকেনি। বরং থিসিস-অ্যান্টিথিসিসকে অতিক্রম করে এর প্লট সিন্থেসিসের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।

গল্পটিতে যেহেতু সরাসরি কোনও কাহিনি নেই, কাজেই এর মধ্যে কাহিনি এবং না-কাহিনির একটাbinary opposition আছে। গগন এবং তার মামার কথপোকথনের মধ্য দিয়েই পাঠককে বাহ্যিক গল্পের বুনটটি তৈরি করে নিতে হয়। এখানেই তৈরি হয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রকৃত ক্ষেত্রটি। গগনের মধ্যে এক প্রকার stream of consciousness আছে, পাশাপাশি উক্তি-প্রতুক্তির মধ্য দিয়ে একটি সমান্তরাল গতিমুখও এখানে তৈরি হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে ধূর্জটি প্রসাদ, সতীনাথ ভাদুড়ী কিংবা গোপাল হালদার প্রমুখেরা আমাদের চৈতন্যপ্রবাহ রীতি উপহার দিয়েছেন ঠিকই, বিমল কর ছোটোগল্পের জগতে সেই রীতিকেই কিছুটা তির্যক উপস্থাপন করবার চেষ্টা করলেন। ‘গগনের অসুখ’ তাই কেবল গগনের চৈতন্যপ্রবাহতেই নয়, পাশাপাশি পার্শ্বচরিত্রের সক্রিয়তাতেও অগ্রগতি লাভ করেছে। এখানেই চরিত্র নির্মাণের pattern-টিও নতুনত্ব লাভ করেছে। গল্পে কোনও ফরওয়ার্ডব্যাক নেই কিন্তু ফ্ল্যাশব্যাক আছে। একাধিক চিঠির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে লেখক বর্তমান থেকে অতীতে, আবার অতীত থেকে বর্তমানেযাত্রা করেছেন। পাশাপাশি রয়েছে আলো-অন্ধকারের বিচিত্র চিত্রকল্প, নিশ্চিত মৃত্যুর হাতছানি। একদিকে অমোঘ মৃত্যু অন্যদিকে গভীর জীবনবোধের এই দ্বন্দ্বকে কোনও নির্দিষ্ট তত্ত্ব ও দর্শন দ্বারা ব্যাখ্যাকরা সম্ভব নয়। অন্যদিকে ‘অথরসপোরশন’- এর ভাষা কোথাও অমসৃণ, কোথাও তীক্ষ্ণ বলে মনে হলেও বাক্য গঠনে কিংবা শব্দচয়নে যে কোনও মোলায়েম ভাব নেই -একথা বলা চলেনা।প্রত্যক্ষতা- স্পষ্টতার পাশে জীবনের অনিশ্চয়তা ও অনির্দেশ্যতা বোধক দিকটিকেও লেখক বিভিন্ন শব্দে হাজির করেছেন–
অন্ধকারে গগন চোখের পাতা খুলল। বাইরে অন্ধকার নেমেছে। কাঁঠাল গাছের মতন বেশ ঘন বুনন্ত অন্ধকার। বাতাস আসছিল, অগ্রহায়নের ঠাণ্ডা বাতাস। মিহি কুয়াশার মতন ধোঁয়ার রেখা দেখা যাচ্ছে অদূরে। গগনের শীত করছিল। কাছাকাছি একটা দেবালয় আছে, ঘণ্টা বাজছিল। গগন আকাশে কয়েকটি তারা দেখতে দেখতে দেবালয়ের ঘণ্টা শুনল। প্রতিটি ঘণ্টা এমন করে বাজে যেন পায়ে পায়ে শব্দটা ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে। গগন ভাবল, তার মনে হল, সে বোধহয় প্রত্যহ দূর থেকে দূরান্তে সরে যাচ্ছে।


ছোটোগল্পের ‘ছোটো’ হওয়া নিয়ে যে বিতর্ক আছে, অর্থাৎছোটোগল্পকে ছোটো এবং গল্প হতে হবে, যার প্রধান শর্তই হল- যাকে এক দফায় পড়ে ফেলতে হবে, ইংরেজিতে যাকে বলে  ‘ইন ওয়ান সীটিং’..

৭,’গগনের অসুখ’-কে কেন্দ্র করে এ জাতীয় কোনও প্রশ্ন ওঠা সম্ভব নয়। কারণ readership–এর দায়িত্ব যদি অটুট থাকে তবে গল্পটিকে নিঃসন্দেহে এক দফায় পড়ে ফেলা সম্ভব। এজন্যলেখককে suspense, surprise কিংবা stunt তৈরির কোনও কৃত্রিম ছলনার বশবর্তীও হতে হয়নি। গীতি কবিতার মতই গল্পটি স্বতঃস্ফুর্ত অন্তর্লীন ভাবনার দ্যোতক হয়ে উঠেছে।

কনজিউমারিজমের যুগে ‘cultural industry’ নামক প্রতিষ্ঠানটি সাহিত্যকেও পণ্যে রূপান্তরিত করেছে। আর পাঁচটি বিজ্ঞাপিত পণ্যের মত সাহিত্যও আজ ‘মাল’ হয়ে উঠেছে। প্রতিষ্ঠানের ‘পা চাটা’ ফরমায়েশি লেখকদের সৃষ্টি তেমন শিল্প-উৎকর্ষহয়ে উঠতে পারছেনা। বিমল কর তাঁর ‘ছোটোগল্প নূতন রীতি’-র মাধ্যমে যেন এর বিরুদ্ধেই গর্জে উঠেছিলেন। এ প্রতিবাদ আসলে  কনজিউমারিজমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, তথাকথিত ‘মাল আমদানি’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ‘সমাজ’কে যদি একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ধরা যায়, ‘পরিবার’-কে যদি বলা হয় সেই সমাজের ক্ষুদ্রতম একক তবে আমরা লক্ষ করব গগনের অবস্থান সেই পরিবার তথা সমাজের বাইরে। অর্থাৎ ‘পরিবার’ নামক প্রতিষ্ঠানের বাইরে গিয়ে সে ক্রমশindividuality–এর দিকে যাত্রা করেছে। কথকের মুখেই তাই শুনতে পাই –
গগন ভাবল, তার মনে হল, সে বোধ হয় প্রত্যহ দূর থেকে দূরান্তে সরে যাচ্ছে।


পাশ্চাত্য শিল্প-সাহিত্যের ধ্যান-ধারণাগুলির যে দ্রুত পরিবর্তনঘটছিল কাফকা তাকে এভাবে ধরতে চেয়েছিলেন –
বালজাক একটা ছড়ি নিয়ে ঘুরতেন। সেই ছড়ির গায়ে খোদাই করা ছিল একটি বাক্য। সেটি হল- আমি প্রতিটি বাধাই চূর্ণ-বিচূর্ণ করি। আমারও একটি প্রবাদবাক্য আছে। তা হল- প্রতিটি বাধাই আমাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে।


  রাবীন্দ্রিক গল্প কাঠামোয় লেখকের অবস্থান ছিল সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের(omnipotent) মতই। অন্যান্য লেখকেরা সেই ধারাটিকে অগ্রগতি দান করেন। বালজাকের মতই তাঁরা চরিত্রদের আভ্যন্তরীণ সকল বাধাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করতেন। চরিত্রদের জন্ম-মৃত্যু, এমনকি চরিত্রদের চাল-চলনের একটি সামগ্রিক sketch লেখকেরা নিজেদের মত করেই তৈরি করতেন। পরবর্তীকালে ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ব, মার্কসীয় দর্শন, পাশ্চাত্য নানা ইজম-এর ব্যবহার বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রটিকে তথ্যে ও তত্ত্বে, দার্শনিক মতাদর্শে পূর্ণ করে তুলেছিল। ধীরে ধীরে গল্প হয়ে উঠল অন্তর্মুখী। বিমল কর, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়েরা হয়ে উঠলেন কাফকার মতই, বাহ্যিক বাধা-বিপত্তি যাদের চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে লাগল। বাইরে থেকে মুখ ফিরিয়ে তাঁরা তখন ভেতরের কথা বলতে চাইলেন নতুনভাবে, নতুন দৃষ্টিতে, নতুন রীতিতে। আর তাতে পাঠকও হয়ে উঠল তাঁদের সহযাত্রী। বিমল করকে তাই বলতে শুনি –
গল্প যতকাল নিছক গল্প ছিল ততকাল পাঠক ছিল শ্রোতা। গল্প যখন থেকে কাব্যের ঐশ্চর্য গ্রহণ করল, তখন থেকে পাঠক আর শ্রোতা থাকল না, লেখকের অভিজ্ঞতার সে সাথী হল, অর্থাৎ কৌতূহল মিটিয়ে সে তৃপ্তি পেল না, অন্যের অনুভূতি সবিস্তারে অনুভব করতে পারল। নিজের অভিজ্ঞতার অনুভূতির মতন....
১০
‘গগনের অসুখ’ পাঠ করে আমরা পাঠকেরাও লেখকের অনুভূতির সাথে নিজেদের অনুভূতিগুলির সংযোগ সাধন করতে পারি। আমরাও হয়ে উঠতে পারি লেখকের অভিজ্ঞতার সাথী।  গগনের মত আমরাও ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে থাকি। to be-not to be-এর দ্বন্দ্ব আমাদের মধ্যেও তখন প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। গগনের মত আমরা পাঠকেরাও তখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাসকারী কোনও নিঃসঙ্গ প্রাণী হয়ে যাই।


‘ছোটোগল্প: নূতনরীতি’ মোটেও স্বাস্থ্যবান ছিল না, এ কথা ঠিক। কিন্তুযত্নবান হাতের স্পর্শ তাতে ছিল তা আমরা লক্ষ করেছি। গগন কোনও স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ নয়। সে রোগভারে জীর্ণ, ব্যাধিগ্রস্ত, সমাজ বিচ্ছিন্ন যুবক। কিন্তু গগন চরিত্র সৃষ্টিতে লেখক যে যত্নবান ছিলেন তা আমরা বলতেই পারি। গল্পে নিজের কথা নিজের মনোমত করে বলবার যে অবকাশ ‘ছোটোগল্প: নূতনরীতি’ দিয়েছিল ‘গগনের অসুখ’ গল্পেও সেই রীতি অনুসৃত হয়েছে। স্টোরি-অ্যান্টিস্টোরির দ্বন্দ্বের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে ‘গগনের অসুখ’ গল্পটিও হয়ে উঠেছে গল্প ভাঙার গল্প, internal reality-এর গল্প। সেই সাথে ‘ছোটোগল্প: নূতনরীতি’  আন্দোলনের অন্যতম ধারক ও বাহক।
               


তথ্যসূত্র ও উৎস নির্দেশ :


১. অরুন মুখোপাধ্যায়, কালের পুত্তলিকা, বাংলা ছোটগল্পের এক শ বছর: ১৮৯১-১৯৯০, দেজ পাবলিশিং, পৃ. ৩৯৫-৩৯৬
২.সন্দীপ দত্ত, বাংলা কবিতা আন্দোলনের তিন দশক, পৃ. ৩৯৬
৩.বিমল কর, বিমল করের শ্রেষ্ঠ গল্প, পৃ. ২৭৫
৪. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭৪
৫. ‘...আমার পরিশ্রমটা অনেকটা মজুরের মতন’, বিমল করের সাক্ষাৎকার, প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায়, দেশ, ৩ নভেম্বর ১৯৯০, পৃ. ৩৩
৬.বিমল কর, বিমল করের শ্রেষ্ঠ গল্প, পৃ. ২৭৩
৭.সন্দীপ দত্ত, বাংলা কবিতা আন্দোলনের তিন দশক, পৃ. ৩০
৮.বিমল কর, বিমল করের শ্রেষ্ঠ গল্প, পৃ. ২৭৩
৯.শেখর বসু, শাস্ত্র বিরোধী গল্প সম্পর্কে কয়েকটি কথা, পৃ. ২১
১০.সন্দীপ দত্ত, বাংলা কবিতা আন্দোলনের তিন দশক, পৃ. ৩১

                                                           






প্রবন্ধ : দেবায়ন চৌধুরী







 স্বপ্নময়ের অণুগল্প

             
আমরা যারা অণুগল্প পড়তে ভালোবাসি, অল্পস্বল্প ভাববার চেষ্টা করি সাহিত্যের সংরূপ নিয়ে; তাঁদের কাছে অবশ্যই প্রিয় হয়ে ওঠেন গল্পকথক স্বপ্নময় চক্রবর্তী। সাম্প্রতিক সময়ে অণুগল্প নিয়ে যে নতুনভাবে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে, এর মূলে তাঁর অবদান কম নয়। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘অণুগল্প সংগ্রহ’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল অভিযান পাবলিশার্স থেকে, ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। শতাধিক গল্পের এই সংকলনের সূত্র ধরেই আমরা পাঠক হিসেবে চিনে নিতে চাইব অনন্য অণুগল্পকারকে। ‘সোনাকথা রুপোকথা’, ‘এই আমি, এই তুমি’, ‘সম্পর্কের এমব্রোডারি’, ‘সময়ের ছেটানো ছবি’—এই চারটি ভাগে  অণুগল্পগুলিকে ভাগ করা হয়েছে। সময় ও সম্পর্ক যেকোনো সাহিত্যিকেরই লেখার প্রধান অবলম্বন। আর, মিথের পুনর্নিমাণের প্রচেষ্টা স্বপ্নময়ের গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। চলুন এবার একটি অণুগল্প পড়ি—

“ রাজারহাটে সাড়ে তিন কাটার প্লট পেয়েছিলাম। বাড়ি করব বলে ভিত খোঁড়া হচ্ছিল, একটি কৌটো বের হল মাটির তলা থেকে। সিঁদুর কৌটো। একটা আয়না। হাড়ের চিরুনি। পুঁতির মালাও পেয়েছিলাম।

        বাড়ি হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে সন্ধের সময় একটা বউ-এর কান্না শুনি। যার একটা সংসার ছিল। যে ঘরছাড়া হয়েছিল।” (পৃঃ ২২) গল্পটির নাম ‘ঘর সংসার’। যার বিবেকবোধ সক্রিয়, সেই বুঝি হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! মাটি খুঁড়ে যে বস্তুগুলো পেয়ে যান লেখক, সেগুলি আমাদের অন্য এক জীবনের গল্প বলতে চায়। উপনগরীর জন্য গ্রামের মানুষের উচ্ছেদ হবার বিষয়টি আমরা তো মেনেই নিয়েছি একভাবে। উন্নয়নের হিড়িকে উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে আমাদের বেশিরভাগ মানুষেরই মাথাব্যথা নেই। কিন্তু এই গল্পে যখন দেখি সন্ধের সময় এক বউ-এর কান্নার স্বর শুনছেন কথক, মনের কোণে কি উঁকি দেয় না দুঃখবোধ? ‘যার একটা সংসার ছিল। যে ঘরছাড়া হয়েছিল।’ দীর্ঘশ্বাসের ডালপালা বেঁধে ফেলে দুটি সময়, দুটি ঘর, দুটি মানুষকে। চোখের জল আড়ালে চলে যায়। বহুতলের ভিতের নিচে এমনই কত ঘরহারাদের আয়না। ‘সোনাকথা রুপোকথা’ অংশের ‘ভুল কোকিল’ গল্পে দেখি লেখক থিম ট্যুরিজম নিয়ে কথা বলছেন। একটি রিসোর্ট যেখানে কৃত্রিমভাবে থিম তৈরি করা হয়। একদিন দুপুরবেলায় সেখানে কোকিল ডাকছে খুব। কম্পিউটার ইনচার্জ বুঝতে পারছেন না গণ্ডগোলটা ঠিক কোথায়। কম্পিউটার বন্ধ করে দেবার পরেও ডেকে উঠল কোকিল। ‘কী সর্বনাশ!’ গল্পের শেষ লাইনটি এরকম— “বাগানে একটা সত্যিকারের কোকিল ঢুকে গেছে।” (পৃঃ ১৬) যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়ে ওঠে যেন প্রকৃতি। কোকিলের ঢুকে পড়া যে কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ বুঝতে পারেনি, তার নাম মধুবন্তী। নকল দেখে দেখে আমরা আসল চিনতেই যে ভুলে গেছি আমরা। প্রযুক্তির উন্নতি, মানুষের কৃত্রিম জীবন নিয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘ভেলা’ গল্পটির কথা এই কাহিনির সূত্রে মনে পড়ে যায়। ‘আমাদের রবীন্দ্রনাথ’ আখ্যানে দেখি রবীন্দ্রনাথের শেষযাত্রার পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। তাঁর শবযাত্রায় রয়েছে মন্ত্রীবর্গ। সব রাজনৈতিক দল। “সি.পি.এম., কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেপি, এমনকি মাওবাদীরাও। সবাই বলছে রবীন্দ্রনাথ আমাদের।” শবদেহ নামানোর পর দেখা গেল একজন অতিমান্য রবীন্দ্রভক্ত রাজনৈতিক নেতা ‘রবীন্দ্রনাথকে প্রণাম করে তাঁর মুখমণ্ডলের একটি মাত্র শ্বেতশুভ্র শ্মশ্রু ছিন্ন করে পকেটে ঢোকালেন।’ ক্রমে ক্রমে বিধায়ক থেকে আবৃত্তিকার, অধ্যাপক থেকে গায়ক সকলেই ‘রবীন্দ্রনাথকে খুবলে নিতে লাগলেন।’ শেষে দেখা গেল শবাধারে কিছু ফুল কেবল পড়ে রয়েছে। মারাত্মক! এখানেই শেষ নয়। সৃষ্টিকর্তা নেমে এলেন। হাতে মাইক নিয়ে বললেন, রবীন্দ্রনাথকে ফিরে পেতে চাইলে টুকরোগুলি ফিরিয়ে দিতে হবে তাঁর কাছে—তিনি জোড়া দিয়ে প্রাণসঞ্চার করবেন। অনধিক দুশো শব্দের এই গল্পটির শেষ হচ্ছে এইভাবে—“ মাইকের ব্যাটারি শেষ হয়ে গেল। কেউ কিছুই ফিরিয়ে দিল না।” (পৃঃ ২১) গল্পটির বাস্তবতা নিয়ে আদৌ কোন সন্দেহ প্রকাশ করা চলে কি? রবীন্দ্রনাথ আমাদের বলে তাঁকে টুকরো টুকরো করে খুবলে নেবার চেষ্টা আমরা তো করে চলেছি প্রতিনিয়তই। পূজা নিবেদনের ফুল সেখানে কোনো অর্থ রাখে আমাদের কাছে? বিশ্বকবির শেষযাত্রার মর্মান্তিক পরিণতিকে ভিত্তি করে গল্পকার আসলে আমাদের রবীন্দ্রভাবনাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইলেন। সৃষ্টিকর্তার অসহায়তার সূত্রে সভ্যতার সংকটের অন্য ভাষ্য তৈরি হয় যেন। রবীন্দ্রনাথের প্রাণ ফিরে না পাবার কথা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে এই গল্পটি ফুটিয়ে তোলে আমাদের অন্তঃসারশূন্যতাকেই।



‘এই আমি, এই তুমি’ শিরোনামের অন্তর্গত গল্পগুলি ছুঁয়ে থাকে বিভিন্ন বিষয়কে। ব্যক্তিগত পরিসরের সূত্রে উঠে আসে সমাজ সময়ের জরুরি কিছু প্রসঙ্গ। ‘কথা’ গল্পে দেখি রেলের কামরায় জানলার পাশে মুখোমুখি বসে এক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা বই পড়েন। কোনোদিন তাদের কথা বলতে দেখেনি কথক। ভদ্রমহিলা হৃদয়পুর স্টেশনে নেমে যাবার আগে রোজ বলেন- “ ... আসি। আবার কাল কথা হবে কেমন?

             ভদ্রলোক বই থেকে চোখ তুলে বলেন হ্যাঁ, আবার কাল কথা হবে।” (পৃঃ ২৯)

কথার ধারণাকেই পাল্টে দেন লেখক। আবিষ্কার করতে থাকেন আমাদের এই প্রতিদিনের জীবনে ছড়িয়ে থাকা সংযোগের ভাষাকে। খালি চোখে যা ধরা পড়ে না। গভীর, গোপন, রহস্যময়। কবিতার মতো। কবিতার সঙ্গে অণুগল্পের মানসিক নৈকট্য খুব বেশি করা পড়ে স্বপ্নময়ের লেখায়। ‘দেখা’ গল্পে দেখি ক্যানসার আক্রান্ত অতুলবাবু তাঁর রিডারের কাছে শুনতে চাইছেন জীবনানন্দের কবিতা—যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে...। শ্যামলী পড়ল কবিতাটি। অতুলবাবু চোখে দেখতে পারেননা জেনেছি আমরা গল্পের প্রথমেই। গল্পের শেষে যখন অতুলবাবু বলেন- “ তোমার চোখে জল শ্যামলী, আমি যে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি” (পৃঃ ৩০); দেখার অন্য অর্থ তৈরি হয়ে ওঠে। চোখের দেখাকে ছাপিয়ে যায় মনের দৃষ্টি। স্বপ্নময়ের গল্পে অন্যান্য সাহিত্যিকদের লেখার উল্লেখ আখ্যানের আত্মার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকে। ‘আবার দেখা’, ‘অন্তর্গর্ভ’, ‘রেখে আসা’ গল্পগুলি অণুর মধ্যেই ফুটিয়ে তোলে বৃহতের ব্যঞ্জনা। গল্প শেষ হয়। কিন্তু ফুরোয় না...



যেকোনো লেখাই আদতে রাজনৈতিক। তবু কোনো কোনো লেখায় রাজনৈতিক অভিঘাত বেশি তীব্র হয়ে ওঠে। যেমন ‘পতাকা’ গল্পটি—

“ কারখানা বহুদিন বন্ধ। রসময় তেলেভাজা ভাজে। পার্টি অফিসে মাঝেমাঝে ওর তেলেভাজা যেত, এখন যায় না। ভি আর এস নিয়ে একজন বাবু কমরেড বড়ো তেলেভাজার দোকান করেছে। শো-কেস, কাগজের বাক্স, ভালো কারিগর। ওই দোকান থেকেই এখন তেলেভাজা যায়।

        রসময়ের মেয়ে বাড়ি থেকে আলুর চপের লেচি নিয়ে আসে। আজ লাল পতাকাটা দিয়ে ঢেকে আলুর চপের থালা নিয়ে এল।

        রসময় ভীষণ জোরে থাপ্পড় মারল মেয়েকে। ছিঃ, এ কী? লাল পতাকায় ঢেকে আলুর চপের লেচি আনলি?

        মেয়েটি কাঁদে। বলে কী করব? ঘরের কোনায় ন্যাকড়া হয়ে পড়ে ছিল এতদিন...

        চোখ মোছে। ওই পতাকা দিয়েই। ” (পৃঃ ৩৬)

গল্পটি পড়বার পর স্তব্ধতা গ্রাস করে পাঠককে। লাল পতাকার গল্পে কীভাবে জড়িয়ে যায় দিনবদলের ছবি। বন্ধ কারখানার শ্রমিকের পেশা পাল্টে গেছে। এদিকে পার্টির পছন্দ বদলেছে, মনোযোগও নয়কি? রসময়ের মেয়ে লাল পতাকা দিয়ে ঢেকে আনে আলুর চপের থালা। পতাকার ব্যবহারিক প্রয়োগ ও কাণ্ডজ্ঞানের দর্শন নিয়ে ভাবনার মধ্যেই চমক লাগে। বাবা তার মেয়েকে মারছে লাল পতাকার অবমাননার জন্যে। মেয়েটি কী করবে সে দেখেছে পতাকাটি ‘ঘরের কোণে ন্যাকড়া হয়ে পড়ে ছিল এতদিন...’ । পতাকা দিয়ে মেয়েটির চোখের জল মোছার ছবিতে গল্পটি ছুঁয়ে ফেলে শিল্পের সর্বোচ্চ স্তরকে। পরতের পর পরত খুলতে খুলতে যায় গল্পটি। পতাকা মানে যে চোখের জলের সম্বল, নানা দুঃখের মধ্যেও জাপ্টে থাকা জীবনবোধ—কতজন অনুভব করি আমরা? যে শ্রমিক কারখানার কাজ হারালো, তার ঘরের কোণে পতাকাকে ন্যাকড়ার মর্যাদা থেকে মুক্ত করবার দায় কি পার্টির ছিল না? নাকি কমরেডের পার্টি বাবুতে ভরে গেছে? তেলেভাজার সূত্রে পরিবর্তিত পরিস্থিতির নিখুঁত চিত্রায়ন কতটা অব্যর্থ, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘ইতিহাস’ গল্পে দেখি একদা বাম রাজনীতি করা এক কাঠকলের মালিককে, যিনি মেয়ের বিয়ের জন্য আসবাব বানাবেন। তাঁর অফিস ঘরে লেনিনের ছবি। শাসক দলের নেতাদের সঙ্গেও তিনি ঘনিষ্ঠ। যাহোক, ভিয়েতনামের সেগুন চেরাই হচ্ছে—“ হঠাৎ তীব্র শব্দ। অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। বিদ্যুৎ চালিত করাত বেঁকে গেল।



আসলে কাঠের গভীরে ছিল কয়েকটা বুলেট। গোপনে। যুদ্ধের।” (পৃঃ ৩৭) লেখকের অন্তর্ঘাতী প্রতিবেদন স্পষ্ট। এক নিমেষে মনে পড়ে যায় ভিয়েতনামের যুদ্ধের কথা। ‘উন্নয়ন’ গল্পে দেখি উন্নয়নের স্বার্থে শহিদ বেদী ভাঙা হচ্ছে। সায় দিচ্ছে কথক চরিত্র। যার কাকা ছিলেন উদ্‌বাস্তু আন্দোলনের কিশোর শহিদ। ‘পাথরের লেখা এখন ঝাপসা’- আমাদের স্মৃতিও। পূর্বপুরুষের জবরদখল করা প্লটে দলিল পাবার পর উঠছে নতুন ফ্ল্যাট। উদ্বাস্তু কলোনীতে আবার ভিটেহারা ইতিহাস। স্বপ্নময়ের কথাভুবনে বারবার পাই দেশভাগ পরবর্তী সময়ে উদ্বাস্তু মানুষের জীবনের কাহিনি। লেখকের অণুগল্পগুলির ‘আমি’-কে তাঁর জীবনের সূত্রে মিলিয়ে পড়া যেতে পারে হয়তো। কিংবা এই আমি আসলে এই সময়ের প্রতিনিধি বিশেষ।  লেখক- পাঠকের সংযোগে আত্মকথনরীতি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য বলেই ধারণা আমাদের। ‘উন্নয়ন’ গল্পের প্রোমোটার হারান জ্যাঠার ছোটোছেলের বাঁ হাতে চণ্ডীর সুতো, আর ডান হাতে সিগারেটকে কীভাবে পড়ব আমরা? সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কোন সূত্রে? শহিদের রক্ত ব্যর্থ হবে না বলে আমাদের চিৎকারের তবে কোনো মূল্যই কি নেই? বাঙালি সত্যি আত্মঘাতী জাতি। ‘শিশুশিক্ষা’ গল্পে দেখি মা ছেলেকে ইংরেজি শেখাতে চেষ্টা করছেন। স্কুলের আন্টির ইংরেজি উচ্চারণ অবশ্য আলাদা। সাংস্কৃতিক পার্থক্যের বিষয়টি সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেন লেখক। গল্পের শেষে দেখা যায়, মন্দিরের সামনে মা ছেলেকে নমো করতে বলছে—“ছেলে বলে, এলিফ্যান্ট গড।

মা বলে—ছিঃ, ইনি গণেশ ঠাকুর।” (৯৬) উপনিবেশের প্রভাব থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি আজও। নয়া- উপনিবেশবাদ জাঁকিয়ে বসেছে আমাদের মনে। তিন বছরেরও কম বয়সি শিশুর ইংরেজি শিক্ষা কতটা সিদ্ধিলাভ কতটা করবে, তা সময় বলতে পারবে। এটুকুই বলার, স্বপ্নময়ের গল্প বাঙালি সংস্কৃতির পরিবর্তনকে প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন করে। ‘সাক্ষরতা’ গল্পে দেখি তিনমাস সাক্ষরতার ক্লাস করার পর নয়নতারা স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ মুখস্থ করেছে—“ কিন্তু কোন্‌টা ক কোন্‌টা খ বুঝতে পারে না।” সনাক্তকরণের সমস্যাকে কীভাবে দেখব আমরা? সাক্ষরতা মিশন আদৌ কতটা সার্থক? মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কথা উঠে আসে একাধিক গল্পে। একটি হোমে মূক ও বধির কিশোরীর ধর্ষণ নিয়ে লেখা হয়েছে ‘প্রতিবাদ’ গল্পটি। ‘বহুরূপী’ গল্পে পাই চরিত্রের মুখে অমোঘ উচ্চারণ—“ ... মানুষ সাজাটাই সবচেয়ে কঠিন।” (পৃঃ ৭০)



‘সম্পর্কের এমব্রোডারি’ কাব্যিক শব্দবন্ধটি থেকেই আঁচ করা যেতে পারে বিষয়ভাবনা সম্বন্ধে। ‘প্রথম অক্ষর’, ‘শেষ অক্ষর’, ‘সবুজ সোয়েটার’, ‘হলুদ শাড়ি’ গল্পগুলি জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়। বস্তুগুলির অনুষঙ্গে জড়ো হয় সম্পর্কের গন্ধ।  ‘মা’ গল্পটি গড়ে উঠেছে সারোগেট মাদার যূথিকার বেদনার অভিব্যক্তিতে। ‘ঘুঁটে’ গল্পে পাই টিফিন বাক্সে একজন লোক ঘুঁটে নিয়ে যাচ্ছে। শেয়ালদা স্টেশনে পুলিশের প্রশ্নে সে জানায়-- “এখন বসিরহাট থেকে এলাম কিনা। আমি তো কাজ করি মেটেবুরুজ। দেশে গেলাম অনেকদিন পর। মা মরেছিল ছোটোবেলায়। নানির কাছে বড়ো হলাম। দেখতে গিয়েছিলাম। এখনও ঘুঁটে দিতে পারে। একটা নিয়ে যাচ্ছি। হাতের ছাপটা লেগে রয়েছে... ” (পৃঃ ১১৪)। সঞ্চরণের তত্ত্ব, জীবন- জীবিকা সব ছাপিয়ে হাতের ছাপের সংরক্ষণ আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়। কেউ ভালোবাসে না বলে যে লোকটা মরবে ভেবেছিল স্বপ্নময়ের গল্পে সেই মানুষই নতুনভাবে বেঁচে ওঠে। রসগোল্লার ভাঁড় দেখে জিজ্ঞেস করে ওতে কিছু আছে কিনা! সামান্য অসামান্য হয়ে ওঠে লেখকের প্রসাদগুণে। অণুগল্প খুব কম সময়ে পাঠকের সঙ্গে যেভাবে সংযোগস্থাপন করতে চায়, তার সার্থক দৃষ্টান্ত হতে পারে আলোচ্য লেখকের আখ্যানমালা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের সংরূপের প্রচলিত আদর্শ যে বদলে বদলে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের ব্যস্ত জীবন অল্প কথায় গল্প শুনতে চায়। চটজলদি পাঠযোগ্য হলেও যার প্রভাব থেকে যাবে অনেকক্ষণ। স্বপ্নময়ের সার্থকতা এখানেই তিনি অণুগল্পের সংরূপে যোগ করেছেন নিজের ব্যক্তিত্ব। বাংলা সাহিত্যে অণুগল্পের ইতিহাসে তিনি বুড়ো আঙুলের ছাপ মুদ্রিত করেছেন বলাই বাহুল্য।



এবারে ‘সময়ের ছেটানো ছবি’ অংশের ‘ভিটে’ গল্পটি সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করছি-

“ হাইওয়েটা দারুণ। ছয় লেন-এর। কিন্তু গাড়িটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। ড্রাইভার গিয়েছে মেকানিক ডাকতে। একা বসে আছি। হাওয়া নেই।

          হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়াল একটা লোক। দু-দিগন্তে দু-হাত।

          বলল, এইখানে ছিল আমার গ্রাম।” (পৃঃ ১৫২) স্থানাঙ্ক নির্ণয়! আমাদের আলোচনার প্রথমেই আমরা তথাকথিত উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। বিজ্ঞাপন শোভিত হাইওয়ে কেবল স্বপ্নের নয়, বরং স্বপ্নভঙ্গের—চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন লেখক। গল্পের আয়তনটুকু মনে রাখার মতো। ‘লক্ষ্মী’ গল্পে দেখি পৌষলক্ষ্মীর পুজোর প্রসাদ খাবার পর বড়ো কর্তা কাঁদছেন।  সামনের বছর এ জমিতে কারখানা হবে। ‘চাষি’ গল্পে দেখি  এক চাষি সর্বাঙ্গে পঙ্ক- চন্দন  মাখছে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে। বলছে—“ শেষ বারের মতো চাষ করে নিলাম গো।” (পৃঃ ১৪৫) কৃষি ও শিল্প নিয়ে বিতর্কের কথা মনে পড়বে পাঠকের। রাজনৈতিক হত্যা, দলবদল উঠে আসে গল্পে। সাম্প্রতিক বিষয়কে আখ্যানে আত্মস্থ করে তাকে চিরন্তন মর্যাদায় উন্নীত করেন লেখক। ‘জঙ্গলমহলের বাপগুলান’ গল্পে পাই এক পুরোহিত ঘরে বৃদ্ধ পিতার মৃতদেহ রেখে অন্যের অপঘাতে মৃত্যুর শ্রাদ্ধ করে আসে—“ ঘরের ভিতরে পচা গন্ধের মধ্যে পিতা জনার্দন তাঁর বি.এ. পাশ করে বসে থাকা সন্তানকে বলে—কম্পিউটার শিখবি বলেছিলি মেয়ে, এই নে টাকা।

     এবার কেঁদে ওঠে বাপ ও মেয়ে।” (পৃঃ ১৬৯) জঙ্গলমহলে মাওবাদী ও যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে সাধারণ মানুষের করুণ অবস্থা ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পকার। ‘চলো পালটাই’,  ‘হাওয়া’ গল্পগুলি পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদল সার্থকভাবে ফুটিয়ে তোলে।  আমাদের চারপাশের বাস্তবতা যখন উঠে আসে আখ্যানের বাস্তবতায়, আমরা চমকিত হই। এমনই একটি গল্প— ‘ঝন্টুদা ভালো আছ?’

“হাসপাতাল তছনছ হচ্ছে।... ভেঙে দে কাচ।... খুলে দে অক্সিজেন। ইশ মাইরি ঝন্টুদা, কী হল! ঝন্টুদার গলায় কাচ ফুটে গেছে। ঝন্টুদাই তো নেতা। ঝন্টুদা ওই হাসপাতালের বিছানায়। তিনটে সেলাই। ঝন্টুদার চিকিৎসার কোনো গাফিলতি চলছে না চলবে না। ভালো আছ তো ঝন্টুদা?”



শিল্প হল জীবনের সমালোচনা। সত্য কথা বলা ছাড়া আর কোনো দায় নেই শিল্পীর। আমাদের সুখ-অসুখের বৃত্তান্তকে মানবিক দৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন যিনি আন্তরিক সততায়, তাঁর আখ্যানের পাঠ যে পাঠককেও নতুনভাবে গড়ে তুলতে চায়। এখানেই স্বপ্নময় চক্রবর্তী অনন্য। স্বতন্ত্র তাঁর আখ্যানভুবন। ভাঙা কাচের শিল্পে যেখানে প্রতিফলিত হয় এক আকাশ জীবনবোধ!   



....................................

























সম্পাদকীয়

১৫ বছর।। বইমেলা।। জানুয়ারি।। ২০১৯




১৪ বছর পর 'পারক' অনলাইনে চলে এলো। কোনও পরিকল্পনা ছিল না, হঠাৎই। আসলে এই মাধ্যমটিকে বর্তমান পাঠককুল আর অস্বীকার করতে পারবেন না আমরাও পারলাম না। দুনিয়ার যেকোনও জায়গা থেকেই পাঠক-লেখকের সম্পর্ক এখন খুব সহজ হয়ে গেছে। এই (অনলাইন) মাধ্যমেও অনেকেই খুব ভালো কাজ করছেন। আমরাও সামিল হতে চেয়েছি সেই যজ্ঞে। তবে এটাও অস্বীকার করি না, নতুন কাগজের গন্ধ শুঁকে পাঠকের রসাস্বাদনের মজাটাই আলাদা।

আর তাই পারকের ওয়েব সংস্করণ থেকে বাছাই করা কিছু লেখা হঠাৎ হঠাৎ মুদ্রিত অবস্থায় পাঠকের হাতে পৌঁছে দিতে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করবো, বিগত বছরগুলির মতোই।

অনলাইন সংস্করণের প্রথম সংখ্যাতেই পারকে এযাবৎ কাল অংশ নেওয়া লেখকেরা যেমন আছেন, তেমনি আছেন নতুন, আনকোরা কলমচিও। আমরা পাশে পেয়েছি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত কয়েকজন সাহিত্যিককেও। সেখানকার গল্প লিখিয়েরা কেমন লিখছেন, তার একটা নমুনা পাবো তাঁদের লেখায়।

এই সংখ্যায় সবার নজর একটি বিষয়ে, তা হল সাক্ষাৎকার। পারক, ২০১৮ শারদ সংখ্যাতেই থাকার কথা ছিল তারঁ সাক্ষাৎকার।  তিনি প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক রমানাথ রায়। নানা কারণে তা হয়ে ওঠেনি। আর বৃহত্তর পাঠক সমাজকে রমানাথবাবুর সম্পর্কে বহু অজানা কথা জানাতে এগিয়ে এলেন সাহিত্যিক প্রগতি মাইতি ও গল্পকার রাজেশ ধর। তাঁদের দুজনকে পত্রিকার পক্ষ থেকে সাধুবাদ জানাচ্ছি।

নতুন বছরে সবাই ভালো থাকবেন, ভালো রাখবেন, এই আশা রেখে শেষ করছি।

টিম
পারক
(৩১/১২/২০১৮)

পুস্তক পরিচয় : নবনীতা সান্যাল



'কথা কিংবা কাহিনি'-- বিম্বিত সময় ও অনন্য অলোক দর্শন





আসছে খুব তাড়াতাড়িই.....






গল্প : রাজেশ ধর





আর কতদিন

কতদিন হল! কতবছর! মনে করতে পারে না সিদ্ধেশ্বরী। এইভাবে, একঠাঁয়ে, একটানা। দুচোখের পাতা বুজে আসতে চায়। আর যে কিচ্ছুটি দেখতে ইচ্ছা করে না!  কিন্তু উপায় আছে? আলো চোখের ওপর পড়লে... চোখ বোজা যায়! ভেতরের সাদা আলোটা কিছুতেই নেভায় না। অথচ! রাতের জন্য হালকা তাঁতের শাড়ি পড়িয়ে দেয়। গরমকালে পাখা চলে। আগে ওপর থেকে ঝোলা পাখা ছিল একটা। এখন তার সাথে দু-দুটো দাঁড়ানো লম্বা পাখা। ঘুরতেই থাকে। পেছনের জানালাটা ওরা বন্ধ করে দেয়। ভালই করে। পচা পাঁক, নোংরা জঞ্জাল, ভেসে আসা গরুমরা,কুকুরমরার গন্ধ। দিনের বেলাতেই পেটের নাড়িভুড়ি উঠে আসতে চায়। শীতকালে গায়ের ওপর দিয়ে জড়িয়ে দেয় বেশ দামী শাল। নরমে গরমে বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু ঐ যে দুটো চোখ বোজা যায় না! কাউকে যে আর দেখতে ইচ্ছা করে না! সব মনে হয় পটুয়ার তৈরি মুখোশপরা পুতুল।

মোটের ওপর মাঝারি এই ঘরটা। সেই সেকাল থেকেই। নতুন ঘর আর হল না। তাতে অবশ্য দুঃখ নেই সিদ্ধেশ্বরীর। তিন বোনের বাড়ি কাছাকাছি। ও বড়, মেজ করুণাময়ী আর ছোট ভগবতী। চিরকাল বড়দেরই তো দায়িত্ব ছোটদের দেখেশুনে দাঁড় করাতে হয়। মেজগুলোর বুদ্ধি একটু বেশি হয়। প্রথম থেকেই মেজটার ঠাঁটবাট একটু বেশি। ওর বরের জন্য একেবারে বারোখানা ঘর। আর ওর নিজের জন্য বিরাট ঐ বাড়ি । এখনও কত বড় চৌহদ্দি! লোক-লস্করের ভিড় লেগেই থাকে। কিছু না কিছু তারা এমনিতেই পায়। কিন্তু নাম হয় মেজর! একেবারে পাশেই মেজটা থাকে। ওর ঘরের উচু মাথাটা এখান থেকে দেখা যায়। কিন্তু তার জন্যই ভিড় এদিকে  কম। আগে তো শুধু ভিখারি, কিছু গেঁজেল, পাগল আর দু-একটা খ্যাপা। এরাই আসত। ইদানিং এই কিছু বছর, কেউকেউ আসছে। বোঝে সিদ্ধেশ্বরী। এত চাপ, আয়-রোজগার নেই! কীসব আরো যে হচ্ছে! মেয়েরা সব ছেলেদের মত! সংসার ভাঙছে, ছেলেপুলে উচ্ছন্নে যাচ্ছে! আরো নাকি এদের টাকা দরকার! কত কী যে দরকার! তাই আজকাল তারা আসছে। আর সাথে করে আনছে দুটোপয়সা, গয়নাগাটি। টাকাকড়ি অবশ্য ওর কাছে থাকে না! কিন্তু ছোটখাট গয়নাগুলো ঐ  সিন্দুকটায় থাকে! যারা দিয়েছে তারা মাঝে মাঝে দেখতে চায়। দেখাতে হয়।

আগে; বছরে দুই অমাবস্যা কাত্তিকে আর ভাদ্দরে, কিছু লোক হত। সামনের চত্বরটায় ছোট মেলামত বসত। ধার দিয়ে গোটা কয়েক অশ্বত্থ, শিশু, বুনো কাঠাল, চালতার জঙ্গল সমেত একটা বড়সড় মাঠ ছিল এই চত্বরটা। এখন আর সেটা অদ্ধেকও নেই। বাসরাস্তা আর দখলকরা দোকানপাট গিলে খেয়েছে। ঐটুকু জায়গাতে আজকাল ঐদুদিন মারকাটারি ভিড়। মুখোশে মুখোশে ছয়লাপ। সিদ্ধেশ্বরী আঁতকে ওঠে। ভয় হয় ওর। এত কচি বাচ্চা, বুড়োবুড়ি জুটেছে! যদি হুড়োহুড়ি লাগে! পায়ের তলায় চাপা পরে মরবে না তো!  তার মধ্যেই চেয়ার টেবিল পাতা হয়। কালো প্যান্ট, সাদা জমা পরা ছেলেরা খাওয়ায়। ঘি-ভাত, আলুর রসা, চাটনি। সেইসময়ে কেমন কেমন মনে হয় ওর। ভেতরটা যেন ফুলে ওঠে সিদ্ধেশ্বরীর। মেজটাকে বলতে ইচ্ছে করে –দেখে যা, সবুরে মেওয়া ফলে।  মেজ কিন্তু দেখে না। একবার তাকিয়েও দেখে না। ভগবতীটা ছোটবেলা থেকেই ওর ন্যাওটা। সেই তো সব খবর দেয়।

মেজটা আর ছোটটা পিঠোপিঠি। সেই সময় থেকেই খুনসুটি আর ঝগড়া। মেজটার বাড়ি বাঁদিকে। ছোটটা আছে ডানদিকে ।ঐ দেখা যাচ্ছে শ্মশান। ওর গোড়ায়। এখন কি আর সেই শ্মশান আছে! একটা পদ্মপুকুর ছিল শ্মশানের আগে। তার  মাটির তলায় এখন খাবার জলের সিন্দুক। আর ওপরে কলকারাখানার মত ঘরবাড়ি। কত লোক কাজ করছে। ভেতরে সুন্দর কেয়ারি করা বাগান, বাচ্চাদের খেলার মাঠ। বুড়োরা বিকেলে হাওয়া খায়। বিজলির চিতায় মরা পুড়ছে।ভগবতীর ঘর একটাই। তবে বেশ উঁচু আর লম্বাটে। খুব রঙচঙে। ওর গয়নাগাটি, সিদ্ধেশ্বরীর থেকে অনেক অনেক বেশি। আর যত্নটাও খুব বেশিই পায় ও। দুবেলাতেই মাছ, মাংস। ডাল, তরকারি, মিস্টি, পায়েস আরও নানারকম। মোটা কাঠের দরজাটা বন্ধ করে দিনে তিনবার বিশ্রাম নেয় মেয়েটা। তার আবার খুব রাগ! কেউ বিরক্ত করে না।

আর ওর বেলায়! ও কিছুই করেনি। তাও সবাই বলে--ও খুব শান্ত, দয়াময়ী। কারুর দুঃখ নাকি সহ্য করতে পারে না! তাই এই শাস্তি!  প্রতিদিনের খাবার বলতে শুধুই ফল-মিস্টি । ঝুলকালি লাগা ঘরটায় ছুঁচো, ইদুর, টিকটিকিদের সাথে থাকা। এইসব সবকিছুই মেনে নেয় সে।  এমনকি সারা দিন-সন্ধেটাও অভ্যেস হয়ে গেছে। কিন্তু  সারাটা রাত ঐভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে দঁড়িয়ে জাগা! আর এই মুখোশগুলোকে দেখা! কতদিন পারে কেউ? মেজটার নাকি রুপো আর হাতির দাঁতের মিনে করা পালঙ্ক। ছোটরও শোয়ার জন্য সুন্দর একটা বড়সড় খাট আছে। ওদের স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আরাম করে শুতে পারে। ওর আর মেজর বরদুটো শুয়ে শুয়েই দিন কাটায়। এমন স্ত্রৈণ পুরুষ আবার ওর পছন্দ না। তেমন ছেলেও বা ও এল কই! তাই বিয়েই আর করা হল না। আজকাল মুখোশগুলো, ওর দুধ-হলুদ রঙ,সুন্দর মুখ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। আর বলে ও নাকি এদেশের না। মেজ আর ছোট কী করে ওর বোন হয়! ওদের মত ঘরজামাই বর কীভাবে এমন মেয়ে বিয়ে করার সুযোগ পাবে?  তখনও বেশ ভাল লাগে! কিন্তু কোমরটা টনটন করে ওঠে মাঝেমাঝেই। আর সত্যি সত্যি তখন  খুব রাগ হয়...হিংসা হয়। কেড়ে নিতে ইচ্ছে করে দুই বোনের ভাগ্য! খাট-পালঙ্ক কিচ্ছুটি দরকার নেই। ঐ  ফাকা ফাকা করে লোহার শিক বসানো দরাজাটা! কিছু দিয়ে ওটা আড়াল করুক ওর ঘরের আব্রু। দিনরাত জ্বলা ঐ সাদা বিজলির আলোটা নিভিয়ে দিক। তারপর ও মাটিতেই শুয়ে পড়বে সেই আগের মত। ঘুমোবে সারা রাত... নিশ্ছিদ্র ঘুম। সারাটাদিন মুখোশ দেখার থেকে শান্তি!

                                                                                    ২

তখন ভাগীরথী বইত এই ঘরটার ঠিক পেছন দিয়ে। অবশ্য এই ঘরটাই ছিল না তখন। ঘোলা জলের ছোট ছোট ঢেউ উঠত ভাগীরথীতে। জোয়ার-ভাটার খেলা চলত। পানসি-বজরা-গহনা-পালতোলা ময়ূরপঙ্খী, হংসমুখীর চলাচল ছিল দিনরাত জুড়ে। আর শ্রাবণের বৃষ্টি শুরু হলেই বন্যা।এপারে তখন সুন্দরী, গরান, ক্যাওড়ার জঙ্গলে চড়ে বেড়ায় হরিণ, বাঘ, বুনো শুয়োরের ঝাঁক। এই এখানে ছিল ছোট্ট একটা ঘাট। বৃষ্টি শেষ হওয়া এক বিকেলে সেই ঘাটে নামল বলদেব পাল। বলদেবই মনে হয় একমাত্র, যার মুখে কখনই মুখোশ দেখেনি সিদ্ধেশ্বরী। ওরা তিনবোন নেমেছিল।  সেই দূর পাহাড়ের দেশে বলদেব গিয়েছিল কাজের খোঁজে। ওখানেই পাহাড়ে পাথরে দিনরাত মাথা খুড়ে মরত সে। সেই ভাবেই তাদের তিনবোনকে সে পেয়েছিল । ইচ্ছে ছিল আরও চার মেয়েকে খুঁজে নিয়ে সে আসবে। তখন সাত কন্যা যার সাথে থাকত সে মহা ভাগ্যবান। কিন্তু ছেনি, হাতুড়ির সাথী বলদেবের নাকে মুখে সবসময় পাথরের গুড়ো ঢুকত। তাই অসুখে ধরল তাকে। চলে আসতে হল এখানে। এই জঙ্গল পেরিয়ে ছিল তার গাঁ, পুঁটিমারি। সে গাঁয়ের পুঁটি মাছের খুব স্বাদ। কিন্তু বলদেব গাঁয়ে গেল না। মাঝিরা নামিয়ে দিয়েছিল ওদের তিনবোনকে। বিকেলের রোদ তখন পাকা কামরাঙা। ওদের তিনজনের দিকে তাকাল বলদেব। তারপর চোখ বুজে বসে পড়ল। পরদিন কুঁড়ে বানাল এখানেই।

চোখে জল আসে সিদ্ধেশ্বরীর। কী মজাই না ছিল তখন! ঘাটের চারপাশে পাখিদের কিচিরমিচির, কতরকমের ফুলের গন্ধ! তখনও মুখোশ ছাড়া অনেকেই ছিল। তারা নৌকাতে উঠতে, নামতে দিয়ে যেত মন্ডা, বাতাসা, ক্ষীরপুলি...কত কী! তার সাথে বলদেবের স্নেহ-শাসন।  বড় গঞ্জ বলতে বেশ দূরে বঁড়শে। তাদেরই কর্তা চৌধুরী মহারাজ যাচ্ছিলেন বজরায় চড়ে। তার মুখে একটা মস্ত বড় মুখোশ দেখেছিল সিদ্ধেশ্বরী। ঐ নদীর বুক থেকেই মেজর জাঁকজমক দেখে তার ভাল লেগে গেল। নামলেন তিনি। পছন্দ করলেন মেজকে। মেজও খুব খুশি। তার বাড়িতে ছিল বিশাল লম্বা চওড়া ছেলে, প্রমথেশ। তাকে  এনে বিয়ে দিলেন মেজর সাথে। তারপরে এখানেই একটু দূরে রাতারাতি জঙ্গল কেটে বিশাল পোড়ামাটির ঘর বানিয়ে দিলেন। খাওয়ার জন্য জঙ্গল কেটে চাষজমিও হাসিল করে দিলেন। কিন্তু এই জমি তার ছিল না। ছিল তহশীলদার আলিসাহেবদের। তহশীলদার খোঁজ নিতেন না জঙ্গলের। চৌধুরী মেজর বাড়িতে রোজ শয়ে শয়ে লোক পাঠাতে শুরু করলেন। এইভাবে এই মহাল ভোগ করতে শুরু করলেন তিনি। আলিসাহেব তখন মারা গেছেন। তার ছেলেরা ছোট ছোট কিছু বলতে পারল না। কিন্তু রেগে রইল।

একটু দূরে সিরিডিহির মহাশ্মশান। সেখান থেকে এক পাগল-ক্ষ্যাপা এল। তার মুখেও একটা মুখোশ ছিল। ঘরে বৌ নেই বলে খাওয়া হয় না তার। ছেলে ভৈরবের সাথে সে ছোটর বিয়ে দিল। ছোটর নজরদারিতে শ্মশানে দাহব্যবসা বেশ জমে গেল। সেই খ্যাপা…মস্ত গুরুদেব হয়ে গেল। বৌমার জন্যেও পাকা ঘর বানাল সে।

দুইবোনই যাবার সময় বলদেবের হাতেপায়ে ধরেছিল। সঙ্গে করে নিয়ে যাবে, না সে যায় নি। পরে বলছিল বলদেব...তোকে ছেড়ে কোথায় যাব? সিদ্ধেশ্বরী চুপ করে ছিল। আরও বলেছিল সে...স্বপ্নে যে তোকে দেখেছিলাম মা! ওরা দুই বোন গর্জন তেলে মাখামাখি কালো। আর বলদেব সিদ্ধেশরীকে হলুদ মাখাত। বাটা শ্বেত চন্দন আর টগরের পাপড়ির ক্কাথ মাখিয়ে রাখত তার মুখে। মনেই হত না তারা দুজনে ওর বোন।

কী যত্নই না করত বলদেব! নিজের হাতে করে নাওয়াত,খাওয়াত। না খেলে জোর বকা দিত। খেয়ে নিত সিদ্ধেশ্বরী। রাতের বেলায় ফাকা নদীর ঘাটে গান শোনাত বলদেব।  আকাশে, চারপাশে হয় চাঁদের আলো নয়ত তারার ঝিকিমিকি। সেই গানে দুচোখে ঘুম নেমে আসত সিদ্ধেশ্বরীর। সকালবেলাতেও বাজত বলদেবের ভোরেলা গান। সাজিভর্তি হয়ে থাকত সদ্যফোটা লালজবার রাশি । জবার লুকোচুরি গন্ধ ঘুম ভাঙাত ওর।

ছোট-মেজর নামযশ, আরাম-বিলাস বাড়ছিল। কিন্তু সিদ্ধেশ্বরী চাইত দিনগুলো যেন এমনই যায়। অথচ গেল না। একবার ভরা বর্ষায় ভাগীরথীতে মহাপ্লাবন হল। ভেসে গেল বলদেব আর তার কুঁড়েঘর। আশেপাশের গাঁ-গঞ্জ সব ধুয়ে মুছে সাফ। মানুষের আর কোন চিহ্নই থাকল না।

কী করত তখন সিদ্ধেশ্বরী? বলদেবের জন্য কাঁদবে? না সে উপায় নেই। সে এক বিভীষিকা! অনেক অনেক পরে একসময় সেই প্লাবনের জল নামল। তারপরেই শুকোতে শুরু করল অত বড় নদী। মাত্র কয়েকটা বছর… থাকল এক সরু  সোঁতা । দুপাশে আবার ঘন হল জঙ্গল। আবার বুনো জীবজন্তু। ওরা তিনবোন শুধু ভূতের মত তিন বাড়িতে।

ঐ সরু সোঁতায় নৌকা চলল অনেক অনেক বছর পর। দুপাশে বসল দু-একটা গ্রাম। ছোট্ট এক খেয়ার পারাপার শুরু হল।  তার মাঝি বলত, সাতগাঁ থেকে ঘুরে আবার নিজের খাতে ফিরে গেছে ভাগীরথী। নতুন সোঁতা নাম নিল গড়িনী। তার সরু সরু স্রোতের সাথে আরও কত মুখোশ এল। দুচার ঘর মানুষও এল।  কত মানুষ-মুখোশ সিদ্ধেশরীর সাথে থাকল, চলে গেল। সবার কথা আজ আর মনে পড়ে না। কিন্তু সেইসব দিনগুলোতেও সব শান্তই ছিল। সারাটা দিন দাঁড়িয়েই সে সবাইকে দেখত। রাত্রিবেলা এইঘরটায় পড়ত মোটা কাঠের আগল। তারপরে ঘুমোত সে। খোলা জানালা দিয়ে ঘরে আসত গড়িনীর মিঠে বাতাস।

                                                                                   ৩


মনে হয় এই সেদিন। তাও অনেকদিন আগে। এক টুকটুকে লাল মুখোশ এল। তখন তাদের খুব জোর। তারা অচেনা ভাষায় কথা বলত। অনেক কুলি কামিন লাগাল সে। তার নাম নাকি টালি! বাপ রে...টালি, খোলার নাম কেউ দেয়! খুব হাসি পেয়েছিল সিদ্ধেশ্বরীর। কিন্ত এলেমদার লোক সে। সরু গড়িনীকে কেটে চওড়া খাল বানাল। আবার নৌকা, মানুষজন, বাণিজ্য। একসময় আর জঙ্গলের কুটোটুকুও থাকল না। মেলা জায়গার লোকজন এসে বসছিল তখন। ঐ সময়েই এল লক্ষ্মী হালদার। বড় একটা মুখোশে ঢাকা ছিল তার মুখ। বেঁটে, হেটো ধুতি পরা লোকটা নৌকা থেকে নামল। কিছুক্ষণ তাকাল ওর দিকে। তারপরেই ভেউভেউ কান্না। স্বপ্নে নাকি সিদ্ধেশ্বরী ওকে ডেকেছে। সে থাকতে শুরু করল তার ঘরেই। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হত লোকটা। সবাই বলত ভর পরেছে। বাঁজা মেয়ের বাচ্চা, অম্লশূলের ওষুধ...অনেক ফিকির জানত সে। কিন্তু তার আসল ফিকির ছিল অন্য।

 মাঝরাতে, গায়ে কালি মাখা দশ-বারোজন ষন্ডা নৌকা থেকে নামত। তাদের নিয়ে সিদ্ধেশ্বরীর কাছে আশীর্বাদ চেয়ে লক্ষ্মী বেরিয়ে পড়ত। সিদ্ধেশ্বরী বুঝতে পারত মুখোশের দলের কীর্তি। জমিদারদের কানেও উঠছিল কথাটা। তখনই একদিন সে বলতে শুরু করল। আবার নাকি তাকে সিদ্ধেশ্বরী বলেছে স্বপ্নে। গাঁয়ের সবাই রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোক।কোনো ভয় নেই। সিদ্ধেশ্বরী এই ঘাটে নিজেই পাহারা দেবে। সেই শুরু হল। মাঝরাত পর্যন্ত সিদ্ধেশ্বরীকে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। লক্ষ্মী আগল টেনে বেরোলে তবে সে  শুতে পারত। তখন থেকেই ওর দুর্ভাগ্যের শুরু। একরাতে লক্ষ্মী বেরোল। আর এল না। তারপর  লক্ষ্মীর ছেলে নিল ওর থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব। তারপর নাতি।

এখনও লক্ষ্মীর বংশই ওর থাকা খাওয়ার দায়িত্বে। এখন আর তাদের গলা উচিয়ে বলতে হয় না যে এই গাঁ রক্ষার সব দায় সিদ্ধেশ্বরীর। সবাই সেকথা জানে। কালে কালে, কীভাবে জায়গাতার নামই হয়ে গেল...সিধপুর। আজ,  কালো ধোঁয়া, ধুলো, সামনে পেছনে লোহার ছোটবড় গাড়ির একটানা দৌড়, খিস্তি, গালাগাল, নেশা, হিংসা, ঝুটো দেখনদারিতে...গমগম করছে সিধপুর।মাথা গুলিয়ে যায় মাঝে মাঝে ওর। এত মুখোশ আসে তার কাছে! সবাইকে লক্ষ্মী হালদার মনে হয়। তারপর ভুল ভাঙে। নাহ্‌...লক্ষ্মী তো এতটা...এমন ছিল না! সে তো একটু হলেও ওকে রাতে ঘুমোতে দিত। পাটা-কোমরটা জিরোতে পারত। এক এক দিন ভোররাতে সে খুলে ফেলত মুখোশটা। তারপর সেই ভেউভেউ কান্না...ক্ষমা করে দে...ক্ষমা করে দে।

অনেককাল এইভাবে কাটল! যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারে না সিদ্ধেশ্বরী! আর তারপরেই আসল সেই দিনটা। কুচকুচে কালো একটা দিন। ও বুঝল অসহ্য যন্ত্রণা কাকে বলে।  সেই দিনটা চলে গেলে মনে হয়েছিল আর তাকাবে না সামনে! যতদিন থাকবে দুচোখ বন্ধ করে জেগে থাকবে। তারপর থেকেই ওর ঘরের পুরো আগলটা উঠে গেল।  ফাক ফাক লোহার শিকের দরজা বসল। সারাটা রাত প্রদীপ আর সাদা বিজলির বাতি। প্রত্যেকটা পল তাকিয়ে থাকতে হয় ওকে। সবাই ভাবে খালের দিকে পিঠ করে এলাকার দিকে যতক্ষণ ও তাকিয়ে থাকবে ততক্ষণ কোনো বিপদ হবে না। অথচ সেদিন তো প্রথমে ও পারেনি! আসলে ও নিজে কিছুই করতে পারেনি। ভোরের কাক ডাকার আগে খাল পেরিয়ে বড় বড় রামদা, সড়কি, মশাল ঢুকছিল এপারে। সেই আলিসাহেবের দখল হওয়া জমির কষ্ট ভুলতে না-পারা কিছু মানুষ আগে আগে। পেছনে গোঁফছাড়া দাড়িওলা ষন্ডার মুখোশ অগুনতি । তখন, মেজর বাড়ি পেরিয়ে আরও কিছু দূরে বসতি।

ওরা প্রথমে মেজর বাড়িতে ঢুকল।  একেএকে গয়নাগাটি,টাকাকড়ি কেড়ে নিল। মেজকে খুঁজছিল ওরা। কিন্তু আগেই বুঝে মেজ গিয়ে লুকিয়েছিল। তার বরের একটা ভাঙা ঘরের কোনে। তারপর সারা বাড়িতে ওরা আগুন লাগিয়ে দিল। আওয়াজ উঠছিল…লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। আগুনের হলকা দেখে তারপর ছুটে এল চার-পাঁচটা গাঁয়ের মানুষ। সে কি রক্তক্ষয়, মানুষের কাটা মুন্ডু, হাত, পা!না , একটাও মুখোশের ছিল না…একসময় ওপারের ওরা পালাতে শুরু করল। এই ঘাটের কাছে এসে ওদের বড় সর্দার কাদায় পিছলে পড়ে গেল। কয়েকটা মুখোশ তাকে ধরে নিয়ে গেল ঐ সামনের হাড়িকাঠে…ওহ্‌! পরদিন থেকে ওর ঘরে ভিড় আরও বেড়ে গেল। ও খুব জাগ্রত! মহাবিপদ থেকে ও রক্ষা করেছে পুরো অঞ্চলকে। মহাশত্রুর বিনাশ হয়েছে ওর হাতে!



                                                                                   ৪

সিদ্ধেশরী এখন আশাই ছেড়ে দিয়েছে। আর মনে হয় ও ঘুমোতে পারবে না। দুপায়ের, কোমরের আর দুচোখের কষ্ট তাকে সহ্য করেই যেতে হবে। ওর চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে। কিন্তু তারপরেই বিচ্ছিরি তাপ আসে। পেছনের টালিনালার  ওপরে বসেছে নোংরা জল পরিস্কার করার বিদ্ঘুটে কল। সেটা চলতে শুরু করলে ঐ বিচ্ছিরি তাপ বেরোয়। সেই তাপে দুচোখের জল শুকিয়ে যায়।

হঠাৎ করেই একদিন ওর মনে হল। দিন যেন এবার পাল্টাবে! হালদারদের বুড়ো ঠাকুরদা সেদিন  ওর পায়ের কাছে বসে গলা ছেড়ে কেঁদেছিল। আর তারপরেই ওর মনে হল। এবার পাল্টাবে সব… পাল্টাবেই। খালপারের  এই ঘরটা নাকি আর থাকবে না।ঘরটাই শুধু না পুরো এলাকাটাই তো আসলে সেই তহশীলদারদের।  এতদিনে  তার বংশের ছেলেরা সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে। এখানে এই বড় পাকা সড়কের ওপর তারা অনেক বড় প্রাসাদ বানাবে! সিদ্ধেশ্বরীকে তারা তাড়িয়ে দেবে? অন্য কোথাও যেতে হবে? বাহ্‌… সেখানে গেলে ও যদি একটু জিরোতে পারে!আর যদি মুখোশ না দেখতে হয়!  একটুও মন খারাপ হল না ওর।

কয়েকদিনের মধ্যেই  তারা এল। তারপর সামনের চত্বরটাতেই দাঁড়িয়ে হালদারদের পুরো গুষ্ঠিকে কথা দিল। সিদ্ধেশ্বরী সবাইকে বাঁচায়। তাই একটা সুন্দর ঘর বানিয়ে দেবে তার জন্য। আর বাকি জায়গাতে, তাদের অট্টালিকা হবে। হালদাররাও ঘর পাবে সেখানে।  আড়ালে গিয়ে আরও কিছু বলল তারা।  হালদাররা খুব খুশী।

 কিন্তু অদ্ভূত হালদারদের মুখে হসি আসল না। কালিতে কে যেন লেপে দিল ওদের মুখোগুলো। একটা চৌকি পেতে কিছু মুখোশ বসে পড়ল চত্বরটায়। এটা সিদ্ধেশরীর জমি। এখানে শুধু সিদ্ধেশ্বরী থাকবে। আর কেউ না! হিন্দুর দেশে এ অন্যায় তারা মানবে না। তারা দিনের বেলার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে বসে রইল। কয়েকদিনের মধ্যে ওদের সামনে ভিড় হতে শুরু করল । এমন হল! সড়ক দিয়ে গাড়ি যাওয়াই বন্ধ! সারাদিন শুধু কালো কালো মাথা। আস্তে  আস্তে মন্ত্রী, সান্ত্রী সবাই আসতে শুরু করল। কয়েক হপ্তা যাওয়ার পর বড় মন্ত্রী এসে বলল-সিদ্ধেশ্বরীর এই ঘরই থাকবে। তাকে কোথাও যেতে হবে না। অনেক মালা পেল সেই মন্ত্রী। তার মুখের চওড়া হাসি মেলাচ্ছিল না। মুখ কালি হওয়া মুখগুলো দুধ খেল। মন্ত্রী, সান্ত্রী, পুলিশ,মুলিশ সব চলে গেল।  ফের মন ভাঙল সিদ্ধেশ্বরীর। চলে যাওয়া হল না। মুক্তি নেই।  বুকের ভেতরটা ফাকা লাগছিল।  তার সাথে কেমন গুরগুর করছিল।  বাইরে থেকেও ভেসে আসছিল একইরকম একটা অদ্ভূত আওয়াজ। চত্বর পেরিয়ে লম্বাটে উচু বাড়িগুলোর মাথা ছাড়িয়ে টুকরো টুকরো আকাশের দিকে তাকাল।  সন্ধে পেরিয়েছে।  গরম এক হলকার সাথে থমথমে মেঘে ছেয়ে আছে গোটা আকাশ। হরেক রকমের বিজলির আলো মশে সেই আকাশ ফ্যাকাশে ধোঁয়া…ধোঁয়া।


মাঝরাতের পর ঝড় উঠল। এমন ঝড় বহু যুগ দেখেনি ও! চত্বরে থেকে যাওয়া একমাত্র বুড়ো আমগাছটা উপড়ে পড়ল…এক লহমায়। হাওয়াতে ওর গায়ের কাপড় থাকছিল না। ওকে মেজ, ছোটর মত দেখতে না মোটেও। তাই কেউ না থাকলেও ওর লজ্জা করছিল। ঘরের সব কিছু, বাসনপত্র, ঘন্টা-কাঁসর এমনকি ঐ গয়নার সিন্দুকটাও নেচে বেড়াতে লাগল। একটু বাদেই বিজলির বাতিগুলো ঝুপ করে হারিয়ে গেল। শেষ কবে এমন হয়েছিল! মনে করতে যাবে সিদ্ধেশ্বরী। তখনই দেখল। বেশকটা সরু সরু বিজলির হাতবাতি ঢুকে পড়েছে ওর ঘরে। ওরা কি গয়না রাখা  সিন্দুকটা ভাঙতে এল? না তো…ওরা যে ওর দিকে এগোচ্ছে। ওরা কি শেষ পর্যন্ত ওকেও…হায়, হায় বলদেব কেন ওকে এইভাবে বানিয়েছিল।  মুখোশগুলো লোহার চেন দিয়ে ওকে বেঁধে ফেলল।

     
  ৫

               
ঝড় থেমেছে অনেক্ষণ! এখনও ভোর হয়নি। মলমূত্র, আবর্জনা আর জঞ্জালের বোঝার নীচে, খালের পচা কাদায় উপুড় হয়ে পড়ে ছিল সিদ্ধেশ্বরী। বহু বহু কাল পর ওর দুচোখ বোজা। দুটো পা-কোমর টানটান।  ও চাইছে কেউ যেন ওকে আর খুঁজে না পায়। এভাবেই যেন ও থাকতে পারে।যুগের পর যুগ। আর ঠাঁয় ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। এই দুর্গন্ধ…গা গুলোনিকেও আজ কী যে ভালো লাগছে! আর দেখতে হবে না মুখোশদের। কী অদ্ভূত! সকালের সেই মুখোশগুলোর কয়েকটাও ছিল হাতবাতি নিয়ে। ওর বলছিল…শালি কী ভারি রে! তোলা যাচ্ছে না। গাড়ি ফাড়ি নেই…কোথায় গিয়ে ফেলব…শেকল ধরে টানছিল আর বলছিল? ওরে সিদ্ধেশ্বরী তোকে…


কীসব গুঁজে দিয়ে আগুন জ্বালাচ্ছিল ওরা। ভয়ঙ্কর আওয়াজ…ঝড়ের আওয়াজও তাকে চেপে রাখতে পারছিল না। কোনযুগের দেয়ালগুলো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছিল। ভেঙে পড়ার সময়, কোন আওয়াজটার জোর বেশি! এই শব্দ… নাকি যা কানে আসছিল। সিদ্ধেশ্বরীর দিব্যি…এমন সাইকোলোন তিনশো বছরেও আসে নি…পনেরো দিনের কী প্ল্যানিং মাইরি…দোষ খেলে খা, আলির বাচ্চা, তোদের জমি,কুড়ি পার্সেন্ট খাবি। তোরা নাকি শোধ তুলবি…খাবি না! খা শালা খা...হ্যা, হ্যা, হ্যা…ওহ্‌ কী পেলান মোনতিরির! ওরে সিদ্ধেশ্বরী তোকে… এই প্রথমবার বলদেবকে অভিশাপ দিয়েছিল সিদ্ধেশ্বরী। কেন ওর  দুটো কান থাকল…কেন, কেন! খালের কাদা আশ্রয় দিলে শান্তি পেল ও। সব শোনার থেকে…সব দেখার থেকে। এবার ওর মুক্তি…মুক্তি…শান্তি।



  ৬

 না কাদা মেখেও মরার মত ঘুম এল না সিদ্ধেশরীর। ওর ঘরটা এখন  রঙচঙে পাথরের। শুধু চুড়োটাই পঞ্চাশ হাত। মাথার ওপর সোনার জলে লেপা কলসি বসানো। এখন আর একটা ঘর নেই। পুরো চত্বর জুড়ে বিশাল বাড়ি। সারা বাড়িজুড়ে গেরুয়া পতাকা...ওঁ লেখা...পতপত করে উড়ছে হাওয়ায়। হালদাররা পালিয়েছে। হিন্দি বলা, টিকি মাথার এক মোটা বুড়ো রোজ ওকে খাওয়ায় পরায়। চেনাজানা কেউ আর সাথে থাকে না। না ভুল বলা হল। মুখফোলানো লেজওয়ালা এক বিশাল পুরুষ অবিশ্যি ওর পাশে এসেছে। তাকেও দিনরাত ওর মতই পুরু কাঁচের দরজার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে থাকতে হয় সামনে। সিদ্ধেশ্বরী বুড়ি হচ্ছে। তার ক্ষমতা কমছে। এলাকাটাকে আর একা রক্ষা করতে পারছে না ও। কোনোমতে সে নিজেকে বাঁচাচ্ছে। তাই উনি...

টনটন করতেই থাকে সিদ্ধেশ্বরীর কোমর, হাঁটু, গোড়ালি, পায়ের পাতা...চোখ ঢুলে আসে। মাঝরাতে পাশের উনি বলে ওঠেন...ঔর কিতনে দিন এই নাকাবো কে বিচ রেহেনা পড়েগা রামজি!  এখন  আর একটামাত্র সাদা বিজলির আলো না। অনেক...  অনেক...অগুনতি, হলুদ, সাদা...ছোট বড়, বিজলির আলো জ্বলে সারা রা...রাতভোর।


গল্প : কৃষ্ণেন্দু পালিত





সব পাঁচশ হাজারের নোট
                               

     সবখানে পাঁচশ হাজারের গল্প। কালো টাকা ভার্সেস সাদা টাকা। ট্রেন বাস চায়ের ঠেক টিউশান বাড়ি ফেসবুক হোয়াটসআপ থেকে শুরু করে ব্যাঙ্ক-এটিএম-এর লাইন, সবজি বাজার শেয়ার মার্কেট... টিভি আর কাগজওয়ালারা তো আছেই। সেই সাথে ছড়াচ্ছে গুজব। কোথায় পাঁচশ টাকার নোট পোড়ানো হয়েছে, কোথায় বস্তা বস্তা টাকা পাওয়া গেছে, কোন কোন ডাক্তারের বাড়ি রেড হয়েছে। নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে দেশের কতটা অগ্রগতি বা অধগতি হবে সে বিতর্কও চলছে। এই সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের কতটা দুর্ভোগ হচ্ছে, অর্থনীতি কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হছে আপনি যতই বুঝুন, বিরোধী দলগুলো তাদের মতো করে বুঝতে বাধ্য করছে মোড়ে মোড়ে মাইক বেঁধে। যত দিন যাচ্ছে প্রসঙ্গটা বিরক্তিকর হয়ে উঠছে কার্তিকের কাছে। সবচেয়ে অসহ্য লাগছে পরিচিত যখন কেউ ফলাও করে গল্প করছে বাড়িতে মা বউ মিলিয়ে কখানা পাঁচশ হাজারের নোট মিলেছে, কখানার ব্যবস্থা করতে পেরেছে, অবশিষ্টগুলোর জন্যে কি কি পরিকল্পনা করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি...।

     কার্তিকের না আছে কালো টাকা না সাদা টাকা। প্রধানমন্ত্রী যখন এই ঘোষণা করেন তখন তাঁর কাছে একটাও পাঁচশ হাজারের নোট ছিল না। এই না থাকাটা প্রথমদিকে তাঁর কাছে সৌভাগ্যের মনে হয়েছিল। যত দিন যাচ্ছে তত তাঁর ধারণা বদলাচ্ছে। মানুষ যেভাবে ফলাও করে তাদের অসুবিধার গল্প শোনাচ্ছে যেন এর থেকে গৌরবের আর কিছু হয় না। পাঁচশ হাজারের মহাযঞ্জে নিজেকে কেমন অপাংতেয় মনে হচ্ছে। যেখানেই এধরনের আলোচনা সেখান থেকেই সে পালাচ্ছে। কিন্তু পালিয়ে কতদূর যাবে! সবখনেই আলোচনার বিষয় এক। বিষয়টা তাকে সমানে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। নিজেকে এত তুচ্ছ আর নগণ্য আগে কখনও মনে হয়নি।

     কার্তিকের বয়স এখন পয়তাল্লিশ। বিয়ে থাওয়া করে ওঠা হয়নি। ভবিষ্যতে হবে এমন আশাও দেখেনা। দাদা বউদির সংসার। খরচ দিয়ে খায়। এছাড়াও বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনে সামলে দিতে হয়। সেসব টাকা অফেরতযোগ্য। তা নিয়ে অবশ্য তাঁর কোন আক্ষেপ নেই। সকাল বিকাল টিউশান করে যা আয় হয় খরচখরচা বাদ দিয়েও মাসের শেষে কিছু থাকে। সেই আতিরিক্ত টাকা যখন জমতে জমতে পাঁচ হাজার স্পর্শ করে, সোজা চলে যায় পোষ্টাপিসে। ক্যাশ সার্টিফিকেট কিনে রাখে। সার্টিফিকেটের মেয়াদ পূর্ণ হলে প্রাপ্য অর্থে আবার সার্টিফিকেট কেনে। তা বলে এমন নয় যে সে ধনকুবের। বরং কৃচ্ছসাধন করেও এখনও ছয় অঙ্কে পৌঁছাতে পারেনি।

     নগদ টাকা কার্তিকের হাতে কমই থাকে। এই যে কৃচ্ছসাধন, সব ভবিষ্যতের কথা ভেবে। টাকার লোভে ভাইপো ভাইঝিরা যদি বৃদ্ধ বয়সে দেখে। সম্প্রতি চারপাশে যা টাকার গল্প শুনছে, বিশেষ করে পরিচিত বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনের--- মনে হচ্ছে তাঁর এই সঞ্চিত অর্থ আসলে ব্যাঙের আধুলি।

     প্রধানমন্ত্রী যেদিন নোট বাতিলের কথা ঘোষণা করলেন, কার্তিকের খুব আনন্দ হয়েছিল। একদল না খেয়ে মরছে তো একদল টাকার পাহাড় জমাচ্ছে। মালগুলো এবার জব্দ হবে। আর সামান্য হলেও সুবিধা পাবে গরীব মানুষগুলো। আনন্দে বাড়ি ফিরে কাগজ কলম নিয়ে বসেছিল সে। ফটাফট কয়েকখানা ছড়া লিখে ফেলেছিল। পরবর্তী দুদিনে মোট এক ডজন ছড়া লিখেছিল। নিয়মিত না হলেও সাহিত্য চর্চায় তাঁর আগ্রহ আছে। যদিও ছড়াকে সাহিত্য বলা যায় কিনা ইদানীং তাঁর সন্দেহ হয়। বড় বড় পত্রপত্রিকাগুলোর কেউ ছড়া ছাপে না। ছাপে কিছু শিশু কিশোর পত্রিকা। শিশুপাঠ্য ছড়া। যে ভাষায় সুকুমার রায়, অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতো ছড়াকার জন্মায় সে ভাষায় ছড়ার এমন করুন আবস্থা কি করে হতে পারে তাঁর মাথায় ঢোকে না।

     কার্তিক ছোটদের জন্যে যেমন লেখে, বড়দের উপযোগী ছড়াও লেখে। সেসব ছড়ার অধিকাংশই খাতা বন্ধি থাকে, ছাপা হয় দু-চারটি। এমন কি যে শহরে সে বাস করে সেখানে সাহিত্য চর্চার একটা ঐতিহ্য আছে। অসংখ্য লিটিল ম্যাগাজিন এবং সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। সাহিত্য পাঠের আসর বসে নিয়মিত। সেসব আসরে সে আমন্ত্রণ পায় কালেভদ্রে। এখানেও তাঁর অবস্থা পাঁচশ হাজারের পাশাপাশি খুচরো পয়সার মতো।

     এত অল্প সময়ে এত সংখ্যক ছড়া লেখা যে কোন লেখকের কাছেই আনন্দের। কার্তিকেরও আনন্দ হয়েছিল। তবে তা সাময়িক। সে আনন্দ ফিকে হতে কয়েকদিন মাত্র সময় লেগেছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই আবিষ্কার করেছিল তাঁর পরিচিত মহলে পাঁচশ হাজারের প্রসঙ্গে সে সংখ্যা লঘু কেবল নয়, একমাত্র মানুষ। ব্যাঙ্কের সামনের দরজা দিয়ে যত টাকা সাদা হচ্ছে, পেছন দরজা দিয়ে হচ্ছে হাজার গুন। নামে বেনামে, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব পরিচিতদের অ্যাকাউন্টে ঢুকছে তারও বেশি। পাশাপাশি সোনা বা অন্যান্য সম্পত্তি কেনার বিষয়টি তো রয়েছেই।  মোদিজির উদ্যোগ পুরোপুরি মাঠে মারা গেছে। কালো টাকার কারবারিরা যেমন ছিল তেমনই আছে, খেটে খাওয়া মানুষগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয় হচ্ছে। প্রায় কাজ নেই বললেই চলে তাদের।

     প্রধানমন্ত্রীর ব্যর্থতা তাই কার্তিকেরও ব্যর্থতা। বন্ধুদের আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না। যেখানেই এধরনের আলোচনা হচ্ছে, সেখান থেকেই পালিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত এক হীনমন্যতা তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।


     অনেকদিন বাদে আজ একটা সাহিত্য সভায় ডাক পেয়েছিল। মোট আটজন লেখক উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে দুজন গল্পকার, পাঁচজন কবি এবং একমাত্র ছড়াকার সে। সম্প্রতি “পাঁচশো হাজারের নোট” শীর্ষক ১২টা ছড়ার যে সিরিজ লিখেছে সেটাই পাঠ করেছিল। সমস্যা তৈরি হল সমালোচনার সময়। সভার নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেকের স্বরচিত রচনা পাঠের শেষে লেখাটি বা লেখাগুলি নিয়ে আলোচনা হবে। আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারবে উপস্থিত যে কেউ। করলও তাই। কেবল তাঁর ছড়ার আলোচনা করতে গিয়ে সকলেই ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ টেনে আনল। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করল। সীদ্ধান্তের বিরোধিতা করল। কেবল ছড়াগুলোই থাকলো উহ্য।

     জরুরী কাজের অজুহাত দেখিয়ে উঠে আসল কার্তিক। বিষয় ভাবনার ক্ষেত্রে প্রায় সকলেই যে মূল বিষয়ের বিপরীত মেরুতে আবস্থান করছে বুঝতে অসুবিধা হয়নি তার। সাহিত্য আর ব্যক্তি বিশ্বাসে আসমান জমিন ফারাক। মন খারাপ নিয়ে পাড়ার ক্লাবে এসে ঢুকল সে। বন্ধুরা তখন ক্যারাম খেলছিল। সেই সাথে চরম বিতর্ক। একসময় পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম। কার্তিক বিরক্ত হয়ে বলল, এছাড়া তোদের আর কোন প্রসঙ্গ নেই! শালা সবখানে এক গল্প।

     -তুই থাম। সাদা ধন কালো ধনের তুই কী বুঝবি? তোর তো কিছুই নেই।
     -থাকলে এতদিন বিয়ে করত। পাশ থেকে আর একজন বলল।
     হো হো করে হেসে উঠল বাকিরা। মুহূর্তে বিতর্ক আড্ডায় রুপ নিল। একজোট হয়ে গেল সবাই। সব ছেড়ে কার্তিককে ধরল। বিয়ে না করার মতো হাস্যকর যেন আর কিছু হয় না। কোথায় কালো টাকা আর কোথায় বউ! রাবিস!

     ক্লাবঘর থেকে বেরিয়ে আসে কার্তিক। কানমাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। সেই সাথে বেশি করে বাজছে দারিদ্র্যের অপমান। কে যে বন্ধু আর কে শত্রু সব ঘুলিয়ে যাচ্ছে। ক্ষোভে অপমানে একদলা থুতু ফেলে রাস্তায়। এ অবস্থায় বাড়ি ফিরলে সারারাত ঘুম হবে না। আরও কিছুক্ষণ এলোমেলো রাস্তায় ঘোরার সিদ্ধান্ত নেয়।

     রাত দশটার ফাঁকা রাস্তা। এবছর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহেই শীতটা জাঁকিয়ে পড়েছে। সেইসাথে কুয়াশা। আজ মাফলারটা নিয়ে বেরতে ভুলে গেছে। মাথা টিপটিপ করছে। এই রাতেও এটিএমের সামনে লম্বা লাইন। উল্টো দিকের চায়ের দোকানটা বোধহয় সেজন্যেই খোলা। বেশ কয়েকজন খদ্দের সেখনে। এক কাপ চা খেলে মাথাটা ছাড়তে পারে ভেবে চায়ের দোকানে ঢোকে। চায়ের অর্ডার দিয়ে লাল সুতোর বিড়ি ধরায়।

     -দাদা কতজনের পরে? খদ্দেরদের একজন জিঙ্গাসা করে।
     কার্তিক বুঝতে পারে না, মানে?
     -কতজনের পরে লাইন? আমি এখনও... লোকটা এটিএমের লাইনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে গোনে, তা জনা পচিশেক তো হবেই। এক ঘণ্টার বেশি হল এসেছি, ব্যথায় পা টনটন করছে।
     -এতক্ষণ তো লাগার কথা নয়!
     লোকটা রহস্যময় হাসে, বুঝলেন না! তিনটে এটিএম কার্ড এনেছি। একবারে একটার বেশি তো তুলতে দিচ্ছে না। দুবার তোলা হয়ে গেছে। দাদার কটা?
     -আমি এটিএমে আসিনি, চা খেতেই এসেছি।
     পাশে বসা অন্য লোকটি এবার মুখ খোলে, সে তো বটেই, ঘরে স্টক থাকলে খামোকা লাইনে দাঁড়াবেন কেন! সমস্যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের। যাদের কালো টাকা আছে, এ শহরের রহিস আদমি, তাদের একজনকেও দেখেছেন ব্যাঙ্ক কিংবা এটিএমের লাইনে। সব ব্যাঙ্কের পেছন দরজা দিয়ে ব্যবস্থা করে ফেলেছে।
     -আপনার কত ছিল?
     -কত আর, সামান্য। আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীর কাছে নগদ বেশি তো থাকে না। সব মিলিয়ে লাখ ছয়েক মতো হবে। প্রথম দুদিনেই ব্যবস্থা করে ফেলেছি।
     -বলেন কী! প্রথমজন শিউরে উঠল যেন, আমি তো মাত্র বাহান্ন হাজার নিয়েই হিমশিম খেয়ে গেছি। শেষ পর্যন্ত যা হোক একটা ব্যবস্থা করতে পেরেছি।... আপনার কত ছিল? শেষ প্রশ্নটা এবার কার্তিককে উদ্দেশ্য করে।
     সবে দু চুমুক খেয়েছিল, লোকটার প্রশ্নে থমকালো। পাশের ঝোলা ব্যাগটা কোলের উপর টেনে নিয়ে বলল, সঙ্গেই আছে।
     বাকি চাটুকু এক চুমুকে শেষ করে, পয়সা মিটিয়ে বেরিয়ে এল। আচমকা এমন আচরণে লোক দুটো ঘাবড়ে যায়। তখনই কিছু বলতে পারে না। আবাক হয়ে কার্তিকের চলে যাওয়া দেখে।

     জিভটা জ্বালা করছে। সেই সাথে একটা তেঁতো তেঁতো অনুভূতি। পুড়ে গেছে হয়তো। কার্তিক সোজা বাড়ি চলে আসে। টেবিলে খাবার ঢাকা দেওয়া আছে। অন্যরা নটা সাড়ে নটার মধ্যে খেয়েদেয়ে শুয়ে পরে। কার্তিকের খাবার ঢেকে রাখে তাঁর ঘরে পড়ার টেবিলে। কার্তিকের ফিরতে এগারোটা হয়ে যায়। টিউশানি থাকে। আজ সাহিত্য সভার জন্য সন্ধ্যার পরের টিউশানিগুলো কামাই করেছে।

     ঢাকা তুলে দেখল চারটে রুটি, আলু চচ্চড়ি আর একটা পাকা কলা। এক নজর দেখেই ঢেকে রাখল। খাওয়ার ইচ্ছাটাই চলে গেছে। ব্যাগ থেকে ছড়ার গোছাটা বের করল। এগুলো সব ফ্রেস কপি। সাহিত্য সভায় যাওয়ার জন্যে পরিষ্কার করে লেখা। প্রতিটি ছড়া আলাদা আলাদা এ/ফোর কাগজে। রাফ আছে খাতায়। লেখার জন্যে সে এখনও রুল টানা খাতা ব্যবহার করে। খাতাটাও টেনে বের করল। পৃষ্টাগুলো ছিঁড়ল। “সব পাঁচশ হাজারের নোট” ছড়াগুচ্ছ যেখানে লিখেছিল।

     কাগজগুলো হাতে নিয়ে উঠোনে বেরিয়ে এল সে। এগুলো এখন অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটছে। ভার বইতে ভালো লাগছে না আর। পকেট থেকে লাইটার বের করে একটা একটা করে আগুন ধরাতে লাগল। গোটা পাঁচ-ছয় পৃষ্টা যখন পোড়ানো হয়েছে, পাশের বাড়ির জানালা খুলে সোনার দোকান মানসদা উপহাস করে বলল, এখনই পুড়িয়ে ঠিক করছ না। পুরো ডিসেম্বর মাসটাই সুযোগ আছে, ব্যবস্থা একটা ঠিক হয়ে যেত। তাছাড়া আমি তো ছিলামই...।

     মানসদা কখন জানালা খুলেছে, কতক্ষণ তাকে লক্ষ করছে, কার্তিক জানে না। হয়তো আশেপাশের আরও অনেক বাড়ি থেকে গোপনে তাকে ফলো করছে। যে যার নিজের নিজের মতো করে ভেবে নিচ্ছে। কাল সকাল হওয়ার আগেই সারা দুনিয়া রাষ্ট্র হয়ে যাবে। গুজব ছড়াবে হাওয়ার আগে। তাকেও নানান জিঙ্গাসার সম্মুখীন হতে হবে। তেমন হলে কী উত্তর দেবে সে ঠিক করে ফেলে।

     কার্তিকের দিক থেকে কোন উত্তর না পেয়ে মানসদা এবার চিৎকার করে ডাকল, কার্তিক?
     এর পরেও ডাক না শোনাটা অভদ্রতা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উত্তর দিল, বলুন।
     -রাত দুপুরে এসব কী করছ?
     -পোড়াচ্ছি।
     -কেন?
     -না পুড়িয়ে উপায় নেই তাই।
     কাগজগুলো এখন দাউ দাউ করে পুড়ছে। কার্তিক খেয়াল করল, তার অনুমানই ঠিক। কোন বাড়ির ছাদে, কোন বাড়ির জানালায় নতুন নতুন আরও অনেক মুখ। হয়তো ঈর্ষায় পুড়ছে। পুড়তে লাগুক। জিভের জ্বালাটা এখন একটু কম বোধ হচ্ছে। মানসদা আর কোন প্রশ্ন করার আগেই তার কৌতূহল মেটাতে বলল, সব পাঁচশ হাজারের নোট।

গল্প : অমিতাভ দাস





সুবিমলের একদিন 


গত বছর এমনি এক জুন মাসের বৃষ্টিভেজা ভোর রাতে বাবাকে নিয়ে ছুটতে হয়েছিল । প্রথমে সরকারী হসপিটাল , তারপর বেসরকারী নার্সিংহোম । আজকেও জুন মাসের বৃষ্টিভেজা শেষ রাত । এম্বুলেন্সে মাকে নিয়ে চলেছে সুবিমল নার্সিংহোমের দিকে । পথে অবিরাম বৃষ্টি । কখনো কম কখনো বেশী ।

মায়ের কষ্ট হচ্ছে । বুকে চাপ চাপ ব্যথা । এম্বুলেন্সে শুয়ে যেতে পারছে না ।শ্বাসকষ্ট হচ্ছে । একটু শুয়ে আবার বসছে  উঠে । বৃষ্টি জোরে নামল । সুবিমলের বাবা কাচ টেনে দিলেন । অথচ কেন যেন বৃষ্টিটা সুবিমলের ভালো লাগছে । অথচ তার ভেতরে একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে । এই মুহূর্তে সে প্রায় কপর্দক শূন্য ।  গত এক বছর ধরে তার টিউশান নেই । হাতে টাকা নেই । ধার করে চলছে । বাড়ির লোক জানেনা কীভাবে সে সংসার খরচ দিচ্ছে । জেনেও বা কী করবে ! সে লিখে , প্রুফ দেখে অন্য নানা ছোট- বড় কাজ করে সামান্য কিছু উপার্জন করছিল ।

এই রকম একটা ঘটনা তাকে যেন সমুদ্রে নিক্ষেপ করেছে । ভেতরে ভেতরে ভাঙন টের পাচ্ছে সে । তবু নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে । কান্না পাচ্ছে না , তবু মনটা ভারী হয়ে আছে সুবিমলের ।

রাস্তা দিয়ে শব্দ করতে করতে পৌচ্ছে যাচ্ছে এম্বুলেন্স । ভোর কেটে একটু একটু আকাশ পরিষ্কার হতে চাইছে যেন । বৃষ্টিটা একটু ধরেছে ।




ডাক্তার ডেকে বললেন , অবস্থা খুব খারাপ । ওখানেই ই সি জি , ইকো ইত্যাদি নানা পরীক্ষা করা হল । এমনকি দুদিন আগে করা ই সি জি রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বললেন , আরো দুদিন আগেই নাকি হার্টে একটা মাইনর এটার্ক হয়ে গেছে । অথচ ওদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বুঝতে পারেননি । অন্য অসুধ দিয়েছেন । যদিও কয়েক দিন যাবৎ জ্বরে ভুগছিল সুবিমলের মা । ডাক্তার জ্বরের চিকিৎসা করেছেন । এখানে ডাক্তার বললেন , আই সি ইউতে এখনি ভর্তি করতে হবে । চান্স ফিফটি ফিফটি । 72 ঘন্টা না গেলে কিছু বলা যাবে না । নন বেঙ্গলি ডাক্তার সুবিমলের বাবাকে ধমকের সুরে বললেন , আপ লোগ শোয়ে রাহে থ্যা ক্যায়া-- অব কিউ লায়ে-- বাঁচেগা কী মরেগা বোল নেহি সাকতা...


এসব বলে ডাক্তার চলে গেল । এবার প্রথম কান্না পেল সুবিমলের । গলার ভেতর কান্না জড়িয়ে আসছে । অনেক দূর থেকে বোন , বোনের বর চলে এসেছে । বোনকে দেখে যেন আরো বেশীই কান্না পেল তার ।

সুবিমল কাউকেই খবর দিতে পারেনি । বা দিতে ইচ্ছেও করেনি । কী দরকার মানুষকে বিব্রত করবার ! এই স্বভাব সংকোচ তার চিরদিনের । তবু মনে হল দু- চারজনকে বলা দরকার । তারপর মনে হল , আমার তো কোনো বন্ধু নেই । কারণ আমার ভ্রাম্যমান জীবন । ভাড়া থাকার সুবাদে আজ এখানে পাঁচ বছর , আবার অন্যত্র সব গুটিয়ে সাত বছর-- এভাবেই চলেছে ওদের জীবন । কোথাও থিতু হতে পারেনি । ফলত সেভাবে বন্ধুও গড়ে ওঠেনি । কম কথা বলা , লাজুক সুবিমল নিজের মতোই থাকে , ছাত্র পড়ায় । ক্লাব কালচার নেই , চাঁদা তোলা নেই , রকবাজি নেই । অবসরে বই পড়ে । ওইটেই তার নেশা ।

করব না করব না করেও সে দুচার জন অতি পরিচিত মানুষকে জানালো । তাঁরা যখন খবর পেয়ে ওর কাছে ফোন করছে , মায়ের কথা জানতে চাইছে , সুবিমলের তখন কেবল গলা আটকে আসছে । কথা বলতে পারছে না । যেন এখনি কান্না করে দেবে । সে কোনো কথা বলার মতো অবস্থায় নেই , তবু কথা বলতে হচ্ছে ।

অন্যদের নানা উপদেশ এখন শুনতে হচ্ছে । কেউ বললে , পাশে আছি । কেউ বললে , এখন তো তোমাকেই সব করতে হবে । চাপমুক্ত থাকো । কেউ বললে , একটু ব্যস্ত আছি  ভাই। পরে ফোন করব তোমায় । আবার কেউ বললে , অফিস থেকে একদম ছুটি নেওয়া যাবে না রে । কাকিমা কেমন আছেন ফোন করে একবার জানাস । কেউ বা বললে , প্রয়োজন হলে আমাকে ফোন করবেন ।

কেবল একটি অনুজ প্রতিম প্রাক্তন ছাত্র বললে , স্যার আমি এখনি আসছি । তবে সুবিমল তাকে কাজ ফেলে আসতে বারন করলে ।

এইজন্যেই সে অন্যকে ফোন করে বিব্রত করতে চায়নি ।  মনে হল , অকারণেই খুব বিব্রত করে ফেলেছি । নিজের কাছেই খুব গিল্টি ফিল করল ।




সুবিমলের কাকা , এলাকার বেশ নাম করা নেতা । উকিল মানুষ । সে দুপুরে চলে এলো , সঙ্গে বেশ কয়েকজন ছেলে । সুবিমল দেখে এসেছে বরাবর, নেতারা একা একা কোথাও যায় না । একটা দল থাকা চাই । নেতার সঙ্গে অনেকেই থাকে । সেইটেই হয়ত অলিখিত নিয়ম । না হলে লোকে নেতা বলে মানবে কেন ?তাঁরা যে সমাজসেবক । মানুষের পাশে পাশে থাকে । মানুষের কাছাকাছি তাঁদের বাস । মানুষের বন্ধু বলে কথা ।

সুবিমল মাথা নিচু করে বসে ছিল আই সি ইউ- এর বাইরে একটা চেয়ারে । গিয়েই তিনি হম্বি- তম্বি শুরু করে দিলেন । এখানে কেন আনা হল ? ঐ নার্সিংহোম ভালো ছিল । ওখানে আমাদের পার্টির ভোম্বলদা ছিল । ঐখানকার এম এল এ- কে একটা ফোন করলেই সমস্যা মিটে যেত । তোদের মেডিক্লেম নেই-- এত টাকা কে দেবে ? কীভাবে জোগার হবে ? ইত্যাদি ইত্যাদি ।

সুবিমল বললে , মেডিক্লেম করা আছে তবে এক বছর মাত্র করেছি । শুনেছি হার্টের সমস্যায় তিন বছর পলিসির বয়স না হলে ক্লেম পাওয়া যায় না , তাই চিন্তায় আছি ।

বিকেলে ভিজিটিং আওয়ারে সুবিমল মা- কে দেখতে গেল । মায়ের কথা বলা বন্ধ । মা- কে যে ঘরে রেখেছে সেটা খুব ঠান্ডা । মাথার ওপর এসি মেসিনটা । মায়ের গায়ে কম্বল । তিনি তাকিয়ে আছেন । কথা বলতে চাইলেন , পারলেন না । নার্স একজন এসে মানা করলে ।মা-কে দেখে খুব কষ্ট হল সুবিমলেন । সারা শরীরে নানা রকম নল । চারপাশে কত অত্যাধুনিক মেশিন- পত্তর । গলায় আর হাতে চ্যানেল করা হয়েছে । তিনি নীরবে তাকিয়ে আছেন সুবিমলেন দিকে । সুবিমল বললে , তোমার কিচ্ছু হয়নি , সব ঠিক হয়ে যাবে -- সামান্য সমস্যা ।

মাকে দেখে বাইরে বেরিয়ে বুকটা যেন মোচড় দিয়ে উঠল । কেমন যেন কান্না পেল । সে তো নিজেকে খুব শক্ত মনের মানুষ বলেই জানত । তাহলে ? এতটা আবেগ থাকাটা কী ভালো !  সে মনে জোর আনতে চাইল --- বাইরে বেরিয়ে এলো । ভিতরেই একটা চা- এর দোকান । একটা চা নিয়ে একটু আড়ালে গিয়ে বসলে । মনে পড়ল এই তো কয়েকদিন আগেই সে একটা স্বপ্ন দেখেছিল ভোর রাতের দিকে । ভয়ে জেগে উঠে ঢক ঢক জল খেয়েছিল । সারা শরীর ভিজে উঠেছিল ঘামে । দেখেছিল , সুবিমলের মা কাঁদছে । বললে , আমি মনে হয় আর বেশী দিন বাঁচব না । অথচ আরো কটা দিন বাঁচতে হবে । আমি মরে গেলে কে দেখবে তোকে । তোর যে খুব কষ্ট হবে রে...এই কথাগুলো শুনে স্বপ্নের ভিতর আধো অন্ধকারে কাঁদছিল সুবিমল । ওই স্বপ্ন সে আজো ভুলতে পারেনি ।

চা শেষ হয়ে গেছে । কাগজের কাপটা নিয়ে সে বসে আছে । মনটা আবার খারাপ হয়ে যাচ্ছে । সে কিছুতেই শক্ত হতে পারছে না ।বিস্ময়ে  ভাবতে থাকে স্বপ্ন তাহলে সত্যি হয় !!




বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয় । খুব ক্লান্ত সুবিমল । ভেতরে ভেতরে হিসেব কষে যাচ্ছে কীভাবে টাকা জোগার হবে । বোধহয় ওর মনের কথা বুঝতে পেরে ওর বোন এক কোনে ডেকে বললে , চিন্তা করিস না দাদা , টাকা ঠিক জোগার হয়ে যাবে । আমি হাজার পঞ্চাশ দিতে পারব । বোনের কথায় কিছুটা আশ্বস্থ হয় সুবিমল ।

এত সবের মধ্যেও সুবিমলের বাবার চিন্তা বাড়ির দুটো পোষ্য বিড়াল নিয়ে । তারা যে সারাদিন অনাহারে আছে । সুবিমলকে বললে , তুই চলে যা । তোর যা যা কাজ আছে কর । একটু রেস্ট নে । বাড়ি গিয়েই বিড়াল দুটোকে খাওয়াবি । পাড়ার কুকুর দুটোকেও কিছু দিস খেতে -- গেটের কাছে বসে থাকে । আর দেখ , টাকা পয়সা কীভাবে জোগার করা যায় -- মেডিক্লেমে যদি কিছু না পাই...

সুবিমল ইচ্ছে না থাকলেও চলে এলো সন্ধে সাতটা নাগাদ । রাতে বোন ফোনে বললে , মা এখন কিছুটা ভালো । ওষুধে রেসপন্স করছে । তবে ডাক্তার এখনো আশার কথা বলেনি । রাতে থাকতে বলেছে--- কখন প্রয়োজন হয় ।

তারপর কিছুটা থেমে বললে , কাকা খুব অসন্তুষ্ট তোর ওপর ।

-- কেন ?

-- কারণ তুই কেন চলে এসেছিস আগে ?

-- বাবা বললে যে...

--সে তো আমি জানি । ওঁর কিছু জুনিয়র উকিল ও আরো কয়েকজনের সামনে খুব বাজে ভাবে বললেন , কী রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলে ! মা হসপিটালে ভর্তি ছেলে চলে গেল রেস্ট নিতে । এদের বোধ- বিবেক আর কবে হবে !! এই যে পঞ্চু , তপা , লালু আছে--- আমাদের পার্টির ছেলে এদের কী দরকার থাকার -- তবু এরা আছে...আশ্চর্য ছেলে তো , চলে গেল বাড়িতে ঘুমুতে । কোথায় আট- দশ জন বন্ধুবান্ধব নিয়ে থাকবে , রাত জাগবে--- কখন কী দরকার হয়...এসব শুনে আমার  খুব খারাপ লাগল রে দাদা। কাকা সুযোগ পেলেই অন্যকে অপমান করেন । অসম্মান করেন ।

-- আমারো তো শুনে খুব খারাপ লাগছে রে...এসব তো সহ্য করতেই হবে । এও এক ভবিতব্য । জানিস তো ,ও এই রকম । বিপদে পড়েছি । নেতা মানুষ । এঁদের ছাড়াও তো চলে না । আজকাল জানিস তো পার্টিই শেষ কথা । রুলিং পার্টি । কিছু বললে চটে যাবে । তবে কাকিমাকে একদিন বলতে হবে যে কেন এই রকম ব্যবহার  করেন  আমাদের কাকা ।

ফোন রেখে দেওয়ার পর মন খারাপ হয়ে গেল সুবিমলের । সে সংবেদনশীল মানুষ । আহত হল কাকার এইসব কথা শুনে ।কী আর করবে-- কারণে- অকারণে কাকার সাহায্য ওদের নিতেই হয় ।

চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে সুবিমল । সে বুঝতে পারে ধীরে ধীরে তার কোনো বন্ধু নেই । কেউ নেই কিছু নেই । একটু একটু করে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে । সে ক্রমাগত একা থেকে আরো একা হয়ে যাচ্ছে । আবার এও ভাবছে , আজকাল কেই বা কার বন্ধু--- কোথায় বন্ধু --- নিকষ আঁধার--- কেবল গহিন অন্ধকার -- বাইরে ভেতরে , আজ সর্বত্র ই যেন ঘন নিঃসীম অন্ধকার ।


ভাবতে ভাবতে নীরব একাকী বিছানায় এই প্রথম বার বেশ জোরে শব্দ করে কেঁদে উঠল সে ।


অণুগল্প : কল্যাণ ভট্টাচার্য



কাসবের মা
ভারতীয় সেনাদের হাতে ধরা পড়েছে উগ্রপন্থী কাসব। বারবার ওর ছবি ফুটে উঠছে টিভি স্ক্রিনে। কাসবের মা জোর আর্তনাদ করে উঠলো। কাসব, কাসব বেটা........। পাকিস্তান থেকে সেই শব্দ আছড়ে পড়ল ভারতে। কাসবের বুকটা যেন একটু ধাক্কা খেল। নড়ে উঠলো। জ্ঞান হারালো কাসবের মা।



                                          দৃশ্য দুই


জ্ঞান ফিরলে জোর করে আবার টিভির স্ক্রিনে চোখ রাখে কাসবের মা। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ছুটছে হিংস্র কাসব। জোর চিৎকার করে উঠল কাসবের মা, ইয়ে মেরা বেটা নেহি হ্যায়। বো তো বহুৎ ছোটা হ্যায়। হাম তো উসে খিলোনা বন্ধুক খরিদকে  দিয়ে থে.......!

ভ্রমণ : অনুরঞ্জনা ঘোষ নাথ



দেবভূমি হিমাচল

"আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী "-এ শুধু কবির বাণী নয়, আমাদেরও মনের কথা।  --তাই যখনই শহুরে ক্লান্তি মাকড়সার মতো মনে মস্তিষ্কে জাল বুনতে শুরু করে তখনই মনপিউপা কখন যেন নিজের অজান্তেই রঙিন ডানা মেলে উড়বার দিন স্থির করে ফেলে।

এবার প্রজাপতিরা যাবে হিমাচলপ্রদেশ তথা  মনিকরণ -মানালি -রোটাং -ধরমশালা -ডালহৌসি আর পাঞ্জাবের অমৃতসর। ২২ অক্টোবর ত্রয়োদশীর দিন দুগ্গা দুগ্গা বলে বেড়িয়ে পড়লাম  তিনজনে (আমি, পতিদেব ও আমার ছেলে সুরম্য। ) আমরা ঠিক করেছি হাওড়া থেকে রাজধানী এক্সপ্রেস এ চেপে দিল্লী আর ওখান থেকে মারুতি dzire নামক যানে করে  শিমলার নিচে পরওয়ানু (পরমাণু )তে (কালকার কাছে )রাত্রি যাপন করে পরদিন মানালির দিকে যাবার পথে মনিকরণ দেখে নেব। আমি এর আগেও একবার মানালি গেছি দিদি জামাইবাবুর সাথে।  সেবার রোটাং যাত্রা স্থগিত করতে হয়েছিল শৈত্য প্রবাহ আর ধসের কারণে। মনিকরণও অধরা ছিল। তাই এবারকার যাত্রা নিয়ে ভীষণ রোমাঞ্চিত আমি।  রোমাঞ্চিত সঙ্গের সফরসঙ্গীর জন্যও -যার বয়স মাত্র পাঁচ বছর এবং যার অজানাকে জানার অচেনাকে চেনার আগ্রহে প্রতি মুহূর্তে করে চলা প্রশ্নবাণে আমাদের  যুগপৎ আনন্দিত ও অতিষ্ঠ করে তুলছে।

আমার চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী ট্রেনের বিনিদ্র রজনীতে কখনো গয়া কখনো মোগলসরাই, এলাহাবাদ কখনো বা কানপুর স্টেশন  দেখতে দেখতে পরদিন সকালে দিল্লী পৌছালাম। দিল্লীতে যে আমাদের চালিত করবে তার নাম করণ সিং ঠাকুর। পথে যেতে যেতে দেখছি চারদিকে সবুজের সমারোহ -তার বুক চিরে চলে গেছে highway-সেই highway তে হাই স্পিড এ চলছে আমাদের আধুনিক বাতানুকূল তৈলচালিত মারুতি কারখানার 'ইচ্ছে' ( 'dzire') যান হরিয়ানা থেকে হিমাচলের পথে -কখনো ব্রিজ কখনো পথ -খালি ক্ষেতে উড়ে যাচ্ছে সাদা বকের দল -কোথাও সবুজ কচি কচি গাছ  মাথায় সোনার মুকুট পরে সর্ষে নাম নিয়ে হাওয়ায় আন্দোলিত আবার কোথাও ইউক্যালিপটাসের সারি আর একগুচ্ছ ধাবা। সেখানকার একটাতেই মধ্যাহ্নভোজ সারা হল।  এখানকার বেশিরভাগ ধাবাই ভেজ,   যা অত্যন্ত আমিষপ্রিয় নাথ পরিবারের কাছে ভীষণ ট্র্যাজিক ব্যাপার।



পরওয়ানুতে পৌঁছতে বিকেল হল। শীতের শুরুর মতো হাল্কা ঠান্ডা এখানে। হিমাচল প্রদেশ ট্যুরিজম এর হোটেল শিবালিক এ রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা হয়েছে আমাদের। বেশ সুন্দর হোটেলটা যদিও একটু নির্জন প্রকৃতির।  হোটেলের বিস্তৃত ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে ডিনার করে ঘুম লাগালাম দুদিনের নিরবিচ্ছিন্ন যাত্রার ক্লান্তি দূর করার জন্য যা ছিল খুবই প্রয়োজনীয়। পরদিন সকালে রওনা দিলাম মণিকরণের উদ্দেশ্যে. বহুপথ, যানজট ইত্যাদি পেরোতে পেরোতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এলো।  হিমাচল প্রদেশের মান্ডি শহর থেকে একটা রাস্তা মানালির দিকে ও অপর একটি মনিকরণের দিকে গেছে অনেকটা 'v' আকৃতির মতো।  মান্ডি ছুঁয়ে মনিকরণ হয়ে আবার মান্ডি ফিরে মানালির পথ ধরতে হবে। আর একটু সকাল সকাল  বেরোলে ভালো ছিল -অনভিজ্ঞতার মাশুল দিলাম সন্ধ্যেয় পৌঁছে।  মণিকরণের আশপাশের দৃশ্যাবলীর সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করার নয়। মণিকরন হল উষ্ণ প্রস্রবণ।  এছাড়া এখানের মূল আকর্ষণ এখানকার গুরুদ্বার ও শিবমন্দির। কুলু জেলার ৪৫ কিমি উত্তর পশ্চিমে পার্বতী ঘাঁটিতে পার্বতী নদীর মধ্যে অবস্থিত হিন্দু ও শিখদের ধর্মস্থল মনিকরণ। সমুদ্রতট থেকে এর উচ্চতা ১৭৬০ মিটার। শীতে এখানে যখন বরফ পড়ে তখনও গুরুদ্বারের ভিতর উষ্ণ প্রস্রবনে স্নান করার মজা নেওয়া যায়। এর জলে বহুল পরিমানে গন্ধকের উপস্থিতি চর্মরোগ বাতজ রোগের ক্ষেত্রে কার্যকরী। চালের পুঁটলি বেঁধে এই জলে ফেলে সিদ্ধ করে ও এই জলে চা করে গুরুদ্বারের লঙ্গরে পর্যটকদের ক্ষুন্নিবৃত্তির তৃপ্তি সাধন করা হয়। শোনা যায় গুরুনানক ভাই মর্দানা ও পঞ্চ পেয়ারের সঙ্গে এখানে যখন  এসেছিলেন মর্দানাকে লঙ্গরের জন্য কিছু ডাল আটা চেয়ে আনতে বলেছিলেন। আর যেখানে তিনি বসেছিলেন তার সামনের একটা পাথর মর্দানাকে তুলতে বলেছিলেন, যখন মর্দানা পাথর তুলল ওখানথেকে গরমজলের স্রোত বেরোতে লাগলো যা আজও কায়েম আছে। অবশ্য অন্য একটি জনশ্রুতিও আছে গুরুনানককে নিয়ে এ সম্পর্কে। এতো গেল ঐতিহাসিক মত। হিন্দু পৌরাণিক মতে শিবপার্বতী এগারো হাজার বছর ধরে এখানে তপস্যা করেছিলেন। মাতা পার্বতী যখন জল ক্রীড়া করছিলেন তখন তার কানের দুলের মণি খুলে জলে  পড়ে যায় এবং ভগবান শিব নিজের কণাদের পাঠিয়েও তার খোঁজ পায়না। এতে ক্রুদ্ধ শিব তৃতীয় নয়ন খুলে ফেলেন, তাতে সমগ্র দেবতারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়েওঠেন। শেষে জানা যায় মণিটি পাতালে শেষনাগের কাছে আছে, শেষনাগ অনিচ্ছাসত্ত্বেও মণি দিতে বাধ্য হয়ে রেগে হুঙ্কার ছাড়লে এখানে গরম জলের ধারার সৃষ্টি হয় আর মণি ফেরত পেয়ে শিব পার্বতী খুশি হয়ে ওঠেন আর তখন থেকে  এর নাম হয় মনিকরণ। এখানকার পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক কাহিনীর মতোই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও আকর্ষণীয়। ক্রিস্টাল পাথরের টোপাজের ন্যায় আলোর বিচ্ছুরণ, সুন্দর বন্য ফুল লতাপাতা, শুকনো ফল এই স্থানকে স্বর্গীয় মহিমায় মহিমান্বিত করেছে যা থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম সন্ধ্যায় পৌঁছানোর কারণে।



যাহোক  আমরা যখন ওখানে পৌঁছে সিঁড়ি দিয়ে নামলাম দেখি উষ্ণ প্রস্রবনের গরম জল নদীর ঠান্ডা জলের সংস্পর্শে এসে ধোঁয়া নির্গত করছে। গন্ধকযুক্ত সেই বায়ুর ঘ্রাণ ছোটবেলাকার মায়ের ও প্রতিবেশিনীদের দেওয়া উনুনের ধোঁয়ার কথা মনে করিয়ে দিল।  পায়ে হাঁটা লোহার ব্রিজ পেরিয়ে পৌঁছালাম বিশালায়তন গুরুদ্বার  এ। এখানে রয়েছে উষ্ণ প্রস্রবনের জল বয়ে যাওয়া স্নানাগার। পুরুষ মহিলা ভিন্ন ব্যবস্থা। রয়েছে হট কেভ -যার অনেকগুলো ঢোকার মুখ আধুনিক টালি দিয়ে বাঁধানো।  প্রবেশপথগুলো খুব ছোট ও নিচু  হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়। ভিতরটা অবশ্য আলোকিত বাল্বের আলোয়।


এরপর গুরুদ্বার এর মূলমন্দির ও শিবমন্দির দর্শন করে ফিরতে ফিরতে মনস্থির করলাম  যদি কখনো জীবন ফের এখানে আসার সুযোগ দেয় তাহলে আমি শুধু মনিকরণেই আসব এবং ৫-৬ দিন এখানের উষ্ণ প্রস্রবনে বসেই কাটিয়ে দেব -যত রোগ জরা ব্যাধি দূর হয় কিনা দেখবো। বেশ মনোকষ্ট নিয়েই ফিরতি পথ ধরলাম মানালির। বেশ সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছিলো তখন আর অন্ধকারের বুক চিরে আলো ফেলে  দ্রুত ফিরে চলা গাড়িতে একটু যেন ভয়ই করতে লাগলো। ইষ্টনাম জপতেজপতে অভিজ্ঞ চালকের দক্ষতায় রাত নটা নাগাদ পৌঁছলাম মানালির মাল রোডের ওপর হিমাচল ট্যুরিজম এর অপর একটি হোটেল কুনজুম- এ।

পরের দিন ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যেতে একা একা বেড়িয়ে পড়লাম মানালির রাস্তায়। আমার ব্যাপক লাগে একা একা নতুন জায়গায় ঘুরতে। সকালের আড়মোড়া ভাঙা প্রকৃতিকে নিজের হাতের ছোঁয়ায় ডেকে তুলতে। দোকানে দোকানে উনুনের ধোঁয়া আর গরম চা, মানুষের পরিমিত আনাগোনা আর কাঁচা সোনারংয়ের সূর্যের হালকা তাপ এই শীতে আমায় মায়ের আদরের মতো করে জড়িয়ে ধরবে আর আমি তার ওম নিতে নিতে  পথ চলব -এ এক অনন্য সাধারণ অনুভূতি।


ঘুরতে এসে প্রকৃতির সৌন্দর্যের বিরল মুহূর্তের দৃশ্যাবলী বন্দি করি মুঠোফোনে। তাও কি পারি সব? যে আবেগ নিয়ে মনের চোখ দেখে মুঠোফোন কি পারে তা বন্দি করতে? তাই প্রানভরে দুচোখ দিয়ে অবাক অপুর মতো চলার পথের বাঁকে বাঁকে প্রকৃতির অদৃশ্যপূর্ব রূপ দর্শন করি আর যতটা পারি বেশি বেশি করে ভরে নিই স্মৃতির মণি কোঠায় যাতে বাড়ি ফিরে অনেকদিন পর কংক্রিটের কেজো জঙ্গলে দিন কাটাবার পর স্মৃতি রোমন্থনে পাই সেই সুন্দর পৃথিবীর স্পর্শ।  সেই  কারণেইতো বারবার ছুটে যাই উন্মুক্ত প্রকৃতির কোলে -অনেকটা গরমের বা পুজোর ছুটিতে ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে মামাবাড়ি যাবার মতো -কেউ পড়তে বলবেনা, বকবেনা, মারবেনা -অন্যায় প্রশ্রয় দেবে, খেলতে দেবে,মাঠেঘাটে বনবাদাড়ে ছুটতে দেবে,যেখানে সকালে ঘুম থেকে ওঠার তারা নেই, রাতে ঘুমোতে যাবার জলদি নেই... তাইতো আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার নিষ্পেষণে শেষ হয়ে যাওয়া জীবনটা নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃতি মায়ের ভালোবাসায়, মামাবাড়ির মতো উন্মুক্ত আকাশ, উদাত্ত পৃথিবীর মধ্যে।
এরপর আমরা মানালির আশেপাশে দর্শনীয় স্থানে এলাম।  ঘন পাইনের বনে অবস্থিত হিড়িম্বা দেবীর মন্দির। কীরকম ভয় ও ভালোলাগার মিশেল ঘটেছে এখানে। দারুনির্মিত মন্দিরের কারুকাজ সমঝদারের আকর্ষণ উদ্রেক করে। মোটা মোটা বড়ো বড়ো খরগোশ দেখলাম যা কয়েকজন হিমাচলী মহিলা পর্যটকদের হাতে দিয়ে ফটো তুলতে বলছে। সত্যি খরগোশ গুলো খুব মজার। ওখানে হিমাচলী পোশাক পরে ছবি তোলারও ব্যাবস্থা রয়েছে এবং আমরা তা গ্রহণ ও করলাম। চমরিগাইয়ের ও দেখা মিললো। ওমা ! দেখি সেও pose দিয়ে ফটো তোলার জন্য একদম রেডি। এখান থেকে বশিষ্ঠ মন্দিরের শিল্প  স্থাপত্য দেখে আমরা চললাম মানালি ক্লাব হাউস এর দিকে। ওখানে সুরম্য ও সুমন বোটিং করলো আর চারপাশটা একটু ঘুরে আমরা হোটেলে ফিরে লাঞ্চ সেরে একটু মানালির ম্যাল এ ঘুরে বেড়ালাম। আমরা মাল রোডে থাকাতে হোটেল থেকে নেমেই দোকানে চলে যাচ্ছিলাম -নানারকম জিনিসের পসরা নিয়ে বসা দোকানগুলো ঝলমল করছে আলোতে,  জিনিসে, মানুষে. অনেকরকম আকৃতির ছোট ছোট রবার প্যাকেটবন্দি (২০-৩০ টাকা থেকে শুরু )দেখলাম। দেখে বেশ মজাও লাগল যে কতরকম বাহার তাদের।  তার কিছু দোকান ছেড়ে আমাদের ঝুলিতেও এলো।  নানারকম পঞ্চু শাল সোয়েটার তথা শীতপোশাকের মেলা -ইচ্ছে থাকলে তার কিয়দংশ আপনার ঝুলিতেও স্থানান্তরিত হতেও পারে কি বলেন !
পরের দিন রোটাংপাস। সকাল সকাল রেডি হয়ে চললাম করণের সঙ্গে সেই পথে। মনে মনে রোমাঞ্চ হচ্ছে। আবার ভয়ও হচ্ছে। আগেরবার 'মারি ' পর্যন্ত গিয়েছিলাম (মিশণ রোটাংপাস  আনসাকসেসফুলই ছিল)। তবে ওখানে এত শৈত্য প্রবাহ ছিল যে ভালো করে গাড়ি থেকে নামাই যাচ্ছিলোনা। তবে এবার রয়েছে রৌদ্রকরোজ্জ্বল আবহাওয়া। তাকে সফরসঙ্গী করে হিমালয়ের রূপ দেখতে দেখতে চলতে লাগলাম উঁচু থেকে উঁচুতে। পথে বরফাবৃত পর্বতে ওঠার উপযুক্ত পোশাক পরে নিতে হল যা ভাড়ায় পাওয়া যায়।  পোশাক পরিহিত আমাদের দেখে মনে হচ্ছিল এখুনি বোধয় রকেটে চেপে মহাকাশচারীর মতো মহাকাশে পাড়ি দেব। মারি পর্যন্ত যখন এসে পৌঁছলাম ততক্ষনে সবুজের সমারোহ শেষ হয়ে কোথাও ধূসর কালো কোথাও বরফের মুকুট মাথায় নিয়ে পর্বতেরা আমাদের চারদিক আলো করে দাঁড়িয়ে। করণ বললো আরকিছুদিনের মধ্যেই সবটা অ ঞ্চল বরফে ঢেকে যাবে এমনকি মানালীতেও বরফ পরে যেখানে আমরা কাল কতো ঘুরলাম। পথে যেতে যেতে এবার দেখা মিললো তরল ঝর্ণা  ও বরফ হয়ে যাওয়া স্ফটিকাকৃতির সুন্দর ঝর্ণার। আরো যত উপরে উঠতে লাগলাম দেখি পর্বতেরাও শীতে সাদা বরফের চাদর গায়ে জড়িয়ে রাজার মতো সূর্যের ওম নিচ্ছে. গাড়ি থেকে নেমে দেখি চারদিকে বরফ আর বরফ !!অবাক করার মতো বিষয় এইযে সূর্যের এত তাপ ছিল যে ওই বরফের রাজ্যে দাঁড়িয়েও রীতিমতো গরম বোধ করছিলাম -টুপি খুলে আমি বরফের মধ্যে শুয়ে পড়েছিলাম। অসাধারণ সে অনুভূতি। আমার নিচে বিশাল  বরফাবৃত পর্বত ওপরে উন্মুক্ত  আকাশ -তাদের মাঝে প্রকৃতির এই অসাধারণ সৃষ্টির মধ্যে আমি এক নগন্য জীব শুয়ে আছি আর আমার মন সেইমুহূর্তের জন্য ঈশ্বরের কাছে নিজের জীবনের কাছে প্রণত হচ্ছে -এই অপরূপ ঘটনার সাক্ষি হবার সুযোগ পেয়ে সুধন্যা হবার জন্য।  মনে মনে বললাম "হে ঈশ্বর, হে প্রকৃতি তোমরা আমাকে ভালোবেসে আপন করে নিলে তোমাদের এই আতিথেয়তা আমি কোনোদিন ভুলবোনা -ভুলবোনা এ অবর্ননীয় অনুভূতি যা আমার মনের ও শরীরের অন্দরে কন্দরে রোমাঞ্চ জাগিয়ে তুলছে।'


ফেরার পথে পড়লাম যানজটে।  ওপরথেকে পাহাড়ের পাকদন্ডী বেয়ে সারিবদ্ধ গাড়ির লাইন দেখে মনে হচ্ছিল যেন সার সার পিঁপড়ে দাঁড়িয়ে আছে।পর্বতের মাথায় বরফের মুকুটে কাঁচাসোনা রোদের স্বর্ণাভ ঝিকিমিকি খেলা দেখতে দেখতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম স্বপ্নের রাজ্যে। দেবভূমিতে দেবতার বাস -সেইখানে নগন্য মানুষের পদার্পন -একথা ভাবতে ভীষণ ভালো লাগলো আর ভালো লাগতে লাগতে কেমন একটা ভালোলাগার আবেশ সারা মনে শরীরে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
মারি অবধি পৌঁছে দেখলাম তুষারপাত হচ্ছে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মতন -জীবনে প্রথম দেখা তুষারপাত মন ছুঁয়ে গেল -হাত পেতে রাখলাম আর হাতের তালুতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তুষারকণা এসে বসত জমাতে লাগল আর আমি ছোট্টশিশুর মতো অবাক কৌতূহলে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
পরেরদিন মানালি ছেড়ে ধরমশালা যাবার পালা। সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম -মানালি থেকে কুলু হয়ে মান্ডি ও কাংড়া উপত্যকার মধ্যে দিয়ে ধরমশালা যেতে হয়। মানালী ছাড়ার সময় কিছুদূর পার্বতী নদী আমাদের বিদায় জানাতে এসেছিল। কিছুদূর পর্যন্ত উপল খন্ডের উপর তার ফিরোজা রঙের স্বচ্ছ জলের নাচ দেখতে দেখতে আর মানালী রোটাংয়ের স্মৃতি মনে নিয়ে এগোতে লাগলাম। তবে এখানে সেই পথের দুধারে খালিমাঠ বড়ো ঘাস ছিল, bhuttico শাল কারখানার বিজ্ঞাপন ছিল একটু দূর দূর কুলু থেকে মানালি যাবার পথে তা আর দেখলাম না। বোধয় এটা অন্য রুট। ধীরে ধীরে কাংড়া উপত্যকায় যখন পৌঁছালাম তখন তার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনকে আপ্লুত করে দিল। পথের বাঁকে বাঁকে ঈশ্বর যেন সৌন্দর্য মুঠো মুঠো করে ছড়িয়ে দিয়েছে।  কোথাও উঁচু পাহাড়ে ঘন পাইনের অরণ্য কোথাও নিচে পাহাড়ী গাছের ঝাঁকড়া চুলো সার মাথা, কোথাও সারিবদ্ধ পাহাড় যেন লাইন দিয়ে স্কুলের প্রার্থনাতে যোগ দিয়েছে আর তার ওপরে মেঘ ও রৌদ্রের খেলা তাকে আরো আকর্ষনীয় করে তুলেছে। পাহাড়ের আড়ালে সূর্য চলে গেলে ঠান্ডা বোধ করতে লাগলাম আবার পাকদন্ডী পেরিয়ে নতুন পাহাড়ের পথে উঠলে সূর্য উঁকি দিলেই বেশ তাপ অনুভূত হতে লাগলো। সূর্যের টুকিটুকি খেলায় মনটা বেশ মেতে উঠলো।  আবার কোথাও দেখলাম সূর্যের আলোয় উপত্যকা ধুয়ে যাচ্ছে -নেমে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করল সেই ছোট্টবেলাকার বন্ধুদের হাত ধরে। এরকমই আরো আরো সুন্দর প্রকৃতিকে সাক্ষি করে পৌঁছে গেলাম ধরমশালা।

ধরমশালা পৌঁছে দেখলাম চারিদিকে ছোট ছোট দোকান আর বহু বিদেশী পর্যটকদের ভিড়। গাড়ি ধরমশালা ছেড়ে ম্যাক্লয়েডগঞ্জ এর দিকে এগোতে থাকলো -পথের দুপাশে যেমন প্রকৃতির অবারিত দান এখানে দেখলাম তেমনি দেখলাম এখানকার রাস্তাঘাট বেশ বাঁধানো সুন্দর ও ঝকঝকে। মনে হল কোন বিদেশে চলে এসেছি যেখানে পথঘাট এত সুন্দর।  এখানে গাড়ি থেকে পথে চলা এক নীলনয়না বিদেশিনীকে দেখলাম ধূসর কেশা ও ধূসর বেশা -তার চোখদুটি অপার মোহময় ও আকর্ষণীয় -যদিও একঝলক তাকে দেখেছিলাম কিন্তু তার সৌন্দর্য মনকে এমন বিদ্ধ করেছিলো যে আজও তাকে মনে করলেই যেন সামনে দেখতে পাই।

যাইহোক ধরমশালা হয়ে ম্যাকলয়েডগঞ্জ  এ পৌঁছতে সন্ধে হল। হোটেল ভাগসু তে (সৌজন্যে হিমাচল ট্যুরিজম )স্থান নিলাম। খুব সুন্দর হোটেল ঘরগুলো অর্ধচন্দ্রাকৃতি আকারে বসানো।  ঘরের লাগোয়া বারান্দার পাশেই ওপেন টেরেস -মাথায় ছাতাযুক্ত কালোরংয়ের টেবিল চেয়ারে সুসজ্জিত। তাকে ঘিরে ছোট গ্রিল এবং তার পরে অনেক বড় লন।  এখানে বেশ ঠান্ডা লাগছিলো।  ঘরটি খুব বড়  না হলেও সুসজ্জিত ও কাঠবাধাঁনো হওয়াতে বেশ আরামদায়ক। একটু ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম ম্যাকলয়েডগঞ্জ এর মূল বাজার চত্তরে। এখানে বহু তিব্বতি ও বিদেশিদের ভিড়। দোকানে দোকানে নানারকম শীতপোশাক,কেক প্যাস্ট্রি, পাথরের গয়না আর রকমারি রঙিন পাথরের পসরা। এখানে একটি তিব্বতি হোটেলে স্নাক্স হিসেবে মটন ও চিকেন মোমো খেলাম। ভিতর থেকে বেরোনো গলিত মাখনের যে সুস্বাদ ও সুঘ্রাণ তা ক্ষুধার্ত ভোজন রসিক বাঙালি  মানুষদের এমনভাবে সম্মোহিত করল যে রাধুঁনীটি প্রায় অপহৃত হয়ে কলকাতা পাড়ি দিচ্ছিল শুধু দলে ভারী নই বলে এই দুঃসাহসিক অভিযানটি ভবিষ্যতে করব বলে তখনকার মত মনস্থির করলাম !এবার চলল সামান্য কেনাকাটা আর কেক কেনার পর্ব।

এরপরের দিন সকালে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম দলাইলামা মন্দির দর্শনে। বিশাল বড় মন্দির মনকে শান্ত পবিত্রতায় ভরিয়ে দেয়। লামাদের সমোচ্চারিত গুরুগম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণে সমগ্র পরিবেশ স্বর্গীয় অনুভবে ভরে ওঠে। ওখান থেকে ফেরারপথে একটি হোটেলে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে করণের সাথে ভাগসু ঝর্ণা, ধরমশালা স্টেডিয়াম ও ভাগসু মন্দির দেখলাম। ওখানে একটি ঠান্ডা জলের সুইমিং পুলে লোকে নির্দ্বিধায় কিভাবে সাঁতরাচ্ছে দেখে অবাক হলাম।
পরদিন আমরা চললাম ডালহৌসির উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যে বেলায় পৌঁছে হোটেল আর্ক্- এ এলাম।  এই হোটেলের লিফটটি হোটেলের বাইরের দিকে থাকায় ওঠা নামার সময় প্রকৃতির সুন্দর দৃশ্যাবলীর সম্মুখ সাক্ষাৎ হবার বারংবার সুযোগ মিলল।

এখানথেকে পরদিন চললাম চাম্বা জেলার খাজিয়ার এর উপত্যকায়, এটি হিমালয়ের একটি বিরাট পার্বত্য উপত্যকা। ওখানে পৌঁছে সুবিস্তৃত গালিচার মতো  সবুজ ঘাসের বিস্তার দেখে মন আনন্দে ভরে উঠলো আর আমি একটা সুবিধামতো জায়গা দেখে ব্যাগপত্তর ফেলে ধুপ করে শুয়ে পড়লাম। বরবাবাজীবন যদিও "করো কি করো কি গিন্নি" বলে হাঁ হাঁ করে ছুটে এলো তবুও কাউকে পাত্তা না দিয়ে সেই সময় উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে কেমন যেন বিছিয়ে দিতে ইচ্ছে করল ঘাসের ঢালু জমিতে আপন প্রাণ প্রবাহিত করে দিয়ে ওই ঢাল বেয়ে গড়িয়ে চলে গিয়ে পৃথিবীর অন্দর মহলে ঘাসের সাথে মিশে যেতে  ঘাস হয়ে -মনে হল শুধু চোখ দিয়ে নয় পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে একে অনুভব করি -নিয়ে নি যতটা পারি সাপ্টে আপন স্মৃতিকোঠায় -আর সেথায় তারে  বন্দি করে রাখি জীবনভোর -ইটকাঠলোহার জেলখানার অধিবাসীদের এ কী অন্যায্য চাওয়া??

এখানে সুরম্য পড়েছিল হিমাচলী পোশাক আর কোলে ছিল ৩টি  কচি কচি খরগোশ ছানা -ওমা একদম হিমাচলী শিশু লাগছে ওকে। দেখলাম মিষ্টি ভেড়ার পাল তারা উপত্যকায় কচি ঘাসের জলখাবার খেতে এসেছে। সুরম্য ওদের দেখে কী খুশি, ওদের সঙ্গে কিছুক্ষন খেলার পর বায়না ধরল  যে ওদের একটাকে বাড়ি নিয়ে এসে পুষবে। ওকে থামানো মুশকিল হল, শেষে ধর্মতলা থেকে পরিষ্কার দেখে ছোট্ট একটা  ভেড়া ওর জন্য কোলকাতায় ফিরেই কিনে আনা হবে -এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে তবে তিনি ক্ষান্ত  হলেন। সেসব কথা ভুলে গেলেও আজও মাঝে মাঝে হিমাচল প্রদেশের কথা উঠলেই মনে করিয়ে দেয় যে, ওর ভেড়াটা এখনো কেনা হয়নি ! আর দুঃখ পেলে বা পড়তে ইচ্ছে না করলেই বলে যে ও  নাকি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে khajiar এ গিয়ে ভেড়া চড়াবে আর আমি আর ও নাকি ওখানেই থেকে যাব !!!

ডালহৌসি থেকে পরদিন আমরা পাততাড়ি গুটিয়ে চললাম অমৃতসরের পথে। পথে যেতে যেতে দেখলাম  ঘন ঝাউবনের মধ্যে ঝিকিমিকি সোনারোদের ঝিলিক-যেন লুকোচুরি খেলা -সেই ছোট্টবেলাকার মতো। যেন ঘন ঝাউবনের পরেই মিলবে আমার সেই রূপকথার রাজ্য -সেই ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী আর সোনার কাঠি রুপোর কাঠি রাজপুত্তুর কোটালপুত্তুরের দেখা -আর সেইসব না ফুরোনো গল্পগুলো -যার শেষ লাইনে এসেও মনের কোনে উঁকি দিত ওই একটাই প্রশ্ন -তারপরে? তারপরে? তারপরে? আজও সেই ঝাউয়ের বন দেখে ওই একটাই প্রশ্ন জেগে উঠছে -তারপরে? তারপরে? তারপরে? প্রকৃতির এই আলোছায়ার খেলা দেখতে দেখতে হিমাচল থেকে পাঞ্জাবে চলে এলাম। 'হাভেলি ' বলে একটি রেস্তোরাঁতে মধ্যাহ্নভোজ (লস্যি সহ )সেরে ওয়াঘা বর্ডার দেখতে গেলাম, যেখানে দুই দেশের সীমারেখা একই ভূখণ্ড কে খন্ড খন্ড করেছে...... কেন জানিনা মনে ভেসে উঠলো 'রিফিউজি 'নামক হিন্দি চলচ্চিত্রের সেই ঋদয়স্পর্শী  গানটি ---

"পঞ্চি নদিয়া পবনকে ঝোঁকে
কোই সরহদ না ইনহে রোকে,
সরহঁদে তো ইনসানো কে  লিয়ে হে,
সোচো তুমনে ঔর ম্যায়নে ক্যায়া  পায়া ইনসা হোকে "


ওখানে দুদেশের বর্ডারে নাচগান দেখলাম যাতে আমরা সাধারণ দর্শকরাও অংশগ্রহণ করতে পারলাম। অনুষ্ঠানটিতে দেশপ্রেমের চেয়ে চটুল হিন্দিগান ও হৈচৈ টাই বেশি আছে বলে আমার মনে হল।  আর দেশপ্রেমের স্লোগান বড্ডো আরোপিত লাগল।

এরপর চললাম অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির। জালিয়ানওয়ালাবাগ স্বর্ণমন্দির এর পাশেই অবস্থিত। যেখানে ইংরেজ শাসকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সাক্ষি বহনকারী দেওয়ালটি বুলেটের চিহ্ন বুকে নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে, আছে সেই মৃত্যু কূপ টিও যদিও আর তার চারদিক বাঁধানো। বাগটিও  সুন্দর  করে লালপাথর ও নানারকম পাতা বাহারি গাছে সাজানো। এর পাশে শ্বেত পাথর ও সোনায় বাঁধানো

স্বর্ণমন্দির তথা গুরুদ্বার এ প্রবেশ করলাম। চারদিকে পুকুর ও তাতে অজস্র বড় বড় রঙ্গিন মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে আর তার মাঝে উজ্জ্বল হয়ে আছে মন্দিরটি। পরিচ্ছন্ন নিয়মনিষ্ঠ পরিবেশে ঈশ্বরের ভজন মনে অপার্থিব অনুভূতি এনে দেয়। এখানকার শুধু মন্দির এর কারুকাজ  নয় মন্দিরের ভিতরের সিলিং ও টেবিল ফ্যান, ভজন গায়কদের হারমোনিয়াম ও মাইক্রোফোন সবই সোনায় বাঁধানো দেখে মুগ্ধ ও বিস্মিত হলাম। হালুয়া প্রসাদ সহ স্বর্ণ মন্দিরের স্বর্ণাভা মনকে পরিপূর্ণতায় ভরে দিল।

পরেরদিন ভোরে উঠে সূর্যসাক্ষি করে অমৃতসর কে বিদায় জানিয়ে পাঞ্জাব,  হরিয়ানা হয়ে দিল্লী ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে যখন আসলাম তখন ঘড়িতে দুটো। সন্ধ্যে ৬.৩০ এ আমাদের উড়ান। আনন্দ সহকারে এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে ঢুকে পড়লাম। এবার যে আমাদের ঘরে ফেরার পালা.....।










গল্প : মোজাফফর হোসেন






বাঁশিওয়ালা মজ্জেল


আজ এতকাল পর মজ্জেলের সাথে দেখা। যত দূর মনে পড়ে, ও মারা গিয়েছিল বছরপনেরো আগে, মে কি জুন মাসে। দিনটি ছিল ওই বছর সবচেয়ে গরমপড়া দিনগুলোর একটি। অবশ্য ওর সাথে আমার শেষ দেখা হয় ওর মৃত্যুরও বছরদুয়েক আগে। দু’বছর নিরুদ্দেশ থাকার পর আমাদের ব্যাঙগাড়ির মাঠে এক শ্যালো মেশিনের পাশে লাশটা মেলে। শরীরের কোনো অংশে কাটাছেঁড়ার দাগ ছিল না। লোকমুখে মৃত্যুর কত কারণ শুনেছিকোনো একটা ঠিক ছিল হয়তো, কিংবা কোনোটাই না। এ নিয়ে পরে কোনো উচ্চবাচ্য না হওয়ায় এর কোনো একটা ভার্সন আমাদের সত্য বলে মেনে নিতে হয়েছে। যেমন, আমাদের এক বাড়িতেই চারটা ভার্সন তৈরি হলো। বাবা বললেন, ‘সব সুময় মরার কারণ থাকবি, এমুনটা আশা করা ভুল।’ মা বললেন, ‘মৃগীব্যারাম, গরমে ওর সমস্যাটা আরু বাড়তুক।’ কাজের মেয়ে মুশির মা বলল, ‘জিনের দোষে মরিচে। ওমুন ধু-ধু ফাঁকা মাঠে একা মানুষ বাঁচে নাকি! দেকো গে তিষ্টা মিটাতি গিলো, অমনি গলা মটকি দিচে।’

আমি মেনে নিয়েছি দাদির ভার্সনটাদাদির ধারণা, মজ্জেল বাঁশিতে ফুঁ দিতে না পেরে দম আটকে মারা গেছে!

মৃত মজ্জেলকে দেখতে যেতে আমার মন সায় দেয়নি। ওর লুঙ্গির কোঁচরে বাঁশিটা গোঁজা ছিল, আর কিছু ছিল না সঙ্গেযারা দেখতে গিয়েছিল তাদের মুখে শোনা।


এভাবে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে দেখা হয়ে যাবে, ভাবতেই পারিনি। প্রথমটায় আমি ওকে চিনতে পারিনি। ওর বাঁশির সুর শুনে চেনা বলে আন্দাজ করেছিলাম মাত্র। মজ্জেলই আমাকে প্রথম চিনল, তাও চাঁদনি রাতে একসমুদ্র আলোয় আমার কাঁপা কাঁপা অবয়ব দেখে; অথবা হতে পারে আগে থেকেই ও আমাকে চিনতে পেরে অনুসরণ করছিল।

‘কী দাদাভাই, মিঠুন-কাট লাগবি নাকি?’ মজ্জেল বাঁশিটা মুখ থেকে নামিয়ে ওর সেই গালটানা হাসিটা হেসে বলল।

‘এখন আর তোমার মিঠুনের যুগ না। এটা হলো রণবীরদের যুগ- এক রণবীর সিং আর এক রণবীর কাপুর! ওদের অবশ্য তুমি চিনবে না।’ আমিও যথারীতি হাসতে হাসতে উত্তর দিলাম। আমরা পাশেই একটি গাছের গুঁড়ির ওপর দু’জন দু’দিকে মুখ করে বসলাম। ২০০৯ সালে আইলাতে সমুদ্রের শরীরের এদিকটাতে আরো কিছুটা জল ধরে, বেদখল হয় লোকালয়ের অংশবিশেষ, দু-একটা গাছের গুঁড়ি এখনো ভাটার সময় জেগে ওঠে।

‘তুমি এখানে যে?’ আমি জানতে চাইলাম।

‘গাঙের ধারে বসি বাপজানের কাছে সাগরের মেলা গল্প শুনছি। বাপজান শুনছে তার বাপজানের কাছে। সেই শুনছে আবার তার বাপজানের কাছে। চৌদ্দুপুরুষে কেউ সাগর দেকিনি। গাঙ শুকি খাল হলু, খাল শুকি খটখটি মাঠ। মরার আগে বাপজান আমার হাতখান ধরি বুলিলো, তুই দেখিস বাপ। তোর কাছে আর কিছুই আমার চাওয়ার নেই। মান্সে তার ছেলির কাছে কত কিছু চায়ছেলি ডাক্তার হবি, হাকিম হবি, মাতববর হবিদশ গাঁয়ির মানুষ তাকে মান্য করি চলবি। আমার বাজান চেইছিল, আমি সাগর দেখবু। গেল বছর একিনে এসিচি। তার আগে কক্সবাজারে ছিলাম।’

‘সমুদ্র তোমার ভালো লাগে?’ আমি আনমনা হয়ে জানতে চাই।

‘কি জানি! তয় ডাঙায় আর মন টেকে না। মনটা খালি তড়পায়। জল বড় মায়া ডাক ডাকে রে ভাই!’

‘বাঁশিতে একটু ফুঁ দাও না মজ্জেল। কত দিন জলের কিনারে বসে তোমার বাঁশি শোনা হয়নি। তুমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমাদের শান বাঁধানো পুকুড়পাড়ে বসে বাঁশি বাজাতে, আর আমরা তোমার পাশে গোল করে বসে তন্ময় হয়ে সেই বাঁশি শুনতামমনে পড়ে?’

মজ্জেল কোনো কথা বলে না। সমুদ্রের জলের মতো ওর চোখেও চাঁদের চিকন আলো গলে-মিশে একাকার হয়ে যায়। বাঁশিটা মুখে তোলে মজ্জেল। বাঁশি বাজায় চোখ বন্ধ করে, ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো একমনা হয়ে। সেই মজ্জেল, তেমনই আছে, তেমন সুরেলা বাজায় সে।

আমার বয়স যেদিন সাত দিন হলো, সেদিনই আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ। আমার আঁতুরে চুল ফেলার জন্যে মা ডেকেছিল। তপ্ত দুপুরে গোলাঘরের চালের তলে বসে আমার চুল কেটেছিল। আমি ছিলাম দাদির কোলে ধরা। শুধু আমি না, প্রথম চুলকাটা থেকে অনেক বড় হওয়া অবধি আমার চার ভাইয়ের চুল কেটেছে ও। গাঁয়ের প্রায় সকল আবালবৃদ্ধবনিতার চুল মজ্জেলই কাটত। গুরুদায়িত্ব বটে। আমার চুল কাটা শেষ হলে ও কাঁঠালের সার দিয়ে গরম ভাতে জল ঢেলে পান্তা বানিয়ে খেয়েছিল। ছেলের প্রথম চুল কাটা, মা বাড়ির পোষা মুরগির ঝালমাংস রান্না করেছিল, মজ্জেল খায়নি। ক’টা টাকা বকশিশ দিতে চেয়েছিল মা, তাও নেয়নি। বরাবরের মতো কেজিখানেক চাল গামছায় বেঁধে হাঁটা দিয়েছিল। এসব কথা আমার মায়ের মুখে শোনা। মজ্জেল যেদিন মারা গেছে বলে সংবাদ এল, সেদিন মা আমাকে দুঃখ করে কথাগুলো বলছিল।

কোনো এক শুক্রবারে জুম্মার আগে মজ্জেলকে বাড়িতে ডাকা হতো। আমরা পিঠাপিঠি দু’ভাই খালি-গা হয়ে বসে পড়তাম। মজ্জেল বাবার চাকু-কাস্তে ধার করা বেলিটে বালু দিয়ে তার খুর ধার দিত। আমরা বসতাম, মজ্জেল তার স্বভাবজাত ঢঙে জানতে চাইত, ‘মিঠুন না অমিতাভ?’ আমি বলতাম, মিঠুন। মেজো ভাইয়ের পছন্দ ছিল অমিতাভ। মজার ব্যাপার হলো, আমরা কেউই তখন অমিতাভ বা মিঠুনকে চিনতাম না। গাঁয়ে তখনো টেলিভিশন ঢোকেনি। আমার ধারণা মজ্জেলও দেখিনি। তবে সেই ধারণা ভুলও হতে পারেপাশের গাঁয়ে চুল কাটতে গিয়ে হয়ত কারো বাড়ি দেখে থাকতে পারে। কারণ পাশের গাঁয়ে তখন তিনটা টিভি আছে বলে আমাদের কাছে খবর ছিল। গাঁয়ে গাঁয়ে কাজিয়া বাঁধলে ওরা এই টেলিভিশন থাকা নিয়ে বড্ড বড়াই করত।

চুল কাটা হলে আয়নায় দেখতাম, দু’জনের চুল কাটার স্টাইল হুবহু এক। মজ্জেলের চুল কাটার ভ্যারিয়েশনটা ছিল ওর মুখেই, কাঁচিতে না। সারা গাঁয়ে একভাবেই চুল কেটেছে বড়-ছোট সবার। বৈচিত্র্য ছিল না ওর বাঁশির সুরেও। সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত একটানা একসুরে বাজত ওর বাঁশি। একসুরা হলেও বেসুরা ছিল না। প্রতিদিনই মনে হতো নতুন করে শুনছি, এমনই দরদ দিয়ে বাজাত ও।

‘চল একটু হাঁটি।’ বাঁশিটা মুখ থেকে নামিয়ে বলল মজ্জেল।

আমরা হাঁটতে থাকি।

‘আচ্ছা, রাত বিশেষ হয়নি, ওদিকটায় মানুষ যা আছে একেবারে কম না। এদিকটা এমন ফাঁকা কেন?’ আমি জানতে চাই।

‘আমি আছি বুলি!’ সরলভাবে উত্তর করে মজ্জেল। ‘রাতে বাতাসে বাঁশির সুর শুনি কেউ আসার সাহস পায় না। আমাকে তো আর কেউ দেখতি পায় না! ভয় দেখি বিশ্বজয়, বুঝলি দাদা?’ মজ্জেল বাঁকা হাসি হেসে বলে।

‘সেদিন তুমিও যদি কোনো ভয় ওদের দেখাতে পারতে, তাহলে তো আর তোমাকে ওইভাবে নিরুদ্দেশ হতে হতো না।’ বলি আমি।

মজ্জেল কোনো কথা বলে না। আনমনা হয়ে কী যেন ভাবে।

‘বিশ্বাস করো, আমি ওদের দলে কোনো দিনই ছিলাম না। সবাই একজোট ছিল বলে, আমি বিরোধিতা করতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, যদি বলো নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ, তবে আমার অপরাধ মেনে নিতে আপত্তি নেই।’ আমি মজ্জেলকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি।

‘সব বুঝি, দাদাভাই। তুমি আমার বাঁশির সুর ভালোবাসতি বুলিই তো আবার আমাদের ফের দেখা হয়িচে। আবার এত দিন পর আমি কারু জন্যি বাজাচ্ছি।’

‘তাহলে মাঝে এত দিন কার জন্যে বাজিয়েছ?’

‘অভ্যেসে। অভ্যেসে বাজাই এখন।’

‘নাকি নিজের জন্যে?’

‘হতিও পারে।’ মজ্জেলের নির্বিকার উত্তর। সমুদ্রের দিকে বোবাদৃষ্টি দিয়ে বাঁশিটা আবার তুলে নেয় সে।

আমাদের সবাইকে রাতে ঘুম পাড়িয়ে তবেই ঘুমাতে যেত। আমার ঘুম আসত একটু দেরিতে। মজ্জেল যখন হেঁটে হেঁটে বাঁশি বাজাতে বাজাতে গাঁয়ের ও প্রান্তে চলে যেত, তখন মনে হতো অন্য কোনো জগৎ থেকে ভেসে আসছে সুরটা। একবার মনে হতো, স্বপ্নের ওপাশ থেকে, আর একবার মনে হতো, মনের কোনো গোপন স্থান থেকে। ফজরের আযানের কিছু আগে বিশ্রামে যেত সে। প্রতিদিনই দেরিতে ওঠার জন্যে মা’র বকা শুনতে হতো আমাকে। মজ্জেলকে একবার বলেওছিলাম সে কথা। ও হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘আমি তো অত রাত পর্যন্ত বাজাইনি, দাদাভাই। এশার আযান হলিই আমার ফুঁ ফুরিয়ে যায় যে!’

বাতাস কমে আসার সাথে সাথে সমুদ্রের কণ্ঠস্বরে খানিক পরিবর্তন আসে। আমার এমন শান্ত-নীরব সমুদ্র দেখলেই বেশি ভয় করত। এখন অবশ্য আর কিছুতেই ভয় করে না। এখন এই অবস্থায় একভাবে টানা কিছুক্ষণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, সমুদ্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, যে শব্দটা আসছে, ওটা ওর নাক ডাকার শব্দ। আমি একটু একটু করে সমুদ্রকে বুঝে উঠতে শুরু করেছি।

‘গাঁটা মেলা বদলি গিচে, তাই না দাদাভাই?’ মজ্জেল বাজানো থামিয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘হুম। অনেক বদলেছে। বাড়ি বাড়ি লম্বা প্রাচীর উঠেছে, হুটহাট কারো বাড়ি যাবার জো নেই। বাড়ির মেয়েরা আর যখন-তখন বের হয় না। পাড়ার ছেলেরা এখন সীমান্তে ফেনসিডিলের কারবার করে। গাঁয়ে আগে মসজিদ ছিল একটা, তাও যেমন তেমন করে বাঁধানো; এখন অনেকগুলো মসজিদ উঠেছে, অট্টালিকার মতো, গায়ে গায়ে বৈদ্যুতিক ফ্যান লাগানো। মোড়ে মোড়ে সেলুন হয়েছে। আধুনিক সব মেশিনে চুল কাটা হয়।’

‘বাহ!’ এটুকু বলেই মজ্জেল থেমে গেল। কিছু একটা যোগ করতে গিয়ে করল না।

‘এখন বাড়ি বাড়ি টেলিভিশন, কত গান-বাজনা হয়, অথচ বাঁশি বাজানোর অপরাধে তোমাকে গ্রামছাড়া করা হলো। কোথা থেকে এসে সাফি হুজুর কি ফতোয়া দিল, আর অমনি গ্রামবাসী ঝাঁপিয়ে পড়ল। অথচ এই গ্রামবাসীই তুমি একরাত অসুস্থ হলে বাঁশি শুনতে পাবে না বলে বিচলিত হয়ে পড়ত। তোমার ত্বরিত চিকিৎসার ব্যবস্থা করত।’

‘একবার আমার গা-গরম কিছুতেই বাগে আসছিল না। মিনু কবিরাজ তার চিকিৎসা ফেল মেরি গেল দেকি পাবনার এক বড় কবিরাজকে ধরি এনিছেল।’ আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে যোগ করে মজ্জেল।

‘অথচ তোমাকে গ্রামছাড়া করার মিছিলে নেতৃত্বস্থানে ছিল সেই মিনু কবিরাজ। মনে পড়ে তোমার?’

‘সমুদ্র কত মহান দেখ দাদাভাই। একটা আস্ত জগৎ কেমন মায়ের মতোন মমতা দি পেটের ভেতর বেঁধি রেকিচে।’ প্রসঙ্গ বদলায় মজ্জেল।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে আরো একটা গুঁড়ি পেয়ে যাই। দু’জনের অখন্ড সময়, বসে পড়ি আগপিছ করে। মজ্জেলকে বাঁশিটা ধরতে আবারো অনুরোধ করি। সে ফুঁ দেয়। আমি চোখ বন্ধ করে অনুভব করি, বহুদূর থেকে ভেসে আসছে সুরটি। আমি বালিশ থেকে মাথা তুলে চেটেপুটে সমস্ত সুরটা উপভোগ করার চেষ্টা করছি। এটা ছিল আমার রোজকার কাজ। মজ্জেল বাঁশি বাজাতে বাজাতেই কোনো একগাছের গুঁড়িতে বসে কিংবা কারো বাঁশের মাচানে শুয়ে অথবা কারো বাঁধানো পুকুরে পানির ভেতর চাঁদের প্রস্থান দেখতে দেখতে রাতটা কাটিয়ে দিত। ঘরসংসারহীন মানুষ সে ছিল না। সে তখন আট সন্তানের বাবা- পাঁচ মেয়ে, তিন ছেলে। একটির সঙ্গেও তার চেহারার মিল নেই। মাঝরাতে মজ্জেলের বৌয়ের বিছানা থেকে একেকদিন একেক জনকে উঠে আসতে দেখা যেত বলে রটনা আছে। বছর বিয়াতো মজ্জেলের বৌ। যদিও গাঁয়েই বাড়ি, তবুও বেশ কয়েক দিন পর পর নিজের বাড়ি যেত সে। বাড়ি থেকে বের হতো দুকাঁধে দুই মেয়েকে নিয়ে। সব সময় দুকাঁধে দুজন থাকত, একজোড়া বড় হলে পিঠাপিঠি অন্য জোড়া আসত। মজ্জেল গভীর মমতা দিয়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খানিকটা সময় বা গোটা দিন কাটিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ত বাঁশি আর চুলকাটার সরঞ্জাম নিয়ে। সংসারে তার অবদান বলতে ছিল, ছেলেমেয়েদের জন্যে মাঝে-মধ্যে মুঠোভর্তি চার আনা দামের লজেন্স নিয়ে যাওয়া। বৌ মেজাজ খিঁচিয়ে তার অর্ধেক ফেলে দিত রান্নাঘরের ঝাঁপির ওপাশে গা ঘিন ঘিন করা কাদার ভেতর। ছেলেমেয়েরা সেটাই কুড়িয়ে পুকুরের পানিতে ধুয়ে পলিথিন ছাড়িয়ে অন্য ছেলেমেয়েদের লোভ দেখিয়ে দেখিয়ে চুষে বেড়াত। মজ্জেলের সেজো মেয়েটা আট বছর বয়সে বাগানে রক্তাক্ত অবস্থায় মারা যায়। রক্তাক্ত কেন হলো, সেটি নিয়ে গাঁয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। চেয়ারম্যান চোখ রাঙিয়ে সবাইকে চুপ করে দিল। মেয়েটিকে কোলে তুলে মজ্জেলের সেকি কান্নাওই প্রথম এবং ওই শেষ কাঁদতে দেখি তাকে। মজ্জেলের লাশ যেদিন পাওয়া যায়, ঠিক তার দিনসাতেক পরে তার বৌ এক পুত্রসন্তান প্রসব করে। অবিকল মজ্জেলের মতো দেখতে। গাঁয়ের মানুষ ভেঙেছিল শিশুটিকে দেখতে। আমিও গিয়েছিলাম। নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। এগার দিনের মাথায় মারা যায় শিশুটি। ভাবলাম কথাগুলো মজ্জেলকে বলি। আবার মনে হলোথাক, এত দিন বাদ সেসব কথা না তোলাই ভালো। আছি যখন, অন্য দিন আরো কথা পাড়া যাবে।

মজ্জেল বাঁশিটা মুখ থেকে নামিয়ে লুঙ্গির ভাঁজে গোঁজে। ‘আমাকে তুমি মাফ করি দাও দাদাভাই।’ মজ্জেল বলে।

‘তুমি তো কোনো অন্যায় করোনি আমার কাছে। ক্ষমা চাচ্ছ যে?’ জিজ্ঞেস করি।

‘জলের স্রোত যকুন তুমাকে টেনি নি যাচ্ছিল, তকুন আমি তুমাকে অনেক বাঁচানুর চেষ্টা করিচি। পারিনি। দেহহীন ইচ্ছাশক্তি বড্ড অকেজো।’

‘তোমাকে আর বলতে হবে না সেসব। এ কয় দিনে আমিও কিছুটা বুঝেছি।’

আমরা আর কেউ কোনো কথা পাড়ি না। সহসা যেন দুজন দুটো প্রাচীন বৃক্ষের ন্যায় অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হয়ে প্রায় কোনো ঘটনাকেই আর ঘটনা মনে না করে নির্বিকার বসে থাকি। মাথার ওপর দিয়ে রোজকার মতো পথ কেটে কেটে নিঃশব্দে বাড়ি ফেরে একথালা চাঁদ। সমুদ্র শেষবারের মতো পাড়ে আছড়ে পড়ে গুটিয়ে যেতে থাকে। ভাটা যে কেবলই ভাটা নয়, বিশাল সমুদ্রের ছোট হয়ে যাওয়ার চেষ্টা, সিসিফাসের সেই ব্যর্থ চেষ্টার নামান্তর তা আর কজনেই বা বোঝে!