Thursday, January 3

অণুগল্প : বাবলু কুমার ঘোষাল




গ্রহণ

মুস্তাফা শেখের খড়ের চালে আগুন দিয়েছে সনাতন। মুস্তাফার অপরাধ, ও  নামাজ পড়ে। সনাতন মণ্ডল সকাল-সন্ধ্যে ঠাকুর ঘরে ধূপ দেয়।

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে মুস্তাফাও সেই রাতে সনাতনের মাঠের ধানে আগুন ধরিয়ে দেয়।

সকাল থেকেই একজন ঘর হারিয়ে আর অন্যজন ভাত হারিয়ে রাগে কাঁপছে।

এদিকে শীতের সকালের মিঠে রোদে মুস্তাফার পোড়া ঘরের চাতালে মুস্তাফা ও সনাতনের পোষা নেড়ি কুকুর দুটো গা জড়াজড়ি করে ঘুমোচ্ছে।

গল্প : মলয় মজুমদার







জীবনচক্র

পোষ্টমর্টেম হয়েছে প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেছে । কিন্তু  এখনো বাসুর লাশ নিয়ে বাড়ি যেতে পারেনি বেলি। সকাল থেকে একের পর এক ঝক্কি সামলাতে সামলাতে বেলি ক্লান্ত । প্রাতঃকর্ম সেরে আসার পর থেকে দু’দন্ড দাঁড়ানোর সময় হয়নি । বাসুর মৃত্যুর খবরটা শুনে থ মেরে গিয়েছিল । কিন্তু সেটাও কয়েক সেনেন্ডের জন্যে । পুলিশের লোকগুলো যা তাড়া দিচ্ছিল । প্রথমে তো বলতেই চায়নি, কিসের জন্যে থানার বড়োবাবু ডেকেছে । দু’জনে কি গুজগুজ করে তারপর বলেছিল,’তোর মরদ কাল রাতে জেলের মধ্যে খুন হয়ে গেছে ‘। কথাটা যেন বেলির কানের পাশ দিয়ে গরম হাওয়ার টুকরোর মতো ধা করে ছুটে গেলো । মুহুর্তের মধ্যে যেন সব কিছু খানখান হয়ে গেলো জীবনের টুকরো টুকরো ইতিহাস গুলো । পড়ে যেতে যেতে কোন রকমে নড়বড়ে পিলারটাকে ধরে ফেলেছিল ।  এই সব কিছুই একটা মুহুর্তের ঘটনা । নিজেকে সামলে থানার লোকগুলোর সাথেই রওনা দিয়েছিলো,বড়োবাবুর সাথে দেখা করতে । তারপর থানা-বাড়ি -জেলখানা,সব শেষে এই হসপিটালে  ।

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এক সময় বেলি বসে পড়লো দেওয়ালে হেলান দিয়ে । চারিদিকে নোংরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে । মাছি ও মশাদের অবাধ চিৎকার । হসপিটালের সেই ওষুধের গন্ধ । এক সময় বেলীর বমি আসতো । সে বহু বছর আগের কথা । হলদিবাড়ির সেই বেলি তো কবে শেষ হয়ে গেছে সভ্যতার বিস্তারের সঙ্গে  । সাদাসিদে গ্রামের মেয়েটা কবেই তো হারিয়ে গেছে । এখন অনেক বেশি কর্কশ, কাউকে মা-বাপ তুলে গালি দিতে একটুও দ্বিধা হয় না ।

বেলি ধপ করে বসে পড়লো দেওয়ালে হেলান দিয়ে । লক্ষ্যও করলো না একটু দূরেই কোন এক টিবি রুগীর এক দলা থকথকে রক্ত-সহ থুতু ছড়িয়ে আছে । চোখটা বুজে আসছে । সকাল থেকে এক মুহুর্ত বিশ্রাম পায়নি । পেটে এক টুকরো দানা জোটেনি । থানা থেকে জেলখানা । সেখান থেকে সোজা হসপিটাল । বেলি পৌছানোর আগেই বাসুর লাশ পাঠিয়ে দিয়েছে হসপিটালে ।  বাড়ি পৌঁছে একটু বিশ্রাম নেবে ভেবেছিল । সে সুযোগ হয়নি । থানার ওসি ডেকে পাঠিয়েছে দু’বার । বেলি কাঁদবে স্বামীর শোকে না পুলিশ আর হসপিটাল করে বেড়াবে । বেলি বোঝে না । কখনো বুকটা ফেটে চীৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করেছে । কিন্তু কে শুনবে বেলির কান্না ? বেলি বাসুর বউ । মদের ঠেকের মালকিন । ডোমার মা । সকাল থেকে ডোমাও কিছু খায়নি । মায়ের সঙ্গে সঙ্গে থানা, জেলখানা, হসপিটাল করেছে । ডোমার চোখে জল দেখেছে কখনো ।কিন্তু নিজের বুকের ভেতর তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাকে চেপে রেখেছে । ও ভেঙে পড়লে , এই অবস্থায় কে দেখবে । আপন বলতে তো কেউ নেই, বস্তির অনেক লোক এসেছে । কিন্তু সব কিছু তো বেলিকেই দেখতে হবে । কালু আর  হাত-কাটা শঙ্কর, বাসুর সাগরেদ । দু’জনে ভেতরে গেছে লাশ নিতে । কাগজে সই-সাবুদ যা ছিল, সব করে এসেছে বেলি । সই তো না, আঙুলের ছাপ । এখন শুধু লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরা ।


নিশি যাপন
----------------

বাসুকে পুড়িয়ে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল ডোমাদের । ঘুম আসেইনি সারারাত । অনেকক্ষণ  বিছানায় এপাশ ওপাশ  করে বারান্দায় এসে বসেছে । রাস্তার আলো বেলিদের বারান্দাকে আলোকিত করে রাখে । সেই আলো-আঁধারের মাঝে বেলি একা স্মৃতিকে জারণ করে চলছে । বাসু নেই । আর কোনদিন ফিরবে না । কোনদিন মাতাল হয়ে এসে বেলির চুলের মুঠি ধরে বলবে না,”শালা খানকি , বেল করাতে এতোদিন লাগলো কেন , কোন নাগরের সাথে মারার ছিলি ।” বেলিও আর কোনদিন তার প্রতি উত্তর দিতে পারবে না । চুলের মুঠি ছাড়িয়ে বাসুর নাকে মুখে চড় চাপড় ও দিতে পারবে না । বলতে পারবে না, “তোর বাবা তো টাকার গাড্ডি রেখে গেছে , তাই দিয়ে তোর বেল করাবো, শালা ইতরের বাচ্চা । বউ এর গায়ে হাত দিস লজ্জা করে না ।” কিন্তু আজ সব কিছু শেষ । বেলি এখন একা । বেলির আর পুরুষ নেই । যদিও ডোমা আছে । কিন্তু সে তো সন্তান । মরদের উপর যে ভরসা করা যায় , সেই ভরসা কি আর মন থেকে ছেলের উপরে করা যায় !? একজন নারী পারে না । নারীর তো ভরসা সেই মরদে । যে তার শরীরকে ভোগ করেছে রাতের পর রাতে । যে তার গর্ভে সন্তানের বীর্য্য ঢেলেছে । যাকে দেখলেই পাড়ার লোক বলে,’ওই দেখ তোর মরদ এসেছে ‘ ।

বাসু নেই ভাবতেই গা টা কেমন ছমছম করে ওঠে । একটা অদ্ভুত বেদনা গ্রাস করেছে সারা শরীরে । এই সেদিনও যে মানুষটাকে কত গুলো পুলিশ তুলে নিয়ে গেলো মারতে মারতে । বাসু বলেছিল ‘চিন্তা করিস না , তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো ।’ কিন্তু বাসু আর ফিরলো না । লোকের মুখে শুনেছিল এবার বাসুর কপাল পুড়বে । এমন জায়গাতে হাত দিয়েছে । তাদের কাছ থেকে বেঁচে ফেরা মুশকিল । জেলে দেখা করতে গিয়ে বাসুকে বলেছিল । কিন্তু বাসু পাত্তা দেয়নি । বলেছিল ‘সব সেট হয়ে গেছে , তুই উকিলকে ধরে বেলের ব্যবস্থা কর তাড়াতাড়ি’ । বেলি বিশ্বাস করেছিল । কারণ এর আগেও তো কত  ঝামেলা , কতবার পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেছে । একবার তো পুলিশের মার খেয়ে রক্তবমি পর্যন্ত করে ফেলেছিল । তাও তো কিছু হয়নি । দু’দিন হসপিটাল থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছে । বেলও পেয়ে গেছিলো । কিন্তু এবার … । না কিছুই মাথাতে ঠিক নিতে পারছে না । একটা ঘোর ! একটা ঘোরের মধ্যে বেলির মাথায় চিন্তার স্রোতে ভেসে বেড়াচ্ছে । কিছু যেন মেলাতে চায়ছিল বেলি । কিছু একটা । কি সেটা সে নিজেও জানেনা । কিন্তু হিসাব মেলানোর চেষ্টা বেলিকে এক ঘোরের মধ্যে ঢেলে দিচ্ছিল । আর স্মৃতির বিবর্ণতা মাঝে মাঝে বেলির মাথায় এসে আবার হারিয়ে যাচ্ছিল ।  কখনো চিন্তাগুলো যেন খেই হারিয়ে ফেলছিল । স্মৃতির পাতাতে কত কি আছে এই পনেরো বছর বিবাহিত জীবনে । সুখ ও দুঃখে মেশানো সব স্মৃতি । প্রথম দেখা থেকে শুরু করে আজকের এই দিন পর্যন্ত সব কিছু বেলি ধরে রাখতে চায় । তবে সুখের স্মৃতি কেমন যেন ফ্যাকাসে । মনে আসে কিন্তু সেই মনের ক্যানভাসে অবয়ব নেয় না ।  আবচ্ছা অন্ধকারের মধ্যে সেই গুলো পড়ে থাকে । অপরিস্কার কিছু আলো সেগুলো লুকিয়ে রাখে মনের গভীরতম উঠোনে ।


তের দিন পার করে চোদ্দদিন । দিন কেটে গেছে শ্রাদ্ধও সম্পন্ন হয়ে গেছে । একদিন হাউমাউ করে কেঁদেছে বেলি । পাগলের মতো কেঁদেছে । সেই কান্নাটাই জীবনের সব জ্বালাকে যেন নির্মূল করে দিলো । তারপর থেকে বেলি শান্ত । বুকের ভেতর জমাট ব্যথা আর উপোভোগ করে না । শুধু স্মৃতিগুলো বাম পাশে এসে চিন চিন করিয়ে দিয়ে চলে যায় । তখন কিছু সময়ের জন্যে স্তব্ধ হয় । তারপর সব স্বাভাবিক । এরই নাম জীবন ।কেউ থাকলে, তাকে ছাড়া বাঁচা যায় না । কেউ চলে গেলে তবু মানুষ বেঁচে থাকে । এটাই মানুষের বেঁচে থাকার গল্প । হলদিবাড়ি লোকাল ট্রেনের কামরা থেকে বাসু সঙ্গে যে যাত্রা শুরু করেছিল । সেটা শেষ হয়ে গেছে  । এখন বেলির যাত্রা পথ একার । ছেলে ডোমা , সেও তো বাপেরই মতো । তেরো বছর বয়স । এরই মধ্যে শিশুদের জেলের ভাত খেয়ে এসেছে । বাপের থেকে একটু বেশি বেপোরয়া । বাপটা তবু কিছু লোককে সমীহ করে চলতো । কিন্তু ডোমা , কাউকে পাত্তা দেয় না । বুঝতে পারে না বেলি - কিসের এতো রাগ । যেন লাগামহীন হয়ে গেছে ডোমা । বেলির দিকে তাকিয়ে দেখে না কখনো । এক ধরনের হিংস্রতা সব সময়  মুখে ফুটে ওঠে  । বেলির ভয় করে ডোমার চোখের দিকে তাকাতে । কেন কে জানে । একটা ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা ডোমার চোখে । তবে কি বাপের বদলা নেবে ? কে জানে । বেলি জানে না । বোঝে না ।  আগে কিন্তু এমন ছিল না ।  আগে কথা শুনে চলতো । কাস্টমারের কাছে ডোমা ভীষণ প্রিয় ছিল । ভালোবেসে কতো লোক দশ বিশ টাকা ডোমাকে দিয়ে যেতো ।  এখন সব কিছু উলটো হয়ে গেছে ।  


ছয় মাস আগের কথা
------------------------------

বাক্সটা প্রায় খুলেই ফেলেছিল ডোমা । বেলি এক ঝটকায় কেড়ে নিলো,  ডোমা কিছু বলার আগেই দু’চার ঘা পিঠে দিয়ে বসলো বেলি । ডোমাও কম যায় না, বিড়বিড় করে খিস্তি দিয়ে বসলো , ‘শালা কুত্তি ‘ । বলেই দৌড়ে চলে গেলো বাড়ির বাইরে । বাড়ি মানে রেলের ঝুপড়িতে গজিয়ে ওঠা উদ্বাস্তু কলোনী । দশ বাই দশ থেকে অনেকটা বড়ো ঘর,ঘরের ভেতর দিয়ে আর একটা ঘর ।   উঠোনটা খুব ছোট নয় । বিঘত তিনেকের মতো । বারান্দা আছে ।বারান্দার পাশে ছোট্ট রান্নাঘর । বারান্দায় একটা বেঞ্চ ও কিছু টুল । সকালের দিকে সাজানো থাকে । দিন যত গড়ায় সব কিছু ছড়িয়ে পড়তে থাকে , এদিক ওদিক । উঠোনের এদিক ওদিক বোতলের ছিপি আর কাস্টোমারের আধ খাওয়া ছোলা বা বাদাম  অথবা চপের টুকরো । সারাদিনে বেলি বহুবার উঠোন পরিস্কার করে । কিন্তু পরিস্কার রাখতে পারে না ।  বেলির স্বামী বাসু । এখন জেলে । কিছুদিন আগেই বেলে বেড়িয়েছিল। কিন্তু কি কারণে বেল ক্যান্সেল হয়ে আবার জেলে । উকিল সেদিন বলছিল ,’সামনের মাসে ছাড়া পাবে ।’ খুনের কেস । সাথে আবার রেপের চার্জও আছে ।  কি সব যেন করেছে । উকিলটা একটা হারামজাদা, ঠিক করে কিছু বলে না । টাকা নেবার সময় ঠিক বুঝে নেয় ।
‘আরে ওই হারামী গেলি কোথায় , মালগুলো পৌঁছাতে হবে তো এন জে পি তে ।’ বেলির চিৎকারে ছেলে ফিরে আসে । ডোমার বয়স তেরো  ।   হলে কি হবে । একদম ঘাঘু । এখনি সব কিছু বুঝে গেছে ।

তুমি তো ছিনায় নিলা  হাত থেকে ।
ওটা কি এখানে খোলার জিনিস নাকি রে শালা । খুললে দাম দিবো নাকি ওই খানকির লোক । বলবে মালে জল আছে ।
ছেলে চুপ করে যায় । বুঝলো মা ঠিকই বলছে । এটা তো দেশী মাল না । একদম ‘ইমপোরট’ করা । নেপালের বর্ডার দিয়ে এসেছে ।  কাল্লুর মা নেপালে যায় । আজ সকালেই দিয়ে গেছে ।
      -  ঠিক আছে, আগে খেতে দাও তারপর যাচ্ছি ।
      - রান্না হয়নি, মাল ডিলিভারী করে আয়  আগে । উসকে বাত খানা মিলে গা ।
    - কিয়া বাত হ্যায় বেলি,  তেরি লেড়কা নে কিয়া বল রাহা হ্যায় । দ্বারভাঙ্গা রমণী  বিলাসী । বেলির প্রতিবেশী ।
     -  কুছ নেহি দিদি, জ্যাইশা বাপ, অইসি বেটা । কাম ধাম তো কুছ করতে নেহি । কুত্তা লোগকো খানা ঠিক টাইম পে চাহিয়ে ।
                    -   মেরা বন গিয়া হ্যায় । ইস উমর মে নেহি খায়েগা তো , মরদ নেহি বন পায়েগা ।
                -   মরদ বনকে কিয়া করেগা । জেল মে বৈঠেগা ।

এরপর কেউ কথা বাড়ায় না । দু’জনেই চুপ হয়ে যায় । ডোমা মাল নিয়ে বেড়িয়ে গেলো । বেলি উঠোন থেকে বারান্দায় উঠতেই মোবাইলের ঘন্টি শুনতে পেলো । পা চালিয়ে ঘরে ঢুকে যা ভেবেছিল তাই , উকিলের ফোন । ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে উত্তর এলো ,’প্রায় দশ হাজার লাগবে । টাকাটা ঠিকঠাক আনিস । আর বারোটার মধ্যে কোর্টে এসে পরিস । দেরি করবি না একদম ।’ বেলি, শুধু হা বলে ফোনটা রেখে দিল ।

টাকার অঙ্কটা শুনে বেলির মাথায় যেন বাজ পরলো । ভেবেছিল দু তিন হাজারেই হয়ে যাবে । এতো একবারে দশ হাজার । কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে দিয়েছিল । মনে মনে একটা কাচা খিস্তি দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় বেলি । উঠোনের এক পাশে দু জন বসে খাচ্ছে । একজন বারান্দার পাশে । টাকা যে নেই বেলির কাছে, তা নয় । কিন্তু সেটা তো মালের টাকা । বিকেলেই মহাজনকে দিতে হবে । ডোমা যদি মালের টাকাটা সাথে করে না আনে, পুরো হিসাবটা বরবাদ হয়ে যাবে । মোবাইল এর লকটা খুলে টাইম দেখলো । প্রায় এগারোটা বাজে । বারোটার মধ্যে কোর্টে যেতে হবে । সে একবার কাস্টমার দুটোকে তাড়া দিলো , ‘কি গো তোমাদের আর কতক্ষণ । আমাকে যে যেতে হবে কোর্টে ।’
কি বেলি , এই তো এলাম । এতো তাড়াহুরো করে কি মাল খাওয়া যায় ?
সে জানি নে বাপু । আজ আমার মরদের বেল হবার কথা । আমাকে যেতে হবে । টাকাটা দিয়ে দাও । তারপর খাও ।
কিছু বলছিল কাস্টমার টা সেদিকে কান না দিয়ে , ঘরে ঢুকে পড়লো । টিনের ট্র্যাঙ্কের একদম নীচ থেকে কড়কড়ে নোটগুলো বের করে বিছানায় নিয়ে বসলো । গুনে দেখলো । পুরোপুরি এগারো হাজার আছে । মহাজনকে সাত দিতে হবে । কিন্তু কি করে দেবে ? সব টাকা তো সেই উকিলের মুখে পুড়তে হবে । না হলে হারামজাদা কোন কথা শুনবে না ।

কাহা হ্যায় বেলি ? আজ কোরট মে জানেকা বাত থা না ?

বিলাসীর গলা । কাল বলে রেখেছিল । আগেই জানতো ডোমা থাকবে না । তাই বিলাসীকে সঙ্গে নিয়ে যাবে । যদিও তেমন কিছু না । তবে সাথে কেউ থাকলে মনে একটু বল পায় ।

হা । তু রেডি হো গিয়া । মেরা দো-মিনিট লাগেগি । উসকে বাত চলতে হ্যায় ।
ঠিক হ্যায় । জলদি চল । মেরোকো ভাট্টি মে জানা হ্যায় । মাল জাদা নেহি হ্যায় ঘরমে ।
লেকিন উকিল নে বারো বাজে জানে কে লিয়ে বোলা ।
কিতনা টেম লাগেগি । কুছ বলা কিয়া ?
নেহি
ঠিক হ্যায় কোই বাত নেহি । চলতে হ্যায় । বাদ মে দিখা জায়েগি ।

বারোটার আগেই কোর্টে গেটের কাছে এসে দাঁড়ালো বেলি ও বিলাসী । হাজার রকমের লোক আর তাদের মুখের হাজার রকমের ভঙ্গি । কেউ ঝিমোচ্ছে , কেউ বা উর্ধ্বশ্বাসে এদিক ওদিক ছোটাছোটি করছে । লোকে লোকারণ্য চারিদিক । কিন্তু বেলি জানে কোথায় গেলে পাওয়া যাবে উকিলের দেখা । সেদিকেই এগোতে এগোতে দেখতে পেলো, একজন উকিল দৌড়াচ্ছে আর তার পেছন পেছন এক মহিলা চটি হাতে ধাওয়া করছে । সেই মহিলার মুখ দিয়ে অভিশাপ আর কুৎসিত ভাষায় গালি । দু’একজন তাকে আটকানো চেষ্টা করছে ঠিকই, কিন্তু সেই মহিলার শরীরে যেন অসুরের শক্তি । সবাইকে ছিটকে ফেলে সেই উকিলের দিকে ছুটে যাচ্ছে । বেলির বেশ মজা লাগলো দৃশ্যটা দেখে । নিজের উকিলের চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠলো । কিন্তু সে দাঁড়ালো না । উকিলদের ঘরের দিকে পা ফেলে এগোতে থাকলো । পাশে বিলাসী । উকিলের নামটা খানি কিন্তু বেশ । চারুচন্দ্র মৈত্র । সবাই চারু উকিল  বলেই ডাকে ।

বেলীদের চারু উকিলকে খুঁজে পেতে দেরি হলো না । দেখে মনে হলো ওদের জন্যেই যেন অপেক্ষায় ছিল । মুখোমুখি হতে প্রথম কথা,’টাকাটা পুরো এনেছিস তো ‘? বেলি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে,  চারু উকিলের মুখে যেন শান্তি ফিরে এলো । বড়ো একটা দুঃশচিন্তার যেন অবসান ঘটলো । টাকাটা বের করে দিতে যাচ্ছিল বেলি । কিন্তু মাথা নেড়ে মানা করে বললো,’এখন তোর কাছেই রাখ । আমি যখন বলবো তখন দিবি ।

উকিলকে অনুসরণ করে ওরা হাঁটতে লাগলো । কোর্টের গারদের সামনে এসে দেখলো । বাসু চুপচাপ বসে আছে গারদের এক কোণে । বেলিদের দেখে উঠে দাঁড়ালো । উকিল কিছু বলার আগেই, প্রায় চিৎকার করে বেলীকে বললো,’মাগী এতো দেরি করলি ক্যান ?

কোথায় দেরী করলাম, উকিলবাবু যখন আসতে কইছ ,তখনি তো আইলাম । অতো চিৎকার করস কেনো ?

বাসু আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই গারদের সেন্ট্রীর লাঠির বাড়িতে বাসু চুপ হয়ে গেলো । উকিলের দেওয়া কাগজে সই করে আবার বসে পড়লো । উকিল বললো,’একটু পরেই তোলা হবে, বেশি কথা বলবি না । সরকারী উকিলের সাথে সেট করেছি । আশা করি বেড়িয়ে যাবে আজ । তবে একটু বেশি টাকা লাগবে । সরকারী উকিল তো, খিদেটা একটু বেশি । “ উকিলের কথা শুনে, বেলির বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘শালা আপনারই বা কিসে কম” ।

চারু উকিল চলে যেতেই বেলী ও বিলাসী দু’জনে গারদের কাছ থেকে সরে এসে দাঁড়ালো । ওই জায়গাটাই মানুষের ভীড়টা বেশী । গুমোট  ও আলো কম । গারদের ভেতর টিমটিম করে বাতি জ্বলছে । তাতে সব কয়েদীদের মুখ ঠিক করে দেখা যায় না । নাম ও নাম্বরে চেনা যায় । বাসুর নাম্বার কতো, বেলী জানে  না।


উকিলের ডাক পেয়ে এগিয়ে গেলো । বাসুকে গারদ থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে । আদালতে তুলবে । কোর্ট রুমে বেশ অনেক ভীড় । কত কালো কোটপরা লোকজন । চেঁচামেচিতে কেউ কারো কথা শুনতে পাচ্ছে কি পাচ্ছে না । বোঝা যায় না । সবাই চেঁচায় । সবাই কথা বলে । উকিল মহাশয় একদম সামনের সারিতে গিয়ে বসে পড়েছে । পাসে এক মহিলা উকিল । কি গুজুর গুজুর করছে , কে জানে ? বেলি আর বিলাসী ঘরের একদিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে লোকজন দেখে যাচ্ছে । বিচারক আসতেই  যারা বসেছিল উঠে দাঁড়ালো । বেলি চোখ শুধু মাত্র উকিলের দিকে । কি এতো কথা বলছে ওই মহিলার সাথে । ওই মহিলা তো সরকারী উকিল । এর আগেও দেখেছে বেলি । খুব চিৎকার করে । কাউকে কিছু বলতে দেয় না ।  সত্যি কি আজ বাসু বাড়ি ফিরবে ! কে জানে ? বিচারক বসে পড়তেই যারা দাঁড়িয়েছিল তারাও বসে পড়লো । কিছুক্ষণ পরে বাসুকে কাঠগড়ায় তোলা হলো । সেই মহিলা আর বেলির ভারাটে উকিল কি সব আংরেজি আর বাংলাতে বললো । কিছুটা শুনতে পেলো কিছুটা কানে এলো না । এই ভাবে অনেকখন কেটে যাবার পর, দেখলো বাসুকে নিয়ে পুলিস চলে যাচ্ছে । এবার বেলি এগিয়ে গেলো উকিলের দিকে ।

কি হলো । ওকে যে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে ।
বেল হলো না ।মানব অধিকার কমিশনের লোক জন পেছন থেকে কিছু করেছে । তার উপর আবার রেপ কেস ।
আপনি যে কইলেন টাকা দিলে বেল হইবো ।
উনি টাকা নেয়নি ।
তাহলে টাকা ফেরত দেন ।
দেওয়া যাবে না । অন্যখানে লেগেছে । পরে হিসাব দিয়ে দেবো ।

কথাটা বলেই উকিল চলে গেলো ।  অসহায় লাগছে বেলীর । আর কতোদিন কতবার এই রকম ভাবে আসতে হবে । বেলি জানে না । সব দিক দিয়ে লোকসান । টাকাটা গেলো । কিন্তু মানুষটা বাড়ি ফিরলো না । চোখ দিয়ে জল বেড়িয়ে আসতে চাইছিল । কিন্তু বেরোতে দেয়নি । আগে হলে এতোক্ষণে হাউমাউ করে কান্নাতে ভেঙে পড়তো । বিলাসী বুঝছিল বেলির মনের অবস্থা । কিন্তু কিছু করার মতো ছিলো না । তাই চুপচাপ বেলিকে প্রায় জড়িয়ে ধরে কোর্ট থেকে বেড়িয়ে এলো ।

কোর্ট থেকে বেড়িয়ে , নির্বাকভাবে বেলি হেঁটে চলছে । পাশে বিলাসী । কিন্তু দু’জনেই কেউ কথা বলছে না । বাড়ি খুব একটা দূর নয় । রেল লাইনটি পার হলেই বেলীদের বাড়ি দেখা যায় । কিন্তু রেল লাইনের কাছাকাছি আসতেই দেখলো একটা মাল গাড়ি ধীরে ধীরে পার হচ্ছে ।  মাল গাড়ি যেতে সময় লাগে । কতো বড়ো গাড়ি । কত কত মাল নিয়ে যায় । কোথায় যায় ? বেলি বা বিলাসী দু’জনের কেউ জানে না । তবে বাসু একবার মাল গাড়ির মাল  লুট করেছিল ।  এক সাথে অতোগুলো টাকা বেলি আগে দেখেনি । কয়েকটা বান্ডিল । তুলসীর পেটে তখন ডোমা । বেশ লাগছিল । বেলি বেশ আহ্লাদী মাখা গলায় বলেছিল,’পেটে যেডা এসেছে , সে আমাগো ভবিষৎ ভালো কইরা দিবো” । যদিও সে সব কিছু হয়নি । দু’দিন পরেই বাসুকে কিছু লোক তুলে নিয়ে গিয়েছিল । সাথে সেই টাকাগুলো ।   পরে জেনেছিল ওই লোকগুলো সিন্ডিকেটের  দাদা । রাজনীতি করে । বাসু ওদের দাবি  মেটায়নি। সিন্ডিকেটকে কিছু না দিয়ে, বাড়ি বানানো । দোকান করা । দাদা ট্যাক্স তোলা বা ডাকাতি করো । কিছুই সম্ভব তখনো ছিলো না, আজো নেই । আগে একজনকে দিলেই হতো । এখন তা হয় না । এখন অনেককে দিতে হয় । একি ঠেকে দু’তিনটে গোষ্ঠী । সবাইকে দিতে হয় ।  না দিলেই শুরু হয় যায় অত্যাচার । এসে প্রথমেই দারুর বোতলগুলো ভাঙবে । তারপর অন্য কিছু ।


বাসু মারা যাবার পাঁচ বছর পরের
-----------------------------------------------
একদিন
------------


কাস্টমাররা প্রায় সব চলে গেছে । এখন ঘড়িতে রাত একটা । দু’এক জন যারা এখনো খাচ্ছে । তারা এই রকম দেরি করে আসে প্রতিদিন । ডোমা বাড়ি নেই । কোথায় গেছে বেলি জানে না । কোনদিন বলে যায় না । মদের ব্যবস্যাতে মাথা ঘামায় না । যা কিছু করার বেলি একা করে । তাতেই সংসার চলে । বেলি বেঁচে আছে । ডোমা কখনো কোন টাকা দেয় না বেলির হাতে । তবে মাঝে মধ্যে বাড়ির বাজার করে আনে । দু’এক বার বেলির জন্যে শাড়ি এনেছে । স্বভাবে বাসুর জেরক্স কপি । কিন্তু বাসুর থেকে অনেক বেশি হিংস্র । দেখতেও সেই রকম হিংস্র । বাসু ও ডোমা এই দুজনই বেলির পৃথিবী । একজন চলে গেছে । আরেক জন আছে । কিন্তু তার দেখা পাওয়া যায় না । দু’বার জেলের ভাত খেয়ে এসেছে এরই মধ্যে । বেলি বসে আছে বারান্দায় । চোখে ঘুমের আবেশ । মাঝে মাঝেই চোখটা বুজে আসছে । কিন্তু ঘুমাতে পারছে । কাস্টমার আছে, ডোমাও বাড়ি ফেরেনি । কিছুটা গভীর ঝিমুনি এসে গেছিল, বুটের দুমদাম আওয়াজে বেলি ধরফর করে উঠে দাঁড়ালো । বুটের আওয়াজ ধীরে ধীরে কাছে আসছে । বেলি অবাক হচ্ছে এতো রাতে রেইড করতে তো পুলিশ আসে না । কারা এরা ? বেলির বাড়ির গেটটা ভেজানো ছিলো । এক প্রকার প্রায় লাথি মেরে ঢুকে পড়লো এক সাথে ছ’জন পুলিশ । প্রত্যেকের হাতে বন্দুক তাক করা । এই রকম ভাবে আগে কখনো দেখেনি বেলি পুলিশকে । এক প্রকার পুরো বাড়িটাকে ঘিরে ধরেছে । বাইরেও পুলিশের গলা । চিৎকার শুনতে পেলো ।কে একজন যেন বললো,’শুয়োরের বাচ্চাটা যেন কোন ভাবে পালাতে না পারে ।’ দু’জন পুলিশ বেলিকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকলো । মুখে অশ্রাব্য গালি । গালি গুলোর থেকে বুঝতে পারলো । এরা এসেছে ডোমার খোঁজে । কিন্তু বুঝতে পারছে না, ডোমা কি করলো যে এতো পুলিশ তার বাড়িটা ঘিরে ফেলেছে । একজন পুলিশ দুম করে বেলির গালে সপাটে চড় বসিয়ে বললো,’কোথায় তোর ছেলে ? শুয়োরের বাচ্চা কোথায় তোর ছেলে ?” যে দু’জন পুলিশ ঘরে ঢুকেছিল তারা বেড়িয়ে এসে বললো,’স্যার ঘরে নেই, ভেগেছে মনে হয় “।
শালা ভেগে যাবে কোথায় !
স্যার , বলবেন দয়া করে  কি করেছে ডোমা ।
শালী জানিস না , তোর ছেলে কি করেছে । এক মেয়েকে রেপ করে খুন করেছে । তোর ছেলে এবার গেছে । কেউ বাঁচাতে পারবে না ।
যে দু’জন বসে খাচ্ছিল । তারা যে কখন ভেগে গেছে বেলি দেখতে পায়নি । পুলিশ কিছুক্ষণ এদিক ওদিক সার্চ করে বেড়িয়ে গেলো । যাবার আগে অশ্রাব্য গালির ফোয়ারা বেলির উপর ছুঁড়ে দিলো । বেলি ধপ করে বারান্দায় বসে পড়লো কপালে হাত দিয়ে । শেষ পর্যন্ত সেই প্রায় একই ধরণের অপরাধ ডোমাও করে বসলো । বাসুকে জেলের ভেতর খুন হতে হয়েছিল । আবার ডোমাও একই পথে । কি করবে বেলি এবার । ঘুম চোখ থেকে উধাও হয়ে গেছে । শুধু একটা ভয় । অজানা ভয় বেলির বুকে আশ্রয় নিয়েছে । একটা উন্মাদ যন্ত্রণা বেলির শরীরকে গ্রাস করে ফেলেছে । মাঝ নদীতে কেউ যেন তাকে ছেড়ে দিয়েছে । আর সে হাবুডাবু খাচ্ছে । কোন কিনারা দেখতে পারছে না চোখ মেলে ।


-------------------------------------------------