Friday, May 10

চিরায়ত গল্প : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়



চিরায়ত গল্প : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় 





অতসী মামি
---------------


যে শোনে সেই বলে, হ্যাঁ, শোনবার মতো বটে!

বিশেষ করে আমার মেজমামা। তার মুখে কোনো কিছুর এমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা খুব কম শুনেছি।

শুনে শুনে ভারী কৌতুহল হল। কী এমন বাঁশি বাজায় লোকটা যে সবাই এমনভাবে প্রশংসা করে? একদিন শুনতে গেলাম। মামার কাছ থেকে একটা পরিচয়পত্র সঙ্গে নিলাম।

আমি থাকি বালিগঞ্জে, আর যাঁর বাঁশি বাজানোর ওস্তাদির কথা বললাম তিনি থাকেন ভবানীপুর অঞ্চলে। মামার কাছে নাম শুনেছিলাম, যতীন। উপাধিটা শোনা হয়নি। আজ পরিচয়পত্রের উপরে পুরো নাম দেখলাম, যতীন্দ্রনাথ রায়।

বাড়িটা খুঁজে বার করে আমার তো চক্ষুস্থির! মামার কাছে যতীনবাবুর এবং তার বাঁশি বাজানোর যে রকম উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনেছিলাম তাতে মনে হয়েছিল লোকটা নিশ্চয় একজন কেষ্টবিষ্টু গোছের কেউ হবেন। আর কেষ্টবিষ্টু গোছের একজন লোক যে বৈকুণ্ঠ বা মথুরার রাজপ্রাসাদ না হোক, অন্তত বেশ বড়ো আর ভদ্রচেহারা একটা বাড়িতে বাস করেন এও তো স্বতঃসিদ্ধ কথা। কিন্তু বাড়িটা যে গলিতে সেটার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, এ যে ইট-বার করা তিনকালের বুড়োর মতো নড়বড়ে একটা ইটের খাঁচা! সামনেটার চেহারাই যদি এ রকম, ভেতরটা না জানি কী রকম হবে।

উইয়ে ধরা দরজার কড়া নাড়লাম।

একটু পরেই দরজা খুলে যে লোকটি সামনে এসে দাঁড়ালেন তাকে দেখে মনে হল ছাইগাদা নাড়তেই যেন একটা আগুন বার হয়ে পড়ল।

খুব রোগা। গায়ের রঙও অনেকটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তবু একদিন চেহারাখানা কী রকম ছিল অনুমান করা শক্ত নয়। এখনও যা আছে, অপূর্ব!

বছর ত্রিশেক বয়স, কী কিছু কম? মলিন হয়ে আসা গায়ের রং অপূর্ব, শরীরের গড়ন অপূর্ব; মুখের চেহারা অপূর্ব। আর সব মিলিয়ে যে রূপ তাও অপূর্ব। সব চেয়ে অপূর্ব চোখ দুটি। চোখে চোখে চাইলে যেন নেশা লেগে যায়।

পুরুষেরও তা হলে সৌন্দর্য থাকে! ইট-বার-করা নোনা-ধরা দেয়াল আর উইয়ে-ধরা দরজা, তার মাঝখানে লোকটিকে দেখে আমার মনে হল ভারী সুন্দর একটা ছবিকে কে যেন অতি বিশ্রী একটা ফ্রেমে বাঁধিয়েছে।

বললেন, আমি ছাড়া তো বাড়িতে কেউ নেই, সুতরাং আমাকেই চান। কিন্তু কী চান?

আমার মুগ্ধ চিত্তে কে যেন একটা ঘা দিল। কী বিশ্ৰী গলার স্বর! কর্কশ! কথাগুলি মোলায়েম কিন্তু লোকটির গলার স্বর শুনে মনে হল যেন আমায় গালাগালি দিচ্ছেন। ভাবলাম, নির্দোষ সৃষ্টি বিধাতার কুষ্ঠিতে লেখে না। এমন চেহারায় ওই গলা! সৃষ্টিকর্তা যত বড়ো কারিগর হোন, কোথায় কী মানায় সে জ্ঞানটা তার একদম নেই।

বললাম, আপনার নাম তো যতীন্দ্রনাথ রায়? আমি হরেনবাবুর ভাগনে।

পরিচয়পত্রখানা বাড়িয়ে দিলাম।

এক নিশ্বাসে পড়ে বললেন, ইস! আবার পরিচয়পত্র কেন হে? হরেন যদি তোমার মামা, আমিও তোমার মামা। হরেন যে আমায় দাদা বলে ডাকে! এসো, এসো, ভেতরে এসো।

আমি ভেতরে ঢুকতে তিনি দরজা বন্ধ করলেন।

সদর দরজা থেকে দু-ধারের দেয়ালে গা ঠেকিয়ে হাত পাঁচেক এসে একটা হাত তিনেক চওড়া বারান্দায় পড়ে ডান দিকে বাঁকতে হল। বাঁদিকে বাঁকবার জো নেই, কারণ দেখা গেল সেদিকটা প্রাচীর দিয়ে বন্ধ করা।

ছোট্ট একটু উঠান, বেশ পরিষ্কার। প্রত্যেক উঠানের চারটে করে পাশ থাকে, এটারও তাই আছে দেখলাম। দুপাশে দুখানা ঘর, এ বাড়িরই অঙ্গ। একটা দিক প্রাচীর দিয়ে বন্ধ করা, অপর দিকে অন্য এক বাড়ির একটা ঘরের পেছন দিক জানালা দরজার চিহ্নমাত্র নেই, প্রাচীরেরই শামিল।


আমার নবলব্ধ মামা ডাকলেন, অতসী, আমার ভাগনে এসেছে, এ ঘরে একটা মাদুর বিছিয়ে দিয়ে যাও। ও ঘরটা বড়ো অন্ধকার!

এ-ঘর মানে আমরা যে ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। ও-ঘর মানে ওদিককার ঘরটা। সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এক তরুণী, মস্ত ঘোমটায় মুখ ঢেকে।

যতীন মামা বললেন, এ কী! ঘোমটা কেন? আরে, এ যে ভাগনে!

মামির ঘোমটা ঘুচবার লক্ষণ নেই দেখে আবার বললেন, ছি ছি, মামি হয়ে ভাগনের কাছে ঘোমটা টেনে কলাবউ সাজবে?

এবার মামির ঘোমটা উঠল। দেখলাম, আমার নতুন পাওয়া মামিটি মামারই উপযুক্ত স্ত্রী বটে। মামি এ-ঘরের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে দিলেন। ঘরে তক্তপোশ, টেবিল, চেয়ার ইত্যাদির বালাই নেই। একপাশে একটা রং-চটা ট্রাঙ্ক আর একটা কাঠের বাকসো। দেয়ালে এক কোণ থেকে আর এক কোণ পর্যন্ত একটা দড়ি টাঙানো, তাতে একটি মাত্র ধুতি ঝুলছে। একটা পেরেকে একটা আধ ময়লা খদ্দরের পাঞ্জাবি লটকানো, যতীন মামার সম্পত্তি। গোটা দুই দু-বছর আগেকার ক্যালেন্ডারেব ছবি। একটাতে এখনও চৈত্রমাসের তারিখ লেখা কাগজটা লাগানো রয়েছে, ছিঁড়ে ফেলতে বোধ হয় কারও খেয়াল হয়নি।


যতীন মামা বললেন, একটু সুজিটুজি থাকে তো ভাগনেকে করে দাও। না থাকে এক কাপ চাই খাবেখন।

বললাম, কিছু দরকার নেই যতীন মামা। আপনার বাঁশি শুনতে এসেছি, বাঁশির সুরেই খিদে মিটবে এখন। যদিও খিদে পায়নি মোটেই, বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি।

যতীন মামা বললেন, বাঁশি? বাঁশি তো এখন আমি বাজাই না।

বললাম, সে হবে না, আপনাকে শোনাতেই হবে।

বললেন, তা হলে বসো, রাত্রি হোক। সন্ধ্যার পর ছাড়া আমি বাঁশি ছুই না।

বললাম, কেন?

যতীন মামা মাথা নেড়ে বললেন, কেন জানি না ভাগনে, দিনের বেলা বঁশি বাজাতে পারি না। আজ পর্যন্ত কোনোদিন বাজাইনি। হ্যাঁ গা অতসী, বাজিয়েছি?

অতসী মামি মৃদু হেসে বললেন, না।

যেন প্রকাণ্ড একটা সমস্যার সমাধান হয়ে গেল এমনিভাবে যতীন মামা বললেন, তবে?

বললাম, মোটে পাঁচটা বেজেছে, সন্ধ্যা হবে সাতটায়। এতক্ষণ বসে থেকে কেন আপনাদের অসুবিধা করব, ঘুরে-টুরে সন্ধ্যার পর আসব এখন।

যতীন মামা ইংরেজিতে বললেন, Tut! Tut! তারপর বাংলায় যোগ দিলেন, কী যে বল ভাগনে! অসুবিধেটা কী হে অ্যাঁ! পাড়ার লোকে তো বয়কট করেছে অপবাদ দিয়ে, তুমি থাকলে তবু কথা কয়ে বাঁচব।

আমি বললাম, পাড়ার লোকে কী অপবাদ দিয়েছে মামা? অতসী মামির দিকে চেয়ে যতীন মামা হাসলেন, বলব নাকি ভাগনেকে কথাটা অতসী? পাড়ার লোকে কী বলে জানো ভাগনে? বলে অতসী আমার বিযে করা বউ নয়!—চোখের পলকে হাসি মুছে রাগে যতীন মামা গরগর করতে লাগলেন, লক্ষ্মীছাড়া বজ্জাত লোক পাড়ার, ভাগনে। রীতিমতো দলিল আছে বিয়ের, কেউ কি তা দেখতে চাইবে? যত স—

ত্রস্তভাবে অতসী মামি বললে, কী যা-তা বলছ?

যতীন মামা বললেন, ঠিক ঠিক, ভাগনে নতুন লোক, তাকে এ সব বলা ঠিক হচ্ছে না বটে। ভারী রাগ হয় কিনা! বলে হাসলেন। হঠাৎ বললেন, তোমরা যে কেউ কারু সঙ্গে কথা বলছ না গো!

মামি মৃদু হেসে বললে, কী কথা বলব?

যতীন মামা বললেন, এই নাও! কী কথা বলবে তাও কি আমায় বলে, দিতে হবে নাকি? যা হোক কিছু বলে শুরু কর, গড়গড় করে কথা আপনি এসে যাবে।

মামি বললে, তোমার নামটি কী ভাগনে?

যতীন মামা সশব্দে হেসে উঠলেন। হাসি থামিয়ে বললেন, এইবার ভাগনে, পালটা প্রশ্ন কর, আজ কী রাঁধবে মামি? ব্যস, খাসা আলাপ জমে যাবে। তোমার আরম্ভটি কিন্তু বেশ অতসী।

মামির মুখ লাল হয়ে উঠল।

আমি বললাম, অমন বিশ্রী প্রশ্ন আমি কক্‌খনো করব না মামি, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমার নাম সুরেশ।

সতীন মামা বললেন, সুরেশ কিনা সুরের রাজা, তাই সুর শুনতে এত আগ্রহ। নয় ভাগনে?


হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ইস! ভুবনবাবু যে টাকা দুটো ফেরত দেবে বলেছিল আজ! নিয়ে আসি, দুদিন বাজার হয়নি। বসো ভাগনে, মামির সঙ্গে গল্প করো, দশ মিনিটের ভেতর আসছি।

ঘরের বাইরে গিয়ে বললেন, দোরটা দিয়ে যাও অতসী। ভাগনে ছেলেমানুষ, কেউ তোমার লোভে ঘরে ঢুকলে ঠেকাতে পারবে না।

মামির মুখ আরক্ত হয়ে উঠল এবং সেটা গোপন করতে চট করে উঠে গেল। বাইরে তার চাপা গলা শুনলাম, কী যে রসিকতা কর, ছি! মামা কী জবাব দিলে- শোনা গেল না।

মামি ঘরে ঢুকে বললে, ওই রকম স্বভাব ওঁর। বাক্‌সে দুটি মোটে টাকা, তাই নিয়ে সেদিন বাজার গেলেন। বললাম, একটা থাক। জবাব দিলেন, কেন? রাস্তায় ভুবনবাবু চাইতে টাকা দুটি তাকে দিয়ে খালি হাতে ঘরে ঢুকলেন।

আমি বললাম, আশ্চর্য লোক তো! মামি বললে, ওই রকমই। আর দাখো ভাই—

বললাম, ভাই নয়, ভাগনে।

মামি বললে, তাও তো বটে। আগে থাকতেই যে সম্বন্ধটা পাতিয়ে বসে আছ! ওঁর ভাগনে না হয়ে আমার ভাই হলেই বেশ হত কিন্তু। সম্পর্কটা নতুন করে পাতো না? এখনও এক ঘণ্টাও হয়নি, জমাট বাঁধেনি।

আমি বললাম, কেন? মামি-ভাগনে বেশ তো সম্পর্ক!

মামি বললে, আচ্ছা তবে তাই। কিন্তু আমার একটা কথা তোমায় রাখতে হবে ভাগনে। তুমি ওঁর বাঁশি শুনতে চেয়ো না।

বললাম, তার মানে? বাঁশি শুনতেই তো এলাম!

মামির মুখ গম্ভীর হল, বললে, কেন এলে? আমি ডেকেছিলাম? তোমাদের জ্বালায় আমি কি গলায় দড়ি দেব?

আমি অবাক হয়ে মামির মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। কথা জোগায় না।

মামি বললে, তোমাদের একটু শখ মেটাবার জন্য উনি আত্মহত্যা করছেন দেখতে পাও না? রোজ তোমরা একজন না একজন এসে বাঁশি শুনতে চাইবে। রোজ গলা দিয়ে রক্ত পড়লে মানুষ কদিন বাঁচে!

রক্ত!

রক্ত নয়? দেখবে? বলে মামি চলে গেল। ফিরে এল একটা গামলা হাতে করে। গামলার ভেতরে জমাট-বাধা খানিকটা রক্ত।

মামি বললে, কাল উঠেছিল, ফেলতে মায়া হচ্ছিল তাই রেখে দিয়েছি। রেখে কোনো লাভ নেই জানি, তবু—

আমি অনুতপ্ত হয়ে বললাম, জানতাম না মামি। জানলে ককখনো শুনতে চাইতাম না। ইস, এই জন্যেই মামার শরীর এত খারাপ?

মামি বললে, কিছু মনে করো না ভাগনে। অন্য কারও সঙ্গে তো কথা কই না, তাই তোমাকেই গায়ের ঝাল মিটিয়ে বলে নিলাম। তোমার আর কী দোষ, আমার অদৃষ্ট!

আমি বললাম, এত রক্ত পড়ে, তবু মামা বাঁশি বাজান?

মামি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, হ্যাঁ, পৃথিবীর কোনো বাধাই ওঁর বাঁশি বাজানো বন্ধ করতে পারবে না। কত বলেছি, কত কেঁদেছি শোনেন না।

আমি চুপ করে রইলাম।

মামি বলে চলল, কতদিন ভেবেছি বাঁশি ভেঙে ফেলি, কিন্তু সাহস হয়নি। বাঁশির বদলে মদ খেয়েই নিজেকে শেষ করে ফেলবেন, নয়তো যেখানে যা আছে সব বিক্রি করে বাঁশি কিনে না খেয়ে মরবেন।

মামির শেষ কথাগুলি যেন গুমরে গুমরে কেঁদে ঘরের চারিদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগল। আমি কথা বলতে গেলাম, কিন্তু ফুটল না।

মামি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, অথচ ওই একটা ছাড়া আমার কোনো কথাই ফেলেন না। আগে আকণ্ঠ মদ খেতেন, বিয়ের পর যেদিন মিনতি করে মদ ছাড়তে বললাম সেইদিন থেকে ও জিনিস ছোঁয়াই ছেড়ে দিলেন। কিন্তু বাঁশির বিষয়ে কোনো কথাই শোনেন না।

আমি বলতে গেলাম, মামি—

মামি বোধ হয় শুনতেই পেল না, বলে চলল, একবার বাঁশি লুকিয়ে রেখেছিলাম, সে কী ছটফট করতে লাগলেন যেন ওঁর সর্বস্ব হারিয়ে গেছে।

বাইরে কড়া নাড়ার শব্দ হল। মামি দরজা খুলতে উঠে গেল।

যতীন মামা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, দিলে না টাকা অতসী, বললে পরশু যেতে।

পিছন থেকে মামি বললে, সে আমি আগেই জানি।

যতীন মামা বললেন, দোকানদারটাই বা কী পাজি, একপো সুজি চাইলাম, দিল না। মামার বাড়ি এসে ভাগনেকে দেখছি খালি পেটে ফিরতে হবে।

মামি ম্লান মুখে বললে, সুজি দেয়নি ভালোই করেছে। শুধু জল দিয়ে তো আর সুজি হয় না।

ঘি নেই?

কবে আবার ঘি আনলে তুমি?

তাও তো বটে! বলে যতীন মামা আমার দিকে চেয়ে হাসলেন। দিব্য সপ্রতিভ হাসি।

আমি বললাম, কেন ব্যস্ত হচ্ছেন মামা, খাবারের কিছু দরকার নেই। ভাগনের সঙ্গে অত ভদ্রতা করতে নেই।

মামি বললে, বসো তোমরা, আমি আসছি। বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মামা হেঁকে বললেন, কোথায় গো? বারান্দা থেকে জবাব এল, আসছি।

মিনিট পনেরো পরে মামি ফিরল। দু হাতে দুখানা রেকাবিতে গোটা চারেক করে রসগোল্লা, আর গোটা দুই সন্দেশ।

যতীন মামা বললেন, কোথেকে জোগাড় করলে গো? বলে, একটা রেকাবি টেনে নিয়ে একটা রসগোল্লা মুখে তুললেন।

অন্য রেকাবিটা আমার সামনে রাখতে রাখতে মামি বললে, তা দিয়ে তোমার  দরকার কী?

যতীন মামা নিশ্চিন্তভাবে বললেন, কিছু না! যা খিদেটা পেয়েছে; ডাকাতি করেও যদি এনে থাক কিছু দোষ হয়নি। স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে সাধ্বী অনেক কিছুই করে।

আমি কুণ্ঠিত হযে বলতে গেলাম, কেন মিথ্যে—

বাধা দিয়ে মামি বললে, আবার যদি ওই সব শুরু কর ভাগনে, আমি কেঁদে ফেলব।

আমি নিঃশব্দে খেতে আরম্ভ করলাম।

মামি ওঘর থেকে দুটো এনামেলের গ্রাসে জল এনে দিলেন। প্রথম রসগোল্লাটা গিলেই মামা বললেন, ওযাক্‌! কী বিশ্রী রসগোল্লা! রইল পড়ে, খেয়ো তুমি, নয় তো ফেলে দিয়ো। দেখি সন্দেশটা কেমন!

সন্দেশ মুখে দিয়ে বললেন, হ্যাঁ এ জিনিসটা ভালো, এটা খাব। বলে সন্দেশ দুটো তুলে নিয়ে রেকাবিটা ঠেলে দিয়ে বললেন, যাও তোমার সুজির ঢিপি ফেলে দিয়োখন নর্দমায়।

অতসী মামির চোখ ছলছল করে এল। মামার ছলটুকু আমাদের কারুর কাছেই গোপন রইল না। কেন যে এমন খাসা রসগোল্লাও মামার কাছে সুজির টিপি হয়ে গেল বুঝে আমার চোখে প্রায় জল আসবার উপক্রম হল।

মাথা নিচু করে রেকাবিটা শেষ করলাম। মাঝখানে একবার চোখ তুলতেই নজরে পড়ল মামি মামার রেকাবিটা দরজার ওপরে তাকে তুলে রাখছে।

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এলে মামি ঘরে ঘরে প্রদীপ দেখাল, ধুনো দিল। আমাদের ঘরে একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে মামি চুপ করে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবতে লাগল।

যতীন মামা হেসে বললেন, আরে লজ্জা কীসের! নিত্যকার অভ্যাস, বাদ পড়লে রাতে ঘুম হবে না।  ভাগনের কাছে লজ্জা করতে নেই।

আমি বললাম, আমি, না হয়—

মামি বললে, বসো, উঠতে হবে না, অত লজ্জা নেই আমার। বলে, গলায় আঁচল দিয়ে মামার পায়ের কাছে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল।

লজ্জায় সুখে তৃপ্তিতে আরক্ত মুখখানি নিয়ে অতসী মামি যখন উঠে দাঁড়াল, আমি বললাম, দাঁড়াও মামি, একটা প্রণাম করে নিই।

মামি বললে, না না ছি ছি—

বললাম, ছিছি নয় মামি। আমার নিত্যকার অভ্যাস না হতে পারে, কিন্তু তোমায় প্রণাম না করে যদি আজ বাড়ি ফিরি রাত্রে আমার ঘুম হবে না ঠিক। বলে মামির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম।

যতীন মামা হো হো করে হেসে উঠলেন।

মামি বললে, দ্যাখো তো ভাগনের কাও!

যতীন মামা বললেন, ভক্তি হয়েছে গো! সকালসন্ধা স্বামীকে প্রণাম করো জেনে শ্রদ্ধা হয়েছে ভাগনের।

কী যে বল!—বলে মামি পলায়ন করল। বারান্দা থেকে বলে গেল, আমি রান্না করতে গেলাম।

যতীন মামা বললেন, এইবার বাঁশি শোনো।

আমি বললাম, থাকগে, কাজ নেই মামা। শেষে আবার রক্ত পড়তে আরম্ভ করবে।

যতীন মামা বললেন, তুমিও শেষে ঘ্যানঘান পানপ্যান আরম্ভ করলে ভাগনে? রক্ত পড়বে তো হয়েছে কী? তুমি শুনলেও আমি বাজাব, না শুনলেও বাজাব। খুশি হয় রান্নাঘরে মামির কাছে বসে কানে আঙুল দিয়ে থাকো গে।

কাঠের বাক্সোটা খুলে বাঁশির কাঠের কেসটা বার করলেন। বললেন, বারান্দায় চলো, ঘরে বড়ো শব্দ হয়।

নিজেই বারান্দায় মাদুরটা তুলে এনে বিছিয়ে নিলেন। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে বাঁশিটা মুখে তুললেন।

হঠাৎ আমার মনে হল আমার ভেতরে যেন একটা উন্মাদ একটা খ্যাপা উদাসীন ঘুমিয়ে ছিল আজ বাঁশির সুরের নাড়া জেগে উঠল। বাঁশির সুর এসে লাগে কানে কিন্তু আমার মনে হল বুকের তলেও যেন সাড়া পৌঁছেছে। অতি তীব্র বেদনার মধুরতম আত্মপ্রকাশ কেবল বুকের মাঝে গিয়ে পৌঁছায়নি, বাইরের এই ঘরদোরকেও যেন স্পর্শ দিয়ে জীবন্ত করে তুলেছে, আর আকাশকে বাতাসকে মৃদুভাবে স্পর্শ করতে করতে যেন দূরে, বহুদূরে, যেখানে গোটা কয়েক তারা ফুটে উঠেছে দেখতে পাচ্ছি, সেইখানে স্বপ্নের মায়ার মধ্যে লয় পাচ্ছে। অন্তরে ব্যথা বোধ করে আনন্দ পাবার যতগুলি অনুভূতি আছে বাঁশির সুর যেন তাদের সঙ্গে কোলাকুলি আরম্ভ করেছে।

বাঁশি শুনেছি ঢের। বিশ্বাস হয়নি এই বাঁশি বাজিয়ে একজন একদিন এক কিশোরীর কুল মান লজ্জা ভয় সব ভুলিয়ে দিয়েছিল, যমুনাতে উজান বইয়েছিল। আজ মনে হল, আমার যতীন মামার বাঁশিতে সমগ্র প্রাণ যদি আচমকা জেগে উঠে নিরর্থক এমন ব্যাকুল হয়ে ওঠে, তবে সেই বিশ্ববাঁশির বাদকের পক্ষে ওই দুটি কাজ আর এমন কী কঠিন!

দেখি, মামি কখন এসে নিঃশব্দে ওদিকের বারান্দায় বসে পড়েছে। খুব সম্ভব ওই ঘরটাই রান্নাঘর, কিংবা রান্নাঘরে যাবার পথ ওই ঘরের ভেতর দিয়ে।

যতীন মামার দিকে চেয়ে দেখলাম, খুব সম্ভব সংজ্ঞা নেই। এ যেন সুরের আত্মভোলা সাধক, সমাধি পেয়ে গেছে।

কতক্ষণ বাঁশি চলেছিল ঠিক মনে নেই, বোধ হয় ঘণ্টা দেড়েক হবে। হঠাৎ এক সময়ে বাঁশি থামিয়ে যতীন মামা ভয়ানক কাশতে আরম্ভ করলেন। বারান্দার ক্ষীণ আলোতেও বুঝতে পারলাম, মামার মুখ চোখ অস্বাভাবিক রকম লাল হয়ে উঠেছে।

অতসী মামি বোধ হয় প্রস্তুত ছিল, জল আর পাখা নিয়ে ছুটে এল। খানিকটা রক্ত তুলে মামির শুশ্রূষায় যতীন মামা অনেকটা সুস্থ হলেন। মাদুরের ওপর একটা বালিশ পেতে মামি তাকে শুইয়ে দিল। পাখা নেড়ে নীরবে হাওয়া করতে লাগল।

তারপর এক সময় উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আজ আসি যতীন মামা।

মামা কিছু বলবার আগেই মামি বললে, তুমি এখন কথা কয়ো না। ভাগনের বাড়িতে ভাববে, আজ থাক, আর একদিন এসে খেয়ে যাবে এখন। চলো আমি দরজা দিয়ে আসছি।

সদরের দরজা খুলে বাইরে যাব, মামি আমার একটা হাত চেপে ধরে বললে, একটু দাঁড়াও ভাগনে, সামলে নিই।

প্রদীপের আলোতে দেখলাম, মামির সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। একটু সুস্থ হয়ে বললে, ওর রক্ত পড়া দেখলেই আমার এরকম হয়। বাঁশি শুনেও হতে পারে। আচ্ছা এবার এসো ভাগনে, শিগগির আর একদিন আসবে কিন্তু।

বললাম, মামার বাঁশি ছাড়াতে পারি কি না একবার চেষ্টা করে দেখব মামি?

মামি বাগ্রকণ্ঠে বললে, পারবে? পারবে তুমি? যদি পার ভাগনে, শুধু তোমার যতীন মামাকে নয়, আমাকেও প্রাণ দেবে।

অতসী মামি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললে।

রাস্তায় নেমে বললাম, খিলটা লাগিয়ে দাও মামি।

কেবলই মনে হয়, নেশাকে মানুষ এত বড়ো দাম দেয় কেন। লাভ কী? এই যে যতীন মামা পলে পলে জীবন উৎসর্গ করে সুরের জাল বুনবার নেশায় মেতে যান, মানি তাতে আনন্দ আছে। যে সৃষ্টি করে তারও, যে শোনে তারও। কিন্তু এত চড়া মূল্য দিয়ে কী সেই আনন্দ কিনতে হবে? এই যে স্বপ্ন সৃষ্টি, এ তো ক্ষণিকের। যতক্ষণ সৃষ্টি করা যায় শুধু ততক্ষণ এ  স্থিতি। তারপর বাস্তবের কঠোরতার মাঝে এ স্বপ্নের চিহ্নও তো খুঁজে পাওয়া যায় না। এ নিরর্থক মায়া সৃষ্টি করে নিজেকে ভোলাবার প্রয়াস কেন? মানুষের মন কী বিচিত্র। আমারও ইচ্ছে করে যতীন মামার মতো সুরের আলোয় ভুবন ছে্য়ে ফেলে, সুরের আগুন গগনে বেয়ে তুলে পলে পলে নিজেকে শেষ করে আনি! লাভ নেই? নাই বা রইল।

এতদিন জানতাম, আমিও বাঁশি বাজাতে জানি। বন্ধুরা শুনে প্রশংসাও করে এসেছে। বাঁশি বাজিয়ে আনন্দও যে না পাই তা নয়। কিন্তু যতীন মামার বাঁশি শুনে এসে মনে হল, বাঁশি বাজানো আমার জন্যে নয়। এক একটা কাজ করতে এক একজন লোক জন্মায়, আমি বাঁশি বাজাতে জন্মাইনি। যতীন মামা ছাড়া বাঁশি বাজাবার অধিকার কারও নেই।

থাকতে পারে কারও অধিকার। কারও কারও বাঁশি হয়তো যতীন মামার বাঁশির চেয়েও মনকে উতলা করে তোলে, আমি তাদের চিনি না।

একদিন বললাম, বাঁশি শিখিয়ে দেবে মামা?

যতীন মামা হেসে বললে, বাঁশি কি শেখাবার জিনিস ভাগনে? ও শিখতে হয়।

তা ঠিক। আর শিখতেও হয় মন দিয়ে, প্রাণ দিয়ে, সমগ্র সত্তা দিয়ে। নইলে আমার বাঁশি শেখার মতোই সে শিক্ষা ব্যৰ্থ হয়ে যায়।

অতসী মামিকে সেদিন বিদায় নেবার সময় যে কথা বলেছিলাম সে কথা ভুলিনি। কিন্তু কী করে যে যতীন মামার বাঁশি ছাড়াব ভেবে পেলাম না। অথচ দিনের পর দিন যতীন মামা যে এই সর্বনাশা নেশায় পলে পলে মরণের দিকে এগিয়ে যাবেন। কথা ভাবতেও কষ্ট হল। কিন্তু করা যায় কী? মামির প্রতি যতীন মামার যে ভালোবাসা তার বোধ হয় তল নেই, মামির কান্নাই যখন ঠেলেছেন তখন আমার সাধ্য কী তাকে ঠেকিয়ে রাখি!

একদিন বললাম, মামা, আর বাঁশি বাজাবেন না।

যতীন মামা চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, বাঁশি বাজাব না? বল কী ভাগনে? তাহলে বাঁচব কী করে?

বললাম, গলা দিয়ে রক্ত উঠছে, মামি কত কাঁদে।

তা আমি কি করব? একটু-আধটু কাঁদা ভালো। বলে হাকলেন, অতসী! অতসী!

মামি এল।

মামা বললেন, কান্না কী জন্যে শুনি? বাঁশি ছেড়ে দিয়ে আমায় মরতে বল নাকি? তাতে কান্না বাড়বে, কমবে না।

মামি ম্লানমুখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

মামা বললেন, জানো ভাগনে, এই অতসীর জ্বালায় আমার বেঁচে থাকা ভার হয়ে উঠেছে। কোথেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলেন, নড়বার নাম নেই। ওর ভার ঘাড়ে না থাকলে বাঁশি বগলে মনের আনন্দে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতাম। বেড়ানো-টেড়ানো সব মাথায় উঠেছে।

মামি বললে, যাও না বেড়াতে, আমি ধরে রেখেছি?

রাখোনি? বলে মামা এমনিভাবে চাইলেন যেন নিজের চোখে তিনি অতসী মামিকে খুন করতে দেখেছেন আর মামি এখন তাঁর সমুখেই সে কথা অস্বীকার করছে।

মামির চোখে জল এল। অশু-জড়িত কণ্ঠে বললে, অমন কর তো আমি একদিন—

মামা একেবারে জল হয়ে গেলেন। আমার সামনেই মামির হাত ধরে কোঁচার কাপড় দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন, ঠাট্টা করছিলাম, সত্যি বলছি অতসী,–

চট করে হাত ছাড়িয়ে মামি চলে গেল!

আমি বললাম, কেন মিথ্যে চটালেন মামিকে?

যতীন মামা বললেন, চটেনি। লজ্জায় পালাল।

কিন্তু একদিন যতীন মামাকে বাঁশি ছাড়তে হল। মামিই ছাড়াল।

মামির একদিন হঠাৎ টাইফয়েড জ্বর হল।

সেদিন বুঝি জ্বরের সতেরো দিন। সকাল নটা বাজে। মামি ঘুমুচ্ছে, আমি তার মাথায় আইসব্যাগটা চেপে ধরে আছি। যতীন মামা একটু টুলে বসে স্নানমুখে চেয়ে আছেন। রাত্রি জেগে তার শরীর আরও শীর্ণ হয়ে গেছে, চোখ দুটি লাল হয়ে উঠেছে। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, চুল উশকোখুশকো।

হঠাৎ টুল ছেড়ে উঠে মামা ট্রাঙ্কটা খুলে বাঁশিটা বার কবলেন। আজ সতেরো দিন এটা বাক্সেই বন্ধ ছিল।

সবিস্ময়ে বললাম, বাঁশি কী হবে মামা?

ছেঁড়া পাম্পশুতে পা ঢুকোতে ঢুকোতে মামা বললেন, বেচে দিয়ে আসব।

তার মানে? যতীন মামা ম্লান হাসি হেসে বললেন, তার মানে ডাক্তার বোসকে আর একটা কল দিতে হবে।

বললাম, বাঁশি থাক, আমার কাছে টাকা আছে।

প্রত্যুত্তরে শুধু একটু হেসে যতীন মামা পেরেকে টাঙানো জামাটা টেনে নিলেন।

যদি দরকার পড়ে ভেবে পকেটে কিছু টাকা এনেছিলাম। মিথ্যা চেষ্টা। আমার মেজো মামা কতবার কত বিপদে যতীন মামাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছেন, যতীন মামা একটি পয়সা নেননি। বললাম, কোথাও যেতে হবে না মামা, আমি কিনব বাঁশি।

মামা ফিরে দাঁড়ালেন। বললেন, তুমি কিনবে ভাগনে? বেশ তো! বললাম, কত দাম? বললেন, একশো পঁয়ত্ৰিশে কিনেছি, একশো টাকায় দেব। বাঁশি ঠিক আছে, কেবল সেকেন্ড হ্যাণ্ড এই যা।

বললাম, আপনি না সেদিন বলছিলেন মামা, এ রকম বঁশি খুঁজে পাওয়া দায়, অনেক বেছে আপনি কিনেছেন? আমি একশো পঁয়ত্রিশ দিয়েই ওটা কিনব।

যতীন মামা বললেন, তা কি হয়। পুরনো জিনিস–

বললাম, আমাকে কি জোচ্চোর পেলেন মামা? আপনাকে ঠকিয়ে কম দামে বাঁশি কিনব?

পকেটে দশ টাকার তিনটে নোট ছিল, বার করে মামার হাতে দিয়ে বললাম, ত্রিশ টাকা আগাম নিন, বাকি টাকাটা বিকেলে নিয়ে আসব।

যতীন মামা কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে নোটগুলির দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, আচ্ছা!

আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। যতীন মামার মুখের ভাবটা দেখবার সাধা হল না।

যতীন মামা ডাকলেন, ভাগনে—

ফিরে তাকালাম।

যতীন মামা হাসবার চেষ্টা করে বললেন, খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে ভেব না, বুঝলে ভাগনে?

আমার চোখে জল এল। তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে মামির শিয়রে গিয়ে বসলাম।

মামির ঘুম ভাঙেনি, জানতেও পারল না যে রক্তপিপাসু বাঁশিটা ঝলকে ঝলকে মামার রক্ত পান করেছে, আমি আজ সেই বাঁশিটা কিনে নিলাম।

মনে মনে বললাম, মিথ্যে আশা। এ যে বালির বাঁধ! একটা বাঁশি গেল, আর একটা কিনতে কতক্ষণ? লাভের মধ্যে যতীন মামা একান্ত প্রিয়বস্তু হাতছাড়া হয়ে যাবার বেদনাটাই পেলেন।

বিকালে বাকি টাকা এনে দিতেই যতীন মামা বললেন, বাড়ি যাবার সময় বাঁশিটা নিয়ে যেও। আমি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, থাক না এখন কদিন, এত তাড়াতাড়ি কীসের?

যতীন মামা বললেন, না। পরের জিনিস আমি বাড়িতে রাখি না। বুঝলাম, পরের হাতে চলে যাওয়া বাঁশিটা চোখের ওপরে থাকা তাঁর সহ্য হবে না।

বললাম, বেশ মামা, তাই নিয়ে যাবখন।

মামা ঘাড় নেডে বললেন, হ্যাঁ, নিয়েই যেও | তোমার জিনিস এখানে কেন ফেলে রাখবে। বুঝলে না?

উনিশ দিনের দিন মামির অবস্থা সংকটজনক হয়ে উঠল।

যতীন মামা টুলটা বিছানার কাছে টেনে টেনে মামির একটা হাত মুঠো করে ধরে নীরবে তার রোগশীর্ণ ঝরা ফুলের মতো ম্লান মুখের দিকে চেয়েছিলেন, হঠাৎ অতসী মামি বললে, ওগো আমি বোধ হয় আর বাঁচব না।

যতীন মামা বললেন, তা কি হয় অতসী, তোমায় বাঁচতে হবেই। তুমি না বাঁচলে আমিও যে বাঁচব না?

মামি বললে, বালাই, বাঁচবে বইকী। দ্যাখো, আমি যদি নাই বাঁচি, আমার একটা কথা রাখবে? যতীন মামা নত হয়ে বললেন, রাখব। বলো।

বঁশি বাজানো ছেড়ে দিয়ো। তিলতিল করে তোমার শরীর ক্ষয় হচ্ছে দেখে ওপারে গিয়েও আমার শান্তি থাকবে না। রাখবে আমার কথা?

মামা বললেন, তাই হবে অতসী। তুমি ভালো হয়ে ওঠ। আমি আর বঁশি ছোঁব না।

মামির শীর্ণ ঠোঁটে সুখের হাসি ফুটে উঠল। মামার একটা হাত বুকের ওপর টেনে শ্রান্তভাবে মামি চোখ বুজল।

আমি বুঝলাম যতীন মামা আজ তাঁর রোগশয্যাগতা অতসীর জন্য কত বড়ো একটা ত্যাগ করলেন। অতি মৃদুস্বরে উচ্চারিত ওই কটি কথা, তুমি ভালো হয়ে ওঠ, আমি আর বঁশি ছোব না, অন্যে না বুঝুক আমি তো যতীন মামাকে চিনি, আমি জানি, অতসী মামিও জানে ওই কথা কটির পেছনে কতখানি জোর আছে! বাঁশি বাজাবার জন্য মন উন্মাদ হয়ে উঠলেও যতীন মামা আর বাঁশি ছোঁবেন না।

শেষ পর্যন্ত মামি ভালো হয়ে উঠল। যতীন মামার মুখে হাসি ফুটল। মামি যেদিন পথ্য পেল সেদিন হেসে মামা বললেন, কী গো, বাঁচবে না বললে ? অমনি মুখের কথা কি না! যে চাঁড়াল খুড়োর কাছ থেকেই তোমায় ছিনিয়ে এনেছি, যম ব্যাটা তো ভালোমানুষ।

আমি বললাম, চাঁড়াল খুড়ো আবার কী মামা?

মামা বললেন, তুমি জান না বুঝি? সে এক দ্বিতীয় মহাভারত।

মামি বললে, গুরুনিন্দা কোরো না।

মামা বললেন, গুরুনিন্দা কী? গুরুতর নিন্দা করব। ভাগনেকে দেখাও না। অতসী তোমার পিঠের দাগটা।

মামির বাধা দেওয়া সত্ত্বেও মামা ইতিহাসটা শুনিয়ে দিলেন। নিজের খুড়ো নয়, বাপের পিসতুতো ভাই। মা বাবাকে হারিয়ে সতেরো বছর বয়স পর্যন্ত ওই খুড়োর কাছেই অতসী মামি ছিল। অত বড়ো মেয়ে, তাকে কিলচড় লাগাতে খুড়োটির বাধত না, আনুষঙ্গিক অন্য সব তো ছিলই। খুড়োর মেজাজের একটি অক্ষয় চিহ্ন আজ পর্যন্ত মামির পিঠে আছে। পাশের বাড়িতেই যতীন মামা বাঁশি বাজাতেন আর আকণ্ঠ মদ খেতেন। প্রায়ই খুড়োর গর্জন আর অনেক রাতে মামির চাপা কান্নার শব্দে তার নেশা ছুটে যেত। নিতান্ত চটে একদিন মেয়েটাকে নিয়ে পলায়ন করলেন এবং বিয়ে করে ফেললেন।

মামার ইতিহাস বলা শেষ হলে অতসী মামি ক্ষীণ হাসি হেসে বললে, তখন কি জানি মদ খায়! তাহলে কক্‌খনো আসতাম না।

মামা বললেন, তখন কী জানি তুমি মাথার রতন হয়ে আঠার মতো লেপটে থাকবে! তাহলে কক্‌খনো উদ্ধার করতাম না। আর মদ না খেলে কি এক ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে মেয়ে চুরি করার মতো বিশ্রী কাজটা করতে পারতাম গো! আমি ভেবেছিলাম, বছরখানেক—

মামি বললে, যাও, চুপ করো। ভাগনের সামনে যা তা বকো না।

মামা হেসে চুপ করলেন।



মাস দুই পরের কথা।

কলেজ থেকে সটান যতীন মামার ওখানে হাজির হলাম। দেখি, জিনিসপত্র যা ছিল বাঁধাছাঁদা হয়ে পড়ে আছে।

অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, এ সব কী মামা?

যতীন মামা সংক্ষেপে বললেন, দেশে যাচ্ছি।

দেশে? দেশ আবার আপনার কোথায়?

যতীন মামা বললেন, আমার কী একটা দেশও নেই ভাগনে? পাঁচশো টাকা আয়ের জমিদারি আছে দেশে, খবর রাখ?

অতসী মামি বললে, হয়তো জন্মের মতোই তোমাদের ছেড়ে চললাম ভাগনে। আমার অসুখের জন্যই এটা হল।

বললাম, তোমার অসুখের জন্য? তার মানে?

মামা বললেন, তার মানে বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছি। যিনি কিনেছেন পাশের বাড়িতেই থাকেন, মাঝখানের প্রাচীরটা ভেঙে দুটো বাড়ি এক করে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

আমি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললাম, এত কাণ্ড করলে মামা, আমাকে একবার জানালে না পর্যন্ত! করে যাওয়া ঠিক হল?

বাঁধা বিছানা আর তালাবন্ধ বাক্সের দিকে আঙুল বাড়িয়ে মামা বললেন, আজ। রাত্রে ঢাকা মেলে রওনা হব। আমরা বাঙাল হে ভাগনে, জানো না বুঝি? বলে মামা হাসলেন। অবাক মানুষ! এমন অবস্থায় হাসিও আসে!

গম্ভীরভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আচ্ছা, আসি যতীন মামা, আসি মামি। বলে দরজার দিকে অগ্রসর হলাম।

অতসী মামি উঠে এসে আমার হাতটা চেপে ধরে বললে, লক্ষ্মী ভাগনে, রাগ কোরো না। আগে থাকতে তোমায় খবর দিয়ে লাভ তো কিছু ছিল না, কেবল মনে ব্যথা পেতে। যা ভাগনে তুমি, কত কী হাঙ্গামা বাঁধিয়ে তুলতে ঠিক আছে কিছু?

আমি ফিরে গিয়ে বাঁধা বিছানাটার ওপর বসে বললাম, আজ যদি না আসতাম, একটা খবরও তো পেতাম না। কাল এসে দেখতাম, বাড়িঘর খাঁখাঁ করছে।

যতীন মামা বললেন, আরে রামঃ! তোমায় না বলে কি যেতে পারি? দুপুরবেলা সেনের ডাক্তারখানা থেকে ফোন করে দিয়েছিলাম তোমাদের বাড়িতে। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরলেই খবর পেতে|

বাড়ি আর গেলাম না। শিয়ালদহ স্টেশনে মামা-মামিকে উঠিয়ে দিতে গেলাম। গাড়ি ছাড়ার আগে কতক্ষণ সময় যে কী করেই কাটল! কারও মুখেই কথা নেই। যতীন মামা কেবল মাঝে মাঝে দু একটা হাসির কথা বলছিলেন এবং হাসাচ্ছিলেনও। কিন্তু তার বুকের ভেতর যে কী করছিল সে খবর আামার অজ্ঞাত থাকেনি।

গাড়ি ছাড়বার ঘণ্টা বাজলে যতীন মামা আর অতসী মামিকে প্রণাম করে গাড়ি থেকে নামলাম। এইবার যতীন মামা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আর বোধ হয় মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখা তার পক্ষে সম্ভব হল না !

জানালা দিয়ে মুখ বার করে মামি ডাকলে, শোনো। কাছে গেলাম। মামি বললে, তোমাকে ভাগনে বলি আর যাই বলি, মনে মনে জানি তুমি আমার ছোটো ভাই। পার তো একবার বেড়াতে গিয়ে দেখা দিয়ে এসো। আমাদের হয়তো আর কলকাতা আসা হবে না, জমির ভা্রী ক্ষতি হয়ে গেছে। যেও, কেমন ভাগনে?

মামির চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরে পড়ল। ঘাড় নেড়ে জানালাম, যাব।

বাঁশি বাজিয়ে গাড়ি ছাড়ল। যতক্ষণ গাড়ি দেখা গেল অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। দূরের লাল সবুজ আলোকবিন্দুর ওপারে যখন একটি চলন্ত লাল বিন্দু অদৃশ্য হয়ে গেল তখন ফিরলাম। চোখের জলে দৃষ্টি তখন ঝাপসা হয়ে গেছে।



মানুষের স্বভাবই এই যখন যে দুঃখটা পায় তখন সেই দুঃখটাকেই সকলের বড়ো কবে দেখে। নইলে কে ভেবেছিল, যে যতীন মামা আর অতসী মামির বিচ্ছেদে একুশ বছর বয়সে আমার দুচোখ জলে ভরে গিয়েছিল সেই যতীন মামা আর অতসী মামি একদিন আমার মনের এক কোণে সংসারের সহস্ৰ আবর্জনার তলে চাপা পড়ে যাবেন।

জীবনে অনেকগুলি ওলট-পালট হয়ে গেল। যথাসময়ে ভাগ্য আমার ঘাড় ধরে যৌবনের কল্পনার সুখস্বৰ্গ থেকে বাস্তবের কঠোর পৃথিবীতে নামিয়ে দিল। নানা কারণে আমাদের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ল। বালিগঞ্জের বাড়িটা পর্যন্ত বিক্রি করে ঋণ শোধ দিয়ে আশি টাকা মাইনের একটা চাকরি নিয়ে শ্যামবাজার অঞ্চলে ছোটো একটা বাড়ি ভাড়া করে উঠে গেলাম। মার কাঁদাকাটায় গলে একটা বিয়েও করে ফেললাম।

প্রথমে সমস্ত পৃথিবীটাই যেন তেতো লাগতে লাগল, জীবনটা বিস্বাদ হয়ে গেল, আশা-আনন্দের এতটুকু আলোড়নও ভেতরে খুঁজে পেলাম না।

তারপর ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে গেল। নতুন জীবনে রসের খোঁজ পেলাম। জীবনের জুয়াখেলায় হারজিতের কথা কদিন আর মানুষ বুকে পুষে রাখতে পারে?

জীবনে যখন এই সব বড়ো বড়ো ঘটনা ঘটছে তখন নিজেকে নিয়ে আমি এমনি ব্যাপৃত হয়ে পড়লাম যে কবে এক যতীন মামা আর অতসী মামির স্নেহ পরমসম্পদ বলে গ্রহণ করেছিলাম সে কথা মনে ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে গেল। সাত বছর পরে আজ ক্কচিৎ কখনও হয়তো একটা অস্পষ্ট স্মৃতির মতো তাদের কথা মনে পড়ে।

মাঝে একবার মনে পড়েছিল, যতীন মামাদের দেশে চলে যাওয়ার বছর তিনেক পরে। সেইবার ঢাকা মেলে কলিশন হয়। মৃতদের নামের মাঝে যতীন্দ্রনাথ রায় নামটা দেখে যে খুব একটা ঘা লেগেছিল সে কথা আজও মনে আছে। ভেবেছিলাম একবার গিয়ে দেখে আসব, কিন্তু হয়নি। সেদিন আপিস থেকে ফিরে দেখি আমার স্ত্রীর কঠিন অসুখ। মনে পড়ে যতীন মামার দেশের ঠিকানায় একটা পত্র লিখে দিয়ে এই ভেবে মনকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম, ও নিশ্চয় আমার যতীন মামা নয়। পৃথিবীতে যতীন্দ্রনাথ রায়ের অভাব তো নেই। সে চিঠির কোনো জবাব আসেনি। স্ত্রীর অসুখের হিড়িকে কথাটাও আমার মন থেকে মুছে গিয়েছিল।

তারপর গড়িয়ে গড়িয়ে আরও চারটে বছর কেটে গেছে।

আমার ছোটো বোন বীণার বিয়ে হয়েছিল ঢাকায়।

পুজোর সময় বীণাকে তারা পাঠালে না। অগ্রহায়ণ মাসে বীণাকে আনতে ঢাকা গেলাম। কিন্তু আনা হল না। গিয়েই দেখি বীণার শাশুড়ির খুব অসুখ। আমি যাবার আগের দিন হু হু করে জ্বর এসেছে। ডাক্তার আশঙ্কা করছেন নিউমোনিয়া।

ছুটি ছিল না, ক্ষুন্ন হয়ে একাই ফিরলাম। গোয়ালন্দে স্টিমার থেকে নেমে ট্রেনের একটা ইন্টারে ভিড় কম দেখে উঠে পড়লাম। দুটি মাত্র ভদ্রলোক, এক-কোণে র‍্যাপার মুড়ি দেওয়া একটি স্ত্রীলোক, খুব সম্ভব এদের একজনের স্ত্রী, জিনিসপত্রের একান্ত অভাব। খুশি হয়ে একটা বেঞ্চিতে কম্বলের ওপর চাদর বিছিয়ে বিছানা করলাম। বালিশ ঠেসান দিয়ে আরাম করে বসে, পা দুটো কম্বল দিয়ে ঢেকে একটা ইংরেজি মাসিকপত্র বার করে ওপেনহেমের ডিটেকটিভ গল্পে মনঃসংযোগ করলাম।

যথাসময়ে গাড়ি ছাড়ল এবং পরের স্টেশনে থামল। আবার চলল। এটা ঢাকা মেল বটে, কিন্তু পোড়াদ পর্যন্ত প্রত্যেক স্টেশনে থেমে থেমে প্যাসেঞ্জার হিসাবেই চলে। পোড়াদ-র পর ছোটোখাটো স্টেশনগুলি বাদ দেয় এবং গতিও কিছু বাড়ায়।

গোয়ালদের পর গোটা তিনেক স্টেশন পার হয়ে একটা স্টেশনে গাড়ি দাঁড়াতে ভদ্রলোক দুটি জিনিসপত্র নিয়ে নেমে গেলেন। স্ত্রীলোকটি কিন্তু তেমনিভাবে বসে রইলেন।

ব্যাপার কী? একে ফেলেই দেখছি সব নেমে গেলেন। এমন অন্যমনস্কও তো কখনও দেখিনি! ছোটোখাটো জিনিসই মানুষের ভুল হয়, একটা আস্ত মানুষ, তাও আবার একজনের অর্ধাঙ্গ, তাকে আবার কেউ ভুল করে ফেলে যায় নাকি?

জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম পিছনে দৃকপাত-মাত্র না করে তাঁরা স্টেশনের গেট পার হচ্ছেন। হয়তো ভেবেছেন, চিরদিনের মতো আজও স্ত্রীটি তার পিছু পিছু চলেছে।

চেঁচিয়ে ডাকলাম ও মশায়—মশায় শুনছেন?

গেটের ওপারে ভদ্রলোক দুটি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বাঁশি বাজিয়ে গাড়িও ছাড়ল।

অগত্যা নিজের জায়গায় বসে পড়ে ভাবলাম, তবে কি ইনি একাই চলেছেন নাকি? বাঙালির মেয়ে নিশ্চয়ই, র‍্যাপার দিয়ে নিজেকে ঢাকবার কায়দা দেখেই সেটা বোঝা যায়। বাঙালির মেয়ে, এই রাত্রিবেলা নিঃসঙ্গ যাচ্ছে, তাও আবার পুরুষদের গাড়িতে!

একটু ভেবে বললাম, দেখুন, শুনছেন?

সাড়া নেই।

বললাম, আপনার সঙ্গীরা সব নেমে গেছে, শুনছেন?

এইবার আলোয়ানের পোঁটলা নড়ল, এবং আলোয়ান ও ঘোমটা সরে গিয়ে যে মুখখানা বার হল দেখেই আমি চমকে উঠলাম।

কিছু নেই, সে মুখের কিছুই এতে নেই। আমার অতসী মামির মুখের সঙ্গে এ মুখের অনেক তফাত। কিন্তু তবু আমার মনে হল, এ আমার অতসী মামিই!

মৃদু হেসে বললে, গলা শুনেই মনে হয়েছিল এ আমার ভাগনের গলা। কিন্তু অতটা আশা করতে পারিনি। মুখ বার কবতে ভয় হচ্ছিল, পাছে আশা ভেঙে যায়।

আমি সবিস্ময়ে বলে উঠলাম, অতসী মামি!

মামি বললে, খুব বদলে গেছি, না?

মামির সিথিতে সিঁদুর নেই, কাপড়ে পাড়ের চিহ্নও খুঁজে পেলাম না।

চার বছর আগে ঢাকা-মেল কলিশনে মৃতদের তালিকায় একটা অতি পরিচিত নামের কথা মনে। পড়ল। যতীন মামা তবে সত্যিই নেই।

আস্তে আস্তে বললাম, খবরের কাগজে মামার নাম দেখেছিলাম মামি, বিশ্বাস হয়নি সে আমার যতীন মামা। একটা চিঠি লিখেছিলাম, পাওনি?

মামি বললে, না। তারপরেই আমি ওখান থেকে দু-তিন মাসের জন্য চলে যাই।

বললাম, কোথায়?

আমার এক দিদির কাছে। দূর সম্পর্কের অবশ্য।

আমায় কেন একটা খবর দিলে না মামি?

মামি চুপ করে রইল।

ভাগনের কথা বুঝি মনে ছিল না?

মামি বললে, তা নয়, কিন্তু খবর দিয়ে আর কী হত। যা হবার তা তো হয়েই গেল। বাঁশিকে ঠেকিয়ে রাখলাম, কিন্তু নিয়তিকে তো ঠেকাতে পারলাম না। তোমার মেজোমামার কাছে তোমার কথাও সব শুনলাম, আমার দুর্ভাগ্য নিয়ে তোমায় আর বিরক্ত করতে ইচ্ছে হল না। জানি তো, একটা খবর দিলেই তুমি ছুটে আসবে!

চুপ করে রইলাম। বলবার কী আছে। কী নিয়েই বা অভিমান করব? খবরেব কাগজে যতীন মামার নাম পড়ে একটা চিঠি লিখেই তো আমার কর্তব্য শেষ করেছিলাম।

মামি বললে, কী করছ এখন ভাগনে?

চাকরি। এখন তুমি যাচ্ছ কোথায়?

মামি বললে, একটু পরেই বুঝবে। ছেলেপিলে কটি?

আশ্চর্য! জগতে এত প্রশ্ন থাকতে এই প্রশ্নটাই সকলের আগে মামির মনে জেগে উঠল!

বললাম, একটি ছেলে।

ভারী ইচ্ছে করছে আমার ভাগনের খোকাকে দেখে আসতে। দেখাবে একবার? কার মতো হয়েছে? তোমার মতো, না তার মার মতো? কত বড়ো হয়েছে?

বললাম, তিন বছর চলছে। চলো না আমাদের বাড়ি মামি, বাকি প্রশ্নগুলির জবাব নিজের চোখেই দেখে আসবে?

মামি হেসে বললে, গিয়ে যদি আর না নড়ি?

বললাম, তেমন ভাগ্য কি হবে! কিন্তু সত্যি কোথায় চলেছ মামি? এখন থাক কোথায়?

মামি বললে, থাকি দেশেই। কোথায় যাচ্ছি, একটু পরে বুঝবে। ভালো কথা, সেই বাঁশিটা কী হল ভাগনে?

এইখানে আছে।

এইখানে? এই গাড়িতে?

বললাম, হুঁ। আমার ছোটো বোন বীণাকে আনতে গিয়েছিলাম, সে লিখেছিল বাঁশিটা নিয়ে যেতে। সবাই নাকি শুনতে চেয়েছিল।

মামি বললে, তুমি বাজাতে জান নাকি? বার করো না বাঁশিটা?—

ওপর থেকে বাঁশির কেসটা পাড়লাম। বাঁশিটা বার করতেই মামি ব্যগ্র হাতে টেনে নিয়ে এক দৃষ্টিতে সেটার দিকে চেয়ে রইল। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, বিয়ের পর এটাকে বন্ধু বলে গ্রহণ করেছিলাম, মাঝখানে এর চেয়ে বড়ো শত্ৰু আমার ছিল না, আজ আবার এটাকে বন্ধু মনে হচ্ছে। শেষ তিনটা বছর বাঁশিটার জন্য ছটফট করে কাটিয়েছিলেন। আজ মনে হচ্ছে বাঁশি বাজানো ছাড়তে না বললেই হয়তো ভালো হত। বাঁশির ভেতর দিয়ে মরণকে বরণ করলে তবু শান্তিতে যেতে পারতেন। শেষ কটা বছর এত মনঃকষ্ট ভোগ করতে হত না।

বাঁশির অংশগুলি লাগিয়ে মামি মুখে তুলল। পরক্ষণে ট্রেনের ঝমঝমানি ছাপিয়ে চমৎকার বাঁশি বেজে উঠল। পাকা গুণীর হাতের স্পর্শ পেয়ে বাঁশি যেন প্রাণ পেয়ে অপূর্ব বেদনাময় সুরের জাল বুনে চলল।

আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। এ তো অল্প সাধনার কাজ নয়। যার তার হাতে বাঁশি তো এমন অপূর্ব কান্না কাঁদে না। মামির চক্ষু ধীরে ধীরে নিমীলিত হয়ে গেল। তার দিকে চেয়ে ভবানীপুরেব একটা অতি ক্ষুদ্র বাড়ির প্রদীপের স্বল্পালোকে বারান্দার দেয়ালে ঠেস দেওয়া এক সুর-সাধকের মূর্তি আমার মনে জেগে উঠল।

মাঝে সাতটা বছর কেটে গেছে। যতীন মামার যে অপূর্ব বাঁশির সুর একদিন শুনেছিলাম, সে সুর মনের তলে কোথায় হারিয়ে গেছে। আজ অতসী মামির বাঁশি শুনে মনে হতে লাগল সেই হারিয়ে যাওয়া সুরগুলি যেন ফিরে এসে আমার প্রাণে মৃদুগুঞ্জন শুরু করে দিয়েছে।

এক সময়ে বাঁশি থেমে গেল। মামির একটা দীর্ঘনিশ্বাস ঝরে পড়ল। আমারও!

কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বললাম, এ কথাটাও তো গোপন রেখেছিলে!

মামি বললে, বিয়ের পর শিখিয়েছিলেন। বাঁশি শিখবার কী আগ্রহই তখন আমার ছিল। তারপর যেদিন বুঝলাম বাঁশি আমার শত্ৰু সেইদিন থেকে আর ছুঁইনি। আজ কতকাল পরে বাজালাম। মনে হয়েছিল, বুঝি ভুলে গেছি!

ট্রেন এসে একটা স্টেশনে দাঁড়াল। মামি জানালা দিয়ে মুখ বার করে আলোর গায়ে লেখা স্টেশনের নামটা পড়ে ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে বললে, পরের স্টেশনে আমি নেমে যাব ভাগনে।

পরের স্টেশনে! কেন?

মামি বললে, আজ কত তারিখ, জান?

বললাম, সতেরোই অঘ্রান।

মামি বললে, চার বছর আগে আজকের দিনে—বুঝতে পারছ না তুমি?

মুহুর্তে সব দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ হয়ে গেল। ঠিক! চার বছর আগে এই সতেরোই অঘ্রান ঢাকা মেলে কলিশন হয়েছিল। সেদিনও এমনি সময়ে এই ঢাকা মেলটির মতো সেই গাড়িটা শত শত নিশ্চিন্ত আরোহীকে পলে পলে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

বলে উঠলাম, মামি!

মামি স্থিরদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললে, সামনের স্টেশনের অল্প ওদিকে লাইনের ধারে কঠিন মাটির ওপর তিনি মৃতু্যযন্ত্রণায় ছটফট করেছিলেন। প্রত্যেক বছর আজকের দিনটিতে আমি ওই তীর্থদর্শন করতে যাই। আমার কাছে আর কোনো তীর্থের এতটুকু মূল্য নেই।

হঠাৎ জানালার কাছে সরে গিয়ে বাইরের দিকে আঙুল বাড়িয়ে মামি বলে উঠল, ওই ওই ওইখানে! দেখতে পাচ্ছ না? আমি তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তিনি যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে একটু স্নেহশীতল স্পর্শের জন্য ব্যগ্র হয়ে রয়েছেন। একটু জল, একটু জলের জন্যেই হয় তো!–উঃ মাগো, আমি তখন কোথায়!

দু-হাতে মুখ ঢেকে মামি ভেতরে এসে বসে পড়ল।

ধীরে ধীরে গাড়িখানা স্টেশনের ভেতর ঢুকল।

বিছানাটা গুটিয়ে নিযে আমি বললাম, চলো মামি, আমি তোমার সঙ্গে যাব।

মামি বললে, না।

বললাম, এই রাত্রে তোমাকে একলা যেতে দিতে পারব না মামি।

মামির চোখ জ্বলে উঠল, ছিঃ! তোমার তো বুদ্ধির অভাব নেই ভাগনে। আমি কি সঙ্গী নিয়ে সেখানে যেতে পারি? সেই নির্জন মাঠে সমস্ত রাত আমি তার সঙ্গ অনুভব করি, সেখানে কি কাউকে নিয়ে যাওয়া যায়! ওইখানের বাতাসে যে তার শেষ নিশ্বাস রয়েছে! অবুঝ হয়ো না—

গাড়ি দাঁড়াল।

বাঁশিটা তুলে নিযে মামি বললে, এটা নিয়ে গেলাম ভাগনে! এটার ওপর তোমার চেয়ে আমার দাবি বেশি।

দরজা খুলে অতসী মামি নেমে গেলেন। আমি নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলাম। আবার বাঁশি বাজিয়ে গাড়ি ছাড়ল। খোলা দরজাটা একটা করুণ শব্দ করে আছড়ে বন্ধ হয়ে গেল।

Thursday, May 9

আত্মকথা : তপন বন্দ্যোপাধ্যায়




আমার মুখোমুখি আমি
----------------------------


"ছ-সাতটি কবিতার বই, তিনশোর বেশি ছোটোগল্প, তিরিশটির মতো উপন্যাস লেখার পরে আজও মনে হয় সেই লেখাটা আজও লেখা হয়নি যা লিখতে চেয়েছি আশৈশব।" ------ তপন বন্দ্যোপাধ্যায়



একটা সরল সত্য দিয়েই শুরু করা যাক এই লেখা। এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই তার নিজের কাছে নায়ক। কেউ কেউ অন্যের কাছেও। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে নায়করূপী এই যে 'আমি'র সদা বিচরণ, সেই আমিকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে যার যার পৃথিবী।

পৃথিবীর আরও একটি সরল সত্য এই যা  মানুষ তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নায়ক থাকে। তার 'আমি'র চারপাশে ব্যপ্ত হয়ে থাকে তার চেতনাবিম্ব। মানুষের এই চেতনাবিম্বে প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টি হচ্ছে অসংখ্য ভাবনা। কোনও ভাবনা চিরস্থায়ী হয় না। ভাবনাগুলো পরমুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যায় মস্তিষ্কের স্বাভাবিক নিয়মে। কোনও কোনও ভাবনা কিছুক্ষণ পরপর ফিরে আসে। আবার মিলিয়ে যায় কেননা পরের ভাবনা মানুষকে খোঁচাতে থাকে। পরের ভাবনাটি সরিয়ে দেয় আগের ভাবনাকে। কিছুক্ষণ পর তৃতীয় ভাবনা সরিয়ে দেয় দ্বিতীয় ভাবনাটি। এরকম অজস্র ভাবনা সারাক্ষণ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্কে। কাগজে লিখে না রাখলে মানুষের সব ভাবনাই বিলীন হয়ে যায় একটু পর পর। তাই পৃথিবীর মানুষের সেই ভাবনাটুকু ধরা থাকে যা মুদ্রিত হয় দুই মলাটের মধ্যে। মানুষের ভাবনা তার চেতনাবিম্বে তখন রূপান্তরিত হয় অক্ষর শিল্পে।

পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের চেতনাবিম্ব যেহেতু আলাদা, তার অনুভব, তার উপলব্ধি সবই আলাদা। প্রতিটি মানুষের সঙ্গে প্রতিটি মানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েনও তাই ভিন্ন। এই কোটি কোটি সম্পর্কের খতিয়ান, তার চেতনা বিম্ব নিয়েই গড়ে ওঠে পৃথিবীর অক্ষরশিল্প।

মানুষের চেতনা বিম্বের একটা অংশই তো গল্প-উপন্যাসের উৎস। পৃথিবীর যেকোনও মানুষ যদি সামনে চলতে চলতে সহসা পিছন ফিরে তাকান, তিনি মুহূর্তে আবিষ্কার করবেন তারঁ জীবনের ওঠাপড়া, ভাঙাগড়া। তারঁ জীবনের প্রতিটি বাঁকেই অপেক্ষা করে থাকে কিছু নতুন ঘটনা, কিছু অভিনব রোমাঞ্চ। সবাই সেই রোমাঞ্চ অনুভব করতে পারেন তা নয়। অনেকেরই মনে হয় জীবনটা বড়ো একঘেয়ে, খুবই গতানুগতিক। কিন্তু আদতে তা নয়। মানুষ ইচ্ছে করলেই তার জীবন উপভোগ করতে পারে নিত্যনতুন ভঙ্গিমায়। প্রত্যেক দিনই মানুষের চেতনা বিম্ব কিছু না কিছু পরিবর্তন সাধিত হয় কালের অমোঘ নিয়মে। সেই চেতনা বিম্ব তিনি কী রঙ দেবেন তা মানুষ নিজেই ভাববেন, নিজের মতো করেই গড়বেন তারঁ জীবন। একটু একটু করে এগোবেন তার জীবনের প্রান্তে। একটু একটু করে আবিষ্কার করবেন নিজেকে। জীবনের পথে মাঝেমধ্যে থমকে দাঁড়িয়ে দেখবেন নিজেকে। সে দেখা বড়ো বিস্ময়ের। কখনও আনন্দের, কখনও আবিষ্কারকের।

মানব জীবনের অনেকটাই পার হয়ে হঠাৎ কোনও দিন পিছন ফিরে তাকালে এখনও দেখতে পাই ছোট্ট আমিটাকে। ছোটবেলার কিছু ফটোগ্রাফ থাকার দৌলতে নিজের মুখটা নতুনভাবে আবিষ্কার করা যায় প্রতিনিয়ত। সেই প্রাথমিকে পড়ার সময় থেকে শুরু করেছিলাম ছড়া লেখা। ছন্দ মিলিয়ে মিল দিয়ে লেখা অসংখ্য ছড়া একসময় হারিয়ে গেছে আমার ঠাইঁনাড়া জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে। ঠাইঁনাড়া বলছি এই কারণেই যে শৈশব-কৈশোরে একটি গ্রামে আমার বড়ো হওয়া, সেখান থেকে একসময় কলেজ পড়তে কোলকাতায় আসা। কোলকাতায় কতোবার যে বাসা বদল হয়েছে আমার জীবনে, পরবর্তীকালে পেশার সূত্রে এতো এতো জেলায় থিতু হয়েছি বছরের পর বছর যে এখন পিছন ফিরলে পুরোটা আমিকে আর একসঙ্গে দেখতে পাই না। চোখে পড়ে আমার অস্তিত্বের টুকরো। টুকরো টুকরো হয়ে আমারই মুখোমুখি ছড়িয়ে আছি আমি।

এই অনেকগুলো টুকরো নিয়েই আজকের আমি। সেই ছড়াকার একসময় লিখতে শুরু করেছিল কবিতা। জীবন তখন বয়ে চলেছে মহাকালের কী এক অনিবার্য টানে। জীবন তখন রোদে শুকোতে শুকোতে, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বিকেলের মরা আলোয় নিজেকে সেঁকতে সেঁকতে, রাতের অন্ধকারে চেতনালুপ্ত হয়ে পুনর্জন্ম নিতে নিতে, একসময় পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ক্রমশ।

তারপর একসময় হাতে উঠে এলো এক-একটি ছোটোগল্প।  তারপর এক-একটি উপন্যাস।

ছ-সাতটি কবিতার বই, তিনশোর বেশি ছোটোগল্প, তিরিশটির মতো উপন্যাস লেখার পরেও আজও মনে হয় সেই লেখাটা আজও লেখা হয়নি যা লিখতে চেয়েছি আশৈশব। অল্প বয়সের প্রগলভতায় মনে হত একটি বা দুটি কবিতার বই বা কিছু ছোটোগল্প বা একটি-দুটি উপন্যাস, ব্যস্, তাহলেই একজন কলমচি হয়ে ওঠে কবি বা লেখক। আজ জীবনের খাদের প্রান্তে পৌঁছে উপলব্ধি করি কবি বা লেখক কোনও কিছুই খুব সহজে হওয়া যায় না।

লেখক হওয়া কঠিন, সুকঠিন।
কী করে একজন কলমচি লেখক হয় তা এক আশ্চর্য রহস্য।
লেখক অর্থে এখন যা বুঝি তিনি আসলে একজন 'আউটসাইডার'। তিনি পৃথিবীতে আসেন বিশ্বপথিকের মতো। হি ইস জাস্ট অ্যা ট্রাভেলার ইন দিস ওয়ার্ল্ড। আসেন, বাস করেন, সবকিছু দেখেন নির্বিকার ভঙ্গিতে। তার মধ্যেই অনুভব করেন সবকিছু। কখনও খুব ঘনিষ্ঠ হন ঘটমান বিষয়ের সঙ্গে। পরক্ষণেই বিচ্ছিন্ন করেন নিজেকে। তখন বিষয়টি দেখেন অনেকখানি দূরে দাঁড়িয়ে।

সেসময় প্রতিটি মানুষই লেখকের চোখে একটি চরিত্র। প্রতিটি ঘটনাই কোনও না কোনও গল্পের প্লট। জীবনের প্রতিটি অংশই একটি উপন্যাস। কিন্তু কোনও মানুষ তার লেখার চরিত্র হয়ে উঠলে, কিংবা কোনও ঘটনা গল্প হয়ে ঢুকে পড়বে তারঁ লেখায় বা জীবনের কোনও এপিসোডকে তিনি উপন্যাস হিসেবে গড়ে তুলবেন তা লেখকের নিজস্ব ব্যাপার। তখন লেখক নিজেকেও দেখতে পান। একটু দূর থেকেই দেখেন নিজেকে। দেখতে দেখতে তারঁ লেখার মধ্যে একসময় ঢুকে পড়েন নিজেই। গল্পের সঙ্গে এগোতে থাকেন ধীর পায়ে। গল্পের অন্য চরিত্রদের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। হাঁটতে থাকেন পরিনতির দিকে। লেখক আর লেখার চরিত্ররা তখন একাকার। এভাবেই লেখকের এক-একটি লেখার গড়ে ওঠার ইতিহাস। প্রতিটি লেখাই একটি নতুন পৃথিবীর নির্মাণ।

তবে যিনি লেখেন তিনিই লেখক নন। দীর্ঘকাল লেখালেখির পরেও আমার এখনও মনে হয় না আমি একজন লেখক। সব সময়েই ভাবি আসল লেখাটা লেখা হয়নি আজও। হয়তো কোনও দিনই হবে না। পৃথিবীর বহু লেখকই আছেন যারাঁ সারাজীবন চেষ্টা করেও তার ইঙ্গিত লেখাটি শেষ পর্যন্ত লিখে উঠতে পারেননি। তবু লেখক না লিখেও পারেন না। লেখাটা লেখকের জীবনে একটা ধারাবাহিক ঘটনা। এভাবে লিখতে লিখতে একটা লেখা হয়তো পাঠকের প্রশংসা কুড়োলো, ঠিক পরের লেখাটায় হয়তো নিন্দে। এভাবে নিন্দা ও প্রশংসার সমভিব্যাহারে লেখকের একটু একটু করে লেখক হয়ে ওঠা।
আবার কোনও লেখার অবিশ্রান্ত প্রশংসাতেও লেখকের আত্মশ্লাঘার কোনও কারণ নেই। কোনও লেখার নিন্দে হলেও মুষড়ে পড়া অনুচিত। লেখা ভালো না হলে তার নিন্দে হবেই। মুষড়ে না পড়ে লেখককে তখন ভাবতে হবে কী কারণে লেখাটা প্রকৃত লেখা হয়ে উঠলো না৷ ভাবতে হবে পরের লেখাটা আরও ভালো করে লেখা চাই। আগের লেখাটির ত্রুটি খুঁজে বার করতে হবে। পরের লেখা থেকে দূর করতে হবে সেই ত্রুটি।
স্বীকার করা ভালো যে, কেউ আমার লেখার নিন্দে করলে তিনি পরোক্ষে আমার উপকারই করেছেন। কোনও সংকলনে আমার লেখা বাদ পড়লে তাতে আরও উসকে উঠছে আমার জেদ। কোনও বড়ো পত্রিকা আমাকে লিখতে না ডাকলে ভেবেছি তাহলে আরও ভালো লিখতে হবে। ভালো লেখাটাই হচ্ছে সব নিন্দে, উপেক্ষা আর অবহেলার জবাব। কারণ আমি তো জানিই কোনও লেখকই তারঁ লেখা সম্পূর্ণ ত্রুটি মুক্ত মনে করতে পারেন না। প্রায় সব লেখাই লেখকের আরও একটু মনোযোগ পেলে আরও পারফেকশনে পৌঁছাতে পারে। এভাবেই তো একজন লেখকের সারা জীবনের দৌড়।

আমি তাই আজও নিজেকে 'কমপ্লিট রাইটার' ভেবে উঠতে পারিনি। তবু লিখি, প্রতিনিয়তই লেখার মধ্যে অবস্থান করি। লেখা এখন আমার কাছে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। সারাদিন শত ব্যস্ততার মধ্যেও নতুন কোনও লেখা নিয়ে অনুশীলন চলে মনে মনে। লেখার বিষয়, তার চরিত্র চিত্রন, তার আঙ্গিক, তার ভাষা, তার উপস্থাপনা ------ এসবই জারিত হয় মগজের গোপন গহবরে। কবে যেন এভাবেই ঢুকে পড়েছি একটা প্রসেসের মধ্যে। এখন ইচ্ছা করলেও তার ভেতর থেকে আর বেরিয়ে আসা যায় না।

এখন একটা উপলব্ধি করতে পারি, দশটা ভালো গল্প কিংবা একটা কি দুটো ভালো উপন্যাস লিখেও নিশ্চিন্ত হতে পারেন না। লেখাটা হচ্ছে সারাজীবনের ব্যাপার। একজন লেখকের অনেক কিছুই বলার থাকে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় মানুষের এই পৃথিবী, তার জীবনযাপন। তা নানাভাবে না এঁকে তোলা পর্যন্ত নিস্তার থাকে না লেখকের।
কীভাবে এরকম একটি নির্দিষ্ট জগতের মাঝে ঢুকে পড়েছি তা ভাবতে এখন বিস্ময় জাগে। ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর টেবিলে ঘাড় গুঁজে একনাগাড়ে দৌড়ের পরও যেন ক্লান্তি নেই৷ নেই, তার কারণ এতো লেখার পরেও মনে হয় এখনও সেই পারফেকশনে পৌঁছাতে পারিনি যা কোনও লেখকের একান্ত অভীষ্ট।

লেখালেখির এই দৌড়টা কিন্তু শুরু হয়েছিল বহুকাল আগে৷ তখন আমার বয়স পাঁচ, দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। স্কুলের খাতায় লিখে ফেলেছিলাম একটা পংক্তি চারেকের ছড়া। পাঠ্যপুস্তকের ছড়া ও কবিতা পড়েই বোধহয় লেখার প্রথম প্রেরণা।

তারপর লেখালেখির সঙ্গে কিভাবে জীবনটা জড়িয়ে গেল, সেকথা পত্রস্থ করার আগে একটা তথ্য কবুল করা ভালো যে, সেই শৈশব থেকেই কিভাবে যেন আমার একটা ধারণা জন্মেছিলো ----- লেখালেখিই আমার ভবিতব্য। নইলে অধুনা উত্তর ২৪ পরগনার এক অজ গাঁয়ে ------ যেখানে সাহিত্যের দন্ত্য স সম্পর্কেও কোনও বাসিন্দার ধারণা ছিলো না, সেই পরিবেশে ক্লাস টু-এ পড়া একটি বালক কেনই বা তার নোট বইতে লিখে যাবে একটার পর একটা ছড়া!

জীবনের অনেকগুলো বছর পার হয়ে এখন আশ্চর্য হই সেই বালকটির স্পর্ধার কথা ভেবে। বালকটি তখনই নিশ্চিত ছিলো সে বড়ো হয়ে কবি হবে, কিংবা লেখক। আজ এতো বছর পরে সেই ছোট্ট 'আমি'টার দিকে তাকালে এরকম কিছু দৃশ্য পর পর ভেসে ওঠে চোখের পর্দায়।

Wednesday, May 8

সুজয় চক্রবর্তীর অণুগল্প




একাল সেকাল


সামান্য কথা কাটাকাটি থেকে রাগের পারদ যে এতটা চড়ে যাবে, বোঝেনি কেউ-ই ; না নীলাঞ্জন , না অনিতা ।
সকালে বাজারে যাওয়ার সময় অনিতা বারবার করে বলে দিলো, ‘ আজ কিন্তু মাছ এনো না। আমার শরীরটা খারাপ ।‘

বাজারে গিয়ে তা একেবারে ভুলে গিয়েছিলো নীলাঞ্জন । সবজি বাজারের শেষে এক কেজি দেড়শো গ্রামের একটা কাতলা নিয়েই ঘরে ঢুকলো সে ।

রাগে গজগজ করতে করতে মাছ কাটতে বসলো অনিতা ।

আজ রবিবার । অফিস ছুটি ।

দুপুরে খাওয়ার টেবিলে অনিতা কেবল নীলাঞ্জনের জন্যই ভাত বাড়লো । “শরীর খারাপ । খেতে ইচ্ছে করছে না ‘ বলে অনিতা যেই বাটিতে মাছের মুড়োটা রাখতে যাবে, অমনি নীলাঞ্জন বলে উঠলো, ‘ আমি ভাত খাবো না । খিদে নেই ।‘

এরপর উত্তর-প্রত্যুত্তর, অনুনয়-বিনয় চললো কিছুক্ষণ । রাগের পারদ চললো নীলাঞ্জনের। এক সময় সে ভাতের হাঁড়িটা ধরে আছাড় মারলো মেঝেতে ! সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়লো ভাত ! ডুকড়ে কেঁদে উঠলো অনিতা । স্তম্ভিত নীলাঞ্জনও ! এতটা করা ঠিক হয়নি । একটু মানিয়ে নিলেই তো ...।

হঠাৎ দেওয়ালে টানানো মায়ের ছবিটার দিকে চোখ গেলো নীলাঞ্জনের । কেঁদে ফেললো ।

একটা সময় পাশের বাড়ি থেকে পান্তা চেয়ে এনে মা খাইয়েছে তাদের দুই ভাইবোনকে । আর আজ একটা সরকারি চাকরি পেয়েই .........!

মায়ের হাসি হাসি মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে এখন । চেয়ারে বসেই মাথাটা নিচু করে ফেললো নীলাঞ্জন।


গোপা মুখোপাধ্যায়ের গল্প






সম্পর্ক
গোপা মুখোপাধ্যায়

স্কুল থেকে ফিরে ইচ্ছা খেতে বসে আবার সেই একই প্রশ্ন করবে মাকে। একথা ভাবতে ভাবতে সেই দুপুর থেকে অপর্ণা কেমন যেন আনমনা হয়ে যাচ্ছে। আজ কটা দিন মেয়েটার মুখে ঐ একটাই কথা, যার উত্তরদেবার মতো সৎ সাহস এবং যুক্তি কোনটাই অপর্ণার নেই। যথারীতি স্কুল ছুটি হবার পর ঠিক বিকেল পাঁচটায় ইচ্ছা বাড়ি ফিরলো। সাইকেলটা ঠিক করে রেখে ইচ্ছা মাকে ডাক দিয়ে বলল, “মা তাড়াতাড়ি খেতে দাও,খুব ক্ষিদে পেয়েছে।’’
অপর্ণা ও খুশী মনে বলে আয়,“তোর জন্যই বসে আছি।’’
এই বলে ইচ্ছাকে খেতে দেবার জন্য রান্নাঘরে গেল। কিন্তু মনের মধ্যে সেই এক ভয় ওকে তাড়া করে যাচ্ছে। খেতে খেতে ইচ্ছা কতো কথাই না বলল মাকে।কিন্তু একবার ও মায়ের ভয়ের প্রশ্নটা করলো না। তাই অপর্ণা মনে একটা বেশ স্বস্তি পেল।মেয়ের খাওয়া শেষ হলে ওর বাসনপত্র নামিয়ে টেবিল পরিষ্কার করে নিল।

এবাড়িতে অপর্ণা আর ইচ্ছা ছাড়া আরো দুটো প্রাণী থাকে।একজন অপর্ণার কাকু আখিলেশ বাবু, যিনি প্যারালাইসিসে পঙ্গু আর কুকুর টমি। এই টমি ইচ্ছার সুখ দুখের সাথী। প্রতিদিনের মতো আজ ও অপর্ণা আখিলেশবাবুর জামাকাপড় পাল্টে বিকেলে চা দিয়ে খবরের কাগজ পড়ে শোনালেন।

বসন্তের সন্ধ্যা।অপর্ণা ঘরের একচিলতে উঠোনে কতোই না গাছ। ছোটো ছোটো ফুলগাছ,দরজায় মালতীলতা ঝাঁকে ঝাঁকে ফুটে আছে। তুলসীমঞ্চের পাশে একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছে অজস্র ফুল। আর তার গন্ধে সারা ঘর মো মো করছে। এর ছায়াতে সারাদিন টমি বসে থাকে আর এ বাড়ীটা লক্ষ্য রাখে। দরজার বাইরে ছোট্ট আমগাছটাতে অনেক বকুল এসেছে, ভাল আম হবে এবার। সব গাছে রোজ অপর্ণা নিজে হাতে জল দেয়।আর তুলসীমঞ্চের ধারে একটা বালতিতে জল রাখে,যাতে তৃষ্ণার্ত পাখপাখালি জলপান করতে পারে।

সারাদিন বাড়ীটায় শূন্যতা ভর করে থাকে। অপর্ণার স্কুল এখান থেকে পনের কিলোমিটার দূর তাই বাসে যেতে হয়,আধঘণ্টা লাগে। আর ইচ্ছার স্কুল সাইকেলে মিনিট পনের। পরানপুর গ্রামে কোনো হাইস্কুল নেই। সন্ধ্যেবেলায় রান্না শেষ করে অপর্ণা কাকুকে খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে মেয়ের পাশে এসে বসে। ইচ্ছা পড়ছে, তাই ওর দিকে নজর দিতে হয়। হঠাৎ মেয়ে বাঁকা চোখে অপর্ণার দিকে তাকায়। মেয়ের দৃষ্টির ধার মা বেশ বুঝতে পারে তাই একটু অপ্রস্তুত হয়েই বলে ওঠেন,
“কি পড়ছিস? বায়োলজি?”
“হ্যাঁ,কেন?”
“না মানে এমনি বললাম। বলছি ইংরাজী বাংলাগুলোর দিকেও নজর দিবি। ওগুলোতে ও যে ভালো নম্বর তুলতে হবে।’’
“মা,আমার প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু তুমি দাও নি।’’
অপর্ণা এড়িয়ে যাবার জন্য বলে, “কাকুকে ওষুধটা দিয়ে আসি”। এই বলে অপর্ণা উঠে যায়। কোথায় যেন একটা দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে মা মেয়ের মধ্যে তা অপর্ণা বেশ বুঝতে পারছে। ইচ্ছা ও আজকালকার মেয়ে। কোনো কথা শে ভোলার পাত্রী নয়। তার উপর যথেষ্ট বুদ্ধিমতী এবং একাদশ শ্রেণী সায়েন্সের ছাত্রী। তাই হয়তো ম্যাচুরিটি ও একটু বেশিই।

অপর্ণা এসে আখিলেশবাবুর খাটের পাশে বসে। আর ঐ অসহায় মানুষটার দিকে তাকায়। মনে পড়ে যায় সব কথা। আজ থেকে প্রায় পনের বছর আগেকার ঘটনা। অপর্ণা তখন তারকেশ্বরের প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করত,তাই ওখানেই থাকতো। একদিন ঐ ষ্টেশনেই এই অখিলেশবাবুকে দেখতে পান অপর্ণা। সেদিনের কথা মনে করে দুচোখে জলের ধারা নেমে আসে ওর। আখিলেশবাবুর চোখে তা ধরা পড়ে যায়। বৃদ্ধের শীর্ন হাত আপ্রাণ চেষ্টা করে অ ব্যর্থ হয় অপর্ণার চোখের জল মুছিয়ে দিতে।
মাথার উপর ফ্যানটা বনবন করে ঘুরছে। আর শয্যাশায়ী অখিলেশবাবুর মনের মধ্যে স্মৃতিগুলো ও যেন সেই তালে বারবার ঘুরে ফিরে আসছে। সেই শ্রাবন মাসের সকাল,সদ্য তাঁর মমতাময়ী স্ত্রী মারা গেছেন।হঠাৎ অখিলেশবাবু জানতে পারলেন তাঁর ডির্ভোসি মেয়ে মানসী নিজের কন্যা সন্তানকে ফেলে নতুন করে অন্যের সাথে ঘার বাঁধার জন্য রেজিষ্ট্রি করে ফেলেছে। এই বেদানাদায়ক ঘটনায় ওঁর মন ভেঙে পড়ে। তখন তাঁর নিজের বাঁচার ইচ্ছেটুকু ও নিঃশেষ হয়ে যায়। তাই মানসীর রেখে যাওয়া কন্যা অর্থাৎ নাতনীর মায়ায় জড়াতে না চেয়ে পরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়েন। সেদিন কাঁধে ছিল সেই পুরনো ছিটের ব্যাগ আর হাতে চিরসঙ্গী কালো ছাতা মাথায় নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন অখিলেশবাবু। তারকেশ্বর ষ্টেশনে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে ভেবে পাচ্ছিলেন না কোথায় যাবেন। এমন সময় পিছন থেকে এক পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে তাকিয়ে দেখেন মেয়ের ছেলেবেলার বান্ধবী অপর্ণা। সেই মিষ্টি স্বভাবের একগুঁয়ে মেয়েটা। যে ছোটবেলায় বাবা মাকে হারিয়ে মামাবাড়িতে মানুষ।
অপর্ণা কাকাবাবুকে নিজের বাসায় নিয়ে তুললো সেদিন। রাতে অখিলেশবাবুর মুখে সব শুনে অপর্ণা তাঁকে আর বাড়ী ফিরে যেতে দেন নি। নিজেই যোগাযোগ করে মানসীর খোঁজখবর নেয়। মানসীর পথের কাঁটা ওর এক বছরের মেয়েকে নিজে সরকারীভাবে দত্তক নেবার সিধান্ত নেয়,তাতে অখিলেশবাবুর ও সম্মতি ছিল। অপর্ণা একবার ও নিজের সংসার পাতার কথা ভাবতেই পারেন না। তাঁর জীবনেও যে আছে এক দুঃখময় স্মৃতি। ভালোবাসায় চরম আঘাত পাওয়ার পর থেকে সে একাকিনী।

আজ রবিবার। সকালথেকেই আকাশটা বেশ গুম হয়ে আছে। কোথাও কোথাও কালো মেঘের ঘনঘটা। অপর্ণা তাড়াতাড়ি স্নান সেরে বাজারে যায়। ইচ্ছা গলদা চিংড়ি খেতে খুব ভালোবাসে আর কাকাবাবু মোচার ঘন্ট। তাই নিজে বাজার থেকে টাটকা এসব এনে রান্না করবে বলে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যায়।
পরানপুরের বাজারটা বেশ বড়। ওদের বাড়ী থেকে বেরিয়ে সোজা বড়রাস্তার মোড়। সেখান থেকে ডান দিকে বেঁকে চওড়া সিমেন্টের রাস্তার শেষ মাথায় দুপাশে বট আর অশ্বথ গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে,আর এখানেই রোজ হাট বসে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় অপর্ণা। একটা অতি পরিচিত গন্ধ নাকে আসে। বাঁদিকে চোখ যেতেই দেখে ইচ্ছা সারা মুখ ওড়না দিয়ে ঢেকে একটি ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। ছেলেটি ও অপর্ণার চেনা। ওদের সামনে না গিয়ে অন্য দিকে গিয়ে বাজার করে অপর্ণা বাড়ী ফিরে আসে। রান্না সেরে দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে অপর্ণা অখিলেশবাবুর পাশে এসে বসে। কাকাবাবু তাঁর চোখের তারা দুটো নাড়িয়ে কিছু জানতে চায়। অপর্ণা জানায় তাঁর মনটা ভালো নেই। আবার কাকাবাবু চোখের তারা দুটো নেড়ে জিগ্যেস করেন,কি হয়েছে? এবার অপর্ণা কান্নায় ভেঙে পড়ে। ইচ্ছার সব কথা জানায় কাকাবাবুকে।

ঘড়ির কাঁটা তিনটের ঘরে। পশ্চিমের আকাশটা কালো মেঘে ছেয়ে আছে, যেন এক্ষুনি ঝড় উঠে সব তছনছ করে দেবে। তাই সবাই যে যার জানালা দরজা বন্ধ করতে ব্যাস্ত। যাতে তার সাজানো গোছানো ঘর ঝড়ে তছনছ না হয়ে যায়। অপর্ণার ঘরেও তার ব্যাতিক্রম নেই। ওদিকে টমি চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। আর ইচ্ছা একা জানালা খুলে কালো মেঘের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। ঘরে অপর্ণা ঢুকতেই ইচ্ছা প্রশ্নটা মায়ের দিকে ছুঁড়ে দিল। বলল, “আমার বাবা কে?”
অপর্ণা আচমকা এই প্রশ্নে হকচকিয়ে যায়। বলেন,“কি বলছিস তুই?’’
“বলছি,আমার বাবা কে?”
“আমিই তোর বাবা। তুই শোন মা,আমার কথা শোন।’’
“না,এক্ষুনি বলো কে আমার বাবা?
       
অপর্ণা গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। বিনা ঝড়েই যেন ওর সাজানো গোছানো ঘর মুহূর্তে তছনছ হয়ে যাবে। এই ভেবে ছুটে আসে ইচ্ছার কাছে। পরম স্নেহে ইচ্ছাকে বুকে টেনে নিতে চায়। ইচ্ছা চিৎকার করে বলে উঠে,“না..., আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও,” এই বলে সে এক ঝটকায় অপর্ণাকে ছিটকে মেঝেতে ফেলে দেয়। নিজের অজান্তে ‘ইন্দ্রনীল’ নামটা বেরিয়ে আসে অপর্ণার মুখ থেকে। মেঝেতে পড়ে থাকে অপর্ণা।টমি আরো জোরে চিৎকার করে। ইচ্ছা মায়ের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করে,সে এখন কোথায়? ঘরের এককোণে রাখা শোকেসের দিকে আঙ্গুল বাড়ায় অপর্ণা,ভালো করে ইচ্ছা দেখে শোকেসের একদম ভিতরের দিকে রাখা এক সুপুরুষের ছবি। তা বের করে অপর্ণাকে দেখায় ইচ্ছা। অপর্ণা ও ঘাড় নাড়ে। ধীরে ধীরে অপর্ণা উঠে বসে। ইচ্ছাকে জানায় তার নিজের মা আসলে মানসী আর বাবা ইন্দ্রনীল। ধীরে ধীরে বিস্তারিতভাবে জানায় ওর ফেলে আসা জীবনের গল্প। অপলক দৃষ্টিতে ইচ্ছা দেখে অপর্ণাকে। একটা অপরাধবোধ গ্রাস করে ওকে। তাও জিগ্যেস করে অখিলেশবাবুর সম্পর্কে। অপর্ণা কিচ্ছু লুকায় না। ইচ্ছাকে জানিয়ে দেয় যে,‘ঐ মানুষটিই ওর নিজের দাদু।’ আর হারাবার ভয় হয় না অপর্ণার। ভাবে, ‘যে সর্বহারা তার আবার হারানোর ভয় কি?’ এবার সে মুখ তুলে আকাশের কালো মেঘের দিকে তাকায়,মনে করে মা যশোদার কথা। নিজের একাকীত্বের বোঝা বয়ে চলার কথাও মনে হয়।
মুহূর্তে ইচ্ছার জীবন অঙ্কের সমীকরণটা বদলে যায়। সে অনুভব করে সম্পর্কের টাণাপোড়েন। বুদ্ধিমতী ইচ্ছার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, ‘ওঘরের বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটার কাছে ওর  রক্তঋণ আর স্নেহময়ী পালিতা মা অপর্ণার কাছে ওর হৃদয়ের আত্মীয়তা। দুটোই আজ তার সমান প্রয়োজন। সে এসে জড়িয়ে ধরে এসে অপর্ণাকে। কাঁদতে কাঁদতে কাতর স্বরে বলে উঠে,“মা তুমি একা নও,এই তো আমি আছি।’’
অপর্ণা দুহাত দিয়ে বুকে চেপে ধরে ইচ্ছাকে। সে যেন কিছুতেই আর ওর বুক থেকে সরে না যায়। বাইরে তখন আঝোরে বৃষ্টি। নরম মাটির নির্মল সোঁদা গন্ধে ভরপুর পরানপুরের সন্ধ্যে। অপর্ণার বুকে ও এক পরম তৃপ্তিময় আর্দ্রতা।

 

Monday, May 6

তিস্তা রায়চৌধুরীর প্রবন্ধ

তিস্তা রায়চৌধুরীর প্রবন্ধ 


‘অরূপের রাস’: একটি পুনর্পাঠ

আচ্ছা, মুখোশের খেলা দেখেছেন কখনো? কিংবা নিজের মুখোশটাকে দেখেছেন কখনো? যদি, এক লহমায় সেই মুখোশটা ছিঁড়ে নগ্ন মুখটা যদি দেখা যায়, তবে কী দেখবো আমরা?! অন্তর্দ্বন্দ্ব, সংঘাত বৈ তো কিছুই নয়!! লেখক হিসেবে জগদীশ গুপ্তের (১৮৮৬-১৯৫৭) সৃষ্ট পাত্র-পাত্রীরা যে কাফ্‌কার মতো কিছুটা সংশয়, দ্বিধায় আক্রান্ত তা বলা যায়। কুলিশ কঠোর বাস্তবের রুক্ষ কঠিন মাটিই তাঁর কথাসাহিত্যের background হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তাঁর চরিত্ররা হয়ে উঠেছে দ্বিধাগ্রস্ত পথের পথিক।

লক্ষণীয়, এই সংশয় বা দ্বিধার জন্মের জন্য দায়ী ধনতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক সভ্যতার উদ্ভব। বিশেষত আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে আধুনিকতা-বিতর্ক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে পশ্চিমি আধুনিকোত্তরবাদের ছায়া বাঙালি-মনে ক্রমশ গাঢ়তর হয়ে ওঠাতে। সেইসঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে নব্য ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশোত্তরবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। পাশাপাশি তত্ত্ববিশ্বে যে জোয়ার তৈরি হয়েছে বিনির্মাণ পন্থা—নারীচেতনাবাদ—মনোবিকলনবাদ—অস্তিত্ববাদ-এর মতো সজীব চিন্তাপ্রণালীর দ্বারা, তা অস্বীকার্য নয়। এই প্রেক্ষিতে জগদীশ গুপ্তের সাম্প্রতিক পাঠ-প্রবন্ধ কার্যত হয়ে ওঠে পাঠোদ্ধার। একমাত্র সার্বিক পুনঃপ্রসঙ্গায়নের মধ্য দিয়ে নির্ণয় করা যায় তাঁর কথাবিশ্ব কতখানি সময়জীর্ণ আর কতটুকুই বা সময়াতিসারী।

বুদ্ধদেব বসু তাঁর ছোটগল্পের শরীরকে চিহ্নিত করেছেন, ‘সাহিত্য তীর্থযাত্রার হোল্ডল’ বলে। কারণ “তারমধ্যে নাটক, প্রবন্ধ, উপদেশ, বিদ্রূপ, সাময়িক টিপ্পনী, সবই কিছু কিছু মাত্রায় যেন মানানসই করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এমনকী কবিতাও ঢোকানো যায়— কবিতা না হোক, কবিত্ব।” জগদীশ গুপ্তের লেখনী এই সকল উপাদানকে ছাপিয়ে গিয়ে যেন অন্য কোনো এক সত্যের দ্বন্দ্বকে সামনে তুলে আনে। ‘কল্লোল যুগ’-এর প্রসঙ্গে জগদীশ গুপ্তের পরিচয় দিয়ে অচিন্ত্যকুমার লিখছেন, “বয়সে কিছু বড় কিন্তু বোধে সমান তপ্তোজ্জ্বল। তাঁরও যেটা দোষ সেটাও ঐ তারুণ্যের দোষ— হয়তো বা প্রগাঢ় প্রৌঢ়তার।”

আলোচ্য ‘অরূপের রাস’ গল্পে তাই খোঁজার চেষ্টা চলবে এই ‘প্রগাঢ় প্রৌঢ়তা’র। আত্মকথকের কথনে কাহিনীক্রমটি এরকম— ছোটোবেলার খেলার সঙ্গী পাড়ার কানুদাকে ভালোবাসে রাণু। কিন্তু ব্রাহ্মণ কানুর সাথে অব্রাহ্মণ রাণুর বিয়ে হয়নি। রাণুর পিতা-মাতার মৃত্যুর পর ঘটনাচক্রে বসন্তবাবুকে নিয়ে সংসার পেতেছে বাপের ভিটেয়। কানুর স্ত্রী ইন্দিরার সঙ্গে রাণুর সম্পর্ক বড় মধুর। রাণু তাঁকে বলে, “আয় বৌ, তুই আর আমি এক হয়ে যাই।” বসন্তবাবুর বদলির খবর এল। চলে যাওয়ার আগের দিন কানুদাকে সে বলে— “কানুদা কাল আমরা যাবো। তোমার বৌ আজ রাত্তিরে আমার কাছে শোবে।” পরদিন ইন্দিরা কানুকে বলল রাণুর পাগলামির কথা। “ইন্দিরা বলিল— যেন স্বামী আর স্ত্রী, সে আর আমি।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস চাপিয়া গেলাম। — ইন্দিরার অঙ্গ হইতে আমার স্পর্শ মুছিয়া লইয়া সে ত্বক রক্তপূর্ণ করিয়া লইয়া গেছে। ... আমি তৃপ্ত।”

এইবার কাহিনীটিকে একটু বিস্তারিত করে দেখা যাক। কাহিনীর শুরুতেই দুটি বিষয় দৃষ্টি আকর্ষক। একটি; প্রত্যকেবার রাণু ও কথকের বয়সের পার্থক্যকে নির্দেশ দেওয়া— “সে সাত, আমি চৌদ্দ বছরের”, “রাণুর বয়স দশ, আমার সতেরো” অর্থাৎ; বয়সের সাথে মনের বদলের হদিশ যেন জানিয়ে যাওয়া বা আলতো করে ছুঁয়ে যাওয়া। বুঝিয়ে দেওয়া শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলো। রাণুর বিয়ের সম্বন্ধ দেখতে আসলে, রাণুর সাজ দেখে অচিরেই তাই কথক ভাবতে পারেন “কিন্তু আমার বুকের ভিতরকার বাকস্ফূর্তি যেন অকস্মাৎ অবরূদ্ধ হইয়া গেলো...।” রাণুর বিয়ের অনতিপরেই তাই কথকের আত্মোপলব্ধি, “অন্তরের তৃষ্ণার্ত কলুষ অগ্নি-তরঙ্গের মতো আমার বুক জুড়িয়া গড়াইয়া বেড়াইতে লাগিলো।” — এই কামনা ঠিক কতটা গ্রহণীয়; বিশেষ করে বিবাহিত এক রমণীর প্রতি এই কামনা যেন ঠিক চিরাচরিত স্রোতে খাপ খায় না। অন্যদিকে রাণুর ভাবনা যদি দেখা যায় তাহলে তা পূর্বেই উল্লিখিত। এখানে, বেশ অনেকগুলি দ্বন্দ্ব বা সংঘাতকে লেখক খুব আলতো করে অথচ অসম্ভব প্রজ্ঞায় স্পর্শ করেছেন। প্রথমত, রাণু ও কানুর সামাজিক প্রেম যেন বৈধতা পায়নি কারণ কানু ব্রাহ্মণ। অন্যদিকে, একটি সামাজিক ধর্মীয় প্রশ্নকে দাঁড় করায় এই কাহিনী যখন বিনাপণে রাণুর বিয়ে হয়। এছাড়া, ইন্দিরার চরিত্রটি এক ভিন্নমাত্রার সংযোজন। রাণুর ছেলে বেণুর জন্য ইন্দিরার যে ‘লালসা’ তা কি কেবল অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা থেকে? সন্তানহীনতার গ্লানি নাকি একাকীত্বের যন্ত্রণা ইন্দিরাকে বারবার দহন করে? এই প্রশ্নের সদুত্তর কথক দেননি। অন্যদিকে, ‘বেণু’-কে কেন্দ্র করে কথকেরও যে লালসা জন্মায় তা আসলে “তাহারই সুনিবিড় আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তির এই বিগ্রহ”। রাণুর “প্রাণের স্পন্দন দেহের বিন্দু বিন্দু ক্ষরিত রক্ত, হৃদয়ের আনন্দ-রস স্থানান্তরিত হইয়া আমার অঙ্গ স্পর্শ করিয়া আছে। ...” — এই না পাওয়ার মধ্যে পাওয়ার যে পরিতৃপ্তির আস্বাদ বারবার এই কাহিনীতে ফিরে ফিরে আসে তা আসলে অপূর্ণ, অবদমিত কামের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। গল্পের শেষ দুটি বাক্য, “ইন্দিরার অঙ্গ হইতে আমার স্পর্শ মুছিয়া লইয়া সে ত্বক রক্তপূর্ণ করিয়া লইয়া গেছে। ... আমি তৃপ্ত।” এই তৃপ্তি ঠিক কীরকম? কানু - রেণু ও ইন্দিরা এই তিনটি চরিত্রের এক অদ্ভুত, অদৃশ্য ত্রিকোণ ও বৈপরীত্য চোখে আসে যা বিস্ময়কর। ‘কানুদার’ শরীর না পাওয়ার যন্ত্রণায় রেণু কানুদার স্ত্রীকেই স্পর্শ করতে চেয়েছে। ‘কানুদার’ স্ত্রীকে গভীর আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে কানুদার শরীরের স্বাদ নিয়েছে। ‘কানুদাও’ এতে তৃপ্ত হয়েছে। কিন্তু ইন্দিরা? ইন্দিরার সংঘাতটাই যেন একটা প্রশ্নচিহ্ন দাঁড় করায়। কানুর সন্তানহীনতার কারণ এবং ইন্দিরার রাণুর সাথে মিলন — এই দুইয়ের মধ্যেই আছে অতৃপ্ত, অবসমিত আকাঙ্ক্ষা, লালসা। এই ‘লালসা’-র contrast তিনটি চরিত্রের তিনরকম, তা সত্ত্বেও ইন্দিরার অভাববোধের প্রশ্নটাই সামনে আসে। রাণুর এই মিলন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলেও ইন্দিরার এই মিলন ঠিক কী ইঙ্গিত করে? বলা বাহুল্য, লেখক এই প্রশ্নের নিরসন করেননি। এই সংশয়টি তাই কাহিনীর শেষেও রয়ে যায়।

ফ্রয়েডীয় মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, গল্পটিতে বস্তুকাম(Fetichism) ব্যক্ত হয়েছে। প্রিয়জনের অভাবে প্রিয়জনের ব্যবহৃত উপকরণের দ্বারা কামতৃপ্তি এর মূল কথা। প্রাথমিকভাবে, এটি নারীর সমকামিতার কাহিনী মনে করলেও আদপে, ইন্দিরার Fetish চরিত্রটিকে পরিষ্ফুট করে। লক্ষ্যণীয়, এই কাহিনীর কোথাওই সমকামী মিলনের কথা স্পষ্টত বর্ণনা দেওয়া হয়নি— কেবল ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। তাই এটি ‘Homosexuality’ এর তকমা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে, হয়ে উঠেছে ‘Homo Eroticism’-এর যথার্থ বাহক। এ প্রসঙ্গে, বলা ভালো এই ব্যতিক্রমী যৌনিতা ও প্রেমের ধারণা অন্তত ‘কল্লোল পর্ব’-এ সাধারণ ছিল না। এখানেই জগদীশ গুপ্ত একজন যথার্থ ন্যাচারালিস্ট কথাসাহিত্যিক হয়ে ওঠেন।

 ‘ন্যাচরালিজম’ কী এই প্রসঙ্গে যেতে হলে আরেকবার ফিরতে হবে পূর্বপাঠে অর্থাৎ ধনতান্ত্রিক বুর্জোয়া সভ্যতার প্রেক্ষাপটে। ‘রিয়েলিজম’ তত্ত্বের প্রয়োগটির চূড়ান্ততম রূপভেদ হলো ‘ন্যাচারালিজম’। দর্শনে আর সাহিত্যে ‘রিয়ালিজম’ ভিন্নার্থবাহী হলেও, ওই দুই ক্ষেত্রে ন্যাচারালিজম প্রায় সমার্থক। ‘ন্যাচারালিজম’ তত্ত্ব এই ভাবনার উপর প্রতিষ্ঠিত যে, মানুষ বিশেষ কোনো গুণের অধিকারী নয়— যে কেবলমাত্র উন্নত শ্রেণীর এক প্রাণী, যার কোনো অধ্যাত্ম বা শারীরিক প্রবৃত্তি-অতিরিক্ত কোনো উচ্চতর স্তরের সম্পর্ক নেই। মানুষের চরিত্র ও ভবিতব্য বা পরিণাম নির্ধারিত হয়, দুটি প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা— বংশগতি ও পরিবেশ। মানুষের ব্যক্তিগত লক্ষণ—বৈশিষ্ট্য স প্রবৃতিতগুলি (ক্ষুধা, কামজবাসনা, লোভ ইত্যাদি) বংশগতির সূত্রে আসে। এবং সে তার সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবেশ, নিজের পরিবার, শ্রেণি ও প্রতিবেশের অধীন। শারীরবিজ্ঞানী Claude Bernard–এর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, ইতিহাসবিদ্‌ Hippolyte Taine-এর পর্যবেক্ষণমূলক তত্ত্ব এবং Charles Robert Darwin–এর ‘থিওরি অফ ইভোলিউশন’-এর তত্ত্ব ‘ন্যাচারালিজম’-এর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। শুধু অভিজ্ঞতাসঞ্জাত বিবৃতি নয়, নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে মোহমুক্তভাবে বৈজ্ঞানিক বীক্ষণ দ্বারা মানুষের আচরণ ও জীবন-পরিণতির সামাজিক ও মনোস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে ‘ন্যাচারালিজম’। ভারতবর্ষে; বিশেষত বাংলা সাহিত্যে যখন এই ‘রিয়ালিজম’, ‘ন্যাচারালিজম’- ইত্যাদি তত্ত্বগুলির অনুপ্রবেশ ঘটছে ততদিনে কলোনিয়াল পিরিয়ড, বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল, ধনতন্ত্র ও পুঁজিবাদ সভ্যতার উত্থান— তথাকথিত ‘আধুনিকতা’ বা ‘modernism’-এর অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে।

সমাজবিকাশের ধারায় পুরোনো ও নতুন সমাজব্যবস্থার দ্বন্দ্বে, যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে, মূল্যবোধের রূপান্তরে, অতীন্দ্রিয়তায় ঋদ্ধ রোম্যান্টিক রবীন্দ্রসাহিত্যের বিরোধিতায় বাংলা গল্প উপন্যাসে জন্ম নিল বাস্তবতা, অনিবার্য সূত্রে প্রকৃতিবাদ ও বিষণ্ণ-বাস্তবতা। “The metaphysical men is dead; our whole demand is transformed with the coming of the Physiological man”— এমিল জোলার এই ঘোষণাই গ্রহণীয় হল। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র এই ‘প্রকৃতিবাদ’কে স্বীকৃতি দিলেন না কিন্তু অদ্ভুত ভাবে রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে রাবীন্দ্রিকতার মোড়কের আড়ালে যেন স্বীকৃত হল মহেন্দ্রের কামজর্জর অবস্থা এবং বিনোদিনীর কামপীড়িত উত্তেজনা ও আশালতার প্রতি তার অনুরাগ। সেই দেহজ অতিরিক্ত অনুরাগ যেন নীরবে সমর্থন করলো আমাদের আলোচ্য ‘ইন্দিরা’ আর ‘রাণু’-র অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষিত মিলনকে। এখানেই, এই শারীরিক প্রবৃত্তির সরাসরি প্রকাশ একজন যোগ্য ন্যাচারালিস্ট সাহিত্যিকের লক্ষণ। ‘অরূপের রাস’ সেই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে স্বীকার করে, বহন করে। এ প্রসঙ্গে, ইসমত চুখতাই-এর ‘লিহাফ’ গল্পটি স্মরণীয়। এই কাহিনীতেও কোথাও সমকামীত্বের বর্ণনা নেই, কিন্তু কিছু বিবরণ সেই ‘Homo Erotic Sense’টি’কে বহন করে ঠিক যেমন আমরা দেখি ‘অরূপের রাস’-এ। কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক— “He, however, had a strange hobby... He kept an open house for students— young, fair and slender-waisted boys whose expenses mere borne by him.”  অর্থাৎ, বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কিশোর রাই নবাব সাহেবের অধীনে থাকতো। অন্দরমহলে, বেগমজান ও রাব্বুর কাহিনীটি সেই বাচ্চা মেয়েটির জবানীতে এরকম— “I woke up at night and Begum Jaan’s quilt was shaking vigorously as though an elephant was struggling inside”... “Go to sleep Child... There’s no thief.” that was Rabbu’s voice.” এই কাহিনীতেও কোথাওই কোনো সমকামিত্ব বা যৌন মিলনের কথা বলা নেই কিন্তু তবুও যে অতৃপ্তি ও আকাঙ্ক্ষার থেকে এই দেহজ বাসনার পরিপূর্ণ রূপ প্রস্ফুটিত হয় তা বোধহয় ‘রাণু’ আর ‘ইন্দিরা’র সাথে সমতুল্য। বাণী বসু-র ‘সংবাহ’ গল্পেও তাই ‘শোভা অগ্রবাল’ ‘রেণু’কে ত্যাগ করতে পারেন না। রেণুর হাতের স্পর্শই যেন কামনার দ্রবায়ণে পরিণত হয়। বারবার এই ছুটে চলা, ফিরে আসা, অতৃপ্তি, অবদমিত আকাঙ্ক্ষা, যৌনতা, লালসা এই সব নিয়েই তাই ‘অরূপের রাস’ যথার্থ হয়ে ওঠে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প সৃষ্টির মূলে সুন্দরের জন্য উৎকণ্ঠা আছে, কিন্তু অসুন্দরের অস্তিত্ব সম্পর্কে এক আগ্রহী সচেতনতাই যেন সেখানেও মুখ্য সুর। জগদীশ গুপ্তের কথাবিশ্বে পর্যটক হওয়াই শ্রেয়। আধুনিক কাল-এর মর্মে যে অস্তিত্বের উপাসনা করছিলেন কল্লোলীয়েরা, তার অন্তর্বর্তী কৃষ্ণবিবর শুধুমাত্র জগদীশের অনুভবে ধরা পড়েছিল। জগদীশের দৃষ্টিতে জীবন মূলতই ছিল অর্থহীনতায় আক্রান্ত। ডব্লিউ. বি. ইয়েটস-এর কয়েকটি পংক্তি তাই যেন দিশা দিয়েছিল— “Things fall apart; the centre cannot hold;/ Mere anarchy is loosed upon the world,/ The blood-dimmed tide is loosed, and everywhere/ The ceremony of innocence is drowned;” বস্তুত, জগদীশ গুপ্তের প্রতিভায় যে প্রবল ক্ষমতা ছিল। রচনার কাঠিন্য ও মর্মভেদী প্রাঞ্জলতার দীপ্তিতে সেই দুর্লভ সামর্থ্যের নিছক বহিরঙ্গ প্রকাশ। ভয়ানককেও সংবেদনীয় করে তোলার প্রবণতাই অনুপস্থিত ছিল জগদীশ গুপ্তের তীব্র প্রখর জীবনানুভাবে। এখানেই তাঁর প্রতিভার গ্রন্থি ও সীমাবদ্ধতা।




উল্লেখপঞ্জি –
১। জগদীশ গুপ্তের গল্প; সম্পাদক : সুবীর রায় চৌধুরী, দে’জ পাবলিশিং,
প্রথম প্রকাশ : অগস্ট ১৯৭৭
প্রথম দে’জ সংস্করণ : জানুয়ারি, ১৯৮৩

২। Lihaaf [The Quilt];
Ismat Chughtai, translated from urdu by M. Asaduddin;
Manushi

৩। সংবাহ; বাণী বসু
দেশ, শারদীয় ১৪১৫

৪। The Second Coming
W.B.Yeats

মানিক সাহার অণুগল্প





ইঁদুরের কল

বুকের ভেতর এই বিকেল বিকেল ভাবটা খুব ভালো লাগে টগরের। সারাদিন কাজের ব্যস্ততা, চিন্তা, দুশ্চিন্তা। তার ফাঁকে এই দুপুরবেলার অবসরটুকু তার কাছে খুব প্রিয় মনে হয়। মনে হয় কোন দূর দেশের একজন বণিক এসেছে তাদের গাঁয়ে। ক্লান্তি দূর করার ঘুম আর গল্প বিক্রি করছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে। টগরের সামর্থ কম তাই তার ঘুম আর গালগল্পের পরিমানও কম। তাতে অবশ্য তার কোন অভিযোগ নেই।

ইংরেজিস্যার বলেছিল, কাট ইয়োর কোট একোর্ডিং টু ইয়োর ক্লোথ। কথাটা ভারী মনে ধরেছিল টগরের। তারপর অবশ্য আর পড়া হল না। কণ্যাশ্রীর জন্য স্কুলে নাম আছে বটে, কিন্তু লেখাপড়ার সময় নেই। তাও মাঝে মাঝে চেষ্টা করে।  আসলে মা-টা মরে গিয়ে সব এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। যখন ছিল তখন বাড়ির বৌয়ের, বাচ্চার মায়ের গুরুত্ব কেউ বোঝেনি।  আর কে-ই বা বুঝতে চায়!

টগর বারান্দায় ছেড়া চাদরখানা বিছিয়ে নেয়। এখানে বেশ হাওয়া আসে। উঠোনের এককোণে নিমগাছ। হাওয়া লেগে তার পাতা ঝিরঝির করে। গোয়ালঘরের পেছনে খচখচ করে শব্দ হয়। লালি কুকুরটা বাচ্চা দিয়েছে ওখানে৷ তার শব্দই হবে। তার পাশে টগরের প্রিয় দুটি গাছ গায়ে গায়ে বেয়ারে উঠেছে। একটা জারুল আর একটা অমলতাস। অমলতাসকে 'বান্দরেরনেটু' নামেই চেনে গ্রামের সবাই।

হলুদ রঙের ফুল ফুটলে মনে হয় গাছের ভেতরে হয়তো একটা দুপুর চুপ করে বসে আছে। জারুল ফুলগুলি যখন বাতাসে উড়ে উড়ে ওদের উঠোনে এসে পড়ে টগর সেই পাপড়িগুলো তুলে নিয়ে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে জমা করে। ওর মনে হয় এইসব ফুল, পাতা, আলো, বাতাস সবকিছুই তার কাছে কিছু বলতে আসে।  অথচ সে তাদের ভাষা বোঝে না। অনেক কিছুই বোঝে না সে। এই যেমন ওর লেখাপড়া।

টগর পড়তে চায়। কিন্তু ওর বাবা চায়না। তাহলে বাড়ির কাজ কে করবে। কে সামলাবে ঘরদোর। টগর বাবাকে বোঝাতে চাইত লেখাপড়া চালিয়েও সে ঘর সামলাতে পারবে। বাবা মানে না, "লেহাপড়া কইরা কি জজ ব্যারিস্টার হবা ?  আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দাও। যা কই তাই শোন। মা নাই তুমি হইলা বড়। তোমার মেলা দায়িত্ত। বুচচো? "

"তালে ইস্কুলে নাম রাখসো ক্যা? খালি ট্যাহার জইন্য? "

"মাইয়া মানুষের বেশি পড়ালেহা করা ভালা না। তোমার দুই ভাই আছে। অরা পড়ুক। তুমি মাঝে মাঝে দ্যাহায় দিবা।...বড় হইচ কিয়ের লাইগ্যা?"

টগরের কান্না পায়। রাগ পায়। কিন্তু বাবার সাথে পেরে ওঠে না। জারুল গাছে গুটগুট করে ঘুঘু ডাকে। কয়েকটা পাখি ডানা ঝাঁপটা মেরে উড়ে যায়। টগর ভাবে আকাশ কত্ত বড়! নিজের জন্য একটা জায়গা খোঁজে সে।  মায়ের কথা মনে পড়ে। মা বলতো," টগর লেহাপড়া বাদ দিবি না। কারো কথা হুনবিনা। কেউ চায়না মাইয়ারা বেশি লেহাপড়া করুক। তোর কিন্তু চাকরি করন লাগবো, কয়া দিতাছি। "

টগর মাটির দিকে তাকায়। মনে মনে বলে, "মাইয়ালোকের জায়গা নাই। কেউ জায়গা দেয়না। জায়গা কইরা নেওন লাগে।"

ঘরে গিয়ে বইখাতা বের করে। এখন তো বইখাতার জন্য বাপের কাছে টাকা চাইতে হয়না। সুতরাং...

  টগর পড়বে এবং পরীক্ষাও দেবে। স্কুলে গিয়ে হোক আর না-গিয়ে হোক।এই দুপুরটুকু, ভোরেরবেলাটুকু, রাতেরকিছুটা সময়,  টগর হিসেব করে নেয়। পড়ার সময় সে ঠিক বের করে নেবে। চাকরি করবে। একটা আলো করা ঘর থাকবে...।

বিকেল গড়িয়ে গেলে বাবা ঘরে আসে। টগরকে ডাক দেয়। "কাইল তোমারে দেখতে আসবো। একটু পরিপাটি হয়া থাইকো। তোমার কাকিরে কইছি। তোমারে সাজায় দিবেনি।"

সারা শরীর অবশ হয়ে যায় টগরের।"কী কও ইগলা? আমি তোমার কথা হুনচি। ইস্কুল বাদ দিছি। কিন্ত মাধ্যমিক..."

"আহ! যা কইছি তার যেন নড়চড় না হয়। ছেলে ভাল৷ বন্দরে পানের দোকান। ভালোই রোজগার করে। আর তোমার অতসব ভাবার কিছু নাই। যা কইলাম সেইডাই করবা।... লেহাপড়া পরেও করন যাইবো যদি তোমার শ্বশুরবাড়ি থিকা পারমিশন দেয়।"

"আর ইস্কুলে নাম? "

"নাম থাকবো। আঠারো বচ্ছর না হইলে তো আর নাম কাটানো যাবো না। ট্যাহাগুলা নষ্ট কইরা কি লাভ কও!"
ঘরের ভেতরে ঠাস করে শব্দ হয় ৷ একটা ইঁদুর মনে হয় কলে পড়ল। টগরের চোখে জল আসতে চায়। আটকে রাখে।

বাবা কল নিয়ে বাইরে আসে- " হালাডারে আইজকা পাইচি। খুব অইত্যাচার করছিস। আজ তোরে হালা জলে ডুবায়া মারুম।"

টগর নির্বাক হয়ে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকে। দম বন্ধ হয়ে আসে।



Sunday, May 5

রবীন বসুর গল্প






ডিলিট


রাকা যখন বাস থেকে নামল তখনও বৃষ্টি পড়ছে l ছাতা নিয়ে বের হলেও বাসস্ট্যাণ্ড থেকে বাড়ি— এই রাস্তাটুকু আসতে ভিজে একসা l আজ শনিবার, তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি l বিকেলে মাকে নিয়ে ডাক্তার বাবুর চেম্বারে যেতে হবে চেক-আপে l

বাড়ি ঢুকতেই মা বলল, জানিস রাকা রজত আজ ফোন করেছিল l

—কেন? সেসব পাট তো চুকিয়ে দিয়ে এসেছি l আমি ওর ব্যাপারে আর ইন্টারেস্টেড নই l

—বলল, তোর সাথে নাকি জরুরি দরকার l বিকেলের দিকে আসবে বলেছে l

রাকা আর কথা বাড়ায় না l  মাকে বলে, ভিজে গেছি খুব l একটু কড়া করে চা কর তো মা l

—তুই চেঞ্জ করে আয়, আমি চা বসাচ্ছি l


রজতকান্তি রায় l স্কুলমাস্টার বাবার প্রিয় ও মেধাবি ছাত্র l এম বি এ করার পর কর্পোরেট দুনিয়ায় মোটা বেতনের চাকরি l রাকা মাস্টার্স আর বি এড করে এস এস সি দিয়ে একটা স্কুল জয়েন করেছে l বাবা একদিন সান্ধ্যভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরে জানাল, রাকার একটা সম্বন্ধ করে এলাম l রবিবার ওকে দেখতে আসবে l

রাকার মা তো অবাক l

—কী বলছ তুমি? সম্বন্ধ, দেখতে আসবে l তুমি রাকার মত নিয়েছ? ও এখন বিয়েতে রাজি হবে?

—শোন, ছেলেটি আমার ছাত্র ছিল l ওর নাম রজত l ওর বাবা সুবিমল আমার কলেজবন্ধু l রাকাকে চেনে l ওর মেয়ে প্রিয়া, আমাদের রাকার সঙ্গে একই নাচের স্কুলে নাচ শিখত l রাকাকে সুবিমলের খুব পছন্দ,তাই ছেলের বউ করতে চায় l

এরপর একটু থেমে রাকার বাবা আরও বলেছিল, আর মাত্র এক বছর আমার চাকরি আছে l আমার তো কোন ছেলে নেই, আমার অবর্তমানে কে রাকার বিয়ে দেবে?

তাই আমি চাই, চাকরি থাকতে থাকতে রাকাকে পাত্রস্থ করতে l এখন তোমরা যদি অমত কর, তাহলে থাক l


রাকা বাবার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল l বিয়ে সে করবে l তবে শর্ত দিয়েছিল l বিয়ের খরচ সে ব্যাঙ্ক থেকে পার্সোন্যাল  লোন নেবে l মাসে মাসে তার মাইনে থেকে ইএমআই কাটা যাবে l বাবাকে সে নিঃসম্বল হতে দিতে পারে না l


বিয়ের দু’তিন বছর পর থেকে রজতের পরিবর্তন শুরু হল l সে শুধু কাজের জায়গায় প্রমোশন আর উপরে ওঠার সিঁড়ির খোঁজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল l অফিস মিটিং পার্টি l এরই মধ্যে অফিসের বস মিস বিয়াসের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ল l বিজনেস ট্যুর আছে বলে দিনের পর দিন বাইরে যেত l ড্রিংকের মাত্রাও বেড়ে চলল l প্রথম প্রথম রাকা বুঝিয়েছিল l

— কী দরকার অত টাকা আর প্রমোশনের পেছনে ছোটা l বেশ তো আছি আমরা l শুধু শুধু টেনশন নেওয়া l তার থেকে আমাদের দু’জনের মাঝে তৃতীয় কেউ আসুক l

ছিটকে গিয়েছিল রজত l  বিকৃত মুখভঙ্গি করে রূঢ়স্বরে বলেছিল, এই না হলে মাস্টারনি l যত্তসব ন্যাকামি l স্বপ্ন দেখতেই শেখেনি l রাবিশ l

রজতের এই রূপ রাকা ভাবতেই পারে নি l সেদিন মনে মনে শুধু আহত হয় নি, নারী হিসেবে অপমানিত বোধ করেছিল l

এরপর নিজেকে শামুকের মত গুটিয়ে নিয়েছিল l শক্ত  খোলসের আবরণে নিজের সব চাওয়া-পাওয়া আর স্বপ্নকে ঢাকা দিয়েছিল l রজত কিন্তু থামেনি l বাড়িতে পার্টি অ্যারেঞ্জ শুরু করল l অনেক রাত পর্যন্ত নাচ-গান হৈ-হট্টগোল l রাকার কোন আপত্তি কানে তুলত না l দিন দিন কেমন মরিয়া আর হিংস্র হয়ে উঠতে লাগল l মাত্রা ছাড়াল যেদিন মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে কয়েক লাখ টাকা চাইল l কারণ জেনে রাকা কঠিন হয়েছিল l বলেছিল, না, টাকা আমি দেব না l প্রথমত অত টাকা আমার কাছে নেই l আর দ্বিতীয়ত থাকলেও আমি হোটেলের বিল মেটাতে টাকা দেব না l

রজত খেপে গিয়ে হাতের কাছে থাকা কাঁচের গ্লাস ছুঁড়ে রাকার কপালে মারল l রক্তাক্ত রাকার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল l  সে সিদ্ধান্ত নিল আর না l এ সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাই l

সুযোগও এসে গেল l কয়েক দিন পর মা ফোন করল, তোর বাবার খুব শরীর খারাপ l আমার কেমন ভয় করছে l বোধহয় হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে l তুই একবার আসবি, মা?

সেদিনই রাকা ও-বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে এল l আর সে মাসেই পর পর দু’বার অ্যাটাক হয়ে বাবা চলে গেলেন l


সেই থেকে রাকা মায়ের কাছে l ফোনে শাশুড়িকে বলে দিয়েছে, সে সেপারেশন চায় l ও বাড়িতে আর ফিরবে না l

একদিনের জন্যও রজত মাকে ফোন করে নি l বাবার কাজের সময় ও নাকি বিদেশে ট্যুরে ছিল l বাবা চলে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে মাকে অনেকটা স্বাভাবিক করেছে রাকা l এমন সময় কানে এল অনেক কথা l যাকে সিঁড়ি করে রজত কোম্পানীর শিখরে পৌঁছতে চেয়েছিল, সেই মিস বিয়াস তাকে পথে বসিয়ে অন্যতম এম ডি মিঃ চৌধুরীর কাঁধে ঝুলে পড়েছেন l রজতের প্রমোশন তো হলই না, উল্টে মিস বিয়াসের তছরূপ করা অনেক টাকার দায় ওর ঘাড়ে পড়েছে l মোটা ফাইন দিয়ে চাকরি বাঁচিয়েছে রজত l


মা চা দিতে রাকা কাপ হাতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল l এখন আর বৃষ্টি নেই l গাছের মাথাগুলো বৃষ্টি-ধোওয়া হয়ে বেশি সবুজ দেখাচ্ছে l সাধারণ স্কুলমাস্টারের আটপৌরে মেয়ে জীবনে খুব বেশি স্বপ্ন দেখেনি, শুধু মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল l  সেই মর্যাদায় আঘাত l অভিমানী রাকার চোখ জলে ভরে গেল l ঝাপসা চোখ নিয়ে সে দেখল, একটা গাড়ি দাঁড়াল গেটের সামনে l রাকা দেখল রজত নামছে l ও তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এল l এসিটা অন করে রজতকে বসার ঘরে বসাল l ওকে কেমন কাহিল দেখাচ্ছে l অফিস থেকে সোজা এসেছে l রাকাকে এক পলক দেখে রজত বলল, কেমন আছো?

—ভালো l রাকা মুখ নিচু করে হাতের বলাটায় একবার হাত বুলিয়ে নিল l তা হঠাৎ কী এমন জরুরি দরকার পড়ল?

—জরুরি তো বটে, দরকারও l

—যা বলার তাড়াতাড়ি বল l মাকে নিয়ে ডাক্তারবাবুর কাছে যাব l

—শুনেছ তো নিশ্চয়ই l সব ব্যাপার l

—হ্যাঁ, তোমার মা আমার মাকে ফোন করেছিল l

—আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি l সরি, বাড়ি ফিরে চল রাকা l

—তা আর হয় না রজত l অনেকটা সময় চলে গেছে l আমি আবার নতুন করে সবকিছু ভাবতে শুরু করেছি l তোমার মানসিকতার সঙ্গে আমার কোন মিল নেই l তাছাড়া মা এখন একা, আমাকে মায়ের পাশে থাকতে হবে l

রাকা সোফা থেকে উঠে দেয়াল আলমারির কাছে গেল l পাল্লা খুলে কিছু পেপার্স  বের করে রজতের সামনে রাখল l
—আমি ল-ইয়ারকে দিয়ে আমাদের মিউচিউয়্যাল সেপারেশনের ডিড করিয়ে রেখেছি l সইও করে দিয়েছি l তুমি সই করে কোর্টে জমা দিলেই হবে l আমার কোন ক্লেম নেই l তুমি তোমার মনের মত একজন গতিশীল অ্যাম্বিশাসী আধুনিকাকে বিয়ে কর l

—তা হয় না রাকা, প্লিজ ফিরে চল l

—কোন ভাবেই আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না l
—তুমি তাহলে তোমার জীবন থেকে আমাকে ডিলিট করে দিচ্ছ?

—হয়তো তাই l ইনবক্স ভরে গেলে লোক তো তাই করে l

টেবিল থেকে পেপার্সগুলো নিয়ে ঝড়ের বেগে ঘর থেকে  বেরিয়ে গেল রজত l ওর গাড়ি বের হবার শব্দ কানে যেতেই রাকা আকুল হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল l আজ সত্যি সে তার জীবন থেকে একটা অধ্যায়কে ডিলিট করে দিল l

                             

সুদীপ ঘোষালের গল্প




পারিজাতের কুটির


 সন্ধ্যার দিকে একটা  লোকাল ট্রেনে সুবোধ আর অপর্ণা রোজ  বাড়ি ফেরে।  স্কুল এক না হলেও কাছাকাছি।স্টেশন থেকে দূরত্ব অনেকটা। তাই অর্পিতা একা আসতে সাহস পায় না। মোবাইলে জেনে নেয় সুবোধের খবরাখবর। তবে সুবোধ কাজ থাকলে আগেই জানিয়ে দেয়। আজ যথারীতি দুজনেই স্কুলে এসেছিলো। এখন ফেরার পালা।

ট্রেন চলছে। ফাঁকা সিটগুলো মন খারাপের  সুরে চলছে। লোকজন খুব কম। অর্পিতা বললো,কি রে আজকে লোকজন কম কেন?  কোনো পুজো পরব     আছে না কি? সুবোধ বললো, না তো। জানা নেই।
অন্যদিন দুজনেই মোবাইলে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু আজ ব্যাপারটা অন্যরকম। দূরে বসে আছে চারটে লোক। বেশ ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। সাধারণত এত আস্তে কথা  কেউ বলে না।

অর্পিতার থার্ড আই সচেতন হলো। বললো,বুঝলি পরের স্টেশনে নেমে আমরা অন্য কামরায় বসবো।কিন্তু বিধি বাম। ট্রেনটা হঠাৎ মাঝ মাঠে থেমে গেলো। এখনও এক ঘন্টা লাগবে।

এতদূরে স্কুল। এবার দুজনেই আবেদন করেছে সরকারের কাছে। বাড়ির কাছে এলে সমস্যা মিটে যাবে  । 

ট্রেনটা থমকে দাঁড়িয়ে আছে।অর্পিতার মনে হলো, কতযুগ ধরে এখানে অন্ধকারে তারা আছে। সময় কাটতে চাইছে না। ঝিঁ ঝিঁ পোকাগুলো আলো ছড়ানো শুরু করেছে। কোন এক রূপকথার জগতে হারিয়ে যায় মন।

হঠাৎ সুবোধের আর্তনাদে সম্বিত ফিরে  এলো  অর্পিতার। লোক দুজন সুবোধকে ধরে এক ঠেলায় ফেলে দিলো আর দুজন অর্পিতাকে বেঁধে একটা বোরখার মত পোশাক পরিয়ে দিলো। এখন অর্পিতার কিছু করার নে। চারজন তাকে ঘিরে রেখেছে বাঁধা অবস্থায়।

প্রায় দশ মিনিট পরে ট্রেন ছেড়ে দিলো। সুবোধ পরে থাকলো আহত অবস্থায় জঙ্গলের মধ্যে।অর্পিতা ভাবে,এই রাতের অন্ধকারে সুবোধ বাড়ি ফিরে যেতে পারবে তো?

অর্পিতা   ভাবে সে কোথায় যাবে  । চাকরির কি হবে,?     এরা কি করতে চায় আমাকে নিয়ে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এখনও অবধি এরা কেউ দেহের গুপ্ত স্থানে হাত দেয় নি। কথাবার্তা  বেশি শোনা যাচ্ছে না। অভ, ইতর স্বভাবের নয়। তাহলে এদের উদ্দেশ্য কি?

এইসব চিন্তা করতে করতে হয়ত কোনো ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো অর্পিতা।

যখন ঘুম ভাঙলো তখন সে শুয়ে আছে জঙ্গলের মাঝে উঁচু একটা মাচানে। খড়,বিচুলি দিয়ে পাতা বিছানা। মাচানের মাথায়   হোগলা পাতার ছাউনি। চারিদকে বন, জঙ্গলে ঘেরা। সামনেইনএকটা ডোবা রয়েছে।

এখন অর্পিতার হাত মুখ বাঁধা নেই।মুক্ত স্বাধীন। বেশ একটা ভয় ভয় ভাব। কিন্তু সামনে কোনো পুরুষ    নেই। একটা দেহাতি মহিলা এলো। ভাঙ্গা বাংলায় কথা বললো।সে বললো,দিদি আপনি একোন হামাদের নজরবন্দি হুয়ে আছেন। পালাতে চেষ্টা কোরবেন না। বাঘ, ভাল্লুক আছে। ছিঁড়ে খেয়ে লিবে। এখন ইখানেই আপনার জিন্দেগি    কাটবে। 

অর্পিতা বললো,তোমার নাম কি?

মহিলাটি বললো,আমিও আপনার মত এখানে এয়েছি।কিন্তুক এরা লোক ভালো। নিজের কাজ লিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমার নাম মঙ্গলি বাঈ।আমাকে সবাই মা বলে ডাকে।

অর্পিতা স্কুলে থাকতে মাঝে মাঝে ভাবতো, একটা জঙ্গলে একবার হারিয়ে গিয়ে দেখবে কেমন লাগে? একঘেয়ে জীবনে আনন্দ নেই। বিধাতা তাই হয়তো সেই সুযোগ দিয়েছে।

অর্পিতা ভাবলো হা পিত্যেশ   করে লাভ নেই। এরা কি চায় দেখা যাক। মরার আগে ভূত হয়ে লাভ নেই।

রাতে মা খাবার দিলো আর অর্পিতার কাছে শুয়ে পড়লো। ভোরবেলা থেকে পাখির আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মা সব ঘুরে ঘুরে অর্পিতাকে চিনিয়ে দিলো। অর্পিতা চালাকি করার চেষ্টা করলো না। দেখলো চারদিকে বিপদের হাতছানি। সাপ,কাঁকড়াবিছে, জোঁক কিছুরই অভাব নেই। তারপর বাঘ,শিয়াল,হায়েনা তো আছেই। শিক্ষিতা আধুনিক মেয়ে সে। বুঝতে পারলো সে এক ভীষণ শক্ত জালে বন্দি।                       
একদিন দুপুরের সময় আলোচনা সভায় নেতাদের আবির্ভাব হলো। এবার প্রথমে দলের ব য়স্ক   লোকটি বললো,মা তুমার ইখানে কোনো মানহানি হুয়েছে কি?

অর্পিতা নির্ভয়ে বললো, আমি এখন কোথায় আছি জানতে চাই। আর আপনাদের উদ্দেশ্য কি?  আমাকে আপনাদের কি প্রয়োজন।

বৃদ্ধ লোকটি বললো,তুমার অবস্থান আমরা বলবেক লাই।    আমরা না খেয়ে মরবো কেনে?  তার প্রতিকার চাই। আর তুমাকে আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষা দিবার লেগে এনেছি। তুমি শিখাই পড়াই দিবে। আমরা জানি তুমি ইস্কুলের মষ্টার। তাই তুকে তুলেছি। সারা দেশের নানা জায়গার লোক ইখানে আছে। আমরা মেয়ে মাষ্টার চাই।পুরুষ মানহষ এসে ইখানে মা বোনের ইজ্জত লিয়ে মরে। তুদের সভ্য জগতের পুরুষগুলাকে আমরা না পসন্দ করি।
আমি বিশি কুতা বলবেক লাই। তু কাজ শুরু কর। আমরা ডাকাতি করেখাবার লিয়ে আসি।

অর্পিতা দেখলো কোনো পথ নাই। হাতে এদের অস্ত্র। কি করে পায় এরা জানি না। পেটে ভাত নাই আর যুদ্ধের শখ। জন্ম থেকে এরা এই শিক্ষা পায়। সরকার তো চেষ্টা করে। কিন্তু একদিন কি আলো ফুটবে না এদের চোখে। অর্পিতা এদের মায়ায় পরে যায়। মনটা কেঁদে ওঠে আর জেদ চেপে যায়, করবো অথবা মরবো।

আলোচনা শেষে অর্পিতা মেয়েদের নিয়ে আলাদা করে বসলো। সে বললো,আমরা লেখাপড়া শেখার পাশাকাশি কাজ করবো।

মিনা বললো,কি কাজ রে দিদি।
অর্পিতা বললো,চাষ করবো। আমরা ফসল ফলাবো জঙ্গলের বুকে। তোরা আমার সাথ দিবি তো?

সব মেয়েরা সমস্বরে বললো, হুঁ দিবো। লিশ্চয় দিবো।

এইসব      ছেলে মেয়েরা    খাটতে জানে। কাজ করে খেতে জানে। শুধু এদের পরিচালনা করতে হবে সঠিকভাবে।

পরের দিন থেকে শুরু হয়ে গেলো অর্পিতার কাজ। সকালে পড়ানো। তারপর কাজ আর কাজ। মাঝে রান্নাবান্না করে একসাথে খাওয়া। এখানে বহুদূরে এক একটি গ্রাম আছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম পায়ে হাঁটা জঙ্গলের সরু পথ। একটা নদীর ধারে জলপ্রপাত। জঙ্গল কবিতাময় মাকড়সাজাল। পথ হারালেই   বিপদ। বাঘ এখানে সহজে আসে না। তবে খট্টাস, খরগোশ  , বেজি,সাপ, শেয়াল দেখা যায় সবসময়। সবথেকে ভয়ংকর হলো হায়না। দলবেঁধে ঘোরে। একটা গোটা গরু     খেতে সময় লাগে কুড়ি মিনিট। কত মানুষ এদের খপ্পরে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে।

আজ বাইশ মাইল দূরে একটা মালগাড়ি ট্রেন ছিনতাই করতে গিয়ে ধংলুর ডান পায়ে গুলি লেগেছে।

তবে ওরা বিভিন্ন শস্যের বীজ, ফসলের বীজ আর প্রচুর চালভর্তি বস্তা    ডাকাতি করেছে। অর্পিতার ভালো লাগলো না। সে বললো,আমার মত যদি নাও আজ থেকে চুরি বন্ধ করো।

----আমরা খাবো কি?
একজন প্রশ্ন করলো।
অর্পিতা বললো,আমরা নিজেরাই জঙ্গল কেটে বা পুড়িয়ে জমি তৈরি করবো ফসল   ফলাবো তোমাদের আনা এই বীজ দিয়ে।

একজন বললো,অত সোজা লয় রে। সোজা হাতে গুড় উঠবে না বাপ।
অর্পিতা জানে বাধা  আসবে। তবু সে এগিয়ে যাওয়ার জেদে অটল রইলো।
মঙ্গলী বাঈ অর্পিতাকে ভালো যত্ন করেন। বলেন, তু আমার বিটি। তুর কোনো অসুবিধা হতে দিবক লাই।
অর্পিতা দেখলো এদের পাঁচমিশালী ভাষা। কিছুটা হিন্দি কিছুটা সাঁওতালি আবার অনেকটা বাংলার মত।     

শুরু হয়ে গেলো চাষ। জলের অভাব নেই। জঙ্গল কেটে পুড়িয়ে বাড়তে থাকলো চাষযোগ্য জমি। মাটির বুকে ফসলের ঘুম, মনকে নাড়া দিলো অর্পিতার ভাবনা।

অন্ধকারে একটা বিশাল হায়েনা একটা ছেলের পা চিবোতে থাকে। তার চিৎকারে লোকের গোলমালে হায়েনাটা পালিয়ে যায়। এরা চুরি করে খড় এনেছে। সবার হাতে এক একটা জ্বলন্ত খড়ের আঁটি।আগুনের ভয়ে সব হায়েনা পালিয়ে গেলো।

অবধারিত মরণের হাত থেকে বেঁচে গেলো ছেলেটা কিন্তু পা টা তার অকেজো হয়ে গেলো। ছেলেটা সুস্থ হওয়ার পর থেকে পড়াশোনার প্রতি মন দিলো। আর দিদির স্নেহে সে বড় হতে লাগলো।

অর্পিতা তাদের সঙ্গে ছয়মাস হলো আছে। তাদের সংস্কার, ভাষা,অভ্যাস,বিশ্বাস ধীরে ধীরে জেনে গেলো। অর্পিতা তাদের মধ্যে জাগাতে থাকলো নতুনকে জানবার আগ্রহ, শান্তির বাণির সুস্থ ভাবধারা, অসির চেয়ে মসি বড়োর ধারণা আর মানুষকে বুঝবার ইচ্ছাশক্তি।   

স্বদেশে ফেরার লোভ বা মোহ যে একেবারেই ছিলো না তা নয়। অর্পিতা চাইলো এদের সঙ্গেই নিজের ভবিষ্যৎ জড়াতে।

কষ্টসাধ্য জীবন ও কর্মে অটল থেকে বন্য জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে থাকলো তার জীবন। তৃষ্ণার জলের জন্য বালি খুঁড়ে জল জোগাড় করতো তারা। নানারকম ফল পাওয়া যায়  এই জঙ্গলে।

অর্পিতা  দেখতো এখানকার অধিবাসীরা  কোনো বিশেষ প্রাকৃতিক দৃশ্যের তোয়াক্কা করতো না। তার এখানকার পরিবেশে থেকেই বড়ো হয়েছে। কিন্তু অর্পিতা জঙ্গলের মধ্যে সুর খুঁজে পেতো। ছন্দে বিভোর হয়ে যায় তার মন। গানের সঙ্গে পাখির ডাক মিশে যেত।রঙিন মেঘ, সবুজ বনানি     , জলকণিকার স্নেহলিপি একাকার হয়ে পারিজাত কাননের ছবি আঁকতো তার মন। নদীর দুই তীরে কাশের কারসাজি লতা বিতান ও বিচিত্র সুগন্ধি ফুলের শোভায় তার মনপ্রাণ আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো।

একটা ছোটো সুন্দর পারিজাতের বাগান অর্পিতার মনে ছবি হয়ে ধরা দিতো। পারিজাতের খেলাঘর বিধাতা তাকে দিয়েছেন। সে এতেই সুখী হতে চায়।     

অর্পিতার মনে বর্ষাকালীন ছবি এক অন্য ধারণা আনে। ভিজে ভিজে চারদিকের শীতল হাওয়া জলে ডোবা তার উপর খাদ্য দুস্প্রাপ্য। চাষ হলেও খাদ্য যথেষ্ট নয়। তার জন্য এক এক দিন একবার মাত্র খাওয়া হয়। সকলে অর্পিতাকে ভালোবাসেন। তার যত্ন করার চেষ্টা করে।বাঁশ আর বাখারি দিয়ে খাট বানিয়ে দেয়।

অর্পিতার ভালো লাগে, কেউ আর মালগাড়িতে ওয়াগন ব্রেকিং করে না। তারা বলে, একটা শহরের শিক্ষিতা    মেয়ে যদি খেটে খেতে পারে তাহলে আমরা পারবো না কেন?  তারা তাদের মূলধন বীজধান বা বীজগম সব খেয়ে নেয় না। ফলমূল খেয়ে বাঁচিয়ে রাখে মূলধন। এখন আর কেউ পুলিশের গুলিতে মারা যায় না। ছয় বছর হয়ে গেলো অর্পিতার জঙ্গলে । একদিনের জন্যও তার অপমানিত হয় নি। সভ্য সমাজের চেয়ে অনেক বেশি  বিবেকের কাছে তারা পরিষ্কার। মানুষের কল্যাণের কাজে লাগতে পেরে অর্পিতা অনেক বেশি খুশি। হয়তো এই ছয় বছরে তার বিয়ে হত একটা বা দুটি সন্তান হত। কিন্তু তা শুধু আত্মীয়দের ভালোলাগার জন্য।আর এখানে তার পুরো আকাশটাই নিজের নীল সংসার। সবাই সকলের জন্য। একের আনন্দে বহুর     সমাবেশ। এটাই তো মানুষের চিরন্তন সুর। মহতের বাণী।     কিন্তু অর্পিতা ভাবে যে বাবা মায়ের কাছ থেকে এই পৃথিবীর আলো দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছে সেই বাবা মা কে কি ভুলে থাকা যায়। যদি আমাকে এরা হত্যা করতো তাহলে কি এইসব ভাবার সুযোগ পেতাম।ফিরে আসতে পারতাম স্বর্গের পারিজাতের কুটির ছেড়ে?  হয়ত পাড়ার লোক, বাবা,মা, সুবোধ ভাবছে আমি মরে গেছি। এতদিনে হয়তো ওরা শোক সামলে জীবনের নাটকে মত্ত। কি হবে এসব ভেবে। সে ভাবে, কোনো ক্ষতি নেই দু একজন যদি পরিচত সমাজ ছেড়ে সভ্যতার স্রোতের বিপরীতে ছোটে।           

অর্পিতা দেখেছে এখানকার শিশুদের অধিকাংশ ক্যালশিয়ামের অভাব,ফ্লুরোরাইডের বিষক্রিয়ায় দেহ শীর্ণ , ভিটামিন সি এর অভাবে নানারকমের রোগ হয়। এই জঙ্গলে হরেক ওষুধের গাছ আছে। যেমন শিউলি,কালমেঘ, থানকুনির পাতা, কুলেখাঁড়া, কলমি শাক আরও নানারকম শাক। নদীতে পানিফলের মত একরকমের ফল,শালুক, পদ্ম তো আছেই। এইসব সবুজের উপকার বুঝিয়ে বলে জঙ্গলের ছেলেমেয়েরা অনেক সুস্থ। তার সঙ্গে যোগাসন। অর্পিতাকে এইজন্যই ধরে আনা হয়েছে শহর থেকে। এদের সর্দার জানে শিক্ষিত হৃদয়বান মানুষ ছাড়া এখানকার উন্নয়ন অসম্ভব। তার জন্য তারা অপরাধ করতেও পিছুপা হয় না। তবে নিরন্ন অশিক্ষিত মানুষের সেবায় নিজেকে লাগাতে পেরে অর্পিতা আজ গর্বিত।

মিনা সবসময় অর্পিতার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। সে অর্পিতার সঙ্গে ওঠে, বসে,শোয়, খায়। লেখাপড়া শিখেছে তার কাছে। এখন ছোটোখাটো শিশুদের পড়ানোর ভার নিয়েছে মিনা। মিনা চাষবাস দেখাশুনা করে। সকালে শিশুদের আসন করায়। ছোলা বাদাম খেতে দেয়। বন মুরগী আর বুনো হাঁসের ডিম ছেলেরা সকালবেলা নদীর ধারে জোগাড় করে। তারপর সিদ্ধ করে খায়। অর্পিতা তাদের বলতো তোরা একটাও পাখি মারবি না। ওদের ডিমও খাবি না। শুধু শাকসব্জী খেয়েই তো হাতির অত বড় শরীর।
কেউ কেউ লুকিয়ে চুরিয়ে ডিম খেতো। কিন্তু সংখ্যাটা কমে গেছে অনেক।

এখন তীর হাতে শিকারে যায় না তারা। মাঠে ফসল ফলায়। আর প্রয়োজনে বুনোমোষ পোষ মানিয়ে চাষ করায় আর গাভী মোষের দুধ খায়। কিন্তু জঙ্গলের একটা অংশে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে কিছু মানুষের ভুল জীবনপ্রণালী। তার জন্য সে    নিজের  বাড়িতে বাবার কাছে শেখা সমস্ত বিদ্যা সে ঢেলে উজাড় করে দিয়েছিলো ভালোবাসার জঙ্গলের শিশুদের জন্য।      সমগ্র অংশের তো পারি নি। অর্পিতা ভাবে, কোনো মানুষের একার পক্ষে তা সম্ভব  নয়। একটা জিনিস সে করতে পেরেছে জঙ্গলকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে তার কাছে থাকা শিশুগুলিকে। কেউ এখন তাকে ছাড়তে চায় না।

এবার পুলিশ প্রশাসন হয়ত জানতে পেরেছে কোনো এক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নজরবন্দী হয়ে এই জঙ্গলে আছে। তারা এটাকে উগ্রপন্থীদের চক্রান্ত বলে সন্দেহ করে, তল্লাশি চালায় এখন রোজ। কিন্ত অর্পিতা আর এই জঙ্গল ছেড়ে যেতে চায় না। তার সামনে পাঁচজন বৃদ্ধ মারা গেছেন অসুখে।

এখনও অনেক বুড়ো বুড়ি আছে। তাদের আর সেই শক্তি নেই। এখন তারা ভালোভাবে বাঁচতে চায়। তাদের ইচ্ছার কথা অর্পিতা প্রশাসনকে জানাবে। আর একটা মানুষও যেন ভুল বেঝাবুঝির শিকার না হয়। সে বিধাতাকে ডাকে তাদের সাহায্য করার জন্য।

একদিন সকালে মিনা তার ছোট্ট কুটির ঘরে অর্পিতাকে নিয়ে গেলো। পারিজাতের কুটিরে মিনার মা, বাবা আছেন। অর্পিতাকে দেখে দেবির মত লাগছে। তার কাছে এসে পায়ে হাত দিতে গেলো। অর্পিতা বললো,আপনারা আমার চেয়ে বড়ো। আপনারাই আমার ভগবান,বিধাতা যা বলেন। সেখানে অর্পিতা নারকেল কোড়া খেলো তাদের খুশির জন্য।মিনার বাবা বললেন,সারা জঙ্গলে ঘরে ঘরে তুয়ার মত বিটি চাই। তবেই জঙ্গলের লোক বুঝবে নিজের ভাগ্য অন্য কেউ গড়ে দেয় না। পরিশ্রম করলে না খেয়ে পরাণটা যায় না।
অর্পিতা বললো,তোমার মেয়ে মিনা আবার দশটা মিনা তৈরি করবে। এইভাবে ছড়িয়ে পড়বে নব আগুনের ঢেউ। সেই আগুনে পবিত্র হবে মানুষের অন্তর। আলো ছড়িয়ে যাবে পারিজাতের কুটিরে কুটিরে  । জেগে উঠবে নতুন ভোর।

তারপর মিনাকে নিয় সে চলে এলো জঙ্গলে। একটা ছোটো  পাইথন,     জড়িয়ে ধরেছে অর্পিতাকে। মিনা চপ করে মুখটা চেপে ধরলো সাপটার তারপর পাকিয়ে খুলে ফেললো সাপের প্যাঁচ। সাপটা ছেড়ে দিলো নদীর ওপাড়ে গভীর জঙ্গলে। অর্পিতা দেখলো পুরোপুরি তৈরি মিনা। জীবন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত তার মন।

অর্পিতা    বললো,পুলিশ আমাকে খুঁজছে। হয়ত আমাকে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে দিয়ে আসবে। আমি না থাকলেও জঙ্গলের প্রাণ তোকে জাগাতে হবে। আরও শত শত মিনার প্রয়োজন এই জঙ্গলের।

মিনা বললো,আমার মনে থাকবে দিদি। আমি চেষ্টা করে যাবো আজীবন।

আজ ভোরে উঠই অর্পিতা দেখে পুলিশের জিপ হাজির। কাউকে না বলে সে জঙ্গলের অন্য আর একটা গ্রামের দিকে ছুট লাগালো। সে স্থির করে ফেললো আরও গ্রামে আমি  আলো জ্বালবো  । সে ছুটতে ছুটতে চলে গেলো আর একটি গ্রামে।

অর্পিতা একটু বিশ্রাম নিলো। তারপর ভাবতে   শুরু করলো কি করে অচেনা  গ্রামের লোক আমাকে চিনবে। জঙ্গলকে আমি চিনি কিন্তু নতুন অশিক্ষিত মানুষের কাছে আবার তার পরিচয় নতুন করে শুরু করতে হবে। নদীর ধার বরাবর দু চার মাইল দূরে এক একটা গ্রাম।সেই ধার বরাবর গিয়েএকটা বাড়িতে সে আশ্রয় নিলো। একজন বয়স্ক মহিলাকে   অর্পিতা বললো,আমি রাস্তা হারিয়ে এখানে এসেছি।যদি দয়া করে একরাত কাটাতে দেন আমি খুব উপকৃত হবো।

মহিলাটি বললেন,অতশত বুজি না বুইলি। তু একরাত থাকবি থাক।  এখন জল খা।

অর্পিতা আশ্বস্ত হলো। এখানেই থাকা যাবে। সে তালপাতার কুটিরে    ঢুকে শুয়ে পড়লো। ধীরে ধীরে রাত নেমে এলো। সবাই ঘুমিয়ে আছে। আর অর্পিতা ভাবছে বাড়ির কথা। সুবোধের কথা। এতদিনে বাবা মা হয়তো আমার আশা ছেড়ে দিয়েছে। সুবোধের ছেলেপিলে হয়েছে।  কিন্তু এসবের জন্যই কি মানুষের জন্ম। কোনো দায়িত্ব নেই জগতের কাজে, মানুষের কাছে। শুধুইএকটা স্বার্থপর গোলোকে নিজেকে শেষ করা। এই কি জীবনের ধর্ম। কি জানি আমি জানি না। অর্পিতা ভাবছে ছোটোবেলার কথা। কত কষ্টে মা তাকে বড়   করেছে,তার কথা।                                           

আমার নাম, ব্যবহার সকলেই পছন্দ করে বলে মনে হয় না । ছোটোবেলা থেকেই বন্ধুবান্ধব সকলেই আমাকে এড়িয়ে চলে।সংসারে আমাকে সকলে একটু অন্য চোখে দেখে। মাসি বলেন,ওকে আগে খাইয়ে দে দিদি, তারপর অন্যকথা।মায়ের মুখে শুনেছি শৈশবে আমি খুব কাঁদুনে স্বভাবের ছিলাম।কেউ কোলে নিয়ে আদর করতে চাইলে আমি প্রাণপণে মাটিতে গড়াগড়ি দিতাম। তারপর কোথাও বেড়াতে গেলে আমার কান্না আরও তীব্র হতো।এরপর বড় হতে লাগলাম।স্কুলে ভরতি হতে গিয়ে প্রথম বছর ভরতি হতে পারলাম না। পরের বছরে ক্লাস ওয়ানে ভরতি হলাম। পড়াশুনায় ভালো ছিলাম। পড়াশুনা ভালোই চলছিলো। তারপর হঠাৎ আমাদের সংসারের মেরুদন্ড প্রিয় কাকাবাবু মরে গেলেন। বাবা চাকরী ছেড়ে জমিজমা, বাড়িঘর দেখার জন্য চলে এলেন আমাদের জন্মভূমি গ্রামের বাড়িতে। বড়দা,মেজদা চাকরী পেলেন বাবার অফিসে।বেশ চলছিলো সুখের সংসার। আমার পড়াশুনা শুরু হলো গ্রামের পরিবেশে।আবার নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধু। সবকিছু নতুন। আমার সকলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় লেগেছিলো
কিন্তু যারা এতদিন বন্ধু হয়ে একসাথে খেলাধূলা করে তারা কি সহজে নতুন কাউকে পাত্তা দেয়। তবু তাদের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করে গেলাম অনবরত। সকলে গ্রহণ করলো না। কোনোরকমে সময় কাটাতাম। তারপর বি,এস,সি পড়ার জন্য হাওড়া চলে এলাম। ক্লাস সেভেনে পড়তে পড়তে চলে গেছিলাম গ্রামে। আবার চলে এলাম শহরে। অনেকের মনে আছে
অনেকের মনে নেই। তবু সবাইকে পরিচয় দিয়ে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করলাম।

মনে পড়ে আমার মধু মাসিকে। ফুটপাতের পাতানো মাসি। আমি বলতাম, মাদার টেরেসা। তার জীবন সংগ্রাম আমি চোখে দেখেছি কিছুটা। মনে পড়ছে সেই মাসির কথা।  মধু মাসি বলেছিলেন তার জীবনের সংগ্রামের কথা।  মাসি ফুটপাতের এক কোণে কোনোরকমে থাকত। তার কোনো ছেলেমেয়ে নেই।একদিন ফুটপাতে কুড়িয়ে পেলো একটা শিশুকে।তাকে ভগবানের দান মনে করে মানুষ করতে লাগলো।তারপর মাসি আরও চারজন অনাথ শিশুর খোঁজ পেলো। মাসি ভিখারী হতে পারে কিন্তু তার পড়াশোনার যোগ্যতা, বুদ্ধি ভালোই ছিলো। শিক্ষিতা রুচিশীল মাসি কি করে ভিখারী    হলো, সে ঘটনা পুরো বলতে গেলে ইতিহাস হয়ে যাবে। যাইহোক স্বাধীনচেতা মাসি স্বামীর ঘর ছেড়ে ফুটপাতে আশ্রয় নিয়েছিলো বাধ্য হয়ে। মাসি এবার পাঁচ শিশুকে নিয়ে সরকারী অফিসে হানা দিতে শুরু করলো। একদিন এক সরকারী আধিকারিক বললেন,মাসি আপনার কোনো পরিচিতি   নেই।আপনার অনাথ আশ্রমের কোনো জমি নেই। কি করে আপনি অনাথ আশ্রয় গড়ে তুলবেন।আপনার অর্থবল,জনবল কিছুই নেই।মাসি বললো,কিন্তু আমার একটা জিনিস আছে, তা হলো ইচ্ছাশক্তি। আমি আশ্রম গড়ে তুলবোই।আপনি দেখে নেবেন। আমার সে মনবল আছে।

পাঁচ শিশুকে নিয়ে মাসির পথ চলা শুরু হলো। তিনি ভিক্ষা করে অই শিশুদের পরিচর্যার ব্যবস্থা করলেন।পাঁচ শিশুকে দেখে একদিন অমরবাবুর মায়া হলো। তিনি মাসিকে বললেন, আপনার শিশুদের থাকার জন্য আমি ঘর তৈরি করে দেবো। আমি জায়গা দেবো। আমার যতটা সাহায্য করা প্রয়োজন আমি করবো। আইনের ঝামেলা আমি দেখাশোনা করবো।
মাসি জোড় হাতে অমরবাবুকে নমস্কার জানালো। কেতুগ্রামের ফাঁকা জমিতে ঘর তৈরি হলো প্রথমে দুটি। তারপর শুরু হলো মাসির বিজয় যাত্রা। তারপর সমাজের বিভিন্ন  স্তরের মানুষের কাছ থেকে সাহায্য আসতে লাগলো। তৈরি হতে লাগলো আরও ঘর। বাউন্ডারি হলো। আর অনাথ শিশুর সংখ্যা বাড়তে থাকলো। প্রথমে শুকনো কাঠ কুড়িয়ে রান্না করা মাসি আজ গ্যাস ওভেনে রান্না করে নিজের শিশুদের জন্য।মাসিকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি। কিন্তু বাদ সাধলো আর এক বিপদ। একদিন আশ্রম থেকে তিনটি শিশু চুরি হয়ে গেলো। মাসি পাগলের মত খুঁজতে শুরু করলেন শিশুদের। এক রাখালের কাছে খবর পেলেন, এক পাষন্ড তিন শিশুকে হাত পা বেঁধে রেখেছে চিলেকোঠার ঘরে। রাখালকে নিয়ে মাসি থানায় গেলেন। পুলিশের সাহায্যে ধরা পড়লো বিরাট শিশু পাচারকারী দল।রাখাল অই মালিকের কাছেই কাজ করতো। তিনজন শিশুকে কাঁদতে দেখে রাখালের সন্দেহ হয়। তারপর মাসি জিজ্ঞেস করাতে সব ছবি পরিষ্কার হয়ে যায়।রাখালকে মাসি অনাথ আশ্রমের এক অনুষ্ঠানে পুরস্কৃত করলেন।

এইভাবে মাসি এলাকার মানুষের কাছে মা বলে পরিচিত হলেন। তিনি এবার আর একটি আশ্রম গড়ে তুললেন শালারে। এইভাবে মাসির পাঁচ পাঁচটা আশ্রম চলছে সুন্দর পরিবেশে মানুষের সহায়তায়।   

অর্পিতার বাবা খুব দয়ালু লোক ছিলেন।তিনি একবার অর্পিতাকে বলছিলেন একটা অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেছিলেন, একবার মহালয়ের সকালে আকাশের সাথে কাশফুলের রং ছড়ানো প্রতিযোগিতা চলছে ! এমন সময় শরতের মেঘ ঝরিয়ে দিলো রূপোলি বৃষ্টি।  চারদিকে মহা সমারোহ প্রকৃতির বুকে। পুজো আসছে কিনা।  তাই তাদের সময় নেই থমকে থাকার। পুজোর পাঁচটা দিন নদীর তীরে বসে থাকতে ভালোলাগে। কতকগুলো ঝুপড়ি বাসা জুড়ে অবহেলিত মানুষের বাস। পুজোর দিনে নগ্ন দেহমনে খিদের ছাপ। বসে আছি পুজোর প্রথম দিনে। আমার পরিধানে নতুন জামা দেখে আদুুল গায়ের দুটি শিশু কাশফুল চিবোচ্ছে আর অবাক চোখে নতুনের গন্ধ খুঁজছে জামার ভাঁজে ভাঁজে। আমার বমি আসছে। চিকেন পকোরা পেটের মধ্যে বিরোধ শুরু করেছে। হাল্কা হয়ে শিশু দুটিকে বসিয়ে গল্প শুরু করলাম।  দূর থেকে ঢাকের শব্দ ভেসে আসছে। শিশু দুটি মাথা দোলাচ্ছে। কাশ ফুলের গোড়া থেকে তখনও খাদ্যপ্রাণ শুষে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে দুজনেই।  থাকতে না পেরে বললাম, তোদের বাড়ি কোনটা?  চল আমাকে নিয়ে চল।
শিশু দুটির বাড়ি গিয়ে মাটির বারান্দায় বসলাম। তাদের মা বেরিয়ে এলো। গামছা জড়ানো গায়ে। কারণ শাড়িটি শতচ্ছিন্ন।  আমি বললাম, ওদের বাবা কোথায়? মুখে কথা না বলে ঈশারায় দেখিয়ে দিলো।  দেখলাম সকাল থেকে নেশা করে পরে থাকা মাতালের মতো ওর অবস্থা।  একবার মুখ তুলে দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে শুয়ে পরলো।  চোখে ঘুম নিয়ে ওদের জন্ম। না দেখাই ভালো।ওরা চোখ চেয়ে থাকলে বিপ্লব ঘটে যাবে রাতারাতি। ঘুম ওদের ভুলিয়ে রাখুক খিদের জ্বালা।
তারপর পাঁচশো টাকা দিয়ে মাকে বললাম, মা তুমি চাল ডাল মাছ এনে রান্না করো।  আমিও তোমাদের সাথে বসে খাবো।
আমার মা ডাকে গামছা দিয়ে চোখ মুছে সে দোকানের দিকে পা বাড়ালো।
পিছন থেকে আমি দেখলাম আমার দেশের মা তার শিশুদের আহারের ব্যবস্থা করার জন্য দৃপ্ত দুই পায়ে এগিয়ে চলেছে...


অর্পিতা মানুষ হয়েছে তার চেনা জগতে। ভোরের আজানের সঙ্গে সঙ্গেই তার বন্ধুর আম্মির মুখ দেখে শুরু হতো তার দিন। সারাদিন স্কুলে কাটতো ছেলেবেলার জগত।

 মনে পরে স্কুল থেকে এসেই ব্যাট হাতে বেরিয়ে পরতো ছেলে মেয়ে একসাথে ক্ষেত্রপালতলার মাঠে। খেলার থেকে গল্প হতো বেশি ৷ জাহাঙ্গীর,মতিউল্লাহ,সিরাজ,ইজাজুর,সামিম, সুদীপ্ত,বাবু,ভম্বল,বিশ্বরূপ,মিলু,অধির সব বন্ধুরা জড়ো হতো ক্রিকেট খেলবে বলে। খেলার শেষে বসে গল্প করতো। প্যান্ট না পরে ছেলেরা মাঠে না এলে   বকাবকি করতেন মিলুদা।পাজামা পরে খেলার অসুবিধা। বলতো,বিরাজুল। , বল লেগে একবার অজ্ঞান হয়ে গেছিলো এক বন্ধু। ধীরে ধীরে সকলের প্যান্ট পরে আসার অভ্যাস হয়ে গেলো। ম্যাচ খেলতে যেতাম অনেক জায়গায়। একবার বিল্বেশ্বর গ্রামের টিমকে হারিয়ে জিতেছিলাম এক হাঁড়ি রসগোল্লা। সুধীনবাবু ধরিয়ে দিলেন বিরাজুলের হাতে ক্যাপটেন হিসেবে। সবাই ভাগ করে খেলো। পুরস্কারের এই অভিনবত্বে অধুনা কানাডা বাসী মিলুদা খুব খুশি হয়েছিলেন। আমাকে কোনোদিন মেয়ে বলে মনে করে নি। বন্ধুর কোনো লিঙ্গভেদ করতো না তারা।    মাঠের বাইরে আমি তাদের বিজয়ের প্রার্থনা করতাম।
অর্পিতা ভাবছে তার ছাত্রী জীবনের কথা,
তখন ১৯৮০সাল। আমরা দশজন বিল্বেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। একটা রেকর্ড রেজাল্টে সবাই খুশি হয়েছিলেন সেবার। তারপর জীবন যুদ্ধে সবাই আলাদা হয়ে গেলো। কে যে কোথায় পড়তে গেলো কোনো খবর পেলাম না। কিন্তু পুরোনো অনেক ক্লাসমেটের সঙ্গে যখন দেখা হয়, মনে পরে যায় পুরোনো দিনের কথাগুলো।

,একবার স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রীদ নিয়ে বেড়াতে গেছিলেন স্কুলের শিক্ষক মহিমবাবু। ঘুরে এসে অজয় নদীর ধারে যখন এলাম, তখন রাত্রি দশটা বেজে গেছে। নদীতে বর্ষার উদ্দাম গতি। কানায় কানায় ভর্তি জল। মহিমবাবু চিন্তায় পরে গেছেন, কি করে চল্লিশটা ছেলেমেয়ে নদী পার হবে। হঠাৎ আমরা অবাক হয়ে চেয়ে দেখলাম পাঁচজন সাহসী ছেলে হাফ প্যান্ট পরে খালি গায়ে লাফিয়ে পরলো জলে। আমরা সবাই হায় হায় করে উঠলাম ভয়ে। কিন্তু আমরা ভুলে গেছিলাম এই বাংলার দামাল ছেলেরা স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিলো নিজের প্রাণের বিনিময়ে ওই লালমুখো বাঁদরদের কাছ থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম, দুটো নৌকো নিয়ে তারা ছেলেদের নদী পার করছে। মহিমবাবু বললেন,মাঝিরা এলো না?  শ্যাম বললো,স্যার চিন্তা করবেন না। ওদের ঘুমের ব্যাঘাত না করে আমরা নৌকো নিয়ে এসেছি। ওরাও জানে শ্যাম থাকলে কোনো ভয় নেই।

মহিমবাবুর চোখে জল এসে গিয়েছিলো। দুহাত তুলে আশীর্বাদ করেছিলেন দামাল পাঁচ ছাত্রকে।

এই রকম খোলামেলা পরিবেশে মানুষ হয়েছিলো অর্পিতা। দানবীর খোলামেলা মানুষ অর্পিতার বাবা। তার রক্ত শিরায় শিরায় প্রবাহিত। হয়ত তার জন্যই অর্পিতা মানবসেবায়   ঝাঁপ দিতে চাইছে।

তা ভাবছে আর তৃতীয় নয়নে দেখছে, একদিকে হাসিখুশি জাঁকজমকের জীবন। একরাশ শিউলির হাতছানি। আর একদিকে কষ্ট, প্রবল বিপদের মত জীবন  নদীর স্রোত।  কোনটাকে বেছে নেওয়া উচিত অর্পিতার। সে বিবেকের কাছেই প্রশ্ন রাখছে। উত্তর দেবে আগামীদিনে  তার চলার পথ...