Tuesday, January 1

গল্প : অন্বেষা চক্রবর্তী







দাঙ্গা


হিন্দু মুসলমান মিলিয়ে ১০০ লোকের বাস এ গ্রামে। স্বাধীনতার প্রাগমুহুর্তে উত্তাল চারিদিক।

ফজরের নামাজ শেষে বাড়ির দাওয়াই মুড়ি নিয়ে বসে সামসুল। গ্রামের রফিক খাঁর ছেলে সে। সেই যেবার সামসুল ১০ ক্লাসের পরীক্ষা দেবে, সেবারই এক দুর্ঘটনায় এক পা হারায় রফিক। আর পড়াশোনা হয়নি রফিকের, বাপের জমি এখন সেই দেখাশোনা করে।

দাওয়াই খেতে খেতে সামসুল হাঁক ছাড়ে আম্মিকে খাবার বেঁধে দেওয়ার জন্য।

" আইস্যি রে বাপ, ঠাহর দেহি"।
একখান গামছা তে বাটি করে ভাত তরকারি বেঁধে আনে আম্মি," সাবধানে যাস্ বাপ, বাইরের অবস্থা কিছু ভালো বুঝি না"।


"তুই শুধু শুধু চিন্তা করস্ আম্মি"-।
খাবারটা আর ঠোঙায় কিছু ফুল নিয়ে বেড়িয়ে পরে সামসুল। তাড়াতাড়ি পা চালায় সে।

তারজন্য অপেক্ষা করে আছে লক্ষী। ফুলটা নাটমন্দিরে দিয়ে সে যাবে লক্ষীর কাছে।

 রমেন মুদীর মেয়ে লক্ষী। এক কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিন জন্মেছিল বলে বাপে নাম রেখেছিলে লক্ষী।জন্মের সময় মা মারা যাওয়ায় বড়ই বাপসোহাগী সে।

ধানের ফলন ভালো হওয়ায় হাতে কিছু টাকার আশা করা যায়। লক্ষী কে এবার একটা দেশি তাঁতে বোনা শাড়ি কিনে দেওয়ার খুব ইচ্ছে সামসুলের। এই মন্দার বাজারে হাটের দুপয়সার কাঁচের চুড়ি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি সে।

মন্দিরের সামনে এসে ফুলটা রাখতেই দেখতে পায় দূরে কদম  গাছের নিচে লাল ডুরে পাড়ের শাড়ি জড়িয়ে তারি অপেক্ষায় লক্ষী। খুব সুন্দরী না হলেও বড্ড মায়া জড়ানো মুখ  মেয়েটার। অভিমানের সুরে বলল " সেই কহন বাপ থেইক্কা তোমার লগে ঠাঁই দাঁড়াই আইস্যি মানা করস্যে বেড়াইতে, তাও চুপিচুপি আইসি"।

'ভয় কি? আমি খাকইত্যে তোর কোন বিপদ নায়" ----সামসুল সাহস যোগায়। মুচকি হেসে মাথা নামায় লক্ষী, আর এই হাসি টুকুই সারাদিনের কাজের রসদ যোগায় সামসুলকে।

পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে। খবর ছড়িয়ে পরে মুসলমানদের জন্যই শুধু আলাদা দেশ হবে, তাতে কোনও হিন্দুর জায়গা হবে না। যে নাট মন্দিরে পূজার সময় হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ভোগ খেত, তা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। যে চাচাদের বাড়িতে সিমাই হলেই ডাক পড়ত মালতি , চিত্রাদের, সেই চাচাদের রক্তচক্ষু আজ বড় অচেনা লাগে। হিন্দুর জোয়ান ছেলেদের প্রায়ই লাশ পাওয়া যায় বড় রাস্তায়। ঘাত প্রতিঘাতে প্রাণ যায় নিরীহ মানুষের। আর এতকিছুর পরও যারা জোর করে থেকে গেছে, তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, শুরু হয় অকথ্য অত্যাচার।

আগুন লাগে লক্ষীদের বাড়িতেও। বাপ সেই যে শহরে গেল মাল আনতে আর ফেরেনি। রাতের অন্ধকারে সামসুলের হাত ধরে পালায় লক্ষী। অনেক দিন নানা বনে জমির ক্ষেতে লুকিয়ে বেড়িয়েছে ওরা। কাল ভোর ভোর সামসুল ওকে পৌঁছে দেবে রিফিউজি ক্যাম্পে।

এক গাছের তলায় বসে দুজন, জলের ধারা শুকিয়ে দাগ পরে গেছে শুকনো মুখে। খাবার ও তেমন পায়নি। " কথা দিইছিলাম্ পরাণ থাকতে তোর ক্ষতি হবে না"-- সামসুল বলে।

" তবে কি আর আমাগো দেইখ্যা হবে না?"- অসহায় লক্ষ্মী জানতে চায়। "

' হবে রে, এই অশান্তি একটু কইম্যা গ্যালেই আবার সব ঠিক হইয়া যাইবো"- আশ্বাস দেয় সামসুল।


ভোর ভোর লক্ষী কে রিফিউজি ক্যাম্পে রেখে ফেরার পথে রওনা দেয় সামসুল। লক্ষী দূর থেকে শুধু  দেখেছিল ওর চলে যাওয়া।



আজ আরেক লক্ষী পুজো। আকাশের চাঁদ সেরকমই বড়। লক্ষী জায়গা পেয়েছে কলকাতা শহরে এক ঘুপচি রিফিউজি ক্যাম্পে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন থেকে এ নাকি তার দেশ।

তবে সেটা কী ছিল? তার বড় হয়ে ওঠার জায়গা, তার কদম গাছ, কাজলী নদী, তার সামসুল.......


বাপ বলেছিল এই পূর্ণিমায় তার জন্ম, আজো লক্ষী অপেক্ষা করে সামসুলের , সে আসবে তাকে নিয়ে যাবে। তার সামসুল কখনো কথার খেলাপ করে না। সে আসবে।





গল্প : সায়ন্তনী বসু চৌধুরী

                     


এপার-ওপার    
                         
বিকেলের আলো নিবে এলে এ পাড়াটা কেমন যেন মৃত্যুপুরী হয়ে যায়। আস্ত আস্ত বাড়ীগুলো যেন গিলে খেতে আসে। ল্যাম্পপোস্টগুলোর নীচে কী প্রকাণ্ড এক একটা ছায়া পড়ে! মাঝে মাঝে মনে হয় বুঝি কোনো বিশালাকার দৈত্যের দেহাবয়ব। চিরটাকাল বড়ো রাস্তার ধারে উজ্জ্বল নিয়নের আলোর নীচে থেকে এসে  এই নির্জন এলাকায় বৈশালীর কিছুতেই মন বসে না। অথচ সে নিজেই একসময় ভিড় আর আলো থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলো। আগে ওরা যে পাড়ায় থাকতো সেখানে রাত বলে কিছু ছিলোনা। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী দুপুর বিকেল আর গোধূলিবেলা পেরিয়ে অন্ধকার নেমে এলেও গোটা দিন একইরকম কোলাহল। রাত দুটো আড়াইটের সময়েও গাড়ীর হর্নের তীব্র আওয়াজে ঘুম ভেঙে যেতো। কতো রাত যে ও পাখিকে কাঁধে ফেলে জেগে কাটিয়েছে তার কোনো সঠিক হিসেব নেই।

বৈশালীর মেয়ে পাখি এখন ক্লাস টু তে পড়ে। সক্কাল সক্কাল নেচার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের হলদে রঙের বাস এসে তাকে নিয়ে যায়। গাবলু গুবলু বাচ্চাটা দুইদিকে পনিটেইল বেঁধে টা টা করে। তারপর বাসে উঠে মেরুন রঙের ইউনিফর্মের ভিড়ে হারিয়ে যায়। নামকরা স্কুল। ভারী সিলেবাস আর ইঁদুর দৌড়ের চাপে একরত্তি বাচ্চাগুলোর চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবার জোগাড়। তাই বোধহয় ওদের কারও মুখে হাসি থাকে না। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে মেয়ে আর বরের জন্য টিফিন রাঁধে বৈশালী। লুচি, পরোটা, ম্যাকারনি, পাস্তা, ম্যাগি...। এক সময় সে নিজেও কর্পোরেট সেক্টরে ছিলো। অফিস যাবার তাড়া, বাস ধরার তাড়া, সমীরণের সঙ্গে লুকিয়ে প্রেম করার সময় বের করা ... সব মিলিয়ে জীবনটা তখন কী যে দারুণ গতিময় ছিলো, ভাবলেও বৈশালী অবাক হয়। আর এখন? রজত আর পাখি বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলে বৈশালী এক্কেবারে একা। গোটা বাড়ীটায় কী যে ভীষণ নিঃসঙ্গতা! প্রতিটা দেওয়াল, প্রতিটা কার্নিশ জুড়ে একাকীত্ব। দম আটকে আসে ওর।
সমীরণ খুব সাধারণ একটা চাকরী করতো। খুব সাধারণ। মাত্র বারো হাজার টাকা স্যালারি। দুহাজার সাতে সালে সদ্য স্নাতক বৈশালীর মনে হয়েছিলো ওটাই অনেক। মাত্র দুজনের সংসার। বারো হাজারে চলবে না? কতো আর খরচা হবে একটা মাস চালাতে? বিরাট বড়ো বাড়ী দামী গাড়ী এসব তো বৈশালী চায় না।

সমীরণ আর ওর একটা ছোট্ট সংসার হবে। আর ওদের একটি ফুটফুটে সন্তান হবে। এই তো বৈশালীর স্বপ্ন। পাখি নামটা সমীরণেরই দেওয়া। ওরা যখন ভবিষ্যতের দিনগুলো সাজাতো, তখনই ভেবে রেখেছিলো সমীরণ। মেয়ে হলে পাখি আর ছেলে হলে পলাশ। মুম্বইয়ের সবচেয়ে নামকরা হাসপাতালে মেয়েকে যখন প্রথমবার  ছুঁয়েছিলো বৈশালী সেদিন পাখি নামটা ছাড়া ওর মুখ থেকে আর কিচ্ছু বেরোয়নি। রজতেরও খুব পছন্দ হয়েছিলো নামটা। সমীরণকে সেদিন ঠিক কতোখানি মিস করেছে, বৈশালী বলতে পারবেনা।

ছয়তলার ওপরে ঝুলন্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে বৈশালী নিজের ঘরের দিকে ফিরে চায়। গত ছ বছরে রজত ওর কোনো ইচ্ছেতে বাধা দেয়নি। যেমন ফ্ল্যাট চেয়েছিলো বৈশালী, ঠিক তেমনটাই কিনেছে রজত। রজত নিজের ক্ষমতার অতিরিক্ত করেছে শুধুমাত্র বৈশালীকে খুশী করার জন্য। আগে ওরা হাইওয়ের ধারে একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতো। বৈশালী থাকতে চায়নি বলেই রজত শহর ছাড়িয়ে এতোটা ভেতরে ফ্ল্যাট কিনেছে। রজতের ভালো চাকরী। বেশ নামকরা কোম্পানির ইঞ্জিনিয়র ও। রজতরা বৈশালীর পিসতুতো দিদির শ্বশুরবাড়ীর তরফের আত্মীয়। পিসতুতো দিদির কল্যাণেই বৈশালীর সঙ্গে রজতের সম্বন্ধটা হয়েছিলো। তখন বৈশালী নিজে একটা চাকরী জুটিয়ে নিয়ে বাড়ীর সঙ্গে তুমুল লড়ছে। আসলে সমীরণের সঙ্গে বৈশালীর সম্পর্ক বাড়ীতে জানাজানি হতে তীব্র অশান্তি হয়েছিলো। বাবা, মা, দাদা কেউই রাজী হয়নি। সমীরণের রোজগারের অভাব মেটাতে বাড়ীর বিরুদ্ধে গিয়ে বৈশালী চাকরী করছিলো। সেসময় রজতের মতো একটা ভালো ছেলের সত্যিই বড্ড প্রয়োজন ছিলো। ভালো ছেলে মানে ভালো রোজগারের ছেলে। বাড়ীতে অকথ্য বকুনি খেয়ে বোকা বোকা মুখ করে প্রেমিকা বৈশালী সবাইকে বলেছিলো,
-বারো হাজারে দিব্যি সংসার চলে যাবে। আমি হিসেব করে দেখেছি। তাছাড়া আমার চাকরীটাও তো আছে।
দাদা চেঁচিয়ে উঠে প্রশ্ন করেছিলো,
-কতো পাস শুনি?

আসলে তখন প্রেমের ঘোরে বাস্তব বোধবুদ্ধি দিয়ে সবকিছু বিচার করার ক্ষমতা ছিলো না। আজ বৈশালী হাড়ে হাড়ে বোঝে সংসার চালাতে মাস গেলে পঞ্চাশ পঞ্চান্ন হাজারও কম পড়ে। মাঝে মাঝে একলা দুপুরগুলোতে সমীরণের কথা ওর খুব মনে পড়ে। রজতের ব্যস্ততায় বিরক্ত হয় বৈশালী। কিন্তু যখন ভাবে আজ যদি ও সমীরণের সঙ্গে হাওড়ার কোনো মধ্যবিত্ত পাড়ায় পড়ে থাকতো তাহলে হয়তো এমন মাখনের মতো নরম ত্বক এমন জেল্লাদার চেহারা থাকতো না, তখনই ওর ভেতরে একটা সাদা আর কালোর লড়াই শুরু হয়। সমীরণকে মনে রাখার মতো কোনো কারণ আছে কী না বৈশালী তা জানে না। তবুও সারাদিনের একাকীত্ব ওকে পুরনো কথাগুলো ভাবতে বাধ্য করে।

***
রবিবার করে পাখির আঁকার ক্লাস থাকে। মেয়েটা দারুণ ক্রিয়েটিভ। নিজের ঝোঁকেই গান, আঁকা, নাচ সবেতে ভর্তি হয়েছে। স্কুলের সব ফাংশনে তার পার্টিসিপেট করা চাই-ই-চাই। পাখিকে আঁকার স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে বৈশালী একা একা সময় কাটায়। বাড়ী আর রান্নাঘরের জন্য টুকটাক কেনাকাটা সেরে রাখে। অনেক সময় তিন চারদিনের আনাজের বাজারটাও হয়ে যায়। আজ ওর শরীর ভালো নেই। মডার্ন আর্ট অ্যান্ড ড্রয়িং ক্লাসের সোজাসুজি যে ছোট্ট কফিশপটা খুলেছে সেখানেই গুছিয়ে বসেছে বৈশালী। আজকাল রজতের সঙ্গে সময় কাটানো হয়ে ওঠে না আর। মেয়েটা যতো বড়ো হচ্ছে, ওদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে দূরত্বও যেনো বাড়ছে। তাছাড়া প্রায় সময়েই রবিবারও রজতের অফিস খোলা থাকে। বৈশালী আজকাল একাকীত্বে ভোগে। বছর চারেক আগেও সংসার থেকে লম্বা ছুটি নিয়ে ও বর্ধমানের বাড়ী চলে যেতো। তখন বাবা বেঁচে ছিলেন। বাড়ীটা আনন্দে জমজমাট থাকতো সারাদিন। কিন্তু এখন সে বাড়ীও শ্মশান। বাবা নেই, মায়ের একবার মেজর অ্যাটাক হয়ে গেছে। দাদা বৌদি আমেরিকা থেকে আসতে চায়না। বৈশালী একজন আয়া রেখে দিয়েছে মায়ের জন্য। দুঃখের অতলে ডুবে থাকতে আর ভালো লাগে না ওর। তাই এই পালিয়ে বাঁচা।

কফিশপের সামনে একটা ঝাঁ চকচকে চারচাকা এসে দাঁড়ালো। সাদা রঙের ব্লেজার পরা একজন মাঝবয়সী লোক আর সঙ্গে দুজন কমবয়সী ছেলে এসে চারটে চেয়ারওয়ালা একটা টেবিল নিলেন। বিকেল বেলার ব্যস্ত রাস্তা আর মানুষ দেখা ছাড়া বৈশালীর আজ কোনো কাজ নেই। হঠাৎ চেনা গানের দুটো লাইন বেজে উঠলো সামনে বসা ভদ্রলোকের মোবাইল ফোনে। এ গান বৈশালীর বহুবার শোনা। একটা সময় প্রতিটা শীতের দুপুর তার কাঁধে মাথা রেখে বৈশালী বারবার শুনত এই গান। গত দশ বছরে সমীরণকে ভুলতে চেয়েও আরও বেশী করে মনে করেছে বৈশালী। কিন্তু সমীরণ কি তাকে একবারও খুঁজেছে? একবারও কি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে বৈশালীর সঙ্গে?
-হ্যালো, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি মিটিং সেরে এইমাত্র একটু কফি খেতে এলাম। ফ্লাইটের ঢের দেরী আছে, চিন্তা কোরোনা। আমি মিস করবোনা।

বহুদূর থেকে চির পরিচিতের কণ্ঠস্বর শুনলে মানুষ যেমন নানা অনুভূতিতে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়, আজ প্রায় একযুগ পরে সমীরণের গলা শুনে বৈশালীও তেমনি অবাক হয়েছে। কিন্তু এ কী? এতো পরিবর্তন? সেই সদা হাস্যময় ছিপছিপে তরুণ আজ এমন গম্ভীর একটা মানুষ সেজে বৈশালীর এক্কেবারে কাছাকাছি এসে হাজির হলো? বছর দশেক আগে একটা অধ্যায় শেষ হয়ে যাবার সেই অন্ধকার দিনগুলো বৈশালীর মন থেকে একেবারে উবে গেলো যেনো। নিজেকে আটকাতে না পেরে পায়ে পায়ে বৈশালী টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো। সম্পর্ক নেই বলে একবার ডেকে কথা বলতেও কি নেই?
-সমীরণ তুমি?

কথাটা বলেই নিজেকে অতি সন্তর্পণে সামলে নিলো বৈশালী। আপনি কি মিস্টার সমীরণ মুখার্জী?
খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে ভদ্রলোক প্রথমে বৈশালীর মুখের দিকে তাকালেন। তারপর প্রায় মিনিট তিনেক ভেবে নিস্পৃহ গলায় উত্তর দিলেন,
-হ্যাঁ, আমিই সমীরণ মুখার্জী। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।

বৈশালীর নরম দুই গালে কেউ যেন কড়া হাতে দুটো চড় মারলো। চিনচিন করে উঠলো মনের মধ্যেটা। মুহূর্তের জন্য মনে হলো সমীরণ বদলা নিচ্ছে। একদিন আর্থিক অবস্থার দোহাই দিয়ে বৈশালীর বাবা দাদা ওকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো। আজ হয়তো বৈশালীকে অপমান করে সমীরণ সেই আগুনেই জল ঢালতে চাইছে। কিন্তু পরক্ষণেই একবুক অভিমান ওর গলা টিপে ধরলো। জীবনের সাড়ে চার বছর যে ছেলেটার সুখ দুঃখ আপন করে ও দিন কাটিয়েছে আজ তার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যান পেয়ে বৈশালীর নিজেকে বড়ো তুচ্ছ মনে হচ্ছে।

***
ড্রয়িং খাতা খুলে নানারকম আঁকিবুঁকি দেখিয়ে আপন মনে বকে চলেছে পাখি। মেয়ের কথার দিকে বৈশালীর মন নেই। সে শুধু রজতের কথা ভাবছে। সমীরণ নামক অতীতকে মনের কোণে লালন করে নিজের জীবন সঙ্গীর প্রতি ও তো সুবিচার করেনি। আজ বৈশালী সব গ্লানি মুক্ত হয়ে বাড়ীর পথে এগোচ্ছে। কারণ আজ সে জানে আমৃত্যু পাখি আর রজতকে আঁকড়ে তাকে এপারেই বাস করতে হবে। জীবন নদীর ওপারে আজ আর তার কেউ নেই। 

গল্প : সুজয় চক্রবর্তী





একটি প্রেমের গল্প

ব্যাচেলার থাকার এই এক সমস্যা।  সহজে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় না । সবাই-ই 'ফ্যামিলি' চায়!

আমার এখনও 'ফ্যামিলি' হয়নি । লাইনে আছি । কিন্তু সেই সময়টুকু দিলে তো ! যেখানেই ঘরের জন্য যাই, সেই এক কথা, 'ফ্যামিলি আছে তো? ', 'ও, আপনি ব্যাচেলর ! না  ভাই, অন্য কোথাও দেখুন।' একজন তো একবার বলেই দিলেন, ' ঘর তো ফাঁকা। বলেন তো, হাতে একটা মেয়ে আছে, দেখাতে পারি।' মানে আমাকে বিয়ে দিয়ে তবেই তিনি তার ঘরে ঢোকাবেন ! বিটকেলে পাবলিক সব । কিছুতেই বোঝাতে পারি না, আমার এখন বউ চাই না, ঘর চাই। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সবে মাত্র চাকরিটা পেয়েছি । বাড়ি থেকে বেশ দূরে। একটু গুছিয়েগাছিয়ে না নিয়ে এসবে নেই আমি ! সেকথা বাড়িতেও বলেছি । দুটো বছর সময় লাগবে আমার। কিন্তু বাড়ির লোকও সে কথা শুনলে তো!  বিশেষ করে মা। সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান। কোনওরকমে থামিয়ে রেখেছি। আর ঠিক করেছি, বছর দুই পরেও যদি বাসা ভাড়াই থাকি, তো ঐ লোকটাকে গিয়ে একদিন বলবো, ' এই দেখুন, ফ্যামিলি আছে । ঘর খালি আছে আপনার? '

যাইহোক, শেষে আমার মেজো মাসির দূর সম্পর্কের এক জামাইকে ধরেটরে অনেক খোঁজ-খবর করার পর জয়িতাদের এই বাড়িটাতে থিতু হয়েছি ।

আমি এ পাড়ায় নতুন । এক মাসও হয়নি। ধীরে ধীরে পরিচিত হচ্ছি আশপাশের লোকজনের সঙ্গে । অনেকের সঙ্গেই আলাপ এখনও বাকি । সামান্য যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাদের মধ্যে আছে সনাতনের বাবা, কীর্তনীয়া বিশু, সুমনের দিদিমা আর বিশালের মা ।
 অফিস যাওয়ার সময় একটা দৃশ্য আমি রোজ দেখি । জয়িতাদের বাড়ির পাশের ফাঁকা মাঠটাতে একটা বাচ্চা মেয়ে খেলছে। একা একাই । বয়স তিন কি চার হবে । কখনও কাদামাটি, কখনও ধুলোবালি নিয়ে ওর খেলা । কোনও ঝামেলা নেই। কান্নাকাটি নেই।

 একদিন অফিস যাওয়ার পথে ওর নামটাও জানতে পেরেছি । পামেলা। খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। খালি গা। সারা হাতপায়ে ধুলো। কিন্তু একগাল হাসি।
আমার নতুন চাকরি। বাড়ি থেকে  হাতে একটু সময় নিয়ে বেরোই । অনেকদিন অফিস থেকে ফেরার সময়েও ঐ একই ছবি দেখেছি । বাচ্চাটা একমনে খেলছে । কখনও পুতুলকে শাড়ি পড়াচ্ছে, কখনও হাড়িতে ভাত চাপিয়েছে ; এইরকম আর কি।

এরমধ্যেই পামেলা আমাকে বেশ চিনে ফেলেছে ৷ রাস্তায় দেখলেই জিজ্ঞাসা করে, ' কাকু, কুথায় যাচ্ছো? কখনও বাজারফেরত আমাকে দেখতে পেলে জানতে চায়, 'কী এনেছো ?' আবার কখনওসখনও আমিও ওর 'রান্না' করা খাবার মুখে দিয়ে বলি, 'বাঃ, হেব্বি হয়েছে !' ও খুব মজা পায়। কিন্তু প্রায়ই ও 'ডিমে'র ঝোল 'রান্না' করে। আর সেই গরম ডিমের ঝোল খেয়ে আমার যখন জিভে 'ছ্যাঁকা' লাগে, তখন যেন ওর হাসি আর ধরে না মুখে! মাঝেসাঝে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি  পামেলার মা'কে । কখনওসখনও চোখাচোখি হয়। ঐ পর্যন্তই।  কথা হয়নি কোনও দিনও। তবে আমি যে জয়িতাদের ভাড়াটে, সেটা জানে।

আজ যাওয়ার সময় দেখলাম পামেলা কাঁদছে! রান্নাবাটি খেলছিল। বোঝা গেল ওকে কেউ বকেছে । খুব খারাপ লাগলো । থেমে গেলাম ।
মুখ নামিয়ে বললাম , ‘ কি হয়েছে তোর, কাঁদছিস কেন ?’
---- মা মেরেছে।
---- নিশ্চয় তুই দুষ্টুমি করেছিস?
---- না, আমি কিছু করিনি...
---- তাহলে মা তোকে এমনি এমনি মারলো !
----- হ্যাঁ ।
---- আচ্ছা, দাঁড়া, তোর মা'কে আমি বকে দিচ্ছি।
কথাটা বলে নিচু হয়ে ওর চোখদুটো হাতের চেটো দিয়ে মুছে দিলাম।

খেয়াল করিনি । চোখ সরাতেই দেখলাম সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে পামেলার মা ! শিউলি।  সেদিন জেনেছি ওর নামটা।  জয়িতা কোন একটা ব্যাপারে 'শিউলি বৌদি' বলে কথা বলছিল।

তা, 'বৌদি' যখন, দাদা নিশ্চয় আছে। এর আগে এত কাছ থেকে ওকে কখনও দেখিনি। যেটুকু নজরে পড়লো, তাতে হাতে চুড়ি, মাথায় সিঁদুর কিছুই দেখলাম না। অবাক হইনি। এখন অনেকেই এসব পরে না। এরজন্য যুক্তিও আছে তাদের। আমার মাসতুতো বোনটা  এরকমই। ও প্রায়ই একটা কথা বলে,' কই, পুরুষরা তো বিয়ের পর কোনও চিহ্নই বয়ে বেরায় না, যার থেকে বোঝা যায় পুরুষটি বিবাহিত! তাহলে মেয়েরা কেন বয়ে বেড়াবে!' তাতো ঠিকই । একেবারেই বাস্তব । আমার ভালো লাগে ওর কথা। আমি সায় দিই।
শিউলির দিকে তাকাতে দেখলাম লজ্জামাখা একটা মুখ ৷ কিন্তু বেশ মোহময়ী। নিশ্চিত, পামেলার সঙ্গে আমার কথাবার্তা ও শুনেছে! ততক্ষণে আমিও কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছি । বকা তো দূর অস্ত। শিউলিকে দেখে মুখ দিয়ে কোনও কথাই আমার বেরোলো না!  আর বেরোবেই বা কি করে? তাকে বকার অধিকারই বা আমাকে কে দিয়েছে ? মাথা নিচু করেই ছিলাম। ঘড়িতে চোখটা পড়তেই পা চালালাম। শুধু আমার চাকরিটাই নতুন নয়, অফিসে বসও নতুন!
এরপর শিউলিকে দূর থেকে দেখলেই আমি মাথা নিচু করে ফেলতাম। লজ্জায়। লজ্জা পাবারই কথা। যার সঙ্গে তেমন কোনও পরিচয় নেই, সেই তাকেই কি না বকাঝকা! বুঝতে পারলাম সেদিন কথাটা বলে ঠিক করিনি। কথাটা যে জাস্ট বলার জন্যই বলা, তা শিউলিও জানে। তবু লজ্জাটা আমার একটু বেশিই। তাই মাথা হেঁট হয়ে যেত ওকে দেখলে। শেষ পর্যন্ত অফিস যাওয়া আসার রাস্তাটাই পালটে ফেললাম! এখন পামেলা বা শিউলি কারও সঙ্গেই আর দেখাটেখা হয় না।

পাড়ায় যাদের সঙ্গে দেখা হলে খুব সহজেই পাশ কাটাতে পারি না, তাদের মধ্যের একজন হল কীর্তনীয়া বিশু। ওর কথা বলার ধরন যে কাউকেই মুগ্ধ করে। রাস্তায় দেখা হলে কুশল সংবাদ ও  জিজ্ঞেস করবেই,  এই সৌজন্যবোধটা ওর আছে । কীর্তনীয়া বিশু এ পাড়ায় অনেক দিন আছে । দূর সম্পর্কের এক মামার বাড়িতে থাকে, খায়। এছাড়া নিজের আর কেউ নেই। রোজগার বলতে অন্য তল্লাটে গিয়ে  কীর্তন শুনিয়ে যা পায়। খুচরো পয়সা, চাল-ডাল। বিয়ে-থা হয়নি। আর জীবনে করবে বলেও মনে হয় না৷  পাড়ার প্রায় সব খবরই রাখে ও। দীপকের বউয়ের কবে বাচ্চা হবে, নন্দিতার বৌদি কেন বাপের বাড়ি চলে গেছে, টুম্পার বাবা কেন ওর দাদাকে মেরেছে, এমন হাজারটা ঘটনার কথা জানে ও ।

আজ শনিবার। অফিস ছুটি। খোকনের পান বিড়ির গুমটির সামনে বিশুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছিল । তাই হয়তো আজ আর বেরোয়নি । কথায় কথায় পামেলাদের কথা উঠলো। মানে, আমিই উঠালাম আর কি। জানতে পারলাম বিয়ের বছর খানেকের মাথায় না কি বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হল তরিতের। তড়িৎ মানে পামেলার বাবার। পামেলা তখন পেটে। ব্রেন ইনজুরি।  সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চললো ছ'মাস। প্রথম দিকে কিছুটা ভালোর দিকে ছিল তড়িৎ। শেষে ভুল চিকিৎসায় মারা গেল ! এরজন্য ডাক্তার ,নার্স দায়ী না । দায়ী নাকি শিউলিই ! 'অলক্ষ্মী' আসার পর থেকেই এক এক করে অনেকগুলো অঘটন ঘটেছে তাদের সংসারে। তাই শাশুড়ি মা যে আর কোনও অঘটন ঘটাতে চান না, সে কথা ঠারেঠোরে বুঝিয়েও দিয়েছেন। তবু মুখ বুঁজে ছিল শিউলি। কিন্তু যেদিন পামেলা হল, সেদিন হাসপাতাল থেকেই সে যাতে বাপের বাড়ি চলে যেতে পারে, তার সব বন্দোবস্ত পাকা করে রেখেছিলেন শাশুড়ি মা। সেই থেকে শিউলি আছে বাপের বাড়ি। আসলে গীতা দে'র মতো শাশুড়ি যার কপালে, তার সংসার জীবনে তো অনেক কষ্টই ভোগ করতে হবে! শিউলি ঝড়ে পড়লো অকালে ; মা-বাবার সংসারে। এখন সে বাধ্য হয়ে বিড়ির কুলো হাতে নিয়ে বসেছে।

শিউলির সম্পর্কে যেটুকু বললো বিশু, তাতে যেকোনও সংবেদনশীল মানুষেরই খারাপ লাগতে বাধ্য। আমারও লেগেছিল। আরও বিশেষ করে খারাপ লাগলো ওর সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বসে ছিলাম। একজন স্বামীহারা মহিলা কত কষ্ট সহ্য করে যে একটা বাচ্চাকে মানুষ করে তুলছে, তার প্রতি সহানুভূতি দেখানোর যে প্রয়োজন, সে বোধ আমার ছিল না। করুনা হয় নিজের ওপর।

আজ আবার বিশুর সঙ্গে দেখা বটতলায়। একথাসেকথায় বিশু যা বললো, আমি তো শুনে থ'। শিউলি নাকি আমাকে আর দেখা যায় না কেন, তা জিজ্ঞেস করেছে তার 'বিশুদা'কে । বিশুকে সে এও  বলেছে, তাকে না কি অনেক দিন কেউ বকেনি ! শুধু সান্ত্বনা দিয়ে গেছে সবাই। সে এখন চায়, তাকেও কেউ বকুক।

আজ বছর দশ পরেও বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, শিউলিকে এতটুকু বকিনি আমি!


              -----------------------