Sunday, January 13

চিরায়ত গল্প : কমলকুমার মজুমদার




লালজুতো

গৌরীর সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার দরুন কিছু ভালো লাগছিল না। মনটা বড্ড খারাপ—নীতীশ ভাবতেই পারছে না, দোষটা সত্যিই কার। অহরহ মনে হচ্ছে—আমার কি দোষ? জীবনে অমন মেয়ের সঙ্গে সে কখনোই কথা বলবে না।

দক্ষিণ দিককার বারান্দা দিয়ে যতবার যায় ততবারই দেখে, গৌরী পর্দা সরিয়ে এদিক পানে চেয়ে আছে, ওকে দেখলেই পলকে পর্র্দা ফেলে দেয়। এ চিন্তা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে মনটা সদা চঞ্চল হয়ে রয়েছে; কী করে, কোথায় বা যায়? কোনো কাজেই মন টিকছে না! অবশেষে বিকেল বেলা মনে পড়ল—জুতোজোড়া নেহাত অসম্মানজনক হয়ে পড়ছে, অনেক অনুনয়-বিনয় করে ঠাকুমার কাছে ব্যাপারটা বলতে—টাকা পাওয়া গেল।

নিজের জিনিস নিজে কেনার মতো স্বাধীনতা বোধহয় আর কিছুতেই নেই, অথচ মুশকিলও আছে যথেষ্ট। যদিও সরকার মশায়ের গ্রাম্য পছন্দের আওতায় নিজের একটা স্বাধীন পছন্দ গড়ে উঠেছিল, কিন্তু তাকে বিশ্বাস নেই—কি জানি যদি ভুল হয়? যদি দিদিরা বলে, ‘ওমা এই তোর পছন্দ?’ সিদ্ধান্ত যদি হয়—’তা মন্দ কী বাপু বেশ হয়েছে, ঘষে-মেজে অনেক দিন পায় দিতে পারবে ‘খন!’ এর চাইতে গুরু শ্লেষ আর কী হতে পারে? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নীতীশ রাস্তা দিয়ে চলেছে। ছোট দোকানে যে তার পছন্দসই জুতো পাওয়া যেতে পারে না, এ ধারণা তার বদ্ধমূল, তাই বেছে বেছে একটা বড় দোকানে গিয়ে উঠল।

জুতোওয়ালা এমন করে কথা বলে, যে তার ওপর কথা বলা চলে না, মনে হয় যেন ওকথাগুলো নীতীশের। যে জুতোজোড়া পছন্দ হলো, সেটা সোয়েড আর পেটেন্ট লেদারের কম্বিনেশন। ক্লাসের ছেলেরা হিংসে করে মাড়িয়ে দিতে পারে, গৌরীর মনে হতে পারে, কেন ছেলে হয়ে জন্মালুম না?

দাম ছ-টাকা; ঠিক পাঁচ টাকাই তার কাছে আছে। দরকষাকষি করতে লজ্জা হয়, পছন্দ হয়নি বলে যে অন্য দোকানে যাবে তারও জো নেই, কারণ শুধু তার জন্যে অতগুলো বাঙ্ নামিয়ে দেখিয়েছে। আজকাল তো সব কিছুই সস্তা, কিছু কম বললে দেয় না? ইচ্ছে আছে, কিছু পয়সা যদি সম্ভব হয় তো বাঁচিয়ে একখানা মোটা খাতা কিনবে, গৌরীর হাতের লেখা ভালো, ভাব হলে, তার ওপর সে মুক্তোর মতো অক্ষরে বসিয়ে দেবে—নীতীশ ঘোষ—সেকেন্ড ক্লাস... অ্যাকাডেমি।

লজ্জা কাটিয়ে বলে ফেললে, সাড়ে চারে হয় না?

জুতোওয়ালা বললে, আপনার পায়ে চমৎকার মানিয়েছে, একবার আয়নায় দেখুন না, দরাদরি আমরা করি না।

নীতীশ পিছন ফিরে আয়নার দিকে যেতে গিয়ে দেখে, নিকটে এক ভদ্রলোক বসে আছেন, যার বয়েস সে আন্দাজ ঠিক করতে পারে না, তবে তার দাদার মতো হবে; যাকে আমরা বলব আটাশ হতে তিরিশের মধ্যে; তাঁর হাতে ছোট্ট ছোট্ট দুটি জুতো, কোমল লাল চামড়ার। দেখে ভারি ভালো লাগল—জুতোজোড়া সেই নরম কোমল পায়ের, যে পা দুখানি আদর করে স্নেহভরে বুকে নেওয়া যায়, সে চরণ পবিত্র, সুকোমল, নিষ্কলুষ।

সহসা যেমন দুর্বার দখিন হাওয়া আসে, তেমনি এর অজানা মধুর আনন্দ, ওই কিশোর নীতীশের বুকের মধ্যে। ছোট লাল জুতো দেখলে ওর যে বিপুল আনন্দ হতে পারে, এ কথা ওর জানা ছিল না—জানতে পেরে আরও খুশি হলো, খুশিতে প্রাণ ছেয়ে গেল। ইচ্ছে হলো, জুতোজোড়া হাতে করতে, ইচ্ছে হলো হাত বুলোতে। কোনো রকমে সে লজ্জা ভেঙে বললে, মশাই দেখি, ওই রকম জুতো।

ক-মাসের ছেলের জন্যে চান?

ভীষণ সমস্যা, ক-মাসের ছেলের জন্যে চাইবে? বললে, ছ-সাত, না না আট-দশ মাসের আন্দাজ।

একটি ছোট্ট বাঙ্, তার মধ্যে ঘুমন্ত দুটি জুতো, কি মধুর। নীতীশের চোখের সামনে সুন্দর দুটি মঙ্গল চরণ ভেসে উঠল। মনে হলো, ও পা দুটি তার অনেক দিনের চেনা, অনেক স্বপ্নমাখা আনন্দ দিয়ে গড়া। হাসি চাপতে পারলে না, হাসি যেন ছুটে আসছে, না হেসে থাকতে পারল না।

মনে করতে লাগল, কার পায়ের মতো? কার পা? কিছুতেই মনে আসছে না, টুটুল? না—টুটুল তো বেশ বড়। ইচ্ছে হলো জুতোজোড়া কিনে ফেলে। জিগগেস করল, ওর দাম?

এক টাকা।

নিজের টাকা দিয়ে কিনতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু সাহস হলো না। কিন্তু উদ্বৃত্ত টাকাও যে তার কাছে এখন নেই, হয়তো কিছু সস্তায় হতে পারে। কি করা যায়, ‘কি হবে কিনে?’ বলে বিদায় দেওয়া যায় না? যাক টাকা পেলে কেনা যাবে। নিজের জুতো কেনাও হলো না, দরে পোষাল না বলে। যখন সে উঠতে যাচ্ছে, তখন তার মনে হলো, পিছন থেকে জুতোজোড়া তাকে টানছে, বিপুল তার টান! যেন ডাকছে, কি মোহিনী শক্তি! একবার মনে হলো কিনে ফেলে, কি আর বলবে, বড়জোর বকবে, তবুও সাহস হলো না।

চিরকাল সে ছোট ছেলে দেখতে পারে না, ছোট ছেলে তার দু-চক্ষের বিষ, ভেবেই পেত না টুটুলকে কি করে বাড়ির লোকে সহ্য করে... কি করে লোকে ছোট ছেলেকে কোলে নেয়? নিজের ওই স্বভাবের কথা ভেবে লজ্জা হলো, তবু—তবু ভালো লাগছিল, যতবার ভুলবার চেষ্টা করে ততবার ভেসে আসে সেই লাল জুতো—মধুর কল্পনা পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে সেই লাল জুতোর পানে দেখে সে আস্তে আস্তে দোকান থেকে বার হয়ে এলো। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কত অসম্ভব কল্পনাই না তার মনে জাগছিল। তার মনে তখন, পিতা হবার দুর্বার বাসনা। গৌরীর সঙ্গে যদি বিয়ে হয়, তাহলে? বেশি ছেলে মেয়ে সে পছন্দ করে না, একটি মেয়ে সুন্দর ফুটফুটে দেখতে, কচি-কচি হাত পা, মনের মধ্যে অনুভব করল, যেন একটা কচি-কচি গন্ধও পেল।

গৌরী সন্ধেবেলায়, প্রায় অন্ধকার বারান্দায় বসে, রুপোর ঝিনুকে করে তাকে দুধ খাওয়াবে : ঝিনুকটা রুপোর বাটিতে বাজিয়ে বাজিয়ে বলবে, আয় চাঁদ আয় চাঁদ—কী মধুর! আকাশে তখন দেখা দেবে একটি তারা।... আমায় বাবা বলে ডাকবে, শুনতে পেল—ছোট দুটি বাহু মেলে আধো-আধো গদ্গদভাবে ডাকছে, বাবা—হাতে দুটি সোনার বালা। দেখতে যেন পেল, গৌরী তাঁকে পিছন থেকে ধরে দাঁড় করিয়েছে, মাঝে মাঝে শিশু টাল সামলাতে পারছে না, উল্লাসে হাতে হাত ঠেকছে, হাসি-উচ্ছল মুখ। আমি হাত দুটো ধরে বলব, ‘চলি-চলি পা-পা টলি-টলি যায়, গরবিনী আড়ে আড়ে হেসে হেসে চায়’...

কি নাম হবে? গৌরী নামটা পৃথিবীর মধ্যে নীতীশের কাছে মিষ্টি কিন্তু ও নামটা রাখবার উপায় নেই, লক্ষ লক্ষ নাম মনে করতে করতে সহসা নিজের লজ্জা করতে লাগল, ছি-ছি সে কি যা-তা ভাবছে! কিন্তু আবার সেই বাহু মেলে কে যেন ডাকল—’বাবা’।
না, ছেলেমেয়ে বিশ্রী, ‘বিশ্রী’ শুধু এই ওজর দিয়ে প্রমাণ করতে হলো যে—যদি টুটুলের মতো মধ্যরাতে চিৎকার করে কেঁদে উঠে—উঃ কি জ্বালাতন!

যে জুতো দেখে ওর মন চঞ্চল হয়ে উঠেছিল, ইচ্ছে হচ্ছিল সেই লাল জুতো-জোড়ার কথা সকলকে বলে, কিন্তু সংকোচও আছে যথেষ্ট, পাছে গৌরীকে নিয়ে যা কল্পনা করেছে তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। যদিও প্রকাশ হবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না, তবুও মনে হচ্ছিল, হয়তো প্রকাশ হয়ে যেতে পারে। একেই তো গৌরী এলে, ঠাকুমা থেকে আরম্ভ করে বাড়ির সকলে ঠাট্টা করে। ঠাট্টা করার কারণও আছে; একদা স্নানের পর তাড়াতাড়ি করে নীতীশ ভাত খেতে গেছে, ঠাকুমা বললেন—নীতীশ তোর পিঠময় যে জল, ভালো করে গাটাও মুছিস নি? পাশেই গৌরী দাঁড়িয়েছিল, সে অমনি আঁচল দিয়ে গাটা মুছিয়ে দিলে পরম স্নেহে—অবশ্য নীতীশ তখন ভীষণ চটেছিল। এই রকম আরো অনেক ব্যাপার ঘটেছিল, যাতে করে বাড়ির মেয়েদের ধারণা, নীতীশের পাশে গৌরীকে বেশ মানায়—বিয়ে হলে ওরা সুখী হবে এবং তাই নিয়ে ওঁরা ঠাট্টাও করেন।

কি করে, আর কাউকে না পেয়ে নীতীশ তার বড় বউদিকে বললে, জানো বড় বউদি, আজ যা একজোড়া জুতো দেখে এলুম, ছোট্ট জুতো টুটুলের পায়ে বোধহয় হবে—কী নরম, তোমায় কী বলব! দাম মাত্র এক টাকা! অবশ্য নীতীশের ভীষণ আপত্তি ছিল টুটুলের নাম করে অমন সুমধুর ভাবনাটাকে মুক্তি দেওয়ায়, কিন্তু বাধ্য হয়ে দিতে হলো।

বউদি বললেন, বেশ, কাল আমি টাকা দেব’খন—তুমি এনে দিও।

মনটা ভয়ানক ক্ষুণ্ন হলো, কী জানি সত্যি যদি আনতে হয়—শেষে কি না টুটুলের পায় ওই জুতোজোড়া দেখতে হবে! তবে আশা ছিল এইটুকু যে, বউদি বলার পরই সব কথা ভুলে যান।

নীতীশ পড়ার ঘরে গিয়ে বসল। পড়ায় আজ তার কিছুতেই মন বসছিল না, সর্বর্দা ওই চিন্তা। তার কল্পনা অনুযায়ী একটি শিশুর মুখ দেখতে ভয়ানক ইচ্ছে হলো—এ-বই সে-বই ঘাঁটে, কোথাও পায় না, যে শিশুকে সে ভেবেছে তার ছবি নেই—কোথায়? কোথায়?
হঠাৎ পাশের ঘর থেকে গৌরীর গলা পাওয়া গেল, অস্বাভাবিক কণ্ঠে সে কথা বলছে। প্রতিবার ঝগড়ার পর নীতীশ এ ব্যাপারটাকে লক্ষ করেছে, গৌরীকে সে বুঝতে পারে না। হয়তো গৌরী আসতে পারে, এই ভেবে সে বইয়ের দিকে চেয়ে বসে রইল।

উদ্দাম দুর্বার বাতাসে ত্রাসে কেঁপে ওঠে যেমন দরজা জানলা, গৌরী প্রবেশ করতেই পড়ার ঘরখানা তেমনি কেঁপে উঠল। হাসতে হাসতে ওর কাঁধের ওপর হাত দিয়ে বললে, লক্ষ্মীটি আমার ওপর রাগ করেছ?...

কথাটা কানে পৌঁছতেই রাগ কোথায় চলে গেল।

রাগের কারণ আছে। গৌরী ফোর্থ ক্লাসে উঠে ভেবেছে যে সে একটা মস্ত কিছু হয়ে পড়েছে—অঙ্ক কি মানুষের ভুল হয় না? হলেই বা তাতে কী? প্রথমবার নয় পারেনি, দ্বিতীয়বার সে তো রাইট করেছে। না পারার দরুন গৌরী এমনভাবে হাসতে লাগল এবং এমন মন্ত্র উচ্চারণ করলে যে অতি বড় শান্ত ভদ্রলোকেরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, নীতীশের কথা তো বাদই দেওয়া যাক।

নীতীশের রাগ পড়েছিল, কিন্তু সে মুখ তুলে চাইতে পারছিল না; সেই কল্পনা তার মনের মধ্যে ঘুরছিল।
রাগ করেছ? আচ্ছা আর বলব না, কক্ষনো বলব না—বাবা বলিহারি রাগ তোমার! কই আমি তো তোমার ওপর রাগ করিনি?
মানে? আমি কি তোমায় কিছু বলেছি যে রাগ করবে?
গৌরীর এইসব কথা শুনলে ভারি রাগ ধরে, কিছু বলাও যায় না।
চুপ করে আছ যে? এই অঙ্কটা বুঝিয়ে দাও না ভাই...
অঙ্ক-টঙ্ক হবে না—
লক্ষ্মীটি তোমার দুটি পায়ে পড়ি।

এতক্ষণ বাদে ওর দিকে নীতীশ চাইল। ওকে দেখে বিস্ময়ের অবধি রইল না, সেই শিশুর মুখ; যাকে সে দেখেছিল নিজের ভিতরে, অবিকল গৌরীর মতোই ফর্সা—ওই রকম সুন্দর চঞ্চল, কাল চোখ।
কী দেখছ?
লজ্জা পেয়ে ওর অঙ্কটা করে দিলে। তারপর নানান গল্পের পর, লাল জুতোজোড়ার কথা ওকে বলে বললে, কী চমৎকার! মনে হবে তোমার সত্যি যেন ছোট্ট ছোট্ট দুটো পা।
ছোট্ট দুটি চরণ কল্পনা করে গৌরীর বুকও অজানা আনন্দে দুলে উঠল—যে আনন্দ দেখা দিয়েছিল নীতীশের মনে। গৌরী বললে, আচ্ছা কাল তোমায় আমি পয়সা দেব, আমার টিফিনের পয়সা জমানো আছে—কেমন?
নীতীশ ভদ্রতার খাতিরে বললে, তোমার পয়সা আমি নেব কেন?
কথাটা গৌরীর প্রাণে বাজল, সে অঙ্কের খাতাটা নিয়ে বিলম্বিত গতিতে চলে গেল। নীতীশ অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইল।
দিনদুয়েক গেল পয়সা সংগ্রহে। এই দুদিনের মধ্যে গৌরী এ বাড়ি আর আসেনি। ঠাকুমা জিগগেস করলেন, নীতীশ, গৌরী আসে না কেন রে?

আমি কী জানি?
কথাটা ঘরে থেকে শুনেই গৌরী তৎক্ষণাৎ গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দাঁড়াল।
ঠাকুমা বললেন, আসো না কেন?
জ্বর।
জ্বর কথাটা নীতীশকে মোটেই বিচলিত করল না, ও জানে, ওটা একটা ফাঁকি ছাড়া আর কিছু নয়।
টাকাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল জুতোজোড়া আনতে, রাস্তা থেকে টাকাটা ভাঙিয়ে নিলে, কারণ হারিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়, প্রতি মোড়ে মোড়ে গুনে দেখতে লাগল পয়সা ঠিক আছে কি না।
জুতোর দোকানে ঢুকেই বললে, দিন তো মশাই সেই লাল জুতো; সেই যে সেদিন দেখে গিয়েছিলুম?
দোকানদার একজোড়া দেখালে। ও বললে, না—না, এটা নয়, দেখুন তো ওই শেলফে?
পাওয়া গেল সেই স্বপ্নময় জুতো! কী জানি কেন আরো ভালো লাগল—ওর মধ্যে কী যেন লুকিয়ে আছে। চিত্তের মধ্যে একটি হিংস্র আনন্দ দেখা দিল—দর নিয়ে গোল বাধল না, একটি টাকা দিয়ে জুতোজোড়া নিলে। জুতোওয়ালা বললে, আবার আসবেন। মনে হলো বোধহয় ঠকিয়েছে।

রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে অনেকবার ইচ্ছে হলো বাঙ্টা খুলে দেখে—কিন্তু পারল না।

একবার মনে হলো, এ দিয়ে কী হবে? কার জন্যেই বা কিনল? সে কি পাগল! মিথ্যে মিথ্যে টাকা তো নষ্ট হলো?
ভিতর হতে কে যেন উত্তর দিল, ‘কেন, টুটুলের পায় যদি হয়?’ টুটুলের কথা মনে হতেই একটু ভয় হলো, যদি তার পায় সত্যই হয়, তাহলেই তো হয়েছে।

আবার প্রশ্ন কিন্তু কার জন্যে সে কিনেছে? বেশ ভালো লাগল বলে কিনেছি! ভালো লাগে বলে তো মানুষ অনেক কিছু করে, বাজি পোড়ায়, গঙ্গায় গয়না ফেলে—এ তবু, একজোড়া জুতো পাওয়া গেল তো। বাজে খরচ হয়নি, বেশ করেছে, একশো বার কিনবে।

সহসা জিহ্বায় দাঁতের চাপ লাগতেই মনে পড়ল, কেউ যদি মনে করে তাহলে জিব কাটে, কে মনে করতে পারে? গৌরী? আজ গৌরীকে ডেকে দেখতে হবে। বাড়িতে পৌঁছে, সকলকে মূল্যবান জিনিসটা দেখাতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু সাহস হলো না, যদি ঠাট্টা করে? প্রথমত সে নিজেই ঠিক করতে পারছে না,—কার জন্যে কিনল, কেন কিনল?

টুটুল বারান্দায় তখন খেলা করছিল, তার পায়ের মাপটা নিয়ে জুতোটা মেপে দেখল, টুটুলের পা কিঞ্চিৎ বড়—কিন্তু ওর মনে হলো অসম্ভব বড়! শঙ্কিত চিত্তে ঠাকুমার কাছে গিয়ে বললে, তোমাদের সেই লাল জুতোর কথা বলেছিলুম, এই দেখো।

ভাঁড়ার ঘর হাসি উচ্ছলিত। ঠাকুমা বললেন, ওমা—কোথা যাব, ছেলে না হতেই জুতো! হৈ হৈ পড়ে গেল। নীতীশের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল, বললে আমি টুটুলের জন্যে এনেছিলুম...

কে শোনে তার কথা! বুঝতে না পেরে, পড়ার ঘরে গিয়ে আলোটা জ্বেলে বসল, সামনে জুতোজোড়া প্রাণভরে দেখতে লাগল। এ দেখা যেন নিজেকে দেখা। ভাবলে, গৌরীকে কি করে ডাকা যায়?

গৌরী গোলমাল শুনে, জানলায় এসে দাঁড়িয়ে দেখছিল—ব্যাপারটা কি সে বুঝতে পারে নি। মনে হচ্ছিল, নীতীশ একবার ডাকে না?
সহসা চিরপরিচিত ইশারায়—না থাকতে পেরে নেমে এলো, আসতেই নীতীশ বললে, তোমায় একটা জিনিস দেখাব, দাঁড়াও।

গৌরী উদ্গ্রীব হয়ে ওর দিকে চাইল। নীতীশের শার্ট বোতামহীন দেখে বললে, তোমার গলায় বোতাম নেই, দেব?
দাও।
গৌরীর চুড়িতে সেফটিপিন ছিল না, শুধু একটি ছিল ব্লাউজে, বোতামের পরিবর্তে—না ভেবেই সেটা দিয়ে বুঝল ব্লাউজ খোলা, বললে—দাও ওটা, তোমায় একটা এনে দিচ্ছি।

থাক।
থাক কেন, এনে দিই না? কাতর কণ্ঠে বললে।
থাক, বলে হাসিমুখে সে জুতোর বাঙ্টা খুলে গৌরীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলে, তার মুখ আনন্দে উৎফুল্ল।

সুনিবিড় প্রেমে কালো চোখ দুটো স্বপ্নময় হয়ে এলো। গৌরী জুতোজোড়া দেখে, কেঁপে উঠল! তার দেহে বসন্ত মধুর শিহরণ খেলে গেল। মনে হলো, এ যেন তারই শিশুর জুতো! অস্পষ্টভাবে বললে, আঃ...! তার দেহ আনন্দে শিথিল হয়ে আসছিল। যেন কোনো রমণীয় সুখ অনুভব করে, আবার বললে, আঃ।... সব কিছু যেন আজ পূর্ণ হলো। নিজেদের কল্পনায় যে সুন্দর ছিল, যেন তাকেই রূপ দেবার জন্যে আজ দুজনে আবদ্ধ হলো।

নীতীশ বিস্ময় ভরে দেখে ভাবছিল একি! পাশের বাড়িতে তখন সেতারে চলছিল তিলক-কমোদের জোড়—তারই ঘন ঝঙ্কার ভেসে আসছিল। ওই সংগীত এবং এই জীবনের মহাসংগীত তাদের দুজনকে আড়াল করে রাখলে, হিংস্র বাস্তবের রাজ্য থেকে। যে কথা অগোচরে অন্তরের মধ্যে ছিল, সে আজ দুলে-দুলে উথলে উঠল। বহু জনমের সঞ্চিত মাতৃস্নেহ-মাতৃত্ব।

দেখতে পেল, সুন্দর অনাগত শিশু, যে ছিল তার কল্পনায়; অঙ্গটি তার মাতৃস্নেহের মাধুর্য দিয়ে গড়া, যাকে দেখতে অবিকল নীতীশের মতো; তার আত্মা যেন শিশুর তনুতে তনু নিল। ইচ্ছে করল বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে—বুকে জড়িয়ে ধরে বেদনা-মাখা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়তে। জুতো দুটোয় আস্তে আস্তে হাত বুলোতে বুলোতে সহসা গভীরভাবে চেপে ধরল, তারপর বুকের মধ্যে নিয়ে যত জোরে পারে তত জোরে চেপে, সুগভীর নিশ্বাস নিলে, মনে হলো যেন তার সাধ মিটেছে। ভগ্নস্বরে কণ্ঠ হতে বেরিয়ে এলো, আঃ...

আনন্দে বিস্ফারিত আঁখিযুগল। নিজেকে যেন অনুভব করলে। আজ শান্ত হলো তার লক্ষ বাসনা লক্ষ বেদনা—লক্ষ স্বপ্ন মূর্তি পেল।
বিশ্বগত অপূর্ণতা তা তারা এই তরুণ বয়সেই উপলব্ধি করলে; পূর্ণতার সম্ভাবনায় দুজনেই মহা-আনন্দে-মদে মত্ত হয়ে উঠল।

গৌরীর হৃদয়ের ভিতর দিয়ে, ওই লাল জুতো পরে, নীতীশ টলমল করে চলল, আর—গৌরী চলতে শুরু করলে, নীতীশের হৃদয়ের মধ্যে দিয়ে পথ করে। আচম্বিতে সশব্দে জুতোজোড়াকে চুম্বন করলে। তারপর নীতীশের দিকে চেয়ে, ঈষৎ লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠে জিগগেস করলে, কার জন্যে গো?

মৃদু হেসে বললে, তোমার জন্যে!
বারে তুমি যেন কী! অতটুকু জুতো, আমার পায় কখনো হয়? কার লক্ষ্মীটি বলো না? তোমার বুঝি?
ধেৎ! আমার হতে যাবে কেন?
ভুরু কুঁচকে বললে, তবে কার? চোখের তারা নেচে উঠল।
তোমার পুতুলের?
ওমা—তা হতে যাবে কেন? তুমি এনেছ, নিশ্চয় তোমার ছেলের?

আচ্ছা, বেশ দুজনের—
হ্যাঁ—অসভ্য, বলে গ্রীবাটাকে পাশের দিকে ফিরিয়ে নিজের মধুর লজ্জাটা অনুভব করলে। লাল জুতোজোড়া তখনো তার কোলে, যেন মাতৃমূর্তি।

Thursday, January 3

অণুগল্প : বাবলু কুমার ঘোষাল




গ্রহণ

মুস্তাফা শেখের খড়ের চালে আগুন দিয়েছে সনাতন। মুস্তাফার অপরাধ, ও  নামাজ পড়ে। সনাতন মণ্ডল সকাল-সন্ধ্যে ঠাকুর ঘরে ধূপ দেয়।

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে মুস্তাফাও সেই রাতে সনাতনের মাঠের ধানে আগুন ধরিয়ে দেয়।

সকাল থেকেই একজন ঘর হারিয়ে আর অন্যজন ভাত হারিয়ে রাগে কাঁপছে।

এদিকে শীতের সকালের মিঠে রোদে মুস্তাফার পোড়া ঘরের চাতালে মুস্তাফা ও সনাতনের পোষা নেড়ি কুকুর দুটো গা জড়াজড়ি করে ঘুমোচ্ছে।

গল্প : মলয় মজুমদার







জীবনচক্র

পোষ্টমর্টেম হয়েছে প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেছে । কিন্তু  এখনো বাসুর লাশ নিয়ে বাড়ি যেতে পারেনি বেলি। সকাল থেকে একের পর এক ঝক্কি সামলাতে সামলাতে বেলি ক্লান্ত । প্রাতঃকর্ম সেরে আসার পর থেকে দু’দন্ড দাঁড়ানোর সময় হয়নি । বাসুর মৃত্যুর খবরটা শুনে থ মেরে গিয়েছিল । কিন্তু সেটাও কয়েক সেনেন্ডের জন্যে । পুলিশের লোকগুলো যা তাড়া দিচ্ছিল । প্রথমে তো বলতেই চায়নি, কিসের জন্যে থানার বড়োবাবু ডেকেছে । দু’জনে কি গুজগুজ করে তারপর বলেছিল,’তোর মরদ কাল রাতে জেলের মধ্যে খুন হয়ে গেছে ‘। কথাটা যেন বেলির কানের পাশ দিয়ে গরম হাওয়ার টুকরোর মতো ধা করে ছুটে গেলো । মুহুর্তের মধ্যে যেন সব কিছু খানখান হয়ে গেলো জীবনের টুকরো টুকরো ইতিহাস গুলো । পড়ে যেতে যেতে কোন রকমে নড়বড়ে পিলারটাকে ধরে ফেলেছিল ।  এই সব কিছুই একটা মুহুর্তের ঘটনা । নিজেকে সামলে থানার লোকগুলোর সাথেই রওনা দিয়েছিলো,বড়োবাবুর সাথে দেখা করতে । তারপর থানা-বাড়ি -জেলখানা,সব শেষে এই হসপিটালে  ।

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এক সময় বেলি বসে পড়লো দেওয়ালে হেলান দিয়ে । চারিদিকে নোংরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে । মাছি ও মশাদের অবাধ চিৎকার । হসপিটালের সেই ওষুধের গন্ধ । এক সময় বেলীর বমি আসতো । সে বহু বছর আগের কথা । হলদিবাড়ির সেই বেলি তো কবে শেষ হয়ে গেছে সভ্যতার বিস্তারের সঙ্গে  । সাদাসিদে গ্রামের মেয়েটা কবেই তো হারিয়ে গেছে । এখন অনেক বেশি কর্কশ, কাউকে মা-বাপ তুলে গালি দিতে একটুও দ্বিধা হয় না ।

বেলি ধপ করে বসে পড়লো দেওয়ালে হেলান দিয়ে । লক্ষ্যও করলো না একটু দূরেই কোন এক টিবি রুগীর এক দলা থকথকে রক্ত-সহ থুতু ছড়িয়ে আছে । চোখটা বুজে আসছে । সকাল থেকে এক মুহুর্ত বিশ্রাম পায়নি । পেটে এক টুকরো দানা জোটেনি । থানা থেকে জেলখানা । সেখান থেকে সোজা হসপিটাল । বেলি পৌছানোর আগেই বাসুর লাশ পাঠিয়ে দিয়েছে হসপিটালে ।  বাড়ি পৌঁছে একটু বিশ্রাম নেবে ভেবেছিল । সে সুযোগ হয়নি । থানার ওসি ডেকে পাঠিয়েছে দু’বার । বেলি কাঁদবে স্বামীর শোকে না পুলিশ আর হসপিটাল করে বেড়াবে । বেলি বোঝে না । কখনো বুকটা ফেটে চীৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করেছে । কিন্তু কে শুনবে বেলির কান্না ? বেলি বাসুর বউ । মদের ঠেকের মালকিন । ডোমার মা । সকাল থেকে ডোমাও কিছু খায়নি । মায়ের সঙ্গে সঙ্গে থানা, জেলখানা, হসপিটাল করেছে । ডোমার চোখে জল দেখেছে কখনো ।কিন্তু নিজের বুকের ভেতর তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাকে চেপে রেখেছে । ও ভেঙে পড়লে , এই অবস্থায় কে দেখবে । আপন বলতে তো কেউ নেই, বস্তির অনেক লোক এসেছে । কিন্তু সব কিছু তো বেলিকেই দেখতে হবে । কালু আর  হাত-কাটা শঙ্কর, বাসুর সাগরেদ । দু’জনে ভেতরে গেছে লাশ নিতে । কাগজে সই-সাবুদ যা ছিল, সব করে এসেছে বেলি । সই তো না, আঙুলের ছাপ । এখন শুধু লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরা ।


নিশি যাপন
----------------

বাসুকে পুড়িয়ে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল ডোমাদের । ঘুম আসেইনি সারারাত । অনেকক্ষণ  বিছানায় এপাশ ওপাশ  করে বারান্দায় এসে বসেছে । রাস্তার আলো বেলিদের বারান্দাকে আলোকিত করে রাখে । সেই আলো-আঁধারের মাঝে বেলি একা স্মৃতিকে জারণ করে চলছে । বাসু নেই । আর কোনদিন ফিরবে না । কোনদিন মাতাল হয়ে এসে বেলির চুলের মুঠি ধরে বলবে না,”শালা খানকি , বেল করাতে এতোদিন লাগলো কেন , কোন নাগরের সাথে মারার ছিলি ।” বেলিও আর কোনদিন তার প্রতি উত্তর দিতে পারবে না । চুলের মুঠি ছাড়িয়ে বাসুর নাকে মুখে চড় চাপড় ও দিতে পারবে না । বলতে পারবে না, “তোর বাবা তো টাকার গাড্ডি রেখে গেছে , তাই দিয়ে তোর বেল করাবো, শালা ইতরের বাচ্চা । বউ এর গায়ে হাত দিস লজ্জা করে না ।” কিন্তু আজ সব কিছু শেষ । বেলি এখন একা । বেলির আর পুরুষ নেই । যদিও ডোমা আছে । কিন্তু সে তো সন্তান । মরদের উপর যে ভরসা করা যায় , সেই ভরসা কি আর মন থেকে ছেলের উপরে করা যায় !? একজন নারী পারে না । নারীর তো ভরসা সেই মরদে । যে তার শরীরকে ভোগ করেছে রাতের পর রাতে । যে তার গর্ভে সন্তানের বীর্য্য ঢেলেছে । যাকে দেখলেই পাড়ার লোক বলে,’ওই দেখ তোর মরদ এসেছে ‘ ।

বাসু নেই ভাবতেই গা টা কেমন ছমছম করে ওঠে । একটা অদ্ভুত বেদনা গ্রাস করেছে সারা শরীরে । এই সেদিনও যে মানুষটাকে কত গুলো পুলিশ তুলে নিয়ে গেলো মারতে মারতে । বাসু বলেছিল ‘চিন্তা করিস না , তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো ।’ কিন্তু বাসু আর ফিরলো না । লোকের মুখে শুনেছিল এবার বাসুর কপাল পুড়বে । এমন জায়গাতে হাত দিয়েছে । তাদের কাছ থেকে বেঁচে ফেরা মুশকিল । জেলে দেখা করতে গিয়ে বাসুকে বলেছিল । কিন্তু বাসু পাত্তা দেয়নি । বলেছিল ‘সব সেট হয়ে গেছে , তুই উকিলকে ধরে বেলের ব্যবস্থা কর তাড়াতাড়ি’ । বেলি বিশ্বাস করেছিল । কারণ এর আগেও তো কত  ঝামেলা , কতবার পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেছে । একবার তো পুলিশের মার খেয়ে রক্তবমি পর্যন্ত করে ফেলেছিল । তাও তো কিছু হয়নি । দু’দিন হসপিটাল থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছে । বেলও পেয়ে গেছিলো । কিন্তু এবার … । না কিছুই মাথাতে ঠিক নিতে পারছে না । একটা ঘোর ! একটা ঘোরের মধ্যে বেলির মাথায় চিন্তার স্রোতে ভেসে বেড়াচ্ছে । কিছু যেন মেলাতে চায়ছিল বেলি । কিছু একটা । কি সেটা সে নিজেও জানেনা । কিন্তু হিসাব মেলানোর চেষ্টা বেলিকে এক ঘোরের মধ্যে ঢেলে দিচ্ছিল । আর স্মৃতির বিবর্ণতা মাঝে মাঝে বেলির মাথায় এসে আবার হারিয়ে যাচ্ছিল ।  কখনো চিন্তাগুলো যেন খেই হারিয়ে ফেলছিল । স্মৃতির পাতাতে কত কি আছে এই পনেরো বছর বিবাহিত জীবনে । সুখ ও দুঃখে মেশানো সব স্মৃতি । প্রথম দেখা থেকে শুরু করে আজকের এই দিন পর্যন্ত সব কিছু বেলি ধরে রাখতে চায় । তবে সুখের স্মৃতি কেমন যেন ফ্যাকাসে । মনে আসে কিন্তু সেই মনের ক্যানভাসে অবয়ব নেয় না ।  আবচ্ছা অন্ধকারের মধ্যে সেই গুলো পড়ে থাকে । অপরিস্কার কিছু আলো সেগুলো লুকিয়ে রাখে মনের গভীরতম উঠোনে ।


তের দিন পার করে চোদ্দদিন । দিন কেটে গেছে শ্রাদ্ধও সম্পন্ন হয়ে গেছে । একদিন হাউমাউ করে কেঁদেছে বেলি । পাগলের মতো কেঁদেছে । সেই কান্নাটাই জীবনের সব জ্বালাকে যেন নির্মূল করে দিলো । তারপর থেকে বেলি শান্ত । বুকের ভেতর জমাট ব্যথা আর উপোভোগ করে না । শুধু স্মৃতিগুলো বাম পাশে এসে চিন চিন করিয়ে দিয়ে চলে যায় । তখন কিছু সময়ের জন্যে স্তব্ধ হয় । তারপর সব স্বাভাবিক । এরই নাম জীবন ।কেউ থাকলে, তাকে ছাড়া বাঁচা যায় না । কেউ চলে গেলে তবু মানুষ বেঁচে থাকে । এটাই মানুষের বেঁচে থাকার গল্প । হলদিবাড়ি লোকাল ট্রেনের কামরা থেকে বাসু সঙ্গে যে যাত্রা শুরু করেছিল । সেটা শেষ হয়ে গেছে  । এখন বেলির যাত্রা পথ একার । ছেলে ডোমা , সেও তো বাপেরই মতো । তেরো বছর বয়স । এরই মধ্যে শিশুদের জেলের ভাত খেয়ে এসেছে । বাপের থেকে একটু বেশি বেপোরয়া । বাপটা তবু কিছু লোককে সমীহ করে চলতো । কিন্তু ডোমা , কাউকে পাত্তা দেয় না । বুঝতে পারে না বেলি - কিসের এতো রাগ । যেন লাগামহীন হয়ে গেছে ডোমা । বেলির দিকে তাকিয়ে দেখে না কখনো । এক ধরনের হিংস্রতা সব সময়  মুখে ফুটে ওঠে  । বেলির ভয় করে ডোমার চোখের দিকে তাকাতে । কেন কে জানে । একটা ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা ডোমার চোখে । তবে কি বাপের বদলা নেবে ? কে জানে । বেলি জানে না । বোঝে না ।  আগে কিন্তু এমন ছিল না ।  আগে কথা শুনে চলতো । কাস্টমারের কাছে ডোমা ভীষণ প্রিয় ছিল । ভালোবেসে কতো লোক দশ বিশ টাকা ডোমাকে দিয়ে যেতো ।  এখন সব কিছু উলটো হয়ে গেছে ।  


ছয় মাস আগের কথা
------------------------------

বাক্সটা প্রায় খুলেই ফেলেছিল ডোমা । বেলি এক ঝটকায় কেড়ে নিলো,  ডোমা কিছু বলার আগেই দু’চার ঘা পিঠে দিয়ে বসলো বেলি । ডোমাও কম যায় না, বিড়বিড় করে খিস্তি দিয়ে বসলো , ‘শালা কুত্তি ‘ । বলেই দৌড়ে চলে গেলো বাড়ির বাইরে । বাড়ি মানে রেলের ঝুপড়িতে গজিয়ে ওঠা উদ্বাস্তু কলোনী । দশ বাই দশ থেকে অনেকটা বড়ো ঘর,ঘরের ভেতর দিয়ে আর একটা ঘর ।   উঠোনটা খুব ছোট নয় । বিঘত তিনেকের মতো । বারান্দা আছে ।বারান্দার পাশে ছোট্ট রান্নাঘর । বারান্দায় একটা বেঞ্চ ও কিছু টুল । সকালের দিকে সাজানো থাকে । দিন যত গড়ায় সব কিছু ছড়িয়ে পড়তে থাকে , এদিক ওদিক । উঠোনের এদিক ওদিক বোতলের ছিপি আর কাস্টোমারের আধ খাওয়া ছোলা বা বাদাম  অথবা চপের টুকরো । সারাদিনে বেলি বহুবার উঠোন পরিস্কার করে । কিন্তু পরিস্কার রাখতে পারে না ।  বেলির স্বামী বাসু । এখন জেলে । কিছুদিন আগেই বেলে বেড়িয়েছিল। কিন্তু কি কারণে বেল ক্যান্সেল হয়ে আবার জেলে । উকিল সেদিন বলছিল ,’সামনের মাসে ছাড়া পাবে ।’ খুনের কেস । সাথে আবার রেপের চার্জও আছে ।  কি সব যেন করেছে । উকিলটা একটা হারামজাদা, ঠিক করে কিছু বলে না । টাকা নেবার সময় ঠিক বুঝে নেয় ।
‘আরে ওই হারামী গেলি কোথায় , মালগুলো পৌঁছাতে হবে তো এন জে পি তে ।’ বেলির চিৎকারে ছেলে ফিরে আসে । ডোমার বয়স তেরো  ।   হলে কি হবে । একদম ঘাঘু । এখনি সব কিছু বুঝে গেছে ।

তুমি তো ছিনায় নিলা  হাত থেকে ।
ওটা কি এখানে খোলার জিনিস নাকি রে শালা । খুললে দাম দিবো নাকি ওই খানকির লোক । বলবে মালে জল আছে ।
ছেলে চুপ করে যায় । বুঝলো মা ঠিকই বলছে । এটা তো দেশী মাল না । একদম ‘ইমপোরট’ করা । নেপালের বর্ডার দিয়ে এসেছে ।  কাল্লুর মা নেপালে যায় । আজ সকালেই দিয়ে গেছে ।
      -  ঠিক আছে, আগে খেতে দাও তারপর যাচ্ছি ।
      - রান্না হয়নি, মাল ডিলিভারী করে আয়  আগে । উসকে বাত খানা মিলে গা ।
    - কিয়া বাত হ্যায় বেলি,  তেরি লেড়কা নে কিয়া বল রাহা হ্যায় । দ্বারভাঙ্গা রমণী  বিলাসী । বেলির প্রতিবেশী ।
     -  কুছ নেহি দিদি, জ্যাইশা বাপ, অইসি বেটা । কাম ধাম তো কুছ করতে নেহি । কুত্তা লোগকো খানা ঠিক টাইম পে চাহিয়ে ।
                    -   মেরা বন গিয়া হ্যায় । ইস উমর মে নেহি খায়েগা তো , মরদ নেহি বন পায়েগা ।
                -   মরদ বনকে কিয়া করেগা । জেল মে বৈঠেগা ।

এরপর কেউ কথা বাড়ায় না । দু’জনেই চুপ হয়ে যায় । ডোমা মাল নিয়ে বেড়িয়ে গেলো । বেলি উঠোন থেকে বারান্দায় উঠতেই মোবাইলের ঘন্টি শুনতে পেলো । পা চালিয়ে ঘরে ঢুকে যা ভেবেছিল তাই , উকিলের ফোন । ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে উত্তর এলো ,’প্রায় দশ হাজার লাগবে । টাকাটা ঠিকঠাক আনিস । আর বারোটার মধ্যে কোর্টে এসে পরিস । দেরি করবি না একদম ।’ বেলি, শুধু হা বলে ফোনটা রেখে দিল ।

টাকার অঙ্কটা শুনে বেলির মাথায় যেন বাজ পরলো । ভেবেছিল দু তিন হাজারেই হয়ে যাবে । এতো একবারে দশ হাজার । কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে দিয়েছিল । মনে মনে একটা কাচা খিস্তি দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় বেলি । উঠোনের এক পাশে দু জন বসে খাচ্ছে । একজন বারান্দার পাশে । টাকা যে নেই বেলির কাছে, তা নয় । কিন্তু সেটা তো মালের টাকা । বিকেলেই মহাজনকে দিতে হবে । ডোমা যদি মালের টাকাটা সাথে করে না আনে, পুরো হিসাবটা বরবাদ হয়ে যাবে । মোবাইল এর লকটা খুলে টাইম দেখলো । প্রায় এগারোটা বাজে । বারোটার মধ্যে কোর্টে যেতে হবে । সে একবার কাস্টমার দুটোকে তাড়া দিলো , ‘কি গো তোমাদের আর কতক্ষণ । আমাকে যে যেতে হবে কোর্টে ।’
কি বেলি , এই তো এলাম । এতো তাড়াহুরো করে কি মাল খাওয়া যায় ?
সে জানি নে বাপু । আজ আমার মরদের বেল হবার কথা । আমাকে যেতে হবে । টাকাটা দিয়ে দাও । তারপর খাও ।
কিছু বলছিল কাস্টমার টা সেদিকে কান না দিয়ে , ঘরে ঢুকে পড়লো । টিনের ট্র্যাঙ্কের একদম নীচ থেকে কড়কড়ে নোটগুলো বের করে বিছানায় নিয়ে বসলো । গুনে দেখলো । পুরোপুরি এগারো হাজার আছে । মহাজনকে সাত দিতে হবে । কিন্তু কি করে দেবে ? সব টাকা তো সেই উকিলের মুখে পুড়তে হবে । না হলে হারামজাদা কোন কথা শুনবে না ।

কাহা হ্যায় বেলি ? আজ কোরট মে জানেকা বাত থা না ?

বিলাসীর গলা । কাল বলে রেখেছিল । আগেই জানতো ডোমা থাকবে না । তাই বিলাসীকে সঙ্গে নিয়ে যাবে । যদিও তেমন কিছু না । তবে সাথে কেউ থাকলে মনে একটু বল পায় ।

হা । তু রেডি হো গিয়া । মেরা দো-মিনিট লাগেগি । উসকে বাত চলতে হ্যায় ।
ঠিক হ্যায় । জলদি চল । মেরোকো ভাট্টি মে জানা হ্যায় । মাল জাদা নেহি হ্যায় ঘরমে ।
লেকিন উকিল নে বারো বাজে জানে কে লিয়ে বোলা ।
কিতনা টেম লাগেগি । কুছ বলা কিয়া ?
নেহি
ঠিক হ্যায় কোই বাত নেহি । চলতে হ্যায় । বাদ মে দিখা জায়েগি ।

বারোটার আগেই কোর্টে গেটের কাছে এসে দাঁড়ালো বেলি ও বিলাসী । হাজার রকমের লোক আর তাদের মুখের হাজার রকমের ভঙ্গি । কেউ ঝিমোচ্ছে , কেউ বা উর্ধ্বশ্বাসে এদিক ওদিক ছোটাছোটি করছে । লোকে লোকারণ্য চারিদিক । কিন্তু বেলি জানে কোথায় গেলে পাওয়া যাবে উকিলের দেখা । সেদিকেই এগোতে এগোতে দেখতে পেলো, একজন উকিল দৌড়াচ্ছে আর তার পেছন পেছন এক মহিলা চটি হাতে ধাওয়া করছে । সেই মহিলার মুখ দিয়ে অভিশাপ আর কুৎসিত ভাষায় গালি । দু’একজন তাকে আটকানো চেষ্টা করছে ঠিকই, কিন্তু সেই মহিলার শরীরে যেন অসুরের শক্তি । সবাইকে ছিটকে ফেলে সেই উকিলের দিকে ছুটে যাচ্ছে । বেলির বেশ মজা লাগলো দৃশ্যটা দেখে । নিজের উকিলের চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠলো । কিন্তু সে দাঁড়ালো না । উকিলদের ঘরের দিকে পা ফেলে এগোতে থাকলো । পাশে বিলাসী । উকিলের নামটা খানি কিন্তু বেশ । চারুচন্দ্র মৈত্র । সবাই চারু উকিল  বলেই ডাকে ।

বেলীদের চারু উকিলকে খুঁজে পেতে দেরি হলো না । দেখে মনে হলো ওদের জন্যেই যেন অপেক্ষায় ছিল । মুখোমুখি হতে প্রথম কথা,’টাকাটা পুরো এনেছিস তো ‘? বেলি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে,  চারু উকিলের মুখে যেন শান্তি ফিরে এলো । বড়ো একটা দুঃশচিন্তার যেন অবসান ঘটলো । টাকাটা বের করে দিতে যাচ্ছিল বেলি । কিন্তু মাথা নেড়ে মানা করে বললো,’এখন তোর কাছেই রাখ । আমি যখন বলবো তখন দিবি ।

উকিলকে অনুসরণ করে ওরা হাঁটতে লাগলো । কোর্টের গারদের সামনে এসে দেখলো । বাসু চুপচাপ বসে আছে গারদের এক কোণে । বেলিদের দেখে উঠে দাঁড়ালো । উকিল কিছু বলার আগেই, প্রায় চিৎকার করে বেলীকে বললো,’মাগী এতো দেরি করলি ক্যান ?

কোথায় দেরী করলাম, উকিলবাবু যখন আসতে কইছ ,তখনি তো আইলাম । অতো চিৎকার করস কেনো ?

বাসু আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই গারদের সেন্ট্রীর লাঠির বাড়িতে বাসু চুপ হয়ে গেলো । উকিলের দেওয়া কাগজে সই করে আবার বসে পড়লো । উকিল বললো,’একটু পরেই তোলা হবে, বেশি কথা বলবি না । সরকারী উকিলের সাথে সেট করেছি । আশা করি বেড়িয়ে যাবে আজ । তবে একটু বেশি টাকা লাগবে । সরকারী উকিল তো, খিদেটা একটু বেশি । “ উকিলের কথা শুনে, বেলির বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘শালা আপনারই বা কিসে কম” ।

চারু উকিল চলে যেতেই বেলী ও বিলাসী দু’জনে গারদের কাছ থেকে সরে এসে দাঁড়ালো । ওই জায়গাটাই মানুষের ভীড়টা বেশী । গুমোট  ও আলো কম । গারদের ভেতর টিমটিম করে বাতি জ্বলছে । তাতে সব কয়েদীদের মুখ ঠিক করে দেখা যায় না । নাম ও নাম্বরে চেনা যায় । বাসুর নাম্বার কতো, বেলী জানে  না।


উকিলের ডাক পেয়ে এগিয়ে গেলো । বাসুকে গারদ থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে । আদালতে তুলবে । কোর্ট রুমে বেশ অনেক ভীড় । কত কালো কোটপরা লোকজন । চেঁচামেচিতে কেউ কারো কথা শুনতে পাচ্ছে কি পাচ্ছে না । বোঝা যায় না । সবাই চেঁচায় । সবাই কথা বলে । উকিল মহাশয় একদম সামনের সারিতে গিয়ে বসে পড়েছে । পাসে এক মহিলা উকিল । কি গুজুর গুজুর করছে , কে জানে ? বেলি আর বিলাসী ঘরের একদিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে লোকজন দেখে যাচ্ছে । বিচারক আসতেই  যারা বসেছিল উঠে দাঁড়ালো । বেলি চোখ শুধু মাত্র উকিলের দিকে । কি এতো কথা বলছে ওই মহিলার সাথে । ওই মহিলা তো সরকারী উকিল । এর আগেও দেখেছে বেলি । খুব চিৎকার করে । কাউকে কিছু বলতে দেয় না ।  সত্যি কি আজ বাসু বাড়ি ফিরবে ! কে জানে ? বিচারক বসে পড়তেই যারা দাঁড়িয়েছিল তারাও বসে পড়লো । কিছুক্ষণ পরে বাসুকে কাঠগড়ায় তোলা হলো । সেই মহিলা আর বেলির ভারাটে উকিল কি সব আংরেজি আর বাংলাতে বললো । কিছুটা শুনতে পেলো কিছুটা কানে এলো না । এই ভাবে অনেকখন কেটে যাবার পর, দেখলো বাসুকে নিয়ে পুলিস চলে যাচ্ছে । এবার বেলি এগিয়ে গেলো উকিলের দিকে ।

কি হলো । ওকে যে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে ।
বেল হলো না ।মানব অধিকার কমিশনের লোক জন পেছন থেকে কিছু করেছে । তার উপর আবার রেপ কেস ।
আপনি যে কইলেন টাকা দিলে বেল হইবো ।
উনি টাকা নেয়নি ।
তাহলে টাকা ফেরত দেন ।
দেওয়া যাবে না । অন্যখানে লেগেছে । পরে হিসাব দিয়ে দেবো ।

কথাটা বলেই উকিল চলে গেলো ।  অসহায় লাগছে বেলীর । আর কতোদিন কতবার এই রকম ভাবে আসতে হবে । বেলি জানে না । সব দিক দিয়ে লোকসান । টাকাটা গেলো । কিন্তু মানুষটা বাড়ি ফিরলো না । চোখ দিয়ে জল বেড়িয়ে আসতে চাইছিল । কিন্তু বেরোতে দেয়নি । আগে হলে এতোক্ষণে হাউমাউ করে কান্নাতে ভেঙে পড়তো । বিলাসী বুঝছিল বেলির মনের অবস্থা । কিন্তু কিছু করার মতো ছিলো না । তাই চুপচাপ বেলিকে প্রায় জড়িয়ে ধরে কোর্ট থেকে বেড়িয়ে এলো ।

কোর্ট থেকে বেড়িয়ে , নির্বাকভাবে বেলি হেঁটে চলছে । পাশে বিলাসী । কিন্তু দু’জনেই কেউ কথা বলছে না । বাড়ি খুব একটা দূর নয় । রেল লাইনটি পার হলেই বেলীদের বাড়ি দেখা যায় । কিন্তু রেল লাইনের কাছাকাছি আসতেই দেখলো একটা মাল গাড়ি ধীরে ধীরে পার হচ্ছে ।  মাল গাড়ি যেতে সময় লাগে । কতো বড়ো গাড়ি । কত কত মাল নিয়ে যায় । কোথায় যায় ? বেলি বা বিলাসী দু’জনের কেউ জানে না । তবে বাসু একবার মাল গাড়ির মাল  লুট করেছিল ।  এক সাথে অতোগুলো টাকা বেলি আগে দেখেনি । কয়েকটা বান্ডিল । তুলসীর পেটে তখন ডোমা । বেশ লাগছিল । বেলি বেশ আহ্লাদী মাখা গলায় বলেছিল,’পেটে যেডা এসেছে , সে আমাগো ভবিষৎ ভালো কইরা দিবো” । যদিও সে সব কিছু হয়নি । দু’দিন পরেই বাসুকে কিছু লোক তুলে নিয়ে গিয়েছিল । সাথে সেই টাকাগুলো ।   পরে জেনেছিল ওই লোকগুলো সিন্ডিকেটের  দাদা । রাজনীতি করে । বাসু ওদের দাবি  মেটায়নি। সিন্ডিকেটকে কিছু না দিয়ে, বাড়ি বানানো । দোকান করা । দাদা ট্যাক্স তোলা বা ডাকাতি করো । কিছুই সম্ভব তখনো ছিলো না, আজো নেই । আগে একজনকে দিলেই হতো । এখন তা হয় না । এখন অনেককে দিতে হয় । একি ঠেকে দু’তিনটে গোষ্ঠী । সবাইকে দিতে হয় ।  না দিলেই শুরু হয় যায় অত্যাচার । এসে প্রথমেই দারুর বোতলগুলো ভাঙবে । তারপর অন্য কিছু ।


বাসু মারা যাবার পাঁচ বছর পরের
-----------------------------------------------
একদিন
------------


কাস্টমাররা প্রায় সব চলে গেছে । এখন ঘড়িতে রাত একটা । দু’এক জন যারা এখনো খাচ্ছে । তারা এই রকম দেরি করে আসে প্রতিদিন । ডোমা বাড়ি নেই । কোথায় গেছে বেলি জানে না । কোনদিন বলে যায় না । মদের ব্যবস্যাতে মাথা ঘামায় না । যা কিছু করার বেলি একা করে । তাতেই সংসার চলে । বেলি বেঁচে আছে । ডোমা কখনো কোন টাকা দেয় না বেলির হাতে । তবে মাঝে মধ্যে বাড়ির বাজার করে আনে । দু’এক বার বেলির জন্যে শাড়ি এনেছে । স্বভাবে বাসুর জেরক্স কপি । কিন্তু বাসুর থেকে অনেক বেশি হিংস্র । দেখতেও সেই রকম হিংস্র । বাসু ও ডোমা এই দুজনই বেলির পৃথিবী । একজন চলে গেছে । আরেক জন আছে । কিন্তু তার দেখা পাওয়া যায় না । দু’বার জেলের ভাত খেয়ে এসেছে এরই মধ্যে । বেলি বসে আছে বারান্দায় । চোখে ঘুমের আবেশ । মাঝে মাঝেই চোখটা বুজে আসছে । কিন্তু ঘুমাতে পারছে । কাস্টমার আছে, ডোমাও বাড়ি ফেরেনি । কিছুটা গভীর ঝিমুনি এসে গেছিল, বুটের দুমদাম আওয়াজে বেলি ধরফর করে উঠে দাঁড়ালো । বুটের আওয়াজ ধীরে ধীরে কাছে আসছে । বেলি অবাক হচ্ছে এতো রাতে রেইড করতে তো পুলিশ আসে না । কারা এরা ? বেলির বাড়ির গেটটা ভেজানো ছিলো । এক প্রকার প্রায় লাথি মেরে ঢুকে পড়লো এক সাথে ছ’জন পুলিশ । প্রত্যেকের হাতে বন্দুক তাক করা । এই রকম ভাবে আগে কখনো দেখেনি বেলি পুলিশকে । এক প্রকার পুরো বাড়িটাকে ঘিরে ধরেছে । বাইরেও পুলিশের গলা । চিৎকার শুনতে পেলো ।কে একজন যেন বললো,’শুয়োরের বাচ্চাটা যেন কোন ভাবে পালাতে না পারে ।’ দু’জন পুলিশ বেলিকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকলো । মুখে অশ্রাব্য গালি । গালি গুলোর থেকে বুঝতে পারলো । এরা এসেছে ডোমার খোঁজে । কিন্তু বুঝতে পারছে না, ডোমা কি করলো যে এতো পুলিশ তার বাড়িটা ঘিরে ফেলেছে । একজন পুলিশ দুম করে বেলির গালে সপাটে চড় বসিয়ে বললো,’কোথায় তোর ছেলে ? শুয়োরের বাচ্চা কোথায় তোর ছেলে ?” যে দু’জন পুলিশ ঘরে ঢুকেছিল তারা বেড়িয়ে এসে বললো,’স্যার ঘরে নেই, ভেগেছে মনে হয় “।
শালা ভেগে যাবে কোথায় !
স্যার , বলবেন দয়া করে  কি করেছে ডোমা ।
শালী জানিস না , তোর ছেলে কি করেছে । এক মেয়েকে রেপ করে খুন করেছে । তোর ছেলে এবার গেছে । কেউ বাঁচাতে পারবে না ।
যে দু’জন বসে খাচ্ছিল । তারা যে কখন ভেগে গেছে বেলি দেখতে পায়নি । পুলিশ কিছুক্ষণ এদিক ওদিক সার্চ করে বেড়িয়ে গেলো । যাবার আগে অশ্রাব্য গালির ফোয়ারা বেলির উপর ছুঁড়ে দিলো । বেলি ধপ করে বারান্দায় বসে পড়লো কপালে হাত দিয়ে । শেষ পর্যন্ত সেই প্রায় একই ধরণের অপরাধ ডোমাও করে বসলো । বাসুকে জেলের ভেতর খুন হতে হয়েছিল । আবার ডোমাও একই পথে । কি করবে বেলি এবার । ঘুম চোখ থেকে উধাও হয়ে গেছে । শুধু একটা ভয় । অজানা ভয় বেলির বুকে আশ্রয় নিয়েছে । একটা উন্মাদ যন্ত্রণা বেলির শরীরকে গ্রাস করে ফেলেছে । মাঝ নদীতে কেউ যেন তাকে ছেড়ে দিয়েছে । আর সে হাবুডাবু খাচ্ছে । কোন কিনারা দেখতে পারছে না চোখ মেলে ।


-------------------------------------------------

Wednesday, January 2

সাক্ষাৎকার : রমানাথ রায়


'কাপুরুষরা কখনো ভালো লেখক হতে পারে না।'





সাহিত্যিক রমানাথ রায়ের মুখোমুখি প্রগতি মাইতি ও রাজেশ ধর


( সাহিত্যিক রমানাথ রায়ের জন্ম ১৯৪০ সালে, মধ্য কলকাতায়। পৈতৃক নিবাস যশোহর, বাংলাদেশ। " শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন" - এর অন্যতম পুরোধা। রাজ্য সরকারের বিদ্যাসাগর পুরস্কার লাভ করেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, দেশ, আজকাল, বর্তমান - ইত্যাদি কাগজে লিখেছেন। কিন্তু তাঁর উত্থান লিটল ম্যাগাজিন থেকে। এখনও লিটল ম্যাগাজিনের সাথে তাঁর নাড়ির সম্পর্ক। বাংলা সাহিত্যে ' জাদু বাস্তবতা'  নিয়ে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তারঁ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : প্রিয় গল্প, দু'ঘন্টার ভালোবাসা, শ্রেষ্ঠ গল্প, গল্প সমগ্র। উপন্যাস  : ছবির সঙ্গে দেখা, ভালোবাসা চাই, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী, কাঁকন, অন্যায় করিনি, উপন্যাস সমগ্র ইত্যাদি।)


পারক : শাস্ত্র বিরোধী আন্দোলন এর কি উদ্দেশ্য ছিল?

বাংলা সাহিত্যে তারাশঙ্কর মানিক প্রমুখ ও লেখকদের হাতে তথাকথিত বাস্তববাদী সাহিত্যের যে ধারা তৈরি হয়েছিল তাকে বর্জন করাই ছিল শাস্ত্রবিরোধী সাহিত্যের উদ্দেশ্য। আমরা চেয়েছিলাম বাস্তবের সঙ্গে ফ্যান্টাসি মিশিয়ে নতুন সাহিত্য রচনা করতে।

পারক : এই আন্দোলনকে সফল হয়েছিল বলে আপনার মনে হয়?

 আমাদের উদ্দেশ্য পূরণ না হলেও অনেকটাই সফল হয়েছে। কারণ এখন অনেকেই তথাকথিত বাস্তববাদী সাহিত্যের ধারা থেকে সরে এসেছেন, তাদের লেখায় ফ্যান্টাসি আসছে। 

পারক : ওই সময় এই আন্দোলনে কে কে ছিলেন? 

এই আন্দোলনে প্রথমে আমি ছাড়া ছিলেন শেখর বসু, আশীষ ঘোষ, সুব্রত সেনগুপ্ত, কল্যান সেন। পরবর্তীকালে এসেছেন অমল চন্দ্র, বলরাম বসাক এবং সুনীল জানা।

পারক : আপনি প্লটে বিশ্বাস করেন না কেন?

 প্লট সব সময় কার্যকারণে গঠিত হয়। সেখানে প্রতিটি কাজের পিছনে কারণ থাকে। কারণ ছাড়া কার্য হয়না। বিজ্ঞানের এই নিয়মকে আমরা মানতে চায়নি। আমরা দেখেছি অনেক কার্যের কারণ সব সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হাইজেনবার্গের 'অনিশ্চয়তার তত্ত্ব' তো সেই কথাই বলে। তাছাড়া আমাদের জীবনে এমন সব অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, যার কারণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সেই কারণেই আমরা প্লট নির্ভর গল্প বর্জন করে ছিলাম।

পারক : আপনার গল্প উপন্যাসে দেখা গেছে আপাত অ্যাবসার্ড  চরিত্র এসেছে। এর পিছনে উদ্দেশ্য কি? 

 পুরনো যুগের বাস্তববাদী সাহিত্যের ধারায় আধুনিক যুগের সমস্যা বা চরিত্রদের প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না বলেই অ্যাবসার্ড সাহিত্যের রচনারীতিকে গ্রহণ করা হয়েছে। এটাও একটা রচনাশৈলী। বর্তমান যুগকে প্রকাশ করতে হলে এই রচনারীতি আমার কাছে জরুরী বলে মনে হয়েছে। এই রকমই জরুরি মনে হয়েছিল ত্রৈলোক্যনাথ, সুকুমার রায় বা রাজ শেখর বসুর কাছে। আমাদের পৌরাণিক গল্পে বা মঙ্গলকাব্যের আমরা এই রচনারীতি দেখেছি, এই রচনারীতি আমরা কথাসরিৎসাগর বা আরব্য রজনীতেও দেখেছি। আমরা আমাদের এই মহান ঐতিহ্য থেকে সরে এসে পাশ্চাত্যের বাস্তববাদী সাহিত্যের ধারায় গল্প উপন্যাস রচনা করতে গিয়ে নিম্নমানের একঘেয়ে রচনা রীতিতে আটকে গেছি।

পারক : আপনার প্রায় সব গল্প উপন্যাসে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ শ্লেষ আছে এর কারণ কি? 

সমাজ ও চরিত্রদের অসঙ্গতিকে ফুটিয়ে তোলা এর উদ্দেশ্য। চিরকালীন মূল্যবোধে যা স্বাভাবিক বলে মনে হয় তা যখন আর স্বাভাবিক থাকে না, হয়ে ওঠে অসঙ্গতিতে ভরা, তখনই তা কৌতুকের বিষয় হয়ে ওঠে। ব্যঙ্গ বিদ্রুপ শ্লেষের প্রয়োজন হয় তখনই। আমার সব লেখায় যে ব্যঙ্গ বা কৌতুক আছে তা বলা যায় না, তবে অনেক লেখাতেই এসব আছে। আমার কি তাহলে দুটো মুখ? এক মুখে হাসি আর এক মুখে বেদনা! জানিনা, আমার পাঠকরাই এর সঠিক উত্তর দিতে পারবেন।

পারক : আপনি কি মনে করেন কথা সাহিত্যে হাস্যরস অনিবার্য? 

সাহিত্যে কোন কিছু অনিবার্য নয়। প্রত্যেক লেখকেই তার মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নিজস্ব রচনারীতি নির্মাণ করেন। সেখানে হাস্যরস থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে। তবে তির্যক দৃষ্টিভঙ্গি বা সরসতা গল্প বা উপন্যাসকে অনেকখানি সুপাঠ্য করে তোলে। তাই বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রের লেখা আমাদের আজও আকর্ষণ করে, আর সরলতার অভাবে তারাশঙ্কর, বা মানিক আমাদের আকর্ষণ করে না। পাশ্চাত্য সাহিত্যেও বর্তমানে হাস্যরসকে আশ্রয় করা হচ্ছে। তাদের রচনায় কৌতুক রসের প্রাবল্য দেখা যায় কাফকা, বোর্হেস, মার্কেজ, ক্যালভিনো, কুন্দেরা প্রমূখ লেখকদের রচনা তার প্রমাণ। 

পারক : আপনার উত্তরণ লিটিল ম্যাগাজিন থেকে। ষাট সত্তরের দশকের লিটিল ম্যাগাজিনের সঙ্গে এই সময়ের লিটল ম্যাগাজিনের কোনো পার্থক্য দেখতে পান?

 ছয়-সাতের দশকের লিটিল ম্যাগাজিনগুলো অর্থাভাবে ভুগত, তাই সেই সময় লিটিল ম্যাগাজিনগুলো ছিল ক্ষীণকায় এবং দীর্ঘস্থায়ী হত না। তা না হলেও সেই সব ম্যাগাজিনে ছিল স্পর্ধা, অহংকার ও যৌবনের দীপ্তি। নতুন চিন্তা ভাবনার নিয়মিত প্রকাশ হত সেখানে। এক কথায় সেখানে থাকত একটা বেপরোয়া ভাব। কিন্তু এখনকার লিটিল ম্যাগাজিন ক্রমশই যেন রক্ষণশীল হয়ে উঠছে। গল্প উপন্যাস বা কবিতায় বিদ্রোহী মনের পরিচয় সেভাবে থাকছে না। সবাই যেন এখন একটা স্থিতাবস্থা চাইছে, অথচ এখন লিটিল ম্যাগাজিনগুলো বেশ স্থূলকায়। দেখে মনে হয় এদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো, কিন্তু সর্বত্র চিন্তার দৈন্যতা কেন? কেন গতানুগতিক? অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু তাদের সংখ্যা নগন্য।

পারক : এই প্রজন্মের গল্পকারদের গল্প কি আপনি পড়েন? পড়লে কেমন লাগে?

 পড়ি। এই প্রজন্মের গল্পকারদের গল্প নিয়মিত পড়ি। ভাল লাগলে  লেখককে জানাতে ভুলি না। 

পারক : এই প্রজন্মের গল্পকারদের বিশেষ কিছু কি বলবার আছে?

 না, বিশেষ কিছু বলার নেই। আমি চাই সবাই নিজের নিজের মত করে লিখুন। বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করুন। শুধু একটাই অনুরোধ, গতানুগতিক লেখা লিখবেন না। 

পারক : সাহিত্যিকের সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকবে কি? 

মানুষ মাত্রই দায়বদ্ধ হয়ে বেঁচে আছে। সে দেশের কাছে দায়বদ্ধ, পরিবারের কাছে দায়বদ্ধ, পাড়ার কাছে দায়বদ্ধ, রাজনৈতিক দলের কাছে দায়বদ্ধ, বন্ধুদের কাছে দায়বদ্ধ, সমাজের কাছে দায়বদ্ধ। তার দায়বদ্ধতা শেষ নেই। এত দায়বদ্ধতার কারণে সে হাঁপিয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। তাই সে এইসব দায়বদ্ধতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। লেখক কোন অসাধারণ মানুষ নয়। সেও একজন সাধারন মানুষ। তার আছে এইসব দায়বদ্ধতা। এছাড়াও তার আছে সম্পাদকের কাছে দায়বদ্ধতা। এত দায়বদ্ধতা নিয়ে তাকে বেঁচে থাকতে হয়। এ খুব কষ্টের, খুব যন্ত্রণার। তবে সবার উপরে শিল্পের কাছে তার দায় বদ্ধতা। নিজের সময় ও সমাজের কথা লিখলেও যদি তা শিল্প না হয়ে ওঠে তাহলে তার কোন মূল্য নেই। লেখক অবশ্যই তার সময় ও সমাজের কথা বলবে, তবে তা যেন প্রচারধর্মী না হয়, বক্তব্যধর্মী না হয়। সময় ও সমাজ হচ্ছে মাটির মতো, যার বুকে শিকড় চালিয়ে যেমন ফুল গাছের জন্ম হয়, তেমনি জন্ম হয় শিল্প-সাহিত্যের এখানে দায়বদ্ধতার কোন ব্যাপার নেই।

পারক : জাদুবাস্তবতার সফল প্রয়োগ আপনার সাহিত্যে নজর কাড়ে। এখন আর কোন কোন কথাকার জাদুবাস্তবতার গল্প লেখেন? আপনি কি মনে করেন গল্পে জাদুবাস্তবতা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে?

 ল্যাটিন আমেরিকার লেখকদের মতো সেই অর্থে আমার গল্পে জাদুবাস্তবতা নেই। যা আছে আমার গল্পে তা হল অ্যাবসার্ডিটি। মঙ্গল কাব্যের কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু সুকুমার রায়, ত্রৈলোক্যনাথে অ্যাবসার্ডিটি কি নেই? আমি ছোটবেলায় সুকুমার রায়ের লেখা পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। এছাড়া বঙ্কিমচন্দ্রের 'মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত', একে তুমি কি বলবে! সুতরাং বাংলা সাহিত্যে এটা ছিল এবং আছে। এই সময় অনেকে অ্যাবসার্ড গল্প লিখেন কেন? তোমার অনেক গল্পেও (প্রগতি মাইতি) আমি অ্যাবসার্ডিটি খ্ব্বুঁজে পেয়েছি। সায়ন্তনী ভট্টাচার্য্য এ নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। আরো অনেকে লিখছেন অর্থাৎ আগের মত এই প্রজন্মে অনেকেই তাদের গল্পে অ্যাবসার্ডিটি আনছে। অ্যাবসার্ডিটি যদি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ না করতে পারে তাহলে সুকুমার রায়ের লেখাগুলো ব্যর্থ বলা যাবে কি!

পারক : আগামীতে বাংলা সাহিত্যে কোনো বাঁক বদল হতে পারে বলে আপনার মনে হয়? 

এটা খুব কঠিন প্রশ্ন। কখন কোন প্রতিভার উন্মেষ হবে তা বলা মুশকিল। তবে সাহিত্য তো স্থবির কিছু নয়, তা গতিশীল। বাংলা সাহিত্যে নানা সময়ে নানা পরিবর্তন হয়েছে এবং কিছু বাঁক বদল হয়েছে। ভবিষ্যতেও যে হবে না তা বলা যায় না, বরং তা হতেই পারে। যদিও এই মুহূর্তে বাংলা সাহিত্য কেমন যেন গর্তের মধ্যে পড়ে পাক খাচ্ছে। এখান থেকে সাহিত্যকে তুলে আনতে হবে, গতিশীল করতে হবে।

পারক : শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম নৈরাজ্য। বেকারি বেড়েই চলেছে। জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া। মধ্যবিত্ত ও গরীব মানুষ দিশাহারা অথচ তেমন কোনো প্রতিবাদ আন্দোলন নেই। একজন প্রবীণ কথাকার হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া জানাবেন।

 শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম নৈরাজ্য দেখা যাচ্ছে। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে। এ অত্যন্ত উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মর্যাদা হারিয়ে ফেলছে। এরকম চলতে থাকলে একদিন শিক্ষা ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়বে। শিক্ষার সাথে সাথে স্বাস্থ্য! সেখানেও আমরা পিছিয়ে পড়ছি। কলকারখানা তেমন করে হচ্ছে না, ফলে বেকারি তো বাড়বেই। শিল্পে ব্যাপক কর্মসংস্থান করতে হবে, আর এখানেই চূড়ান্ত সংকট। ব্যাপক কর্মসংস্থানের কথা কেউই ভাবছেন না। সবদিক থেকে একটা অদ্ভুত সংকট এসে উপস্থিত অথচ বিরোধী শক্তির তেমন কোনো আন্দোলন চোখে পড়ছে না। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকাটাও একটা সমস্যা বলে মনে করি। লেখক কবিদেরও সাহসী হতে হবে, কলম ধরতে হবে। কাপুরুষরা কখনো ভালো লেখক হতে পারে না।




গল্প : দূর্বা মিত্র



দুঃসহ দুবাই

লেক ক্লাবের সুইমিং পুলে ৫০ থেকে ১০০ বার এপার ওপার করলে সন্ধ্যেটা ভালো কাটে সৌমাভ সান্যালের | ওপার থেকেই দেখতে পেলো মোবাইল ফোনের আলো জ্বলছে নিভছে রং লাল আর সাদা ।তার মানে কমিশনার  স্যারের মোবাইল থেকে ফোন | হাত বাড়িয়ে চেয়ার থেকে তোয়ালে জড়িয়ে ফোনটা কানে ধরে সৌমাভ -
-"বলুন স্যার |"
-"এয়ারপোর্ট পৌঁছতে কতক্ষন লাগবে ?"
-"৪০ মিনিটস স্যার |"
-"ব্যাগ এ পাসপোর্ট আছে ?"
-"হ্যাঁ স্যার |"
-"ভালো কথা | এয়ারপোর্ট চেক ইন কাউন্টার এ তোমার টিকেট আর কেস ফাইল রাখা আছে |
দূতাবাসের একজন অফিসার থাকবেন - ভিসা স্ট্যাম্প মেরে দেবেন | ওহ ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স সাথে রেখো | আমাদের যে অফিসার থাকবে - তাকে নিজের জীপ্ এর চাবি দিয়ে দিও - তোমার বাড়িতে পৌঁছে দেবে |
THE CASE IS CODE RED, HANDLE IT PROPERLY |"
ফোন লাইন কেটে যায় |
অবান্তর প্রশ্ন করা সৌমাভর স্বভাব নয় - কমিশনার এর সময় নেই |
পুল থেকে জীপ্ এ পৌঁছতে ওর সময় লাগলো ৭ মিনিটস - তাহলে হাতে রইলো ৩৩ মিনিটস | হুটার চালু না করলেও হবে ।শুধু যেন বাইপাস এ জ্যাম  না থাকে | যাদবপুর থানা পৌঁছোবার আগেই একটি পাইলট বাইক স্যালুট করে ফলো করতে হাত দেখালো | নিশ্চিন্তি | কমিশনার স্যার এর কোনো কাজে সুঁচ গলার ফাঁক থাকে না | ৩০ মিনিটে এয়ারপোর্ট |
সব ফর্মালিটিজ মিটিয়ে টিকেট এ চোখ পড়লো - দুবাই - ফ্লাইট এর সিকিউরিটি চেক ইন শুরু হয়ে গ্যাছে | সৌমাভর একটাই ব্যাগ - হাই প্রায়োরিটি সিকিউরিটি ক্লেয়ারেন্স নিয়ে প্লেন এ উঠে বসলো | উইন্ডো সিট | ৫ ঘন্টা |
এবার ফাইলটা খোলা যাক | একটা কালচে রুমাল ফাইল এর খোলা পাতার ওপর ফেলে লাইন বাই লাইন পড়তে শুরু করে |
অনাবাসী মহিলা যাত্রী | সঙ্গে ১৭ বছরের কন্যা | গন্তব্য ছিল কলকাতা | দুবাই এয়ারপোর্ট এ  স্টপ ওভার ছিল কয়েক ঘন্টার | বোর্ডিং শুরু হবার পর মেয়ে অস্থির হয়ে ছুটে যায় কাউন্টার এ - মা কে ডাকাডাকি করা সত্ত্বেওউঠছে না -  ঘুমাচ্ছে |
একজন মহিলা কর্মচারী ছুটে যান | গায়ে হাত দিয়ে ডাকতেই সোফা  থেকে গড়িয়ে পড়েন | ইমার্জেন্সি রেসকিউ টীম ডাকা হয় - তারা ডেড - অন -আরাইভাল রায় দিয়ে যায় |
কেস টা ৩ দেশে ছড়ানো হওয়াতে দুবাই পুলিশ লালবাজার এর সাহায্য চায় | ফলশ্রুতি - সৌমাভ দুবাই পৌছায় |
একজন লোকাল অফিসার ওকে নিয়ে সোজা পুলিশ মর্গে  যায়  | পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে
ম্যাসিভ কার্ডিয়াক এটাক |
বডি দেখলো সৌমাভ | মধ্যবয়সি মহিলা শরীর | সুগঠিত | মাঝারি সুন্দরী | উচ্চতা ৫'৩" / ওজন ৬২ কেজি.| কালো চুল ও চোখ | এ ছাড়া আর কিছু দেখার নেই | কোনো চোট / আঘাত নেই |
একজন লেডি অফিসার মহিলার মেয়েটিকে নিয়ে বাইরে বসে ছিল | সৌমাভর হাতে একটা
ফাইল দিলো | এটা এসকর্ট হ্যান্ডওভার ফাইল | সৌমাভ মহিলার মৃতদেহ ও বাচ্চা মেয়েটিকে
নিজের দায়িত্বে দুবাই থেকে কলকাতায় নিয়ে আসবে |
সই করে ফেরত দিয়ে মেয়েটির দিকে তাকায় - "খিদে পেয়েছে ?"
মেয়েটি ঘাড় নাড়ে - "No, thank you  ... I am just thirsty. Oh by the way - I can understand Bangla but can't speak fluently."
সৌমাভ একটা সোডা মেয়েটার হাতে ধরায় -" Can you show me the place inside the airport lounge - where you and mom had been sitting?"
মেয়েটি ঘাড় নাড়ে | লেডি অফিসার হাত নেড়ে গাড়ি ডাকেন | তিনজনে ২০ মিনিটে এয়ারপোর্ট এ পৌঁছন | অফিসারটি নিজের আই.ডি. দেখিয়ে ওদের নিয়ে ঢোকেন |
জায়গা টা একটু কোণের দিকে | হলুদ ক্রাইম সিন্ টেপ দিয়ে ঘেরা |
মেয়েটি ফুঁপিয়ে ওঠে - "We were sitting together on that sofa - mom said waiting for transit would take 5 hours. She was feeling a bit tired - wanted to take some rest - closed her eyes. i got up and started to walk around."
- "How long you had been out of her sight?"
-"I haven't checked closely - perhaps a couple of hours - or a bit more."
কথা বলতে বলতে সৌমাভ নজর ফেলছিলো  ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার দিকে | ডানদিকের
ক্যামেরা ঘুরে চলেছে , বাঁ দিকেরটা স্থির | সৌমাভ ইশারা করে লেডি অফিসারটির দিকে | তিনি টেবিল এ ল্যাপটপ রেখে সেলফোন এ কাউকে কিছু নির্দেশ দেন | একটু বাদেই পর্দায় পরপর দুটো ক্যামেরার ছবি ফুটে ওঠে |
মা কে সোফায় শুয়ে থাকতে দেখা যায় | মেয়েটি হেঁটে বেড়িয়ে যাচ্ছে | কোনো নতুন চেহারা নেই | সৌমাভ বলে একটু ফাস্ট ফরওয়ার্ড করতে ।ঘুমের মধ্যেই কার্ডিয়াক আরেস্ট  হয়ে থাকলে দেখার কিছু নেই |
দেড় ঘন্টার মাথায় ফ্রেম এ কিছু পরিবর্তন দেখা যায় |
হিজাব  পরা একটি স্থানীয় মেয়ের আগমন ঘটে | হাতে একটা ট্রে তে দুটি পেপার  কাপ এ কফি - এক্সট্রা লার্জ |  অন্য হাতে ফোন | সৌমাভ জুম করতে বলে - পাশ থেকে বাচ্চা মেয়েটি আঁতকে ওঠে - "MOM !!"
ঠিক | হিজাব পরা মেয়েটির হাতের ফোন এ মৃত মহিলাটির ছবি ।আইফেল টাওয়ার এর সামনে তোলা |
মেয়েটি খুব ভালো করে মিলিয়ে নিতে থাকে ছবি ও বাস্তবের মুখ |
নিশ্চিন্ত হয়ে কাউকে ফোন করে | ইতিবাচক ঘাড় নেড়ে ফোন পকেটে ঢোকায় | পাশের সোফায় বসে ।হাতে ধরা গরম কফি ছলকে পড়ে ঘুমন্ত মহিলাটির গায়ে | তিনি চমকে চেঁচিয়ে উঠে
বসেন | স্থানীয় মেয়েটি বারবার ক্ষমা চাইতে থাকে - এমন কি হাঁটু গেড়ে বসে ও পড়ে |
কথা তো কিছু শোনা যাচ্ছে না | নিজের হিজাব খুলে মুছে নিতে থাকে মহিলার গায়ে পরা কফি | মহিলা ধীরে ধীরে শান্ত হন | মেয়েটি একটা কাপ বাড়িয়ে ধরে করুণ মুখ করে - মহিলাটি একটু হেসে কাপটা নিয়ে মেয়েটিকে বসতে বলেন |
দুজনে কথা বলতে বলতে কফি খেতে থাকে |
একটু পরে স্থানীয় মেয়েটি কারো ফোন ধরে ।মহিলা কে একটা আঙ্গুল দেখিয়ে ক্যামেরা
ফ্রেম -এর বাইরে চলে যায় | মহিলা কফি শেষ করে নিজের ফোন বার করেন | কারো সাথে দু একটা কথা বলে ফোন ব্যাগ এ রাখেন |

ধীরে ধীরে ওনার মাথা একপাশে ঝুলে পড়তে থাকে - সোফায় কাত হয়ে শুয়ে পড়েন |
ফ্রেম  এ একটি অল্পবয়েসী আফ্রিকান ছেলে আসে | সে ও ফোন এ মহিলার ফটো মিলিয়ে নিয়ে ফোন পকেট এ রাখে | তারপর ধীরে সুস্থে কফির কাপ ও ট্রে তুলে বাইরে বেড়িয়ে যায় |
এরপর একেবারে মহিলাটির নিজের মেয়ের প্রবেশ । মা কে ডাকতে থাকে । দৌড়ে বেড়িয়ে যায় - কিছু অফিসিয়াল লোকদের নিয়ে ঢোকে |
সৌমাভ ল্যাপটপ পজ করে | পাশে বাচ্চা মেয়েটি রীতিমতো কাঁদছে | তাকে বাঁ হাতে শক্ত করে ধরে থাকে | লেডি অফিসারটির সাথে কথা বলতে থাকে ।ওই স্থানীয় মেয়েটি আর আফ্রিকান ছেলেটিকে খুঁজে বার করারব্যাপারে | কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ কাজ | তবে অসম্ভব নয় - দরকারে ইন্টারপোল এর সাহায্য নেয়া যেতে পারে |
বাচ্চা মেয়েটির কান্নার মধ্যে বলা কিছু কথা কানে যেতে ওকে ঘুরে আরেকটা সোফায় বসায় |
টুকরো কথা জোড়া দিয়ে দিয়ে ইতিহাস তৈরী হয় |
ওর মায়ের কোনোদিন বিয়েই হয়নি | বাবা কি জিনিষ ও দেখেনি | ছোট থেকেই বিদেশে মায়ের সাথে থেকেছে    ।কলকাতায় দাদু, দিদা আর এক মামা ছিল | এখন শুধু মামা | প্যারিস এ একজন বাঙালির সাথে মায়ের আলাপ হয় ।তিনি ওদের সাথে বাড়িতে গিয়েও থাকেন | বেশ কয়েকবার গেছেন | মা খুব আনন্দ পেতেন ।প্রচুর জিনিষ কিনে দিতেন | এবার ও এক সুটকেস ভর্তি জিনিষ নিয়েছেন |
ওকে জিজ্ঞেস   করেছেন ওই লোকটিকে বাবা বলে যদি ও মানে ।তবে কলকাতায় গিয়েই বিয়ে করবেন |মেয়েটির কোনো আপত্তি ছিল না ।সে তো প্যারিস এ গিয়ে আর্ট নিয়ে পড়বে ঠিক
করেছে |
সৌমাভ ওকে লোকটির নাম ও নাম্বার জিজ্ঞেস করে | মেয়েটি নিজের ফোন খুলে দেখায় | অতি সাধারণ দেখতে একটি মধ্য বয়েসী লোক |
একটু ভেবে নিয়ে ডাটা ট্রান্সফার করে লালবাজারে  ওর একজন জুনিয়র অফিসার এর ফোন এ | কমিশনার কে জিজ্ঞেস করে যে কফিন আর বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে রিটার্ন ফ্লাইট ধরবে কি না |
কেসটা প্রবাবেল হোমিসাইড শুনে আর সাস্পেক্ট কলকাতার বাসিন্দা জেনে কমিশনার সৌমাভকে ফিরে আসতে বলেন | দুবাই পুলিশ নিজের কাজ করুক |
সৌমাভ ফ্লাইট এ মেয়েটির কাছ থেকে আরো কিছু খবর পায় | কলকাতায় নেমে মেয়েটি কে মামার হাতে তুলে দিয়ে অনুমতি চায় মহিলার দেহ ও জিনিসপত্র । বিশেষ করে ফোন গুলি ফরেনসিক আর সাইবার পরীক্ষা করানোর জন্যে লালবাজার এ নিয়ে যাবার |
মামা মানুষটি গোবেচারা | ঘাড় নেড়ে কাগজ পত্র সই করে দেন | লালবাজারের একজন
অফিসার  মামা ও মেয়েটিকে নিয়ে তাদের বাড়ির দিকে যায় ।সৌমাভ তার দলকে কফিন আর জিনিসপত্র ভ্যান এ তুলতে বলে | নিজের জিপসি গাড়ির চাবি নিয়ে  এগোয় অফিস এর দিকে |
এক সপ্তাহ লাগলো সব কাজ শেষ করতে | ফাইল নিয়ে সৌমাভ কমিশনার এর কাছে যায় |
কমিশনার সব যুক্তি শোনেন | কিছু প্রশ্ন করেন | সেক্রেটারি কে ডেকে নির্দেশ দেন গ্রেফতারি
পরোয়ানা তৈরী করতে |
পরের দিন সকাল ৬ টায়ে একটা ভ্যান সঙ্গে নিয়ে সৌমাভ সেই লোকটাকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে আসে লালবাজারে |
সে ভাবতেই পারেনি তার ফোনরেকর্ডস , ব্যাঙ্ক ডিটেলস , ২০ বছর আগেকার বিয়ের সার্টিফিকেট ,  মহিলার ফোন আর ফেসবুক রেকর্ডস ,  সব মজুদ থাকবে সৌমাভর টেবিলে | বাঁ দিকে একটা বড় কাঁচের জার এ কোনো শরীরের
ভেতরের অংশ তরলে ভাসছে |
ঘরে ঢুকেই সেটার দিকে আঙ্গুল তোলে সৌমাভ - " এটা ওই মহিলার পাকস্থলী | ভিসেরা টেস্ট রিপোর্ট বলছে হজম না হওয়া স্যান্ডউইচ / কফি - সঙ্গে অতিরিক্ত সুগার ও  প্রেসার কমাবার ওষুধ আর ঘুমের ওষুধ | কেনা হয়েছে আপনার মায়ের নামে প্রেসক্রিপশন এ | ও হ্যাঁ ,এটা দুবাই পুলিশ এর ফ্যাক্স । ওই দুজন মেয়ে আর ছেলে ও ধরা পড়েছে - ফোন ও ব্যাঙ্ক ডিটেলস সহ |"
লোকটা হড়হড় করে বমি করে ফেললো - পাশ থেকে ধরে না রাখলে পড়েই যেত |
কমিশনার নিজের ঘরে বসে হেসেই ফেললেন সিসিটিভি দেখে | জার এ পাকস্থলী রাখার আইডিয়া টা দুর্দান্ত | লোকটা হুড়মুড় করে কনফেস করতে লাগলো |
অবিবাহিত ও সন্তানের জননী কে ঘরণী করার কোনো বাসনাই তার কোনোদিন ছিল না |
কলকাতায় তার ইলেকট্রনিক্স এর দোকান, জমিবাড়ির দালালি, বাড়ি, গাড়ি, বৌ, বাচ্চা সবই আছে | বাইরে যেত । ওই মহিলাটির সাথে আলাপ হওয়ার পর থাকা খাওয়ার খরচ বেঁচে যায় | উপরন্তু প্রচুর উপহার পেতো - যা দেশে  বেশি দামে বেচে দিতো | বিয়ে করবো ভাবটা জারি রাখতো - যাতে একটু একটু করে মহিলাটির টাকা পয়সা ও সম্পত্তি হস্তগত করতে পারে |
এইবার যে মহিলা  ১০বছর পর কলকাতা ফিরে বিয়ে করবেই প্রতিজ্ঞা করে বসবেন - সেটা ওর হিসেবের বাইরে ছিল |
শহরে পৌঁছে গেলে গায়েব করা শক্ত হতো | দুবাই এর লোক কে সুপারি দিয়েছিলো কফি দিতে আর কাপ সরিয়ে ফেলতে ।সরাসরি খুন করাও হলো না | ওষুধ গুলি পেট এ গিয়ে প্রথমে ঘুম এসে গিয়েছিলো ।তারপর হার্ট এট্যাক |
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায় সৌমাভ | ফাইল আর পেন ধরায় সই করার  জন্যে | ফোন তুলে নির্দেশ পাঠায় লক আপ  এ  ভরার  আর চার্জশীট তৈরী করার উদ্দেশ্যে |


গল্প : গৌতম দে




পরী

আমার নাম ধীমান চ্যাটার্জি। লিপি দুলের প্রেমিক।
আমি লিপি দুলে। ধীমান চ্যাটার্জির প্রেমিকা।
অনেকটা বাঁধা আর শক্তি যেন দুটো ডাম্বেল হয়ে প্রতিনিয়ত আঘাত করছে আমাদের। আজ দুহাজার আঠেরোর পনেরো আগস্ট। একটা সিদ্ধান্তে এসেছি। আমরা দুজনে। এই সিদ্ধান্তটা আমাদের একেবারে নিজস্ব। দুজনের সম্মতিক্রমে...।



এসো, কাছে এসো। একদম ঘন হয়ে কাছে বসো। আমার এই কথায় লিপি খুব খুশি হয়। সে অনেকটা আবেগ নিয়ে আমার খুব কাছে সরে আসে। একেবারে কোলের কাছে। আমাকে ভীষণ বিশ্বাস করে লিপি। ভালোবাসে। খুব খুব ভালোবাসে।

লিপির সঙ্গে প্রেম করছি বছর পাঁচেক। এখনও চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের যেন কথার শেষ নেই। কোনও বিরাম নেই। এ পাড়ার প্রতিটা মানুষ, প্রতিটা গাছ, প্রতিটা পাখি জানে আমাদের প্রেমকাহিনী। কিন্তু আমাদের বাড়ির মানুষজন আমাদের প্রেম মেনে নিতে পারেনি। মেনে নিতে পারেনি বলে পাড়ার অনেকেই 'লায়লা-মজনু' নামে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে। তাতে আমাদের কিসসু যায় আসে না। 

আমি যেমন লিপিকে ভাবোবাসি সেও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। 'আমাকে ছাড়া সে একদন্ড কাউকে ভাবতে পারে না।'  সে বুক চিতিয়ে বলেও এই কথা।

আমি মাঝেমধ্যে ওর এই কথায় হেসে উঠি। বলে কি অষ্টাদশী মেয়েটি!

আমি যত  হাসি ও তত রেগে যায়। ভীষণ রেগে যায়। তারপর চিৎকার করে বলে, আমি, কি এমন হাসির কথা বললাম। বলো? 
আমি এর কোনও উত্তর দিই না। কেবল হাসতেই থাকি। হো হো হি হি। হাসতে হাসতে আমার শরীরটা ছড়িয়ে পড়ে চাদ্দিকে। মাথাটা ফুটবলের মতো গড়াতে গড়াতে চলে যায় রেল লাইন বরাবর। দুটো হাত টপাটপ এ গাছের কিংবা ও গাছের ডাল ধরে ঝুলতে থাকে। দুপায়ে ভয়ংকর গতি নিয়ে একছুটে চলে যাই অজানা জায়গায়। অনেকটা স্বপ্নের জগতে। সেখানে লিপিকে পরীর মতো দেখতে পাই। সাদা পোশাকের সুন্দর পরিপাটি সাজ। পরীর পিঠে সুন্দর দুটো ডানা। সেই সুন্দর ডানা নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে এখানে সেখানে। গাছে গাছে রং বেরঙের ফুল ফল। কত নাম না জানা নানা রঙের পাখি। পরীকে চেনে। তার সঙ্গে খেলা করে। আকাশের রং ঘন নীলে ডোবা। গর্বিত মেঘগুলো নিজেদের শরীর ভাঙতে ভাঙতে দিকশূন্যপুরে এগিয়ে যাচ্ছে। লিপিও সেই মেঘেদের সঙ্গে খেলতে খেলতে আমার দৃষ্টির বাইরে হারিয়ে যাচ্ছে। সেই হারিয়ে যাওয়াতে যেন ক্লান্তি নেই। কেবল আনন্দ আর আনন্দ। 
আমি আঁতকে উঠি। আমি 'লিপি লিপি' করে চেঁচিয়ে ডাকি। এটা ঠিক, লিপি দু'হাত বাড়িয়ে সাড়া দেয়। সেও ডাকে। বলে, এসো আমাকে ধরো তো দেখি। লিপি খিলখিল করে হাসতে হাসতে অনায়াসে এই কথাগুলো বলে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। লিপির পিছন পিছন বেপরোয়া ভাবে  ছুটতে থাকি। লিপি নামক পরীর নাগাল পাই না তবুও। 
আবার ফিরেও আসি। এইসব লিপি বুঝতে পারে না। কেবল আমার শরীরটা ওর কোলের কাছে প্রাণহীন একখন্ড পাথরের মতো পড়ে থাকে।

আসলে ওর রাগটা আমার ভীষণ ভালো লাগে। রাগলে পরে ওর ঠোঁটজোড়া থরথর করে কাঁপে। তখন আমার মনে হয়, ওর পাকা করমচার মতো ঠোঁটজোড়া এখুনি বুঝি মুখ থেকে খসে পড়বে মাটিতে! এই ঠোঁট দিয়ে সে অনেকবার আমাকে চুমু খেয়েছে। আদর করেছে। ওর ঠোটজোড়ায় অনেক রস আছে। মিষ্টি রস। ঠিক মিষ্টি রস নয়। অনেকটা ঝাঁঝাল। নেশা ধরিয়ে দেওয়ার মতো। আমিও মাঝে মধ্যে ওর ঠোঁটে  ঠোঁট ডুবিয়ে ওর জিবের অনেকটা নাগাল পেয়ে যেতাম। তাতে ও খুব খুশি হত।

তো সেই পাকা করমচার মতো ঠোটজোড়া যদি  খসে পড়ে তখন এই লিপিকে দেখতে কেমন লাগবে? লিপির ঝকঝকে দাঁতের পাটিজোড়া ভয়ানক ভাবে বেরিয়ে আসবে। এই অনিন্দ সুন্দর মুখটা দেখতে খারাপ লাগবে তখন। তার চেয়ে বরং  দু'হাতের তালু নৌকোর কোল করে ওর ঠোঁটের তলায় মেলে ধরি আমি। যদি পড়ে যায়, আমার হাতেই পড়বে। এখনও কাঁপছে। ভয়ানক ভাবে কাঁপছে লিপির ঠোঁটজোড়া।

আমার হাসিটা আসতে আসতে পেটের ভিতর ঢুকে যায়। ঢুকতে ঢুকতে শরীরের অনেক নীচে নেমে যায়। তারপর  মাথাটা ওর ঘাড়ের কাছে নিয়ে যাই। ও দুহাতে জড়িয়ে ধরে আমায়। আমার ঠোঁটজোড়া ওর ঘাড় স্পর্শ করে। আমার দুই ঠোঁট ওকে খুব আদর করে। আদর করতে করতে ডান কানের লতিতে কামড় বসায়। আমি বুঝতে পারি, ওর ঠোঁটের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীর কাঁপছে। এবার আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। 

লিপি আমার হাতে তুলে দেয় ওর যত্নে রাখা স্তনজোড়া। আমি যেন জাগলারির মাস্টার হয়ে উঠি মুহূর্তে। দু'হাতে ওর দুই স্তন নিয়ে খেলতে থাকি। স্পষ্ট দেখতে পাই প্রতি মুহূর্তে ওর দুই স্তন জায়গা পরিবর্তন করছে আশ্চর্যজনক ভাবে। 

আগেও বলেছি। আবার বলছি, লিপি আমাকে বিশ্বাস করে। ভালোবাসে।

ভালোবাসতে বাসতে আমরা দুজন মাখনের মতো গলতে থাকি। গলতে  গলতে একেবারে গাছের শিকড়ে গিয়ে পৌঁছে যাই।

এই বৃদ্ধ বটগাছটা সব জানে। ওর কোলেই আমাদের বহু বছরের আশ্রয়। সব জানে আমাদের কথা। বড় বড় শিকড়ের ফাঁকে অনায়াসে ঢুকে যায় আমাদের শরীর। আমরা ক্ষণিকের শীতল আশ্রয় পেয়ে আপ্লুত হয়ে উঠি। তখন এই নির্জন জায়গাটা মনে হয়, আরও নির্জন। আশপাশে আমাদের মতো একটিও প্রাণী  নেই। আমাদের কান্ড কারখানা একমাত্র এই প্রবীণ বটগাছ জানে। আমাদের ছেলেমানুষী দেখে পাতায় পাতায় হাততালির শব্দ বেজে ওঠে। আমরা স্পষ্ট শুনতে পাই।
আমাদের গলতে থাকা শরীরের ভিতর থেকে একটা পাখি তীব্র চিৎকারে ডাকে। শেষবারের মতো এই ডাক বোধহয়। সেই ডাক আমাদের দুজনার শরীরে দুলতে থাকে। ঘন ঘন। পরস্পরের নিঃশ্বাসে ধূপের সুগন্ধি ভাসে। ভাসতে থাকে।  আমাদের শরীর গলতে গলতে গড়াতে গড়াতে রেল লাইনের বরাবর চলে যায়। আর কয়েক মিনিটের মধ্যে একটা এক্সপ্রেস ট্রেন যমদূতের মতো ছুটে আসবে। 

শেষবারের মতো আমরা দুজনায় দুজনকে দেখতে থাকি। দেখি লিপি সত্যি সত্যি একটু একটু করে পরী হয়ে যাচ্ছে। অথচ নীলে ডোবা চেনা আকাশটা আজ উধাও। সাদা মেঘের পরতে পরতে কি ভীষণ রক্তের দাগ। হঠাৎ তীব্র গতিতে ভয়ংকর হুইসেল বাজাতে বাজাতে ঝড়ের মতো ট্রেনটা ছুটে আসে আমাদের মধ্যে। দিশাহীন আমি লিপিকে দেখতে পাই না। লিপিও আমাকে দেখতে পায় না।

ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর আমরা দুজন দুজনকে নতুনভাবে দেখি। তারপর বাঁচার আনন্দে পাগলের মতো হেসে উঠি। 

Tuesday, January 1

গল্প : অন্বেষা চক্রবর্তী







দাঙ্গা


হিন্দু মুসলমান মিলিয়ে ১০০ লোকের বাস এ গ্রামে। স্বাধীনতার প্রাগমুহুর্তে উত্তাল চারিদিক।

ফজরের নামাজ শেষে বাড়ির দাওয়াই মুড়ি নিয়ে বসে সামসুল। গ্রামের রফিক খাঁর ছেলে সে। সেই যেবার সামসুল ১০ ক্লাসের পরীক্ষা দেবে, সেবারই এক দুর্ঘটনায় এক পা হারায় রফিক। আর পড়াশোনা হয়নি রফিকের, বাপের জমি এখন সেই দেখাশোনা করে।

দাওয়াই খেতে খেতে সামসুল হাঁক ছাড়ে আম্মিকে খাবার বেঁধে দেওয়ার জন্য।

" আইস্যি রে বাপ, ঠাহর দেহি"।
একখান গামছা তে বাটি করে ভাত তরকারি বেঁধে আনে আম্মি," সাবধানে যাস্ বাপ, বাইরের অবস্থা কিছু ভালো বুঝি না"।


"তুই শুধু শুধু চিন্তা করস্ আম্মি"-।
খাবারটা আর ঠোঙায় কিছু ফুল নিয়ে বেড়িয়ে পরে সামসুল। তাড়াতাড়ি পা চালায় সে।

তারজন্য অপেক্ষা করে আছে লক্ষী। ফুলটা নাটমন্দিরে দিয়ে সে যাবে লক্ষীর কাছে।

 রমেন মুদীর মেয়ে লক্ষী। এক কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিন জন্মেছিল বলে বাপে নাম রেখেছিলে লক্ষী।জন্মের সময় মা মারা যাওয়ায় বড়ই বাপসোহাগী সে।

ধানের ফলন ভালো হওয়ায় হাতে কিছু টাকার আশা করা যায়। লক্ষী কে এবার একটা দেশি তাঁতে বোনা শাড়ি কিনে দেওয়ার খুব ইচ্ছে সামসুলের। এই মন্দার বাজারে হাটের দুপয়সার কাঁচের চুড়ি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি সে।

মন্দিরের সামনে এসে ফুলটা রাখতেই দেখতে পায় দূরে কদম  গাছের নিচে লাল ডুরে পাড়ের শাড়ি জড়িয়ে তারি অপেক্ষায় লক্ষী। খুব সুন্দরী না হলেও বড্ড মায়া জড়ানো মুখ  মেয়েটার। অভিমানের সুরে বলল " সেই কহন বাপ থেইক্কা তোমার লগে ঠাঁই দাঁড়াই আইস্যি মানা করস্যে বেড়াইতে, তাও চুপিচুপি আইসি"।

'ভয় কি? আমি খাকইত্যে তোর কোন বিপদ নায়" ----সামসুল সাহস যোগায়। মুচকি হেসে মাথা নামায় লক্ষী, আর এই হাসি টুকুই সারাদিনের কাজের রসদ যোগায় সামসুলকে।

পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে। খবর ছড়িয়ে পরে মুসলমানদের জন্যই শুধু আলাদা দেশ হবে, তাতে কোনও হিন্দুর জায়গা হবে না। যে নাট মন্দিরে পূজার সময় হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ভোগ খেত, তা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। যে চাচাদের বাড়িতে সিমাই হলেই ডাক পড়ত মালতি , চিত্রাদের, সেই চাচাদের রক্তচক্ষু আজ বড় অচেনা লাগে। হিন্দুর জোয়ান ছেলেদের প্রায়ই লাশ পাওয়া যায় বড় রাস্তায়। ঘাত প্রতিঘাতে প্রাণ যায় নিরীহ মানুষের। আর এতকিছুর পরও যারা জোর করে থেকে গেছে, তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, শুরু হয় অকথ্য অত্যাচার।

আগুন লাগে লক্ষীদের বাড়িতেও। বাপ সেই যে শহরে গেল মাল আনতে আর ফেরেনি। রাতের অন্ধকারে সামসুলের হাত ধরে পালায় লক্ষী। অনেক দিন নানা বনে জমির ক্ষেতে লুকিয়ে বেড়িয়েছে ওরা। কাল ভোর ভোর সামসুল ওকে পৌঁছে দেবে রিফিউজি ক্যাম্পে।

এক গাছের তলায় বসে দুজন, জলের ধারা শুকিয়ে দাগ পরে গেছে শুকনো মুখে। খাবার ও তেমন পায়নি। " কথা দিইছিলাম্ পরাণ থাকতে তোর ক্ষতি হবে না"-- সামসুল বলে।

" তবে কি আর আমাগো দেইখ্যা হবে না?"- অসহায় লক্ষ্মী জানতে চায়। "

' হবে রে, এই অশান্তি একটু কইম্যা গ্যালেই আবার সব ঠিক হইয়া যাইবো"- আশ্বাস দেয় সামসুল।


ভোর ভোর লক্ষী কে রিফিউজি ক্যাম্পে রেখে ফেরার পথে রওনা দেয় সামসুল। লক্ষী দূর থেকে শুধু  দেখেছিল ওর চলে যাওয়া।



আজ আরেক লক্ষী পুজো। আকাশের চাঁদ সেরকমই বড়। লক্ষী জায়গা পেয়েছে কলকাতা শহরে এক ঘুপচি রিফিউজি ক্যাম্পে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন থেকে এ নাকি তার দেশ।

তবে সেটা কী ছিল? তার বড় হয়ে ওঠার জায়গা, তার কদম গাছ, কাজলী নদী, তার সামসুল.......


বাপ বলেছিল এই পূর্ণিমায় তার জন্ম, আজো লক্ষী অপেক্ষা করে সামসুলের , সে আসবে তাকে নিয়ে যাবে। তার সামসুল কখনো কথার খেলাপ করে না। সে আসবে।





গল্প : সায়ন্তনী বসু চৌধুরী

                     


এপার-ওপার    
                         
বিকেলের আলো নিবে এলে এ পাড়াটা কেমন যেন মৃত্যুপুরী হয়ে যায়। আস্ত আস্ত বাড়ীগুলো যেন গিলে খেতে আসে। ল্যাম্পপোস্টগুলোর নীচে কী প্রকাণ্ড এক একটা ছায়া পড়ে! মাঝে মাঝে মনে হয় বুঝি কোনো বিশালাকার দৈত্যের দেহাবয়ব। চিরটাকাল বড়ো রাস্তার ধারে উজ্জ্বল নিয়নের আলোর নীচে থেকে এসে  এই নির্জন এলাকায় বৈশালীর কিছুতেই মন বসে না। অথচ সে নিজেই একসময় ভিড় আর আলো থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলো। আগে ওরা যে পাড়ায় থাকতো সেখানে রাত বলে কিছু ছিলোনা। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী দুপুর বিকেল আর গোধূলিবেলা পেরিয়ে অন্ধকার নেমে এলেও গোটা দিন একইরকম কোলাহল। রাত দুটো আড়াইটের সময়েও গাড়ীর হর্নের তীব্র আওয়াজে ঘুম ভেঙে যেতো। কতো রাত যে ও পাখিকে কাঁধে ফেলে জেগে কাটিয়েছে তার কোনো সঠিক হিসেব নেই।

বৈশালীর মেয়ে পাখি এখন ক্লাস টু তে পড়ে। সক্কাল সক্কাল নেচার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের হলদে রঙের বাস এসে তাকে নিয়ে যায়। গাবলু গুবলু বাচ্চাটা দুইদিকে পনিটেইল বেঁধে টা টা করে। তারপর বাসে উঠে মেরুন রঙের ইউনিফর্মের ভিড়ে হারিয়ে যায়। নামকরা স্কুল। ভারী সিলেবাস আর ইঁদুর দৌড়ের চাপে একরত্তি বাচ্চাগুলোর চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবার জোগাড়। তাই বোধহয় ওদের কারও মুখে হাসি থাকে না। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে মেয়ে আর বরের জন্য টিফিন রাঁধে বৈশালী। লুচি, পরোটা, ম্যাকারনি, পাস্তা, ম্যাগি...। এক সময় সে নিজেও কর্পোরেট সেক্টরে ছিলো। অফিস যাবার তাড়া, বাস ধরার তাড়া, সমীরণের সঙ্গে লুকিয়ে প্রেম করার সময় বের করা ... সব মিলিয়ে জীবনটা তখন কী যে দারুণ গতিময় ছিলো, ভাবলেও বৈশালী অবাক হয়। আর এখন? রজত আর পাখি বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলে বৈশালী এক্কেবারে একা। গোটা বাড়ীটায় কী যে ভীষণ নিঃসঙ্গতা! প্রতিটা দেওয়াল, প্রতিটা কার্নিশ জুড়ে একাকীত্ব। দম আটকে আসে ওর।
সমীরণ খুব সাধারণ একটা চাকরী করতো। খুব সাধারণ। মাত্র বারো হাজার টাকা স্যালারি। দুহাজার সাতে সালে সদ্য স্নাতক বৈশালীর মনে হয়েছিলো ওটাই অনেক। মাত্র দুজনের সংসার। বারো হাজারে চলবে না? কতো আর খরচা হবে একটা মাস চালাতে? বিরাট বড়ো বাড়ী দামী গাড়ী এসব তো বৈশালী চায় না।

সমীরণ আর ওর একটা ছোট্ট সংসার হবে। আর ওদের একটি ফুটফুটে সন্তান হবে। এই তো বৈশালীর স্বপ্ন। পাখি নামটা সমীরণেরই দেওয়া। ওরা যখন ভবিষ্যতের দিনগুলো সাজাতো, তখনই ভেবে রেখেছিলো সমীরণ। মেয়ে হলে পাখি আর ছেলে হলে পলাশ। মুম্বইয়ের সবচেয়ে নামকরা হাসপাতালে মেয়েকে যখন প্রথমবার  ছুঁয়েছিলো বৈশালী সেদিন পাখি নামটা ছাড়া ওর মুখ থেকে আর কিচ্ছু বেরোয়নি। রজতেরও খুব পছন্দ হয়েছিলো নামটা। সমীরণকে সেদিন ঠিক কতোখানি মিস করেছে, বৈশালী বলতে পারবেনা।

ছয়তলার ওপরে ঝুলন্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে বৈশালী নিজের ঘরের দিকে ফিরে চায়। গত ছ বছরে রজত ওর কোনো ইচ্ছেতে বাধা দেয়নি। যেমন ফ্ল্যাট চেয়েছিলো বৈশালী, ঠিক তেমনটাই কিনেছে রজত। রজত নিজের ক্ষমতার অতিরিক্ত করেছে শুধুমাত্র বৈশালীকে খুশী করার জন্য। আগে ওরা হাইওয়ের ধারে একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতো। বৈশালী থাকতে চায়নি বলেই রজত শহর ছাড়িয়ে এতোটা ভেতরে ফ্ল্যাট কিনেছে। রজতের ভালো চাকরী। বেশ নামকরা কোম্পানির ইঞ্জিনিয়র ও। রজতরা বৈশালীর পিসতুতো দিদির শ্বশুরবাড়ীর তরফের আত্মীয়। পিসতুতো দিদির কল্যাণেই বৈশালীর সঙ্গে রজতের সম্বন্ধটা হয়েছিলো। তখন বৈশালী নিজে একটা চাকরী জুটিয়ে নিয়ে বাড়ীর সঙ্গে তুমুল লড়ছে। আসলে সমীরণের সঙ্গে বৈশালীর সম্পর্ক বাড়ীতে জানাজানি হতে তীব্র অশান্তি হয়েছিলো। বাবা, মা, দাদা কেউই রাজী হয়নি। সমীরণের রোজগারের অভাব মেটাতে বাড়ীর বিরুদ্ধে গিয়ে বৈশালী চাকরী করছিলো। সেসময় রজতের মতো একটা ভালো ছেলের সত্যিই বড্ড প্রয়োজন ছিলো। ভালো ছেলে মানে ভালো রোজগারের ছেলে। বাড়ীতে অকথ্য বকুনি খেয়ে বোকা বোকা মুখ করে প্রেমিকা বৈশালী সবাইকে বলেছিলো,
-বারো হাজারে দিব্যি সংসার চলে যাবে। আমি হিসেব করে দেখেছি। তাছাড়া আমার চাকরীটাও তো আছে।
দাদা চেঁচিয়ে উঠে প্রশ্ন করেছিলো,
-কতো পাস শুনি?

আসলে তখন প্রেমের ঘোরে বাস্তব বোধবুদ্ধি দিয়ে সবকিছু বিচার করার ক্ষমতা ছিলো না। আজ বৈশালী হাড়ে হাড়ে বোঝে সংসার চালাতে মাস গেলে পঞ্চাশ পঞ্চান্ন হাজারও কম পড়ে। মাঝে মাঝে একলা দুপুরগুলোতে সমীরণের কথা ওর খুব মনে পড়ে। রজতের ব্যস্ততায় বিরক্ত হয় বৈশালী। কিন্তু যখন ভাবে আজ যদি ও সমীরণের সঙ্গে হাওড়ার কোনো মধ্যবিত্ত পাড়ায় পড়ে থাকতো তাহলে হয়তো এমন মাখনের মতো নরম ত্বক এমন জেল্লাদার চেহারা থাকতো না, তখনই ওর ভেতরে একটা সাদা আর কালোর লড়াই শুরু হয়। সমীরণকে মনে রাখার মতো কোনো কারণ আছে কী না বৈশালী তা জানে না। তবুও সারাদিনের একাকীত্ব ওকে পুরনো কথাগুলো ভাবতে বাধ্য করে।

***
রবিবার করে পাখির আঁকার ক্লাস থাকে। মেয়েটা দারুণ ক্রিয়েটিভ। নিজের ঝোঁকেই গান, আঁকা, নাচ সবেতে ভর্তি হয়েছে। স্কুলের সব ফাংশনে তার পার্টিসিপেট করা চাই-ই-চাই। পাখিকে আঁকার স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে বৈশালী একা একা সময় কাটায়। বাড়ী আর রান্নাঘরের জন্য টুকটাক কেনাকাটা সেরে রাখে। অনেক সময় তিন চারদিনের আনাজের বাজারটাও হয়ে যায়। আজ ওর শরীর ভালো নেই। মডার্ন আর্ট অ্যান্ড ড্রয়িং ক্লাসের সোজাসুজি যে ছোট্ট কফিশপটা খুলেছে সেখানেই গুছিয়ে বসেছে বৈশালী। আজকাল রজতের সঙ্গে সময় কাটানো হয়ে ওঠে না আর। মেয়েটা যতো বড়ো হচ্ছে, ওদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে দূরত্বও যেনো বাড়ছে। তাছাড়া প্রায় সময়েই রবিবারও রজতের অফিস খোলা থাকে। বৈশালী আজকাল একাকীত্বে ভোগে। বছর চারেক আগেও সংসার থেকে লম্বা ছুটি নিয়ে ও বর্ধমানের বাড়ী চলে যেতো। তখন বাবা বেঁচে ছিলেন। বাড়ীটা আনন্দে জমজমাট থাকতো সারাদিন। কিন্তু এখন সে বাড়ীও শ্মশান। বাবা নেই, মায়ের একবার মেজর অ্যাটাক হয়ে গেছে। দাদা বৌদি আমেরিকা থেকে আসতে চায়না। বৈশালী একজন আয়া রেখে দিয়েছে মায়ের জন্য। দুঃখের অতলে ডুবে থাকতে আর ভালো লাগে না ওর। তাই এই পালিয়ে বাঁচা।

কফিশপের সামনে একটা ঝাঁ চকচকে চারচাকা এসে দাঁড়ালো। সাদা রঙের ব্লেজার পরা একজন মাঝবয়সী লোক আর সঙ্গে দুজন কমবয়সী ছেলে এসে চারটে চেয়ারওয়ালা একটা টেবিল নিলেন। বিকেল বেলার ব্যস্ত রাস্তা আর মানুষ দেখা ছাড়া বৈশালীর আজ কোনো কাজ নেই। হঠাৎ চেনা গানের দুটো লাইন বেজে উঠলো সামনে বসা ভদ্রলোকের মোবাইল ফোনে। এ গান বৈশালীর বহুবার শোনা। একটা সময় প্রতিটা শীতের দুপুর তার কাঁধে মাথা রেখে বৈশালী বারবার শুনত এই গান। গত দশ বছরে সমীরণকে ভুলতে চেয়েও আরও বেশী করে মনে করেছে বৈশালী। কিন্তু সমীরণ কি তাকে একবারও খুঁজেছে? একবারও কি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে বৈশালীর সঙ্গে?
-হ্যালো, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি মিটিং সেরে এইমাত্র একটু কফি খেতে এলাম। ফ্লাইটের ঢের দেরী আছে, চিন্তা কোরোনা। আমি মিস করবোনা।

বহুদূর থেকে চির পরিচিতের কণ্ঠস্বর শুনলে মানুষ যেমন নানা অনুভূতিতে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়, আজ প্রায় একযুগ পরে সমীরণের গলা শুনে বৈশালীও তেমনি অবাক হয়েছে। কিন্তু এ কী? এতো পরিবর্তন? সেই সদা হাস্যময় ছিপছিপে তরুণ আজ এমন গম্ভীর একটা মানুষ সেজে বৈশালীর এক্কেবারে কাছাকাছি এসে হাজির হলো? বছর দশেক আগে একটা অধ্যায় শেষ হয়ে যাবার সেই অন্ধকার দিনগুলো বৈশালীর মন থেকে একেবারে উবে গেলো যেনো। নিজেকে আটকাতে না পেরে পায়ে পায়ে বৈশালী টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো। সম্পর্ক নেই বলে একবার ডেকে কথা বলতেও কি নেই?
-সমীরণ তুমি?

কথাটা বলেই নিজেকে অতি সন্তর্পণে সামলে নিলো বৈশালী। আপনি কি মিস্টার সমীরণ মুখার্জী?
খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে ভদ্রলোক প্রথমে বৈশালীর মুখের দিকে তাকালেন। তারপর প্রায় মিনিট তিনেক ভেবে নিস্পৃহ গলায় উত্তর দিলেন,
-হ্যাঁ, আমিই সমীরণ মুখার্জী। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।

বৈশালীর নরম দুই গালে কেউ যেন কড়া হাতে দুটো চড় মারলো। চিনচিন করে উঠলো মনের মধ্যেটা। মুহূর্তের জন্য মনে হলো সমীরণ বদলা নিচ্ছে। একদিন আর্থিক অবস্থার দোহাই দিয়ে বৈশালীর বাবা দাদা ওকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো। আজ হয়তো বৈশালীকে অপমান করে সমীরণ সেই আগুনেই জল ঢালতে চাইছে। কিন্তু পরক্ষণেই একবুক অভিমান ওর গলা টিপে ধরলো। জীবনের সাড়ে চার বছর যে ছেলেটার সুখ দুঃখ আপন করে ও দিন কাটিয়েছে আজ তার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যান পেয়ে বৈশালীর নিজেকে বড়ো তুচ্ছ মনে হচ্ছে।

***
ড্রয়িং খাতা খুলে নানারকম আঁকিবুঁকি দেখিয়ে আপন মনে বকে চলেছে পাখি। মেয়ের কথার দিকে বৈশালীর মন নেই। সে শুধু রজতের কথা ভাবছে। সমীরণ নামক অতীতকে মনের কোণে লালন করে নিজের জীবন সঙ্গীর প্রতি ও তো সুবিচার করেনি। আজ বৈশালী সব গ্লানি মুক্ত হয়ে বাড়ীর পথে এগোচ্ছে। কারণ আজ সে জানে আমৃত্যু পাখি আর রজতকে আঁকড়ে তাকে এপারেই বাস করতে হবে। জীবন নদীর ওপারে আজ আর তার কেউ নেই। 

গল্প : সুজয় চক্রবর্তী





একটি প্রেমের গল্প

ব্যাচেলার থাকার এই এক সমস্যা।  সহজে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় না । সবাই-ই 'ফ্যামিলি' চায়!

আমার এখনও 'ফ্যামিলি' হয়নি । লাইনে আছি । কিন্তু সেই সময়টুকু দিলে তো ! যেখানেই ঘরের জন্য যাই, সেই এক কথা, 'ফ্যামিলি আছে তো? ', 'ও, আপনি ব্যাচেলর ! না  ভাই, অন্য কোথাও দেখুন।' একজন তো একবার বলেই দিলেন, ' ঘর তো ফাঁকা। বলেন তো, হাতে একটা মেয়ে আছে, দেখাতে পারি।' মানে আমাকে বিয়ে দিয়ে তবেই তিনি তার ঘরে ঢোকাবেন ! বিটকেলে পাবলিক সব । কিছুতেই বোঝাতে পারি না, আমার এখন বউ চাই না, ঘর চাই। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সবে মাত্র চাকরিটা পেয়েছি । বাড়ি থেকে বেশ দূরে। একটু গুছিয়েগাছিয়ে না নিয়ে এসবে নেই আমি ! সেকথা বাড়িতেও বলেছি । দুটো বছর সময় লাগবে আমার। কিন্তু বাড়ির লোকও সে কথা শুনলে তো!  বিশেষ করে মা। সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান। কোনওরকমে থামিয়ে রেখেছি। আর ঠিক করেছি, বছর দুই পরেও যদি বাসা ভাড়াই থাকি, তো ঐ লোকটাকে গিয়ে একদিন বলবো, ' এই দেখুন, ফ্যামিলি আছে । ঘর খালি আছে আপনার? '

যাইহোক, শেষে আমার মেজো মাসির দূর সম্পর্কের এক জামাইকে ধরেটরে অনেক খোঁজ-খবর করার পর জয়িতাদের এই বাড়িটাতে থিতু হয়েছি ।

আমি এ পাড়ায় নতুন । এক মাসও হয়নি। ধীরে ধীরে পরিচিত হচ্ছি আশপাশের লোকজনের সঙ্গে । অনেকের সঙ্গেই আলাপ এখনও বাকি । সামান্য যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাদের মধ্যে আছে সনাতনের বাবা, কীর্তনীয়া বিশু, সুমনের দিদিমা আর বিশালের মা ।
 অফিস যাওয়ার সময় একটা দৃশ্য আমি রোজ দেখি । জয়িতাদের বাড়ির পাশের ফাঁকা মাঠটাতে একটা বাচ্চা মেয়ে খেলছে। একা একাই । বয়স তিন কি চার হবে । কখনও কাদামাটি, কখনও ধুলোবালি নিয়ে ওর খেলা । কোনও ঝামেলা নেই। কান্নাকাটি নেই।

 একদিন অফিস যাওয়ার পথে ওর নামটাও জানতে পেরেছি । পামেলা। খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। খালি গা। সারা হাতপায়ে ধুলো। কিন্তু একগাল হাসি।
আমার নতুন চাকরি। বাড়ি থেকে  হাতে একটু সময় নিয়ে বেরোই । অনেকদিন অফিস থেকে ফেরার সময়েও ঐ একই ছবি দেখেছি । বাচ্চাটা একমনে খেলছে । কখনও পুতুলকে শাড়ি পড়াচ্ছে, কখনও হাড়িতে ভাত চাপিয়েছে ; এইরকম আর কি।

এরমধ্যেই পামেলা আমাকে বেশ চিনে ফেলেছে ৷ রাস্তায় দেখলেই জিজ্ঞাসা করে, ' কাকু, কুথায় যাচ্ছো? কখনও বাজারফেরত আমাকে দেখতে পেলে জানতে চায়, 'কী এনেছো ?' আবার কখনওসখনও আমিও ওর 'রান্না' করা খাবার মুখে দিয়ে বলি, 'বাঃ, হেব্বি হয়েছে !' ও খুব মজা পায়। কিন্তু প্রায়ই ও 'ডিমে'র ঝোল 'রান্না' করে। আর সেই গরম ডিমের ঝোল খেয়ে আমার যখন জিভে 'ছ্যাঁকা' লাগে, তখন যেন ওর হাসি আর ধরে না মুখে! মাঝেসাঝে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি  পামেলার মা'কে । কখনওসখনও চোখাচোখি হয়। ঐ পর্যন্তই।  কথা হয়নি কোনও দিনও। তবে আমি যে জয়িতাদের ভাড়াটে, সেটা জানে।

আজ যাওয়ার সময় দেখলাম পামেলা কাঁদছে! রান্নাবাটি খেলছিল। বোঝা গেল ওকে কেউ বকেছে । খুব খারাপ লাগলো । থেমে গেলাম ।
মুখ নামিয়ে বললাম , ‘ কি হয়েছে তোর, কাঁদছিস কেন ?’
---- মা মেরেছে।
---- নিশ্চয় তুই দুষ্টুমি করেছিস?
---- না, আমি কিছু করিনি...
---- তাহলে মা তোকে এমনি এমনি মারলো !
----- হ্যাঁ ।
---- আচ্ছা, দাঁড়া, তোর মা'কে আমি বকে দিচ্ছি।
কথাটা বলে নিচু হয়ে ওর চোখদুটো হাতের চেটো দিয়ে মুছে দিলাম।

খেয়াল করিনি । চোখ সরাতেই দেখলাম সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে পামেলার মা ! শিউলি।  সেদিন জেনেছি ওর নামটা।  জয়িতা কোন একটা ব্যাপারে 'শিউলি বৌদি' বলে কথা বলছিল।

তা, 'বৌদি' যখন, দাদা নিশ্চয় আছে। এর আগে এত কাছ থেকে ওকে কখনও দেখিনি। যেটুকু নজরে পড়লো, তাতে হাতে চুড়ি, মাথায় সিঁদুর কিছুই দেখলাম না। অবাক হইনি। এখন অনেকেই এসব পরে না। এরজন্য যুক্তিও আছে তাদের। আমার মাসতুতো বোনটা  এরকমই। ও প্রায়ই একটা কথা বলে,' কই, পুরুষরা তো বিয়ের পর কোনও চিহ্নই বয়ে বেরায় না, যার থেকে বোঝা যায় পুরুষটি বিবাহিত! তাহলে মেয়েরা কেন বয়ে বেড়াবে!' তাতো ঠিকই । একেবারেই বাস্তব । আমার ভালো লাগে ওর কথা। আমি সায় দিই।
শিউলির দিকে তাকাতে দেখলাম লজ্জামাখা একটা মুখ ৷ কিন্তু বেশ মোহময়ী। নিশ্চিত, পামেলার সঙ্গে আমার কথাবার্তা ও শুনেছে! ততক্ষণে আমিও কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছি । বকা তো দূর অস্ত। শিউলিকে দেখে মুখ দিয়ে কোনও কথাই আমার বেরোলো না!  আর বেরোবেই বা কি করে? তাকে বকার অধিকারই বা আমাকে কে দিয়েছে ? মাথা নিচু করেই ছিলাম। ঘড়িতে চোখটা পড়তেই পা চালালাম। শুধু আমার চাকরিটাই নতুন নয়, অফিসে বসও নতুন!
এরপর শিউলিকে দূর থেকে দেখলেই আমি মাথা নিচু করে ফেলতাম। লজ্জায়। লজ্জা পাবারই কথা। যার সঙ্গে তেমন কোনও পরিচয় নেই, সেই তাকেই কি না বকাঝকা! বুঝতে পারলাম সেদিন কথাটা বলে ঠিক করিনি। কথাটা যে জাস্ট বলার জন্যই বলা, তা শিউলিও জানে। তবু লজ্জাটা আমার একটু বেশিই। তাই মাথা হেঁট হয়ে যেত ওকে দেখলে। শেষ পর্যন্ত অফিস যাওয়া আসার রাস্তাটাই পালটে ফেললাম! এখন পামেলা বা শিউলি কারও সঙ্গেই আর দেখাটেখা হয় না।

পাড়ায় যাদের সঙ্গে দেখা হলে খুব সহজেই পাশ কাটাতে পারি না, তাদের মধ্যের একজন হল কীর্তনীয়া বিশু। ওর কথা বলার ধরন যে কাউকেই মুগ্ধ করে। রাস্তায় দেখা হলে কুশল সংবাদ ও  জিজ্ঞেস করবেই,  এই সৌজন্যবোধটা ওর আছে । কীর্তনীয়া বিশু এ পাড়ায় অনেক দিন আছে । দূর সম্পর্কের এক মামার বাড়িতে থাকে, খায়। এছাড়া নিজের আর কেউ নেই। রোজগার বলতে অন্য তল্লাটে গিয়ে  কীর্তন শুনিয়ে যা পায়। খুচরো পয়সা, চাল-ডাল। বিয়ে-থা হয়নি। আর জীবনে করবে বলেও মনে হয় না৷  পাড়ার প্রায় সব খবরই রাখে ও। দীপকের বউয়ের কবে বাচ্চা হবে, নন্দিতার বৌদি কেন বাপের বাড়ি চলে গেছে, টুম্পার বাবা কেন ওর দাদাকে মেরেছে, এমন হাজারটা ঘটনার কথা জানে ও ।

আজ শনিবার। অফিস ছুটি। খোকনের পান বিড়ির গুমটির সামনে বিশুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছিল । তাই হয়তো আজ আর বেরোয়নি । কথায় কথায় পামেলাদের কথা উঠলো। মানে, আমিই উঠালাম আর কি। জানতে পারলাম বিয়ের বছর খানেকের মাথায় না কি বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হল তরিতের। তড়িৎ মানে পামেলার বাবার। পামেলা তখন পেটে। ব্রেন ইনজুরি।  সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চললো ছ'মাস। প্রথম দিকে কিছুটা ভালোর দিকে ছিল তড়িৎ। শেষে ভুল চিকিৎসায় মারা গেল ! এরজন্য ডাক্তার ,নার্স দায়ী না । দায়ী নাকি শিউলিই ! 'অলক্ষ্মী' আসার পর থেকেই এক এক করে অনেকগুলো অঘটন ঘটেছে তাদের সংসারে। তাই শাশুড়ি মা যে আর কোনও অঘটন ঘটাতে চান না, সে কথা ঠারেঠোরে বুঝিয়েও দিয়েছেন। তবু মুখ বুঁজে ছিল শিউলি। কিন্তু যেদিন পামেলা হল, সেদিন হাসপাতাল থেকেই সে যাতে বাপের বাড়ি চলে যেতে পারে, তার সব বন্দোবস্ত পাকা করে রেখেছিলেন শাশুড়ি মা। সেই থেকে শিউলি আছে বাপের বাড়ি। আসলে গীতা দে'র মতো শাশুড়ি যার কপালে, তার সংসার জীবনে তো অনেক কষ্টই ভোগ করতে হবে! শিউলি ঝড়ে পড়লো অকালে ; মা-বাবার সংসারে। এখন সে বাধ্য হয়ে বিড়ির কুলো হাতে নিয়ে বসেছে।

শিউলির সম্পর্কে যেটুকু বললো বিশু, তাতে যেকোনও সংবেদনশীল মানুষেরই খারাপ লাগতে বাধ্য। আমারও লেগেছিল। আরও বিশেষ করে খারাপ লাগলো ওর সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বসে ছিলাম। একজন স্বামীহারা মহিলা কত কষ্ট সহ্য করে যে একটা বাচ্চাকে মানুষ করে তুলছে, তার প্রতি সহানুভূতি দেখানোর যে প্রয়োজন, সে বোধ আমার ছিল না। করুনা হয় নিজের ওপর।

আজ আবার বিশুর সঙ্গে দেখা বটতলায়। একথাসেকথায় বিশু যা বললো, আমি তো শুনে থ'। শিউলি নাকি আমাকে আর দেখা যায় না কেন, তা জিজ্ঞেস করেছে তার 'বিশুদা'কে । বিশুকে সে এও  বলেছে, তাকে না কি অনেক দিন কেউ বকেনি ! শুধু সান্ত্বনা দিয়ে গেছে সবাই। সে এখন চায়, তাকেও কেউ বকুক।

আজ বছর দশ পরেও বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, শিউলিকে এতটুকু বকিনি আমি!


              -----------------------