Tuesday, December 10

সুদীপ ঘোষালের গল্প : রক্ষাকবচ






সুদীপ ঘোষাল
রক্ষাকবচ


রাজু  বামুন পাড়ার ছেলে। পৈতে হয়েছে বৈশাখ মাসে। উপনয়নের পর উপবীত ধারণ করতে হয়। এই উপবীতের চলতি নাম পৈতে। পৈতে কথাটি সমাজে বহুপ্রচলিত।   বাহুতে গুরুদেব বেঁধে দিয়েছেন কবচ। রাজুদের বংশের গুরুদেব বলেছেন, সমস্ত বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবে এই কবচ আর পৈতে।  সব কাজে সফল হবে নিশ্চিতভাবে আর সারাজীবন রক্ষাকবচের মত আগলে রাখবে জীবন। 

 রাজু গরীব বামুনের ছেলে। দুবিঘে জমি, দুটো গরু আর গোটা দশেক ছাগল তাদের সম্পত্তি। রাজুর পৈতেটা একটু দেরী করেই হয়েছে। তার ফলে গুরুদেবের আদেশ অনুযায়ী  প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে তার ফর্দমত। তার ফলে খরচ অনেকটা বেড়ে গেছে।

  এখন তার বয়স উনিশ। বাবা মরে গেছেন অনেক আগেই। তার মা অই গুরুদেবের কথামত সংসার চালান। পুজো, উপবাসে মেতে থাকেন মা। আর গুরুদেবের ফলাহার রাজু তাকিয়ে দেখে। মা গুরুদেবের খাওয়ার শেষে তার উচ্ছিষ্ট খান। এটাই মায়ের গুরুর প্রসাদ। 

গুরুদেব মাঝে মাঝে রাতে রাজুদের বাড়িতে থাকেন। রাজু বোঝে সবকিছু কিন্তু চুপ করে থাকে। গুরুদেব মা কে বলেন, আমার কথামত চললে তোমাদের ভাল হবে। এই ভাল হওয়ার লোভে রাজুর মা গুরুদেবের সব কথা মেনে নেন। রাজুর মায়ের মিথ্যে রক্ষাকবচ হলেন গুরুদেব। এক অদৃশ্য দেওয়া নেওয়ার খেলা  তিনি খেলেন নিষ্ঠুর হৃদয়ে। 
রাজু সকালবেলা মাঠে যায়। সে বামুন হলেও লাঙল ধ'রে চাষ করে। ছোট থেকেই করে আসছে। বেশ গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা তার। সকলে বেশ সমীহ করে চলে তাকে। পড়াশুনা বেশিদূর গড়ায় নি। বাবা মরে যাওয়ার   পর থেকে সংসারের দায়ীত্ব তার উপরেই ন্যস্ত।

সকালে গরু ছাগল নিয়ে মাঠে যায়। হাতে পাঁচন গলায় গামছা। লুঙ্গি পরে আলের উপর বসে থাকে। গরু ছাগল পালিয়ে গেলে ডাকিয়ে নিয়ে আসে ঘাসের বনে। পরের ফসল খেলে লোকে ছাড়বে না। এ নিয়ে অনেকবার ঝগড়া হয়েছে রাজুর সঙ্গে জমির মালিকদের। একদিন রমেন মোড়ল লাঠি নিয়ে এসে বলল, তোর ছাগলে আমার জমির ফসল খেয়েছে। খবরদার বলছি আমি কিন্তু ছাড়ব না। এই লাঠি মেরে মাথা ফাটিয়ে দোব। রাজু বললো, বেশ কাকা আর হবে না এই ভুল। আমি নজর রাখব। সঙ্গে সঙ্গে মোড়ল নরম সুরে বলল, তোমরা হলে গিয়ে বামুনের ছেলে। বলতে খারাপ লাগে। বুঝলে তোমার বাবাকে আমি দাদা বলে ডাকতাম। রাজু বলল,মায়ের কাছে শুনেছি সব। তবে আপনার ফসলের ক্ষতি হলে তো রাগ হবেই। আমি এবার ভাল করে লক্ষ্য রাখব। মোড়ল বললেন, বেশ বাবা বেশ। বেঁচে থাক।

রাজু ভাবে ফসলের মাঠে গরু, ছাগল চড়ানো খুব কঠিন। কখন যে কার মাঠে নেমে যায় বোঝা মুস্কিল। সে ভাবল, কাল থেকে অই পাকা রাস্তার ধার ঘেঁষে বারেন্দা গ্রামের কাছাকাছি জঙ্গলে যাবে গরু চড়াতে। ওখানে ফসলের জমি নাই। নিশ্চিন্তে বসতে পারবে। মাকে বলে, জলখাবার সঙ্গে নিয়ে যাবে।
পরের দিন রাজুর মা সকাল থেকে আলুভেজে দিল আখের গুড় দিল আর এক জামবাটি ভরতি করে মুড়ি দিল।   রাজু গামছায় বেঁধে গরু, ছাগলের দড়ি খুলে পাঁচন হাতে চলে গেল জঙ্গলে। সেখানে গিয়ে দেখল ঘাস আছে পাতা আছে। আর ভিড় কম। পাশে ক্যানেলের পরিষ্কার জল। সেখানে মাছ ধরছে হাজরাদের একটা মেয়ে। রাজু ভাবল, কি সুন্দর দেখতে মেয়েটা। উবু হয়ে মাছ ধরছে। মেয়েটা রাজুকে দেখতে পায় নি। একটু পরে রাজু ডাকল, ও মেয়ে, তোর নাম শ্যামলী নয়?  শ্যামলী বলল, হুঁ।
----- তুই রোজ এখানে আসিস মাছ ধরতে?
--- হুঁ
--- আমাকে চিনিস?
---- হুঁ
আয় এখানে আয়। দুজনে মুড়ি খাই। তোর মাছ নেব না। আয়।

শ্যামলী হাত, পা ভাল করে ধুয়ে চলে এল রাজুর কাছে। রাজু গামছায় মুড়ি ঢেলে দিল। দুজনে গল্প করতে করতে খেল। তারপর দুপুর হলে দুজনে চলে এল নিজের বাড়ি।

রাজু গোয়ালে গরু বেঁধে, হাত পা ধুয়ে স্নান সেরে নিল। তারপর দরজার কাছে এসে দেখল দরজা বন্ধ। দরজায় একটা ফুটো আছে। চোখ লাগিয়ে দেখল, গুরুদেব মা কে নিজের উলঙ্গ দেহ দিয়ে ঢেকে ফেলেছে। মাকে দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি মাকে বশ করেছে কবচ পরিয়ে?  আমাকেও দিয়েছে কবচ। রাজুর রাগ হল। কিন্তু কোন আওয়াজ না করে চলে গেল গোয়ালে।
প্রায় কুড়ি মিনিট পরে রাজুর মা রাজুকে দেখতে গোয়ালে এল। রাজুর মা বলল, আমি তোকে না দেখে একটু শুয়েছিলাম। আজকে তোর দেরী হল কেন?  রাজু বলল, মা আমার খিদে পেয়েছে। খেতে দাও। আমি এখানে বসে খাব।

তারপর বর্ষা এল। নদী, পুকুর, খাল, বিল সব কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল। শুধু পূর্ণ হল না রাজুর মন। গুরুদেবের প্রতি ঘৃণায় তার মন খারাপ ছিল। কিন্তু এখনও সেই ঘটনা ঘটে চলেছে। রাজু জানে, মানুষের জীবনে কিছু ঘটনা মনের কোণে থেকে যায়। তার প্রতিকার হয় না কোনোদিন।

রাজু এবার চাষ করেছিল সময়ে। কিন্তু বন্যায় ধানের চারা ডুবে থাকল দশদিন। সব পচে গেল। পচে গেল সমস্ত কৃষকের আশা আকাঙ্খা সবকিছু। আর কদিন পরেই শরৎকালের দুর্গাপুজো। সবাই নতুন জামা, কাপড় কিনবে। কিন্তু এই গ্রামের লোকগুলো খালি গায়ে গামছা কাঁধে ঘুরবে। রাজু শ্যামলীকে এইসব কথা বলে। রাজু বলে, তোকে একটা শাড়ি দোব ভেবেছিলাম, কিন্তু কি করে দোব?
শ্যামলি বলে, দিতে হবে না গো। তুমি শুধু এমনি করে আমাকে জড়িয়ে থেক।
রাজু আর শ্যামলী দুজনে দুজনকে ভালবাসে। তারা বিয়ে করবে। কিন্তু বামুনের সঙ্গে হাজরা বা হাড়ি জাতের বিয়ে সমাজের সেনাপতিরা মেনে নেবে না। ওরা ঠিক করল, পালিয়ে গিয়ে ওরা বিয়ে করবে  পরে। ততদিনে রাজু ভাবে, একটু গুছিয়ে নেব নিজেকে। টাকা, পয়সা জমিয়ে রাখব। তারপর বিয়ে,সংসার।

প্রায় দুবছর পরে রাজু আর শ্যামলী ঠিক করল দুদিন পরে তারা শিবলুন স্টেশনে ট্রেন ধরবে। তারপর বহরমপুরে চলে যাবে। ওখানে নিশ্চয় কাজ পেয়ে যাবে। তা না হলে কুলিগিরি করবে। ওদের ঠিক চলে যাবে।

রাজু আজ বাড়ি গিয়ে গুরুদেব আর মা কে দেখতে পেল। গুরুদেবের দয়ায় মায়ের খাওয়া পরার অভাব নেই। মেয়ের বয়সী রাজুর মা। গুরুদেব   এই মেয়ের বয়সী অসহায় বিধবার সঙ্গে যে খারাপ দৃষ্টি দিতে পারে, এই ধারণা গ্রামের সরল মানুষের ছিল না। আর রাজুর দেখা সেদিনের ঘটনা একমাত্র শ্যামলী বিশ্বাস করে। আর কাকে বলবে সে। এই ঘটনার সঙ্গে যে মা জড়িত। মা যদি লজ্জায় গলায় দড়ি দিয়ে বসে তাহলে রাজু তো মাতৃহারা হবে। তাই নিজের পায়ে কোপ রাজু মারতে চায় না। নিজের মত করে পরবর্তী জীবন সে আনন্দে কাটাতে চায়।

হঠাৎ একদিন গুরুদেব রাজুকে কাছে বসালেন। বললেন, তুই নিজেকে খুব চালাক মনে করিস নয়?  রাজুর মা বললেন, কেন কি করেছে রাজু?
গুরুদেব বললেন, তোমার ছেলে হাড়িদের মেয়ের সঙ্গে ঘোরে।মাখামাখি করে। ওদের পাড়ার অনেকে দেখেছে। আমাকে বলেছে। রাজু বলল, হ্যাঁ, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।
গুরুদেব বললেন, আমি হতে দেব না। তুই বামুনদের ছেলে। সমাজ মানবি তো হতভাগা। রাজু বলল, আপনার মুখোশপরা সমাজ আমি মানি না। আমি জাতপাত মানি না। এই বিয়ে হবেই। কোনো শক্তি এই বিয়ে আটকাতে পারবে না। প্রয়োজনে প্রাণ দিয়ে দেব।
রাজুর মা চিৎকার করে বললেন, কাকে কি
বলছিস   তুই?  এই বিয়ে হলে আমার মরা মুখ দেখবি। আমি গলায় দড়ি দেব।
গুরুদেব বললেন, ছি ছি রাজু। মায়ের কথা চিন্তা না করে তুই দেহের কথা চিন্তা করছিস। ছি ছি।

রাজু মা কে বলল, মা হয়ে তুমি ছেলেকে সাজা দেবে?
রাজু ছুটতে ছুটতে নতুন পুকুরের পাড়ে গেল। রাজুর মা ও ছেলেকে ডাকছেন, রাজু ফিরে আয়। রাজু ফিরে আয়।

রাজু দূর থেকে দেখল শ্যামলী ছুটতে ছুটতে শিবলুন স্টেশনে যাচ্ছে। এখন তাকে কোনো বাধা আটকাতে পারবে না।

আজ তাদের পালিয়ে বিয়ে করার দিন। রাজু অবাক চোখে  দেখে, শ্যামলী খোলামাঠে হৃদয় মেলে আনন্দে  মেঘ হয়ে ভাসছে।
রাজু ভাবল, এই আনন্দ ম্লান হয়ে যেতে পারে না।সে ও হাওয়ায় উড়তে চায়।

রাজু  অসহায়  । সে ভেবে পাচ্ছে না কি করবে?  একদিকে শ্যামলী তার প্রাণের বাঁশি আর একদিকে মা, রাজুর শ্রেষ্ঠ  দেবী। 

গুরুদেবের সমস্ত মিথ্যা কথা রাজুর মনে পড়ছে। কবচ পরলে নিশ্চিতভাবে সকল কাজে সফল হওয়া যায়। পৈতে থাকলে সিদ্ধিলাভ হয়। কই রাজুর জীবন তাহলে ব্যর্থতায় ভরা কেন?  রাজু ভাবে, এইসবকিছু গুরুদেবের বানানো কথা। শাস্ত্র কখনও জাতিগত ভেদাভেদ করে নি। পৃথিবীর কোন ধর্ম কোন মানুষকে ছোট করে নি।শুধুমাত্র গুরুদেবের মত স্বার্থপর লোকেরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য  এইসব নিয়ম চালু রাখেন সমাজে। রাজু এই মুখোশ একা খুলতে পারবে    না। তবু নিজের জীবনে তো   নিজের ইচ্ছেমত থাকতে পারবে। সে মা কে বুঝিয়ে বলবে। মা নিশ্চয়ই বুঝবে। 

              রাজু অনেক আশা নিয়ে  পৈতে খুলে ফেলল। কবচ খুলে ফেলল। দুটো বিষফলের মত, কুসংস্কারের বোঝা   ছুঁড়ে ফেলে দিল পুকুরের জলে। আর কখনও বিষফল দুটো রাজুর ভাবনার বাধা হতে পারবে না। রাজুর মনটা হাল্কা হল।

তারপর দৃপ্ত পদক্ষেপে হাঁটা শুরু করল মানুষের মনের  কুসংস্কার মুছে ফেলার সংকল্প নিয়ে। 


                                                                                       

নিমার্ল্য ঘোষের রম্যগল্প : ভোট-রঙ্গ







নির্মাল্য ঘোষ
ভোট-রঙ্গ

উত্তেজনায় রাত্রিতে ঘুমই আসল না। সরকারী চাকুরী জীবনে প্রথম ভোটের ডিউটি এসেছে- তাও আবার লোকসভা নির্বাচনে।  ফার্স্ট পোলিং অফিসার। আগামীকাল ট্রেনিং হবে। জলপাইগুড়ি ফনীন্দ্র দেব বিদ্যালয়ে। এতদিন ভোট দিয়ে এসেছি -এবার ভোট নিতে যাওয়া- ভাবা যায়? দেশের গণতন্ত্র রক্ষার কাণ্ডারী নির্বাচন প্রক্রিয়ার আমিও একজন অফিসিয়াল কর্মী – ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয় যেন। দু চাকার বাইক নিয়ে যখনি রাস্তায় বের হচ্ছি, মনে হচ্ছে যেন লাল বাতি লাগান চার চাকা গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি – অদ্ভুত একটা অনুভূতি।
যা হোক, প্রথম ট্রেনিং দুর্দান্ত লাগল। নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন খুঁটি নাটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শেখান হল। আমি হাঁ করে শুনে গেলাম বক্তব্য। বিবিধ ফর্ম কিভাবে ভর্তি করতে হবে, ইভিম মেশিন কিভাবে চালাতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।   ট্রেনিং এর সময় দেওয়া শুধু মাত্র লাল এক কাপ চা খেয়ে মনে হল প্যারিসে বসে রেড ওয়াইন খাচ্ছি যেন। সব কিছুতেই একটা ভীষণ রকম ভালো লাগা। কি অদ্ভুত!
এরপর দ্বিতীয় ট্রেনিং। জলপাইগুড়ির গর্বের আর্ট  গ্যালারীতে । এদিন আবার পোলিং টীমের সঙ্গেও দেখা হওয়ার দিন। নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দেখলাম প্রিসাইডিং অফিসার, ফার্স্ট পোলিং, সেকেণ্ড পোলিং, থার্ড পোলিং অফিসার সবাই বসে আছেন। প্রিসাইডিং অফিসার বেশ রাশভারী – বছর পঞ্চাশেক বয়স ; সেকেণ্ড পোলিং অফিসার একটি ছোকরা মত ছেলে – টি শার্ট পরে বসে আছে আর পান চিবুচ্ছে – টেরিকাটা চুল; থার্ড পোলিং অফিসার ঘাটের মরা যেন – রোগা হ্যাংলা, সব চুল শাদা – দেখে মনে হয় বয়স খুব কম করেও সত্তর হবে – অথচ এখনো চাকুরি করছে কি করে? ভাবতে ভাবতে ট্রেনিং শুরু হয়ে গেল।
ট্রেনিং শেষে প্রাপ্তি হল একখানি ভোট পরিচালনার গাইড বই – টীমের আর কেউ না, শুধু প্রিসাইডিং অফিসার আর আমি পেলাম। গর্বে বুক ফুলে গেল। প্রিসাইডিং অফিসার বললেন –“ ভালো করে পড়বেন, আমার অবর্তমানে তো আপনাকেই ভোট পরিচালনার দ্বায়িত্ব নিতে হবে…”
“ কেন, আপনি ভোটের সময় বর্তমান থাকবেন না?” আমার অবাক প্রশ্ন।
প্রিসাইডিং অফিসার আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে গট মট করে হাঁটা দিলেন। আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম।  যা হোক, নিজেকে শান্ত করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
ভোটের আগের দিন আমরা জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ডি সি আর সি তে মিলিত হলাম। ডি কোডিং এর পর জানা গেল আমাদের বুথ পড়েছে ধুপগুড়ির গাদং এ। কাছাকাছি হওয়াতে আমরা একটু খুশী হলাম- জলপাইগুড়ি থেকে মাত্র পঞ্চান্ন কিলোমিটার।  প্রিসাইডিং অফিসার চলে গেলেন মোবাইল ফোন নম্বর রেজিস্ট্রেশন করাতে।  লম্বা লাইন – উনি রেজিস্ট্রেশন করিয়ে আসলে তারপর আমরা যাব ভোটের মালপত্তর সংগ্রহ করতে। আমরা একটু ছায়াতে গিয়ে বসলাম। ছোকরা থার্ড পোলিং অফিসার ছেলেটিকে দেখলাম একটি সুন্দরী মহিলা পুলিসের সঙ্গে দিব্বি ভাব জমিয়ে আড্ডা মারছে – ভোটের ডিউটি নিয়ে তার যেন কোনো তাপ উত্তাপই নেই। আর ফোর্থ পোলিং দাদুকে দেখলুম এক টিপ নস্যি বের করে আরাম করে নাকে গুঁজে চোখমুখ লাল করে একটা পেল্লায় হাঁচি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। আমি বেচারা এক কাপ লাল চা নিয়ে চুমুক লাগাতে থাকলাম।
বেশ কিছুক্ষণ পরে মোবাইল রেজিস্ট্রেশন করিয়ে প্রিসাইডিং অফিসার ফিরে আসলেন। আমরা চললাম ভোটের মালপত্তর সংগ্রহের নির্দিষ্ট লাইনের দিকে। হঠাৎই একদল লোক ছুটে এল হৈ হৈ রৈ রৈ করে – ঘিরে ফেলল আমাদের। লোকগুলোকে দেখে ভদ্রলোকই মনে হল। সঙ্গে চারজন পুলিশকেও দেখলাম। ওদের মধ্য থেকে একজন আমাদের প্রি সা ই ডিং অফিসারের দিকে তেড়ে এল। চীৎকার করে বলে উঠল :
“আমার মানি ব্যাগ টা তাড়াতাড়ি বের করুন…”
“ আপনার মানিব্যাগ তো আমার কাছে নেই…. আমি কোত্থেকে বের করব?” প্রিসাইডিং অফিসার বিস্মিত, সঙ্গে আমরাও…
“ বেশী চালাকি করার চেষ্টা করবেন না…. ফল খারাপ হবে…বের করুন তাড়াতাড়ি….” সঙ্গের লোকজনও ভদ্রলোককে সঙ্গ দিল সমস্বরে।
“আমি চালাকি করছি না…. আপনারা করছেন…” প্রিসাইডিং ভ্রু কুঞ্চিত করে উত্তর দিল।
“ তবে রে শালা…তোর একদিন কি আমার একদিন আজকে…” ভদ্রলোক তেড়ে আসল প্রিসাইডিং অফিসারের দিকে…অন্যরা কোনোমতে আটকাল, কিন্তু তারাও প্রিসাইডিংকে গালাগালি করতে থাকল। আমরা হতভম্ব – কিছুই বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ দুই পক্ষের বাদানুবাদ শুনে কিছু জিনিস পরিষ্কার হল, সেটা এরকম :
রেগে যাওয়া ভদ্রলোকও প্রিসাইডিং অফিসার – মোবাইল রেজিস্ট্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন আমাদের প্রিসাইডিং অফিসার । হঠাৎ ভদ্রলোক খেয়াল করেন তার পকেটের টাকা ভর্তি মানি ব্যাগটি উধাও। চারিদিকে খোঁজ খোঁজ…শেষে পুলিশের সাহায্যে সি সি টিভি ফুটেজে দেখা যায় যে ভদ্রলোকের পকেট থেকে কোনোভাবে মানি ব্যাগটি পড়ে যায় আর সেটি দেখে ফেলেন পিছনে দাঁড়ান আমাদের প্রিসাইডিং অফিসার। কিন্তু সবাইকে অবাক করে ফুটেজে দেখা যায় যে উনি ব্যাগটি ফেরত না দিয়ে নিজের পকেটে পুরে নেন। ভদ্রলোকের খেয়াল হয় যে আমাদের প্রিসাইডিং অফিসার ওনার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন –দুজনের মধ্যে কথাও হয়েছিল -তাই চিনতে অসুবিধে হয়নি - উনি পুলিশের সাহায্য নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে পাকড়াও করেছেন আমাদের প্রিসাইডিং অফিসারকে।
এবার পুলিশের একজন এসে কলার ধরলেন আমাদের প্রিসাইডিং অফিসারের –“ বের করুন ব্যাগটা না হলে কিন্তু…..”
আমাদের প্রিসাইডিং অফিসার এবার ধীরে ধীরে মাঠের মধ্যে বসে পড়লেন।  মাথা নীচু করে নিজের এট্যাচি ব্যাগ টা খুললেন আস্তে আস্তে – তারপরে আমাদের অবাক করে দিয়ে টাকা ভর্তি একটি মানি ব্যাগ বের করে এগিয়ে  দিলেন ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোক চীৎকার করে উঠলেন : “ এই তো…এই তো আমার মানি ব্যাগ…শালা চোর, ছোটো লোক, আবার ভদ্রলোকের পোষাক পরেছে….”
চোর প্রিসাইডিং অফিসার মাথা নীচু করে বসে থাকলেন। লোকজন গালাগালি দিতে দিতে ফিরে গেল।  সেক্টর অফিসার আমাকে এসে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন- “ যা বুঝতে পারছি, বাস্তবে হয়ত আপনাকেই প্রিসাইডিং অফিসারের দ্বায়িত্ব পালন করতে হবে…উনি নাম কে ওয়াস্তা থাকবেন।“  আমি ঢোঁক গিলে একটা কাষ্ঠ হাসি হাসলাম। বাস্তবেও সেবার আমাকেই প্রিসাইডিং অফিসারের সব কাজ করতে হয়েছিল যদিও উনি সঙ্গেই ছিলেন, কিন্তু সেক্টর ওনাকে আর বিশ্বাস করতে পারেননি।
যদিও এ ঘটনা বহু বছর আগের, কিন্তু আমার প্রথম ভোটের ডিউটির এই ভোটরঙ্গ আমার স্মৃতি পটে চির মুদ্রিত হয়ে আছে – ভোটের আমোচনীয় কালির মতই। সত্যি কত ধরণের লোক আছে এই পৃথিবীতে – ভাবলে অবাক লাগে।
                                                 

শুভাশিস দাশের অণুগল্প : অভিশাপ





শুভাশিস দাশ
অভিশাপ

ভোর চারটে কুড়ির বামনহাট শিলিগুড়ি প্যাসেঞ্জার ট্রেনে উঠেই বাবার কথা মনে পড়ে গেলো বিভাসের ।
স্কুল পড়বার সময় বাবা একদিন খেতে বসে ওপার থেকে ছেড়ে আসার গল্প করছিলেন । বাপ ঠাকুরদার
চোদ্দ পুরুষের ভিটে ছেড়ে এপারে এই বামনহাটে চলে আসার গল্প । ঊনিশশ পঁয়শটটি সালের পাক ভারত
যুদ্ধের পর আর সেখানে থাকেন নি বাবা । তখন বড়দা কোলে ।
বামনহাট থেকে লালমনিরহাট খুব বেশি দূরে নয় । দূরত্বটা শুধু মাঝে দুদেশের সীমান্ত !
বিভাসদের দেশের বাড়ি ছিল ওপারের লালমনিরহাট রেল জংশনের পাশে । অবশ্য বিভাস সেসব কিছুই দেখে নি । বামনহাট হাইস্কুলে যখন সে ক্লাশ নাইনে পড়ত তখন একদিন তার এক নিকট আত্মীয়ের সাথে
লালমনিরহাট ঘুরে এসেছিল । তখন অবশ্য ওদের বাপ ঠাকুরদার বাড়ির জায়গা রেলের দখলে চলে গিয়েছে ।
তবুও একবার দেখে এসেছে তাতেই শান্তি ।
ট্রেন হুইসেল দিয়ে ছেড়ে দিলো । এই বামনহাটও জংশন । অবিভক্ত ভারতে এই রেলপথ ছিল জমজমাট ।
দিনহাটার রাষ্ট্রীয় কোন ব্যাংক আধার কার্ড করছে । সকাল সকাল লাইনে না দাঁড়ালে হবে না তাই এই
সাত সকালে গিয়ে ধর্না দিতে হবে । বিভাসের কামরায় আরো অনেকেই উঠেছে দিনহাটাতে গিয়ে ব্যাংকে
লাইনে দাঁড়ানোর জন্য । মকবুল মাস্টারও উঠেছে । গাঁয়ের পরিচিত মানুষ । তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটে এই বামনহাটে । বিভাসকে দেখে কাছে এসে ওর পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো কিরে এত সকালে ? আধার কার্ড ?
হ্যা কাকা ! লাইনে দাঁড়াতে যাচ্ছি । তুমি ? বিভাস বলে ।
আমার একটু বিডিও অফিসে যেতে হবে রে , নাতিটার ডিজিটাল রেশন কার্ড এখনো হয় নি ।
আর বলিস কেন ! কী যে চলছে ! একটার পর একটা ফেকরা লেগেই আছে ।
তবে লাকিলি বাবার জমির দলিলের একটা অংশ পেয়েছি অন্তত দেশটা হয়তো ছাড়াতে পারবে না ।
আচ্ছা বল তো এই যে দেশ টা এখানে আমরা সবাই তো মিলে মিশে আছি । হঠাৎ কেমন করে সব ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে না ? আরে বাবা অনুপ্রবেশ ? ঠেকাও না ! তোমাদের তো বর্ডারে কাঁটাতার আছে , আছে সীমান্ত রক্ষী !
ভোরের গাড়ি তাই এদিক থেকে সঠিক সময়েই যায় । মকবুল কাকার সাথে কথা বলতে বলতে গাড়ি দিনহাটা
স্টেশনে ঢুকে পড়ল । গাড়ি থেকে নেমে বিভাস একটা সিটি রিকশা নিয়ে সোজা ইউনিয়ন ব্যাংকে গেলো ।
বিভাস যখন সেখানে পৌঁছল তখন দশ জনের লাইন হয়ে গেছে । দু একজন বয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়ে । আর লাইনে
কাগজে নাম লিখে ইটে চাপা দেয়া । বিভাস এগারো নম্বরের সিরিয়ালে রইল । পাশের বয়স্ক মানুষটিকে জিজ্ঞেস করলো বাড়ি কোথায় ? তিনি বললেন কূর্সাহাট । সেখান থেকে রাত তিনটের সময় সাইকেলে চেপে রওনা দিয়েছেন ।
কী আর করা যাবে বলো ? বৃদ্ধ বললেন । আমাদের সব থেকেও কিছু নেই । সব অদৃষ্ট !
আসলে এটা অভিশাপ , বুঝলে ? এটা অভিশাপ ! নইলে এক জীবনে কত বার প্রমাণ দিতে হবে ?
সূর্যের আলো ফুটছে । বিভাসের মনে হলো এবার বুঝি সব আঁধার কেটে যাবে । তবু কোথাও একটা অজানা আতংক তাড়া করছে সবসময় ।

বিজয়া দেবের গল্প : স্বপ্নকথা




বিজয়া দেব
স্বপ্নকথা
             

শীতের রাতে বর্ষা রাতের স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেল কথার। কী কালো মেঘ! কী ঝড়! কী বিদ্যুৎ চমকানো! আর বিদ্যুতের ঝলকানিতে একটা মুখ ঝলসে উঠছিল- সে মুখটা সে কখনও দেখে নি। মাথায় একঢাল চুল, কপালে বড়সড় টিপ আর পরনে ধূসর শাড়ি। চেহারাটা এখনও স্পষ্ট প্রকট হয়ে আছে। অচেনা মানুষ স্বপ্নে আসে যখন, তখন বেশ কৌতূহল হয়। মানুষটাকে ভালো করে চিনে নিতে মন যায়। রাস্তার চলমান মানুষের সাথে ঐ মুখের মিল খুঁজে নিতে ইচ্ছে যায়।
  তাই হল কথার আজ। কলেজ থেকে ফিরে মার সাথে পার্কে গেল আর খোশগল্পে ব্যস্ত কিছু মহিলার মাঝে স্বপ্নে দেখা মানুষটির মিল খুঁজে বেড়াতে লাগল এবং বেশ আশ্চর্যের মতই হঠাৎ করে একখণ্ড কালো মেঘ এই মাঘ মাসের শীতের বিকেলে আকাশে ধীরে ধীরে ডানা বিস্তার করতে শুরু করল। প্রকৃতির খেয়াল, রাতে এক পশলা বৃষ্টি হল, সাথে খানিকটা হাওয়া, একটু আধটু বিদ্যুৎ চমকাল –কিন্তু এই বলে স্বপ্নের মহিলাকে খুঁজে পেল না কথা।
  পরদিন ঐ স্বপ্নের মহিলার চেহারার আদল খানিকটা ফিকে হয়ে গেল এবং আরও দুদিন পর তা মিলিয়েও গেল।
  স্বপ্ন স্বপ্নই হয়। বাস্তবের সাথে তার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। স্বপ্নে অপূর্ণতা থাকে, তারা খণ্ড, ছায়াময়, নিরন্তর কিন্তু অস্পষ্ট। আবার চমৎকার মুহূর্তগুলোকে মানুষ স্বপ্ন বলে আখ্যা দিয়ে থাকে। যেমন রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-‘ স্বপনে দোঁহে ছিনু কী মোহে যাবার বেলা হল’, যখন দোঁহে মোহে ছিল তখন ছিল স্বপনে আর যাবার বেলায় অবশ্যই স্বপ্নভঙ্গ। অর্থাৎ চমৎকার মুহূর্তগুলোই স্বপ্ন। আর মানুষ খুব আনন্দে, ভালোতে বেঁচে থাকতে চায়, তাই সে স্বপ্নেই বেঁচে থাকে।
  কথা এক নিরালা বিকেলে ভাবল স্বপ্নেরা আসলে দলবেঁধে আসে আবার দলবেঁধে চলেও যায়। যাবার পর হেমন্তের ফসল তুলে নেওয়া ধূ ধূ মাঠের মত মনটা স্বপ্নহীন পড়ে থাকে। তখন দিনগুলোতে দৈনন্দিনতা ছাড়া কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না।
   পরদিন সকালবেলা ঘুম উঠেই দরজা খুলে দেখল কথা এক রুখুসুখু ভিখারিনি দোরে দাঁড়িয়ে। পরনে ময়লা শাড়ি, গায়ে ছেঁড়া কম্বল, কপালে একখানা বড়সড় উজ্জ্বল টিপ। গোটা অবয়বের সাথে টিপটা খুব বেমানান। চেহারাটা চেনা চেনা, কোথাও যেন দেখা গেছে। কিন্তু কোথায়?
   ভিখারিনি চলে গেল। তার দেহের দুর্গন্ধ ও চুলের জট একটা বিপরীত আবহ তৈরি করলেও কথার মনে হল যেন কোত্থেকে পেঁজা তুলোর মত সাদা মেঘের দল তাকে ঘিরে ফেলছে। যেন মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে হাজারও নক্ষত্রের ফুলকি, যেন বনবাদাড় ভেদ করে তীব্রগতিতে ছুটে চলেছে যূথবদ্ধ হরিণী। সময়টাকে ঠিক চিনে নিতে না পারলেও হঠাৎ করেই অভিমন্যু সেনকে একটা ফোন করল কথা।  অভিমন্যু সেন তার জীবনে এসেছিল ভালবাসার প্রতীক হয়ে। ভালবাসাবাসি হয়নি কখনও, তবু পরিচয় প্রসঙ্গের আড়ালে এক ক্ষীণ ভালবাসার স্রোত তিরতির করে বয়ে যেত, প্রতীকী প্রেমের মতই। অভিমন্যু সেন ফোন পেয়ে যেন একটু অবাকই হল। তবে কণ্ঠের আবেশময়তা বুঝিয়ে দিল সেই সংকেতধর্মী প্রেম মরে যায়নি আজও। কথা অভিমন্যুকে জিজ্ঞেস করল- কেমন আছেন?-অভিমন্যু সেন বলল- এতদিন পর? মনে পড়ল আমায়? ভাবছিলাম বুঝি ভুলেই গেছেন! – শুনে একটু অবাক হল কথা। অভিমন্যু ভুলে যায়নি তাহলে! অনেকদিন ত দেখা নেই। ফোনটোন হয়নি। তবু সে বেঁচে আছে অভিমন্যুর মনে, এটাই আশ্চর্যের। নাহলে সময়টা পেঁজা তুলোর মত, আসছে সরে যাচ্ছে। বৃহৎ বলে কিছুই আর নেই। বড্ড সাময়িক। অভিমন্যু বলল-একদিন আসবেন? গল্প হবে।
কথা বলল- যেতে পারি।
-হ্যাঁ আসুন, কতদিন হল আপনার মুখোমুখি হই নি।
-আসব।
-অনেকদিন পর আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরবে, গাছপালা সজীব হবে।
কথা একটু শব্দ করে হাসল। বলল- বিদ্যুৎ চমকাবে, তবে ঝড় হবে না।
অভিমন্যু একটু ভেবে নিয়ে বলল- প্রকৃতির আগাম বার্তা আবহবিদদেরও ভুল হয় কথা। ও কথা থাক। তাহলে বলুন কবে?
-যেদিন আমার ফুলবাগানে হাস্নুহানা ফুটবে সেদিন।
- কুঁড়ি এসেছে?
-হ্যাঁ।
- বেশ। আমি অপেক্ষায় রইলাম।
তারপরের দিন পার্কে সেই ভিখারিনির দেখা পেল কথা। আজও তার কপালে পূর্ণিমার চাঁদের মত গোলাকার টিপ,আর একঢাল চুল, পরনে সেই দুর্গন্ধ ছেঁড়া শাড়ি। কথা ভাবল সামনের দিনে পার্কে একখানা নতুন শাড়ি নিয়ে আসবে সাথে শীতের আচ্ছাদনি।
  সময় কীভাবে কেটে যায়! হাসনুহানা ফুটল, ফুলের গন্ধে ম ম করছিল চারপাশ কিন্তু অভিমন্যু সেনের সাথে দেখা হল না কথার। কথাকে চলে যেতে হয়েছিল রাখুকাকার বাড়ি।  রাখুকাকা তখন খুব অসুস্থ, বিছানায় শোয়া,নিদারুণ শ্বাসকষ্ট, কষ্টে দিনযাপন চলছিল। সেই ভিখারিণিকে শাড়ি ও চাদর দেওয়া হল না। সব ফুরিয়ে গেল হঠাৎই। রাখুকাকা জীবনের মায়া কাটিয়ে চলে গেল। স্নেহের একটি বড় জায়গা হঠাৎই সরে গেল। মা খুব কাঁদল। কথার পিতৃহীন জীবনে ও কথার মার স্বামীহীন জীবনে রাখুকাকা অনেক জায়গা জুড়ে ছিল। রাখুকাকা কথার বাবার খুব কাছের মানুষ ছিল। রক্তের সম্পর্কে তাদের কেউ নয়, অথচ খুব কাছের, যেন রবীন্দ্রনাথের সেই প্রাণের মানুষ’ টি। রাখুকাকা তাকে ঘুড়ি ওড়াতে শিখিয়েছিল। মনে পড়ে মা বলেছিল- তুমি বড় পাগল রাখু, কথাকে শেখাচ্ছ ঘুড়ি ওড়াতে? মেয়েরা কী কখনও তেমন করে ঘুড়ি ওড়ায়? – রাখুকাকা হেসে বলেছিল – তুমি আরো বড় পাগল বৌদি। স্বাধীনতার সুখে ছেলেমেয়ে করছ! – বলে রাখুকাকার কী হাসি! মা খুব লজ্জা পেয়ে গেছিল। কথাও খুব হেসেছিল। হাসবে না? ঘুড়ি ওড়াতে গেছে তার আবার ছেলেমেয়ে!
 রাখুকাকার মৃত্যুটা যেন হঠাৎই এল। কথা ভাবতেও পারেনি রাখুকাকা এভাবে চলে যাবে। রাখুকাকার শেষযাত্রার পর কথা দেখল আকাশবাতাস জুড়ে সাদা রঙের ছড়াছড়ি। চারপাস যেন বরফের মত সাদা হয়ে গেছে। গাছপালা, মাটিজমি, নদীনালা, পথপ্রান্তর সবই যেন সাদা, সবই যেন একরঙা। কোথাও কিছু নেই, কতগুলো শুকনো বটপাতার ওপর পা মড়মড়িয়ে চলে গেলে যে ধ্বনির দ্যোতনা হয় , তাও যেন নেই। এরকম নিবিড় শূন্যতা তাকে জড়িয়ে রেখেছিল মাস দুই। তারপর সজীব চঞ্চল জীবন তাকে ফিরিয়ে আনল রঙে, উষ্ণতায়। কিন্তু কেন কে জানে হাসনুহানা গাছটা শুকিয়ে উঠল একদিন। মা বলল গাছে পোকা ধরেছিল। এরকম সময়ে একদিন মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল, মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল অভিমন্যু সেন। ফোন তুলতেই অভিমন্যু বলল –ওহো কথা! তোমাকে ফোন করি নি। ভুল করে তোমার নং এ লেগে গেছে। স্যরি কথা, ডোন্ট মাইন্ড! ভালো আছো ত? হাসনুহানা আর ফুটলই না?
-ফুটেছিল। ঝরে গেল তাড়াতাড়ি। হাসনুহানা গাছটা আর নেই।
-তাই নাকি? আপনি যত্ন করলে গাছটা ঠিক বেঁচে যেত কথা।
-যত্ন করিনি বলছেন?
- সেভাবে হয়ত করেননি।
ফোনটা কেটে গেল।
এদিকে মা শুধু স্মৃতিচারণ করে। সময় চলে গেলে সোনালি হয়ে যায়। গোল্ডেন টাইম। নদী, নৌকো, দু’পাশে ছড়ানো গ্রামীন জীবন –যেন পটে আঁকা ছবি। স্মৃতি খানিকটা এমনি। রাত হলে মা শচীন দেববর্মণ শোনে-মন দিল না বঁধু/মন নিল যে শুধু, শোনো গো দখিন হাওয়া / প্রেম করেছি আমি। নিজেও সাথে গুনগুন করে গান গায়। টুকরো টুকরো জীবন ছড়ানো চারপাশে- তার থেকে মা যেন খণ্ড খণ্ড অংশ তুলে নেয়। স্বপ্নময় অতীত। কথা বোঝে। মা নিজেকে সোনালি স্বপ্নের সাথে মিশিয়ে দিয়ে বাঁচতে চায়।
  একদিন হঠাৎই কলেজ করিডরে অভিমন্যুকে দেখা গেল। কলেজে এসেছে সে। তবে কথার সাথে দেখা করতে নয়। কথা ক্লাস নিচ্ছিল বি,এ ফার্স্ট ইয়ার এ। টেনিসনের কবিতা। তিন-চারটে মেয়ে সেকেন্ড বেঞ্চে ফুসুর ফুসুর করছিল। মেয়ে দুটোকে সাবধান করতে যাবে, হঠাৎ লম্বা করিডরে চোখ পড়ল। অভিমন্যু। তাকে দেখেছে কি? বোধহয় না। বোটানির অধ্যাপক অরণ্যের সাথে কথা বলতে বলতে পেরিয়ে গেল করিডরের দৃশ্যমান অংশটুকু। একটু আনমনা হয়ে পড়ল কথা। এবার সেকেন্ড বেঞ্চের মেয়েগুলো ফুসুর ফুসুর থামিয়ে তাকেই পর্যবেক্ষণ করছে। বেশ কৌতূহলী দৃষ্টি তাদের। কেন? ওদের কথা বলা থেমে গেল কেন? তার মুখে কি আলোছায়া খেলল? সেটা চোখে পড়ল বুঝি মেয়েগুলির?


সুবীর ঘোষের অণুগল্প : ব্যক্তিগত




সুবীর ঘোষ
ব্যক্তিগত


বাসুদেবদা লেকটাউনে থাকতেন । মাসে একবার সকালের দিকে গিয়ে আড্ডা দিয়ে আসতাম । সেবার খুব রোদ ছিল । জুন মাস । মনসাতলায় নেমে একটা রিক্সা নিয়েছি । বললাম--- জ্যোতি মিল চল । ওখানে নেমে বাসুদেবদার বাড়ি হাঁটা পথ । রিক্সা যাচ্ছে যাচ্ছে । জ্যোতিমিলের রাস্তায় না ঘুরে এগিয়ে চলল । ভাবলাম অন্য রাস্তায় যাবে বোধ হয় । কিছুটা গিয়ে কেমন জলাজংলা আসতে লাগল । চালককে জিজ্ঞেস করলাম-- এদিকে কোথায় যাচ্ছ ? সে বলল-- আপনি তো দক্ষিণদাঁড়ি যাবেন বললেন । নামুন , এসে গেছে । আমি বললাম --আমি তো দক্ষিণদাঁড়ি বলিনি , বলেছিলাম --- জ্যোতি মিল। রিক্সাওয়ালা কিছুতেই মানতে রাজি নয় । না আমার ভুল হতেই পারে না । আমি বহুদিন  রিক্সা চালাচ্ছি । আপনি  দক্ষিণদাঁড়িই বলেছিলেন । কী ফ্যাসাদে পড়া গেল । আমাদের কথোপকথন তো আর রেকর্ড করা নেই । আমি যত বলি আমি  জ্যোতি মিল বলেছিলাম সে বলে আপনি  দক্ষিণদাঁড়ি বলেছিলেন । দেখলাম মাথা গরম করে লাভ হবে না । ওকে বললাম --দেখ ভাই যদি আমি  দক্ষিণদাঁড়ি বলতাম , তা হলে এখন তো  দক্ষিণদাঁড়ি পৌঁছে গেছ , তাহলে আমি তো নেমে যেতাম । লোকটি দেখলাম যুক্তি ব্যাপারটাই বোঝে না । সে বলল-- সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার । গন্তব্যে এসে না নামার মধ্যে কী ব্যক্তিগত ব্যাপার থাকতে পারে সেটা আমার মাথায় ঢুকল না । আমি বললাম --দেখ আমার এখানে কোনো কাজ নেই । এখানে আমি নামবও না । তুমি রিক্সা ঘুরিয়ে  জ্যোতি মিলে নিয়ে গিয়ে আমাকে ছেড়ে দাও ।  রিক্সাওয়ালা এবার বলল --আমাকে দু জায়গায় যেতে হবে ।  ভাড়া বেশি লাগবে । আমি তখন একটু রূঢ় স্বরেই বললাম ---এইটাই তাহলে তোমার উদ্দেশ্য । অকারণ ঘুরিয়ে বেশি পয়সা আদায় করা ? লোকটা গজগজ করতে করতে রিক্সা ঘোরাল । বিড়বিড় করে বলতে থাকল-- আমি চিটিংবাজ নই । আমি ঠিক জায়গাতেই মানুষকে নামাই । কারোর ব্যক্তিগত ব্যাপার থাকলে আমার কী করার আছে !

এবারও আমি বুঝলাম না ভুল গন্তব্যে না নামার সঙ্গে  ব্যক্তিগত শব্দটার যোগ কোথায় । তবে আমি কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলাম । কিছুক্ষণ পর  জ্যোতি মিল এসে গেল । আমি রিক্সা থেকে নেমে  জিজ্ঞেস করলাম--কত ? রিক্সাওয়ালা কোনো কথা না বলে এবং ভাড়ার টাকা না নিয়েই রিক্সা ঘুরিয়ে চলে গেল । আমি বোকার মতো বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম যদি সে ফেরে । না সে আর ফেরেনি । সেটাও তার   ব্যক্তিগত ব্যাপার বোধ হয় ।